দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
এই জনহীন পুরীর মধ্যে কেবলমাত্র সুরেশকে লইয়া জীবনযাপন করিতে হইবে এবং সেই দুর্দিন প্রতি মুহূর্তে আসন্ন হইয়া আসিতেছে। বাধা নাই, ব্যবধান নাই, লজ্জা নাই—আজ নয় কাল বলিয়া একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করিবার পর্যন্ত সুযোগ মিলিবে না।
বীণাপাণি বলিয়াছিল, সুরমাদিদি, শ্বশুর-ঘর আপনার ঘর, সেখানে হেঁট হয়ে যেতে মেয়েমানুষের কোন শরম নেই।
হায় রে, হায়! তাহার কে আছে, আর কি নাই, সে জমাখরচের হিসাব তাহার অন্তর্যামী ভিন্ন আর কে রাখিয়াছে! তথাপি আজও তাহার আপনার স্বামী আছে এবং আপনার বলিতে সেই তাহাদের পোড়া ভিটাটা এখনও পৃথিবীর অঙ্ক হইতে লুপ্ত হইয়া যায় নাই। আজিও সে একটা নিমিষের তরেও তাহার মাঝখানে গিয়া দাঁড়াইতে পারে।
আবদ্ধ পশুর চোখের উপর হইতে যতক্ষণ না এই বাহিরের ফাঁকটা একেবারে আবৃত হইয়া যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত যেমন সে একই স্থানে বারংবার মাথা কুটিয়া মরিতে থাকে, ঠিক তেমনি করিয়াই তাহার অবাধ্য মনের প্রচণ্ড কামনা তাহার বক্ষের মধ্যে হাহাকার করিয়া বাহিরের জন্য পথ খুঁজিয়া মরিতে লাগিল। পার্শ্বের ঘরে সুরেশ নিরুদ্বেগে নিদ্রিত, মধ্যের দরজাটা ঈষৎ উন্মুক্ত এবং তাহারই এ-ধারে মেঝের উপর মাদুর পাতিয়া আপনার আপাদমস্তক কম্বলে ঢাকিয়া হিন্দুস্থানী দাসী অকাতরে ঘুমাইতেছে। সমস্ত বাটীর মধ্যে কেহ যে জাগিয়া আছে, তাহার আভাসমাত্র নাই—শুধু সেই যেন অগ্নিশয্যার উপরে দগ্ধ হইয়া যাইতে লাগিল। অনেক দিন এই পালঙ্কের উপরেই তাহার পার্শ্বে বীণাপাণি শয়ন করিয়াছে, কিন্তু আজ তাহার স্বামী উপস্থিত, সে তাহার নিজের ঘরে শুইতে গিয়াছে, এবং পাছে এই চিন্তার সূত্র ধরিয়া নিজের বিক্ষিপ্ত পীড়িত চিত্ত অকস্মাৎ তাহাদেরই অবরূদ্ধ কক্ষের সুষুপ্ত পর্যঙ্কের প্রতি দৃষ্টি হানিয়া হিংসায়, অপমানে, লজ্জার অণু-পরমাণুতে বিদীর্ণ হইয়া মরে, এই ভয়ে সে যেন আপনাকে আপনি প্রচণ্ড শক্তিতে টানিয়া ফিরাইল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত দেহটা তার তীব্র তড়িৎস্পৃষ্টের ন্যায় থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল।
পার্শ্বের কোন একটা ঘরের ঘড়িতে দুইটা বাজিল। গায়ের গরম কাপড়খানা ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া বসিতেই অনুভব করিল, এই শীতের রাত্রেও তাহার কপালে-মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম দিয়াছে। তখন শয্যা ছাড়িয়া মাথার দিকের জানালাটা খুলিয়া দিতেই দেখিতে পাইল, কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীর খণ্ড-চন্দ্র ঠিক সম্মুখেই দেখা দিয়াছে, এবং তাহারই স্নিগ্ধ মৃদু কিরণে শোনের নীল জল বহুদূর পর্যন্ত উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে। গভীর রাত্রির ঠাণ্ডা বাতাস তাহার তপ্ত ললাটের উপর স্নেহের হাত বুলাইয়া দিল এবং সেইখানে সেই জানালার উপরে সে তাহার অদৃষ্টের শেষ সমস্যা লইয়া বসিয়া পড়িল।
এই কথাটা অচলা নিশ্চয় বুঝিয়াছিল যে, তাহার এই অভিশপ্ত, হতভাগ্য জীবনের যাহা কিছু সত্য, সমস্তটাই লোকের কাছে শুধু কেবল একটা অদ্ভুত উপন্যাসের মত শুনাইবে এবং যেদিন হইতে এই কাহিনীর প্রথম সূত্রপাত হইয়াছিল, সেইদিন হইতে যত মিথ্যা এ জীবনে সত্যের মুখোশ পরিয়া দেখা দিয়া গিয়াছে, তাহাদের একটি একটি করিয়া মনে করিয়া ক্রোধে, ক্ষোভে, অভিমানে তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল এবং যে ভাগ্যবিধাতা তাহার যৌবনের প্রথম আনন্দটিকে মিথ্যা দিয়া এমন বিকৃত, এমন উপহাসের বস্তু করিয়া জগতের সম্মুখে উদ্ঘাটিত করিতে লেশমাত্র মমতা বোধ করিল না, সেই নির্মম নিষ্ঠুরকে সে যদি শিশুকাল হইতে ভগবান বলিয়া ভাবিতে শিক্ষা পাইয়া থাকে ত সে শিক্ষা তাহার একেবারে ব্যর্থ, একেবারে নিরর্থক হইয়াছে। সে চোখ মুছিতে মুছিতে বার বার করিয়া বলিতে লাগিল, হে ঈশ্বর! তোমার এত বড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এই দুর্ভাগিনীর জীবনটা ভিন্ন কৌতুক করিয়া আমোদ করিবার আর কি ছাই কিছুই ছিল না!
মনে মনে কহিল, কোথায় ছিলাম আমি এবং কোথায় ছিল সুরেশ। ব্রাহ্ম-পরিবারের ছায়া মাড়াইতেও যাহার ঘৃণা ও বিদ্বেষের অবধি ছিল না, ভাগ্যের পরিহাসে আজ সেই লোকেরই কি আসক্তির আর আদি-অন্ত রহিল না! যাহাকে সে কোনদিন ভালবাসে নাই, সে-ই তাহার প্রাণাধিক, শুধু এই মিথ্যাটাই কি সবাই জানিয়া রাখিল? আর যাহা সত্য, সে কি কোথাও কাহারো কাছেই আশ্রয় পাইল না? আবার সে মিথ্যাটা কি তাহার নিজের মুখ দিয়াই প্রচার হওয়ার এত প্রয়োজন ছিল? অদৃষ্টের এত বড় বিড়ম্বনা কাহার ভাগ্যে কবে ঘটিয়াছে? স্বামীকে সে অনেক দুঃখেই পাইয়াছিল, কিন্তু সে সহিল না—তাহার চরম দুর্দশার বোঝা বহিয়া অকস্মাৎ একদিন সুরেশ গিয়া অভিসম্পাতের মত তাহাদের দেশের বাটীতে উপস্থিত হইল। তাহার সুখের নীড় দগ্ধ হইয়া গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহার ভাগ্যটাও যে পুড়িয়া ভস্মসাৎ হইয়া গিয়াছে, এ কথা বুঝিতে আর যখন বাকি রহিল না, তখন আবার কেন তাহার পীড়িত স্বামীকে তাহারই ক্রোড়ের উপরে আনিয়া দেওয়া হইল! যাহাকে সে একেবারে হারাইতে বসিয়াছিল, সেবার ভিতর দিয়া আবার তাহাকে সম্পূর্ণরূপে ফিরাইয়া দেওয়াই যদি বিধাতার সঙ্কল্প ছিল, তবে আজ কেন তাহার দুঃখ-দুর্দশা, লাঞ্ছনা-অপমানের আর কূলকিনারা নাই?
অচলা দুই হাত জোড় করিয়া রুদ্ধস্বরে বলিতে লাগিল, জগদীশ্বর! রোগমুক্ত স্বামীর স্নেহাশীর্বাদে সকল অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত নিঃশেষ হইয়াছে বলিয়াই যদি একদিন আমাকে বিশ্বাস করিতে দিয়াছিলে, তবে এতবড় দুর্গতির মধ্যে আবার ঠেলিয়া দিলে কিসের জন্য? সে যে সঙ্কোচ মানে নাই, এত কাণ্ডের পরেও সুরেশকে সঙ্গে আসিতে নিমন্ত্রণ করিয়াছিল, জগতে এ অপরাধের আর ক্ষালন হইবে না, কলঙ্কের এ দাগ আর মুছিবে না—কিন্তু অন্তর্যামী, আমার অদৃষ্টে তুমিও কি ভুল বুঝিলে? এই বুকের ভিতরটায় চিরদিন কি রহিয়াছে, সে কি তোমার চোখেও ধরা পড়িল না?
পিতার চিন্তা, স্বামীর চিন্তা সে যেন প্রাণপণ-বলে দুই হাত দিয়া ঠেলিয়া রাখিয়া দিত, আজও সকল ভাবনাকে সে কাছে ঘেঁষিতে দিল না; কিন্তু তাহার মৃণালের কথাগুলা মনে পড়িল, আর মনে পড়িল পিসীমাকে। আসিবার কালে স্নেহার্দ্র করুণ-কণ্ঠে সতী-সাধ্বী বলিয়া তিনি যত আশীর্বাদ করিয়াছিলেন, সেই-সব। তাহার সম্বন্ধে আজ তাঁহাদের মনোভাব কল্পনা করিতে গিয়া অকস্মাৎ মর্মান্তিক আঘাতে কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত বোধশক্তি তাহার যেন আচ্ছন্ন হইয়া গেল এবং দেহ-মনের সেই অশক্ত অভিভূত অবস্থায় জানালার গায়ের উপর মাথা রাখিয়া বোধ হয় অজ্ঞাতসারে চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল, এমন সময় পিছনে মৃদু পদশব্দে চমকিয়া ফিরিয়া দেখিল, খালি-গায়ে খালি-পায়ে সুরেশ দাঁড়াইয়া আছে। মুহূর্তের উত্তেজনায় হয়ত সে কিছু বলিতে গিয়াছিল, কিন্তু বাষ্পোচ্ছ্বাসে তাহার কণ্ঠরোধ করিয়া দিল। ইহাকে দমন করিয়া কথা কহিতে বোধ হয় আর তাহার প্রবৃত্তি হইল না, তাই পরক্ষণেই মুখ ফিরাইয়া সে তেমনি করিয়াই গরাদের উপর মাথা রাখিল; কিন্তু যে অশ্রু এতক্ষণ তাহার চোখ দিয়া বিন্দুতে বিন্দুতে পড়িতেছিল, সে যেন অকস্মাৎ কূল ভাঙিয়া উন্মত্ত-ধারায় ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
কোথাও কোন শব্দ নাই, রাত্রির গভীর নীরবতা গৃহের ভিতরে-বাহিরে বিরাজ করিতে লাগিল। পিছনে দাঁড়াইয়া সুরেশ পাষাণ-মূর্তির মত স্তব্ধ—সহসা তাহার সমস্ত দেহটা বাতাসে বাঁশপাতার কত কাঁপিতে লাগিল, এবং চক্ষের পলক না ফেলিতেই সে দুই হাত বাড়াইয়া অচলার মাথাটা টানিয়া আনিয়া বুকের উপর চাপিয়া ধরিল।
অচলা আপনাকে মুক্ত করিয়া লইয়া আঁচলে চোখ মুছিল, কিন্তু অতি বড় বিস্ময় এই যে, যে লোকটা তাহার এতবড় দুঃখের মূল, তাহার এই ব্যবহারে আজ অচলার উৎকট ঘৃণা বোধ হইল না, বরঞ্চ মৃদু-কণ্ঠে কহিল, তুমি এ ঘরে এসেচ কেন?
সুরেশ চুপ করিয়া রহিল। বোধ করি কণ্ঠস্বরের অভাবেই সে জবাব দিতে পারিল না।
অচলা ধীরে ধীরে জানালাটা বন্ধ করিয়া দিয়া বলিল, শীতে তোমার হাত কাঁপচে, যাও, খালি-গায়ে আর দাঁড়িয়ে থেকো না—ঘরে গিয়ে শুয়ে পড় গে।
সুরেশের চোখ জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু তাহার গলা কাঁপিতে লাগিল—অচলার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল, তা হলে তুমিও আমার ঘরে এসো।
অচলা মুহূর্তকাল নির্বাক বিস্ময়ে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া শুধু কহিল, না, আজ নয়। এই বলিয়া ধীরে ধীরে নিজের হাত ছাড়াইয়া লইল।
এই শান্ত সংযত প্রত্যাখ্যানের মধ্যে ঠিক কি ছিল, তাহা নিশ্চয় বুঝিতে না পারিয়া সুরেশ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
অচলা তাহার প্রতি না চাহিয়াই পুনশ্চ কহিল, আমি জেগে আছি জানতে পেরে কি তুমি এ ঘরে ঢুকেছিলে?
সুরেশ আহত হইয়া বলিল, নইলে কি তোমাকে ঘুমন্ত জেনেই ঢুকেছি, এই তুমি আশা কর?
আশা! অচলা মুখ ফিরাইয়া একটুখানি হাসিল। এই তীক্ষ্ণ কঠিন হাসি দীপের অত্যন্ত ক্ষীণ আলোকেও সুরেশের চক্ষু এড়াইল না। সে হাসি যেন স্পষ্ট কথা কহিয়া বলিল, ওরে কাপুরুষ! নিদ্রিত রমণীর কক্ষে যে চোরের মত প্রবেশ করিতে নাই, পুরুষের এ মহত্ত্ব কি তুমি আজও দাবী কর? কিন্তু মুখে কোন কথাই কহিল না। ক্ষণেক পরে গবাক্ষ ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল, তোমার শরীর ভাল নেই, আর জেগো না—যাও, শোও গে। বলিয়া সে ধীরে ধীরে বিছানায় আসিয়া গায়ের কম্বলটা আগাগোড়া মুড়ি দিয়া শুইয়া পড়িল।
কিছুক্ষণ পর্যন্ত আড়ষ্টভাবে সুরেশ সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিল, তার পরে নিঃশব্দ পদক্ষেপে নিজের ঘরে চলিয়া গেল।