মহাত্মাজীর প্রতি
ভারতের জনগণ মহাত্মা গান্ধীর জীবনকথা ও তাঁর কার্য্যাবলীর সঙ্গে এত সুপরিচিত যে, আমাকে যদি তাঁর জীবনের ঘটনাবলীর কথা আবার বলতে হয়, তবে তাদের অভিজ্ঞতার অবমাননাই করা হবে। তার পরিবর্ত্তে ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে মহাত্মাজীর স্থান কোথায়, আমি শুধু তা-ই আলোচনা করব। ভারতের সেবায় এবং ভারতের স্বাধীনতা-অর্জ্জনের প্রচেষ্টায় মহাত্মা গান্ধীর অবদান এত অসামান্য ও অনুপম যে, তার জন্যে তাঁর নাম আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সর্ব্বযুগে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
ভারতের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর যে স্থান, তা বুঝতে হলে বৃটিশ কর্ত্তৃক ভারত-বিজয়ের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার। আপনারা সকলে জানেন, বৃটিশ যখন ভারতের মাটিতে পদার্পণ করল, তখন ভারতে দুধ-ভাত ছিল সচ্ছল—ভারতের ঐশ্বর্য্যই সমুদ্রের ওপারের দারিদ্র্যপীড়িত ইংরাজদের প্রলুব্ধ করেছিল। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাজনীতিক দাসত্ব ও অর্থনীতিক শোষণের ফলে ভারতের জনগণ ক্ষুধায় ও অনাহারে প্রাণত্যাগ করছে। আর যে বৃটিশ জাতি একদিন দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত ছিল, আজ তারা ভারতের ধনসমৃদ্ধিতে পরিপুষ্ট ও ঐশ্বর্য্যশালী হয়ে উঠেছে। দুঃখ ও দুর্ভোগ, দীনতা ও নিপীড়নের ভিতর দিয়ে ভারতের জনগণ শেষ পর্য্যন্ত এই শিক্ষা লাভ করেছে যে, তাদের বহু রকমের সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে তাদের হারানো স্বাধীনতার পুনরুদ্ধার সাধন।
বৃটিশ কর্ত্তৃক ভারত-বিজয়ের উপায়গুলির কথা পর্য্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, বৃটিশ ভারতের কোন অংশের সমগ্র জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রয়াসী হয় নি,—তারা একেবারে সমগ্র ভারত বিজয় এবং অধিকার করতে চেষ্টাও করেনি। তারা সামরিক কার্য্যকলাপ আরম্ভ করবার আগে সর্ব্বদাই উৎকোচ ও দুর্নীতির সাহায্যে এক শ্রেণীর লোককে করায়ত্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিল। বাংলাতেই এই ব্যাপার ঘটেছিল। সেখানে প্রধান-সেনাপতি মীরজাফরকে বাংলার মসনদ অর্পণ করে বশীভূত করা হয়েছিল। সেই সময় ভারতে ধর্ম্মগত বা সাম্প্রদায়িক সমস্যা কারও জানা ছিল না। বাংলার শেষ স্বাধীন নরপতি সিরাজদ্দৌলা মুসলমান ছিলেন; তাঁর প্রধান সেনাপতি মুসলমান হয়েও তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল এবং হিন্দু সেনাপতি মোহনলালই শেষ পর্য্যন্ত সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছিলেন। ভারতের ইতিহাসের এই ঘটনা থেকে আমরা এই শিক্ষাই লাভ করি যে, বিশ্বাসঘাতকতা রোধ করতে এবং তার শাস্তিবিধান করতে যদি যথাসময়ে ব্যবস্থা অবলম্বিত না হয়, তা হলে কোন জাতিই তার স্বাধীনতা রক্ষা করবার আশা করতে পারে না। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলার এই ঘটনাচক্র যথাসময়ে ভারতীয় জনগণের চোখ ফুটিয়ে দিতে পারে নি। এমন কি সিরাজদ্দৌলার পতনের পরেও যদি ভারতের জনগণ বৃটিশের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হত, তা হলে তারা অনায়াসেই বিদেশীদের ভারতের বুক থেকে বিতাড়িত করতে সমর্থ হত।
একথা কেউই বলতে পারবে না যে, ভারতের জনগণ তাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেনি। কিন্তু তারা সকলে মিলে একতাবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেনি। যখন বৃটিশ ভারত আক্রমণ করল, তখন কেউই তাদের পিছন থেকে আক্রমণ করেনি। পরে যখন বৃটিশ দক্ষিণ-ভারতে টিপুসুলতানের সঙ্গে যুদ্ধরত হল, তখন মধ্য-ভারতের মারাঠারা কিংবা উত্তর-ভারতের শিখরা—কেউই টিপু সুলতানের উদ্ধারের জন্য অগ্রসর হয়নি। এমন কি বাংলার পতনের পরেও দক্ষিণ-ভারতের টিপুসুলতান, মধ্য-ভারতের মারাঠাগণ ও উত্তর-ভারতের শিখরা সম্মিলিত হলে বৃটিশকে বিতাড়িত করা সম্ভব হত। আমাদের দুর্ভাগ্য, তা করা হয় নি। সুতরাং ভারতের এক এক অংশে এক একবার আক্রমণ করা এবং ক্রমান্বয়ে সমগ্র দেশে বৃটিশের প্রভুত্ব বিস্তার করা সম্ভবপর হয়েছিল। ভারতীয় ইতিহাসের এই বেদনাময় অধ্যায় থেকে আমরা শিক্ষালাভ করেছি যে, যদি শত্রুর সম্মুখে ভারতবাসীরা সম্মিলিতভাবে দণ্ডায়মান না হয়, তবে তারা কখনও স্বাধীনতা অর্জ্জন করতে পারবে না; স্বাধীনতা অর্জ্জন করলেও তারা তা রক্ষা করতে পারবে না।
ভারতীয় জনগণের চোখ ফুটতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। শেষ পর্য্যন্ত, ১৮৫৭ অব্দে ভারতের নানা অংশে তারা একযোগে বৃটিশকে আক্রমণ করল। সংগ্রাম আরম্ভের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ অনায়াসে পরাজিত হল। এই সংগ্রামকে ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা “সিপাহী বিদ্রোহ” নামে অভিহিত করে; কিন্তু আমরা একে “প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রাম” বলে থাকি। দু’টি কারণে শেষ পর্য্যন্ত আমাদের পরাজয় ঘটে। ভারতের সমস্ত অংশ এই সংগ্রামে যোগদান করেনি, আর তা ছাড়া আমাদের সৈন্যাধ্যক্ষদের সামরিক দক্ষতা শত্রুর সেনাবাহিনীর অধিনায়কদের চেয়ে নিকৃষ্ট ছিল।
জালিয়ানওয়ালাবাগের শোচনীয় ঘটনার পর ভারতের জনগণ সাময়িকভাবে হতবুদ্ধি ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল। স্বাধীনতা-অর্জ্জনের সমস্ত চেষ্টা ইংরেজ তার সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে নির্ম্মমভাবে চূর্ণ করেছে। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন, বৃটিশ পণ্য-বর্জ্জন, সশস্ত্র বিপ্লব—এর কোনটির দ্বারাই স্বাধীনতা-অর্জ্জন সম্ভবপর হয়নি। আশার আর একটি আলোক-রশ্মিও অবশিষ্ট ছিল না। হৃদয়ে অবরুদ্ধ রোষ প্রজ্বলিত থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় জনগণ নূতন পদ্ধতি—স্বাধীনতা-সংগ্রামের তিন অস্ত্রের সন্ধানে ফিরছিল। এই সঙ্কটজনক মুহূর্ত্তে মহাত্মা গান্ধী তাঁর অসহযোগ, সত্যাগ্রহ, অথবা আইন-অমান্য আন্দোলনের অভিনব পদ্ধতি নিয়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। মনে হল স্বাধীনতার পথ-প্রদর্শনের জন্যে স্বয়ং ঈশ্বর যেন তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সমগ্র জাতি তাঁর পতাকাতলে সমবেত হল। সংগ্রামের নূতন পথ পেয়ে ভারতবাসী যেন বেঁচে গেল। প্রত্যেকের মুখমণ্ডল আশা ও বিশ্বাসের আলোকে প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। আবার মনে হল, ভারতের জয় সুনিশ্চিত।
কুড়ি বছর অথবা তার চেয়েও অধিককাল যাবৎ মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁর সঙ্গে ভারতীয় জনগণও ভারতের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। ১৯২০ অব্দে তিনি স্বাধীনতা-সংগ্রামের নূতন অস্ত্র নিয়ে যদি আবির্ভূত না হতেন, তা হলে ভারতকে আজও হয়তো অবসাদগ্রস্তহয়েই থাকতে হ’ত। একথার মধ্যে একটুও অতিরঞ্জন নেই। ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে তাঁর অবদান অপূর্ব্ব, অতুলনীয়। কোন একক ব্যক্তি এই রকম অবস্থায় এর চেয়ে বেশী কিছু কখনো করতে পারতেন না।
১৯২০ অব্দ থেকে ভারতীয় জনগণ মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে দুটি জিনিষ শিক্ষা করেছে, যা স্বাধীনতা-অর্জ্জনের সংগ্রামে অপরিহার্য্য। সর্ব্বপ্রথমে তারা জাতীয় সম্মানবোধ ও আত্মপ্রত্যয় শিক্ষা করেছে, যার ফলে তাদের হৃদয়ে এখন বিপ্লবের অনুপ্রেরণা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছে; দ্বিতীয়ত তারা দেশব্যাপী এমন একটা প্রতিষ্ঠান লাভ করেছে, যার প্রভাব ভারতের দূরতম পল্লীতেও গিয়ে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার বাণী সমস্ত ভারতবাসীর হৃদয়ে প্রবেশ করায় সমগ্র জাতির প্রতিনিধিস্থানীয় একটা রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান তারা পেয়েছে। আজ চরম মুক্তি-সংগ্রামের—স্বাধীনতার জন্য শেষ যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত।
আধ্যাত্মিক জাগরণের ফলে কেবল যে ভারতেই স্বাধীনতা-সংগ্রাম সূচিত হয়েছে, তা নয়। ইতালীর ‘রিসর্জিমেণ্টো’ আন্দোলনে ম্যাট্সিনিই প্রথম ইতালীয় জনগণকে আধ্যাত্মিক প্রেরণা দান করেন। তার ফলে বীরযোদ্ধা গ্যারিবল্ডি তাঁর অনুবর্ত্তী হয়ে এক হাজার সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবকের পুরোভাগে থেকে রোম অভিমুখে অভিযান সুরু করেন। আধুনিক কালের আয়ার্ল্যাণ্ডেও সিনফিনদল, ১৯০৬ অব্দে এই দলের উদ্ভাবকালে, আইরিশ জনগণকে একটি কর্ম্মতালিকা প্রদান করেছিল। এই কর্ম্মতালিকার সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর ১৯২০ অব্দের অসহযোগ-আন্দোলনের কর্ম্মপন্থার সাদৃশ্য অত্যন্ত বেশী। সিনফিন দলের উৎপত্তিকাল থেকে দশ বছর পরে, অর্থাৎ ১৯১৬ সালে, প্রথম সশস্ত্র বিপ্লব ঘটে।
মহাত্মা গান্ধী স্বাধীনতার সরল পথে দৃঢ়ভাবে আমাদের পরিচালনা করেছেন। তিনি ও অন্যান্য নেতৃগণ আজ কারান্তরালে বন্দিজীবন যাপন করছেন। সুতরাং মহাত্মা গান্ধী যে কাজ আরম্ভ করেছিলেন, তা দেশের ভিতর ও বাইরে থেকে তাঁর স্বদেশবাসিদের সম্পন্ন করতে হবে। দেশের ভিতরে যে ভারতীয়েরা আছেন, শেষ-সংগ্রামের জন্য তঁদের যা কিছু দরকার, তা তাঁদের আছে। কেবল একটি জিনিষের তাদের অভাব,—তা হচ্ছে মুক্তি-সেনাদল। এই মুক্তি-সেনাদল ভারতের বাইরে থেকে পাঠাতে হবে, এবং তা কেবল ভারতের বাইরে থেকেই পাঠানো যেতে পারে।
১৯২০ অব্দের ডিসেম্বর মাসে নাগপুরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে ভারতীয় জাতির কাছে অসহযোগ আন্দোলনের কর্ম্মপন্থা উত্থাপিত করে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন—‘যদি ভারতের আজ তরবারি থাকত, তা হলে ভারত তরবারি কোষমুক্ত করত।’ এমনিভাবে যুক্তি দেখিয়ে তারপর মহাত্মাজী বলেন যে, সশস্ত্র বিপ্লবের কথা অবান্তর বলেই, দেশবাসীর পক্ষে তার পরিবর্ত্তে অপর উপায় হচ্ছে অসহযোগ অথবা সত্যাগ্রহ। তারপর থেকে সময়ের পরিবর্ত্তন হয়েছে এবং ভারতীয় জনগণের পক্ষে এখন তরবারি কোষমুক্ত করা সম্ভবপর। আমরা এজন্য আনন্দিত ও গর্ব্বিত যে, ভারতের মুক্তি-বাহিনী সংগঠিত হয়েছে এবং ক্রমে ক্রমে তার সৈন্যসংখ্যা বেড়ে চলেছে। একদিকে আমাদের সেনাদলের শিক্ষা সম্পূর্ণ করবার ব্যবস্থা করে, তাদের যত শীঘ্র সম্ভব, যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে হবে; সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নতুন সেনাদল গঠন করে, রণক্ষেত্রের সৈন্যবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করে যেতে হবে। স্বাধীনতার শেষ-যুদ্ধ দীর্ঘ এবং কঠোর হবে এবং যে পর্যন্ত ভারতে ইংরেজরা বন্দী অথবা দেশ থেকে বিতাড়িত না হয়, সে পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ করে যেতে হবে। আমি আপনাদের সতর্ক করে দিতে চাই যে, আমাদের মুক্তি-বাহিনী আজাদ-হিন্দ ফৌজ ভারতের মাটিতে পদার্পণ করার পর ইংরেজের কবল থেকে সমগ্র ভারতকে মুক্ত করতে এক বছর। অথবা তারও চেয়ে বেশী সময় লাগবে। আসুন, আমরা সেজন্য উঠে পড়ে লাগি এবং দীর্ঘ ও কঠোর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হই।
ব্যাঙ্কক, ২রা অষ্টোবর (১৯৪৩), মহাত্মা গান্ধীর ৭৫তম জন্মবাষিকী উপলক্ষে