গৃহদাহ by শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, chapter name ত্রযোত্রিংশ পরিচ্ছেদ

ত্রযোত্রিংশ পরিচ্ছেদ

দুই-একজন দাস-দাসী ব্যতীত দিন পাঁচ-ছয় হইল, বাটীর সকলেই কলিকাতায় চলিয়া গিয়াছেন। কেবল যাওয়া ঘটে নাই কর্তার। কি একটা জরুরী কাজের অজুহাতে তিনি শেষ-সময়ে পিছাইয়া গিয়াছিলেন। এ-কয়দিন রামচরণবাবু নিজের কাজ লইয়াই ব্যস্ত ছিলেন, বড়-একটা তাঁহাকে দেখিতে পাওয়া যাইত না। হঠাৎ আজ প্রত্যুষেই তিনি সাড়া দিয়া উপরের বারান্দায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং সুরমার নাম ধরিয়া ডাকিতে লাগিলেন।

শীতের দিনের এমন প্রভাতে তখন পর্যন্ত কেহ শয্যাত্যাগ করিয়া উঠে নাই, আহ্বান শুনিয়া অচলা শশব্যস্তে দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল এবং ক্ষণেক পরেই সুরেশও আর একটা দরজা খুলিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে বাহির হইয়া আসিল। এই সদ্যনিদ্রোত্থিত দম্পতিকে বিভিন্ন কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতে দেখিয়া এই বৃদ্ধের প্রসন্ন দৃষ্টি যে সহসা বিস্ময়ে সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিল, তাহা সুরেশ দেখিতে পাইল না বটে, কিন্তু অচলার চক্ষে প্রচ্ছন্ন রহিল না।

রামবাবু সুরেশের দিকে চাহিয়া একটু অনুতাপের সহিত কহিলেন, তাই ত সুরেশবাবু, হাঁকাহাঁকি করে অসময়ে আপনার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলুম, বড় অন্যায় হয়ে গেল।

সুরেশ হাসিয়া বলিল, অন্যায় কিছুই নয়। তার কারণ আমি জেগেই ছিলুম, বাইরে থেকে ডেকে কেন, ঢাক পিটেও আমার ঘরের শান্তিভঙ্গ করতে পারতেন না। কিন্তু এত ভোরেই যে?

বৃদ্ধ অচলাকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, আজ আমার সুরমা-মায়ের ওপর একটু উপদ্রব করবার আবশ্যক হয়ে পড়েছে, বলিয়া একবার তাহার দিকে ফিরিয়া চাহিয়া হাসিমুখে বলিলেন, আমার পালকি প্রস্তুত, এখুনি বার হতে হবে, বোধ করি দুটো-তিনটের আগে আর ফিরতে পারবো না; এই বুড়োটার জন্যে আজ চারটি ডাল-ভাত ফুটিয়ে রেখো মা, অত বেলায় এসে যেন না আর আগুন-তাতে যেতে হয়।

এই পরম নিষ্ঠাবান্‌ নিরামিষাহারী ব্রাহ্মণ স্ত্রী এবং পুত্রবধূ ভিন্ন আর কাহারও হাতে কখনও আহার করেন না। তাঁহার রান্নাঘরটিও একেবারে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

এমন কি, সকলের সে ঘরে যাওয়ার পর্যন্ত অধিকার ছিল না; এবং স্বপাক আহার তাঁহার মাঝে মাঝে অভ্যাস ছিল বলিয়াই মেয়েরা বাড়ি ছাড়িয়া দেশে যাইতে পারিয়াছিল। এ-কয়দিন তাঁহার সেই ব্যবস্থাই চলিয়াছিল, কিন্তু আজ অকস্মাৎ এই অজ্ঞাত অপরিচিত মেয়েটির উপর ভার দেওয়ার প্রস্তাবে সে বিস্ময়ে, এবং সকলের চেয়ে বেশী ভয়ে অভিভূত হইয়া পড়িল।

রামবাবু সেই ম্লান মুখের দিকে চাহিয়া সস্নেহে কহিলেন, তুমি ভাবছ মা, এ বুড়ো আজ বলে কি! রান্না-খাওয়া নিয়ে যার এও বাছবিচার, অত হাঙ্গামা, তার আজ হলো কি? তা হোক। রাক্ষুসীর হাতে খেতে যখন আপত্তি হয় না, তখন তুমিই বা দুটো ডাল-ভাত ফুটিয়ে দিলে অপ্রবৃত্তি হবে কেন? আর হোক ভাল, না হোক ভাল, মা, অতখানি বেলায় ফিরে এসে হাঁড়ি ঠেলতে যেতে পারব না। বলিয়া অচলার নিরুত্তর মুখের প্রতি ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া পুনশ্চ সহাস্যে কহিলেন, তুমি নিশ্চয় মনে মনে ভাবচ, এ বুড়োটার মধ্যে হঠাৎ যদি এতবড় ঔদার্যই জন্মে থাকে তবে আমাকে কষ্ট না দিয়ে হিন্দুস্থানী বামুনঠাকুরের হাতে খেলেই ত হতো। না গো মা, তা হতো না।

আজও এ বুড়োর তেমনি গোঁড়ামি, তেমনি কুসংস্কার আছে—মরে গেলেও ঐ সন্ধ্যা-গায়ত্রীহীন হিন্দুস্থানী ‘মহারাজে’র অন্ন আমার গলা দিয়ে গলবে না। আর আমার রাক্ষুসী মাকে আর তোমাকে এরই মধ্যে একবার এক করে নিতে পেরেচি, সেও সত্য নয়, কিন্তু যতই দেখচি, আমার মনে হচ্চে, এই মা-জননীটিও যদি একদিন রেঁধে দেন, সে যে আমার অন্নপূর্ণার অন্ন হবে না, এ আমি কোনমতেই মানব না। কিন্তু আর ত দেরি করতে পারিনে মা, বাকি যেটুকু বলবার রইল, সেটুকু খেতে খেতেই বলব আর সেই বলাই তখন সবচেয়ে সত্যিকার বলা হবে। বলিয়া বৃদ্ধ চলিবার উপক্রম করিতেই অচলা ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কি বলিবে, তাহা স্থির করিতে না করিতে যে কথাটা সকলের পূর্বে মুখে আসিয়া পড়িল, তাহাই বলিয়া ফেলিল, কহিল, কিন্তু আমি ত ভাল রাঁধতে জানিনে। আমার রান্না আপনার ত পছন্দ হবে না।

বৃদ্ধ রামবাবু ফিরিয়া দাঁড়াইয়া একটু হাসিলেন। বলিলেন, এই কথাটা আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে বল মা?

অচলা কহিল, সকলেই কি রাঁধতে জানে?

বৃদ্ধ জবাব দিলেন, সকলেই জানে, তাই কি আমি বলচি?

অচলা এ কথার হঠাৎ কোন প্রত্যুত্তর করিতে না পারিয়া মৌন হইয়া রহিল। কিন্তু সুরেশের পক্ষে সেখানে দাঁড়াইয়া থাকা একপ্রকার অসম্ভব হইয়া উঠিল। অচলার বিবর্ণ মুখের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া সে তাহার বেদনা বুঝিল। এই বৃদ্ধের সংস্কার, তাঁহার হিন্দু আচার ভাল হউক, মন্দ হউক, সত্য হউক, মিথ্যা হউক, তাঁহাকে রাঁধিয়া খাওয়ানোর মধ্যে যে কদর্য প্রতারণা লুক্কায়িত রহিয়াছে, সে কথা যে অচলার অগোচর নাই এবং এই ভদ্রনারীর হৃদয়ের বিবেক যে কিছুতেই এই গোপন কথার গভীর দুষ্কৃতি হইতে আপনাকে অব্যাহতি দিতেছে না, ইহা তাহার শ্রীহীন পাণ্ডুর মুখের উপর স্পষ্ট দেখিতে পাইয়া সে আর কোনদিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া মুখহাত ধোয়ার অছিলায় দ্রুতবেগে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গেল।

তা হলে আমি চললুম, বলিয়া সঙ্গে সঙ্গে রামচরণবাবুও সুরেশের অনুসরণ করিলেন। মুহূর্তকাল অচলা হতবুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তার পরেই নিজেকে জোর করিয়া সচেতন করিয়া তুলিয়া ডাকিল, একবার শুনুন—

বৃদ্ধ ফিরিয়া দেখিলেন, সুরমা কি যেন বলিতে চাহিয়াও নীরবে নতনেত্রে দাঁড়াইয়া আছে। তখন কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া আসিয়া কহিলেন, আর একটা কথা তোমাকে জানাবার আছে মা। তোমার সঙ্কোচ যখন কোনমতেই কাটতে চাইচে না, তখন—কি জান সুরমা, ছেলেবেলায় আমি ছিলাম পাড়ার মেজদা। তোমার বাপের চেয়ে হয়ত বয়সে ছোটও হব না। তা হলে আমাকে কেন মেজ-জ্যাঠামশাই বলে ডেকো না মা!

এই বৃদ্ধ যে তাহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন, অচলা তাহা জানিত। ভালবাসার এই প্রকাশ্যতায় তাহার চোখের কোণে যেন জল আসিয়া পড়িল। তাই সে শুধু নিঃশব্দে ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল।

বৃদ্ধ প্রশ্ন করিলেন, আর কিছু বলবে?

অচলা তেমনি নীরবে ক্ষণকাল মাটির দিকে চাহিয়া থাকিয়া এইবার বোধ হয় সে নিজের সমস্ত শক্তিই এক করিয়া শুধু অস্ফুটে বলিল, কিন্তু আমার বাবা ব্রাহ্ম ছিলেন।

রামচরণবাবু হঠাৎ চমকিয়া গেলেন। কহিলেন, সত্যিকারের, না পাঁচজন কলকাতায় এসে দু’দিন শখ করে যেমন হয়, তেমনি? তারা ব্রাহ্মদের দলে বসে হিঁদুদের কোসে গালাগালি দেয়—তেমন গাল সত্যিকারের ব্রাহ্মরা কখনো মুখে আনতেও পারে না—তার পরে ঘরে ফিরে সমাজে দাঁড়িয়ে সে ব্রাহ্মদের নাম করে আবার এমনি গালিগালাজ করে যে, তেমন মধুর বচন হিঁদুদের চৌদ্দপুরুষও কখনো উচ্চারণ করতে পারে না। বলি, তেমনি তা মা? তা হয় ত আমার এতটুকু আপত্তি নেই।

অচলার চোখমুখ লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল, কেবলমাত্র কহিল, না তিনি সত্যিকার ব্রাহ্ম।

উত্তর শুনিয়া বৃদ্ধ একটু যেন দমিয়া গেলেন। কিন্তু একটু পরেই প্রফুল্লমুখে বলিলেন, তা হলেনই বা বাবা ব্রাহ্ম, মেয়ে ত আর তাঁর খাতক নয় যে, এখন ভয় করতে হবে। বরঞ্চ যাঁর সঙ্গে তুমি ধর্ম ভাগ করে নিয়েচ মা, তিনি যখন হিন্দু, তাঁর গলায় যখন যজ্ঞোপবীত শোভা পাচ্চে, তিনি যখন ওই সুতো ক’গাছার এখনো অপমান করেন নি, তখন বাপের কর্ম ত তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না! কিন্তু তুমি যত ফন্দিই কর না, সুরমা, জ্যাঠামশাইকে আজ আর ফাঁকি দিতে পারচ না। আজ তোমাকে রেঁধে ভাত দিতেই হবে। তাই বাপের শিক্ষার গুণে সেদিন উপোস করতে চাওনি বটে! আজ তার সুদসুদ্ধ উসুল করে তবে ছাড়বো। বলিয়া তিনি পুনরায় চলিয়া যান দেখিয়া অচলা এতক্ষণ পরে তাহার অভিভূত ভাবটাকে একনিমিষে অতিক্রম করিয়া গেল। সুস্পষ্টকণ্ঠে বলিল, আচ্ছা জ্যাঠামশাই, আমি ব্রাহ্মমহিলা হলে আপনি আমার হাতে খাবেন না?

বৃদ্ধ বলিলেন, না। কিন্তু সে ত তুমি নও। সে ত তুমি হতে পার না।

অচলা প্রশ্ন করিল, কিন্তু তাও যদি হতো, তা হলে কি শুধু আমার ধর্মমতটা আলাদা বলেই আমি আপনার কাছে অস্পৃশ্য হয়ে যেতুম?

বৃদ্ধ বলিলেন, অস্পৃশ্য হবে কেন মা, অস্পৃশ্য নয়। কিন্তু তোমার হাতে খেতে পারতাম না।

এ সম্বন্ধে আজ তাহার অনেক কথাই জানা প্রয়োজন! তাই সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না। কহিল, কেন পারতেন না, সে কি ঘৃণায়?

বৃদ্ধ সহসা কোন উত্তর দিতে পারিলেন না, কেবল একদৃষ্টে মেয়েটির মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলেন।

অচলা সমস্ত সঙ্কোচ ত্যাগ করিয়াছিল, বলিল, জ্যাঠামশাই, আপনার মায়া-দয়া যে কত বড়, তার অনেক সাক্ষী এ পৃথিবীতে আছে জানি, কিন্তু আমাদের চেয়ে বড় সাক্ষী আর কেউ নেই। তবে আপনার মত মানুষের মন যে কেমন করে এত অনুদার হতে পারে, তাই আমি ভেবে পাইনে। আপনি কি করে মানুষকে এমন ঘৃণা করতে পারেন?

বৃদ্ধ অকস্মাৎ ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিলেন, আমি ঘৃণা করি? কাকে মা? কখন মা?

অচলা বলিল, যার হাতের ছোঁয়া আপনার অস্পৃশ্য, সে আপনার ঘৃণার পাত্র—তাকেই আপনি মনে মনে ঘৃণা করেন। আর ঘৃণা যে করেন, তাও দীর্ঘদিনের অভ্যাসে ভুলে গেছেন। আমাদের ওই হিন্দুস্থানী চাকরটার কথা ছেড়ে দিন, পাচকটার হাতের রান্নাও যে কোনমতেই আপনার গলা দিয়ে গলবে না, সেও আপনি নিজের মুখেই প্রকাশ করেছেন। এতে দেশের কত ক্ষতি, কত অবনতি হয়েচে সে ত—

বৃদ্ধ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন, অচলার উত্তেজনাও লক্ষ্য করিতেছিলেন। তাহার কথা হঠাৎ শেষ হইলে একটু হাসিয়া বলিলেন, মা, ঘৃণা আমরা কোন মানুষকেই করিনে। যে নালিশ তুমি করলে, সে নালিশ সাহেবেরা করে—তাদের কাছে তোমার বাবার শেখা—আর তাঁর কাছে তুমি শিখেচ। নইলে মানুষ যে ভগবান, এ জ্ঞান কেবল তাদের নয়, আমাদেরও ছিল, আজও আছে।

এই সময় নীচে হইতে একটা অস্পষ্ট কোলাহল শুনা যাইতেছিল, বৃদ্ধ সেদিকে একমুহূর্ত কান পাতিয়া কহিলেন, সুরমা খাওয়া জিনিসটা যাদের মধ্যে মস্ত বড় জিনিস, মস্ত ঘটা-পটার ব্যাপার, তাদের সঙ্গে আমাদের মিল হবে না। আমাদের ভাতে-ভাত খাওয়াটা তুচ্ছ বস্তু, সেটুকুর আজ একটু যোগাড় করে রেখো—মুখে দিতে দিতে তখন আলোচনা করা যাবে, ঘৃণাটা আমরা কাকে কত করি এবং দেশের অবনতি তাতে কতখানি হচ্চে—কিন্তু গোলমাল বাড়চে—আর নয় মা, আমি চললুম। বলিয়া তিনি একটু দ্রুতবেগে নামিয়া গেলেন।