চারমূর্তি by নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, chapter name হাবুল সেনের মৃতদেহ

হাবুল সেনের মৃতদেহ

      আমি আর ক্যাবলা টপটপ নীচে নেমে পড়লুম। নেমেই দেখি, কোথাও কিছু নেই। টেনিদা নয়—গজেশ্বর নয়—স্বামী ঘুটঘুটানন্দর ছেড়া দাড়ির টুকরোটুকুও নয়। ব্যাপার কী ! ঘচাং ফুর দল টেনিদাকেও ভ্যানিশ করে দিয়েছে নাকি ? ক্যাবলা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, টেনিদা তো এখানেই এক্ষুনি পড়ল রে । গেল কোথায় ?

      আমি এতক্ষণে কিন্তু আবছা আবছা আলোয় সাবধানে তাকিয়ে তাকিয়ে সেই কাঁকড়াবিছেটাকে খুঁজছিলুম। সেটা আশেপাশে কোথাও ল্যাজ উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে কি না কে জানে ! তার মোক্ষম ছোবল খেয়ে ওই গুণ্ডা গজেশ্বর কোনওমতে সামলেছে—কিন্তু আমাকে কামড়ালে আর দেখতে হচ্ছে না—পটলডাঙার পালাজ্বর-মাক প্যালারামের সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চত্নপ্রাপ্তি।

      ক্যাবলা আমার মাথায় একষটা থাবড়া মেরে বললে, এই টেনিদা গেল কোথায় ?

      —আমি কেমন করে জানব ! ক্যাবলা নাক চুলকে বললে, বড়ী তাজব কী বাত ! হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি ? কিন্তু পটলডাঙার টেনিদা—আমাদের জাঁদরেল লিডার—এত সহজেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার পাত্র ? তৎক্ষণাৎ কোত্থেকে আবার টেনিদার অশরীরী চিৎকার : ক্যাবলা—প্যালা—চলে আয় শিগগির ভীষণ ব্যাপার ।

      যাব কোথায় ! কোনখান থেকে ডাকছ ? এ যে সত্যিই ভূতুড়ে ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি। আমার মাথার চুলগুলো সঙ্গে সঙ্গে কড়াং করে দাঁড়িয়ে উঠল।

      ক্যাবলা চেঁচিয়ে বললে, টেনিদা, তুমি কোথায় ? তোমার টিকির ডগাও যে দেখা যাচ্ছে না !

      আবার কোথা থেকে টেনিদার অশরীরী স্বর : আমি একতলায় ।

      —একতলায় মানে ? টেনিদা এবার দাঁত খিচিয়ে বললে, কানা নাকি? সামনের দেওয়ালে গর্ত দেখতে পাচ্ছিসনে ?

      আরে—তাই তো ! এদিকের পাথরের দেওয়ালে একটা গর্তই তো বটে ! কাছে এগিয়ে দেখি, তার সঙ্গে একটা মই লাগানো ভেতর থেকে । যাকে বলে, রহস্যের খাসমহল !

      টেনিদা বললে, বেয়ে নেমে আয় । এখানে ভয়াবহ কাণ্ড—লোমহর্ষণ ব্যাপার ।

      অ্যাঁ ।

      ক্যাবলাই আগে মই বেয়ে নেমে গেল—পেছনে আমি । সত্যিই তো—একতলাই বটে। যেখানে নামলুম, সেটা একটা লম্বা হলঘরের মতো—কোত্থেকে আলো আসছে জানি না—কিন্তু বেশ পরিষ্কার । তার একদিকে একটা ইটের উনুন—গোটা-দু’তিন ভাঙা হাঁড়িকুঁড়ি—এক কোনায় একটা ছাইগাদা আর তার মাঝখানে—

      টেনিদা হাঁ করে দাঁড়িয়ে । ওধারে হাবুল সেন পড়ে আছে—একেবারে ফ্ল্যাট ।

      টেনিদা হাবুলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললে, ওই দ্যাখ ।

      ক্যাবলা বললে, হাবুল !

      আমি বললাম, আমন করে আছে কেন ?

      টেনিদার গলা কাঁপতে লাগল ; নিশ্চয় ওকে খুন করে রেখে গেছে!

      আমার যে কী হল জানি না। খালি মনে হতে লাগল, ভয়ে একটা কচ্ছপ হয়ে যাচ্ছি ! আমার হাত-পা একটু-একটু করে পেটের মধ্যে ঢোকবার চেষ্টা করছে । আমার পিঠের ওপরে যেন শক্ত খোলা তৈরি হচ্ছে একটা । আর একটু পরে গুড়গুড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি একেবারে জলের মধ্যে গিয়ে নামব !

      আমি কোনওমতে বলতে পারলাম : ওটা হাবুল সেনের মৃতদেহ !

      কথা নেই—বার্তা নেই—টেনিদা হঠাৎ ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ফেললে ; ওরে হাবলা রে । এ কী হল রে । তুই হঠাৎ খামকা এমন করে বেঘোরে মারা গেলি কেন রে ; ওরে কলকাতায় গিয়ে তোর দিদিমাকে আমি কী বলে বোঝাব রে ; ওরে—কে আর আমাদের এমন করে আলুকাবলি আর ভীমনাগের সন্দেশ খাওয়াবে রে !

      ক্যাবলা বললে, আরে জী, রোও মৎ। আগে দাখো—জিন্দা আছে কি মুদা হয়ে গেছে ।

      আমারও খুব কান্না পাচ্ছিল । হাবুল প্রায়ই ওর দিদিমার ভাঁড়ার লুঠ করে আমের আচার আর কুলচুর এনে আমায় খাওয়াত ! সেই আমের আচারের কৃতজ্ঞতায় আমার বুকের ভেতরটা হায়-হায় করতে লাগল। আমি কোঁচা দিয়ে নাক-টাক মুছে ফেললুম। আমার আবার কী যে বিচ্ছিরি স্বভাব—কান্না পেলেই কেমন যেন সর্দি-উর্দি হয়ে যায়।

      বারতিনেক নাক টেনে আমি বললুম, আলবাত মরে গেছে ! নইলে অমন করে পড়ে থাকবে কেন ?

      ক্যাবলাটার সাহস আছে—সে গুটি-গুটি এগিয়ে গিয়ে হাবুলের মৃতদেহের পেটে একটা খোঁচা মারল । আর, কী আশ্চর্য ব্যাপার—অমনি মৃতদেহ উঠে বসল ধড়মড়িয়ে ।

      —বাপ রে—ভূত হয়েছে ! বলেই আমি একটা লাফ মারলুম। আর লাফিয়ে উঠতেই টেনিদার খাঁড়ার মতো খাড়া নাকটার একটা ধাক্কা আমার মাথায় । কী শক্ত নাক—মনে হল যেন চাঁদিটা স্রেফ ফুটাে হয়ে গেছে —নাক গেল—নাক গেল—বলে টেনিদা একটা পেল্লায় হাঁক ছাড়ল, আর ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়লুম আমি ।

      খাসা ঘুমাইতে আছিলাম, দিলি ঘুমটার দফা সাইরা !

      তখন আমার খটকা লাগল। ভূতেরা তো চন্দ্রবিন্দু দিয়ে কথা বলে—এ তো বেশ ঝরঝরে বাংলা বলে যাচ্ছে । আর, পরিষ্কার ঢাকাই বাংলা !

      টেনিদা খ্যাঁচ-খ্যাঁচ করে উঠল : —আহা-হা—কী আমার রাজশয্যে পেয়েছেন রে—যে নবাবি চালে ঘুমোচ্ছেন । ইদিকে তখন থেকে আমরা খুঁজে মরছি—হতচ্ছাড়ার আক্কেলটা দ্যাখো একবার !

      হাবুল আয়েশ করে হাই তুলে বলল, একহাঁড়ি রসগোল্লা সাঁইঠ্যা জব্বর ঘুমখানা আসছিল । তা, গজাদা কই ? স্বামীজী কই গেলেন ?

      টেনিদা বললে, ইস, বেজায় যে খাতির দেখছি। স্বামীজী—গজাদা ।

      হাবুল বললে, খাতির হইব না ক্যান ? কাইল বিকালে আইছি—সেই থিকা সমানে খইত্যাছি । কী আদর-যত্ন করছে—মনে হইল যান ঠিক মামাবাড়ির আইছি । তা, তারা গেল কই ?

      ক্যাবলা বললে, তারা গেল কই—সে আমরা কী করে জানব ? তা, তুই কী করে ওদের পাল্লায় পড়লি ? এখানে এলিই বা কী করে ?

      —ক্যান আসুম না ? একটা লোক আইস্যা আমারে কইল, খোকা—এইখানে পাহাড়ের তলায় গুপ্তধন আছে। নিবা তো আইস। বড়লোক হওনের অ্যামন সুযোগটা ছাড়ম ক্যান ? এইখানে চইল্যা আইছি । স্বামীজী—গজাদা—আমারে যে যত্ন করছে—কী কমু !

      টেনিদা ভেংচি কেটে বললে, হ, কী আর কবা । এখানে বসে উনি রাজভোগ খাচ্ছেন, আর আমরা চোখে অন্ধকার দেখছি ।

      ক্যাবলা বললে, এ-সব কথা এখন থাক । এই গর্তের মধ্যে ওরা ক'জন থাকত রে ?

      —জনচারেক হইব ।

      —কী করত ?

      —কেমনে জানুম ? একটা কলের মতো আছিল—সেইটা দিয়া খুটুর-খুঁটুর কইরা কী যান ছাপাইত । সেই কলড়াও তো দ্যাখতে আছি না। চই্যা গেল নাকি ? আহা হা, বড় ভালো খাইতে আছিলাম রে —হাবুলের বুক ভেঙে দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরুল একটা ।

      —থাক তোর খাওয়া !

      —টেনিদা বললে, চল এবার বেরুনো যাক এখান থেকে । আমরা সময়মতো এসে পড়েছিলুম—নইলে খাইয়ে খাইয়েই তোকে মেরে ফেলত !

      আমি বললুম, উহু, মোটা করে শেষে কাটলেট ভেজে খেত ।

      ক্যাবলা বললে, বাজে কথা বন্ধ কর। হ্যাঁ রে হাবুল—ওরা কী ছাপত রে ?

      —ক্যামন কইরা কই ? ছবির মতো কী সব ছাপাইত ।

      —ছবির মতো কী সব ! ক্যাবলা নাক চুলকোতে লাগল : পাহাড়ের গর্তের মধ্যে চুপি চুপি । বাংলোতে লোক এলেই তাড়াতে চাইত জঙ্গলের মধ্যে একটা নীল মোটর ! শেঠ ঢুৃণ্ডুরাম ।

      টেনিদা বললে, চুলোয় যাক শেঠ ঢুণ্ডুরাম । হাবুলকে পাওয়া গেছে—আপদ মিটে গেছে। ওটা নয় হাঁড়িভর্তি রসগোল্লা সাবড়েছে—কিন্তু আমাদের পেটে যে ছুঁচোর দল সংকীর্তন গাইছে রে ; চল বেরোই এখান থেকে—

      আমি বললুম, আবার ওই মই বেয়ে ?

      হাবুল বললে, মই ক্যান ? এইখান দিয়েই তো যাওনের রাস্তা আছে।

      —কোন দিকে রাস্তা ?

      —ওই তো সামনেই । হাবুলই দেখিয়ে দিলে। হলঘরের মতো সুড়ঙ্গটা পেরুতেই দেখি, বাঃ । একেবারে যে সামনেই পাহাড়ের একটা খোলা মুখ । আর কাছেই সেই নদীটী—সেই শালবন । ক্যাবলা বললে, কী আশ্চর্য, তুই তো ইচ্ছে করলেই পালাতে পারতিস হবলা ।

      হাবুল বললে, পালাইতে যামু ক্যান ? অমন আরামের খাওন-দাওন! ভাবছিলাম—দুই-চাইরটা দিন থ্যাইকা স্বাস্থ্যটারে এইটু ভালো কইরা লই।

      টেনিদা চেঁচিয়ে বললে, ভালো কইরা ! হতচ্ছাড়া—পেটুকদাস । তোকে যদি গজেশ্বর কাটলেট বানিয়ে খেত, তাহলেই উচিত শিক্ষা হত তোর !

      কিন্তু বলতে বলতেই—হঠাৎ মোটরের গর্জন ।

      মোটর ! মোটর আবার কোত্থেকে ? আবার কি শেঠ ঢুণ্ডুরাম ?

      হাঁ—ঢুণ্ডুরামই বটে। সেই নীল মোটরটা । কিন্তু এদিকে আসছে না। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দূরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ—তারপর পাতার আড়ালে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। যেন আমাদের ভয়েই উৰ্ধৰ্বশ্বাসে পালাল ওটা ।

      আর আমি স্পষ্ট দেখলুম—সেই মোটরে কার যেন একমুঠো দাড়ি উড়ছে হাওয়ায়। তামাক-খাওয়া লালচে পাকা দাড়ি ।

      স্বামী ঘুটঘুটানন্দের দাড়ি ?