কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্থ পরিচ্ছেদ

গোয়ালিণী

এইরূপে কিছুদিন যায়। এখন একদিন এক গোয়ালিনী নদীতে স্নান করিতে আসিয়াছিল। স্নান করিতে করিতে তাহার পায়ে সেই ঝিনুকটি ঠেকিল। ডুব দিয়া সে সেই ঝিনুকটি তুলিল। দেখিল যে চমৎকার ঝিনুক। ঝিনুকটি সে বাড়ী লইয়া গেল। আর আপনার চালের বাতায় গুঁজিয়া রাখিল।

বাহিরের দ্বারে কুলুপ দিয়া গোয়ালিনী প্রতিদিন লোকের বাড়ী দুধ দিতে যায়। কঙ্কাবতী সেই সময় ঝিনুকের ভিতর হইতে বাহির হয়। প্রথম দিন ঝিনুকের ভিতর হইতে বাহির হইয়া যেমন সে মাটিতে পা দিল, আর তাহার রাজবেশ গিয়া একেবারে পূর্ববৎ বেশ হইল। কঙ্কাবতী তাহা দেখিয়া বড়ই আশ্চর্য হইল। প্রতিদিন ঝিনুকের ভিতর হইতে বাহির হইয়া কঙ্কাবতী গোয়ালিনীর সমুদয় কাজ-কর্ম সারিয়া রাখেন। ঘর-দ্বার পরিষ্কার করেন, বাসন-কোসন মাজেন, ভাত ব্যঞ্জন রাঁধেন, আপনি খান আর গোয়ালিনীর জন্য ভাত বাড়িয়া রাখেন।বাড়ী আসিয়া সেইসব দেখিয়া গোয়ালিনী বড়ই আশ্চর্য হয়। গোয়ালিনী মনে করে, “এমন করিয়া সমুদয় কাজকর্ম কে করে? দ্বারে যেরূপ চাবি দিয়া যাই, সেইরূপ চাবি দেওয়াই থাকে। বাহির হইতে বাড়ীর ভিতর কেহ আসে নাই। তবে এসব কাজকর্ম করে কে?”

ভাবিয়া চিন্তিয়া গোয়ালিনী কিছুই স্থির করিতে পারে না। এইরূপ প্রতিদিন হইতে লাগিল।

অবশেষে গোয়ালিনী ভাবিল, আমাকে ধরিতে হইবে। প্রতিদিন যে আমার কাজকর্ম সারিয়া রাখে তারে ধরিতে হইবে।এইরূপ মনে মনে স্থির করিয়া, গোয়ালিনী তার পরদিন সকাল সকাল বাটী ফিরিয়া আসিল। নিঃশব্দে, অতি ধীরে ধীরে দ্বারটি খুলিয়া দেখে যে, বাটীর ভিতর এক পরমাসুন্দরী বালিকা বসিয়া বাসন মাজিতেছে।

গোয়ালিনীকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি কঙ্কাবতী যেই ঝিনুকের ভিতর লুকাইতে গেল, আর সে গিয়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। ধরিয়া দেখে না কঙ্কাবতী।

আশ্চর্য হইয়া গোয়ালিনী জিজ্ঞাসা করিল, “কঙ্কাবতী,তুমি এখানে? তুমি এখানে কি করিয়া আসিলে? তুমি না নদীর জলে ডুবিয়া গিয়াছিলে?”কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “হাঁ মাসী, আমি কঙ্কাবতী। আমি নদীর জলে ডুবিয়া গিয়াছিলাম। নদীতে আমি ওই ঝিনুকটির ভিতর ছিলাম। ঝিনুকটি আনিয়া তুমি চালের বাতায় রাখিয়াছ। তাই মাসী, আমি তোমার বাড়ী আসিয়াছি।”

গোয়ালিনী এখন সকল কথা বুঝিল। আশ্চর্য হইবার আর কোনও কারণ রহিল না।

কঙ্কাবতী পুনরায় বলিল “মাসী, আমি যে এখানে আছি, সে কথা এখন তুমি আমার বাড়ীতে বলিও না। শুধু হাতে বাড়ী গেলে বাবা হয় তো বকিবেন। জলের ভিতর আমি অনেক টাকা দেখিয়াছি। তাহারা দরজীকে দিল, কিন্তু আমাকে দিল না। আমি কত কাঁদিলাম কাটিলাম, তবুও তাহারা আমাকে দিল না। দেখি, যদি তাহারা আমাকে কিছু দেয়, তাহা হইলে বাবাকে দিব, বাবা তাহা হইলে বকিবেন না, দাদা গালি দিবেন না।গোয়ালিনী বলিল, “বাছা রে আমার, জনার্দন চৌধুরীকে এই সোনার বাছা বেচিতে চায়! পোড়ারমুখো বাপ! রও, এইবার দেখা হইলে হয়, গালি দিয়া ভুত ছাড়াইব।”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “না মাসী, বাবাকে গালি দিও না, জান তো মাসী? বাবা দুঃখী মানুষ, ঘরে অনেকগুলি পুষ্যি। আমাকে না বেচিলে বাবা সংসার প্রতিপালন কি করিয়া করিবেন?”

এইরূপ কথাবার্তার পর স্থির হইল যে, কঙ্কাবতী এখন কিছুদিন গোয়ালিনীর ঘরে থাকিবে।কঙ্কাবতী বলিল, “মাসী, প্রতিদিন তুমি পাড়ায় যাও। গ্রামে যে দিন যে ঘটনা হয়, আমাকে আসিয়া বলিও।”

গোয়ালিনীর ঘরে কঙ্কাবতী বাস করিতে লাগিল। গ্রামে যে দিন যেখানে যাহা হয়, গোয়ালিনী আসিয়া তাহাকে বলে।

একদিন গোয়ালিনী আসিয়া বলিল, “আহা। খেতুর মার বড় অসুখ! খেতুর মা এবার বাঁচেন কি না।”

অতি কাতরভাবে, কাঁদ-কাঁদ হইয়া, কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে, মাসী? তাঁহার কি হইয়াছে?”গোয়ালিনী উত্তর করিল, “শুনিলাম, তাঁহার জ্বর-বিকার হইয়াছে। খেতু বৈদ্য ডাকিতে গিয়াছে, কিন্তু বৈদ্য আসে নাই। বৈদ্য বলিয়াছেন, তোমার বাটীতে চিকিৎসা করিতে গিয়া শেষে জাতিটি হারাইব না কি?”

কঙ্কাবতী বলিল, “মাসী, তিনি আমাকে বড় ভালবাসেন। আমার আপনার মা যেরূপ, তিনিও আমার সেইরূপ। তাঁহার অসময়ে আমি কিছু করিতে পারিলাম না, সেজন্য বড় দুঃখ মনে রহিল।”

এই বলিয়া কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিল।

তাহার পরদিন অতি প্রত্যুষে কঙ্কাবতী বলিল, “মাসী, আজ একটু সকাল সকাল তুমি পাড়ায় যাও। শীঘ্র ফিরিয়া আসিয়া আমাকে বল, তিনি কেমন আছেন।”গোয়ালিনী সকাল সকাল পাড়ায় গেল, সকাল সকাল ফিরিয়া আসিয়া কঙ্কাবতীকে বলিল, “আহা! বড় দুঃখের কথা। খেতুর মা নাই। খেতুর মা মারা গিয়াছেন। মাকে ঘাটে লইয়া যাইবার নিমিত্ত খেতু দ্বারে দ্বারে ঘুরিতেছে, কিন্তু কেহই আসিতেছে না। সকলেই বলিতেছে, তুমি ‘বরখ’ খাইয়াছ। তোমার জাতি গিয়াছে। তোমার মাকে ঘাটে লইয়া গেলে আমাদের জাতি যাইবে। ষাঁড়েশ্বর চক্রবর্তী, গোবর্ধন শিরোমণি, আর, কঙ্কাবতী, তোমার বাপ― এই তিনজনে সকলকে মানা করিয়া বেড়াইতেছেন, যেন কেহ না যায়।”

এই সংবাদ শুনিয়া কঙ্কাবতী একেবারে শুইয়া পড়িল। অবিশ্রান্ত কাঁদিতে লাগিল। গোয়ালিনী তাহাকে কত বুঝাইল। গোয়ালিনী কত বলিল, “কঙ্কাবতী, চুপ কর। কঙ্কাবতী, উঠ, খাও।” কঙ্কাবতী উঠল না, সে দিন রাঁধিল না। মাটিতে পড়িয়া কেবল কাঁদিতে লাগিল।সন্ধ্যাবেলা কঙ্কাবতী বলিল, “মাসী, তুমি আর একবার পাড়ায় যাও। দেখ গিয়া সেখানে কি হইতেছে। শীঘ্র আসিয়া আমাকে বল।”

গোয়ালিনী পুনরায় পাড়ায় গেল। একটু রাত্রি হইল, তবুও গোয়ালিনী ফিরিল না। একপ্রহর রাত্রি হইল, তবুও গোয়ালিনী ফিরিল না। মাটিতে শুইয়া পথপানে চাহিয়া কঙ্কাবতী কেবল কাঁদিতে লাগিল।

এক প্রহর রাত্রির পর গোয়ালিনী ফিরিয়া আসিল। গোয়ালিনী বলিল, কঙ্কাবতী, বড়ই দুঃখের কথা শুনিয়া আসিলাম। খেতুর মাকে লইয়া যাবার নিমিত্ত কেহই আসে নাই। খেতু করে কি? সন্ধ্যা হইলে কাঠ নিজে মাথায় করিয়া প্রথম ঘাটে রাখিয়া আসিল। আহা! একেবারে অতগুলি কাঠ লইয়া যাইতে পারবে কেন? তিনবার কাঠ লইয়া তাকে ঘাটে যাইতে হইয়াছে। সে এখন মাকে ঘাটে লইয়া যাইতেছে। একেলা নিজে কোলে করিয়া মাকে লইয়া যাইতেছে। মরিলে লোক ভারী হয়। তাতে শ্মশান ঘাট তো আর কম দূর নয়। খানিক দূর লইয়া যায়, তারপর আর পারে না। মাকে মাটিতে শয়ন করায়, একটু বিশ্রাম করিয়া পুনরায় লইয়া যায়। এইরূপ করিয়া সে এখন মাকে ঘাটে লইয়া যাইতেছে। অন্ধকার রাত্রি। একটু দূরে দূরে থাকিয়া আমি এই সব দেখিয়া আসলাম।এই কথা শুনিয়া কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত কঙ্কাবতী বসিয়া ভাবিতে লাগল, তাহার পর ধীরে ধীরে উঠিল, ধীরে ধীরে গিয়া বাটীর দ্বারটি খুলিল, বাটীর বাহিরে গিয়া উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াইল।

গোয়ালিনী বলিল, “কঙ্কাবতী, কোথায় যাও? কঙ্কাবতী, কোথায় যাও?”

আর, কোথায় যাও! আজ আর কঙ্কাবতী রানী-অধিরানী-মহারানী নয়, আজ কঙ্কাবতী পাগলিনী। মনোহর রাজবেশে আজ কঙ্কাবতী সুসজ্জিতা নয়, আজ কঙ্কাবতী গোয়ালিনীর একখানি সামান্য মলিন বসন পরিহিতা। কঙ্কাবতীর মুখ আজ উজ্জ্বল প্রভাসম্পন্ন নয়, আজ কঙ্কাবতীর মুখ ঘন-ঘটায় আচ্ছাদিত।বাটীর বাহির হইয়া, মলিন বেশে আলুলায়িত কেশে, পাগলিনী সেই শ্মশানের দিকে ছুটিল।

“কঙ্কাবতী শুন, কঙ্কাবতী শুন।” এই কথা বলিতে বলিতে কিয়দ্দুর গোয়ালিনী তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমানা হইল। কিন্তু কঙ্কাবতী তাহার কথায় কর্ণপাত করিল না, একবার ফিরিয়াও দেখিল না।

রাহুগ্রস্ত পূর্ণশশী অবিলম্বেই নিশার তমোরাশিতে মিশিয়া গেল। গোয়ালিনী আর তাহাকে দেখিতে পাইল না। কাঁদিতে কাঁদিতে গোয়ালিনী বাড়ী ফিরিয়া আসিল।