বরফ গলা নদী by জহির রায়হান, chapter name তিন

তিন

পরদিন শঙ্কিত মন নিয়ে ছাত্রীর বাড়িতে এলেও একটা ব্যাপারে মরিয়ম নিশ্চিন্ত হতে পারলো না। মনসুরের সঙ্গে অমন দুব্যবহার করা উচিত হয় নি। আজ যদি তার সঙ্গে দেখা হয়, এবং দেখা হবে তা জানতো, তাহলে তার ক্ষমা চাইবে সে। ক্ষমা যদি নাও চায়, তবু ভালোভাবে-ভদ্রভাবে কথা বলবে মনসুরের সঙ্গে। যতদিন তার কাছ থেকে কোন অশোভন প্ৰকাশ না পায় ততদিন সহজ সম্পর্ক বজায় রাখবে মরিয়ম।

বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেলিনা কি যেন করছিলো। ওকে আসতে দেখে মৃদু হেসে অভ্যর্থনা জানালো।

মরিয়ম বললো, আমার আজ একটু দেরি হয়ে গেছে সেলিনা।

সেলিনা বললো, আমি ভাবছিলাম আজ তুমি আসবে না আপা?

অহেতুক চমকে উঠলো মরিয়ম। সেলিনাকে কিছু বলে নি তো মনসুর?

পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বললো, কেন বলতো?

সেলিনা নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জবাব দিলো, রোজ ঠিক সময়টিতে আসো কিনা, তাই।

ওর কথায় অনেকটা আশ্বস্ত হলো মরিয়ম। কিন্তু মনসুরকে আজ না দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার একটা অস্বস্তি জেগে উঠলো ওর ভেতরে। পড়াতে বসে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো মরিয়ম। বাইরের ঘরে কোন গলার আওয়াজ পেলেই কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করলো কার গলা। আর যখন বুঝলো এ মনসুরের নয় তখন হতাশ হলো সে।

সেলিনা পড়ার ফাঁকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি শরীরটা আজ ভালো নেই আপা?

মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো মরিয়মের। ইতস্তত করে বললো, কই নাতো। কেন আমায় দেখে কি অসুস্থ মনে হচ্ছে?

সেলিনা বললো, হ্যাঁ।

‘না। আমার কিছু হয়নি, তুমি পড়ো’। ছাত্রীকে বইয়ের প্রতি মনোযোগী হতে আদেশ করলো মরিয়ম। তারপর সে ভাবলো, না–এসবের কোন অর্থ হয় না। যা ঘটে গেছে তার জন্যে অনুতাপ কেন করবে মরিয়ম। অন্যায় সে কিছু করে নি। লোকটার যে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই তার নিশ্চয়তা আছে? উদ্দেশ্য মহৎ হওয়ারও কোন কারণ খুঁজে পেলো না সে। যেভাবে রোজ রোজ পিছু নেয় তাতে তার স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ জাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু লোকটাকে নিয়ে এত মাথা ঘামাতেই বা শুরু করেছে কেন মরিয়ম?

পড়ানো শেষ করে সবে বিদায় নেবে এমন সময় মনসুরকে হঠাৎ দোরগোড়ায় দেখে প্রথমে অবাক হলো, পর মুহূর্তে ফ্যাকাশে এবং তারপর রক্তাভ হলো মরিয়ম।

মনসুর এগিয়ে এসে বললো, কি খবর, কেমন আছেন?

ওর গলার স্বরে কোন জড়তা নেই, গতকালের ঘটনার কোন রেশ নেই, শুনে ঈষৎ বিস্মিত হলো মরিয়ম। পরক্ষণে সে মৃদু হেসে বললো, ভালো, আপনি কেমন? এতটুকু কথায় এত উচ্ছাস প্ৰকাশ নিজের কাছেই ভালো লাগলো না মরিয়মের।

মনসুর একটুকাল সন্ধানী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। কণ্ঠস্বরটা ওর কাছেও বড় নতুন ঠেকছে আজ।

কয়েকটা নীরব মুহূর্ত।

কী যে হলো, বড় ভয় করতে লাগলো মরিয়মের। মুখ তুলে ওর দিকে তাকাতে সাহস হলো না। ‘চলি সেলিনা।’ এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে দ্রুত রাস্তায় বেরিয়ে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মরিয়ম।

কিছুদূর এসে একবার পেছনে ফিরে দেখলে সে।

না। আজ আসছে না। মনসুর।

প্রথমে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেও, খানিক পরে মরিয়মের মনে হতে লাগলো, বোধ হয়। লোকটা অসন্তুষ্ট হয়েছে। ওর ব্যবহারে তাই আজ এলো না এগিয়ে দিতে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো মরিয়মের।

বাসায় ফিরতে একটা মিহি কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো মরিয়ম।

খোকনকে সামনে পেয়ে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে রে খোকন? কাঁদছে কে?

খোকনের চোখজোড়া ছলছল করছিলো। ভাঙ্গা গলায় বললো, ছোট আপাকে বাবা মেরেছে।

‘কেন?’ প্রশ্নটা খোকনকে করলেও, তার উত্তরের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলো না মরিয়ম। অন্ধকার ঘরে পা দিতে হাসিনার কান্নাটা আরো জোরে শোনা গেলো। বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে সে, আবছা দেখা যাচ্ছে তাকে।

ওর গায়ের ওপর একখানা হাত রেখে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো মরিয়ম, কি হয়েছেরে হাসি?

এক ঝটিকায় ওর হাতখানা দূরে সরিয়ে দিলো হাসিনা।

খানিকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে স্যান্ডেলটা চৌকির নিচে রেখে দিলো মরিয়ম। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ব্লাউজটা ধীরে ধীরে খুললো সে। বডিসটা খুলে রাখলো আলনার ওপরে। শাড়িটা পাল্টে নিলো। তারপর নিঃশব্দে মায়ের ঘরে এলো সে। কি হয়েছে মা, হাসিনা কাঁদছে কেন? বলে মায়ের দিকে চোখ পড়তে রীতিমত আর্তনাদ করে উঠল মরিয়ম, একি! কি হয়েছে মা? চওড়া চৌকিটার ওপর শুয়ে মা। মাথাটা আগাগোড়া ব্যাণ্ডেজ করা।

বাবা পাশে বসে মৃদু পাখা করছেন তাকে। হাসমত আলী হাতের ইশারায় মরিয়মকে জোরে কথা বলতে নিষেধ করলেন। সালেহা বিবি ঘুমোচ্ছেন এখন। তাকে জাগানো ঠিক হবে না।

একটু পরে বাবার কাছ থেকে সব জানতে পেলো মরিয়ম। কতদিন তিনি বারণ করেছেন। সকলকে, ছাদে দৌড়-ঝাঁপ না দিতে। পুরোনো বাড়ি নড়বড়ে ছাদ। কখন ভেঙ্গে পড়ে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তবু রোজ ছাদে উঠে খেলবে হাসিনা। আজও বিকেল বেলা খেলছিলো সে। নিচে তোর মা বসে বসে চাল বাছছিলেন, বাইরে ওই কুয়োতলায় রাখা আছে গিয়ে দেখে আয় তুই। পোয়াখানেক ওজনের একটা ইট, ছাদ থেকে খসে তার মাথার উপর এসে পড়লো। ঘরের কোণে আলো নিয়ে দেখ, কত রক্ত জমে আছে সেখানে।

হাসমত আলী থামলেন।

তিনি তখন বাসায় ছিলেন। আয়োডিন আনিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন সালেহা বিবির মাথায়। রাতের রান্না-বান্না কিছুই হয় নি। দুলুটা কাঁদতে কাঁদতে এই একটু আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। খোকনটারও ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়। যদিও মুখ ফুটে সে কিছু বলে নি এখনো। হারিকেনের মৃদু আলোতে বসে বসে পড়ছে সে। মাঝে মাঝে উস্‌খুস করছে, চোখ তুলে তাকাচ্ছে ওদের দিকে।

হ্যারিকেনের আগুনে কুপিটা ধরিয়ে নিয়ে পাকঘরে চলে গেলো মরিয়ম।

হাসিনার কান্নাটা এখান থেকে শোনা যাচ্ছে। রাগের মাথায় ভীষণ মেরেছেন তাকে বাবা।

একটা তরকারি আর দুটো ভাত সিদ্ধ করে নামাতে বেশ রাত হয়ে গেলো। ঘুম থেকে তুলে দুলুকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো মরিয়ম। খোকনকে খাওয়ালো। তারপর সবার জন্য ভাত সাজিয়ে হাসিনাকে ডাকতে এসে মরিয়ম দেখলো, কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে হাসিনা।

প্রথমে দূর থেকে ডাকলো মরিয়ম, তারপর ওর গায়ে হাত রেখে জোরে নাড়া দিয়ে বললো, হাসি উঠ, বাবা বসে আছেন তোর জন্যে।

বড় ক্লান্তি লাগছিলো ওর। হাত ধরে টেনে বললো, কইরে ওঠ।

হাসিনা নড়েচড়ে আবার চুপ করে রইলো।

হাসি ভাত খাবি ওঠ।

আমি খাব না, হাসিনা জবাব দিলো তোমরা খাওগে যাও।

ওঠ মিছিমিছি রাগ করে না। নরম গলায় বললো মরিয়ম। তারপর দুহাতে ওকে বিছানা থেকে তোলার চেষ্টা করলো সে।

এই ভালো হবে না বলছি, এই-এই। ওর হাতে একটা কামড় বসিয়ে দিলো হাসিনা।

উহ! বলে ছেড়ে দিলো মরিয়ম। হাসিনা আবার চুপচাপ।

ওকে একা ফিরে আসতে দেখে হাসমত আলী শুধালেন, কী, হাসিনা এলো না?

মরিয়ম আস্তে করে জবাব দিলো, ও খাবে না।

হাসমত আলী মাটির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে কি যেন ভাবলেন, মুখখানা গভীর এবং বিরক্তিপূর্ণ। একটু পরে নিজেকে শোনাচ্ছেন যেন এমনি করে বললেন, বয়স কি কম হয়েছে ওর? তবু একটু কাণ্ডজ্ঞান হলো না। বিয়ে হলে ও স্বামীর ঘর করবে কেমন করে?

মরিয়ম বললো, ভাত খাবে এসো বাবা।

হাসমত আলী বললো, তুমি খাওগে আমার ক্ষিধে নেই। স্ত্রীর পাশে বালিশটা টেনে কাৎ হয়ে শুলেন তিনি। মরিয়মকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন, যাও, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, অনেক রাত হয়েছে।

আরো অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মরিয়ম।

তারপর পাকঘরে গিয়ে ভাত-তরকারিগুলো চাপা দিয়ে দুগ্ৰাস জল খেয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলো। থাক, সেও খাবে না আজ।

হাসিনা ঘুমোচ্ছে। মৃদু নাক ডাকছে ওর।

বাইরের দরজাটা বন্ধ করা হয়েছে কিনা দেখে এসে শুয়ে পড়লো মরিয়ম।

শুধু এই বাড়িতে নয়, পুরো পাড়াটায় ঘুম নেবেছে এখন। দুএকটা বাড়ি থেকে অন্ধকার কাঁপিয়ে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে দুএকটা গলার স্বর। গলির হ্যাংলা কুকুরগুলো ডাকছে কখনো কখনো। আর কোন শব্দ নেই। কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঘুমোতে পারলেন না। হাসমত আলী। রাতে ঘুম না হওয়া বড় বেদনাদায়ক। বিশেষ করে এই নিরবতার মাঝখানে এক রাত জগতে গেলে, অনেক চিন্তা এসে জমাট বাঁধে মাথায়। একান্তভাবে কোন কিছু চিন্তা করার এটাই বোধ হয় প্রকৃত সময়।

অতীত। ভবিষ্যৎ। বর্তমান।

ছুরি দিয়ে কেটে-কেটে জীবনটাকে বিশ্লেষণ করার মত প্রবৃত্তি না হলেও, জীবনের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলো টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো স্মৃতি হয়ে দেখা দেয় মনে। সেখানে আনন্দ আছে, বিষাদ আছে। ব্যর্থতা আছে, সফলতা আছে, হাসি আছে, অশ্রু আছে। অতীতের মত বর্তমানও যেন ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত উঠা আর পড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যৎ কেমন হবে কেউ তা বলতে পারে না। তা-কি খুব সুন্দর হবে, না আরো মলিনতায় ভরা হবে ভাবতে ভাবতে একটুখানি তন্দ্ৰা এসেছিলো। একটা ধাড়ি ইঁদুরের কিচকিচি ডাকে তন্দ্ৰা ছুটে গেলো। তাঁর। চোখ মেলে চারপাশে তাকালেন হাসমত আলী। আবার চোখের পাতাজোড়া বন্ধ করলেন। তারপর ছেলেমেয়েদের কথা ভাবতে লাগলেন তিনি।

বড় ছেলে মাহমুদ। সবার বড় ও। কিন্তু ওর ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে পারেন না তিনি। কি যে হবে ওর খোদা জানেন। লেখাপড়া শিখেছে। বছর তিনেক হলো বি. এ. পাশ করেছে। তার এই গ্রাজুয়েট হবার পেছনে নিজের কোন অবদান খুঁজে পান না হাসমত আলী। পত্রিকায় চাকরি করে নিজের টাকায় পড়েছে মাহমুদ। ম্যাট্রিক পাশ করার পর বাবার কাছে বেশি কিছু দাবি করে নি। দাবি করলেও দিতে পারতেন কিনা সন্দেহ। নিম্নপদস্থ কেরানীর পক্ষে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো শুধু কষ্টসাধ্য নয়, দুরূহও বটে। তাই মাহমুদের নিজের ইচ্ছার ওপরে কোন রকম খবরদারী করার সাহস পান না। তিনি। জোর করে কিছু নির্দেশ দেবার পিতৃসুলভ ইচ্ছে থাকলেও তাকে দমন করেন হাসমত আলী। নিজেকে অপরাধী মনে হয় ছেলের কাছে। মরিয়মের কাছেও অপরাধী হাসমত আলী।

ম্যাট্রিক পর্যন্ত ওর পড়ার খরচ জুগিয়েছেন তিনি, তারপর এ বাড়ি ও বাড়ি ছাত্রী পড়িয়ে কলেজে পড়েছে মরিয়ম। এই তো মাস দুয়েক হলো ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে সে।

তারপর হাসিনা–

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েন। হাসমত আলী। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন।

সেই যে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো মাহমুদ তারপর দুদিন তার কোন দেখা নেই।

এমনি হয়।

মাঝে মাঝে বাসার সবার সঙ্গে ঝগড়া করে কয়েক দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যায় মাহমুদ। বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় গিয়ে থাকে। হােটেলে রেস্তোরাঁঁয় খায়। পকেটে পয়সা না থাকলে উপোসে কাটায়।

সকালে তখনও মাথার যন্ত্রণায় গায়ে জ্বর ছিলো সালেহা বিবির। মরিয়মকে ডেকে শুধোলেন তিনি, হ্যাঁরে, মাহমুদ ফিরেছে?

মায়ের পাশে এসে বসে মরিয়ম সংক্ষেপে বললো, না।

মা যন্ত্রণায় কাতর গলায় বললেন, কার যে স্বভাব পেলো ও। কিছু বলবার উপায় নেই, অমনি রাগ করবে। ওকে নিয়ে আমি কি করি বলতো? মায়ের দুচোখে জল।

মরিয়ম কিছু বলতে যাবার আগে হাসমত আলী উষ্ণ গলায় বললেন, কি দরকার ছিলো ওকে রাগাবার। জানতো ও ওরকম, তবু ওসব কথা বলতে গেলে কেন।

খোকনের কাছ থেকে মাহমুদের বাড়ি না আসার কারণটা জানতে পেরেছিলেন তিনি। তখন থেকে স্ত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন হাসমত আলী। মাহমুদকে কোন কারণে রাগাবার পক্ষপাতী তিনি নন। স্বভাবে উদ্ধৃঙ্খলতা দােষ থাকলেও সে নিশ্চয় বখাটে ছেলে নয় তা বোঝেন হাসমত আলী। সংসারে টাকা-পয়সা দিয়ে প্রতিমাসে সাহায্য করছে সে। লেখাপড়া আর জানাশোনার দিক থেকেও বাবার চেয়ে সে অনেক বড়। তাছাড়া ছেলেমেয়েদের সকলের ভবিষ্যৎ ওর হাতে নির্ভর করছে। নিজে যে কোন সময় মারা যেতে পারেন। সে জ্ঞান রাখেন হাসমত আলী। তখন মাহমুদ না থাকলে কে দেখবে ওদের? মরিয়ম-মেয়ে, ওর ওপর কতটুকু ভরসা করা যেতে পারে? দিন সব সময় এক রকম যায় না। মাহমুদ একদিন একটা ভালো চাকরি পেয়ে যেতে পারে সে আশাও রাখেন হাসমত আলী।

হাসমত আলীর কথার জবাবে উচ্চবাচ্য করলেন না সালেহা বিবি। নীরবে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। মরিয়ম উঠে যেতে যেতে বললো, তুমি এ নিয়ে বেশি ভেবো না মা। দুপুরে অফিসে গিয়ে ওর খোঁজ নেবো আমি।

হাসমত আলী অফিসে গেলে, মায়ের পাশে অনেকক্ষণ ঘোরাফেরা করলো হাসিনা। ইট পড়ে তার মাথা ফেটে গেছে। সেজন্য মনে মনে অনুতপ্ত সে।

সালেহা বিবির চোখে তন্দ্রা ছিলো, তাই প্রথমে নজরে আসে নি। পরে দৃষ্টি পড়তে ইশারায় তাকে কাছে ডাকলেন তিনি। ইতস্তত করে দূরে দাঁড়িয়ে রইলো হাসিনা।

সালেহা বিবি আবার ডাকলেন, এদিকে আয় হাসি।

এবারে গুটি গুটি পায়ে পাশে এলো হাসিনা। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে মা বললেন, তোর মুখখানা এত শুকনো কেন রে?

মায়ের বুকে মুখ গুঁজে হঠাৎ কেঁদে উঠলাে হাসিনা। মা, আর উঠবো না মা। আর ছাতে উঠবো না। সালেহা বিবি তার চুলে সিঁথি কেটে দিয়ে বললেন, ও মা, এতে কাঁদবার কী আছে। কাঁদে না মা। ছাতে যাবি না কেন, একশ বার যাবি।

হাসিনা তবুও বললো, না। আর যাবো না, মা।

আপাকে কাঁদতে দেখে, গালে আঙুল পুরে দুলু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। ওর দিকে চোখ পড়তে সালেহা বললেন, দেখ হাসি, দুলুটা কেমন নোংরা হয়ে আছে। ওকে একটু কুয়োতলায় নিয়ে ভালো করে চান করিয়ে দে না মা।

অন্য সময় হলে ঠোঁট বাঁকিয়ে সেখান থেকে দূরে সরে যেতো হাসিনা। এখন গেলো না। মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে একটু হাসলো। তারপর খুশি মনে দুলুকে কুয়োতে চান করাতে নিয়ে গেলো হাসিনা।

 

রাতে পত্রিকা অফিসে এসে দারওয়ানের হাতে একখানা চিঠি পেলো মাহমুদ।

দারওয়ান বললো, ‘এক মেমসােব দে গিয়া।’

চিঠিখানা খুলে পড়লো সে। মরিয়ম লিখেছে।

 

‘ভাইয়া,

আজ দুদিন তুমি বাসায় এলে না। মারা ভীষণ অসুখ। বারবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। মাকে এভাবে কেন কষ্ট দিচ্ছে তুমি?

আশা করি আজ নিশ্চয় বাসায় ফিরবে।’

 

নিচে নিজের নাম সই করেছে।

চিঠিটা পড়ে টুকরো করে ছিড়ে ফেললো মাহমুদ। ‘মা ভীষণ অসুস্থ, ইয়ার্কির আর জায়গা পায়নি’ মনে মনে বললো মাহমুদ। এ শুধু ওকে বাসায় ফিরিয়ে নেবার চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। এভাবে একটা মিথ্যে কথার আশ্রয় না-নিয়ে সরাসরি বাসায় যাবার জন্যে লিখলেই তো পারতো মরিয়ম। মাহমুদ ভাবলো, রাতে বাসায় ফিরে মরিয়মকে এক প্রস্থ গালাগাল দিতে হবে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলে, সামনে একফালি সরু বারান্দা। ডান হাতে ম্যানেজারের দপ্তর। বাঁ হাতে নিউজ সেকসনের লম্বা ঘর। টেবিলের ওপর কাগজের স্তুপ। আলপিনের বাক্স। শূন্য চায়ের পেয়ালা। পেপার কাটার আর দোয়াত কলম। একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো মাহমুদ। প্রথম প্রথম এ ঘরটিতে এসে ঢুকতে আশ্চর্য রোমাঞ্চ অনুভব করতো সে। এখন কোন অনুভূতিই জাগে না। বরঞ্চ বিতৃষ্ণায় ভরে উঠে মন। সাংবাদিক হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে আজ সে লজ্জা বোধ করে। সে তো সাংবাদিক নয়, মালিকের হাতের একটি যন্ত্রবিশেষ। কর্তার ইচ্ছেমতো সংবাদ তৈরি করতে হয় তাকে। তাঁরই ইচ্ছেমত বিকৃত খবর পরিবেশন করতে হয়। মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে মন। তখন সে ভাবে, যদি তার টাকা থাকতো তা হলে নিজে একখানা পত্রিকা বের করতো মাহমুদ। সুস্থ সাংবাদিকতা হতো যার আদর্শ। কিন্তু এসব উদ্ভট কল্পনা বিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রত্যহ প্রয়োজন মেটানোর যার সামথ্য নেই, সে স্বপ্ন দেখে দৈনিক পত্রিকা বের করবার। ‘দুত্তোর আদর্শ’-পিনের বাক্সটা একপাশে ঠেলে রেখে, কলামটা হাতে তুলে নিলো মাহমুদ।

মাসখানেক পরে, একদিন সেলিনাকে পড়াতে আসার পথে দূর থেকে ওদের বাসার সামনে একটা চকলেট রঙের নতুন গাড়ি দেখতে পেলো মরিয়ম। ভাবলো, বোধ হয় নতুন কোন অতিথি এসেছে বাসায়।

এ একমাসে বৈচিত্র্যের দিক থেকে না হলেও, ঘটনার দিক থেকে অনেক নতুন কিছু ঘটেছে তার জীবনে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে সে। যে চাকরিটা হবে আশা করেছিলো, তা হয়নি। আরো দু একটা নতুন টিউশনি পাবার আশ্বাস পেয়েছে মরিয়ম। মনসুরের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক বজায় রেখেছে সে। গত এক মাসের মেলামেশার মধ্য দিয়ে লোকটাকে কখনো খারাপ মনে হয় নি। অন্তত সে রকম কোন ধারণা জন্মাবার মত ব্যবহার করে নি মনসুর। যে ক’দিন এখানে এসেছে, যাবার পথে গলির মাথা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে মরিয়মকে। একদিন তো সে নিজেই আমন্ত্রণ করেছিলো তাকে, আসুন না আমাদের বাসায়, একটু বসে যাবেন।

‘না, আজ থাক। আরেকদিন যাবো।’ উপেক্ষা নয়, বরং সলজ্জ সংকোচে আমন্ত্রণ এড়িয়ে গেছে মনসুর।

মরিয়ম তাতে দুঃখ পেয়েছে তা নয়। সে প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করায়, নিজের দৈন্য আর প্রতিপক্ষের স্বচ্ছলতার কথা ভেবে অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছে মরিয়ম। যদি সে আসতো। তাহলে তাকে কোথায় বসতে দিতো মরিয়ম। কী খাওয়াতো তাকে?

যে কোনদিন মনসুর বাসায় যাওয়ার কথা তুলতে পারে এই আশঙ্কায় সুন্দর দেখে দুটো চায়ের কাপ দুটো পিরিচ কিনে রেখেছে সে বাসায়। এলে আর কিছু না হােক এক কাপ চা তো দিতে হবে। মরিয়ম আরো ভেবেছে, দুটো চেয়ার আর একটা গোল টিপয় যদি কিনতে পারে তাহলে হয়তো ভদ্রভাবে সাজানো যাবে ঘরটাকে। বাইরে থেকে কেউ এলে তাকে বসানো যাবে।

দূর থেকে মটরটাকে দেখছিলো মরিয়ম, পাশ কাটিয়ে ভেতরে যাবার সময় আরেক বার চোখ বুলিয়ে নিলো সে।

বৈঠকখানায় সবার সাথে এক সঙ্গে দেখা। বাইরে বেরুবার তোড়জোড় করছিলো ওরা। সেলিনা, তার আম্মা আর মনসুর। সেলিনার বাবাকে দেখা গেলো না সেখানে। একটা ছাই রঙের প্যান্ট পরেছে মনসুর। গায়ে একটা সিল্কের সাদা সার্ট। সেলিনার পরনে আকাশ রঙের শাড়ি, গায়ে বাদামি ব্লাউজ।

ওকে দেখতে পেয়ে সেলিনা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো, এই যে আপা এসে গেছে, কি মজা, এবার সবাই একসঙ্গে বেড়াতে বেরুবো আমরা।

মনসুর হাসলো। সেলিনার আম্মাও।

অপ্ৰস্তুত মরিয়ম তিনজনের দিকে তাকালো একবার করে। মনসুর হেসে বললো, আপনার অপেক্ষা করছিলাম আমরা। সেলিনা আজ পড়বে না। চলুন বেরিয়ে আসবেন আমাদের সঙ্গে।

সেলিনার আম্মা–আনিসা বেগমের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মরিয়ম জানতে চাইলো, কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?

সেলিনা আর আনিসা বেগম দুজনে এক সঙ্গে বলে উঠলো, নিউ মার্কেট। উপলক্ষটা তেমন কিছু নয় আসার পথে বাইরে যে গাড়িটা দেখে এসেছে মরিয়ম কিছুদিন হলো মনসুর কিনেছে ওটা। ওর নতুন গাড়িতে করে ওদের একটু ঘুরিয়ে আনতে চায় সে।

এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও পারবে না মরিয়ম, তা জানতো সে। তাই রাজী হয়ে বললো, আমায় একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হয় আজ।

মনসুর বললো, ঘাবড়াবেন না। ঠিক সময়ে বাসায় পৌঁছে দেবো আপনাকে ৷

সেলিনা অহেতুক ফিক করে হাসলো একটু। আনিসা বেগম কেন যেন একটু গভীর হয়ে গেলেন।

গাড়িতে মনসুর আর সেলিনা সামনের সিটে বসলো। মরিয়ম আর আনিসা বেগম পেছনে।

হ্যাঁ, গত এক মাসে আরো একটি সত্য আবিষ্কার করেছে মরিয়ম। একদিন কথায় কথায় আনিসা বেগম হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেছিলেন তাকে মনসুরকে কেমন মনে হয় তোমার মরিয়ম?

এ ধরনের প্রশ্ন আশা করেনি মরিয়ম, তাই মুহূর্ত কয়েক বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলো। সহসা কোন জবাব দিতে পারে নি। ক্ষণকাল নীরব থেকে বলেছে, কেন, বেশ ভালোই তোI

আনিসা বেগমের মুখখানা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার উত্তর শুনে। আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে চাপা স্বরে বলেছেন, সেলিনার সঙ্গে ওকে কেমন মানাবে বলতো?

প্রশ্নের হেতুটা এতক্ষণে বুঝতে পেরে খানিকটা স্বস্তি পেয়েছে মরিয়ম।

কিন্তু এরকম কিছু মুহূর্ত আগেও ভাবে নি সে। পরন্তু অন্য একটি সম্ভাবনার কথা ভেবে শঙ্কিত হয়েছিলো। উত্তরটা দিতে আবার বিলম্ব হয়েছিলো মরিয়মের, মন্দ কি? বেশ ভালোই মানাবে ওদের।

আমারো তাই মনে হয়, আনিসা বেগম বলেছিলেন, কিন্তু কথাটা কোথাও আলোচনা করো না তুমি, কেমন?

মরিয়ম মাথা নত করে কথা দিয়েছিলো তাকে। না, এ কথা কাউকে জানাবে না সে।

গাড়িটা তখন নবাবপুর রোড ধরে এগুচ্ছিলো। দুধারে সারি সারি বাতিগুলো একে-একে পেছনে রেখে আসছিলো ওরা। বাইরে দৃষ্টি গলিয়ে দেখছিলো মরিয়ম। আঁচলে টান পড়তে মুখ ফিরিয়ে তাকালো সে। আনিসা বেগম কিছু বলতে চান তাকে। কাছে সরে আসতে ফিসফিসিয়ে তিনি বললেন, পাশাপাশি ওদের কেমন লাগছে বলতো?

শুনে হাসি পেলো মরিয়মের। অতি কষ্টে সামলে নিয়ে জবাব দিলো, বেশ ভালো।

আনিসা বেগম গলাটা আরো খাটো করে বললে, দুজনের গায়ের রঙ এক রকম, তাই না?

মরিয়ম বললো, হ্যাঁ।

স্বভাবের দিক থেকেও বেশ মিলবে, তাই না?

হ্যাঁ।

আনিসা বেগম মুখখানা ধীরে ধীরে সরিয়ে নিলেন বাইরের দিকে। রমনা এলাকাটা অনেকটা নির্জন। দুপাশে দোকানপাট, লোকজনের ভিড় নেই। কোলাহল নেই।

জানালার পাশে ঘেঁষে বসতে এক ঝলক বাতাস এসে সারা মুখখানা শীতল করে দিয়ে গেলো মরিয়মের।

নিউমার্কেট এসে অনেক কেনাকাটা করলো ওরা–সেলিনা আর আনিসা বেগম। দু-খানা শাড়ি কিনলো সেলিনা। একখানা ব্লাউজ পিস। এক টিন পাউডার, একটা টুথপেস্ট, কয়েকখানা সাবান কিনলো ওরা এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে।

মনসুর একফাঁকে গলাটা নামিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কিছু কিনবেন না? মরিয়ম অন্যমনস্কভাবে একটা সেন্টের শিশি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো ঈষৎ অপ্ৰতিভ হয়ে বললো, না।

কথাটা কানে গেলো আনিসা বেগমের। সেলিনাসহ একটা নকল পাথরের তৈরি মালার দর করছিলেন তিনি। ওর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, ওকি, তুমি তো কিছুই কিনলে না, একটা-কিছু কেনা উচিত তোমার।

মরিয়ম নিষেধ করতে যাচ্ছিলো। এক জোড়া মালা কিনে একটা ওর দিকে এগিয়ে দিলেন আনিসা বেগম, লজ্জা করছে কেন, তুমিতো আমার মেয়ের মতো।

এ কথার পর মালাটা ফিরিয়ে দিতে পারলো না মরিয়ম। আনিসা বেগম হয়তো মনে আঘাত পাবেন।

মনসুর চুপচাপ কেনাকাটা দেখছিলো। ওদের। মাঝেমাঝে দু-একটা মন্তব্য করছিলো। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে দু-শিশি সেন্ট কিনলো সে। একটা সেলিনার জন্যে আরেকটা মরিয়মের জন্যে। মরিয়মকে সরাসরি দিতে হয়তো সাহস হচ্ছিলো না। সেলিনার হাতে তুলে দিয়ে বললো, আমার তরফ থেকে এ দুটো দিলাম তোমাদের। তারপর আনিসা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো, খালাম্মা, আপনাকে কি দেয়া যেতে পারে বলুন তো?

আনিসা বেগম হেসে বরলেন, না বাবা, আমাকে দিতে হবে না, আমি বুড়োমানুষ।

সেলিনা পরক্ষণে বললো, মাকে একটু চুল না-ওঠার তেল কিনে দিন, মাথার চুলগুলো উঠে যাচ্ছে ওঁর।

মেয়ের প্রতি কুপিত দৃষ্টি হানলেন আনিসা বেগম।

মরিয়মের মুখখানা অনেক আগেই কালো হয়ে গেছে।

মার্কেট থেকে বেরুবার পথে মাহমুদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। বোধ হয় কোন কাজে এসেছে সে, মরিয়ম ভাবলো। চোখে চোখ পড়তে মৃদু হাসলো সে। মাহমুদের কোন ভাবান্তর হলো না। বাকি সকলের দিকে একটি সন্ধানী দৃষ্টি হেনে, ওর খুব কাছে এগিয়ে এসে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, এরা কারা?

ওরা তখন সামনে এগিয়ে গেছে। মরিয়ম পেছনে পড়ে ছিলো। একবার ওদের দিকে আরেকবার মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বললো, এসো না, ওদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই তোমার।

আমি আলাপ করতে চাইনে মরিয়ম। ওরা কারা, তাই জানতে চেয়েছি। মাহমুদ গম্ভীর গলায় জবাব দিলো।

মরিয়ম অপ্রস্তুত গলায় বললো, একজন আমার ছাত্রী সেলিনা, আরেকজন তার মা।

আর লোকটা কে?

সেলিনার বড় বোনের দেওর।

যাও, ওরা অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে।

মরিয়ম তাকিয়ে দেখলো গাড়িতে বসে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে সবাই। গাড়িতে উঠতে গিয়ে সে লক্ষ্য করলো মনসুরের মুখখানা কেমন ভার-ভার।

 

বালিশে উপুর হয়ে পড়ছিলো হাসিনা। ষান্মাসিক পরীক্ষা ঘনিয়ে এসেছে ওর। রোজ পাঠ্য বই নিয়ে বসে প্রথমে একবার, লেখাপড়ার সূচনা যারা করেছিলো তাদের একপ্রস্থ গালাগাল আর অভিশাপ দিয়ে নেয় হাসিনা, তারপর পড়তে শুরু করে।

বাসায় ফিরে এসে, শাড়িটা বদলে নিয়ে, ওর কাছে এসে মরিয়ম বললো, তোমার জন্যে আজ একটা জিনিস এনেছি হাসিনা।

কী, কী আপা? বই ফেলে উঠে বসলো হাসিনা।

মরিয়ম মৃদু হাসলো। তার আগে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে তোমায়।

কী প্ৰতিজ্ঞা? হাসিনা ব্যগ্র গলায় জিজ্ঞেস করলো।

মরিয়ম বললো, ভালো করে লেখাপড়া করবে।

অন্য সময় হলে এত বড় প্রতিজ্ঞায় রাজী হতো না হাসিনা। কিন্তু, কিছু-একটা পাবার লোভে বিনা দ্বিধায় রাজী হয়ে গেলো।

বললো, ঠিক পড়বো দেখো, এই গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি তোমার। কী এনেছো আমার জন্যে, দেখাও না আপা। আর বিলম্ব সহ্য হচ্ছিলো না হাসিনার।

টেবিলের ওপর থেকে পাথরের মালাটা এনে, হাসিনার হাতে গুঁজে দিলো মরিয়ম। চোখের সামনে মালাটা তুলে ধরে আনন্দে ফেটে পড়লো হাসিনা। আপাকে জড়িয়ে ধরে বললো, কী সুন্দর আপা, কী সুন্দর!

মরিয়ম বললো, দাও আমি গলায় পড়িয়ে দেই।

মালাটা গলায় পরিয়ে দিয়ে টেবিলের ওপর থেকে কোণা-ভাঙা আয়নাটা এনে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখলো হাসিনা। খুশিতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। আপার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললো, দাঁড়াও মাকে দেখিয়ে আসি, কি সুন্দর লাগছে তাই না? নাচতে নাচতে মাকে মালাটা দেখাতে চলে গেলো। সে।

সেন্টের ছোট্ট শিশিটা টেবিলের ওপর রাখা ছিলো। হাসিনার চোখ পড়ে নি। ওর ওপর। তাহলে এতক্ষণে বাড়িটা মাথায় তুলতো। উঠে গিয়ে শিশিটা চৌকির তলায় রাখা ওর টিনের বাক্সটার মধ্যে যত্ন করে রেখে দিলো মরিয়ম। হাসিনাকে ওটা দেবে না সে।

পথে আসতে আকাশে মেঘ দেখে এসেছিলো, মনে হয়েছিলো যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। এতক্ষণে বুঝি নামলো। প্রথমে কয়েক ঝলক দমকা বাতাস জানালার কবাট, ঘরের দেয়ালে বাধা পেয়ে করুণ বিলাপের মত শব্দ করলো। তারপর ঝিরঝির এবং অবশেষে ঝমােঝম শব্দে বৃষ্টি নেমে এলো। উঠে গিয়ে জানালার কবাট জোড়া বন্ধ করে দিলো মরিয়ম। গলির আর সব বাড়িগুলোতেও জানালা বন্ধ করার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বউ-ঝিদের হাঁক-ডাক।

আপা–আপা–ও ঘর থেকে হাসিনার ডাক শোনা গেলো।

মরিয়ম জবাব দিলো, আসছি।

সবেমাত্র রান্নাবান্না সেরে এসেছেন সালেহা বিবি। হাসমত আলী খোকনকে পড়াচ্ছেন বসে বসে। দুলুটা ওঁর পিঠের ওপর উপুড় হয়ে আছে গলা জড়িয়ে। মাকে মালাটা দেখাচ্ছিলো আর কি যেন বলছিলো হাসিনা। মরিয়ম অসতে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, এটা কত দিয়ে কিনেছিসরে আপা?

মরিয়ম বললো, বিনে পয়সায়।

মা, বাবা, হাসিনা তাকালো ওর দিকে।

মরিয়ম আবার বললো, সেলিনার আম্মা আমাকে কিনে দিয়েছে এটা।

ও। হাসিনা ভ্রু কুঁচকে বললো, তাহলে তুই কিনিস নি!

সালেহা বিবি বললো, তোকে কিনে দিয়েছেন উনি, তুই আবার হাসিনাকে দিয়ে দিয়েছিস কেন?

মালা হারাবার ভয়ে হাসিনার মুখখানা ম্লান হয়ে গেলো।

মরিয়ম বললো, কী আছে, ও পরুক না।

শুনে আবার উজ্জ্বলতা ফিরে এলো হাসিনার চিবুকে।

বৃষ্টি তখন আরো বেড়েছে। বাইরে শুধু একটানা ঝুপঝাপ শব্দ। কে যেন জোরে কড়া নাড়ছে সদর দরজায়। সালেহা বিবি বললেন, দেখতে হাসিনা, বোধ হয় মাহমুদ এলো।

একটু পরে ছুটতে ছুটতে হাসিনা এসে হেসে লুটোপুটি খেলো–দেখে এসো মা, ভাইয়া একেবারে ভিজে চুপসে গেছে।

সালেহা বিবি ধমকালেন, দাঁত বের করে হাসছিস কেন, এতে হাসার কী আছে?

মরিয়মের মনে পড়লো মাহমুদের ঘরে আলো নেই। দ্রুত পায়ে নিজের ঘর থেকে হ্যারিকেনটা তুলে নিয়ে ওঘরে রাখলো সে। ভিজে কাপড়গুলো বদলে মাহমুদ তখন গামছায় পা মুছছিলো। কাগজের স্তুপের ওপাশে রাখা হ্যারিকেনটা নিয়ে ওতে আলো জেলে দিলো মরিয়ম।

কেমন করে ভিজলি, একটু কোথাও দাঁড়াতে পারলি না? মা এসে দাঁড়িয়েছেন দোরগোড়ায়।

মাহমুদ বললো, সখ করে নিশ্চয় ভিজি নি।

সালেহা বিবি বললেন, বছরের প্রথমে বৃষ্টি, এ বড় খারাপ। একটু গায়ে পড়লেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। মাথার চুলগুলো মুছে নে ভালো করে।

মরিয়ম উঠতে যাচ্ছিলো। মাহমুদ বললো, কোথায় চললে, তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার, বসো।

 

মরিয়ম বসলো। ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে সালেহা বিবি চলে গেলেন একটু পরে।

পকেট থেকে একটি বিড়ি বের করে ধারালো মাহমুদ। তারপর বিছানার মাঝখানে আস্তে করে বসলো, রোজ সন্ধ্যায় তুমি কোথায় যাও তা জানতে পারি কি আমি?

মরিয়ম অপ্রস্তুত হয়ে বললো, কেন ছাত্রী পড়াতে।

পড়ানোর কাজটা কি নিউমার্কেট সারা হয়? মাহমুদের গলায় শ্লেষ। মরিয়ম ক্ষণকাল নীরব থেকে বললো, ওরা নিউ মার্কেটে যাচ্ছিলো, সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। আমায়–।

তুমি গেলে কেন–? ওর মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে মাহমুদ রূঢ় গলায় জবাব দিলো, ওদের সঙ্গে সম্পর্ক হলো মালিক আর মাস্টারনীর সম্পর্ক। ওদের মেয়েকে পড়াও আর বিনিময়ে টাকা পাও। নিউ মার্কেটে ওদের সঙ্গ দেবার জন্য নিশ্চয় কোন বাড়তি টাকা তোমাকে দেয়া হয় না?

মাথা নত করে চুপচাপ বসে রইলো মরিয়ম।

ওকে চুপ থাকতে দেখে হাতের বিড়িটা এক পাশে সজোড়ে ছুড়ে মেরে মাহমুদ আবার বললো, কতদিন বলেছি বড়লোকের বাচ্চাগুলোকে আমি দেখতে পারি না, আর তুমি সঙ্গে হাওয়া খেতে বেরোও?

ছেলের চিৎকার শুনে সালেহা বিবি ছুটে এসে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে, অমন চেঁচাচ্ছিস কেন তুই?

হাসিনা এতক্ষণ দুয়ারের আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিলো সব। সে ফিসফিসিয়ে বললো, আপা সেলিনাদের সঙ্গে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলো, তাই ভাইয়া বকছে তাকে।

সালেহা বিবি মাহমুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিউ মার্কেটে গেছে তাতে হয়েছে কি, এমন কি অন্যায় করেছে যে তুই বকছিস ওকে।

তুমি যা-বোঝো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না মা, কিছুটা সংযত হতে চেষ্টা করলো মাহমুদ। নিউ মার্কেট ও যাবে না কেন, একশো বার যাবে কিন্তু ওই বড়লোকদের বাচ্চাগুলোর সঙ্গে নয়।

কেন ওরা কি মানুষ না নাকি? সালেহা বিবি ছেলের অহেতুক রাগের কোন কারণ খুঁজে না-পেয়ে নিজেই রেগে গেলেন ওরা যদি সঙ্গে করে নিয়ে যায় তাহলে—

কই ওরা তো আমাকে নিয়ে যায় না? মায়ের মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে মাহমুদ জবাব দিলো। নিউ মার্কেট কেন সদরঘাট পর্যন্ত ওরা মোটরে করে নিয়ে যাবে না আমায়। তোমার মেয়েকে দেখবে বুড়িগঙ্গার ওপারেও নিয়ে যাবে। স্বরটা নামিয়ে নিয়ে মাহমুদ আবার বললো, কই দশ টাকা বেতন এ মাসে বাড়িয়ে দিবে বলে কথা দিয়েছিলো, বাড়িয়েছে? ওদের আমি চিনি নি ভাবছো? সব ব্যাটা বেঈমান।

মরিয়ম তখনো মাথা নুইয়ে চুপচাপ বসেছিলো। হ্যারিকেনের আলোয় ভালো করে মুখ দেখা যাচ্ছিলো না ওর।

সালেহা বিবি ধীর গলায় বললেন, সব বড়লোক এক রকম হয় না।

যা জানো-না তা নিয়ে কথা বলো না। এত জোরে চিৎকার করে উঠলো মাহমুদ, যে ওরা সকলে চমকে তাকালো ওর দিকে। সব বড়লোক সমান না–কটা বড়লোক তুমি দেখেছো শুনি? কোনো বড়লোকের ছেলেকে দেখেছে। বি. এ. পাশ করে পঁচাত্তর টাকার চাকরির জন্যে মাথা খুঁড়ে মরতো? কই, একটা বড়লোক দেখাও তো আমায়, যার মেয়ে অন্যের বাড়িতে ছাত্রী পড়িয়ে যে টাকা পায় তা দিয়ে কলেজের বেতন শোধ করে? দুপুর রোদে এক মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে ক্লাশ করতে যায়? ওরা সমান না বললেই হলো। সব শালা বেঈমান, চামার। বিনে পয়সায় মানুষকে খাঁটিয়ে মারতে চায়। দিয়েছি। শালার চাকরি ছেড়ে। জাহান্নামে যাক–বলতে গিয়ে কাশি এলো তার। বিছানার ওপর উপুড় হয়ে ভয়ানকভাবে কাশতে লাগলো মাহমুদ।

পাথরের মূর্তির মত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সালেহা বিবি।

মরিয়ম নীরব।

মাহমুদ তখনও কাশছে একটানা।

ওর কাছে এগিয়ে এসে শঙ্কিত গলায় সালেহা বিবি বললো, ঠাণ্ডা লাগে নি তো? একটু সরষের তেল গরম করে এনে বুকে মালিশ করে দেবো?

উঠে দাঁড়িয়ে বোধ হয় তেল গরম করে আনার জন্যে বেরিয়ে গেলো মরিয়ম।

কাশি থামলে মাহমুদ বললো, আমাকে নিয়ে অত চিন্তা করতে হবে না তোমাদের মা, এত সহজে আমি মরবো না। বলে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো মাহমুদ।

সালেহা বিবি বললেন, শুয়ে পড়লি কেন? ওঠ। যাই আমি নামাজ পড়ে ভাত দেই তোদের।

হাসমত আলী পুরোপুরি ওর আলোচনাটা না-শুনতে পেলেও মাঝে মাঝে টুকরো কথাগুলো কানে আসছিলো তার। বিশেষ করে যখন নিজের দৈন্যের কথা, সাখীহীনতার কথা বলছিলো মাহমুদ। শুনেছিলেন আর মনে মনে নিজেকে বারবার অপরাধী বলে মনে হচ্ছিলো তাঁর। ছেলেমেয়েদের লেখা-পড়া শেখানোর গুরুভার বহন করতে পারেন নি। তিনি। পারেন। নি তাদের সহজ স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্য দিয়ে মানুষ করতে। তাদের শৈশব-যৌবনের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে চরিতাৰ্থ করতে। মনে মনে পীড়িত হচ্ছিলেন হাসমত আলী। স্ত্রীকে আসতে দেখে চাপা স্বরে শুধালেন, কি বলছিলো মাহমুদ।

সালেহ বিবি নামাজের যোগাড়যন্ত্র করতে করতে জবাব দিলেন, চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ও।

অনেক কথা শুনলেও এ খবরটি ইতিপূর্বে কানে আসে নি তাঁর। স্ত্রীর মুখে শুনে, খানিকক্ষণ একটা অর্থহীন দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। ভ্রু-জোড়া ঈষৎ কুঁচকে এলো তাঁর। চোখজোড়া সরু হয়ে এলো। কেউ যেন শুনতে না পায় এমনি করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হাসমত আলী।

বাইরে তখনো একটানা বৃষ্টি ঝুপঝুপ শব্দে।

সালেহা বিবি সবে নামাজের নিয়ত বেঁধেছেন। হাসিনার উঁচু স্বরের ডাক শোনা গেলো ওঘর থেকে। আপা, জলদি আয়। পানি পড়ে বিছানাটা যে একেবারে ভিজে গেলো।

পাকঘরে বোধ হয় মাহমুদের জন্যে তেল গরম করতে এসেছিলো মরিয়ম। কান খাড়া করে ওর ডাক শুনতে পেলে সে।

একটু জোরে বৃষ্টি হলে ফাটল দিয়ে ফোঁটা-ফোঁটা পানি পড়তে থাকে ঘরে। প্রতি বর্ষায় তাই বাড়িওয়ালাকে বলে মিস্ত্রী আনিয়ে ফাটলগুলো মেরামত করতে হয়। তা না হলে বর্ষার মরশুমে ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়ে।

মরিয়ম এসে দেখলো টপটপ করে পানি পড়ে বিছানাটা বেশ ভিজে গেছে। দু-বোনে দু-মাথায় ধরে চৌকিটা একপাশে নিয়ে এলো। যেখানে পানি পড়ছিলো সেখানে একটা পানির পাত্ৰ এনে বসিয়ে দিলো মরিয়ম। হাসিনা বললো, আজ রাতে থাকবে কেমন করে?

মরিয়ম কোনো জবাব দিলো না। চৌকির এক কোণে বসে পড়ে সে ভাবতে লাগলো কবে তাদের এমন দিন আসবে যখন এ বাড়ি ছেড়ে একটা ভালো বাসায় উঠে যেতে পারবে তারা, যেখানে ছাদটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে-ভেঙে পড়বে না মাথার উপর আর বৃষ্টির পানি তাদের চোখের ঘুম কেড়ে নেবে না? কিন্তু তেমন কোন দিন অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পেলো না মরিয়ম। হাতজোড়া কোলের উপর গুটিয়ে রেখে অসহায়ভাবে বসে রইলো সে। মা যখন ভাত খেতে ডাকলেন সকলকে, বৃষ্টি তখন থেমে আসছে। খাওয়া শেষ হতে অনেক রাত হয়ে গেলো।

বিছানায় শুয়ে বারবার এপাশ-ওপাশ করছিলেন হাসমত আলী।

সালেহা বিবি শুধালেন, কী ব্যাপার, অমন করছে কেন?

না, কিছু না। আবার পাশ ফিরে শুলেন হাসমত আলী।

কিছুক্ষণ পরে তার গলার আওয়াজ শোনা গেলো। মাহমুদ হঠাৎ চাকরিটা ছেড়ে দিলো কেন?

ওকে জিজ্ঞেস করলেই পারো। সালেহা বিবি উত্তর দিলেন, অত খামখেয়ালী হলে চলে? মাসে মাসে পঁচাত্তরটা টাকা কম ছিলো কিসে কণ্ঠস্বরে তার আক্ষেপ ধ্বনিত হলো।

হুঁ। আবার নড়েচড়ে শুলেন হাসমত আলী। তারপর মৃদু গলায় বললেন, ছেড়ে না দিলেই ভালো করতো।

একটু পরে নীরব হয়ে গেলেন দুজন।

সকালে ঘুম ভাঙতেই মরিয়মের মনে হলো, মাথাটা বড় বেশি ভার-ভার লাগছে ওর। গা-হাত-পা ব্যথা করছে। চোখের ভেতরটা জ্বলছে অল্প অল্প। হাত বাড়িয়ে হাসিনা আছে কিনা দেখলো মরিয়ম ৷ ও উঠে গেছে, এতক্ষণে পাশের বাড়ির বউটিকে হয়তো গলার মালাটা দেখাতে গেছে সে। মরিয়ম পাশ ফিরে শুলো। একটু পরে আবার ঘুমিয়ে পড়লো সে।

ভালো করে আকাশটা ফর্সা হবার আগেই উঠে পড়েছিলো মাহমুদ, মুখ-হাত ধুয়ে চা নাস্তা খাবার আগে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লো সে। পরিচিত দুচার জনের বাসায় গিয়ে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজের চাকরি ছেড়ে দেয়ার খবরটা জানালো, কোথাও কোন কাজের সুযোগ থাকলে যেন তাকে জানানো হয়–সে অনুরোধটাও তাদের করতে ভুললো না সে। বেশি টাকার আশা করে না মাহমুদ, শ’খানেক টাকা পাওয়া যেতে পারে এ-রকমের একটা চাকরি পেলে আপাতত চলে যাবে তার।

এখানে-সেখানে ঘুরে বিশ্রামাগারের চৌকাঠে যখন পা রাখলে সে, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে।

কেরোসিন কাঠের কাউন্টারের ওপাশে বসে হাতজোড়া সামনে প্রসারিত করে স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে নঈমকে কি যেন বলছিলো খোদাবক্স। হ্যাঁ, নতুন আসছে মেয়েটা; এইতো হপ্তাকানেক হলো। একশ’ টাকার মাষ্টারনী–এই যে, মাহমুদ সাহেব যে, কাল কেমন ভিজলেন? কত করে বললাম, আরেকটু বসে যান, আকাশটা একটু ধরে আসুক। মাহমুদকে নীরব থাকতে দেখে খোদাবক্স তার পুরনো কথায় ফিরে গেলো। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। নতুন মাষ্টারনী হয়েছে মেয়েটা। দেখতে কেমন বলছো? একেবারে আগুনের শিখা। গায়ের রংটা? কাঁচা হলুদ দেখছো কোনদিন? ঠিক তার মত। অনেক মেয়ে তো দেখলাম, অমনটি দেখি নি। একটা ঢোক গিয়ে খোদাবক্স আবার বললো, শরীরটা ছিপছিপে, চুলগুলো কোঁকড়ানো আর চোখ দুটো—।

দেখি আজকের খবরের কাগজটা এদিকে দাওতো।

মাহমুদের ডাকে কথার মাঝখানে হোঁচট খেলো খোদাবক্স। কাউন্টারের এককোণে রাখা খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে দিলো সে। তারপর আবার বললো, বসো না, চা খাও। একটু পরেই তো আসবে, দেখাবো তোমায়।

পত্রিকাটি খুলে চাকরির বিজ্ঞাপনের উপর চোখ বুলোতে লাগলো মাহমুদ। খোদাবক্সকে এখনো সে তার বেকারত্বের কথা শোনায় নি। তাহলে আর বাকিতে খেতে দেবে না। বলবে, এমনিতে এত টাকা জমা হয়ে আছে আপনার।

হ্যাঁ, মাহমুদ সাহেব ইয়ে হয়েছে, দশটা টাকা কি এ মাস থেকে বাড়লো আপনার? খোদাবক্স প্রশ্ন করছে।

পত্রিকা থেকে মুখ না-তুলে মাহমুদ জবাব দিলো, বাড়বে, এখনো বাড়ে নি। মিথ্যে কথা বলে আশু আক্রমণ থেকে মুক্তি পেলেও মনে শান্তি পাচ্ছিলো না সে।

তা হলে এ মাসে কিছু টাকা শোধ করছেন আপনি? খোদাবক্সের গলা।

তোমার কি হয়েছে বলতো। দিনে দিন একটা চামার হয়ে যাচ্ছো। সকালবেলা সবে এসেছি, অমনি টাকা-টাকা বলে চিৎকার শুরু করেছো? মাহমুদের গলা তিক্ততায় ভরা, টাকা শোধ করবো না বলে ভয় হচ্ছে নাকি তোমার? গরিব হতে পারি, নীচ নই, বুঝলে? যা খেয়েছি তা পাই-পাই করে শোধ করে দেবো। বেঈমান ভেবো না আমাদের, বেঈমান নাই। পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে রাস্তার পাশে পান-দোকানে ঝোলান দড়িটা থেকে আগুন ধরিয়ে এসে আবার বসলো মাহমুদ।

আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন মাহমুদ সাহেব। আমি বলছিলাম। কি—।

থাক, থাক, এবার চুপ করো। ওসব কথা শুনতে ভাল লাগে না আমার। বিড়িতে একটা জোর টান দিয়ে আবার পত্রিকার উপর ঝুঁকে পড়লো মাহমুদ।

খদ্দেরদের রাগাতে মোটেই প্রস্তুত নয় খোদাবক্স। তাহলে ব্যবসার ক্ষতি হয়। বিশেষ করে ছোটখাটো রেস্তোরাঁ যারা চালায় তাদের পক্ষে এটা একটা অভিশাপস্বরূপ।

খানিকক্ষণ ইতস্তত করে গলাটা একবারে খাদে নামিয়ে খোদাবক্স বললো, আপনাদের সেই ইন্টারভিউটার কি হলো মাহমুদ সাহেব?

বিড়ির ছাই ফেলতে ফেলতে মাহমুদ জবাব দিলো, কিছু হয় নি- হবে না যে জানতাম। তার গলার স্বরটা শান্ত।

শুনে আশ্বস্ত হলো খোদাবক্স। একটা খদ্দেরের কাছ থেকে চা আর টোষ্টের দামটা নিয়ে ক্যাশ বাক্সে রাখলে সে। তারপর সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো খোদাবক্স। রাতে বৃষ্টি হবার পর আজকের সকালটা অন্য দিনের চেয়ে আরো বেশি উজ্জ্বল লাগছে। মেয়ে স্কুলের লাল দালানটার গায়ে চিকচিক করছে এক টুকরো রোদ। গেটের সামনে মেয়েদের বয়ে নিয়ে আসা ঘোড়ার গাড়িগুলো একটা দুটা করে জমা হচ্ছে এসে। এক সময়ে ক্ষুদ্র চোখজোড়া বড় হয়ে এলো খোদাবক্সের। ওই যে আসছে–আসছে। চাপা উত্তেজিত গলায় বললো সে। চোখজোড়া তখনো রাস্তার উপর নিবদ্ধ তার।

ওর দৃষ্টি ধরে, মাহমুদ আর নঈম দু-জনে তাকালো সেদিকে।

খোদাবক্স মিথ্যে বলে নি। গায়ের রংটা ওর কাঁচা হলুদের মত। চুলগুলো ঘন কালো আর কোঁকড়ানো। দেহটা ছিপছিপে। সরু কটি। চোখজোড়া ভালো করে দেখতে পেলো না মাহমুদ। খোদাবক্স মৃদু হেসে বললো, এর কথা বলছিলাম, নতুন মাস্টারনী।

লাল দালানটার ভেতরে একটু পরেই অদৃশ্য হয়ে গেলো মেয়েটা। মাহমুদের মনে হলো কোথায় যেন তাকে দেখেছে সে। কোনো বাসায়? কোনো অফিসে? কোনো রাস্তার মোড়ে?

খোদাবক্স বললো, ওর নাম লিলি।

মাহমুদের মনে হলো, নামটাও এর আগে কোথায় শুনেছে সে। কার মুখে যেন শুনেছিলো? দূর তোর জাহান্নামে যাক মেয়েটা। দুহাতে মুখখানা ঢেকে নীরবে ভাবতে লাগলো মাহমুদ, কোথায় গেলে সে আশু একটা চাকরি পেতে পারে।

দুপুরের গানগনে রোদে চোখমুখ জ্বালা করছিলো ওর। আকাশে একটুও মেঘ নেই। রাস্তার পাশে একটি-দুটি পাতা ঝরা গাছ। ছায়াহীন পথ। মতিঝিলের চওড়া রাস্তাটা পেরিয়ে শান্তিনগরে প্রান্তিক প্রেসে যখন এসে পৌঁছলো মাহমুদ, তখন সূর্যের প্রখরতা এতটুকু কমে নি।

টিনের ছাপরা দেওয়া ছোট্ট প্রেস।

ছাপরার নিচে একখানা চৌকোণ টেবিলকে সামনে নিয়ে, চেয়ারে বসে শাহাদত তালপাতার পাখায় হাওয়া দিচ্ছিলো গায়ে। ওকে দেখে পাখাটা সামনে নাবিয়ে রেখে ত্ৰস্তপায়ে উঠে দাঁড়ালো সে। আরে, মাহমুদ যে, এসো এসো।

মাহমুদ বললো, উতলা হয়ে না, বসো। কোণায় রাখা গোল টুলটা টেনে এনে বন্ধুর মুখোমুখি বসলো সে। তারপর একটা লম্বা হাই ছেড়ে জামার বুতামগুলো একে-একে সব খুলে নিলো। পাখাটা হাতে নিয়ে জোরে বাতাস করতে করতে শুধালো, তারপর কেমন আছে বলো।

কেমন আছি জিজ্ঞেস করছো? অদ্ভুতভাবে হাসলো শাহাদাত, সুখে আছি, দিনে দিনে তলিয়ে যাচ্ছি।

মাহমুদ বিরক্তির সাথে বললো, হেঁয়ালি রাখো, আমেনা কেমন আছে?

শাহাদাত সংক্ষেপে বললো, ভালো।

ছেলেমেয়ে?

ভালো।

বাইরে গানগনে রোদের দিকে তাকিয়ে পাখাটা আরো জোরে নাড়তে লাগলো মাহমুদ। উপরের টিন তেতে গিয়ে গরমটা আরো বেশি করে লাগছে। এখানে।

হঠাৎ শাহাদাত শুধালো, তোমার কি খবর?

পাখা থামিয়ে মাহমুদ বললো, চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।

ছেড়ে দিয়েছো? শাহাদাত অবাক হলো, এতদিনে পারলে ছাড়তে?

মাহমুদ বললো, ধৈর্যের একটা সীমা আছে বুঝলে? বলে চাকরি ছাড়ার ইতিবৃত্তটা ওকে শুনালো মাহমুদ। সাংবাদিক হবার স্বপ্ন ছিলো, সে তো চুরমার হয়ে গেছে। সাংবাদিকতার নামে গণিকাবৃত্তি করেছি এ-কবছর। মালিকের হুকুম তামিল করেছি বসে বসে। গেলকে ঘি বলতে বলেছে, বলেছি। হাতিকে খরগোশ বানাতে বলেছে, বানিয়েছি। তবু বেটারা বেঈমামি করলো। জামার কলারটা তুলে ধরে জোরে বুকের মধ্যে বাতাস করতে লাগলো মাহমুদ।

কিছুক্ষণ পর শাহাদাত আবার প্রশ্ন করলো, এখন কি করবে তুমি?

সহসা কোন জবাব দিতে পারলো না মাহমুদ। কি ভেবে বললো, যে কোন একটা চাকরি পেলে করবো। তাইতো এসেছি তোমার কাছে। যদি কোথাও কোন প্রেসে কিছু-একটা জুটিয়ে দিতে পারো।

শাহাদাত বিব্রত গলায় বললো, আমার অবস্থা খুলে না বললেও তুমি বুঝতে পারো। কম্পিটিশনের বাজারে ভালো ক্যাপিটাল না-থাকলে বিজনেসে টিকে থাকা যায় না। প্রেসটা বোধ হয় বিক্রি করে দিতে হবে। ক্ষণকাল থেমে আবার বললো, থাকগে, নিজের দুঃখের কথা বলে তোমার দুঃখের বোঝা বাড়াতে চাই নে। আমার সাধ্যিমত চেষ্টা করে দেখেবো, যদি কিছু জুটিয়ে দিতে পারি।

শেষের কথাগুলো মাহমুদের কানে গেলো কিনা বোঝা গেলো না। সামনে ঝুঁকে পড়ে অবাক কণ্ঠে সে শুধালো, প্রেসটা কি বিক্রি করে দেবে তুমি? শাহাদাতের প্রেস বিক্রি করে দেবার খবরে যেন ভীষণ আঘাত পেয়েছে সে।

শাহাদাত ম্লান হেসে বললো, কিছু টাকা। যদি দিতে পারো তা হলে এ যাত্ৰা ঠেক দিয়ে রাখা যায়। টাইপগুলো সব পুরনো হয়ে গেছে। ওগুলো দিয়ে আর কাজ চালানো যাচ্ছে না। নতুন টাইপ না কিনলে লোকে এখানে ছাপতে আসবে কেন? তাছাড়া শহরে এখন অনেক অভিজাত ছাপাখানা হয়ে গেছে–তাদের পাশে আমার টিনের ছাপরাটা কি হাস্যকর নয়? কথা শেষে আবার হাসলো শাহাদাত।

মাহমুদ এতক্ষণে গম্ভীর হয়ে গেছে। মাস কয়েক আগে বউয়ের অলংকার বিক্রি করে টাইপ কেনার টাকা সংগ্রহ করেছিলো শাহাদাতা। সে-খবর মাহমুদের অজানা নয়। সে-টাকা তবে কি করেছে সে? জুয়োর আড্ডায় সব উড়িয়েছো বুঝি?

শাহাদাত চমকে বললো, কী?

আমেনার অলংকার বেচার টাকাগুলো?

শুনে বিমর্ষ হলো শাহাদাতা। ইতস্তত করে বললো, পাগল হয়েছো? জুয়োর আড্ডায় উড়াবো, পাগল হয়েছো?

থাক, আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত চাই নি, পাখাটা টেবিলের উপর নাবিয়ে রেখে মাহমুদ বললো, আমেনা আছে কি ভিতরে?

প্রসঙ্গটা আপনা থেকে ঘুরিয়ে নেয়ায় খুশি হলো শাহাদাতা। বললো না, ও ওর এক খালার বাড়ি গেছে, এইতো কমলাপুর। বসো, এক্ষুণি এসে যাবে।

মাহমুদ বললো, না, আমি আর বসবো না। বেলা অনেক হয়ে গেছে, এবার উঠি।

শাহাদাত বললো, কোথায় যাবে?

বাসায়।

আরেকটু বসো না, এক কাপ চা খেয়ে যাও।

না, এখন চা খাবো না।

আবার সেই গানগনে রোদের সমুদ্রে নেমে এলো মাহমুদ। পেছন থেকে শাহাদাতের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আবার এসো কিন্তু।

 

 

সেই যে সকালে মাথা ধরেছিলো মরিয়মের তারপর দুটো দিন বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারলো না সে। সারা গা কঁপিয়ে জ্বর এলো। সারা দেহে অসহ্য যন্ত্রণা।

এখনো গায়ে জ্বর আছে অল্প-অল্প। ডাক্তারের কাছ থেকে মিকচার এনে খাইয়েছেন হাসমত আলী। মাথার পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিয়েছেন সালেহা বিবি, হাসিনা গা-হাত পা টিপে দিয়েছে ওর।

শরীরটা ভয়ানক দুর্বল বোধ হলেও এখন অনেকটা সুস্থ মরিয়ম।

জানালা গলিয়ে এক ঝলক রোদ এসে পড়েছে। ঘরের কোণে, যেখানে একটা মাকড়সা জাল বুনছে আপন মনে। সুরকি-ঝরা লাল দেয়ালটা জুড়ে সাদা পাতলা আলোর জাল। চোখের পাতাজোড়া বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে রইলো মরিয়ম। সালেহা বিবি কখন এ ঘরে এসেছেন। টের পায় নি সে। কপালে একখানা হাত রেখে দেহের উত্তাপ নিলেন তিনি। তারপর মৃদুস্বরে বললেন এক বাটি বার্লি বানিয়ে দিই, কেমন?

মায়ের হাতের ওপর ওর ডান হাতখানা রেখে অস্পষ্ট স্বরে মরিয়ম বললো, খেতে ইচ্ছে করে না মা।

না খেলে যে শরীর আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। সালেহা বিবির কণ্ঠে কোমলতায় ভরা, বানিয়ে আনবো।

আনো মা! ক্ষীণ গলায় জবাব দিলো মরিয়ম।

একটু পরে ওর গায়ের কাপড়টা ভালোভাবে টেনে দিয়ে চলে গেলেন মা। তার পায়ের লঘু শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো দূরে।

কোথায় একটা কাক ডাকছে কা কা করে। এই মাত্র একটি চিল ডেকে গেলো। গলিতে বুঝি কোন ছেলে টিন পিটিয়ে খেলা করছে। কারা কথা বলছে ও বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব শুনছিলো মরিয়ম।

আপা! দোরগোড়ায় হাসিনার গলা, একটা লোক আসছে তোর কাছে, দেখা করতে চায়।

জ্বরের মধ্যেও চমকে উঠলো মরিয়ম।

হাসিনা কাছে এসে বললো, ভেতরে নিয়ে আসবো?

হাতের ইশারায় ওকে আরো কাছে ডেকে মরিয়ম শুধালো, নাম জিজ্ঞেস করেছিস লোকটার।

হাসিনা মাথা নাড়লো, না তারপর নাম জিজ্ঞেস করার জন্য বোধ হয়। আবার ফিরে যাচ্ছিলো হাসিনা।

মরিয়ম ক্ষীণ গলায় ডাকলো, হাসিনা এই শোন!

হাসিনা ফিরে দাঁড়ালো।

মরিয়ম বললো, মায়ের ঘর থেকে চেয়ারটা এনে এখানে রাখ। টেবিলের উপরে বইগুলো বড্ড আগোছালো হয়ে আছে। হ্যাঁরে হাসিনা, বাবা আছেন ঘরে?

হাসিনা ঘাড় নাড়ালো, না।

ভাইয়া?

না।

ইশারায় লোকটাকে ভেতরে নিয়ে আসতে বলে কাঁথাটা সারা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলো মরিয়ম।

প্ৰথমে মায়ের ঘর থেকে চেয়ারটা এ ঘরে রেখে গেলো হাসিনা। তারপর লোকটাকে নিয়ে এলো।

মরিয়ম যা আশঙ্কা করেছিল– মনসুর।

এ কী? ঘরে ঢুকে ওর চোখ পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়লো মনসুর। আপনার অসুখ করেছে নাকি? ওর কণ্ঠস্বরের এই ব্যগ্রতায় বিব্রত বোধ করলো মরিয়ম। দৃষ্টিটা ওর পায়ের পাতার কাছে নামিয়ে এনে আস্তে করে বললো, বসুন।

মনসুর বসলো।

হাসিনা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিলো। মাকে একটা নতুন লোক আসার খবর দেবার জন্য বোধ হয় চলে গেলো সে।

মরিয়ম তাকালো ওর দিকে।

একজোড়া গভীর সহানুভূতি ভরা চোখ চেয়ে দেখছে তাকে।

মরিয়ম বললো, তারপর কেমন আছেন?

ওর প্রশ্ন, খুশির আবির ছড়িয়ে দিলো মনসুরের চোখেমুখে। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বাঁ হাতের তালুটা ঘষতে ঘষতে সে জবাব দিলো, আমি ভালো আছি। আপনার অসুখ হয়েছে জানতে পেলে আরো আগে দেখতে আসতাম। দু-দিন ও-বাসায় আপনি গেলেন না, ভাবলাম কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে। মনসুর থামলো। শান্ত, স্নিগ্ধ ও গভীর দৃষ্টি নিয়ে সে তাকালো মরিয়মের দিকে।

মরিয়ম ইতস্তত করে বললো, এখন জ্বর প্রায় ছেড়ে গেছে। দু-একদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবো।

মনসুর বললো, দু-দিনের জুরে আপনি ভীষণ শুকিয়ে গেছেন।

রোগপাণ্ডুর মুখখানা ঈষৎ আরক্ত হলো মরিয়মের। ইচ্ছে হচ্ছিলো, গায়ের কাঁথাটা দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলতে তার। হাসিনা এসে এই বিপর্যন্ত অবস্থা থেকে মুক্তি দিলো তাকে।

মরিয়ম বললো, ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছে আপনার? আমার ছোট বোন হাসিনা।

মনসুর ফিরে তাকালো ওর দিকে। মৃদু হাসলো, তারপর বললো, উনিই তো ভেতরে এনেছেন আমায়।

হাসিনা চুপচাপ হাতের নখ খুঁটতে লাগলো। মরিয়ম দেখলো, মা দূর থেকে উঁকি মেরে একবার মনসুরকে দেখে চলে গেলেন। হাসিনাও গেলো তাঁর পিছু পিছু। শায়িত অবস্থায়, ওর দিকে তাকিয়েও মরিয়ম বুঝতে পারছিলো, একজোড়া সহানুভূতিভরা শান্ত চোখ গভীর দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে তাকে। অকারণে আরেক বার আরক্ত হলো মরিয়ম। কিছু না বলে নীরব থাকাটাও অস্বস্তিকর মনে হলো। অথচ কি যে আলোচনা করা যেতে পারে কিছু খুঁজে পেলো না। ‘হ্যাঁ, সেলিনা কেমন আছে?’ একটা কিছু আলোচনার বিষয়বস্তু পেয়ে আসন্ন বিপদমুক্ত হলো মরিয়ম।

মনসুর বললো, ভালো।

তারপর আবার নীরবতা।

এবার উঠি তাহলে। নীরবতা গুঁড়িয়ে বললো মনসুর, একটা কাজ আছে যাই এখন। আবার আসবো।

না না, যাবেন আর কি, আরেকটু বসুন, ক্ষীণ গলায় বললো মরিয়ম। দরজা লক্ষ্য করে তাকালো সে–যদি হাসিনাকে দেখা যায়। মনসুরকে চা-নাস্তা করানো উচিত এবং মা নিশ্চয়ই তার যোগাড়যন্ত্র করছে।

মরিয়মের অনুমান মিথ্যে নয়। একটু পরে, কিছুদিন আগে কেনা চায়ের কাপে চা আর একটা পিরিচে দুটো পান্তুয়া আর দুটো সন্দেশ সাজিয়ে নিয়ে এলো হাসিনা। টেবিলের উপর ওগুলো নামিয়ে রাখলে সে।

মরিয়ম বললো, এক গ্রাস পানি দিয়ে যাও হাসি।

মনসুর একবার টেবিলের দিকে, আরেকবার মরিয়মের দিকে তাকিয়ে নীরব রইলো।

মরিয়ম ওর দিকে কাৎ হয়ে শুয়ে বললো, আমরা গরীব। বিশেষ কিছু খাওয়াতে পারবো না আপনাকে,–এক কাপ চা খান। বলতে গিয়ে আবার আরক্ত হলো মরিয়ম। কিন্তু মনসুর গম্ভীর হয়ে গেছে, মুখখানা কালো হয়ে আসছে তার। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে এসেছে।

চা-নাস্তা খেয়ে আবার আসবো বলে চলে গেলো মনসুর।

ও চলে গেলে অনেকক্ষণ কেন যেন ভালো লাগলো মরিয়মের। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর যে ক্লান্তি বোধ করছিলো তা আর এখন নেই। বাইরে কোন পরিবর্তন হয় নি। গায়ে জ্বর এখনো আছে, মাথাটা ধরে আছে এখনো। তবু একটা আনন্দের আভা জেগে উঠেছে তার দুগালে। বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। গায়ের উপর থেকে কথাটা সরিয়ে দিয়ে, চোখ বুজে মনসুরের কথা ভাবতে লাগলো মরিয়ম।

কে এসে ছিলোরে মরিয়ম? মায়ের কণ্ঠস্বর। হাতে এক গ্রাস বার্লি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।

মরিয়ম বললো, সেলিনার বড় বোনের দেবর। বার্লির গ্লাসটার জন্য হাত বাড়িয়ে জবাব দিলো মরিয়ম। সে ভেবেছিলো, মা কিছু বলবেন, কিন্তু সালেহা বিবি আর কোন প্রশ্ন করলেন না। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মরিয়ম বুঝতে পারলো সালেহা বিবি লোকটার আগমনে সুখী হতে পারেন নি। কে জানে, হয়তো জাহেদের কথা মনে পড়ে গেছে তাঁর। কিন্তু সব পুরুষ কি এক রকম? বার্লির গ্লাস হাতে ভাবলো মরিয়ম। মনসুরকে জাহেদের মত বলে ভাবতে কোথায় যেন একটা যন্ত্রণা অনুভব করলো সে।

লোকটা করে কী? এতক্ষণে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন সালেহা বিবি।

বার্লিটা খেয়ে নিয়ে মরিয়ম জবাব দিলো, ব্যবসা করে।

কিসের ব্যবসা?

জানি না।

মা চলে গেলে অনেকক্ষণ মরিয়ম ভাবলো, মনসুরকে বলে দিলেই হতো সে যেন আর না আসে।

বিকেলে আবার এলো মনসুর।

এক বোতল হরলিক্স আর এক ঠোঙ্গা আঙ্গুর-বেদানা হাতে। সসঙ্কোচে ওগুলো টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলে সে। মরিয়মের দিকে সরাসরি তাকাতে সাহস পেলো না।

মরিয়ম অস্ফুটস্বরে বললো, ওখানে কী?

মনসুর সলজ্জ গলায় বললো, একটা হরলিক্স আর কিছু ফ্রুটস।

কেন এনেছেন শুধুশুধু। আর বেশি বলতে পারলো না মরিয়ম। মনে-মনে ওর প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছিলো তার। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারলো না। একজোড়া সহানুভূতিপূর্ণ লজ্জাবনত চোখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গেলো সে। সকালে এনে-রাখা চেয়ারখানা দেখিয়ে বললো, বসুন।

বাসায় বাবা আর মাহমুদ দু-জন আছেন এখন। তাদের কথা ভেবে শঙ্কিত হলো মরিয়ম। তারা নিশ্চয় মনসুরের এই আসা-যাওয়া শুভ চোখে দেখবে না। জাহেদকে এত সহজে ভুলতে পারে না। ওরা। মরিয়মও ভুলে নি।

এখন কেমন আছেন? গলার স্বরে উৎকণ্ঠা। কনুই-এর উপর ভর দিয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করলো মরিয়ম। ক্ষীণ গলায় বললো, ভালো।

মনসুরকে এখন বিদায় দিতে পারলে বাঁচে সে। রোগাক্লিষ্ট দেহে কোন রকমে অপঘাত সহ্য করতে পারবে না। বাবা মনে-মনে রাগ করলেও মুখে কিছু বলবে না। কিন্তু মাহমুদ হয়তো প্রকাশ্যে অপমান করে বসবে। আর তা খুব সুখপ্রদ হবে না মরিয়মের কাছে।

কেমন আছিস মা? বাবা এখন আসবেন তা জানতো মরিয়ম। মুহূর্তে সারা গাল রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেলো তার। হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে যেন শ্বাসরোধ করে দাঁড়ালো।

মনসুরকে দেখে বিব্রত বোধ করলেন হাসমত আলী।

মরিয়ম অস্ফুটস্বরে বললো, বাবা।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, ওদের দুজনকে চমকে দিয়ে হাসমত আলীর পা ধরে সালাম করলো মনসুর। ডানহাতখানা সামনে বাড়িয়ে ইতস্তত করে হাসমত আলী বললেন, থাক।

নিজের নাম আর পরিচয় শেষে শূন্য চেয়ারটা হাসমত আলীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মনসুর বললো, বসুন। যেন ঐ বাড়ির কর্তা। হাসমত আলী মেহমান হিসেবে এসেছেন।

মনসুরের ব্যবহারে দুজনে ওরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেলো।

হাসমত আলী বললো, না, না, আমি বসব না, আপনি বসুন।

মনসুর বসলো না–দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর অত্যন্ত সহজভাবে হাসমত আলীর সঙ্গে মরিয়মের চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করলো সে। একটা ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত। কিছু টনিক খাওয়ালে শারীরিক দুর্বলতা আর থাকবে না, তাও বললো মনসুর। বিব্রত বোধ করলেও অপ্ৰসন্ন যে হন নি হাসমত আলী, সেটা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো মরিয়ম। একটু আগের সকল শঙ্কা দূর হয়ে গিয়ে হাল্কা বোধ করলো সে।

পরদিন আবার এলো মনসুর।

পরদিন।

তার পরদিনও।

তারপর থেকে নিয়মিত ওদের বাসায় আসতে লাগলো মনসুর। বাবা, হাসিনা, সালেহা বিবি, খোকন, সকলকে কি এক অদ্ভুত যাদুবলে আপনার করে নিল সে। মরিয়ম নিজেও বুঝতে পারলো না, কেমন করে এটা সম্ভব হলো। স্রোতের মুখে তৃণখণ্ডের মত সমস্ত পরিবারকে দুর্বার বেগে তার কাছে টেনে নিয়ে এলো মনসুর। হাসমত আলীকে বাবা বলে সম্বোধন করলো সে, সালেহা বিবিকে মা। খোকনকে একটা ফুটবল কিনে দিলো, দুলুকে একটা প্লাস্টিকের পুতুল। হাসিনার জন্য ওর পছন্দ মত একটা শাড়ি কিনে আনলো–আর মরিয়মের জন্য নানা রকম টনিক, ফ্রুটস আর হরলিক্স।

দারিদ্র্য-বিধ্বস্ত পরিবারে খোদার ফেরেস্তা হিসেবে আবির্ভূত হলো মনসুর। কোনদিন ও না এলে মা চিন্তিত হয়ে শুধায়, কিরে, মনসুরটা তো আজ এলো না। অসুখ-টসুখ করে নি তো ওর?

বাবা বলেন, আসবে, বোধহয় কোন কাজে-টাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আহা বড় ভালো ছেলে। জীবনে কত মানুষ দেখলাম, এমন নম্র আর ভদ্র ছেলে আমি দেখি নি।

 

খোকন ফুটবলটা দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে, মনসুর ভাই আজ আসবে না আপা?

হাসিনা বলে, সত্যি, উনি না এলে কিছু ভালো লাগে না।

কোনো মন্তব্য করে না, শুধু একজন। সে মাহমুদ। ভোরে ঘুম থেকে উঠে নির্বিকার নির্লিপ্ততায় বাইরে বেরিয়ে যায় সে। সারাদিন আর ফেরে না। ফেরে রাত বারোটায়। কোনদিন খায়, কোনদিন না-খেয়ে শুয়ে থাকে। বাসায় কাউকে মুখ দেখাতে যেন লজ্জা বোধ করে সে। তাই সকলের ঘুম ভেঙ্গে ওঠার আগে বেরিয়ে যায়–আবার সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তবে বাসায় ফেরে।

মনসুর দু-একদিন জিজ্ঞেস করছিলো ওর কথা।

সালেহা বিবি হতাশ গলায় বলেছেন, ওর কথা আর বলো কেন বাবা? বাসায় খোঁজ খবর কি রাখে ও? সারাটা দিন কি চিন্তায় যে ঘুরে বেড়ায়, খোদা জানে।

হাসিনা বলে, ভাইয়া দিন দিন বাউণ্ডুলে হয়ে যাচ্ছে।

হাসিনা! মরিয়ম শাসানো-দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে।

হাসিনা বলে, বাউণ্ডুলে নয় তো কি? ভাইবোনগুলোর একটু খোঁজখবর নেয় কোনোদিন?

মরিয়ম বলে, ও কথা বলতে নেই হাসিনা।

হাসিনা চুপ করে যায়।

মরিয়ম এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বিছানা ছেড়ে এ ঘরে ও ঘরে চলাফেরা করে সে। বাইরে বেরুতে চেয়েছিলো। কিন্তু মনসুরের কড়া নিষেধ। জ্বর ছাড়লে কি হবে, আবার আসতে পারে। শরীরটা সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে বাইরে বেরুনো চলবে না।

মরিয়ম বলে, এখন তো কোন অসুখ নেই। সত্যি ভালো হয়ে গেছি।

মনসুর বলে, আরো ক’টা দিন যাক।

মরিয়ম বলে, সেলিনার নিশ্চয় পড়ার খুব ক্ষতি হচ্ছে?

মনসুর বলে, ঘাবড়াবার কিছু নেই, আপনার চাকুরি যাবে না। ওদের বলে দিয়েছি আমি, আপনার অসুখ।

মরিয়ম বলে, সত্যি আপনার কাছে অনেক ঋণী হয়ে রইলাম।

একটু ইতস্তত করে মনসুর বলে, ভালো হয়ে নিন, এক দিন না হয় এ ঋণ শোধ করার সুযোগ দেয়া যাবে আপনাকে।

বুকটা ধড়াস করে ওঠে মরিয়মের। চোখ তুলে ওর দিকে আর তাকাতে পারে না সে। বুকের কাছে কোথায় যেন একটু ভয়, একটু আনন্দ মিশে গিয়ে এক অপূর্ব অনুভূতির সৃষ্টি করে।

একদিন হাসিনা আর খোকনকে নিয়ে বেড়াতে বেরুলো মনসুর। মাকেও যেতে বলেছিলো। মা বললেন, আমি বুড়ো মানুষ, তোমরা যাও।

মনসুরের কিনে দেওয়া শাড়িখানা পরে, গলায় সেই পাথরের মালাটা জড়িয়ে বেরিয়ে যাবার সময় মরিয়মকে লক্ষ্য করে বলে গেছে হাসিনা, তুই বিছানায় শুয়ে থাক আপা, আমরা চললাম বেড়াতে। কি, খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি? মুচকি হেসে খোকনের হাত ধরে মনসুরের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে সে। ফিরে এসে উল্লাসে ফেটে পড়েছে হাসিনা।

মনসুর মোটরে করে পুরো রমনাটা ঘুরিয়েছে ওদের। রেসকোর্স, সারপেন্টাই লেক, আজিমপুর, মতিঝিল, কত জায়গায় গেছে। কি সুন্দর মনসুর ভাইয়ের মোটরটা। মাঝে মাঝে খুব জোড়ে চালাচ্ছিল আর এমন ভয় হচ্ছিলো আমার আপা!

হাসিনা বললো, খোকন বারবার পিগ পিগ করে হর্ণ দিছিলো, এত ভালো লাগছিলো আমার, বলতে গিয়ে সারা চোখ-মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিলো তার, কসবা রেস্টুরেন্টে কোনদিন গেছিস আপা? বাইরে কি গরম, আর ওখানে ঢুকলে ঠাণ্ডায় গা কাঁপে। মনসুর ভাই ওখানে নিয়ে গিয়ে পরটা-কাবাব খাওয়ালেন। তারপর গলির মাথায় আমাদের নামিয়ে বললেন, তোমার আপা ভালো হলে সবাইকে নিয়ে আরেক দিন বেড়াতে বেরুবো। কি মজা, তাই না আপা? মরিয়মকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে লুটিপুটি খেলো হাসিনা।

শুধু তখন নয়, পড়তে বসে, খাওয়ার সময়, শোবার আগখান দিয়েও কোথায় কোথায় গিয়েছিলো আর কি কি দেখেছে–সে সব কথা সকলকে শুধালো হাসিনা। বারবার মনসুরের প্রশংসা করলো। ওর মত এত ভালো লোক এ জীবনে সে দেখে নি। আর মনসুর ভাই দেখতে খুব সুন্দর—তাই না। আপা?

চমকে হাসিনার দিকে তাকালো মরিয়ম। কটাকটা চোখজোড়া স্বপ্নময়। আনন্দে চিকচিক করছে যেন।

তোমার কি হয়েছে হাসিনা? মনে মনে বললো মরিয়ম। জাহেদের কথা এ মুহূর্তে মনে পড়লো তার আর নিজের প্রথম যৌবনের কথা। খানিকক্ষণ সে শুধু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলো তাকে। এক প্ৰগলভতা কেন হাসিনার?

নিজেকে প্রশ্ন করলো মরিয়ম। হাসিনার প্রতিটি গতিবিধি, কথাবার্তা, আশঙ্কাজনক বলে মনে হলো তার।

রাতে ভালো ঘুম হলো না মরিয়মের।

পরদিন সকালে অন্য দিনের মত বেরিয়ে গেলো না মাহমুদ। বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো। কুয়োতলায় বসে অনেকক্ষণ ধরে দাঁত মাজলো, মুখ হাত ধুলো। তারপর মায়ের ঘরে চা-নাস্তা করতে বসে খবরটা জানালো সে। নতুন একটা চাকরি হয়েছে তার। প্রেসে প্রুফ-রিডারের চাকরি। মাসে নব্বই টাকা করে দেবে।

মেঝেতে চাটাই বিছিয়ে গোল হয়ে বসে চা খেতে বসেছিলো সবাই। মুখ তুলে একবার করে তাকালো ওর দিকে।

সালেহা বিবি প্রথম কথা বললেন, রাত জেগে কাজ করতে হবে নাতো?

মাহমুদ বললো, রাত দিন ঠিক নেই, যখন দরকার হবে তখনি করতে হবে কাজ।

সালেহা বিবি বললেন, এ আবার কেমনতর চাকরি।

আর কেউ কোন মন্তব্য করলো না।

এক মুখ মুড়ি চিবোতে চিবোতে হাসিনা বললো, মনসুর ভাইকে বললে উনি আরো একটা ভালো চাকরি যোগাড় করে দিতেন তোমায়।

মনসুর ভাইটা আবার কে? যেন কিছু জানে না। এমনিভাবে সবার দিকে তাকালো মাহমুদ।

মরিয়ম যে মেয়েটাকে পড়ায় তার বড় বোনের দেবর। সালেহা বিবি জবাব দিলেন ক্ষণকাল পরে–তোমার সঙ্গে কি আলাপ হয় নি তার হবেই বা কেমন করে তুমি কি আর বাসায় থাকো?

এ ফাঁকে সেখান থেকে সরে পড়লো মরিয়ম।

হাসিনা ডাকলো–চা না খেয়ে চলে যাচ্ছিস কেন আপা?

মরিয়ম বললো, আসছি। কিন্তু সে আর এলো না।

মুখেপোরা মুড়িগুলো গিলে নিয়ে মাহমুদ বললে, বাসায় না থাকলে কি হবে, কোথায় কি হচ্ছে সে খোঁজ আমি রাখি মা। টাকার জন্যে যে তোমরা আত্ম বিক্রি করছে তা আমি জানি।

সকলে চুপ

মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও ছেলের কথার জবাবে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না হাসমত আলী।

হাসিনা অবাক হয়ে তাকালো মাহমুদের দিকে। এ কথার কোন অর্থ বোধগম্য হয় নি তার।

সালেহা বিবি ইতস্তত করে বললেন, যা মুখে আসে তা পট করে বলে বসিস না, বুঝলি? একটু চিন্তা করিস।

মাহমুদ পরক্ষণে জবাব দিলো, চিন্তা করার কথা আর কেন বলছি মা। লোকটার যদি টাকা পয়সা না থাকতো, সে যদি তোমার ছেলেমেয়েদের জন্যে এটা সেটা কিনে না দিতো তাহলে কি আর তাকে অমন মাথায় তুলে নাচতে তোমরা? মায়ের কাছ থেকে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়ালো মাহমুদ। নিজের ঘরে চলে যাবার আগ মুহূর্তে বলে গেলো–চা-টা আমার ঘরে দিয়ে যাস তো হাসিনা।

ও চলে গেলে হাসিনা মুখ বিকৃতি করে বললো, ভাইয়াটা যে কি মিছিমিছি অন্য লোককে গালাগাল দেবে, নিজে যেন কত বড় হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত একটা শাড়ি কিনে দিতে পারলো না আমায়, মুখে শুধু বড় বড় কথা।

ওই কথা বলে বলেই তো গেলো, যোগ করলেন সালেহা বিবি।

খোকন বললো, মনসুর ভাই কখন আসবেন?

সে কখন আসবে তাতে তোমার কি? হাসমত আলী খেঁকিয়ে উঠলেন, ওদের বাজে কথা ছেড়ে বই নিয়ে পড়তে বসো। উষ্মা বিরক্তি বিতৃষ্ণা।

সালেহা বিবি বললেন, ও কী করেছে যে ওকে অমন ধমকাচ্ছো তুমি?

হাসমত আলী বললেন, আজকাল পড়ালেখা কিছু করে ও? সারাদিন তো ঐ ফুটবলটা নিয়ে আছে।

ছেলেমানুষ একটু খেলাধুলো করবে নাতো কি? সালেহা বিবি জবাব দিলেন–তুমি শুধু-শুধু ওকে অমন করে ধমকিও না। চায়ের বাটি আর মুড়ির থালাগুলো হাতে নিয়ে পাকঘরে চলে গেলেন তিনি।

বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিলো মাহমুদ। চায়ের কাপটা পাশে নাবিয়ে রাখতে বইটা বন্ধ করে বললো, হাঁরে হাসি, ধর আমি যদি একটা বড় চাকরি করতাম, মাসে মাসে যদি শ-পাঁচেক টাকা আয় হতো আমার, আর তোদেরকে যতি রোজ বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতাম, এটা-সেটা কিনে দিতাম–থাওলে তোরা আমাকে খুব ভালোবাসতি তাই না?

হাসিনা বুঝলো না। অবাক হয়ে মাহমুদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে। তারপর ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, তুমি পাঁচশো টাকা আয় করতে পারলে তো। বলে ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো সে।

অপমানিত বৈাধ করলো মাহমুদ। সে পুরুষ। পাঁচশো টাকা আয় করার মতো সামৰ্থ কোনদিন তার হবে না। হবে না এ জন্য নয় যে–তার শক্তি নেই, ক্ষমতা নেই, যোগ্যতা নেই। হবে না এ জন্য যে–তার কোন বড়লোক হিতৈষী নেই, মন্ত্রী আত্মীয় নেই, অসৎ পথে অর্থ রোজগারের প্রবৃত্তি নেই। মরিয়ম। হঠাৎ চিৎকার করে ডাকলো সে–মরিয়ম। প্রথম তার কোন জবাব এলো না। দ্বিতীয় ডাকের একটু পরে মরিয়ম সশরীরে এসে হাজির–আমায় ডাকছে?

হ্যাঁ, বসো, এক চুমুকে চায়ের কাপটা শূন্য করে একটা বিড়ি ধরালো মাহমুদ। তুমি কি করবে ঠিক করেছাে।

মরিয়ম ইতস্তত করে বললো, এখনো কিছু ঠিক করি নি।

মাহমুদ বললো, কেন, ওই বড়লোকটার গলায় ঝুলে পড়লেই তো পারো, মন্দ কি? তীর্যক কণ্ঠস্বর।

মরিয়মের ইচ্ছে হচ্ছিলো মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। ক্ষোভে, দুঃখে, লজ্জায় চোখমুখে জ্বালা করে উঠলো তার। এ সময় হাসিনা না এলে হয়তো কেঁদে ফেলতো মরিয়ম।

হাসিনা দরজার ওপাশ থেকে বললো, কে এসেছে দেখে যা আপা।

ওর উচ্ছাস দেখে প্ৰথমে মরিয়মের মনে হয়েছিলো মনসুর। আর তাই মনে হতে ভীষণ বিব্রত বোধ করছিলো সে।

হাসিনা বললো, লিলি আপা এসেছে।

মরিয়ম হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। মাহমুদ বললো, তোমার সঙ্গে কথা কিন্তু শেষ হয় নি আমার। বান্ধবীকে বিদায় দিয়ে আবার এসো।

লিলি একা আসে নি, সঙ্গে তার একটা সতেরো-আঠারো বছরে ছেলে। হাতে একটা ক্যামেরা। লিলি পরিচয় করয়ে দিয়ে বললো, আমার মামাতো ভাই তসলিম, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। হাসিনা ফটো তুলবে বলেছিলো তাই ওকে নিয়ে এসেছি।

হাসিনা খুশিতে ডগমগ হলো।

মরিয়ম বললো, তোমাকে আরো আগে আশা করেছিলাম লিলি। এতদিন আস নি। কেন?

লিলি বললো, সারাদিন ছাত্রী পড়িয়ে বিকেলে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।

মরিয়ম বললো, আমার অসুখ করেছিলো, যদি মরে যেতাম!

লিলি অবাক হলো–অসুখ হয়েছিলো? আমাকে একটু খবর দিলেই তো পারতে, আমি কিচ্ছু জানি না।

মরিয়ম বললো, কার হাতে খবর পাঠাবো?

লিলি বললো, তোমার দাদাকে তো প্রায়ই দেখি, আমাদের স্কুলের সামনে একটা রেস্তোরাঁয় বসে বসে আড্ডা দেন। তার হাতে খবর পাঠালে পেতাম।

মাহমুদ সম্পর্কে লিলির মন্তব্যটা ভালো লাগলো না মরিয়মের।

হাসিনা বললো, দেখলি তো আপা, ভাইয়া সারাদিন রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা মারে, তাইতো বাসায় বেশি খায় না।

বাজে বকো না হাসিনা। মরিয়ম ধমকে উঠলো।

মুহূর্ত কয়েক আবহাওয়াটা গুমোট হয়ে রইলো।

অবশেষে পরিবেশটা হাল্কা করে দিয়ে লিলি বললো–চলো ফটো তুলবে।

হাসিনা হাততালি দিয়ে বললো, চল আপা, ভাইয়াকে ডাকবো?

তারপর তসলিমের দিকে চেয়ে বললো, আমার একটা ভালো ফটো তুলে দিতে হবে কিন্তু।

আপনারা কি গ্রুপ ফটো তুলবেন, না প্রত্যেকে আলাদা করে। তসলিম এতক্ষণে কথা বললো, আমার কাছে কিন্তু বেশি ফিল্ম নেই।

ফিল্ম না থাকলে এসেছেন কেন? হাসিনা পরক্ষণে জবাব দিলো, না এলেই পারতেন।

এই হাসিনা। ওর চুলের গোছা ধরে টান দিলো মরিয়ম।

তসলিমের কচি মুখখানা লাল হয়ে গোলো।

লিলি হেসে বললো, রাগ করো না হাসিনা–আরেক দিন ভর্তি ফিল্ম নিয়ে আসবে ও।

মরিয়ম বললো, বড় বেশি ফাজিল হয়ে গেছে।

ফটো তোলার জন্যে মাহমুদকে ডাকতে গেলে ও বললো, আমার অত সখ নেই।

মরিয়ম বললো, সবাই তুলছি আমরা।

মাহমুদ জবাব দিলো, তোমরা তোলা গে।

মা এসে বললো, কেন কি হয়েছে। ভাইবোন সবাই মিলে ওরা একটা ফটো তুলতে চাইছে, তাতে তোর এত আপত্তি কেন শুনি? তুই এমন হলি কেন অ্যাঁ?

উত্তরে কি যেন বলতে যাচ্ছিলো মাহমুদ। দোরগোড়ায় লিলিকে উঁকি মারতে দেখে থেমে গেলো সে। উঠে দাঁড়াতে মৃদু গলায় বললো, চলো তোমাদের যখন এত সখ হয়েছে।

কিন্তু কোথায় বসে ফটো তুলবে তা এক সমস্যা দাঁড়িয়ে গেলো। ছাদে বসে তুলবে বলে আগে ভেবেছিলো। ওরা। মাহমুদ বললো, পাগলামো আর কি। এক সঙ্গে সবাই ওখানে উঠলে ছাত্র ভেঙ্গে পড়বে।

হাসিনা বললো, একজন করে উঠলে তো হয়।

কিন্তু গ্রুপ ফটো তুলতে হলে সকলকে একসঙ্গে বসতে হবে। অবশেষে ঠিক হলো কুয়োর পাশে পাক ঘরের সামনে যে অপরিসর আঙ্গিনাটা আছে সেখানে বসবে ওরা।

ফটো তোলার ব্যাপারে হাসমত আলী কোন আপত্তি করলেন না। ছেলেমেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার সাহস তাঁর নেই। শুধু একবার মাথা চুলকে বললেন, আমায় কেন? বলতে বলতে কুয়োতলায় নেমে এলেন তিনি।

সালেহা বিবি বেঁকে বসলেন। বললেন, তোমরা তোলো, আমি দেখি।

মরিয়ম বললো, এসো না মা।

লিলি বললো, আসুন খালা আম্মা।

 

সালেহা বিবি বললেন, আমি বুড়ো মানুষ, আজ বাদে কাল মরবো, ফটো তুললে গুনাহ হয়। মনে তারও ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু ধর্মীয় সংস্কার বারবার বাধা দিচ্ছিলো এসে।

মাহমুদ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলো এতক্ষণ। বিরক্ত হয়ে এবার বললো, ফটো তোলার যদি ইচ্ছে হয়ে থাকে এসো মা তোমাদের অত ধানাইপানাই আমার ভালো লাগে না, আমি চললাম। ও চলে যেতে উদ্যত হলো।

ওর রাগ দেখে ফিক করে হেসে দিলো লিলি।

দাঁড়িয়ে, পেছন ফিরে ওর দিকে তাকালো মাহমুদ। একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মেয়েটা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না বোধ হয়। চোখ নামিয়ে নিলো। মা এতক্ষণে রাজী হলেন।

পাকঘরের সিঁড়ির ওপর পাশাপাশি বসলো।

মা-বাবা মাঝখানে। বাবার পাশে মাহমুদ। মায়ের পাশে মরিয়ম। সামনে বসলো হাসিনা, দুলু আর খোকন।

তসলিম বললো, একটু অপেক্ষা করতে হবে। রোদ ঢাকা পড়ে গেছে। মেঘটা সরে যাক৷

একফাঁকে খোকনের মনে পড়লো তার ফুটবলটার কথা। দৌড় দিয়ে খাটের তলা থেকে ওটা বের করে এনে কোলে নিয়ে বসলো সে। ওর ফুটবল নিয়ে বসতে দেখে, দুলুর মনে পড়লো ওর পুতুলটার কথা। ছুটে গিয়ে পুতুলটা নিয়ে এলো সে, ওর মুখে হাসি। খোকন একবার নিজের ফুটবল আর ওর পুতুলটার দিকে তাকিয়ে ভ্রু বঁকালো, আর আস্তে করে বললো, আমার দেখাদেখি।

মেঘ সরে গেছে, সকলেই ক্যামেরাটার দিকে তাকালো এবার।

গ্রুপ ফটো তোলা হয়ে গেছে। মাহমুদ চলে যাচ্ছিলো। হাসিনা পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো ওর। ভাইয়া পালাচ্ছে কেন, আমি তুমি আর আপা একখানা তুলবো।

মাহমুদ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, বাজে আবদার করো না।

মরিয়ম ডাকলো–ভাইয়া।

নাও, তুলতে হলে তাড়াতাড়ি তোল। মাহমুদ আবার এসে বসলো পাকঘরের সিড়ির ওপর। মরিয়ম আর হাসিনা ওর দু-পাশে।

লিলি মৃদু মৃদু হাসছিলো আর দেখছিলো ওদের। ওর দিকে চোখ পড়তে মরিয়ম বললো, এসো না লিলি তুমিও এসো।

হাসিনা ডাকলো, আসুন লিলি আপা, আসুন না। ওর গলায় অবদারের সুর।

মাহমুদের দিকে তাকিয়ে, মুখখানা রক্তে লাল হয়ে গেলো লিলির। দ্রুত ঘাড় নাড়লো সে–না তুলব না।

মাহমুদ এ প্রথম বললো ওর সঙ্গে–এত লজ্জা নিয়ে আপনি শহরে বেরোন কি করে? ফটো তুলতে আসুন।

লিলি এবার সরাসরি তাকালো ওর দিকে। মুখখানা স্নান হয়ে গেছে তার। মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বললো, আপনারা তুলুন।

ফটো তোলা শেষ হলে তসলিমকে ধরে বসলো হাসিনা–আমাকে ছবি তোলা শেখাতে হবে।

তসলিম সুবোধ বালকের মত মাথা নোয়ালো, আচ্ছা।

হাসিনা বললো, আচ্ছা তো বুঝলাম, কিন্তু আপনার দেখা পাওয়া যাবে কোথায়? তসলিম সঠিক কোন উত্তর না দিতে পেরে ইতস্তত করছিলো।

হাসিনা বললো, আপনি আমাদের বাসায় আসবেন, রোজ একবার করে আসতে হবে কিন্তু।

তসলিম মৃদু হেসে সায় দিলো–আসবো।

হাসিনা সহজে ছেড়ে দিলো না তাকে। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলো। কি করে ছবি ওঠে তা জিজ্ঞেস করলো। একটা ক্যামেরার দাম কতো জানতে চাইলো। আজকে তোলা ফটোগুলো কবে পর্যন্ত পাবে সে ব্যাপারে প্রশ্ন করলো। তসলিম কবে থেকে শিখেছে, শিখতে তার কতদিন লেগেছে, হাসিনার কতদিন লাগতে পারে, এমনি নানা আলাপের শেষে বললো, আমাকে কিন্তু শিখাতে হবে নইলে… কথাটা শেষ না করলেও অপূর্ব ভঙ্গিতে ওকে শাসলো হাসিনা।

এতদিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকলেও আজ লিলির সঙ্গে বাইরে বেরুলো মরিয়ম। দুটি কারণ ছিলো এর পিছনে। প্রথমত মাহমুদকে এ-মুহূর্তে এড়াতে চায় সে। দ্বিতীয়ত নিরালায় বসে মনসুর সম্পর্কে লিলির সঙ্গে আলাপ করবে। একটা সিদ্ধান্ত অবিলম্বে নিতে চায় মরিয়ম।

বাসায় ফিরতে সাঁঝ হয়ে গেলো। দুপুরে লিলির ওখানে খেয়েছে সে। তারপর গল্প করতে করতে কখন বেলা পড়ে এসেছে সে খেয়াল ছিলো না।

বাইরে থেকে হাসিনার উচ্ছসিত গলার স্বর শুনে বুঝতে পেরেছিলো, মনসুর এসেছে।

মাহমুদ ঘরে আছে কিনা উঁকি মেরে দেখে, বারান্দায় বার কয়েক হোঁচট খেয়ে যখন ভেতরে এলো মরিয়ম, তখন সকাল বেলা ফটো তোলার ব্যাপারটা মনসুরকে শোনাচ্ছিলো হাসিনা। তসলিম তাকে ফটো তোলা শেখাবে বলেছে। সে খুব ভালো ছেলে-বড় ভালো–এসব কথাও তাকে বলছিলো সে।

মনসুর অন্যমনস্কভাবে শুনছিলো সব। মরিয়মকে দেখে মুখখানা মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে স্নানতায় ফিরে এলো।

কখন এসেছেন আপনি? ভেতরে এসে প্রশ্ন করলো মরিয়ম।

অনেকক্ষণ। ম্লানমুখে বললো মনসুর, আপনি বুঝি আবার বেরুতে শুরু করেছেন?

মৃদু হেসে ওর পাশ কাটিয়ে এসে বিছানার ওপর বসলো মরিয়ম। ময়লা চাদরটার দিকে চোখ পড়তে, হাসিনার প্রতি একটা কটাক্ষ হানলো সে।

হাসিনা আবার ফটো তোলার খবর শোনাতে লাগলো। তারপর বললো, আমাকে একটা ক্যামেরা কিনে দিতে হবে মনসুর ভাই।

মনসুর হেসে দিয়ে বললো, কিনে দেবো।

মরিয়ম উসখুস করছিলো। অকস্মাৎ হাসিনার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি একটু বাইরে যাও হাসি, মনসুর সাহেবের সঙ্গে আমার কিছু আলাপ আছে। গলার স্বরটা অদ্ভুত শোনালো মরিয়মের।

মনসুর অবাক চোখে তাকালো ওর দিকে।

একবার মরিয়ম, আরেকবার মনসুরের দিকে তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো হাসিনা।

একেবারে চলে গেলো না সে। বারান্দায় আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে রইলো।

দুজনে নীরব।

মরিয়ম ভাবছিলো কী করে কথাটা বলা যায় ওকে।

মনসুর শঙ্কিত হলো, চরম মুহূর্তটি বুঝি আজ এলো ওর সামনে।

আরো অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে, অদূরে টেবিলটার দিকে তাকিয়ে মরিয়ম বললো, আপনি রোজ রোজ এখানে কেন আসেন?

যা আশঙ্কা করছিলো মনসুর।

সারা দেহে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর এলো।

ক্ষণকাল পরে সে বললো, সে কথা কি এ মুহূর্তে শুনতে চান আপনি? ওর চোখে চোখ পড়তে দ্রুত চোখজোড়া নাবিয়ে নিল মরিয়ম।

হ্যাঁ। গলাটা কেঁপে উঠলো তার।

আবার নীরবতা।

নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো মনসুর। বার-কয়েক ঢোক গিলে অবশেষে বললো, আমি আপনাকে ভালবাসি।

অপ্রত্যাশিত কিছু ছিলো না, তবু সারা দেহ দুলে উঠলো মরিয়মের। জীবনে আরেকটি ক্ষণ, মুহূর্ত মনে পড়ে গেলো। বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে ভয়ে-আনন্দে। মুখ তুলে ওর দিকে তাকাতে পারলো না মরিয়ম। মনে হলো, ওর দৃষ্টির সামনে থেকে যদি নিজেকে এখন কোথাও লুকিয়ে ফেলতে পারতো সে? বিছানার চাদরটাকে ডান হাতে আঁকড়ে ধরলো মরিয়ম। ওকে চুপ থাকতে দেখে অদ্ভুত গলায় মনসুর আবার বললো, আমি জানি আপনি কি ভাবছেন। যদি অন্যায় কিছু বলে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দেবেন আমায়। আরেক বার ঢোক গিললো সে। কথাগুলো ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না আমি, আপনি বিশ্বাস করুন, জীবনে এই প্রথম একটি মেয়েকে ভালবেসেছি আমি। যেদিন আপনাকে প্রথম দেখি সেদিন।

কথার খেই হারিয়ে ফেললো মনসুর।

সমস্ত দেহটা কুঁচকে একটুখানি হয়ে এলো মরিয়মের। ভয় আর আনন্দ। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না সে। খানিকক্ষণ পরে মনসুর আবার বললো, আপনি হয়তো মনে মনে ঘৃণা করতে পারেন আমাকে, কিন্তু যেদিন আপনাকে প্রথম দেথি সেদিনই ঠিক করেছিলাম আপনাকে বিয়ে করবো।

মরিয়ম চমকে তাকালো ওর দিকে।

একজোড়া যন্ত্রণাকাতর চোখ।

পরক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মরিয়ম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, বাবাকে বলবেন, দয়া করে এসব কথা বাবাকে বলবেন। আমি কিছু জানি না বলে তার সামনে থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো মরিয়ম।

আর এলো না।