চারমূর্তি by নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, chapter name শেঠ ঢুণ্ডুরাম

শেঠ ঢুণ্ডুরাম

ওঠ জোয়ান—হেঁইয়ো !

      পাথরের খাঁজে খাঁজে পা দিয়ে দিয়ে যখন গর্তের মুখে উঠে পড়লুম, তখন আমার পালাজ্বরের পিলেটা পেটের মধ্যে কচ্ছপের মতো লাফাচ্ছে। অবশ্য কচ্ছপকে আমি কখনও লাফাতে দেখিনি—সুড়সুড় করে শুড় বের করতে দেখেছি কেবল । কিন্তু কচ্ছপ যদি কখনও লাফায়—আনন্দে হাত-পা তুলে নাচতে থাকে—তা হলে যেমন হয়, আমার পিলেটা তেমন করেই নাচতে লাগল। একেবারে পুরো পাঁচ মিনিট ।

      পিলের নাচ-টাচ থামলে কামরাঙা গাছটার ডাল ধরে আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলুম। কোথাও কেউ নেই—ক্যাবলা আর টেনিদা কোথায় গেছে কে জানে ! ও-ধারে একটা আমড়া গাছে বসে একটা বানর আমাকে ভেংচি কাটছিল—আমিও দাঁত-টাত বের করে সেটাকে খুব খারাপ করে ভেংচে দিলুম। বানরটা রেগে গিয়ে বললে, কিচ–কিচ–কিছু—বোধহয় বললে, তুমি একটা বিচ্ছু !—তারপর টুক করে পাতার আড়ালে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল ।

      পায়ের তলায় গর্তটার ভেতর থেকে গজেশ্বর গাড়ুইয়ের গোঙনি শোনা যাচ্ছে। আমার বেশ লাগছিল । আমাকে বলে কিনা কাটলেট করে খাবে ! যাচ্ছেতাই সব ইংরিজি শব্দের মানে করতে বলে আর জানতে চায় হনোলুলুর রাজধানীর নাম কী ! বেশ হয়েছে ! পাহাড়ি কাঁকড়া-বিছের কামড়—পুরো তিনটি দিন সমানে গান গাইতে হবে গজেশ্বরকে !

      এইবার আমার চোখ পড়ল সেই কালান্তক গোবরটার দিকে । এখনও তার ভিতর দিয়ে পেছলানোর দাগ—ওই পাষণ্ড গোবরটাই তো আমায় পাতালে নিয়ে গিয়েছিল । ভারি রাগ হল, গোবরকে একটু শিক্ষা দেবার জন্যে ওটাকে আমি সজোরে পদাঘাত করলুম।

      এহে-হে—এ কী হল । ভারি ছ্যাঁচড়া গোবর তো ! একেবারে নাকে-মুখে ছিটকে এল যে ! দুৰ্ত্তোর !

      কিন্তু এখানে আর থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। গজেশ্বরকে বিশ্বাস নেই—হঠাৎ যদি উঠে পড়ে গর্তের ভেতর থেকে ! সরে পড়া যাক এখান থেকে ! পত্রপাঠ !

      যাই কোন দিকে ! ঝণ্টিপাহাড়ি বাংলোর ঠিক পেছন দিকে এসে পড়েছি সেটা বুঝতে পারছি—কিন্তু যাই কোন ধার দিয়ে । কীভাবে যে এসেছিলুম, ওই মোক্ষম আছাড়টা খাওয়ার পর মাথার ভেতর সে-সমস্ত হালুয়ার মতো তালগোল পাকিয়ে গেছে। ডাইনে যাব, না বাঁয়ে ? আমার আবার একটা বদ দোষ আছে। পটলডাঙার বাইরে এলেই আমি পুব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ কিছুই আর চিনতে পারিনে। একবার দেওঘরে গিয়ে আমার পিসতুতো ভাই ফুচুদাকে বলেছিলুম ; দেখো ফুচুদা, কী আশ্চর্য ব্যাপার। উত্তরদিক থেকে কী চমৎকার সূর্য উঠছে —-শুনে ফুচুদা কটাং করে আমার লম্বা কানে একটা মোচড় দিয়ে বলেছিল, স্ট্রেট এখান থেকে রাঁচি চলে যা প্যালা—মানে, রাঁচির পাগলা গারদে !

      কোন দিকে যাব ভাবতে ভাবতেই—আমার চোখ একেবারে ছানাবড়া! কিংবা একেবারে চমচম । ওদিকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গুটিমুটি মেরে ও কারা আসছে ? কাঠবেড়ালির ল্যাজের মতো ও কার দাড়ি উড়ছে হাওয়াতে ?

      স্বামী ঘুটঘুটানন্দ–নির্ঘাত । তাঁর পেছনে পেছনে আরও দুটাে ষণ্ডা জোয়ান—তাদের হাতে দুটাে মুখ-বাঁধা সন্দেহজনক হাঁড়ি ! নিঘাত যোগসর্পের হাড়ি–মানে, দই আর রসগোল্লা-ফোল্লা থাকা সম্ভব ! একা একা নিশ্চয় খাবে না, খুব সম্ভব হাবুল সেনও ভাগ পাবে।

      আমি পটলডাঙার প্যালারাম—রসগোল্লার ব্যাপারে একটুখানি দুর্বলতা আমার আছে। কিন্তু সেই লোভে আবার আমি গজেশ্বর গাড়ুইয়ের পাল্লায় পড়তে চাই না—উহু—কিছুতেই না ! বেঁচে কেটে পড়ি এখান থেকে!

      সুট্‌ করে আমি বাঁ পাশের ঝোপে ঢুকে গেলুম। দৌড়নো যাবে না—পায়ের আওয়াজ শুনতে পাবে ওরা । ঝোপের মধ্যে আমি সুড়সুড়িয়ে চললুম।

      চলেছি তো চলেইছি। কোন দিকে চলেছি জানি না। ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে, নালা-ফালা টপকে, একটা শেয়ালের ঘাড়ের ওপর উলটে পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে, চলেছি আর চলেইছি। আবার যদি দস্যু ঘচাং ফুর পাল্লায় পড়ি—তা হলেই গেছি। গজেশ্বর যে-রকম চটে রয়েছে—আমাকে আবার পেলে আর দেখতে হবে না। সোজা শুক্তোই বানিয়ে ফেলবে !

      প্রায় ঘণ্টাখানেক এলোপাথাড়ি হাঁটবার পর দেখি, সামনে একটা ছোট্ট নদী । ঝুরঝুরে মিহি বালির ভেতর দিয়ে তিরতির করে তার নীলচে জল বয়ে চলেছে। চারদিকে ছোট-বড় পাথর । আমার পা প্রায় ভেঙে আসবার জো—তেষ্টায় গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ।

      পাথরের ওপর বসে একটুখানি জিরিয়ে নিলুম ! আকাশটা মেঘলা—বেশ ছায়াছায়া জায়গাটা । শরীর যেন জুড়িয়ে গেল ! চারদিকে পলাশের বন—নদীর ওপারে আবার দুটাে নীলকন্ঠ পাখি ।

      একটুখানি জলও খেলুম নদী থেকে । যেমন ঠাণ্ডা—তেমনি মিষ্টি জল । খেয়ে একেবারে মেজাজ শরিফ হয়ে গেল। দস্যু ঘচাং ফুঃ, গজেশ্বর, টেনিদা, ক্যাবলা, হাবুল—সব ভুলে গেলুম। মনে এত ফুর্তি হল যে আমার চা-রা-রা-রা-রা—রামা হো—রামা হো—বলে গান গাইতে ইচ্ছে করল ।

      কেবল চা-রা-রা-রা-রা—বলে তান ধরেছি—হঠাৎ পেছনে ভোঁপ-ভোঁপ-ভোঁপ ! দুত্তোর—একেবারে রসভঙ্গ ! তার চাইতেও বড় কথা এখানে মোটর এল কোত্থেকে ? এই ঝণ্টিপাহাড়ির জঙ্গলে ?

      তাকিয়ে দেখলুম, নদীর ধার দিয়ে একটা রাস্তা আছে বটে। আর-একটু দূরেই সেই রাস্তার ওপর পলাশ-বনের ছায়ায় একখানা নীল রঙের মোটর দাঁড়িয়ে ।

      কী সর্বনাশ–এরাও ঘচাং ফুঃ-র দল নয় তো ? ডিটেকটিভ গল্পে এইরকমই তো পড়া যায় ! নিবিড় জঙ্গল—একখানা রহস্যজনক মোটর—তিনটে কালো-মুখোশ পরা লোক, তাদের হাতে পিস্তল—আর ডিটেকটিভ হিমাদ্রি রায়ের চোখ একেবারে মনুমেন্টের চূড়ায় । ভাবতেই আমার পালাজ্বরের পিলেটা ধপাস করে লাফিয়ে উঠল। ফিরে কচ্ছপ-নৃত্য শুরু করে আর-কি !

      উঠে একটা রাম-দৌড় লাগাব ভাবছি—এমন সময় আবার ভোঁপ, ভোঁপ ! মোটরটার হর্ন বাজল । তারপরেই গাড়ি থেকে যে নেমে এল, তাকে দেখে আমি থমকে গেলুম। না—কোনও দস্যুর দলে এমন লোক থাকতেই পারে না। কোনও গোয়েন্দা-কাহিনীতে তা লেখেনি।

      প্রকাণ্ড থলথলে ভুঁড়ি—দেখলে মনে হয়, ক্রেনে করে তুলতে গেলে ক্রেন ছিড়ে পড়বে। গায়ের সিল্কের পাঞ্জাবিটা তৈরি করতে বোধহয় একথান কাপড় খরচ হয়েছে। প্রকাণ্ড একটা বেলুনের মতো মুখ—নাক-টাকগুলো প্রায় ভেতরে ঢুকে বসে আছে। মাথায় একটা বিরাট হলদে রঙের পাগড়ি । গলা-টলার বালাই নেউ—পেটের ভেতর থেকে মাথাটা প্রায় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে মনে হয়। ঠিক থুতনির তলাতেই একছড়া সোনার হার চিকচিক করছে। দুহাতের দশ আঙুলে দশটা আংটি ।

      একখানা মোক্ষম শেঠজী । নাঃ—এ কখনও দস্যু ঘচাং ফুঃ-র লোক নয়। বরং ঘচাং ফুদের নজর সচরাচর যাদের ওপর পড়ে—এ সেই দলের । কিন্তু এ রকম একটি নিটোল শেঠজী খামকা এই জঙ্গলে এসে ঢুকেছে কেন ?

      শেঠজী ডাকলেন : খোঁকা—এ খোঁকা— আমাকেই ডাকছেন মনে হল । কারণ, আমি ছাড়া কাছাকাছি আর কোনও খোঁকাকে আমি দেখতে পেলুম না। সাত-পাঁচ ভেবে আমি গুটি-গুটি এগোলুম তাঁর দিকে । ,

      —নমস্তে শেঠজী ।

      —নমস্তে খোকা । —শেঠজী হাসলেন বলে মনে হল । বেলুনের ভেতর থেকে গোটাকতক দাঁত আর দুটাে মিটমিটে চোখের ঝলক দেখতে পেলুম এবার । শেঠজী বললেন, তুমি কার লেড়কা আছেন ? এখানে কী করতেছেন ?

      একবার ভাবলুম, সত্যি কথাটাই বলি। তারপরেই মনে হল কার পেটে যে কী মতলব আছে কিছুই বলা যায় না। এই ঝণ্টিপাহাড়ি জায়গাটা মোটেই সুবিধের নয়। শেঠজীর অত বড় ভূড়ির আড়ালেও রহস্যের কোনও খাসমহল লুকিয়ে আছে কি না কে বলবে ।

      তাই বোঁ করে বলে দিলুম, আমি হাজারিবাগের ইস্কুলে পড়তেছেন। এখানে পিকনিক করতে এসেছেন ।

      —হাঁ ! পিকনিক করতে এসেছেন ?—শেঠজীর চোখ দুটো বেলুনের ভেতর থেকে আবার মিটমিট করে উঠল । এতো দূরে ? তা, দলের আউর সব লেড়কা কোথা আছেন ?

      —আছেন ওদিকে কোথাও । —আঙুল দিয়ে আন্দাজি যে-কোনও একটা দিক দেখিয়ে দিলুম। তারপর পাল্টা জিজ্ঞেস করলুম, আপনি কে আছেন, এই জঙ্গলে আপনিই বা কী করতে এসেছেন ?

      —হামি ? শেঠজী বললেন, হামি শেঠ ঢুণ্ডুরাম আছি। কলকাতায় হামার দোকান আছেন—রাঁচিমে ভি আছেন। এখানে হামি এসেছেন জঙ্গল ইজারা লিবার জন্যে।

      —ও–জঙ্গল—ইজারা লিবার জন্যে ? আমার হঠাৎ কেমন রসিকতা করতে ইচ্ছে হল । কিন্তু জঙ্গলে বেশি ঘোরাফেরা করবেন না শেঠজী—এখানে আবার ভালুকের উৎপাত আছে ।

      —অ্যাঁ—ভালুক ! শেঠ ঢুণ্ডুরামের বিরাট ভূড়িটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠল ভালুক মানুষকে কামড়াচ্ছেন ?

      —খুব কামড়েছেন! পেলেই কামড়াচ্ছেন!

      —অ্যাঁ ।

      আমি শেঠজীকে ভরসা দিয়ে বললুম ; ভুড়ি দেখলে আরও জোর কামড়াচ্ছেন । মানে ভালুকেরা ভুড়ি কামড়াতে ভালোবাসেন । আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

      —অ্যাঁ ! রাম-রাম । শেঠজী হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন । অত বড় শরীর নিয়ে কেউ যে অমন জোরে লাফাতে পারে সেটা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না ।

      তারপর মন-চারেক ওজনের সিন্ধের সেই প্রকাণ্ড বস্তাটা এক দৌড়ে গিয়ে মোটরে উঠল। উঠেই চেঁচিয়ে উঠল : এ ছগনলাল—আরে মোটরিয়া তো হাঁকাও ! জলদি !

      ভোঁপ—ভোঁপ ! চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতেই ঢুণ্ডুরামের নীল মোটর জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল ! আর পুরো পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমি পরমানন্দে হাসতে লাগলুম। বেড়ে রসিকতা হয়েছে একটা !

      কিন্তু বেশিক্ষণ আমার মুখে হাসি রইল না। হঠাৎ ঠিক আমার পেছনে জঙ্গলের মধ্যে থেকে— -

      —হালুম ! ভালুক নয়—ভালুকের বড়দা । অর্থাৎ বাঘ রসিকতার ফল এমন যে হাতে-হাতে ফলে আগে কে জানত ।

      —বাপরে, গেছি !—বলে আমিও এক পেল্লায় লাফ ! শেঠজীর চাইতেও জোরে ।

      আর লাফ দিয়ে ঝপাং করে একেবারে নদীর কনকনে ঠাণ্ডা জলের মধ্যে । পেছন থেকে সঙ্গে-সঙ্গে আবার জোর আওয়াজ : হাল্লুম !