চারমূর্তি by নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, chapter name বাঘা কাণ্ড

বাঘা কাণ্ড

      বাপস্‌—কী ঠাণ্ডা জল ! হাড়ে পর্যন্ত কাঁপুনি লেগে গেল! আর স্রোতও তেমনি | পড়েছি হাঁটু জলে—কিন্তু দেখতে দেখতে প্রায় তিরিশ হাত দূরে টেনে নিয়ে গেল ।

      কিন্তু জলসই না হলে যে বাঘসই—মানে, বাঘের জলযোগ হতে হবে এক্ষুনি ! অাঁকুপাঁকু করে নদী পার হতে গিয়ে একটা পাথরে হোচট খেয়ে জলের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলুম—খানিকটা জল ঢুকল নাক-মুখের মধ্যে । আর তক্ষুনি মনে হল, বাঘটা বুঝি এক্ষুনি পেছন থেকে আমার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়বে।

      আর সেই মুহূর্তেই—

      পেছন থেকে বাঘের গর্জন নয়—অট্টহাসি শোনা গেল ।

      বাঘ হাসছে ! বাঘ কি কখনও হাসতে পারে ? চিড়িয়াখানায় আমি অনেক বাঘ দেখেছি। তারা হাম-হাম করে খায়, হুম-হুম করে ডাকে—নয় তো, ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোয় । আমি অনেকদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেবেছি বাঘের কখনও নাক ডাকে কি না। আর যদি ডাকেই, সেটা কেমন শোনায় । একদিন বাঘের হাঁচি শোনবার জন্যে এক ডিবে নস্যি বাঘের নাকে ছুঁড়ে দেব ভেবেছিলুম—কিন্তু আমার পিসতুতো ভাই ফুচুদা ডিবেটা কেড়ে নিয়ে আমার চাঁদির ওপর কটাৎ করে একটা গাট্টা মারল । কিন্তু বাঘের হাসি যে কোনও-দিন শুনতে পাওয়া যাবে—সে-কথা স্বপ্নেও ভাবিনি ।

      পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখব ভাবছি, সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা নুড়িতে হোঁচট খেয়ে জলের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়লুম। আবার সেই অট্টহাসি—আর কে যেন বললে —উঠে আয় প্যালা, খুব হয়েছে ! এর পরে নিঘাত ডবল-নিউমোনিয়া হয়ে মারা যাবি ।

      এ তো বাঘের গলা নয় ! আর কে ? নিঘাত ক্যাবলা ! পাশে টেনিদাও দাঁড়িয়ে । দুজনে মিলে দন্তবিকাশ করে পরমানন্দে হাসছে—যেন পাশাপাশি একজোড়া শাঁকালুর দোকান খুলে বসেছে।

      টেনিদা তার লম্বা নাকটাকে কুঁচকে বললে, পেছন থেকে একটা বাঘের ডাক ডাকলুম আর তাতেই অমন লাফিয়ে জলে পড়ে গেলি ! ছোঃ-ছোঃ—তুই একটা কাপুরুষ !

      অ ! দুজনে মিলে বাঘের আওয়াজ করে আমার সঙ্গে বিটকেল রসিকতা হচ্ছিল । কী ছোটলোক দেখছ! মিছিমিছি ভিজিয়ে আমার ভূত করে দিলে—কাঁপুনি ধরিয়ে দিলে সারা গায়ে !

      রেগে আগুন হয়ে আমি নদী থেকে উঠে এলুম। বললুম, খামকা এরকম ইয়ার্কির মানে কী?

      ক্যাবলা বললে, তোরই বা এ-সব ইয়ার্কির মানে কী ? দিব্যি আমাদের পেছনে শামুকের মতো গুড়ি মেরে আসছিলি—তারপরই একেবারে নো-পাত্তা ! যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলি ! ওদিকে আমরা সারাদিন খুঁজে-খুঁজে হয়রান । শেষে দেখি–এখানে বসে মনের আনন্দে পাগলের মতো হাসা হচ্ছে । তাই তোর খরচায় আমরাও একটু হেসে নিলুম।

      আমি বললুম, ইচ্ছে করে আমি হাওয়ায় মিলিয়েছিলুম নাকি ? আমি তো পড়ে গিয়েছিলুম দস্যু ঘচাং ফুঃর গর্তে ।

      —দস্যু ঘচাং ফুঃ-র গর্তে ! সে আবার কী ?—ওরা দুজনেই হাঁ করে চেয়ে রইল ।

      —কিংবা ঘুটঘুটানন্দেরগর্তেও বলতে পার ।

      —স্বামী ঘুটঘুটানন্দ ! ক্যাবলা বারতিনেক খাবি খেল । টেনিদা তেমনি হাঁ করেই রইল—ঠিক একটা দাঁড়কাকের মতো ।

      —সেই সঙ্গে আছে গজেশ্বর গাড়ুই। সেই হাতির মতো লোকটা ।

      —আর আছে শেঠ ঢুণ্ডুরামের নীল মোটরগাড়ি ।

      —অ্যাঁ !

      ওরা একদম বোকা হয়ে গেছে দেখে আমার ভারি মজা লাগছিল! ভাবলুম চ্যা-র‌্যা-র‌্যা-র‌্যা করে গানটা আবার আরম্ভ করে দিই—কিন্তু পেটের মধ্যে থেকে গুরগুরিয়ে ঠাণ্ডা উঠছে—এখন গাইতে গেলে গলা দিয়ে কেবল গিটকিরি বেরুবে । বললুম, বাংলোয় আগে ফিরে চল—তারপরে সব বলছি ।

      সব শুনে ওরা তো বিশ্বাসই করতে চায় না। স্বামী ঘুটঘুটানন্দই হচ্ছে ঘচাং ফুঃ ! সঙ্গে সেই গজেশ্বর গাড়ই । তারা আবার পাহাড়ের গর্তের মধ্যে থাকে যা-যাঃ ! বাজে গল্প করবার আর জায়গা t

      টেনিদা বললে, নিশ্চয় জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে-ঘুরতে প্যালার পালাজ্বর এসেছিল। আর জ্বরের ঘোরে ওই সমস্ত উটুম-ধুষ্টম খেয়াল দেখেছিল ।

      আমি বললুম, বেশ, খেয়ালই সই! কাঁকড়াবিছের কামড়ের জেরটা মিটে যাক না আগে, তারপরে আসবে ওই গজেশ্বর গড়ই। তুমি আমাদের লিডার—তোমাকে ধরে ফাউল কাটলেট বানাবে !

      ক্যাবলা বললে, ফাউল মনে হল মুরগি । টেনিদা মুরগি নয়—কারণ টেনিদার পাখা নেই ; তবে পাঁঠা বলা যায় কি না জানিনে। মুশকিল হল, পাঁঠার আবার চারটে পা । আচ্ছা টেনিদা, তোমার হাত দুটােকে কি পা বলা যেতে পারে ?

      টেনিদা ক্যাবলাকে চাঁটি মারতে গেল । চাঁটিটা ক্যাবলার মাথায় লাগল না—লাগল চেয়ারের পিঠে । বাপ রে গেছি—বলে টেনিদা নাচতে লাগল খানিকক্ষণ ।

      নাচ-টাচ থামলে বললে, তোদের মতো গোটাকয়েক গাড়লকে সঙ্গে আনাই ভুল হয়েছে ! ওদিকে হতচ্ছাড়া হবলাটা যে কোথায় বসে আছে তার পাত্তা নেই। আমি এক কতদূর আর সামলাব !

      —আহা-হা—কত সামলাচ্ছ ! ক্যাবলা বললে, তুম কেইসা লিডার—উ মালুম হো গিয়া ! তোমাকে যে কে সামলায় তার ঠিক নেই !

      টেনিদা আবার চাটি তুলছিল—চেয়ার থেকে চট করে সটকে গেল ক্যাবলা । আমি রেগে বললুম, তোমরা এই করো বসে-বসে । ওদিকে গজেশ্বর ততক্ষণে হাবলাকে চপ করে ফেলুক !

      ক্যাবলা বললে, মাটন চপ । হাবলাটা এক-নম্বরের ভেড়া । কিন্তু আপাতত ওঠা যাক টেনিদা। প্যালা সত্যি বলছে কি না একবার যাচাই করে দেখা যাক । চল প্যালা—কোথায় তোর ঘুটঘুটানন্দের গর্ত একবার দেখি । ওঠো টেনিদা—কুইক ।

      টেনিদা নাক চুলকে বললে, দাঁড়া, একবার ভেবে দিকি ।

      ক্যাবলা বললে, ভাববার আর কী আছে ? রেডি–কুইক মার্চ। ওয়ান—টু—খ্রি—

      টেনিদা কুইনিন-চিবানোর মতো মুখ করে বললে, মানে, আমি ভাবছিলুম—ঠিক এ-ভাবে পাহাড়ের গুহায় ঢোকাটা কি ঠিক হবে ? আমাদের তো দু-এক গাছ লাঠি ছাড়া আর কিছু নেই—ওদের সঙ্গে হয়তো পিস্তল-বন্দুক আছে। তা ছাড়া ওদের দলে হয়তো অনেকগুলো গুণ্ডা—আমরা মোটে তিনজন—ঝাঁটুটাও বাজার করতে গেছে—

      ক্যাবলা বুক চিতিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল । —কী আর হবে টেনিদা ? বড়জোর মেরে ফেলবে—এই তো ? কিন্তু কাপুরুষের মতো বেঁচে থাকার চাইতে বীরের মতো মরে যাওয়া অনেক ভালো ! নিজের বন্ধুকে বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে কতকগুলো গুণ্ডার ভয়ে আমরা পালিয়ে যাব টেনিদা ? পটলডাঙার ছেলে হয়ে ?

      বললে বিশ্বাস করবে না-ক্যাবলার জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে আমারও যেন কেমন তেজ এসে গেল ! ঠিক কথা—করেঙ্গা ইয়া মরেঙ্গা ! পালাজ্বরে ভুগে-ভুগে এমনভাবে নেংটি ইদুরের মতো বেঁচে থাকার কোনও মানেই হয় না । ছ্যা-ছ্যা ! আরে—একবার বই তো দুবার মরব না !

      তাকিয়ে দেখি, আমাদের সদর টেনিদাও খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ভিতু মানুষটা নয়—গড়ের মাঠের গোরা পিটিয়ে যে চ্যাম্পিয়ন—এ সেই লোক ! বাঘের মতো গলায় বললে, ঠিক বলেছিস ক্যাবলা—তুই আজকে আমার আক্কেল-দাঁত গজিয়ে দিয়েছিস । একটা নয়—একজোড়া ! হয় হাবুল সেনকে উদ্ধার করে কলকাতায় ফিরে যাব, নইলে এ পোড়া প্রাণ রাখব না ।

      —হ্যাঁ, একেই বলে লিডার । এই তো চাই । তক্ষুনি বেরিয়ে পড়লুম তিনজনে । ওদের দুটো লাঠি তো ছিলই। আমার সেই ভাঙা ডালটা কোথায় পড়ে গিয়েছিল, অগত্যা একটা কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে সঙ্গে চললুম !

      এবার আর জায়গাটা চিনতে ভুল হল না । এই তো সেই কামরাঙা গাছ। এই তো সেই পাষণ্ড গোবরটা, যেটা আমাকে পিছলে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু গর্তটা ? গর্তটা গেল কোথায় ?

      গর্তের কোনও চিহ্নই নেই । খালি একরাশ ঝোপঝাড় । ক্যাবলা বললে, কই রে—তোর সে গহুর গেল কোথায় ?

      –তাই তো !— টেনিদা বললে, আমি তক্ষুনি বলেছিলুম—প্যালা, জ্বরের ঘোরে তুই খোয়াব দেখেছিস । স্বামী ঘুটঘুটানন্দ হল কিনা দস্যু ঘচাং ফুঃ ! পাগল না পাঁজফুলুর ।

      আমার মাথা ঘুরতে লাগল। সত্যিই কি জ্বরের ঘোরে আমি খোয়াব দেখেছি। তাহলে এখনও গায়ে টনটনে ব্যথা কেন ? ওই তো গোবরে আমার পা পেছলানোর দাগ । তাহলে ?

      ভূতুড়ে কাণ্ড নাকি ? পাখি ওড়ে,—রসগোল্লা উড়ে যায়, চপ-কাটলেট হাওয়া হয়—মানে পেটের মধ্যে;কিন্তু অত বড় গর্তটা যে কখনও উড়ে যেতে পারে—সে তো কখনও শুনিনি!

      টেনিদা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললে, তোর গর্ত আমাদের দেখে ভয়ে পালিয়ে গেছে—বুঝলি ? এই বলেই বীরদর্পে ঝোপের ওপর এক পদাঘাত।

      আর সঙ্গে সঙ্গেই ঝোপটায় যেন ভূমিকম্প জাগল। তার চাইতেও বেশি ভূমিকম্প জাগল টেনিদার গায়ে । —আরে আরে বলে চেঁচিয়ে উঠেই ঝোপঝাড়-সুদ্ধ টেনিদা মাটির তলায় অদৃশ্য হল । একেবারে সীতার পাতাল প্রবেশের মতো । তলা থেকে শব্দ উঠল—খচ্‌ খচ্‌, ধপাস !

      ওগুলো তবে ঝোপ নয় ? গাছের ডাল কেটে গর্তের মুখটা ঢেকে রেখেছিল ? আমি আর ক্যাবলা কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। কী বলব—কী যে করব—কিছুই ভেবে পাচ্ছি না ।

      সেই মুহুর্তেই গর্তের ভেতর থেকে টেনিদার চিৎকার শোনা গেল—ক্যাবলা—প্যালা—

      আমরা চেঁচিয়ে জবাব দিলুম, খবর কী টেনিদা ? —একটু লেগেছে, কিন্তু বিশেষ ক্ষতি হয়নি। তোরা শিগগির গর্তের খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে ভেতরে নেমে আয় ! ভীষণ ব্যাপার এখানে—লোমহর্ষণ কাণ্ড ।

      শুনে আমাদের লোম খাড়া হয়ে গেল । আমার মনে পড়ল করেঙ্গা ইয়া মরেঙ্গা ! আমি তক্ষণাৎ গর্তের মুখে পা দিয়ে নামতে আরম্ভ করলুম—ক্যাবলাও আমার পেছনে ।