চার
বিয়ের আনুষঙ্গিক আয়োজনগুলো যত সহজে সারা যাবে বলে মনে করেছিলেন হাসমত আলী, কাজে নেমে দেখলেন সেগুলো তত সহজ নয়। টাকা-পয়সার স্বল্পতা পরিকল্পনাগুলোকে বানচাল করে দেয়। তবু বড় প্রসন্ন হাসমত আলী।
মেয়ের জন্যে এমন পাত্র কোনদিন আশা করেননি তিনি। কল্পনাও ছিলো না। তবে, যেদিন থেকে মনসুর এ বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু করে সেদিন থেকে সালেহা বিবির সঙ্গে এ বিষয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা করেছেন তিনি। আশা নিরাশায় দুলেছেন দুজনে। স্বপ্ন দেখেছেন।
অবশেষে স্বপ্ন তাদের সফল হতে চলেছে।
ভয় ছিলো একটি, সে হলো মাহমুদ। তাঁরা ভেবেছিলেন মাহমুদ এ বিয়েতে বিরোধিতা করবে। ঝগড়া বাধাবে। অকারণে হৈ চৈ করবে। বাধা না দিলেও প্রতিবাদ অবশ্য করেছে মাহমুদ। বলেছে–তোমাদের মেয়ের বিয়ে দেবে সে তোমরা জানো, তোমাদের মেয়ে জানে। আমাকে শুধু শুধু জিজ্ঞেস করতে এসেছো কেন মা?
সালেহা বিবি বলেছেন সে কি, তোকে জিজ্ঞেস করবো নাতো কাকে জিজ্ঞেস করবো, তুই হলি বড় ছেলে।
মায়ের কথা শুনে হেসেছে মাহমুদ। হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলেছে, দেখো মা, আমার মতামত যদি চাও তাহলে বলবো, এ বিয়েতে মত নেই আমার। অবশ্য আমার মতামতের ওপর ওটা নাকচ করে দাও, সেটা আমি চাই নে।
এ আবার কেমনতর কথা হলো, সালেহা বিবি অবাক হয়ে বললেন, তোর মত থাকবে না কেন, এর চেয়ে ভালো বর আর কোথায় পাবি ওর জন্যে?
মাহমুদ বললো, মা, কেন মিছামিছি আমার মেজাজটা চড়াচ্ছো। ভালো খারাপের কতটুকু তুমি জানো? যে লোকটার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে বলে আহ্লাদে আটখানা হচ্ছো তার চরিত্র বলে কোনো পদার্থ আছে কিনা খোঁজ নিয়েছো?
দেখ মুখে যা আসে তা বলে দিস না, একটু ভাবিস। সালেহা বিবি বিরক্তির সাথে বললেন, কে বললো তোকে ওর চরিত্র খারাপ?
মুখ কালো করে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো মাহমুদ। তারপর ধীরে ধীরে বললো, মা, তুমি বুঝবে না, মরিয়মকে ডেকে জিজ্ঞেস করো এ দেশে কটা লোক আছে যে তার চরিত্র ঠিক রেখে বড়লোক হতে পেরেছে? অন্যকে ফাঁকি দিয়ে, ধোঁকাবাজ আর লাম্পট্য করে, শোষণ আর দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে টাকা রোজগার করে বড়লোক হয়েছে সব। তাদের আবার চরিত্র! ও-সব বাজে কথা আমাকে শুনিয়ো না মা। তোমাদের মেয়ে তোমরা বিয়ে দাওগে, আমার কোন মতামত নেই।
পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে ধরালো মাহমুদ।
উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাবার পথে মা আস্তে করে বললেন, তোমার মত থাকুক কি, না থাকুক এ বিয়ে হবে।
মা চলে গেলে, একটা বই খুলে বসে বার কয়েক বিড়িতে জোর টান দিলো মাহমুদ।
ওর মতামতটা মরিয়মের কাছেও অজানা ছিলো না। তাই, পারতপক্ষে মাহমুদের সামনে আসে না সে। যতক্ষণ মাহমুদ ঘরে থাকে ততক্ষণ খুব সাবধানে চলাফেরা করে মরিয়ম। কখনো সামনে পড়ে গেলে, লজ্জায় চোখমুখ লাল হয়ে আসে। পাশ কাটিয়ে একপাশে সরে যায় সে।
আরেকটা ব্যাপারে বড় শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো মরিয়ম। আনিসা বেগমকে কি করে মুখ দেখাবে সে। সেলিনাকে মনসুরের কাছে বিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে মনের বাসনাটা জানিয়েও ছিলেন মরিয়মকে। তাকে বড় বিশ্বাস করতেন তিনি। অবশেষে যেদিন মরিয়মের সঙ্গে বিয়ের কথা শুনবেন সেদিন ওর সামনে কি করে গিয়ে দাঁড়াবে মরিয়ম?
ইদানীং সেলিনাকে পড়াতে যায় সে।
সম্পর্কটা আগের মতই আছে। কিন্তু আর কতদিন এভাবে চলবে সেটা জানে না মরিয়ম। একদিন নিশ্চয় খবরটা যাবে ওদের কানে। যাক, সে নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না সে। তার চেয়ে বিবাহিত জীবনের সুন্দর কল্পনা করতে ভালো লাগে। ভয় আর আনন্দ মেশানো এক অপূর্ব অনুভূতি।
হাসিনা সবচেয়ে খুশি।
বিয়ের পর ওকে একটা ক্যামেরা কিনে দেবে কথা দিয়েছে মনসুর। তসলিমের কাছে ও ছবি তোলা শিখছে। তার সঙ্গে বসে আপার বিয়ের সময় ঘরগুলো কিভাবে সাজাবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করে সে। একটা বাঁশের গেট তৈরি করতে হবে বাড়ির সামনে। কিছু পটকা বাজী কিনবে ওরা। আর কয়েক দিস্তা লাল নীল কাগজ। হ্যাঁ, একটা উপহার ছাপাতে হবে সবার নামে। তোমার নামটাও ওখানে থাকবে তসলিম ভাই, তাই, না? তসলিম মাথা নুইয়ে সায় দেয়–হ্যাঁ।
কিন্তু ঐ সবের জন্য টাকার দরকার। বাবার কাছ থেকে কিছু পাওয়া যাবে না জানতো হাসিনা। মাহমুদ শুনলে রাগ করবে। তাই চুপি চুপি মনসুরের কাছ থেকে দশটা টাকা আদায় করে নিয়েছে সে। কাউকে বলে নি, বলেছে শুধু তসলিমকে। ওকে দিয়ে কেনাবে সব। আর জানিয়েছে মাকে। মা বললেন, খবরদার মাহমুদের কানে যেন না যায়। বড় বোনের বিয়ে, একটু আমোদ-ফুর্তি করবি না তো কী?
হাসিনা বলে, আমায় নতুন একটা শাড়ি কিন্তু কিনে দিতে হবে মা।
মা বললেন, বলেছি তো কিনে দেবো।
হাসিনা খুশিতে ঘরময় নেচে বেড়ায়।
মনসুর আজকাল আসা বন্ধ করেছে। মরিয়ম নিষেধ করেছে তাকে। ও এলে মরিয়ম বিব্রত বোধ করে। ওর সামনে আসতে লজ্জা লাগে মরিয়মের। আমার কথা ভেবে, এ কটা দিন আর এসো না তুমি। মনসুরকে বলেছে সে। যদি দেখা করতে হয় বাইরে করো, কিন্তু সেলিনাদের ওখানে নয়।
একদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে মাহমুদকে ডেকে বসলেন হাসমত আলী। সালেহা বিবিও একখানা পাখা হাতে বসলেন তাদের পাশে। বিয়ের তারিখটা ঘনিয়ে আসছে। কাদের নিমন্ত্রণ করতে হবে। কি খাওয়ানো যেতে পারে। কত টাকার প্রয়োজন তার একটা হিসেব করলেন হাসমত আলী।
মাহমুদ বললো, দলসুদ্ধ লোক নিমন্তন করার দরকার নেই। যাদের না করলে নয় তাদের দাওয়াত করো।
সালেহা বিবি বললেন, কাউকে বাদ দিলে তো চলবে না, বড় মেয়ের বিয়ে–।
তাই বলে সবাইকে দাওয়াত করতে হবে নাকি। অত লোক খাওয়াবে কি করে? হাসমত আলী ছেলের পক্ষ নিলেন। টাকার চিন্তা বারবার বিভ্রান্ত করছিলো তাকে। কেরানীর জীবনে সঞ্চয় সম্ভব নয়। হাসমত আলীও কিছু জমাতে পারে নি। অথচ ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে হলে মোটা অঙ্কের না হোক মোটামুটি একটা অঙ্কের প্রয়োজন।
মাহমুদ বললো, দেখি এ মাসে বেতনটা যদি অগ্রিম পাওয়া যায় তাহলে পুরোটা দিয়ে দেবো আমি।
সালেহা বিবি বললেন, তাহলে তুই চলবি কেমন করে?
সে কথা তোমাকে ভাবতে হবে না মা। মৃদু গলায় জবাব দিলে মাহমুদ। কাদের দাওয়াত করতে হবে একটা তালিকা তৈরি করলেন হাসমত আলী। কি খাওয়ানো হবে সে সম্পর্কেও আলোচনা হলো, ক্রমে রাত বাড়লে মাহমুদ ঘুমোতে চলে গেলো।
ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে শুধু জেগে রইলেন অনেক রাত পর্যন্ত। টাকার কথা ভাবছিলেন ওঁরা।
সালেহা বিবি ফিসফিস করে বললেন, মরিয়মকে দিয়ে মনসুরের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার চাইলে ও নিশ্চয় দেবে।
হাসমত আলীও তাই ভাবছিলেন। এমনি হাত পাতা যাবে না। ধার চাইতে হবে। পরে শোধ করতে যে পারবেন না, তা জানেন তিনি। তবু ধার চাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু মাহমুদ যদি জানতে পারে তাহলে বাড়িশুদ্ধ মাথায় তুলবে।
হাসমত আলী চাপা গলায় বললেন, চাইলে নিশ্চয় দেবে, কিন্তু মাহমুদ কি জানবে না ভেবেছো?
সালেহা বিবি বললেন, জানুক। জানলে কি হবে, ও পারবে অতগুলো টাকা যোগার করে দিতে?
স্ত্রীর কথায় আশ্বস্ত হতে পারলেন না হাসমত আলী। ইতস্তত করে বললেন, এক কাজ করলে হয় না, অন্য কারো কাছ থেকে কর্জ নিলে।
শোধ করবে কেমন করে? পরক্ষণে সালেহা বিবি জবাব দিলেন তাছাড়া দুটো মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে সে খেয়াল আছে? হাসিনা আর দুলুর কথা বলছেন সালেহা বিবি।
ওদের বিয়ে দিতে হবে একদিন।
বাতি নিভিয়ে দিয়ে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে আরো অনেকক্ষণ আলাপ করলেন ওরা। টাকা সংগ্রহের বহুবিধ উপায় নিয়ে জল্পনা কল্পনা করে অবশেষে দুজনে নীরব হলেন।
রাতে ভাল ঘুম হলো না ওদের।
পরদিন সকালে চা খেতে বসে মাহমুদ বললো, দেখো মা, খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা না করে, নাস্তাপানি খাইয়ে সকলকে বিদায় দেবার বন্দোবস্ত করো। গরিবের অত ভোজ খাওয়াবার চিন্তা না করাই ভালো। মা বললেন, গরিব হয়েছি বলে বুঝি স্বাদ-আহ্লাদ নেই আমাদের?
মাহমুদ মৃদু হাসলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো, মা, রোজ পাঁচ বেলা যার কাছে মাথা ঠোকো, তাকে ভুলেও কি একবার জিজ্ঞেস করতে পারো না, এত স্বাদ-আহ্লাদ দিয়ে যদি গড়েছেন তোমাদের, সেগুলো পূরণ করার মত সামর্থ্য কেন দেননি?
এ-কথার তাৎপর্য ঠিক ধরতে পারলেন না সালেহা বিবি। তাই চুপ করে রইলেন তিনি।
ও ঠিক বলছে। ছেলেকে সমর্থন জানালেন হাসমত আলী–অত ভোজ দেবার কি দরকার, আমাদের সামথ্য যখন নেই–৷ কথাটা শেষ করলেন না তিনি।
সালেহা বিবি বললেন, সামর্থ্য কজনের থাকে। তাই বলে কি তারা বড় মেয়ের বিয়েতে নাস্তা পানি খাইয়ে মেহমান বিদায় করে? আমার পোড়া কপাল নইলে–দু-চোখে পানি এসে জমা হলো তাঁর। আঁচলে চোখ মুছলেন তিনি।
মায়ের কান্না দেখে আর কোন কথা বলতে সাহস পেলো না মাহমুদ। চা-টা শেষ করে নীরবে উঠে গেল সে। হাসমত আলী বার কয়েক মাথা চুলকালেন তারপর দুহাটুর মধ্যে মুখ গুঁজে চুপচাপ কি যেন ভাবতে লাগলেন তিনি।
আজ মরিয়মের বিয়ে। সকাল থেকে পুরো বাড়িটায় উৎসব। মেহমান, অতিথি, গিজগিজ করছে ঘরগুলো, বারান্দা, কুয়োতলা।
ভোরে ভোরে পাকঘরে ঢুকেছে সালেহা বিবি। সেখান থেকে আর বেরোয় নি। পাড়ার কয়েকজন বয়স্ক মহিলা–যাদের ওরা নেমন্তন করেছিলো–কাজের সহায়তা করছে তাঁকে।
হাসিনা, খোকন আর তসলিম আগের রাতে সাদা সুতোয় লাল-নীল কাগজ এঁটে ঘরগুলো সাজিয়েছে। সামনে একটা বাঁশের তোরণ তৈরি করেছে তারা। মাহমুদের ঘরটায় বরযাত্রীদের এনে বসানো হবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে, ওর বইপত্র আর কাগজগুলো মায়ের খাটের নিচে একটা চাটাই বিছিয়ে তার ওপর রেখে এসেছে মাহমুদ। কুয়ো থেকে পানি তুলে এনে নিজ হাতে ঘরটা ধুয়ে-মুছে দিয়েছে সে। লিলি এসেছে। সেলিনাও এসেছে আজ। ওকে নিজে গিয়ে আমন্ত্রণ জানাতে সাহস পায়নি মরিয়ম। চিঠি লিখে জানিয়েছে। আনিসা বেগমের মুখোমুখি হতে ভয় ওর। সেলিনাকে দেখে বেশ খুশি হয়েছে বলে মনে হলো। মনসুর ভাই-এর সঙ্গে মরিয়ম আপার বিয়ে আনন্দ যেন উপছে পড়ছে ওর চোখেমুখে। মা আসতে নিষেধ করেছিলেন। তবু চুপি চুপি চলে এসেছে সেলিনা। ওরা সব মরিয়মের ঘরে, ঘিরে বসেছে ওকে। গল্প করছে, হাসছে, কৌতুকে ফেটে পড়ছে মাঝে মাঝে।
হাসমত আলী পাকঘরে গিয়ে একবার সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এলেন, দুপুরের মধ্যে সবকিছু তৈরি হওয়া চাই। অপরাহ্নে বর আসবে।
মাহমুদ সব আয়োজন শেষ করে ফরাসের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে বিড়ি ধরালো একটা। অন্য ঘরে আত্মীয়-স্বজনেরা এসে ভিড় জমালেও এখানে সকলকে আসতে নিষেধ করেছে। চিৎকারে মাথা ধরে ওর।
লিলি উঁকি মেরে চলে যাচ্ছিলো।
মাহমুদ ডাকলো ওকে, শুনুন।
লিলি ফিরে এসে বললো, আমায় ডেকেছেন? সারা গায়ে ঘাম ঝরছে তার। শাড়ির আঁচল দিযে বার বার মুখ মুছছে।
মাহমুদ বললো, ওখানে হৈ হট্টগোলের মধ্যে যদি আপনাদের ভালো না লাগে, এখানে এসে বসতে পারেন। আমি বাইরে বেরুচ্ছি।
লিলি মৃদু হেসে বললো, ধন্যবাদ।
মরিয়ম আর সেলিনাকে নিয়ে এ ঘরে দরজায় খিল এঁটে দিলো লিলি। বাব্বাঃ গরমে সেদ্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। ফরাসের উপর শুয়ে শাড়ির আঁচলে গায়ে বাতাস দিতে লাগলো ওরা।
হাসিনা কড়া নাড়ছিলো।
প্রথমে কেউ সাড়া দিলো না। পরে সে যখন দরজার উপর দুমদাম শব্দে কিল চাপড় দিতে লাগলো তখন উঠে দরজাটা খুলে দিলো সেলিনা।
ভেতরে এসে হাসিনা বললো, এখানে শুয়ে শুয়ে কি করছো তোমরা, আমি খুঁজে-খুঁজে হয়রান। দরজায় খিল এঁটে ওদের পাশে শুয়ে পড়লো সে।
লিলি বললো, বিয়ের পর আমাদের ভুলে যাবে না তো ম্যারি?
মরিয়ম হাসলো। কিছু বললো না।
সেলিনা ক্ষণকাল পরে জিজ্ঞেস করলো, বিয়ের পর আমাকে আর পড়াতে যাবে না তুমি, তাই না আপা?
মরিয়ম ওর চুলে সিঁথি কেটে দিয়ে বললো, যেতাম, কিন্তু তোমার মা যে আর ও বাড়িতে ঢুকতে দেবে না আমায় সেলিনা।
আপার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলো সেলিনা। তারপর বললো, আচ্ছা আপা, মা তোমার বিয়ের খবর শুনে অমন রেগে গেছেন কেন? বারবার শুধু গালাগাল দিচ্ছিলেন তোমাকে। আমাকেও।
হাসিনা পরক্ষণে বললো, আপনার মায়ের ভীমরতি হয়েছে।
মায়ের সম্পর্কে কটু মন্তব্য শুনে মুখখানা কালো হয়ে গেলো সেলিনার।
মরিয়ম ধমকের সুরে বললো, বাজে বকো না হাসিনা, এখান থেকে যাও।
হাসিনা পাশ ফিরে শুলো।
বাইরে বিয়েবাড়ির হাঁক-ডাক, হৈ-হুল্লোড় আর ধুপধাপ শব্দ এখান থেকেই শোনা যাচ্ছে। পাড়ার প্রবীণেরা বাইরে দাওয়ায় বসে সুখ্যাতি গাইছে বরের–হাসমত আলীর কপাল, নইলে, অমন বড়লোক বর ক’জনের ভাগ্যে জোটে!
লিলি মুখখানা মরিয়মের মুখের কাছে বাড়িয়ে এনে, ওর চিবুকটা নেড়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো, কার কথা ভাবছিস ম্যারি, বরের কথা বুঝি?
ধ্যাৎ। লজ্জায় লাল হয়ে গেলো মরিয়ম। কপট অভিমানে মুখখানা অন্য দিকে সরিয়ে নিলো সে।
দুপুরে, যথা সময়ে বরযাত্রীরা এলো।
গলির মাথায় একসার মোটর থামিয়ে, নোংরা আবর্জনা পেরিয়ে আসতে বেশ কষ্ট হলো ওদের।
ঘরে পাখা নেই, গরমে হাঁসফাঁস করলো তারা। কলকল শব্দে কথা বললো।
খেলো।
পান চিবোল।
বিয়েটা নির্বিঘ্নে হয়ে গেলো মরিয়মের।
কন্যা সম্প্রদানের সময় হু হু করে কেঁদে দিলেন হাসমত আলী। সুখী হও মা, সুখে থেকো।
সালেহা বিবি আঁচলে মুখ মুছলেন, কুয়োতলায় বসে ডুকরে কাদলেন। পাড়ার বয়স্কা মহিলারা সান্তুনা দিলেন তাকে।
এ সময়ে কাঁদতে নেই বউ। সব মেয়ে কি চিরকাল বাপের বাড়ি থাকে?
হাসিনার চোখেও অশ্রু। কান্না লুকোতে গিয়ে দরজার আড়ালে মুখ লুকালো সে।
মাহমুদ নির্বাক। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে সে শুধু নীরবে চেয়ে-চেয়ে দেখছিলো, কেমন করে একটি মেয়ের জীবন এক ছেলের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেলো এক মুহূর্তে।
রাতের প্রথম প্রহরে কনে নিয়ে চলে গেলো ওরা।
সঙ্গে খোকন গেলো। তসলিম গেলো। কয়েকজন নিকট ও দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও গেলো কন্যাপক্ষ হয়ে।
মাহমুদকে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করেছিলো সকলে, ও গেলো না। ফরাসের উপর চুপচাপ শুয়ে রইলো সে।
মেহমান অতিথি যারা এসেছিলো তারা বিদায় নিয়ে গেছে অনেক আগে। সেলিনা চলে গেছে। পাড়ার বউ ঝিয়েরাও। লিলিকে যেতে দেয় নি হাসিনা। বলেছে, আজ রাতে তুমি থাক লিলি আপা, নইলে একা ভীষণ ভয় করে আমার।
লিলি বলেছে, পাগল, বাসায় না গেলে বকবে সবাই।
সালেহা বিবি বলেছেন, যাবে আর কি, আরো কিছুক্ষণ থেকে যাও না, রাতে খেয়ে যেয়ো।
লিলি গেলো না। পাকঘরে সবকিছু গোছাবার কাজে মাকে সহায়তা করলো হাসিনা আর লিলি।
একটু আগে যে বাড়িটা গমগম করছিলো মানুষের কোলাহলে, এখন সেখানে কবরের নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে থালাবাসনগুলো নাড়াচাড়া আর কুয়োতলায় পানি তোলার শব্দ হচ্ছে।
তন্দ্রায় দুচোখ জড়িয়ে এসেছিলো মাহমুদের।
হাসিনার ডাকে তন্দ্রা ছুটে গেলো।
হাসিনা বললো, ভাইয়া খাবে এসো।
মাহমুদ বললো, তুই যা আমি আসছি। পরক্ষণে কি মনে হতে আবার বললো, হ্যারে, সবাই কি চলে গেছে?
হাসিনা বললো, হ্যাঁ, শুধু লিলি আপা আছে।
মায়ের ঘরে এসে মাহমুদ দেখলো বাবা কাত হয়ে শুয়ে আছেন খাটের ওপর। দুলু ঘুমোচ্ছে। খোকন মেঝেতে বসে দুলুর পুতুলগুলো নিয়ে খেলছে। আজ ওর ছুটি। হাসিনা আর লিলি কুয়োর পাড়ে বসে গল্প করছে।
খাওয়া শেষ হলে লিলি বললো, এবার যাই আমি আসি।
সালেহা বিবি বললেন, এত রাতে যাবে তুমি?
লিলি বললো, পারবো খালাম্মা।
মাহমুদকে পেয়ে সালেহা বিবি বললেন, তুই কি বাইরে বেরুবি আজ?
মাহমুদ বললো, হ্যাঁ, এখনি বেরুবো। সারাদিন তো তোমাদের বিয়ের ঝামেলায় কাটলো। এখন সারারাত জেগে প্রুফ দেখতে হবে আমায়। কিন্তু কেন বলতো?
সালেহা বিবি ইতস্তত করে বললেন, লিলি মেয়েটা একা যাচ্ছে, ওকে একটু এগিয়ে দিয়ে–। কথাটা শেষ করলেন না তিনি।
মাহমুদ ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো, দিতে পারি ওর যদি আপত্তি না থাকে।
লিলি ঢোক গিললো, কিছু বললো না।
রাতের এই প্রহরে পথঘাটগুলো বড় নির্জন হয়ে আসে। টিমটিমে বাতি-জ্বলা দোকানীরা শেষ খদ্দেরের প্রত্যাশায় তখনো বসে। আশে-পাশে কোন রিক্সা নেই।
লিলি বললো, আপনার যদি কোন অসুবিধা না হয় যেতে পারেন, আমার কোন আপত্তি নেই।
তারপর নীরবে দুজনে হেঁটে চললো ওরা। কখনো আগে-পিছে। কখনো পাশাপাশি। মাহমুদ কি যেন ভাবছিলো। হঠাৎ সে বললো, কি অদ্ভুত! তাই না?
লিলি চমকে তাকালো ওর দিকে–কী?
মাহমুদ বললো, এই বিয়েটা।
লিলির কিছু বোধগম্য হলো না। অবাক হয়ে শুধালো–বিয়েটা মানে?
হ্যাঁ এই বিয়েটার কথা বলছিলাম। মাহমুদ ধীরে ধীরে বললো, কতগুলো লোক এলো, খেলো আর হাত তুলে মোনাজাত করলো, ব্যাস, একটা মেয়ের জীবন আরেকটা ছেলের জীবনের সঙ্গে চিরকালের জন্যে গেঁথে গেলো। এই ফার্সটা না করলেও তো চলে।
লিলি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, বিয়ে বুঝি ফার্স বলে মনে হয় আপনার কাছে?
মাহমুদ মুখ ঘুরিয়ে তাকালো ওর দিকে। একটা তীক্ষ্ণ্ম তীব্র দৃষ্টি। সে দৃষ্টি সব কিছু অস্বীকার করতে চায়। সারা পথ আর একটি কথাও বললো না মাহমুদ। লিলিকে তার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যখন প্রেসে এসে পৌঁছলো তখন রাত সোয়া এগারোটা। টেবিলের ওপর স্তুপাকার প্রুফসিটগুলো রাখা আছে। ওগুলো দেখে শেষ করতে রাত দুটো তিনটে বেজে যাবে। তারপর বাসায় ফিরবে না মাহমুদ। লম্বা টেবিলটার ওপর গুটিসুটি হয়ে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেবে।
একটা বিড়ি ধরিয়ে চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো মাহমুদ। পরদিন ভোরে বিশ্রামাগারে যখন এলো সে, তখন চোখজোড়া ভয়ানক জ্বালা করছে।
রেস্তোরাঁয় আর কোন খদ্দের আসেনি এখনো। খোদাবক্স টেবিল চেয়ারগুলো সাজাচ্ছে আর চাকর ছোড়াটা আগুন দিচ্ছে চুলোয়। ওকে আসতে দেখে খোদাবক্স বললো, ইয়ে হয়েছে মাহমুদ সাহেব, আপনাকে যেন বড় কাহিল কাহিল মনে হচ্ছে আজ?
মাহমুদ একখানা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লো, ইয়ে হয়েছে এক কাপ কড়া চা বানিয়ে দাও জলদি করে। থাকলে চায়ের সঙ্গে একটা টোষ্ট দিও।
ছেলেটা একটা পাখা এনে জোরে বাতাস করতে লাগলো চুলোয়। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে উপরে, ধীরে ধীরে আগুনের শিখাগুলো উঁকি মারলো। কালো চায়ের কেটলিটা চুলোর উপর তুলে দিলো সে। টেবিল চেয়ারগুলো ঠিকভাবে সাজানো হয়েছে কি না দেখে নিয়ে খোদাবক্স বললো, আজ বুঝি নাইট ডিউটি ছিলো? খোদাবক্স জানতো না যে মাহমুদ ও-চাকরিটা অনেক আগে ছেড়ে দিযেছে।
মাহমুদ টেবিলের উপর মাথা রেখে বললো, তোমার মাথা, চাকরি আমি কবে ছেড়ে দিয়েছি।
খোদাবক্স অবাক হয়ে বললো, কই কিছু বলেন নি তো আপনি?
তোমাকে সব কিছু বলতে হবে নাকি?
ধমক খেয়ে চুপ করে গেলো খোদাবক্স, তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে দেবার জন্যে ছেলেটাকে তাড়া দিলো। তারপর দুঠোঁটে হাসি টেনে আবার বললো, আপনার বন্ধু নঈমের একটা চাকরি হয়েছে, শুনেছেন কি মাহমুদ সাহেব?
শুনি নি, এই শুনলাম। দু-বাহুর আড়ালে মুখ লুকালো মাহমুদ।
ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন খদ্দের এসেছিলো, তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করলো খোদাবক্স। খাতাপত্র দেখে কি যেন হিসেব করলো। ড্রয়ারটা খুলে খুচরো পয়সাগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো। তারপর আবার বললো, ইয়ে হয়েছে মাহমুদ সাহেব, শুনলাম আপনার বোনের বিয়ে হয়েছে কাল?
এক চুমুক চা খেয়ে মাহমুদ বললো, তুমি জানলে কোথা থেকে?
খোদাবক্স ইতস্তত করে জবাব দিলো, না কাল আপনি আসেন নি কিনা, ওরা সবাই আলোচনা করছিলো।
হুঁ–কাপটা পিরিচের উপর থেকে আবার তুলে নিলো মাহমুদ।
খোদাবক্স মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, ইয়ে হয়েছে মাহমুদ সাহেব, শুনলাম ছেলের নাকি গাড়ি আছে।
হ্যাঁ।
তাহলে তো আপনার আর কোন চিন্তা নেই মাহমুদ সাহেব, এবার একটা চাকরি নিশ্চয় পাবেন। গদগদ গলায় বললো খোদাবক্স।
একটা টোষ্ট আর এক কাপ চা লিখে রাখুন। মাহমুদ উঠে দাঁড়ালো। বেরুতে যাবে এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো রফিক। এই যে মাহমুদ, তোমার কথা ভাবতে ভাবতেই আসছিলাম। তুমি কি চলে যাচ্ছো নাকি? একটু বসো প্লিজ বসো, একটু। তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে আমার।
মাহমুদ বললো, পরে বলো এখন ভালো লাগছে না আমার, বাসায় যাবো।
একটু বসে যাও, এই একটু। ওর গলায় করুণ আকুতি। প্রেমে পড়ার পর থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে সে।
মাহমুদ বসলো। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসলো রফিক। তারপর হাসি থামিয়ে বললো, এবার তুমি নিশ্চয় হতাশ করবে না আমায়, মাহমুদ।
মাহমুদ বললো, খোলাসা করে বলো, কিছু বুঝতে পারলাম না।
তোমার বোনের বিয়ের খবর আমরা পেয়েছি মাহমুদ। যদিও তুমি কিছুই জানাও নি।
মাহমুদ জবাব দিলো, আমার বোনের বিয়েটেত তোমাদের কিছু জানাবার ছিলো বলে মতো মনে হয় না।
না না, আমি সে কথা বলছি না। লজ্জা পেয়ে রফিক পরক্ষণে বললো, তুমি অল্পতেই সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ো। আমি বলছিলাম কি তোমার ভগ্নিপতির হাতে অনেক চাকরি আছে শুনেছি। তুমি যদি আমার হয়ে তাকে একটু বলো; কিম্বা তাকে চিঠি লিখে দাও।
ও এই ব্যাপার। মুখখানা কালো হয়ে গেলো মাহমুদের।
আমার জন্যে অন্তত এইটুকু তুমি করো মাহমুদ। নইলে মেয়েটির ওরা বিয়ে দিয়ে ফেলবে অন্য কোথাও। মনে হচ্ছিলো সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। ডুকরে গড়িয়ে পড়বে ওর পায়ের ওপর।
মাহমুদ নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর মৃদু গলায় বললো, তার চেয়ে একখানা ছুরি নিয়ে আমার গলাটা কেন কেটে দাও না বন্ধু?
তোমার কি আমার জন্যে এতটুকু অনুভূতি নেই মাহমুদ?
নেই।
মেয়েটির কথাও কি তুমি একটু ভাবছো না?
না।
তুমি কি পাথর দিয়ে তৈরি? এবার সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললো রফিক।
হ্যাঁ আমি পাথর দিয়ে তৈরি। ছুটে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো মাহমুদ। ওর জল ছলছল চোখজোড়া আর সহ্য হচ্ছিলো না মাহমুদের।
বাসায় এসে লম্বা একটা ঘুম দিলো মাহমুদ। ঘুম যখন ভাঙলো দুপুর গড়িয়ে গেছে। কুয়োতলায় বসে অনেকক্ষণ ধরে গায়ে পানি ঢেলে স্নান করলো সে। বাসায় এখন মা আর দুলু ছাড়া কেউ নেই। বাবা অফিসে, হাসিনা স্কুলে, খোকন মরিয়মের সঙ্গে গেছে। স্নান সেরে আসতে সালেহা বিবিও এলেন পিছু পিছু। মাহমুদ বুঝলো মা কিছু বলতে চান। চুলে চিরুনি বুলিয়ে নিয়ে সে তাকালো মায়ের দিকে–কিছু বলবে কি মা?
মা বললেন, মরিয়ম নেই, বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
মাহমুদ কোন মন্তব্য করলো না দেখে ক্ষণকাল পরে আবার বললেন তিনি–তুই একটা বিয়ে কর মাহমুদ। এ কথাটা বলতেই বোধ হয় এসেছিলেন সালেহা বিবি।
মৃদু হাসলো মাহমুদ।
হাসছিস কেন?
মা অবাক হয়ে বললেন, বয়স কি কম হযেছে তোর?
মাহমুদ হাসি থামিয়ে বললো, বিয়ে করে আরেকটা ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কি মা?
ঝামেলা হতে যাবে কেন? মা জবাব দিলেন, বউ আনলে লক্ষ্মী আসবে ঘরে।
মাহমুদ ভ্রু বাঁকিয়ে বললো, খাওয়াবে কি?
সালেহা বিবি বললো, কেন আমরা কি উপোস থাকি?
অনেক জোড়াতালি দেয়া, মায়ের পরনের শাড়িটার দিকে চোখ নামিয়ে এনে আস্তে করে বললো, যেভাবে আমরা থাকি, সেভাবে মানুষ থাকে না মা! কি দরকার আরেকটা নিরীহ মেয়েকে অমানুষ বানিয়ে?
নিজের শতচ্ছিন্ন শাড়িটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন সালেহা বিবি।
আমেনার শাড়িটাও অজস্র ছেড়া আর তালিতে ভরা। সেও মা। তারও ছেলেমেয়ে আছে। স্বামী আছে। তবু সালেহা বিবির সঙ্গে কোথায় যেন একটা ব্যতিক্রম রয়েছে ওর। চৌকির এক কোণে বসে নীরবে আমেনাকে দেখছিলো আর ভাবছিলো মাহমুদ।
ঘরটা ঝাঁট দিয়ে, টুকিটাকি জিনিসপত্রগুলো গোছাচ্ছিলো আমেনা। মুখ তুলে বললো, প্রেস বিক্রি করে দেবে দাও। বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করো কেন? আমি করবো না বললেই কি আর রেহাই পাওয়া যাবে।
কথাগুলো শাহাদাতকে উদ্দেশ্যে করে।
মাহমুদের মুখোমুখি একবার টুলের ওপর বসে ছিলো সে। নড়েচড়ে একবার মাহমুদ আরেকবার আমেনার দিকে তাকিয়ে সে বললো, তাই বলে তোমার বুঝি কোন মতামত থাকবে না?
আমেনার মতামত ছাড়া শাহাদাত কিছু করে না তা নয়। এ ক্ষেত্রে আমেনার মতামত চাওয়ার মধ্যে একটা সুপ্ত ইচ্ছে লুকিয়ে রয়েছে, সেটা জানতো মাহমুদ। আমেনার বড় তিন ভাই বেশ রোজগার করছে ইদানীং। ধানমণ্ডিতে বাড়ি করেছে ওরা। গাড়িও কিনেছে একখানা। ছেলেমেয়ে নিয়ে ওরা বেশ সুখে আছে। আমেনা ইচ্ছে করলে এ দুঃসময়ে হাত পাততে পারে ওদের কাছে। রক্তের ভাই, সহজে না করবে না। প্রেসটাকেও তাহলে বিক্রির হাত থেকে বাচানো যাবে। কিন্তু, প্রস্তাবটা সরাসরি মুখ ফুটে বলতে ভয় পায় শাহাদাত। আমেনার স্বভাবটা ওর অজানা নয়। আমেনা কিছুক্ষণ পরে বললো, আমার মতামত আবার নতুন করে কি দিবো। চালাতে না পারলে বিক্রি করে দাও।
শাহাদাত বললো, তারপর চলবে কেমন করে?
আমেনা গম্ভীর হয়ে বললো, আর পাঁচজন যেমন করে চলে। বলে বাচ্চা ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলো আমেনা।
এতক্ষণে মাহমুদ একটি কথাও বলে নি। সে ভেবেছিলো, মায়ের সঙ্গে আমেনার ব্যতিক্রম যেখানে–সেখানে ওর সঙ্গে রয়েছে একটা আশ্চর্য মিল। না তা নয়। আমেনাকে ওর নিজের চেয়ে বড় মনে হলো আজ।
শাহাদাত মৃদু গলায় বললো, দেখলে তো, কী যে স্বভাব পেয়েছে ও বুঝি না। দূরের কেউ তো নয়, আপন মায়ের পেটের ভাই, দরকার পড়েছে তাই হাত পাতবে। ভিক্ষে তো চাইছি না, ধার চাইছি। এতে অসম্মানের কি হলো?
মাহমুদ চুপ করে রইলো।
ওকে নীরব থাকতে দেখে শাহাদত আবার বললো, আরে ভাই, ওদের হচ্ছে হারামীর টাকা। কন্ট্রাকটারী করে, রাস্তায় রাস্তায় রোজগার করছে। দিতে একটু গায়ে লাগবে না।
মাহমুদ আস্তে করে বললো, ওই হারামী টাকাগুলো এনে তোমার অনেক শ্রমে গড়া প্রেসটাকে কলুষিত করো না শাহাদাত। তারচেয়ে বিক্রি করে দাও ওটা।
ওর কাছ থেকে কোন রকম সমর্থন না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়লো শাহাদাত। সবার ইচ্ছে প্রেসটা বিক্রি করে দেয়। কিন্তু বিক্রির কথা ভাবতে গিয়ে নিজের মন থেকে সত্যিকার কোন সাড়া পায় না সে। বুকটা ব্যথায় চিনচিন করে ওঠে। কত কষ্টে গড়া ওই প্রেস। বার কয়েক উসখুস করে ধরা গলায় হঠাৎ শাহাদাত বললো, তোমরা কি আমার কথা একবার ভাবো না? ওই প্রেসটার পেছনে সর্বস্ব দিয়েছি আমি, ওটাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে কি করে বাঁচবো, বলো।
মাহমুদ নীরব।
পর পর কয়েকটা লম্বা শ্বাস নিলো শাহাদাত। তারপর অনেকক্ষণ অভিমানেভরা কণ্ঠে বললো, ঠিক আছে, তাই হবে বলে চুপ করে গেলো সে।
এ সময়ে আবার এ ঘরে এলো আমেনা। মরিয়মের বিয়ে প্রসঙ্গে মাহমুদকে দুচারটে প্রশ্ন করলো সে। কোথায় বিয়ে হয়েছে, ছেলে দেখতে শুনতে কেমন, কি করে। পানদানটা সামনে রেখে একটা পান বানিয়ে খেলো আমেনা। তারপর আবার চলে গেলো। অনেকক্ষণ পর মাহমুদ বললো, প্রেসটা বিক্রি করে দেবার পর কি করবে? চাকরি-বাকরি–!
কথাটা শেষ করতে পারলো না। শাহাদাত বাধা দিয়ে বললো, কি যে বলো তুমি? আমি চাকরি করবো? আমেনা তাহলে গলায় দড়ি দেবে। বলে হেসে উঠলো সে। হাসতে গিয়ে চিবুকে অনেকগুলো ভাঁজ পড়লো তার।
মাহমুদ কিছু বলবে ভাবছিলো।
আমেনা আবার এলো সেখানে–কী হলো অমন হাসছে যে। বলতে গিয়ে খুকখুক করে বার কয়েক কাশলো সে। আবার কাশলো।
শাহাদাত শঙ্কিত চোখে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, তোমার কাশটা দেখছি আরো বাড়লো।
আমেনা পরক্ষণে বললো, না কিছু না।
শাহাদাত বললো, কিছু না নয়, তুমি ভীষণ ঠাণ্ডা লাগাও আজকাল। এ কথার কোন জবাব দিলো না আমেনা। খানিকক্ষণ কেশে নিয়ে ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসলো সে।
ওদের এই দাম্পত্য আলাপের মাঝখানে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো মাহমুদ। কাল বিকেলে এতক্ষণে বর এসে গেছে মরিয়মের। আজ সে শ্বশুরবাড়ি। সঙ্গে খোকনও আছে। হাসিনা ফিরেছে স্কুল থেকে।
বাসায় এখন বাবা, মা, দুলু আর সে হয়তো বসে বসে বিয়ের গল্প করছে। কাল স্বামীসহ আবার ফিরে আসবে মরিয়ম। হাসিনার ঘরে ওদের থাকার বন্দোবস্ত করা হবে। হাসিনা থাকবে মায়ের সঙ্গে। আর বাবার জন্যে মাহমুদের ঘরে একটা নতুন বিছানা পাতা হবে। মা হয়তো এতক্ষণে সে বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন বাসায় সবার সঙ্গে। মাহমুদ উঠে দাঁড়ালো।
শাহাদাত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ওকি উঠলে কেন?
মাহমুদ আস্তে করে বললো, না, এবার যাই।
যাবে আর কি বসো না।
না, আর বসবো না।
কোথায় যাবে? টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা হাই তুললো শাহাদাত।
মাহমুদ বললো, প্রেসে, দেখি কোন কাজ আছে কি না। শরীরটা আজ বড্ড ম্যাজম্যাজ করছে, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাবো।
আমেনা পেছন থেকে শুধালো, মরিয়ম ফিরছে কখন?
মাহমুদ সংক্ষেপে বললো, কাল।
আমেনা বললো, আবার এসো তুমি, খাওয়ার দাওয়াত রইলো।
মাহমুদ আস্তে বললো, আসবো। তারপর শাহাদাতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় নেমে এলো সে।
দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো মরিয়ম। বিয়ের পর তিনটে মাস কেটে গেছে। দিনগুলো যেন বাদাম তোলা নৌকোর মতো দেখতে না দেখতে চলে গেলো। প্রথম প্রথম মনসুর তো ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলো। সারাদিন ঘরে থাকতো। সারাক্ষণ মরিয়মের পাশে। মরিয়ম রাগ করে বলতো ব্যবসাটা কি ডোবাবে নাকি?
মনসুর বলতো, তোমার জন্যে ডোবে যদি ডুবুক। ক্ষতি নেই। রোজ বিকেলে সাজপোশাক পরে, চকোলেট রঙের গাড়িতে চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছে ওরা। যেখানে যেতে চেয়েছে মরিয়ম, সেখানে নিয়ে গেছে মনসুর।
মাঝে বারকয়েক বাবার বাড়িতেও এসেছিলো মরিয়ম। দিন দুতিনেক করে থেকে গেছে।
আরো থাকতো। মনসুরের পীড়াপীড়িতে থাকতে পারে নি।
নিজের স্বচ্ছল জীবনের পাশে বাবা মা-ভাইবোনের দীনতা মনে আঘাত দিয়েছে মরিয়মকে। যখন যা পেরেছে, টাকা-পয়সা দিয়ে ওদের সাহায্য করছে সে। মনসুর কথা দিয়েছে, একটা ভালো বাড়ি দেখে সেখানে নিয়ে আসবে ওদের। ভাড়াটাও নিজেই দেবে, আর হাসিনা ও খোকনের পড়ার খরচটা চালাবে মনসুর। শুনে প্রসন্ন হয়েছে মরিয়ম। মাবাবারও খুশির অন্ত নেই। যখন হাত পেতেছেন কিছু না কিছু পেয়েছেন মনসুরের কাছে। জীবনটা বেশ চলছিলো।
কিন্তু দুমাস না যেতে, অকস্মাৎ একদিন প্রথম জোয়ারের উচ্ছাসে ভাটা এলো। খাওয়ার টেবিলে সেদিন বড় উন্মনা মনে হচ্ছিল মনসুরকে। শোবার ঘরে এসে প্রথম বললো, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ম্যারি, উত্তর দেবে?
শঙ্কিত দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে মরিয়ম জবাব দিলো, কি কথা, বলো।
জাহেদ নামে কোন ছেলেকে তুমি চিনতে? ওর দৃষ্টি মরিয়মের চোখের উপর।
বুকটা বহুদিন পর কেঁপে উঠেছে মরিয়মের। ইতস্তত করে বললো, চিনতাম।
মনসুরের মুখখানা কাল হয়ে এলো। ক্ষণকাল পরে সে আবার বললো, তার সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিলো তোমার?
মুখখানা মাটির দিকে নামিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো মরিয়ম। তারপর মুখ তুলে সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে বললো সে, ওকে আমি ভালবাসতাম বলতে গিয়ে একটা ঢোক গিললো মরিয়ম |
ভালবাসতে! যেন আর্তনাদ করে উঠল মনসুর।
মরিয়ম আস্তে করে বললো, হ্যাঁ। মাথার উপরের পাখাটা আরো জোরে ঘুরিয়ে দিয়ে মনসুর কাঁপা গলায় বললো, তারপর?
মরিয়মের দেহটা পাথরের মত নিশ্চল ঠাণ্ডা। অকম্পিত গলায় সে জবাব দিলো, তখন আমি স্কুলে পড়ি। বাবা হঠাৎ পড়া বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেললেন আমার। জাহেদকে আমি ভালবাসতাম। আমাদের পাড়াতেই সে থাকতো। কলেজে পড়তো। সেও ভালবাসতো আমায়। মরিয়ম থামলো, থেমে বার কয়েক ঘন ঘন শ্বাস নিলো সে। তারপর আবার বললো, বাবা যখন কিছুতেই বিয়ের আয়োজন বন্ধ করলেন না তখন একদিন রাতে ওর সঙ্গে পালিয়ে গেলাম আমি।
পালিয়ে গেলে! দ্বিতীয়বার আর্তনাদ করে উঠলো মনসুর।
মরিয়ম অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। ঢাকা থেকে পালিয়ে চিটাগাং চলে গেলাম আমরা। জাহেদ তার মায়ের কিছু অলঙ্কার আর নগদ টাকা সঙ্গে নিয়েছিল। কথা হয়েছিল চাটগাঁ গিয়ে একটা বাসা ভাড়া নেবো আমরা। জাহেদ একটা চাকরি জোগাড় করবে। মরিয়ম থামলো।
টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে এসে আবার বললো মনসুর–তারপর?
পাখার বাতাসে কালো চুলগুলো বারবার উড়ে উড়ে পড়ছিলো মরিয়মের ফর্সা মুখের ওপর। আস্তে করে সে আবার বললো, ওখানে গিয়ে বাসা পাওয়া গেলো না, একটা সস্তা হোটেলে একখানা রুম ভাড়া করেছিলাম আমরা।
একসঙ্গে ছিলে? ওর মুখের দিকে তাকাতে সাহস হলো না মনসুরের। মরিয়ম হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে
জবাব দিলো, হ্যাঁ।
তারপর?
পাখার নিচে ঘামতে শুরু করেছে মনসুর।
তারপর সেখানে দু-মাস ছিলাম আমরা–মরিয়ম মৃদু গলায় বললো, টাকা পয়সা সব ফুরিয়ে গিয়েছিলো, ভীষণ কষ্টে দিন কাটছিলো আমাদের। তারপর একদিন–বলতে গিয়ে ইতস্তত করলো মরিয়ম, তারপর একদিন আমাকে সেখানে একা ফেলে রেখে কোথায় যেন চলে গেলো জাহেদ, আর ফিরলো না। বলতে গিয়ে এতক্ষণে চোখজোড়া পানিতে টলমল করে উঠলো তার।
মরিয়মের কথা শেষ হয়ে গেলে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো ওরা। পাখাটা ঘুরছে মাথার উপর। ঘরের মধ্যে শুধু তার বনবন শব্দ। কারো দিকে কেউ তাকালো না ওরা। কি এক নির্বিকার নীরবতায় দুজনে ডুবে গেলো। পরস্পরের কাছাকাছি অস্তিত্বটা ধীরে ধীরে যেন দূরে সরে গেলো। মরিয়মের মনে হলো, অনেকক্ষণ পরে, বহুদূর থেকে যেন মনসুর জিজ্ঞেস করছে তাকে, জাহেদকে সত্যি ভালবাসতে তুমি?
মরিয়ম মাথা নোয়ালো–হ্যাঁ।
এখনো ভালবাস? দ্বিতীয় প্রশ্ন।
মরিয়ম মাথা নাড়লো–না।
মনসুরের মনে হলো মিথ্যে কথা বলছে মেয়েটা।
সে রাতে আর কোন কথা হলো না।
মরিয়ম লক্ষ্য করেছে, সারারাত ঘুমোতে পারে নি লোকটা।
পরদিন সকালে, মাঝে মাঝে তাল ভঙ্গ হয়ে গেলেও আগের মত ব্যবহার করলো মনসুর। বাইরে বেরুবার সময় রোজকার মত দুহাতে ওকে আলিঙ্গন করে মৃদু গলায় বললো, কাজটা সেরে আসি, কেমন? মরিয়ম ওর মুখের কাছে মুখ এনে মিষ্টি হেসে বললো, এসো।
কিন্তু দুপুরে আবার যখন ফিরে এলো মনসুর, তার মুখখানা তখন আবার ভার হয়ে গেছে। সারা মুখে চিন্তার ছায়া। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলো সে। খাওয়ার পরে, বিছানায় বিশ্রাম নেবার সময় বার কয়েক এপাশ ওপাশ করে হঠাৎ সে উঠে বসে বললো, তুমি আমাকে ভালবাস মরিয়ম? গলাটা অদ্ভুত শোনালো ওর।
মরিয়ম পাশে বসেছিলো। চমকে তাকালো ওর দিকে। মৃদু হেসে জবাব দিলো, কেন, তোমার কি সন্দেহ হচ্ছে?
মনসুর মৃদু গলায় বললো, না। ক্ষণকাল চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলো, তুমি জাহেদকেও ভালবাসতে, তাই না? তার কণ্ঠস্বরে অস্থিরতা।
মরিয়ম দৃষ্টিটা ওর ওপর থেকে সরিয়ে নিয়ে বললো, হ্যাঁ।
অন্যদিন এ সময়ে বেরুতো না মনসুর, সেদিন বেরিয়ে গেলো। যাবার সময় মরিয়ম জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছো?
মনসুর ইতস্তত করে দু-হাতে কাছে টেনে নিলো ওকে। তারপর বললো, কাজ আছে।
বিকেলে সে ফিরলো না, ফিরলো সে অনেক রাত করে। কাপড় চোপড় ছেড়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়।
মরিয়ম জিজ্ঞেস করলো, খাবে না?
সে বললো, মাথা ধরেছে, কিছু ভালো লাগছে না আমার।
কপালটা টিপে দেবো?
না।
সারারাত যন্ত্রণায় ছটফট করেছে মনসুর।
পরদিন চায়ের টেবিলে হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো, সত্যি করে বলতো ম্যারি, তুমি কাকে বেশি ভালবেসেছ? জাহেদকে না আমাকে?
চায়ের কাপটা মুখের কাছে এনে নামিয়ে রাখলো মরিয়ম। এক ঝলক চা ঢলকে পড়ে গেলো পিরিচের ওপর, মৃদু স্বরে সে জবাব দিলো, জানি না।
ভ্রুজোড়া অদ্ভুতভাবে বাকালো মনসুর। তারপর আস্তে করে বললো, তোমার কি মনে হয়, মানুষ দুবার প্রেমে পড়তে পারে?
বিব্রত মরিয়ম বললো, পারে।
বাজে কথা। চায়ের কাপটা সামনে ঠেলে দিয়ে উঠে পড়লো মনসুর। লম্বা সোফাটার উপর শুয়ে পড়ে দুহাতে কপালটা চেপে ধরলো সে। আবার মাথা ধরেছে।
সেদিন বিকেলে লিলি এলো বাসায়।
ভাই আর ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাসা ছেড়ে দিয়েছে সে। শঙ্করটোলা লেনে একটা ঘর নিয়ে থাকবে বলে সে কথা মরিয়মকে জানাতে এসেছিলো লিলি। ওর ম্লান মুখ দেখে অবাক হলো সে। বললো, তোমার কি অসুখ করেছিলো ম্যারি?
কই না তো। মরিয়ম ঘাড় নাড়লো।
লিলি বললো, তুমি ভীষণ শুকিয়ে গেছ।
মরিয়ম হাসতে চেষ্টা করলো, তাই নাকি?
লিলি বললো, হ্যাঁ।
সেদিন অনেকক্ষণ দুজনে গল্প করেছিলো ওরা। বাইরে ছোট লনটিতে দুটো বেতের চেয়ার বের করে মুখোমুখি বসেছিলো।
লিলি বললো, হাসিনা এসেছিলো?
মরিয়ম বললো, মাঝখানে দিন চারেক সে থেকে গেছে এখানে, তারপর আর আসে নি।
বাবা এসেছিলেন একদিন। খোকন আসে মাঝে মাঝে।
তোমার দাদা?
না। বলতে গিয়ে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস পড়লো তার। মাহমুদ যে আসবে না সেটা জানতো মরিয়ম।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো। আকাশে তারারা জ্বলে উঠেছিলো একে একে। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে সবুজ লনের উপর দিয়ে। অন্ধকারে ওরা দুজনে বসে। মরিয়ম ভেবেছিলো লিলিকে কিছু বলবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর সংবরণ করে রাখতে পারলো না সে। দিন কয়েক ধরে যা ঘটেছে সব খুলে বললো লিলিকে।
শুনে লিলি মন্তব্য করলো, তুমি এতো বোকা তাতো জানতাম না ম্যারি।
মরিয়ম শুধালো কেন।
লিলি বললো, সব কিছু ওভাবে খুলে বলতে গেলে কেন ওকে?
মরিয়ম বললো, মিথ্যে তো বলি নি।
লিলি হাসলো, অত সত্যবাদী হতে নেই ম্যারি। এ সমাজে বাঁচতে হলে মিথ্যের মুখোশ পরে চলতে হয়।
মরিয়ম অবাক হয়ে বললো, কেন?
কেন তা টের পাবে ধীরে। জবাব দিলো লিলি।
ক্ষণকাল চুপ থেকে মরিয়ম বললো, মানুষ কি দুবার প্রেমে পড়তে পারে না? একজনকে হারিয়ে সেকি আরেকজনকে ভালবাসতে পারে না?
পারে। দুবার কেন দশবারও পারে। লিলি বললো, কিন্তু সেটা কেউ স্বীকার করে না। যেমন আমার কথাই বল না। তুমি তো জান, দুটি ছেলেকে ভালোবাসছিলাম আমি। একজন ছিলো খুব ভালো অভিনেতা, আরেকজন ছিলো গায়ক। সেসব অতীতের কথা, তাই বলে ভবিষ্যতে আমি কাউকে ভালবাসবো না, তাতো নয়। হয়তো ভালবাসবো, কিন্তু ওদের কারো কথা আমি বলবো না তাকে ৷
অন্ধকারে শব্দ করে হেসে দিলো মরিয়ম |
লিলি বললো, তুমি হাসছে ম্যারি। বড় সরল মেয়ে তুমি। এ সমাজের কিছুই জান না।
অনেক রাত হয়ে গেছে বলে উঠে পড়লো লিলি। একদিন তার নতুন ঘরটায় গিয়ে দেখে আসতে অনুরোধ করলো। মরিয়ম খেয়ে যাওয়ার জন্যে ধরেছিলো। লিলি জানালো, অন্য আরেকদিন এসে খাবে সে, আজ নয়।
কয়েকদিন পরে, সেটা হয় রোববার ছিলো। বারান্দায় বসেছিলো ওরা।
মরিয়ম একটা বই পড়ছিলো আর মনসুর সেদিন ডাকে-আসা কয়েকখানা চিঠি দেখছিলো বসে বসে। চিঠিগুলো পড়া শেষ হলে সে বললো, আচ্ছা মরিয়ম–। মরিয়ম চোখ তুলে তাকালো।
জাহেদের ব্যাপারে তুমি আমাকে আগে বল নি কেন?
তুমি জিজ্ঞেস করো নি বলে। আবার বই-এর মধ্যে মুখ নামালো মরিয়ম।
আবার মনসুরের গলা– লুকোও নি তো?
মরিয়ম চমকে উঠলো। বইটা বন্ধ করে রেখে সোজা ওর চোখের ওপর দৃষ্টি ফেললো সে। তারপর মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি হয়েছে বলতো?
না, কিছু না। চিঠিগুলো হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো মনসুর। একটা তীব্র দৃষ্টি হেনে গেলো যাবার সময়। দুহাতে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেললো মরিয়ম।
বিয়ের তিনটি মাসের শেষ মাসটি এমনি করে কেটেছে তার। ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে মরিয়ম ভাবছিলো দিনগুলো কেমন করে এত তাড়াতাড়ি কেটে গেলো।
আয়ার ডাকে চমক ভাঙলো তার। আপনার ভাই এসেছে গো, দেখুন। মরিয়ম তাকিয়ে দেখলো, দোরগোড়ায় খোকন দাঁড়িয়ে।
ছুটে এসে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলো সে। চিবুক ধরে আদর করলো তাকে–কিরে খোকন, স্কুলে যাসনি আজ?
খোকন বললো, না। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে।
মরিয়ম বললো, মা কেমন আছেরে?
প্যান্টের পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে মরিয়মের হাতে দিলো খোকন। বললো, মা দিয়েছে এটা।
মরিয়ম খুলে দেখলো হাসিনার হাতের লেখা। দশটা টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে মা।
বড় দরকার।
চিঠিটা পড়ে ব্লাউজের মধ্যে রেখে দিলো সে।
দুপুরে খেয়ে যাবে তুমি, এখন বসো। তোমার দুলাভাই আসুন, তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেবো।
বসে বসে খোকন অনেকক্ষণ এটা-সেটা জিজ্ঞেস করলো মরিয়মকে। দুলু কি তার কথা বলে? হাসিনা কেমন আছে? আর ভাইয়া? বাবার শরীর ভালতো? তসলিম কি এখনো হাসিনাকে ছবি তোলা শেখায়? কাল রাতে কি রান্না হয়েছিলো ওদের? সকালে কি নাস্তা করেছে সে?
খোকনকে কাছে পেয়ে বড় ভালো লাগছিলো মরিয়মের।
দুপুরে মনসুর ফিরে এলে বললো, দশটা টাকা দিতে পারে?
মনসুর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, কেন বলতো?
মরিয়ম কোন জবাব দেবার আগেই খোকনের দিকে চোখ পড়লো তার। ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে সে আবার বললো, তোমার বাপের বাড়ি থেকে টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে বুঝি?
ওর কথা বলার ধরন দেখে ক্ষুণ্ণ হলো মরিয়ম। ইতস্তত করে বললো, ধার চেয়েছেন, মাস এলে শোধ করে দেবেন।
ওসব ন্যাকামো করো কেন বলতো, মনসুরের কণ্ঠে উন্মা। এ তিন মাসে কম টাকা নেয় নি ওরা, এক পয়সা শোধ দিয়েছে? ব
লতে বলতে পকেট থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে একখানা দশ টাকার নোট বের করলো সে। তারপর নোটখানা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে আবার বললো, দশ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে বললেই তো হয়–নাও। তার কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। নোটখানা হাত থেকে উড়ে মাটিতে পড়ে গেলো। মরিয়ম পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর উপুড় হয়ে ওটা তুলে নিলো হাতে।
খোকনকে বিদায় দেবার সময, কাছে টেনে আদর করলো মরিয়ম। তারপর কানে কানে বলে দিলো মাকে কিছু বলো না কেমন? আবার এলে টফি দেবো তোমায়।
খোকন মাথা নেড়ে সায় দিলো।
এতক্ষণ কিছু বলার জন্যে উসখুস করছিলো মনসুর ও চলে যেতে বললো তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, উত্তর দেবে? ঈষৎ লাল চোখজোড়া মেলে তাকালো সে।
ছড়ানো চুলগুলো খোঁপায় বন্ধ করতে করতে মরিয়ম বললো, বলো।
মনসুর চিন্তা করছিলো বলবে কিনা। অবশেষে বললো, তুমি কি আমায় সত্যি ভালবেসেছিলে না আমার টাকার প্রতিই আকর্ষণ ছিলো তোমার?
চোখজোড়া বড় বড় করে ওর দিকে তাকালো মরিয়ম। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। আমরা গরীব বলে আজ এত বড় কথা বলতে পারলে তুমি। এত অবিশ্বাস যদি মনে ছিলো তবে বিয়ে করলে কেন?
তখন কি আমি জানতাম যে তোমার ওই দেহটা তুমি আরেকজন পুরুষের হাতে তুলে দিয়েছিলে? তিক্ত গলায় ফেটে পড়লো মনসুর–সে লোকটা সারা দেহে চুমো দিয়েছে তোমার, রাক্ষসের মত ভোগ করেছে, আর তুমি দু-হাতে তাকে আলিঙ্গন করেছো, গভীর তৃপ্তিতে তার বুকে মুখ গুঁজেছ, ভাবতে ঘিন্না লাগে, বমি আসে আমার, একটুকাল দম নিয়ে সে আবার বললো, আমি তোমাকে কুমারী বলে জানতাম আর আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে তুমি ঠকিয়েছ।
উহ আর না; আর বলো না, দোহাই তোমার এবার থামো। আর সহ্য হচ্ছে না আমার। সারা দেহটা কান্নায় দুলছিলো মরিয়মের। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে দুহাতে মুখখানা ঢেকে রাখলে সে। খোপাবদ্ধ চুলগুলো সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়লো কালো হয়ে। মনুসর তখনো হাঁপাচ্ছে।
আজ দুপুরে আমেনারা চলে যাবে। অনেক করে বলে গেছে শাহাদাত–কাল সময় করে একবার এসো, এইতো শেষ দিন তোমাদের শহরে। এসো কিন্তু।
প্রেসটা বিক্রি করে দিয়েছে ওরা। ভৈরবে একটা ষ্টেশনারী দোকান কিনেছে। প্রেসের মালিক অবশেষে স্টেশনারী দোকানের মালিক হতে চললো।
কাউন্টারে বসে-বসে জিনিসপত্র বিক্রি করবে শাহাদাত। তবু কারো চাকরি সে করবে না। আমেনা চায় না তার স্বামী কারো গোলামী করুক।
শুনে মাহমুদ বলেছিলো, দোকান দিয়েছো ভালো কথা। কিন্তু ভৈরবে কেন? ঢাকায় কিনতে পারলে না?
পেলে নিশ্চয় কিনতাম। জবাবে বলেছে শাহাদাত–ওখানে সস্তায় পাওয়া গেলো তাই।
কথাটা যে সত্য নয় সেটা বুঝতে বিলম্ব হয় নি মাহমুদের, ভৈরবে দোকান কেনার পেছনেও রয়েছে আমেনার অদৃশ্য ইংগিত। সে চায় না তাদের এই ক্ষয়ে ক্ষয়ে তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা সকলে দেখুক, উপভোগ করুক, বিশেষ করে তার ভাইয়েরা আর তাদের পরিচিত বন্ধুবান্ধবেরা। ওদের চোখের কাছ থেকে নিজের দীনতাটুকু আড়াল করে রাখতে চায় আমেনা। ভৈরবে পরিচিত কেউ নেই। সেখানকার সকলে নতুন পরিচয়ে জানবে তাকে, জানবে দোকানীর বউ বলে। এককালে সে প্রেস মালিকের বউ ছিলো আর তার ভাইয়েরা এখনো ঢাকার রাস্তায় মোটর হাকিয়ে বেড়ায়–এ খোঁজ কাউকে দেবে না আমেনা।
মাহমুদ এসে দেখলো জিনিসপত্রগুলো সব ইতিমধ্যে বেঁধে-ছেঁদে নিয়েছে ওরা। একটা পুরানো ট্রাঙ্ক, দুটো সুটকেস, একটা চামড়ার, আরেকটা টিনের। তিনটে বস্তার মধ্যে টুকিটাকি মাল। কাঠের আসবাবপত্রগুলো পাড়ার একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে শাহাদাত। ওগুলো সঙ্গে নেয়া যাবে না। পথে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। ভৈরব গিয়ে, মিস্ত্রি দিয়ে নতুন করে আবার বানিয়ে নিতে হবে সব।
শাহাদাত বসে বসে একটা বস্তার মুখ সেলাই করছিলো।
আমেনা আঙ্গিনায় ছেলেমেয়েদের গোসল করাচ্ছে।
মাহমুদ বললো, আমার আসতে দেরি হয়ে গেলো, তোমরা তৈরি হয়ে আছো দেখছি।
শাহাদাত মুখ তুলে মৃদু হাসলো। হেসে বললো, বসো। একটু পরে ঠেলাগাড়িওয়ালা আসবে। ট্রেনেরও বোধ হয় সময় হয়ে এলো।
মাহমুদ বসলো।
গত সাত বছর ধরে এখানে আছে ওরা, এই বাসাতে।
আজ ছেড়ে চলে যাবে।
তারপর এ পথে হয়তো আর আসবে না মাহমুদ। এলে ওদের বাসাটার দিকে চোখ পড়লে নিশ্চয় ভীষণ খারাপ লাগবে ওর।
মিছামিছি তুমি দোকান দিচ্ছ শাহাদাত। মাহমুদ এক সময়ে বললো, একদিন সেটাও বিক্রি করে দিতে হবে।
কেন, কেন? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো শাহাদাত।
মাহমুদ বললো, সেখানেও সবাইকে ধারে জিনিসপত্র দিতে শুরু করবে তুমি। তারপর যখন কেউ আর ধার শোধ করতে চাইবে না, তখন দেখবে দোকান শূন্য। মাল নাই।
উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো শাহাদাত।
আমেনা এলো ভেতরে।
মাহমুদ বললো, ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন তুমি এনেছো আমেনা, আর এই বিশ্রী স্বভাবটা বদলাতে পারলে না।
কি, কোন স্বভাবের কথা বলছো? আমেনার দুচোখে কৌতুক।
মাহমুদ বললো, লোককে ও বিশ্বাস করে। বড় বেশি ধার দেয়।
আমেনা কোন উত্তর দেবার আগে শব্দ করে হেসে উঠলো শাহাদাত। বস্তার মুখটা ভালোভাবে বন্ধ করে দিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে বললো, কার কাছে অভিযোগ করছে মাহমুদ। এ স্বভাবটা আমার ওর কাছে পাওয়া।
আমেনা ততক্ষণে আবার বাইরে বেরিয়ে গেছে।
মাহমুদ ধীরে ধীরে বললো, স্বভাবটা যারই হোক, নিশ্চয় এটা খুব ভালো স্বভাব নয়। দুনিয়াটা হলো কতগুলো স্বার্থপরের আড্ডাখানা। অন্যকে দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে পার তুমি কিন্তু প্রয়োজনে কারো কাছ থেকে একটা কানাকড়িও পাবে না।
ম্লান হাসলো শাহাদাত। তারপর গম্ভীর হয়ে বললো, তোমার উক্তির সত্যতা নিয়ে আমি তর্ক করতে চাইনে মাহমুদ। দুনিয়াটা কতকগুলো স্বার্থপরের আড্ডাখানা একথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে আমি রাজী নই। আজ এই বিদায়ের মুহূর্তে আর পাঁচটা কাজ ফেলে তুমি যে এখানে এসেছে, এর পেছনে কোন স্বাৰ্থ আছে বলতে চাও? নেই, জানি। জানি বলেই তো এখনো বেঁচে আছি। নইলে–বলতে গিয়ে থেমে গেলো শাহাদাত। গলাটা ধরে এসেছে ওর। চোখের কোণে দুফোটা জল মুক্তোর মত চিকচিক করছে।
বিব্রত মাহমুদ, বড় ট্রাঙ্কটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো।
স্টেশনে এসে ট্রেন ছাড়বার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মাহমুদের হাত ধরে শাহাদাত বললো, চিঠিপত্র লিখো মাহমুদ, আর যদি পারো একবার গিয়ে বেড়িয়ে এসো।
মাহমুদ কিছু বলতে পারলো না। মাথা নেড়ে সায় দিলো শুধু। জানালার ধারে বসে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে আমেনা | পাশে তার ছেলেমেয়েরা। পান খেয়ে ঠোঁট জোড়া লাল করেছে সে। কালো ছোট্ট একটা টিপ। গাড়ির আঁচলখানা খোঁপা পর্যন্ত তোলা। আজ হঠাৎ সুন্দর করে সেজেছে আমেনা।
সামনে এগিয়ে গিয়ে মাহমুদ বললো, আবার দেখা হবে আমেনা।
আমেনা লাল ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে বললো, একবার বেড়াতে এসো কিন্তু, নেমন্তন্ন রইলো।
মাহমুদ আস্তে করে বললো, আসবো।
একটু পরে ট্রেন ছেড়ে দিলো। ওদের মুখগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো চোখের আড়ালে।
একটা কনট্রাক্টরের সঙ্গে কাজে লেগে গেছে রফিক।
সকাল থেকে সন্ধ্যা মজুরদের সঙ্গে বসে বসে ওদের কাজ তদারক করা। কতদূর কাজ হলো দেখা। হিসেব নেয়া। আর কেউ কাজ না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তাকে ধমকিয়ে কাজ আদায় করা।
খোদাবক্স বলেছিলো, ওর ইচ্ছে ছিলো—লেখাপড়া-জানা মানুষ, লেখাপড়ার চাকরি করবে। তা বেকার বসে থাকার চেয়ে এটাও মন্দ কিসের, কি বলেন মাহমুদ সাহেব?
মাহমুদ সায় দিয়ে বললো, হ্যাঁ, অফিসের কেরানীগিরি করার চেয়ে এ চাকরি ঢের ভালো।
তারপর থেকে বেশ ক-দিন আর রফিকের দেখা পাওয়া যায় নি। সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে ও। রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে এখন। আজ বিশ্রামাগারে আসার পথে ওর কথা ভাবছিলো মাহমুদ। হয়তো ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। দেখা হলে বিয়ের কতদূর কি করলো জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু বিশ্রামাগার পর্যন্ত আসতে হলো না। পথেই দেখা হয়ে গেলো, গায়ে আধ ময়লা একটা জামা, পরনে এর চেয়েও ময়লা একটা পায়জামা! পায়ে টায়ারের স্যান্ডেল। কাজ শেষে ফিরছে সে।
দেখা হতে একগাল হেসে বললো, মনে মনে তোমার কথাই ভাবছিলাম মাহমুদ।
আমার কথা তুমি ইদানীং বড় বেশি ভাবছো। মাহমুদ জবাব দিলো পরক্ষণে।
পথ চলতে চলতে রফিক আবার বললো, তুমি ইচ্ছে করলে আমার একটা ভালো চাকরি নিয়ে দিতে পারতে মাহমুদ। যাকগে, চাকরি একটা জুটিয়েছি। মন্দ না, ভালোই।
টেলিগ্রামের তারে বসে একটা কাক কা-কা শব্দে ডাকছে একটানা। সেদিকে তাকিয়ে থেকে মাহমুদ বললো, তুমি চাকরি চেয়েছিলে, একটা পেয়েছো আবার কি?
রফিক বললো, এবার ওকে বিয়ে করে ঘর বাঁধবো আমি। তোমরা দেখো, আমি খুব সুখী হবো। বলতে গিয়ে মুখখানা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো, তুমি বিয়ে করছে না কেন মাহমুদ?
চলার পথে হোঁচট খেলো মাহমুদ, হঠাৎ আমার সম্পর্কটি ভাবতে শুরু করছো কেন? নিজের কথা ভাবো।
রফিক চুপসে গেলো।
খানিকক্ষণ নীরবে পথ হাঁটলো ওরা।
নীরবতা ভেঙ্গে রফিক সহসা বললো, তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিলো আমার।
বলো। এবার তুমি আমায় হতাশ করবে না, কথা দাও।
অমন কথা আমি দেই নে। মাহমুদের গলা বিরক্তিতে ভরা।
রফিক বললো, তাহলে আর কি লাভ।
মাহমুদ বললো, না বলাই ভালো।
কিন্তু না বলে কতে পারলো না রফিক। না বলার অনেক চেষ্টা করলেও অবশেষে বলতে হলো—শোনো মাহমুদ, মেয়েদের স্কুলের লিলি মাস্টারনির সঙ্গে শুনেছি তোমার নাকি বেশ আলাপ আছে।
কার কাছ থেকে শুনেছো? ওর কথাটা শেষ হবার আগেই গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো মাহমুদ।
রফিক ইতস্তত করে বললো, কেন সবাই জানে। খোদাবক্স বলেছিলো সেদিন বিকেলে মেয়েটা নাকি স্কুল থেকে বেরিয়ে ওখানে খোঁজ করছিলো তোমায়।
বাজে কথা, একেবারে মিথ্যে কথা। মাহমুদ উত্তেজিত গলায় বললো, খোদাবক্স বানিয়ে বলেছে তোমাদের।
তা না হয় বলেছে। কপালের ঘাম মুছে নিয়ে রফিক আবার বললো, কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে যে তোমার আলাপ আছে, তা কি সত্যি নয়?
মাহমুদ বললো, হ্যাঁ, সত্যি, কিন্তু তোমার সেটা নিয়ে এতো মাথা ঘামানো কেন?
আছে বন্ধু, আছে, নইলে কি আর মিছিমিছি মাথা ঘামাচ্ছি? রফিক হেসে দিয়ে বললো। ভাই এবার আমার কথাটা রাখ, ভালই হবে তোমার। আজ ক’দিন ধরে ওর সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। আগে দাইগুলোর হাতে হাতে চিঠি পাঠাতাম। এই দাইগুলো, বুঝলে, এক নম্বরের বজ্জাত। একটা চিঠির জন্যে দুটো করে টাকা নিতো। সেও ভালো ছিলো, এখন নেয়াই বন্ধ করে দিয়েছে, বলে ‘ডর লাগতী, নোকরি চলি যায়গী।‘
মাহমুদ বাধা দিয়ে বললো, ওসব শুনে কি হবে আমার। আমার কিছু করার থাকলে তাই বলো।
তাইতো বলছি মাহমুদ। তুমি বন্ধু, বন্ধুর দুঃখ বুঝবে। সলজ্জ সঙ্কোচের সঙ্গে বললো, তোমার সেই লিলি মাস্টারনির হাতে যদি আমাদের চিঠিগুলো—কথাটা শেষ করতে পারলো না রফিক। মাহমুদের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো সে। কে যেন আলকাতরা লেপে দিয়েছে ওর চোখেমুখে। একটু পরে মৃদু গলায় সে বললো, ওইসব ইয়ার্কি আমার ভালো লাগে না, বুঝলে?
রফিক কাতর গলায় বললো, তোমার কি আমার জন্যে অতটুকু অনুভূতি নেই মাহমুদ?
মাহমুদ জবাব দিলো, না।
রফিক বললো, এই বুঝি তোমার বন্ধুত্ব?
মাহমুদ বললো, হ্যাঁ। ততক্ষণে ওরা বিশ্রামাগারের চৌকাঠে এসে পা রেখেছে।
আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামবার আগে, শঙ্করটোলা লেনে লিলির নতুন বাসাটা খুঁজে বের করলো মরিয়ম। ওকে বাসায় পাওয়া যাবে কিনা ভাবছিলো সে। এসে দেখলো সবে বাইরে থেকে ফিরেছে লিলি। মুখ-হাত ধুয়ে, স্টোভে আগুন জ্বালাচ্ছে। ওকে দেখে, কেতলিতে আরেক কাপ আন্দাজ পানি ঢেলে স্টোভের ওপর চড়িয়ে দিলো লিলি।
বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে।
লিলি বললো, ঠিক সময়ে এসে পৌঁছে গেলে তুমি, নইলে ভিজতে হতো। মরিয়ম বললো, আরো আগে এসে পৌঁছতাম, তোমার ঠিকানাটা খুঁজে বের করতে দেরি হয়ে গেছে।
তাকের উপর থেকে চায়ের কৌটোটা নামিয়ে নিয়ে লিলি বললো, এই একটু আগে তোমার কথা ভাবছিলাম আমি। ভাবছিলাম কাল সকালে তোমার ওখানে যাবো। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে লিলি আবার বললো, আজ দুপুরে দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো রাস্তায়।
তাই নাকি? অন্যমনস্ক গলায় বললো মরিয়ম।
লিলি বললো, হ্যাঁ। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন তিনি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জ্বলন্ত স্টোভটার দিকে তাকিয়ে রইলো মরিয়ম। কেটলির ঢাকনাটা তুলে এক মুঠো চায়ের পাতা ঢেলে দিয়ে লিলি আবার বললো, তোমার কি খবর?
সহসা কোন জবাব দিলো না মরিয়ম ৷
লিলি উঠে দাঁড়িয়ে সস্নেহে একখানা হাত রাখলো ওর কাঁধের ওপর–ও কি এখনো আগের মত ব্যবহার করছে?
তবু কিছু বললো না মরিয়ম। ডাগর চোখজোড়া ধীরেধীরে জলে ভরে এলো তার। কান্না চেপে মৃদু গলায় বললো, আগের মত হলে ভালোই ছিলো লিলি। আজকাল সে কি আর মানুষ আছে, অমানুষ হয়ে গেছে। বলতে গিয়ে চোখ উপচে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার।
ওকি, কাঁদছো কেন? হাত ধরে বিছানায় এনে ওকে বসালো লিলি। কেঁদে কি হবে।
জানি কেঁদে কিছু হবে না। মরিয়ম ধীরে ধীরে বললো, জীবনটা আমার এমন হলো কেন লিলি? এমনটি হোক, তাতো আমি চাই নি কোনদিন।
নিজহাতে তুমি নিজের সুখ নষ্ট করেছো ম্যারি। কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো লিলি।
মরিয়ম নীরবে মাটির দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, গত দুদিন সে বাসায় আসে নি। ওর কণ্ঠস্বরে ক্লান্তি আর হতাশা ৷
লিলি ওর মুখের দিকে চেয়ে শুধালো, একেবারেই আসে নি?
মরিয়ম সংক্ষেপে বললো না। স্টোভের ওপর থেকে কেটলি নামিয়ে আগুনটা নিভিয়ে দিলো লিলি। তারপর তাকের ওপর থেকে দুটো চায়ের পেয়ালা আর চিনির কৌটোটা মেঝেতে নাবিয়ে রাখলো সে।
মরিয়ম বললো, আমি চা খাবো না লিলি।
লিলি অবাক হয়ে শুধালো, কেন?
খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলো মরিয়ম। তারপর মান গলায় বললো, আজ দু-দিন সে বাসায় আসে নি। তুমি কি ভাবছো এ দু-দিন কিছু মুখে দিতে পেরেছি আমি? বলতে গিয়ে কান্নায় গলাটা ভেঙ্গে এলো তার।
লিলি কী বলে ওকে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পেলো না। পাশে এসে বসে বিব্রত গলায় বললো, ওর জন্যে নিজেকে এমন করে কষ্ট দিচ্ছো কেন ম্যারি?
মরিয়ম কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে লিলির কোলে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ কাঁদলো। জড়ানো স্বরে বললো, আমি কি পাপ করেছিলাম বলতে পারো লিলি? বলতে পারো আমার কপালটা এমন হলো কেন?
কেটলিটা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। ওর কারো চা খাওয়া হলো না।
বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পরেই, দোরগোড়ায় মনসুরের পায়ের শব্দে চমকে উঠলো মরিয়ম। আনন্দ ও আতঙ্ক দুটোই এসে এক সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
ওকে দেখে মনসুর বিস্ময়ের ভান করলো, তুমি এখনো আছো? অদ্ভুত ভাবে ভ্রুজোড়া বাঁকালো সে।
না থাকলেই কি তুমি খুশি হতে? গলাটা কাঁপছিলো মরিয়মের। ঘরের মাঝখানে টিপয়টার চারপাশে সাজানো সোফার উপর বসে অকম্পিত স্বরে মনসুর জবাব দিলো, এ সহজ কথাটা কি আর বোঝ না তুমি?
ওর প্রতিটি কথা তীরের ফলার মত এসে বিঁধলো তার বুকে। ওর মুখের উপর থেকে জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মরিয়ম। যে মুখে অত বড় কথা উচ্চারণ করেছে মনসুর, সে মুখের দিকে একটিবারও আর ফিরে তাকাবে না সে।
তবু তাকাতে হলো।
তবু ওর পাশে এসে দাঁড়ালো মরিয়ম। হাঁটু গেড়ে বসে আশ্চর্য কোমল গলায় শুধালো আমি চলে গেলে সত্যি খুশি হবে তুমি? মনসুর উঠে দাঁড়িয়ে অন্য সোফায় গিয়ে বসলো। তারপর জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বিকৃত কণ্ঠে বললো, সত্যি তোমার লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেই?
অকস্মাৎ কোন জবাব দিতে পারলো না মরিয়ম। সারা মুখ আরো স্নান হয়ে এলো তার। নীরবে, মেঝেতে বিছানা কাপেটের ওপর হিজিবিজি কাটতে কাটতে অবশেষে আস্তে করে বললো, তাহলে তাই হবে, তুমি যা চাও তাই করবো আমি। ওর কথাগুলো মনসুর শুনতে পেলো কিনা বোঝা গেলো না।