ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
সেই ঘরের সম্মুখে ব্যাগের উপরে বসিয়া আশা ও আশ্বাসের স্বপ্ন দেখিয়া অচলার কোথায় দিয়া যে দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হইয়া গেল, তাহা সে জানিতে পারিল না। কিছুক্ষণ সূর্য উঠিয়াছে। শীতের দিনের ধূলি-ধূসরিত তরুশ্রেণী কল্যকার ঝড়-জলে স্নাত ও নির্মল হইয়া প্রভাতসূর্যকিরণে ঝলমল করিতেছে। সিক্ত-স্নিগ্ধ রাজপথের উপর দিয়া বিগত-ক্লেশ পান্থ প্রফুল্লমুখে চলিতে শুরু করিয়াছে; কদাচিৎ দুই-একটা এক্কাগাড়ি ছোট ছোট ঘণ্টার শব্দে চারিদিক মুখরিত করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে; মাঝে মাঝে রাখাল-বালকেরা গো-মহিষের দল লইয়া অদ্ভুত ও অসম্ভব আত্মীয়সম্বন্ধের অস্তিত্ব উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিয়া কোন গ্রামপ্রান্তে যাত্রা করিয়াছে; অদূরবর্তী কোন এক কুটির হইতে গমভাঙ্গা যাঁতার শব্দে মিশিয়া হিন্দুস্থানী গৃহস্থ-বধূর অশ্রান্ত অপরিচিত সুর ভাসিয়া আসিতেছে। সবসুদ্ধ লইয়া এই যে একটি নূতন দিনের কর্মস্রোত তাহার চেতনায় ধীরে ধীরে গতিশীল হইয়া উঠিতেছিল, ইহারই বিচিত্র প্রবাহে তাহার দুঃখ, তাহার দুর্ভাগ্য, তাহার দুশ্চিন্তা কিছুক্ষণের নিমিত্ত কোথায় যেন ভাসিয়া গিয়াছিল। ঠিক কিসের জন্য, কেন সে এখানে এভাবে বসিয়া, তাহার স্মরণ ছিল না। অকস্মাৎ মনে পড়িল জন-দুই পল্লী বালকের বিস্মিত দৃষ্টিপাতে! তাহারা আঙ্গিনার একপ্রান্ত হইতে শুধু বিস্ফারিতচক্ষে নিঃশব্দে চাহিয়াছিল। এই জীর্ণ মলিন পান্থশালার প্রাচীন দিনের গৌরব-ইতিহাস ছেলে-দুটার জানা ছিল না; কিন্তু তাহাদের জ্ঞান হওয়া অবধি এরূপ বিশিষ্ট অতিথির সমাগম যে এ গৃহে কখনো ঘটে নাই, তাহাদের নীরব চোখের চাহনি সে কথা স্পষ্ট করিয়া অচলাকে জানাইয়া দিল। ঘুম ভাঙ্গিয়া নিত্য-নিয়মিত খেলা করিতে আসিয়া আজ সহসা এই আশ্চর্য ব্যাপার তাহাদের চোখে পড়িয়া গিয়াছে।
অচলা চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বোধ হয় কিছু প্রশ্ন করিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু ছেলে-দুটা নিমিষে অন্তর্ধান হইয়া গেল। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাহার মনে পড়িল, প্রায় ঘণ্টা-দুই পূর্বে সেই যে সুরেশ কাপড় ছাড়িবার নাম করিয়া পাশের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিয়াছে, আর দেখা দেয় নাই। এতক্ষণ ধরিয়া সে একাকী কি করিতেছে জানিবার জন্য সে তখন ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া সেই কক্ষের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল এবং অবরুদ্ধ কবাটের ভিতর হইতে কোনপ্রকার সাড়া-শব্দ না পাইয়া সে মিনিট-দুই চুপ করিয়া থাকিয়া তাহার পর আস্তে আস্তে দ্বার ঠেলিয়া সামনেই যাহা দেখিতে পাইল তাহাতে একই কালে মুক্তির তীব্র আবেগে ও বিকট ভয়ে ক্ষণকালের নিমিত্ত তাহার সমস্ত দেহমন যেন পাষাণ হইয়া গেল। ঘরটা অন্ধকার, শুধু ওদিকের একটা ভাঙ্গা জানালা দিয়া খানিকটা আলো ঢুকিয়া মেঝের উপর পড়িয়াছে। সেইখানে আলো-আঁধারের মধ্যে একান্ত অপরিচ্ছন্ন ধূলা-বালির উপরে সুরেশ চিত হইয়া শুইয়া আছে। তাহার গায়ে তখনো সেই-সব জামা-কাপড়, শুধু কেবল খোলা ব্যাগটার ভিতর হইতে কতকগুলা জিনিসপত্র ইতস্ততঃ ছড়ানো।
চক্ষের পলকে তাহার শেষ-কথাগুলা অচলার মনে পড়িল; সে ডাক্তার, সে শুধু মানুষের জীবনটা ধরিয়া রাখিবার বিদ্যাই শিখিয়াছিল, তাহা নয়, তাহাকে নিঃশব্দে বাহির করিয়া দিবার কৌশলও তাহার অবিদিত ছিল না। মনে পড়িল, নিদারুণ ভুলের জন্য তাহার সেই উৎকট আত্মগ্লানি; মনে পড়িল, তাহার সেই বিদায় চাওয়া, সেই আশ্বাস দেওয়া—সর্বোপরি তাহার সেই বারংবার প্রায়শ্চিত্ত করার নিষ্ঠুর ইঙ্গিত; সমস্তই একসঙ্গে এক নিশ্বাসে যেন ওই অবলুণ্ঠিত দেহটার কেবল একটিমাত্র পরিণামের কথাই তাহার কানে কানে কহিয়া দিল। সেইখানে সেই দ্বার ধরিয়া সে ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িল—তাহার এমন সাহস হইল না যে, আর ঘরে প্রবেশ করে।
কিন্তু এইবার ওই অচেতন দেহটার প্রতি চাহিয়া তাহার দুই চক্ষু ফাটিয়া জল বাহির হইয়া পড়িল। যে তাহারই জন্য এত বড় দুর্নামের বোঝা মাথায় লইয়া হতাশ্বাসে এমন করিয়া এই পৃথিবী হইতে চিরদিনের তরে বিদায় লইয়া গেল, অপরাধ তাহার যত গুরুতরই হোক, তাহাকে মার্জনা করিতে পারে না, এত বড় কঠিন হৃদয় সংসারে অল্পই আছে, এবং আজই প্রথম তাহার কাছে তাহার নিজের অপরাধও সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দিল।
সুরেশের সহিত সেই প্রথম দিনের পরিচয় হইতে সেদিন পর্যন্ত যতকিছু কামনা-বাসনা, যত ভুলভ্রান্তি, যত মোহ, যত ছলনা, যত আগ্রহ-আবেগ উভয়ের মধ্য দিয়া বহিয়া গিয়াছে, সমস্তই একে একে ফিরিয়া ফিরিয়া দেখা দিতে লাগিল। তাহার নিজের আচরণ, তাহার পিতার আচরণ—অকস্মাৎ সর্বাঙ্গ শিহরিয়া মনে হইল, শুধু কেবল নিজের নয়, অনেকের অনেক পাতকের গুরুভার বহন করিয়াই আজ সুরেশ যে বিচারকের পদপ্রান্তে গিয়া উপনীত হইয়াছে, সেখানে সে নিঃশব্দে মুখ বুজিয়া সমস্ত শাস্তি স্বীকার করিয়া লইবে, কিংবা একটি একটি করিয়া সকল দুঃখ অভিযোগ ব্যক্ত করিয়া তাঁহার ক্ষমা ভিক্ষা চাহিবে!
ওই লোকটির সংসারে উপভোগ করিবার অনেক সাজ-সরঞ্জাম, অনেক উপকরণই সঞ্চিত ছিল, তথাপি এই যে নীরবে, লেশমাত্র আড়ম্বর না করিয়া সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল, ইহার গভীর বেদনা অচলাকে আজ ফিরিয়া ফিরিয়া বিদ্ধ করিতে লাগিল। সে যে যথার্থই প্রাণ দিয়া ভালবাসিয়াছিল, সে কথা আজ ওই মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিবার, অবিশ্বাস করিবার আর এতটুকু অবকাশ রহিল না।
আবার তাহার দুই গণ্ড বাহিয়া দরদর ধারে অশ্রু বহিতে লাগিল। গতরাত্রে গাড়ির মধ্যে তাহাদের বিস্তর কঠিন কটু কথা, বিস্তর ধর্মাধর্ম, ন্যায়-অন্যায়ের বিতর্ক হইয়া গিয়াছে। কিন্তু সে-সকল যে কত বড় অর্থহীন প্রলাপ, অচলা তখন তাহার কি জানিত। ভালবাসার যে জাতি নাই, ধর্ম নাই, বিচার-বিবেক ভালমন্দ-বোধ কিছুই নাই, যে এমন করিয়া মরিতে পারে, সে যে এই-সব সমাজের হাতেগড়া আইন-কানুনের অনেক উপরে, এ-সকল বিধিনিষেধ যে তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না, এই মরণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আজ এ কথা সে অস্বীকার করিবে কেমন করিয়া?
অচলা আঁচল দিয়া চোখ মুছিতেছিল, সহসা তাহার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করিয়া মনে হইল, মৃতদেহটা যেন একটুখানি নড়িয়া উঠিল, এবং পরক্ষণেই একটা অস্ফুট আর্তস্বরের সঙ্গে সুরেশ পাশ ফিরিয়া শুইল। সে মরে নাই—জীবিত আছে; একটা প্রচণ্ড আগ্রহবেগে অচলা ছুটিয়া গিয়া তাহার কাছে পড়িল এবং ভগ্নকণ্ঠে কহিল, সুরেশবাবু!
আহ্বান শুনিয়া সুরেশ দুই আরক্ত চক্ষু মেলিয়া চাহিল, কিন্তু কথা কহিল না।
অচলা আর কোন কথা বলিতে পারিল না, শুধু অদম্য বাষ্পোচ্ছ্বাস তাহার কণ্ঠরোধ করিয়া অশ্রুর আকারে দুই চক্ষু দিয়া নিরন্তর ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। কিন্তু মুহূর্ত পূর্বের অশ্রুর সহিত এ অশ্রুর কতই না প্রভেদ!
অথচ তাহার সকল চিন্তার মধ্যে যে চিন্তাটা ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত সংগোপনে পীড়া দিতেছিল, তাহা ইহার বাস্তব দিকটা। এই অজানা অপরিচিত স্থানে সুরেশের মৃতদেহ লইয়া সে কি উপায় করিবে, কাহাকে ডাকিবে, কাহাকে বলিবে—হয়ত অনেক অপ্রীতিকর আলোচনা, অনেক কুৎসিত প্রশ্ন উঠিবে—সে তাহার কাহাকে কি জবাব দিবে, হয়ত পুলিশে টানাটানি করিয়া সকল কথা বাহির করিয়া আনিবে—সেই-সকল অনাবৃত প্রকাশ্যতার লজ্জায় তাহার সমস্ত দেহ-মন যে অন্তরে অন্তরে পীড়িত, কিরূপ ক্লিষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার সমস্তটা বোধ করি সে নিজেও সম্পূর্ণ উপলব্ধি করে নাই। এখন সেই বিপদের অপরিমেয় লাঞ্ছনা হইতে অকস্মাৎ অব্যাহতি পাইয়া তাহার কান্না যেন আর থামিতে চাহিল না, এবং সে মরে নাই, শুধু ইহাতে তাহার প্রতি অচলার সমস্ত হৃদয় কানায় কানায় কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
কিছুক্ষণ এইভাবে কাটিলে সুরেশ ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, কাঁদছ কেন অচলা?
অচলা ভগ্নকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, কেন তুমি এমন করে শুয়ে রইলে? কেন গেলে না? কেন আমাকে এত ভয় দেখালে?
তাহার কণ্ঠস্বরে যে স্নেহ উদ্বেলিত হইয়া উঠিল, তাহা এমনই করুণ, এমনই মধুর যে, শুধু সুরেশের নয়, অচলার নিজের মধ্যেও কেমন একপ্রকার মোহের সঞ্চার করিল। সে পুনরায় কহিল, তোমার যদি এতই ঘুম পেয়েছিল, আমাকে বললে না কেন? আমি ত ওদিকের বড় ঘরটা পরিষ্কার করে যা হোক কিছু পেতে তোমার একটা বিছানা তৈরি করে দিতে পারতুম। ট্রেনের সময় হতে ত ঢের দেরি ছিল।
সুরেশ কোন জবাব দিল না, শুধু বিগলিত স্নেহে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ধীরে ধীরে হাত বাড়াইয়া অচলার ডান হাতখানি তুলিয়া নিজের উত্তপ্ত ললাটের উপর রাখিয়া কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল।
অচলা চকিত হইয়া কহিল, এ যে ভয়ানক গরম! তোমার কি জ্বর হয়েছে নাকি!
সুরেশ কহিল, হুঁ। তা ছাড়া এ জ্বর সহজে সারবে বলেও আমার মনে হয় না। বোধ হয়—
অচলা হাতখানি আস্তে আস্তে টানিয়া লইল, এবং প্রত্যুত্তরে তাহার মুখ দিয়াও এবার কেবল একটা দীর্ঘনিশ্বাসই পড়িল। তাহার উদ্বেলিত সমস্ত স্নেহ-মমতা একমুহূর্তে জমিয়া যেন পাথর হইয়া গেল। সহ্য করিবার, ধৈর্য ধরিবার তাহার যে কিছু শক্তি ছিল, সমস্ত একত্র করিয়া সে স্থির হইয়া আজিকার বেলাটুকু গাড়ির জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিবে, ইহাই সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, কিন্তু এই অচিন্তনীয় ও অভাবিতপূর্ব বিপদের মেঘে তাহার আশার ক্ষীণ রশ্মিরেখাটুকু যখন নিমিষে অন্তর্হিত হইয়া গেল, তখন মৃত্যু ভিন্ন জগতে আর প্রার্থনীয় বস্তু তাহার দ্বিতীয় রহিল না।
ইহাকে এইভাবে এখানে একাকী ফেলিয়া যাওয়ার কথা সে কল্পনা করিতেও পারিল না। কিন্তু যাহার পীড়ার সর্বপ্রকার দায়িত্ব, সমস্ত গুরুভার তাহার মাথায় পড়িল, তাহাকে লইয়া এই অপরিচিত স্থানে সে কি করিবে, কোথায় কাহার কাছে কি সাহায্য ভিক্ষা চাহিবে, কি পরিচয়ে মানুষের সহানুভূতি আকর্ষণ করিবে, অহর্নিশি কি অভিনয় করিবে, এই-সকল চিন্তা বিদ্যুৎবেগে তাহার মাথায় প্রবাহিত হওয়ায় সে ছুটিয়া পলাইবে, না ডাক ছাড়িয়া কাঁদিবে, না সজোরে মাথা কুটিয়া এই অভিশপ্ত জীবনের পালাটা হাতে হাতে চুকাইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইবে, ইহার কোনটারই যেন কূল-কিনারা পাইল না।