ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার by আইজাক আসিমভ, chapter name দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ২৩. ট্রানটরের ধ্বংসস্তূপ

দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ২৩. ট্রানটরের ধ্বংসস্তূপ

ট্রানটরের বুকে কোনো বস্তুর অবস্থান খুঁজে বের করায় যে সমস্যা গ্যালাক্সির অন্য কোনোখানে সেই সমস্যা হয় না। হাজার মাইল দূর থেকে অবস্থান চিহ্নিত করার মতো কোনো মহাদেশ বা মহাসাগর নেই। মেঘের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ার মতো কোনো নদী, হ্রদ বা দ্বীপ নেই।

ধাতু-আচ্ছাদিত-বিশ্ব ছিল- এখনো আছে। পুরোটাই একটা শহর। আউটার স্পেস থেকে বহিরাগতরা শুধুমাত্র ইম্পেরিয়াল প্যালেস চিনতে পারত অনায়াসে। অবতরণের একটা জায়গা খুঁজে বের করার জন্য বেইটা প্রায় এয়ার কারের উচ্চতায় পুরো গ্রহটা বারবার চক্কর দিচ্ছে।

মেরু অঞ্চলে ধাতব গম্বুজগুলোর উপরে বরফের প্রলেপ দেখে বোঝা যায় আবহাওয়া নিয়ন্ত্রক যন্ত্রগুলো পুরোপুরি নষ্ট বা সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি কারো মনোযোগ নেই। সেদিক থেকে ওরা এগোল দক্ষিণ দিকে। মাঝে মাঝে চোখে যা পড়ছে নিওট্রানটর থেকে সংগ্রহ করা অপর্যাপ্ত মানচিত্রের সাথে তা মিলিয়ে নিচ্ছে বা নেওয়ার চেষ্টা করছে।

কিন্তু জায়গাটা চোখে পড়ার পর আর কোনো সংশয় থাকল না। গ্রহের ধাতব আবরণের মাঝে পঞ্চাশ মাইলের মতো উন্মুক্ত প্রান্তর। একশ বর্গমাইলেরও বেশি জুড়ে বিস্তৃত অস্বাভাবিক সবুজ উদ্ভিদের সমারোহ, প্রাচীন ইম্পেরিয়াল বাসস্থানগুলোকে ঘিরে রেখেছে।

পাখির মতো বাতাসে ভেসে থাকল বেইটা, ধীরে ধীরে পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান নির্ণয় করল। পথ দেখানোর জন্য আছে শুধু বিশাল বিশাল কতগুলো প্রশস্ত পায়ে চলা সড়ক। মানচিত্রে সেগুলোকে দেখানো হয়েছে লম্বা তীরচিহ্ন সংবলিত কতগুলো উজ্জ্বল ফিতার মতো।

মানচিত্রের যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় দেখানো হয়েছে সেখানে অনুমান করেই পৌঁছতে হবে। সমতল জায়গাটা নিশ্চয়ই এক সময় ছিল কোনো ল্যাণ্ডিং ফিল্ড। ওটার উপরে পৌঁছে ধীরে ধীরে অবতরণ করতে লাগল বেইটা।

মনে হল যেন এক বিশৃঙ্খল ধাতুর সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছে তারা। আকাশ থেকে দেখা মসৃণ সৌন্দর্য এখন পরিণত হয়েছে ভাঙা, তোবড়ানো ধ্বংসস্তূপে। গম্বুজগুলোর অগ্রভাগ কেটে কে যেন ছোট করে দিয়েছে, মসৃণ দেয়ালগুলো বাঁকা হয়ে আছে গেটে বাগ্রস্ত রোগীর মতন, এবং মাত্র এক ঝলকের জন্য উন্মুক্ত মাটি চোখে পড়ল- সম্ভবত কয়েকশ একর হবে-চাষ করা হয়েছে সেখানে।

.

শিপটা যখন সর্তকভাবে অবতরণ করছে লী স্যান্তার তখন অপেক্ষায় ছিল। অদ্ভুত শিপ, নিওট্রানটর থেকে আসেনি, এবং ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। অদ্ভুত শিপ এবং আউটার স্পেস এর লোকগুলোর সাথে লেনদেনের অর্থ স্বল্পস্থায়ী শান্তির দিন শেষ, আবার সেই যুদ্ধ এবং রক্তপাত পূর্ণ দিনগুলোর ফিরে আসার সম্ভাবনা। স্যান্তার ছিল গ্রুপ লিডার; প্রাচীন বইগুলো ছিল তার দায়িত্বে আর পুরোনো দিনের কথা সে বইয়ে পড়েছে। ওই দিনগুলো ফিরে আসুক সে চায় না।

শিপ সমতলে নামতে আরো দশ মিনিট। কিন্তু এর মাঝেই পুরোনো স্মৃতিগুলো সব ভিড় জমালো। মনে পড়ল শৈশবের সেই বিশাল ফার্মের কথা কিন্তু তার স্মৃতি বলতে শুধু ব্যস্তপায়ে মানুষের ছুটোছুটি। তারপর তরুণ পরিবারগুলো নতুন মাটির সন্ধানে দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া শুরু করে। সে তখন দশ বছরের বালক; একমাত্র সন্তান, ভীত, বিহ্বল।

নতুন করে সব শুরু করতে হয়; বিরাট আকৃতির ধাতব স্ল্যাবগুলো সরিয়ে উন্মুক্ত মাটিতে নিড়ানি দেওয়া হয়; আশপাশের ভবনগুলো ভেঙে সমান করে দেওয়া হয় মাটির সাথে; বাকিগুলো রেখে দেওয়া হয় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহারের জন্য। শুরু হয় চাষাবাদের কাজ। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা হয় প্রতিবেশী ফার্মগুলোর সাথে ।

ক্রমেই তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে সেই সাথে বৃদ্ধি পায় আরশাসনের প্রয়োজনীয়তা। মাটির বুকে জন্ম নেওয়া একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠে কঠিন পরিশ্রমী মনোবল নিয়ে। ঐ দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন যেদিন তাকে গ্রুপ লিডার নির্বাচিত করা হয়।

আর এখন গ্যালাক্সি হয়তো অনাহুতভাবে তাদের একাকী শান্তি ভঙ্গ করবে।

শিপ অবতরণ করছে। নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে সে। পোর্টের দরজা খুলে বেরিয়ে এল চারজন, সতর্ক। তিনজন পুরুষ, তরুণ, বৃদ্ধ এবং, হালকা পাতলা একজন। এবং একজন নারী এমনভাবে পাশাপাশি হাঁটছে যেন সেও পুরুষদের সমকক্ষ। হাত থেকে দুটো চকচকে দাড়ির চুল ফেলে সামনে বাড়ল স্যান্তার।

মহাজাগতিক সংকেত অনুযায়ী শান্তির চিহ্ন দেখাল সে। হাত দুটো সামনে। পরিশ্রমে শক্ত হয়ে যাওয়া তালু দুটো উপরে তোলা।

তরুণ লোকটা সামনে এগিয়ে এসে তার ভঙ্গি অনুকরণ করল। “শান্তি।”

অদ্ভুত উচ্চারণ, কিন্তু শব্দগুলো বোঝা যায়। প্রতি উত্তরে সে বলল, “শান্তি। আমাদের দল আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছে। আপনারা ক্ষুধার্ত? খাবার পাবেন। তৃষ্ণার্ত? পানীয় পাবেন।”

জবাব এল বেশ ধীরে ধীরে, “অসংখ্য ধন্যবাদ। নিজেদের বিশ্বে ফিরে আপনাদের এই আতিথেয়তার কথা আমরা সবাইকে বলতে পারব।”

আজব উত্তর, কিন্তু চমৎকার। তার পিছনে গ্রুপের অন্যরা হাসছে। বাড়ির আড়াল থেকে মেয়েরা বেরিয়ে আসতে লাগল।

নিজের কোয়ার্টারে এসে স্যান্তার গোপন জায়গা থেকে একটা চমৎকার বাক্স বের করে অতিথিদের প্রত্যেককে একটা করে লম্বা পেট মোটা সিগার দিল । মেয়েটার সামনে এসে ইতস্তত করল খানিকক্ষণ। পুরুষদের সাথে একই সারিতে বসেছে মেয়েটা। হয়তো আগন্তকদের সমাজে এটা স্বীকৃত।

হাসিমুখে একটা সিগার নিল মেয়েটা, ধরিয়ে সুগন্ধি ধোয়া ছাড়ল। বিরক্তি গোপন করল লী স্যান্তার।

খানাপিনার সময় তাদের আলোচনা মোড় নিল ট্র্যানটরের কৃষিকাজের দিকে।

বৃদ্ধ একজন জিজ্ঞেস করল, “হাইড্রোফোনিক্স হলে কেমন হয়? আমার ধারণা ট্রানটরের মতো বিশ্বে হাইড্রোফোনিক্স একমাত্র সমাধান।”

মাথা নাড়ল স্যান্তার। অনিশ্চিত বোধ করছে। বই পড়া জ্ঞানের সাথে বিষয়টা মেলাতে পারছে না সে। “কেমিক্যালের সাহায্যে কৃত্রিম চাষাবাদ? না, ট্র্যানটরে হবে না। শিল্পোন্নত গ্রহে হাইড্রোফোনিক্স প্রয়োজন হয়-যেমন, অনেক বড় কোনো কেমিক্যাল ইণ্ডাস্ট্রিজ, কিন্তু যুদ্ধ বা বিপর্যয়ের সময় ইন্ডাস্ট্রিগুলো বন্ধ হয়ে গেলে খাদ্য সংকট তৈরি হয়। চাহিদা অনুযায়ী সব খাবার কৃত্রিমভাবে উৎপাদন করা সম্ভব না। অনেক সময় খাদ্যের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। মাটিই অনেক ভালো-সবসময় নির্ভর করা যায়।”

“আপনাদের খাদ্য সরবরাহ পর্যাপ্ত?”

“পর্যাপ্ত; হয়তো বৈচিত্র্যহীন। গৃহপালিত পশু পাখি থেকে আমরা ডিম এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যগুলো পাই-কিন্তু মাংসের সরবরাহ মূলত নির্ভর করে বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর।”

“বাণিজ্য,” তরুণ সম্ভবত আগ্রহী হল খানিকটা। “আপনারা তা হলে বাণিজ্য করেন। কিন্তু কী রপ্তানি করেন?”

“ধাতু” কাঠখোট্টা জবাব। “আপনি নিজেই দেখছেন ধাতুর কোনো কমতি নেই। একেবারে পরিশোধিত অবস্থায় আছে সব। নিওট্রানটর থেকে ওরা শিপ নিয়ে আসে, আমাদের দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকে ধাতু তুলে নিয়ে যায়-এভাবে আমাদের চাষের জমির পরিমাণ বাড়ছে-বিনিময়ে আমরা পাই মাংস, টিনজাত ফল, ফুড কনসেনট্রেট, খামারের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। সবাই লাভবান।”

খাবারের তালিকায় ছিল রুটি, পনির এবং অত্যন্ত চমৎকার স্বাদের ভেজিটেবল সুপ। আমদানি করা একমাত্র খাবার ছিল হিমায়িত ফলের ডেজার্ট। সেটা খাওয়ার সময়ই নিজেদের আসল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল অতিথিরা। তরুণ ট্র্যানটরের একটা মানচিত্র বের করল। শান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করল স্যান্তার, শুনল মনোযোগ দিয়ে, বলল গম্ভীর গলায়। “ইউনিভার্সিটি গ্রাউণ্ড পবিত্র স্থান। আমরা কৃষকরা সেখানে চাষাবাদ করি না। নিজের ইচ্ছায় কখনো সেখানে যাই না। আমাদের আরেক সময়ের কয়েকটা নিদর্শনের মধ্যে এটা একটা এবং যেভাবে আছে ঠিক সেভাবেই রাখতে চাই।”

“আমরা জ্ঞানের অন্বেষণকারী। কোনো কিছু নষ্ট করব না। আমাদের শিপ আপনারা জিম্মি হিসেবে রাখতে পারেন।” প্রবল আগ্রহের সাথে প্রস্তাব দিল বৃদ্ধ।

“তাহলে আমি আপনাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারি।” বলল স্যান্তার

সেই রাতে আগন্তকরা ঘুমানোর পর নিওট্রানটরে একটা মেসেজ পাঠালো লী স্যান্তার।

*