কেন দেশ ছেড়েছি
ভ্রাতা ও ভগ্নীগণ, আজ আপনারা আমাকে যেমন আন্তরিকতা ও আনন্দের সঙ্গে অভিনন্দিত করেছেন, সে জন্যে আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাই। আমার যে সব ভগ্নী তাঁদের অন্তরের অগ্নিময় স্বদেশ-প্রেমের প্রেরণায় এত অধিক সংখ্যায় এগিয়ে এসেছেন, আমি তাঁদের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। আজ আমি যা দেখছি তাতে আমার মনে এই বিশ্বাস জন্মেছে, আসন্ন সংগ্রামে শোনান এবং মালয়স্থিত আমার দেশবাসীরা অগ্রণীর স্থান দখল করবেন। একদিন যে স্থান বৃটিশ-সাম্রাজ্যের প্রাকারস্বরূপ ছিল, সেই স্থান আজ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দুর্গে পরিণত হয়েছে।
আমি কেন জন্মভূমি পরিত্যাগ করে বিপদসঙ্কুল এই দুর্গম পথে পা দিলাম—সেকথা খোলাখুলি ভাবে আপনাদের কাছে বলি—এই আমার ইচ্ছ। আপনারা জানেন, ১৯২১ অব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণদ্বার দিয়ে বাইরে আসার পর থেকে আমি স্বাধীনতা-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে লিপ্ত আছি। গত কুড়ি বৎসরকাল আন্দোলন-ঘটিত সর্ব্বপ্রকার কার্য্যোদ্যমের সঙ্গে আমি সর্ব্বতোভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। হিংসাত্মক এবং অহিংসা—সকল প্রকার বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ যোগ ছিল, এবং এই সম্পর্কের সন্দেহে আমাকে বার বার বিনা বিচারে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। সুতরাং আমি যদি একথা বলি, স্বাধীনতা-আন্দোলনে আমি যেমন সকল দিক থেকে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আর কোন নেতাই সেরূপ অভিজ্ঞতা দাবী করতে পারেন না—তবে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, ভারতের ভিতরে থেকে আমরা যত রকমের চেষ্টাই করি না কেন, সেই চেষ্টা ব্রিটিশকে ভারত থেকে তাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট হবে না। যদি ভারতে থেকে চেষ্টা করাই আমাদের দেশের লোকের স্বাধীনতা লাভের পক্ষে যথেষ্ট হত, তবে আমি অনাবশ্যক বিপদের ঝুঁকি নেবার নির্ব্বুদ্ধিতা দেখাতাম না। সুতরাং সংক্ষেপে বলতে গেলে, ভারতে যে সংগ্রাম চলছে, বাহির থেকে তার শক্তি বৃদ্ধি করাই আমার দেশত্যাগের উদ্দেশ্য ছিল। বাইরের সমর্থন ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা লাভ সম্ভব নয়। ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সাফল্যপূর্ণ অবসানের জন্যে বাইরের এই অত্যাবশ্যক সাহায্যের পরিমাণ খুব সামান্য হলেই চলে। এর কারণ এই যে, অক্ষশক্তিবর্গ ব্রিটিশের উপর বারম্বার পরাজয়ের আঘাত করেছে; তার ফলে ব্রিটিশের শক্তি ও মর্য্যাদা এমন ভাবে ভেঙে পড়েছে যে, আমাদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে খুবই হালকা।
দেশবাসীর নিকট থেকে যে সাহায্য আবশ্যক ছিল এবং এখনও আছে তা দুই রকমের—নৈতিক এবং সামরিক। প্রথমতঃ, তাদের মনে এই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাতে হবে যে, পরিণামে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। দ্বিতীয়তঃ, বাইরে থেকে তাদের সামরিক সাহায্য দিতে হবে। প্রথম উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে হলে যুদ্ধের আন্তর্জাতিক অবস্থা পর্য্যালোচনা করে যুদ্ধের ফল কি দাঁড়াবে তা নির্ণয় করা আবশ্যক। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ভারতে কিংবা ভারতের বাইরে যে সব ভরতবাসী আছে তারা তাদের স্বদেশস্থ ভারতবাসীদের কি সাহা্য দিতে পারে, তার সন্ধান করা দরকার। সেই সঙ্গে দেখতে হবে, যদি প্রয়োজন হয়—তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থকদের নিকট থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা।
বন্ধুগণ, আমি এখন আপনাদের একথা বলতে পারি যে, এই উভয় উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হতে চলেছে। বিদেশে পরিভ্রমণ করে আমি স্বচক্ষে সব কিছু দেখার সুযোগ পেয়েছি এবং যুযুধান শক্তিবর্গের সামর্থ্যের পরিমাণ বুঝতে পেরেছি। আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে ইঙ্গ-মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের পতন সুনিশ্চিত। বাইরে থেকে আমি স্বদেশবাসীদেরও এ সংবাদ জানিয়েছি। এই দৃশ্য দেখে আমি আনন্দ পেয়েছি যে, জগতের যেখানে আমার যে দেশবাসী আছে তারা সবাই জেগে উঠেছে এবং দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে যোগদানের জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। আরও আনন্দের বিষয় এই যে, অক্ষ-শক্তিবর্গও ভারতকে বিদেশের অধীনতা থেকে মুক্ত দেখতে আগ্রহাকুল এবং ভারতবাসীরা যদি তাদের সাহায্য চায় তবে সে সাহায্য দিতে তারা প্রস্তুত।
বিদেশস্থ ভারতীয়দের মনোভাব সম্বন্ধে আমার এই বিশ্বাস যে, তাঁদের মধ্যে এমন একজনও নেই যিনি ভারতের স্বাধীনতা কামনা না করেন, এবং ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে যিনি সাহায্য করতে প্রস্তুত নন। অক্ষশক্তিবর্গের মতিগতি সম্বন্ধে যদি কারও মনে কোন সংশয় থাকে, তবে তাঁকে আমি অপর্য্যাপ্ত প্রমাণের দ্বারা বুঝিয়ে দিতে পারি, আমাদের নিজেদের কথা বাদ দিয়ে এরাই বর্ত্তমানে আমাদের প্রকৃষ্ট বন্ধু।
আপনারা আমাকে বিশ্বাস করুন। আমি আমার দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন কাজ করতে পারি, আমার যারা অতি-বড় শত্রু, আমার সম্বন্ধে এমন কথা বলার ধৃষ্টতা তাদেরও হবে না। বৃটিশ গবর্নমেণ্টই যখন আমার মনের শক্তি দমিত করতে পারে নি, কিংবা আমাকে প্রতারিত ও প্রলুব্ধ করতে পারে নি, তখন জগতের অপর কোন শক্তিই তা করতে পারবে না। সুতরাং আমার কথা বিশ্বাস করুন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপনারা যে সংগ্রাম আরম্ভ করেছেন, যদি তার জন্যে আপনারা বাইরের সাহায্য চান, তবে সত্যই অক্ষশক্তিবর্গ আপনাদের আনুকূল্য করবে। এই সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিনা, তা স্থির করবেন আপনারাই এবং একথা বলাই বাহুল্য যে, এই সাহায্য ছাড়া যদি আপনারা নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে পারেন, তবে ভারতের পক্ষে, সেটাই হবে সর্ব্বোৎকৃষ্ট পন্থা। সেই সঙ্গে একথাও আমাকে বলতে হচ্ছে যে, সর্ব্বশক্তিমান বৃটিশ গবর্নমেণ্টই যদি ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে পৃথিবীর সর্ব্বত্র সাহায্য চেয়ে ঘুরতে পারে—পরাধীন ক্রীতদাসের অবস্থায় পর্য্যবসিত দারিদ্র্যে অভিভূত ভারতবাসীদের কাছে পর্য্যন্ত তারা যখন সাহায্য চায়—তা হলে অবস্থার চাপে আমরা যদি বাইরের সাহায্য নিই, সেটা নিশ্চয়ই দোষের হবে না।
সময় সমুপস্থিত। দেশের স্বাধীনতা লাভের জন্যে আমরা কিরূপ উদ্যমে অবতীর্ণ হয়েছি সে বিষয়ে খোলাখুলি ভাবে সমস্ত জগৎকে—এমন কি আমাদের বিরুদ্ধপক্ষকেও জানাতে পারি। ভারতের বাইরে যেসব ভারতবাসী আছেন, বিশেষ করে পূর্ব্ব-এশিয়ায় যাঁরা আছেন, তাঁরা একটি সেনাদল গঠনে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এই সেনাদল ভারতে অবস্থিত বৃটিশ-বাহিনীকে আক্রমণ করার মতো শক্তিশালী হবে। যখন আমরা আক্রমণ করব, তখন বিদ্রোহের সূত্রপাত হবে। সে বিদ্রোহ শুধু ভারতের অসামরিক জনগণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বৃটিশ-পতাকার তলে যারা এখন সংগ্রাম করছে সেই ভারতীয় সেনাদের মধ্যেও এই বিদ্রোহের বীজ ছড়িয়ে পড়বে। বৃটিশ গবর্নমেণ্ট তখন ভারতের ভিতর এবং বাহির দু-দিক থেকেই আক্রান্ত হবে। ফলে সে গবর্নমেণ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়বে এবং তখন ভারতবাসীরা তাদের স্বাধীনতা ফিরে পাবে। সুতরাং আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করলে ভারতের সম্বন্ধে অক্ষশক্তিবর্গের মতিগতি কিরূপ তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হয় না। ভারতবাসী যদি ভারতের বাইরে থেকে এবং ভিতর থেকে তাদের কর্ত্তব্য পালন করে, তবে তারাই বৃটিশদের ভারত থেকে তাড়িয়ে দিয়ে আটত্রিশ কোটি স্বদেশবাসীকে স্বাধীন করতে পারে।
আমি জানি, এমন সংশয়বাদী আছেন—যিনি বলতে পারেন, ভারতের মধ্যে থেকে আটত্রিশ কোটি ভারতবাসী যদি ভারত থেকে বৃটিশ-শক্তির উচ্ছেদ ঘটাতে না পারে, তবে বাইরে থেকে তিরিশ লক্ষ মাত্র ভারতবাসীর দ্বারা সে কাজ সম্ভব হতে পারে—এমন আশা করা চলে কি? কিন্তু বন্ধুগণ, আয়ার্ল্যাণ্ডের ইতিহাস দেখুন। যদি তিরিশ লক্ষ আইরিশ বৃটিশের অধীনে সামরিক আইনের বাঁধনের মধ্যে থেকেও মাত্র বাহান্ন হাজার সশস্ত্র সিনফিন স্বেচ্ছাসেবকের সাহায্যে গত ১৯২১ অব্দে বৃটিশ গবর্নমেণ্টকে নতজানু করে ফেলতে সমর্থ হয়ে থাকে, তবে ভারতের অভ্যন্তরে পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনের সাহায্য লাভ করে তিরিশ লক্ষ ভারতবাসীর পক্ষে বৃটিশকে ভারত থেকে বিতাড়িত করার প্রচেষ্টা দুরাশা হবে কেন?
একথা আমি জোরের সঙ্গেই বলতে পারি, ভারতের বাইরে যেসব ভারতবাসী আছেন—বিশেষ করে পূর্ব্ব-এশিয়ায়, তাঁরা তাঁদের সর্ব্বশক্তি নিয়োগ করবেন। সেই প্রচেষ্টা সুব্যবস্থিতভাবে পরিচালনার জন্যে স্বাধীন ভারতের একটি সাময়িক গবর্ণমেণ্ট স্থাপনের ইচ্ছা আমার আছে। ভারতবাসীদের সকল শক্তি পুনর্গঠিত করে ভারতস্থ বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা—এই গবর্নমেণ্টের কাজ হবে। এই প্রচেষ্টা যখন সার্থক হবে এবং ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে, এই সাময়িক গবর্নমেণ্ট তখন স্বাধীন ভারতের স্থায়ী গবর্নমেণ্টের হাতে নিজেদের কার্য্যভার ছেড়ে দেবে। ভারতবাসীদের অভিপ্রায় অনুসারেই এই স্থায়ী গবর্নমেণ্ট স্থাপিত হবে। বন্ধুগণ, এখন আপনারা বেশ বুঝতে পারছেন যে পূর্ব্ব এশিয়ার তিরিশ লক্ষ ভারতবাসীর পক্ষে তাদের সর্ব্ববিধ শক্তি, ধনবল এবং জনবল সুগঠিত করার সময় এসেছে। মনমরা ভাব নিয়ে কাজ করলে চলবে না। আমি সর্ব্বাঙ্গীণ শক্তি-সংগ্রহ চাই—সব দিতে হবে, একটুও কম নয়। আমরা বারবার আমাদের বিপক্ষপক্ষের মুখে পর্য্যন্ত একথা শুনে এসেছি যে, বর্ত্তমান যুদ্ধ সামগ্রিক যুদ্ধ।
আজ আপনাদের সম্মুখে ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের উদ্দেশ্যে গঠিত আজাদ-হিন্দ ফৌজের অংশবিশেষ দেখতে পাচ্ছেন। টাউন-হলের সামনে সেদিন এরা এদের আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ করেছে। তারপর তারা এই সঙ্কল্প গ্রহণ করেছে যে, পুরানো দিল্লীর লালকেল্লার সামনে গিয়ে যতদিন পর্য্যন্ত তারা বিজয়োৎসবসূচক কুচকাওয়াজ না করতে পারবে, ততদিন পর্য্যন্ত তারা সংগ্রাম থেকে নিরস্ত হবে না। ‘দিল্লী চলো’, ‘দিল্লী চলো’—এই ধ্বনিকে তারা নিজেদের অস্ত্রস্বরূপ গ্রহণ করেছে। বন্ধুগণ, পূর্ব্ব-এশিয়াবাসী তিরিশ লক্ষ ভারতীয়ের কণ্ঠে আজ এই ধ্বনি উঠুক যে, সর্ব্বস্ব ত্যাগ করেও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
এই সামগ্রিক সমর-সজ্জার জন্যে আমি আশা করছি, আরও অন্ততঃ তিন লক্ষ সৈনিক এবং তিন কোটি ডলার অর্থ সংগ্রহ করতে পারব। মৃত্যুবিজয়ী একটি নারীবাহিনীর জন্যে আমি তেজস্বিনী নারীদের নিয়ে গঠিত একটি বাহিনী দেখতে চাই। ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁসীর রাণী যে তরবারি ধারণ করেছিলেন, বর্ত্তমান স্বাধীনতা-সংগ্রামে এই নারীবাহিনী সেই তরবারি ধারণ করবেন। বন্ধুগণ, অনেকদিন থেকেই আমরা ইউরোপের দ্বিতীয় ফ্রণ্ট সম্বন্ধে কত কথা শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু ভারতে আমাদের দেশবাসীরা চারদিক থেকে নিস্পিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তারা দ্বিতীয় ফ্রন্টের সাহায্য পাচ্ছে না। পূর্ব্ব-এশিয়ার ভারতীয়েরা আমাকে ধনবল এবং জনবল দিয়ে সর্ব্বাঙ্গীন সাহায্য করুন, আমি আপনাদের দ্বিতীয় ফ্রণ্ট দেখাব, ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের পক্ষে সেটা দ্বিতীয় ফ্রণ্ট হবে।
সিঙ্গাপুর, ১৯৪৩ অব্দের ৯ই জুলাই