ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার by আইজাক আসিমভ, chapter name দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ১১. বর কনে

দ্বিতীয় পর্ব : দ্য মিউল - ১১. বর কনে

মিউল–গ্যালাকটিক ইতিহাসের সমপর্যায়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের তুলনায় মিউল সম্বন্ধে বেশি কিছু জানা যায়নি। যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তার বেশিরভাগই পাওয়া গেছে মিউলের প্রতিপক্ষের কাছ থেকে এবং বিশেষ করে সেই নববিবাহিত তরুণী–

এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকা

বর কনে

প্রথম দর্শনেই হেভেন পছন্দ হল না বেইটার। তার স্বামী দেখিয়ে দিল-গ্যালাক্সির প্রান্তে অসীম শূন্যে হারিয়ে যাওয়া একটা নিপ্রভ নক্ষত্র। পাতলাভাবে ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রের শেষ আঁক থেকে অনেক দূরে, যেখানে নিঃসঙ্গ অবস্থায় অনিয়মিত আলো বিকিরণ করছে। সব মিলিয়ে কেমন যেন হতচ্ছাড়া আর অনাকর্ষক।

টোরান ভালোভাবেই জানে যে এই রেড ডোয়ার্ফএ নববিবাহিত জীবন শুরু করাটা চিত্তাকর্ষক হবে না। এটা ভেবেই ঠোঁট বাঁকা করল। “আমি জানি, যে-এখানে তোমার ভালো লাগবে না। মানে ফাউণ্ডেশন থেকে এখানে এসে।”

“জঘন্য, টোরান। তোমাকে আমার বিয়ে করা উচিত হয়নি।”

এই কথায় তার স্বামীপ্রবর আঘাত পেল এবং সেটা গোপন করার আগেই তার সেই বিশেষ উষ্ণ গলায় বলল, “এবার ঠোঁট ফুলিয়ে তীর বেঁধা পাখির মতো কাতর দৃষ্টিতে তাকাও-আমার কাঁধে মাথা রাখার আগে যেভাবে তাকাতে, আর আমি তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দেই। তুমি অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিলে, তাই না? আশা করেছিলে আমি বলব, তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে আমি সেখানেই সুখী হব, টোরান!’ অথবা তুমি পাশে থাকলে ইন্টারস্টেলার গহ্বরে গিয়েও ঘর বাঁধতে পারি! স্বীকার করে নাও।”

স্বামীর দিকে একটা আঙুল তুলল সে এবং টোরান কামড় দেওয়ার আগেই ঝট করে সরিয়ে আনল।

“যদি আমি হার মেনে নেই, স্বীকার করি তোমার কথাই ঠিক, তা হলে তুমি ডিনার তৈরি করবে?” বলল টোরান।

রাজি হয়ে মাথা নাড়ল বেইটা আর সে শুধু হাসি মুখে তাকিয়ে রইল।

এমনকি দ্বিতীয়বার তাকিয়েও বেইটাকে গড়পড়তা মেয়েদের মতো সুন্দরী বলা যাবে না-এটা টোরানকে স্বীকার করতেই হবে। মসৃণ চৰ্চকে কালো চুল। মুখ কিছুটা প্রশস্ত। কিন্তু মেহগনি রঙের চোখদুটো হাসছে সবসময়, ঘন ভুরু সে দুটোকে আলাদা করে রেখেছে ফর্সা মসৃণ কপাল থেকে।

তার জীবনবোধ দৃঢ় এবং কঠোর বাস্তবমুখী, তারপরেও হৃদয়ের এক কোণায় ধারণ করে রেখেছে ভালবাসার উষ্ণ প্রস্রবণ, খোঁচা মেরে যা কখনো বের করে আনা যাবে না। শুধু জানতে হবে সেই প্রস্রবণে পৌঁছানোর সঠিক উপায়।

অপ্রয়োজনেই কিছুক্ষণ কন্ট্রোলগুলো নাড়ল টোরান, তারপর বসল আয়েশ করে। আর মাত্র একটা ইন্টারস্টেলার জাম্প এবং বহু মিলিমাইক্রো পারসেক সোজা পথে এগোনোর পর ম্যানুয়ালি চালাতে হবে। চেয়ারের পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা হেলিয়ে স্টোররুমের দিকে তাকাল সে, বেইটা সেখানে অভ্যস্ত হাতে ডিনারের ব্যবস্থা করছে।

বেইটার প্রতি তার আচরণ অনেকটা যুদ্ধজয়ী সৈনিকের মতো-কারণ,তিন বছরের সীমাহীন হীনম্মন্যতা থেকে সে বেরিয়ে আসতে পেরেছে বিজয়ীর মতো।

সে একজন প্রভিন্সিয়াল-শুধু তাই নয় একজন দলত্যাগী বণিকের সন্তান। আর বেইটা খোদ ফাউণ্ডেশন-এর নাগরিক-শুধু তাই নয় হোবার ম্যালোর বংশধর।

এসব কারণেই অস্বস্তি বোধ করছে। হেভেনের মতো একটা পাথুরে বিশ্ব যার শহরগুলো সব পাহাড়ের গুহার ভেতর-যেগুলোকে বলা হয় কেভ সিটি-সেখানে নিয়ে আসা যথেষ্ট খারাপ। ফাউণ্ডেশন-এর প্রতি বণিকদের আক্রোস-অত্যাধুনিক নগরবাসীদের প্রতি তাদের চরম ঘৃণার মুখোমুখি তাকে দাঁড় করানোটা হচ্ছে জঘন্য।

কিন্তু কিছু করার নেই-সাপারের পরেই, শেষ জাম্প।

হেভেনকে মনে হচ্ছে টকটকে লাল আগুনের গোলা, এবং দ্বিতীয় গ্রহটার অর্ধেক মনে হচ্ছে জোড়াতালি দেওয়া আলোর বৃত্ত, কিনারা দিয়ে বায়ুমণ্ডলের আভা বেরিয়ে আসছে, বাকি অর্ধেক অন্ধকার। সামনে ঝুঁকে ভিউটেবলের দিকে তাকাল বেইটা, সেখানে মাকড়সার জালের মতো অনেক রৈখার মাঝখানে হেভেন দুই এর চমৎকার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।

“প্রথমে তোমার বাবার সাথে দেখা করতে চাই,” গম্ভীর গলায় বলল সে। “যদি তিনি আমাকে পছন্দ না করেন—”

“তা হলে,” নিরাসক্ত গলায় বলল টোরান, “তুমিই হবে প্রথম সুন্দরী মহিলা যে তার মনে এই ধারণা তৈরি করবে। একটা হাত খোয়ানোর আগে এবং গ্যালাক্সি চষে বেড়ানো থামানোর আগে বাবা-নিজেই জিজ্ঞেস করো, কানের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। এক সময় আমি মনে করতাম সব বানিয়ে বলছে। কারণ একই গল্প কখনো দ্বিতীয়বার বলার সময় ঠিক আগের মতো করে বলত না।”

হেভেন দুই দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। নিচে ভূমি বেষ্টিত সাগর মনে হচ্ছে ভারী ফিতার মতে, নিচের ধূসর বর্ণ হালকা হতে হতে একসময় হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে, ছেঁড়াখোঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে উপকূলবর্তী পাহাড়ের চূড়া।

আরো কাছে এগিয়ে যাওয়াতে সাগরের ঢেউ পরিষ্কার হল, শেষ মাথায় বিলীন হয়ে গেছে দিগন্তের ওপারে, বাঁক নেওয়ার সময় ভূমি আঁকড়ে থাকা বরফের মাঠ দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।

তীব্র গতি ধীরে ধীরে কমে আসার ফলে প্রবল ঝাঁকুনি সহ্য করতে হচ্ছে যাত্রীদের। দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল টোরান, “তোমার স্যুট ঠিকমতো লক করা হয়েছে?”

গায়ের চামড়ার সাথে সেটে থাকা ইন্টারনালি হিটেড পোশাকের আর্দ্রতা শোষক স্পঞ্জ এর কারণে বেইটার সুঢৌল মুখমণ্ডল আরো ফোলা ফোলা এবং রুক্ষ্ম মনে হল।

মালভূমির ঠিক উপরেই একটা সমতল খোলা জায়গায় মহাকাশযান অবতরণ করল ঝরে যাওয়া পাতার মতো।

আউটার গ্যালাকটিক রাতের অস্বস্তিকর নিকষ কালো অন্ধকারে বেরিয়ে এল যাত্রীরা। প্রচণ্ড শীত আর ঠাণ্ডা বাতাসে হাঁপাতে লাগল বেইটা। তার একটা বাহু ধরে টোরান সংকীর্ণ মসৃণ পথ বেয়ে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল দূরের এক সারি কৃত্রিম আলোর দিকে।

অর্ধেক পথ যাওয়ার পরেই মোলাকাত হল এগিয়ে আসা গার্ডদের সাথে। ফিসফিস করে কিছু বাক্য বিনিময়ের পরেই নিয়ে যাওয়া হল তাদের। ভেতরে ঢোকার পর পিছনে পাথুরে দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই দূর হয়ে গেল শীত আর ঠাণ্ডা বাতাস। ভেতরটা উষ্ণ, দেয়ালের আলোয় সাদাটে ভাব, বেসুরো গুনগুন শব্দে ভারী হয়ে আছে বাতাস। ডেস্কের লোকগুলো হাতের কাজ রেখে চোখ তুলে তাকাল, নিজেদের কাগজপত্র এগিয়ে দিল টোরান।

এক ঝলক দেখেই হাত নেড়ে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল তাদের। স্ত্রীর কানে ফিসফিস করল টোরান, “বাবা সম্ভবত আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। পাঁচ ঘণ্টার আগে ছাড়া পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার।”

তাড়াহুড়ো করে ভোলা জায়গায় বেরিয়েই বেইটা থমকে দাঁড়াল। বিষ্ময়াভিভূত সুরে বলল, “ওহ মাই–”

দিনের আলোয় ভেসে যাচ্ছে কেভ সিটি-নবীন সূর্যের সাদাটে দিনের আলো। যদিও আসলে কোনো সূর্য নেই। যে জায়গায় আকাশ থাকতে পারত সেখানটা অসম্ভব উজ্জ্বল, তাকানো যায় না। সঠিক ঘনত্বের উষ্ণ বাতাসে সবুজ উদ্ভিদের সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।

“টোরান, কী চমৎকার।”

উদ্বেগ পুরোপুরি না কাটলেও কিছুটা উৎফুল্ল হয়ে দাঁত বের করে হাসল টোরান। “আসলে বে, ফাউণ্ডেশন-এর সাথে কোনো তুলনাই চলে না, কিন্তু এটা হেভেন দুই এর সবচেয়ে বড় শহর-জনসংখ্যা বিশ হাজার-তোমার ভালো লাগবে। যদিও বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই, অন্যদিকে গুপ্ত পুলিশের ঝামেলাও নেই।”

“ওহ্ টোরি, আমার কাছে খেলনা নগরীর মতো মনে হচ্ছে। পুরোটাই সাদা আর গোলাপি-আর কত পরিষ্কার।”

টোরান ও শহর দেখতে লাগল। অধিকাংশ ঘরবাড়ি দোতলা এবং স্থানীয় মসৃণ পাথর দিয়ে তৈরি। ফাউণ্ডেশন-এর মতো মোচাকৃতি চূড়া অনুপস্থিত এখানে, নেই ওল্ড কিংডমের মতো বিশাল কমিউনিটি হাউজ-কিন্তু নিজস্ব স্বকীয়তা রয়েছে।

মনযোগ আকর্ষণের জন্য হঠাৎ বেইটার হাত ধরে টানল সে। “বে-ওই যে বাবা! ওখানে-আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। তুমি দেখছ না?”

এখান থেকেই মনে হল মানুষটা বিশালদেহী, পাগলের মতো হাত নাড়ছে, আঙুলগুলো ছড়ানো যেন বাতাস খামচে ধরবে। বজ্রের মতো গমগমে গলার চিৎকার পৌঁছল তাদের কানে। একটা লনের উপর দিয়ে স্বামীকে অনুসরণ করছে বেইটা। ছোটখাটো একজন মানুষের উপর চোখ পড়ল তার, চুল সাদা, বিশালদেহী প্রথমজন যে এখনো চিৎকার করছে আর হাত নাড়ছে তার একটা বাহুর আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে দ্বিতীয়জন।

কাঁধের উপর দিয়ে চিৎকার করল টোরান, “উনি হলেন বাবার হাফ ব্রাদার। ফাউণ্ডেশনে ছিলেন।”

ঘাসের উপর দুই দল মিলিত হল, হাসছে উম্মাদের মতো। টোরানের বাবা একটা শেষ চিৎকার দিয়ে সীমাহীন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা থামাল। হেঁচকা টান মেরে খাটো জ্যাকেটের চেইন লাগাল তারপর নকশা খোদাই করা ধাতুর তৈরি বেল্ট ঠিক করে নিল! এই দুটোই তার একমাত্র বিলাসিতা।

পালাক্রমে দুজনের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “বাড়ি ফেরার জন্য একটা বাজে দিন বেছে নিয়েছ, বয়!”

“কী! ওহ সেলডনের জন্মদিন, তাই না?”

“হ্যাঁ। এখানে আসার জন্য গাড়ি ভাড়া করতে হয়েছে আর চালানোর জন্য আনতে হয়েছে ড্রাগুন রাকে।”

এবার চোখ পড়ল বেইটার উপর আর সরল না, আরো নরম সুরে বলল, “ক্রিস্টাল সাথে এনেছি-চমৎকার হয়েছে, কিন্তু বুঝতে পারছি ছবি যে তুলেছে সেই ব্যাটা কোনো কম্মের না।”

জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা স্বচ্ছ কিউব বের করল সে, আলোর স্পর্শ পেয়ে ভেতরের হাস্যোজ্জ্বল ছোট মুখাবয়ব জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল নানা বর্ণে, যেন জীবন্ত বেইটার ক্ষুদে সংস্করণ।

“এটা!” বলল বেইটা। “এখন বুঝতে পারছি টোরান ছবিটা কেন পাঠিয়েছিল। খুব অবাক হয়েছি আপনি আমাকে কাছে আসতে দিয়েছেন দেখে, স্যার।”

“এসে পড়েছ? আমাকে ফ্র্যান ডাকতে পারো। আমার কোনো শুচিবাই নেই। তাই আমার হাত ধরে গাড়িতে উঠতে পারো। আজকের আগে কখনো বুঝতে পারিনি আমার ছেলে কিসের পেছনে ছুটছে। বোধহয় সেই ধারণা পাল্টানো উচিত। নাহ্, অবশ্যই পাল্টাতে হবে।”

টোরান তার হাফ আংকেলকে নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, “বুড়োর দিন কেমন কাটছে আজকাল? এখনো মেয়েদের পেছনে দৌড়ায়?”

রাণু যখন হাসে তখন তার মুখে অসংখ্য ভাঁজ পড়ে। “যখনই সময় পায়, টোরান, যখনই সময় পায়। মাঝে মাঝে মনে পড়ে যে আগামী জন্মদিন হবে ষাটতম, তখন মুষড়ে পড়ে। কিন্তু হৈহুল্লোড়ে মেতে থেকে এই ভাবনা উড়িয়ে দেয়। ও হচ্ছে সেকেলে ধরণের বণিক। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা কী, টোরান। এই চমৎকার মেয়েটাকে তুমি কোথায় খুঁজে পেলে?”

তরুণ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বৃদ্ধের বাহু নিজের হাতের ভাজে আটকে নিল। “তুমি তিন বছরের পুরো গল্পটা একবারে শুনতে চাও, আংকেল?

বাড়ির ছোট লিভিংরুমে ঢুকে বেইটা হাতের বোঝা নামিয়ে রেখে চুলের বাঁধন আলগা করে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশ করে বসল। তারপর আন্তরিক ভঙ্গিতে তাকাল বিশালদেহী স্বাস্থ্যবান বৃদ্ধের দিকে।

“বুঝতে পারছি আপনি কী হিসাব করছেন। আমি সাহায্য করছি।” সে বলল। বয়স, চব্বিশ, উচ্চতা পাঁচ ফুট চার, ওজন একশ দশ, শিক্ষাক্ষেত্র ইতিহাস।” সে খেয়াল করে দেখেছে নিজের খোয়া যাওয়া হাতটা গোপন রাখার জন্য বৃদ্ধ একটু তেড়ছাভাবে দাঁড়ায়।

কিন্তু এবার আরো কাছে এসে সামনে ঝুঁকে বলল, “যেহেতু তুমি বললে তাই বলছি-ওজন, একশ বিশ।”

বেইটার লজ্জায় আরক্তিম মুখ দেখে গলা ছেড়ে হেসে উঠল সে। তারপর সবাইকে উদ্দেশ করে বলল, “মেয়েদের বাহুর উপরের অংশ দেখে তাদের ওজন বলতে পারবে-তবে সেজন্য অবশ্যই যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। তুমি কিছু পান করবে, বে?”

“সাথে আরো অনেক কিছু,” বলল বেইটা, তারপর দুজন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, টোরান তখন বুক শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন কোনো এডিশন আছে কিনা দেখছে।

ফ্র্যান ফিরে এল একা, “ও আসছে কিছুক্ষণ পর।”

বিশাল কর্ণার চেয়ারে দড়াম করে বসল সে, পা তুলে দিল সামনের টেবিলের উপর। লালমুখে এখনো হাসি লেগে আছে, এবং তার মুখোমুখি হওয়ার জন্য ঘুরল টোরান।

“বেশ, তুমি ফিরে এসেছে, বয়, সেজন্য আমি খুশি,” বলল ফ্র্যান, “তোমার বান্ধবীকে আমার পছন্দ হয়েছে, ছিচকাঁদুনে শহরে ননীর পুতুল নয় সে।”

“আমি তাকে বিয়ে করেছি।” স্বাভাবিক গলায় বলল টোরান।

“বেশ, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।” তার দৃষ্টি কিছুটা মলিন হল। “এভাবে নিজের ভবিষ্যৎ বেঁধে ফেলা বোকামি, দীর্ঘ অভিজ্ঞ জীবনে আমি কখনো এধরনের কাজ করিনি।”

রাণু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের কোণায়, সেখান থেকেই আলোচনায় যোগ দিল। “কী ব্যাপার ফ্র্যানসাট, এটা কী ধরনের তুলনা? ছয় বছর পূর্বে ক্র্যাশ ল্যাণ্ডিংএর সময় বিয়ে করার জন্য তোমার কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। আর করতে চাইলেও কে রাজি হত?”

এক হাতঅলা লোকটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা হয়ে বসল, উম্মার সাথে বলল, “অনেকেই রাজি হত, ব্যাটা নির্বোধ–”

ঝগড়া থামানোর উদ্দেশ্যে দ্রুত বলল টোরান, “বাবা, এটা একটা লিগ্যাল ফরমালিটি। অনেক সুবিধা আছে।”

“তার বেশিটাই মেয়েদের পক্ষে,” বিড় বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করল ফ্র্যান।

“তা ঠিক,” একমত হল রাণু, “তারপরেও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক তোমার ছেলে। বিয়ে ফাউণ্ডেশনারদের একটা পুরোনো রীতি।”

“সৎ বণিকরা ফাউণ্ডেশনারদের কোনো আদর্শ হিসেবে মনে করে না।”

আবার বাধা দিল টোরান, “আমার স্ত্রী একজন ফাউণ্ডেশনার।” পালাক্রমে তাকাল দুজনের দিকে, তারপর শান্তভঙ্গিতে বলল, “ও আসছে।”

খানাপিনার পর আলোচনা মোড় নিল সাধারণ কথাবার্তায়। খুন-জখম, মেয়েমানুষ, অর্থ ইত্যাদি উপাদেয় মশলা মিশিয়ে মনোমুগ্ধকর ভঙ্গিতে পুরোনো দিনের তিনটা গল্প শোনালো ফ্র্যান। ছোট টেলিভাইজরটা চালানো, কোনো একটা ক্লাসিক ড্রামা চলছে, কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে নিচু ভলিউমে শব্দ করে চলেছে। রাণু নিচু বিছানায় আরাম করে শুয়ে অলস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পাইপ থেকে বেরোনো ধোয়ার দিকে। ফারের তৈরি সাদা একটা মোলায়েম গালিচায় হাঁটু গেড়ে বসেছে বেইটা। অনেক দিন আগে একটা ট্রেড মিশনে গিয়ে গালিচাটা এনেছিল ফ্র্যান। এখন শুধু বিশেষ উৎসবের দিনেই এটা বের করা হয়।

“তুমি ইতিহাস নিয়ে পড়ালেখা করেছ, মাই গার্ল?” আমুদে গলায় জিজ্ঞেস করল রাণু।

মাথা নাড়ল বেইটা। “আমার ব্যাপারে শিক্ষকরা ছিলেন হতাশ। তবে সামান্য হলেও শিখতে পেরেছি।”

“একটা স্কলারশিপ,” আত্মপ্রসাদের সুরে বলল টোরান, “ব্যস এইটুকুই।”

“তুমি কতদূর শিখেছ?” আলোচনা চালু রাখার জন্য বলল রাণু।

“বলা যায় প্রায় সবকিছু।” হাসল বেইটা।

বৃদ্ধও জবাবে চমৎকার ভঙ্গিতে হাসল, “বেশ, গ্যালাকটিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে তোমার কী মনে হয়?”

“আমার ধারণা,” সংক্ষিপ্ত জবাব দিল বেইটা,” একটা সেলডন ক্রাইসিস অমিমাংসিত রয়ে গেছে-এবং যদি সেটা সত্যি হয় তা হলে সেলডন প্ল্যানও একই সাথে ক্ষগ্রিস্থ হয়েছে। এটা আমাদের একটা ব্যর্থতা।”

(“ফুহ্,” নিজের কোণা থেকে ফিসফিস করল ফ্র্যান। সেলডন সম্পর্কে কথা বলার কী ছিরি। তবে কাউকে শোনানোর মতো জোরে কিছু বলল না।)

চিন্তিত ভঙ্গিতে পাইপে কয়েকটা টান মেরে ধোয়া ছেড়ে রাণু বলল, “তাই? এরকম মনে হওয়ার কারণ কী? তরুণ বয়সে আমিও ফাউণ্ডেশনে ছিলাম, তখন আমিও অনেক রোমান্টিক নাটকীয় চিন্তাভাবনা করেছি। কিন্তু তোমার এখন এই ধারণা হল কেন?”

“আসলে,” গভীর চিন্তায় বেইটার দৃষ্টি আচ্ছন্ন, গালিচার নরম পশমের ভিতর নগ্ন গোড়ালি ডুবিয়ে একহাতের তালুর উপর চিবুক রাখল সে, “আমার মনে হয়েছে যে সংক্ষেপে সেলডন প্ল্যানের মুখ্য উদ্দেশ্য হল প্রাচীন গ্যালাকটিক এম্পায়ারের তুলনায় আরো আধুনিক এবং উন্নত একটা বিশ্ব গড়ে তোলা। তিন শতাব্দী পূর্বে যখন সেলডন ফাউণ্ডেশন তৈরি করেন তখন এই বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল-এবং ইতিহাসে যদি সত্যি কথা বলা হয়ে থাকে, এই ধ্বংসের মূল কারণ ছিল তিনটা-অভ্যন্তরীণ জড়তা, স্বৈরতন্ত্র এবং মহাবিশ্বের সম্পদসমূহের অসম বণ্টন।”

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রাণ্ডু আর টোরান গর্ব আর অহংকার নিয়ে তাকিয়ে আছে স্ত্রীর দিকে, ফ্র্যান জিভ দিয়ে শব্দ করে যত্নের সাথে নিজের গ্লাসে পানীয় ঢালতে লাগল।

বেইটা বলে চলেছে, “সেলডনের গল্প যদি সত্যি হয় তা হলে বলা যায় তিনি তার সাইকোহিস্টোরির নীতির সাহায্যে এম্পায়ারের সম্পূর্ণ পতন এবং মানবজাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নতুন সেকেণ্ড এম্পায়ার গড়ে তোলার পূর্বে ত্রিশ হাজার বছর স্থায়ী বর্বরযুগের অনুমান করতে পেরেছিলেন, তার সারাজীবনের কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল যেন দ্রুতগতিতে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায় সেটা নিশ্চিত করা।”

ফ্র্যান এর গমগমে কণ্ঠস্বর বিস্ফোরণের মতো আছড়ে পড়ল, “আর তাই তিনি দুটো ফাউণ্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।”

“আর তাই তিনি দুটো ফাউণ্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন,” পুনরাবৃত্তি করল বেইটা। “আমাদের ফাউণ্ডেশন তৈরি করা হয় মূমুর্মু এম্পায়ার এর বিজ্ঞানীদের নিয়ে যাদের উদ্দেশ্য ছিল অর্জিত জ্ঞান এবং বিজ্ঞান সংরক্ষণ করে মানুষের প্রয়োজনে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মহাকাশে ফাউণ্ডেশন-এর অবস্থান এবং ঐতিহাসিক পরিবেশ এমন ছিল যে সতর্কতার সাথে মেধা ও মননশীলতার প্রয়োগ করে সেলডন অনুমান করেছিলেন যে এক হাজার বছরের মধ্যে এটা নতুন এবং আরো উন্নত বিশাল একটা এম্পায়ারে পরিণত হবে।”

বিস্ময় এবং শ্রদ্ধায় নিশ্চুপ হয়ে আছে সবাই।

আবার শুরু করল বেইটা, “পুরোনো গল্প। আপনারা সবাই জানেন। প্রায় তিন শতাব্দী ধরে ফাউণ্ডেশন-এর প্রত্যেকেই গল্পটা জানে। তবুও আমার মনে হয়েছিল যে সংক্ষেপে আরেকবার বলে নেওয়া দরকার। আজকে সেলডনের জন্মদিন, আমি ফাউণ্ডেশনার, আপনারা হেভেন এর বাসিন্দা, অথচ এই ক্ষেত্রে আমাদের মিল আছে-”

সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্কভাবে ধোয়ার দিকে তাকিয়ে আছে বেইটা। “ইতিহাসের নিয়ম পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মের মতোই অকৃত্রিম, এবং ভুলের সম্ভাবনা যদি বেশি হয় তার কারণ হচ্ছে পদার্থ বিজ্ঞান যতসংখ্যক এটম নিয়ে কাজ করে ইতিহাস তত সংখ্যক মানুষ নিয়ে কাজ করে না, তাই ইণ্ডিভিজুয়াল ভেরিয়েশন্স অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক হাজার বছরের অগ্রগতির মাঝে সেলডন ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো ক্রাইসিস অনুমান করে রেখেছেন যার প্রতিটি ইতিহাসকে নতুন পথে মোড় নিতে বাধ্য করে। এই ক্রাইসিস গুলোই আমাদের পরিচালিত করছে-তাই এখন অবশ্যই একটা ক্রাইসিস তৈরি হতে বাধ্য।”

এবার গলায় জোর এনে বলতে লাগল সে “সর্বশেষ ক্রাইসিসের পর প্রায় এক শতাব্দী পেরিয়ে গেছে, এবং সেই শতাব্দীতেও এম্পায়ারের প্রতিটা ব্যধির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ফাউণ্ডেশনে। অভ্যন্তরীণ জড়তা! আমাদের শাসক শ্রেণী একটা আইন জানে: নো চেঞ্জ। স্বৈরতন্ত্র! তারা শুধু একটা নিয়ম জানে: বল প্রয়োগ। সম্পদের অসম বণ্টন! তাদের শুধু একটাই আকাক্ষা; সবকিছু গ্রাস করে নেওয়া।

“আর সবাই না খেয়ে মারা যাক!” গর্জে উঠল ফ্র্যান সেই সাথে বিশাল থাবা দিয়ে ওজনদার ঘুষি মারল চেয়ারের হাতলে। “গার্ল, তোমার প্রতিটা শব্দ একেকটা মুক্তোর দানা। ওদের পেট মোটা মানিব্যাগ ফাউণ্ডেশন ধ্বংস করে দিচ্ছে, যেখানে সাহসী বণিকরা হেভেনের মতো গ্রহের পাথরের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছে নিজেদের অভাব অনটন। সেলডনের কী চরম অপমান, তার মুখে কাঁদা ছুঁড়ে মারার মতো, তার দাড়িতে বমি করার মতো অপমান।” উত্তেজিত হয়ে একমাত্র হাতটা উঁচু করল সে, তারপর কষ্টের ছাপ পড়ল মুখে। “যদি আমার অন্য হাতটা থাকত। যদি-একবারের জন্য ফিরে পেতাম-সবাই আমার কথা শুনত!”

“বাবা,” বলল টোরান, “শান্ত হও।”

“শান্ত হও। শান্ত হও।” তার বাবা হিংস্র ভঙ্গিতে মুখ ভেংচালো। “আমরা এখানে পচে গলে মরব-আর উনি বলছেন শান্ত হও।”

“ও হল আমাদের আধুনিক লাথান ডেভর্স, পাইপ উচিয়ে বলল রাণু, “আমাদের এই ফ্র্যান। ডেভর্স আশি বছর আগে তোমার স্বামীর পরদাদার সাথে খনিতে মারা যায়, কারণ তার বিচক্ষণতা না থাকলেও হৃদয় ছিল।”

“হ্যাঁ,বাই দ্য গ্যালাক্সি, ওর জায়গায় আমি থাকলেও একই কাজ করতাম,” শপথ বাক্য আওড়ালো ফ্র্যান। “ডেভর্স ছিল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বণিক-অতিরিক্ত প্রশংসা করে বাতাস ভর্তি ব্যাগের মতো ফোলানো ফাউণ্ডেশন-এর পরম পূজনীয় ম্যালোর থেকেও বড় মাপের। গলা কাটা খুনীর দল যারা ফাউণ্ডেশন চালায় তারা যদি ওকে খুন করে থাকে তা হলে চরম মূল্য দিতে হবে।”

“তুমি আলোচনা চালিয়ে যাও, গার্ল,” বলল রাণ্ডু। নইলে সারারাত বকবক করবে আর ওর পাগলামির ঠেলায় মাটি হবে কালকের দিনটা।”

“আর কিছু বলার নেই,” হতাশ সুরে বলল বেইটা। “একটা ক্রাইসিস তৈরি হতে বাধ্য, কিন্তু কিভাবে তৈরি হবে আমি জানি না। ফাউণ্ডেশনে প্রগতিশীল শক্তি বিপজ্জনকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বণিকদের হয়তো সদিচ্ছা আছে কিন্তু তারা কোণঠাসা আর বিচ্ছিন্ন। যদি ফাউণ্ডেশন-এর ভিতরের বাইরের সব সদিচ্ছা গুলোকে একত্রিত করা যেত–”

বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে কর্কশ সুরে হেসে উঠল ফ্র্যান, “ওর কথা শোন, রাণু, ওর কথা শোন। বলছে ফাউণ্ডেশন-এর ভিতরে বাইরে। গার্ল, গার্ল, ফাউণ্ডেশন-এর কোনো আশা নেই। তাদের অল্প কয়েকজনের হাতে আছে চাবুক বাকিরা চাবুকের আঘাতে জর্জরিত। ভালো একজন বণিকের মুখোমুখি হওয়ার মতো তেজ ওই ঘুণে ধরা গ্রহের নেই।”

কথার প্রবল স্রোতে বেইটার বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।

সামনে ঝুঁকে তার মুখে হাত চাপা দিল টোরান। “বাবা,” ঠাণ্ডা সুরে বলল সে, “তুমি কখনো ফাউণ্ডেশনে যাওনি। তুমি কিছুই জান না। আমি জানি ভেতরে ভেতরে তারা যথেষ্ট সাহসী এবং বেইটা তাদেরই একজন।”

“অল রাইট, বয়, নো অফেন্স। রাগ করার কী আছে?” সে সত্যিই উত্তেজিত।

আন্তরিক সুরে বলতে লাগল টোরান, “বাবা তোমাকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে সবকিছু তুমি বিচার করো প্রভিন্সিয়াল দৃষ্টিভঙ্গিতে। তুমি মনে করো কয়েক লাখ বণিক গ্যালাক্সির নিঃসীম শূন্যের শেষপ্রান্তে হারিয়ে যাওয়া অবাঞ্চিত এক গ্রহের খানাখন্দে ছুটে বেড়ায় বলেই তারা সাহসী যোদ্ধা। ফাউণ্ডেশন থেকে কর সংগ্রহের জন্য যারা আসে অবশ্যই তারা আর কখনো ফিরতে পারেনা, কিন্তু সেটা সস্তা নাটকীয়তা। যদি ফাউণ্ডেশন পুরো একটা ফ্লিট পাঠায়। তখন?”

“আমরা ওদের উড়িয়ে দেব?” ধারালো গলায় জবাব দিল ফ্র্যান।

“নিজেরাও উড়ে যাবে-লাভ হবে ওদের। তোমরা সংখ্যায় কম, তোমাদের অস্ত্র কম, তোমরা অসংগঠিত-ফাউণ্ডেশন হামলা করলেই বুঝতে পারবে। তোমাদের মিত্র খুঁজে বের করতে হবে-সম্ভব হলে ফাউণ্ডেশন-এর ভিতরে।”

“রাণ্ডু,” বলল ফ্র্যান, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে একটা অসহায় ষাঁড়ের মতো।

মুখ থেকে পাইপ সরাল রাণু “ছেলেটা ঠিকই বলেছে, ফ্র্যান। মনের গভীরে যে চিন্তাগুলো লুকিয়ে আছে সেগুলো ভাবলেই বুঝতে পারবে যে ও ঠিকই বলেছে। কিন্তু চিন্তাগুলো সব কষ্টকর এবং হতাশাজনক। তাই তর্জন গর্জন করে সেগুলো ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চাও। কিন্তু ওগুলো তোমার মনের ভেতরেই আছে। টোরান আমি সব খুলে বলছি।”

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ধূমপান করল সে, তারপর ট্রের কোণায় পাইপটা বাড়ি দিয়ে ছাই ফেলে অপেক্ষা করতে লাগল ফ্ল্যাশ এর জন্য। পরিষ্কার পাইপ তুলে নিয়ে ছোট আঙুল দিয়ে টিপে টিপে তামাক ভরল আবার।

“আমাদের প্রতি ফাউণ্ডেশন-এর আগ্রহ নিয়ে তুমি যা বলেছ টোরান,” কথা শুরু করল সে, “পুরোপুরি ঠিক। সাম্প্রতিক সময়ে পরপর দুইবার কর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এসেছিল ওরা, বিপদের কথা হচ্ছে দ্বিতীয়বার যে এসেছিল তার সাথে ছিল একটা লাইট ট্রেলশিপ। ল্যান্ড করেছিল গ্লেয়ার সিটিতে আমাদের বুঝিয়েছিল যে মেরামতের জন্য নেমেছে-এবং স্বাভাবিকভাবেই তাদের আর ফিরতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এবার তারা ব্যাপক শক্তি নিয়ে ফিরে আসবে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার বাবা তা ভালোভাবেই জানে টোরান, সত্যি জানে।

“জেদি লোকটার দিকে তাকাও। সে জানে হেভেনের সামনে ভীষণ বিপদ এবং আমরা অসহায়, কিন্তু,সে নিজের ফরমুলার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। এটা তাকে ভিতরের দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা করে। কিন্তু নিজের কথা বলা হয়ে গেলে, তর্জন গর্জন করে অবজ্ঞা প্রকাশের পর যখন বুঝতে পারে যে একজন মানুষ এবং একজন বণিক হিসেবে তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে তখন সে আমাদের বাকিদের থেকে অনেক বেশি যুক্তিশীল।”

“বাকিরা কারা?” জিজ্ঞেস করল বেইটা।

তার দিকে তাকিয়ে মধুর ভঙ্গিতে হাসল বৃদ্ধ। “আমরা ছোট একটা সংগঠন তৈরি করেছি বেইটা-শুধু আমাদের শহরে। এখনো তেমন কিছু করতে পারিনি, অন্যান্য শহরের সাথেও যোগাযোগ করতে পারিনি, কিন্তু এটা একটা সূচনা।”

“কিন্তু কী অর্জন করতে চান?” মাথা নাড়ল রাণু। “আমরা এখনো জানি না। শুধু অলৌকিক কিছু ঘটার আশা করছি। তোমার মতো আমরাও বুঝতে পেরেছি যে একটা সেলডন ক্রাইসিস তৈরি হতে যাচ্ছে।” দুহাত তুলে উপরে দেখাল সে। “গ্যালাক্সি ভরে আছে বিচ্ছিন্ন এম্পায়ারের ভাঙা টুকরায়। চতুর্পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে জেনারেলরা। তোমার কী মনে হয় তাদের কেউ হঠাৎ করে দুঃসাহসী এবং উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠতে পারে?

প্রশ্নটা বিবেচনা করল বেইটা, তারপর মাথা নাড়ল দৃঢ় ভঙ্গিতে, ফলে মসৃণ কালো চুল সামনে এসে কান ঢেকে দিল। “না, কোনো সম্ভাবনা নেই। ওই জেনারেলদের প্রত্যেকেই জানে ফাউণ্ডেশনে হামলা করা মানে আত্মহত্যা। বেল রিয়োজ ছিলেন তাদের ভেতর সবচেয়ে দক্ষ, আর তিনি আক্রমণ করেছিলেন পুরো গ্যালাক্সির শক্তি নিয়ে, কিন্তু সেলডন প্ল্যানের বিরুদ্ধে জিততে পারেননি। এমন কোনো জেনারেল আছে যে এটা জানে না।”

“কিন্তু আমরা যদি তাদের প্ররোচিত করি, চালিত করি?”

“কোথায়? এটমিক ফারনেসে? কী দিয়ে তাদেরকে প্ররোচিত করবেন?”

“বেশ, একজন আছে-নতুন একজন। গত দু-এক বছর ধরে অদ্ভুত এক লোকের কথা শোনা যাচ্ছে, সবাই তাকে ডাকে মিউল নামে।”

“মিউল? “ চিন্তা করল কিছুক্ষণ। “কখনো শুনেছ, টোরি?”

মাথা নাড়ল টোরান, বেইটা বলল, “খুলে বলুন।”

“সবটা আমিও জানি না। তবে লোকমুখে শোনা যায় সে নাকি অসম্ভব এবং অদ্ভুত উপায়ে যুদ্ধে জয়লাভ করছে। হয়তো গুজব, যাই হোক না কেন তার সাথে যোগাযযাগ করতে পারলে বোধহয় লাভ হবে। যাদের সীমাহীন দক্ষতা এবং সীমাহীন উচ্চাকাঙ্খ আছে তারা হ্যারি সেলডন এবং তার সাইকোহিস্টোরি বিশ্বাস নাও করতে পারে। আমরা সেই অবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দেব। ফলে সে হয়তো আক্রমণ করবে।”

“এবং ফাউণ্ডেশন জয়ী হবে।”

“হ্যাঁ-কিন্তু খুব একটা সহজ হবে না। এটা একটা ক্রাইসিস হতে পারে, এবং পরিস্থিতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমরা ফাউণ্ডেশন-এর স্বৈরশাসকদের সাথে একটা সমঝোতা করতে পারি। নিদেন পক্ষে দীর্ঘ সময়ের জন্য তারা আমাদের কথা ভুলে যেতে বাধ্য হবে এবং আমরা আমাদের পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।”।

“তোমার কী মনে হয়, টোরি?”

ফ্যাকাশে ভাব নিয়ে হাসল টোরান, এক গোছা বাদামি চুল সরাল চোখের উপর থেকে। “যেভাবে বলছে তাতে তো মনে হয় কোনো বিপদ হবে না; কিন্তু কে এই মিউল? তার ব্যাপারে কী জানো, রাণু?”।

“এখনো কিছুই জানি না। সেই উদ্দেশ্যে তোমাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি, টোরান। এবং তোমার স্ত্রীকে, যদি তার আপত্তি না থাকে। এ ব্যাপারে আমরা কথা বলেছি, আমি আর তোমার বাবা। এ ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত কথা বলেছি।”

“কীভাবে রা? তুমি আমাদের কাছে কী চাও?” তরুণ দ্রুত কৌতূহলী দৃষ্টি হানল স্ত্রীর দিকে।

“তোমাদের হানিমুন হয়েছে?”

“উমম–হ্যাঁ–যদি ফাউণ্ডেশন থেকে হেভেনে আসার ট্রিপটাকে বিবেচনায় ধরো।”

“কালগানে আরো ভালো একটা হানিমুন হলে কেমন হয়? সেমি ট্রপিক্যাল-সমুদ্র সৈকত-ওয়াটার স্পোর্টস-পাখি শিকার-ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা। এখান থেকে সাত হাজার পারসেক-খুব বেশি দূরে না।”

“কালগানে কী আছে?”

“মিউল! বা অন্তত তার কোনো লোক। সে এটা দখল করেছে গত মাসে এবং বিনা লড়াইয়ে, যদিও কালগানের ওয়ারলর্ড হুমকি দিয়ে প্রচার করেছিল যে আত্মসমর্পণ করার আগে সে পুরো গ্রহ আয়োনিক ধুলায় মিশিয়ে দেবে।”

“সেই ওয়ারলর্ড এখন কোথায়?”

“নেই,” শ্রাগ করল রাণু। “কী বলল তোমরা?”

“কিন্তু আমরা কী করব?”

“আমি জানি না। ফ্র্যান আর আমার বয়স হয়েছে। আমরা প্রভিন্সিয়াল। হেভেনের সব বণিকই প্রভিন্সিয়াল । আমাদের বাণিজ্য সীমিত আর পূর্বপুরুষদের মতো আমরা গ্যালাক্সিতে ছুটে বেড়াইনি। চুপ কর, ফ্র্যান! কিন্তু তোমরা গ্যালাক্সি ভালোভাবেই চেন। বিশেষ করে বেইটা চমৎকার ফাউণ্ডেশন বাচনভঙ্গিতে কথা বলে। শুধু আশা যে তোমরা কিছু বের করতে পারবে। যদি তোমরা যোগাযোগ করতে পারো কোনোভাবে–সেটা অবশ্য আশা করি না। ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করো। ইচ্ছা হলে দলের অন্যদের সাথেও দেখা করতে পারবে, ওহ, এক সপ্তাহের আগে হবে না। তোমাদের একটু দম ফেলার ফুরসত দেওয়া উচিত।”

সাময়িক নীরবতা, তারপর ফ্র্যান এর বজ্র গম্ভীর গলার আওয়াজ শোনা গেল, “আর কেউ কী একটা ড্রিংক নেবে? মানে আমি ছাড়াও?”

*