পাঁচ
কদিন ধরে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। মাঝে মাঝে একটু থামে, হয়তো ঘণ্টাখানেকের জন্যে, তারপর আবার আকাশ কালো করে নেমে আসে ঝপ ঝপ শব্দে।
একটানা বৃষ্টি হলে ফাটলগুলো চুঁইয়ে ঘরে টপটপ পানি পড়ে। এ ঘরে সে ঘরে হেঁটে সালেহা বিবি দেখছিলেন কোথায় পানি পড়ছে। সেখানে একটি করে মাটির পাত্র বসিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি। হাসিনা বললো, বাড়িওয়ালাকে ডেকে ঘরটা মেরামত করে দিতে বলো না কেন?
সালেহা বিবি বললেন, তোর দুলাভাই বলেছে এ মাসের মধ্যে একটা বাড়ি দেখে নিয়ে যাবে আমাদের। তাই তোর বাবা আর মেরামতের জন্যে গা লাগান নি।
হাসিনা বললো, কবে যে এ বাড়ি থেকে যাবো, একটু ছাতেও উঠতে পারি নে।
সালেহা বিবি পানি পড়ার জায়গাগুলো লক্ষ্য করতে করতে বললো, মাহমুদটার জন্যে, নইলে এতদিনে তোর দুলাভাই এখান থেকে নিয়ে যেতো আমাদের।
হাসিনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, ভাইয়াটা যে কী?
কথাটা কানে গেলে নিশ্চয় একটা কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতো মাহমুদ। এমনিতে কম হৈ চৈ করে নি সে। মাকে ডেকে নিয়ে বলেছে, দেখো মা, তোমার জামাইকে বড় বেশি কৃপা দেখাতে নিষেধ করো। আমরা গরিব হতে পারি, কৃপার পাত্র নই। এ পাড়ার আরো পাঁচশো পরিবার এমনি ভাঙ্গাচোরা বাড়িতে থাকে। তোমার জামাই পারবে তাদের সবার জন্য নতুন বাড়ির বন্দোবস্ত করে দিতে? আমাদের ওপর অত বদান্যতা কেন? মেয়ে বিয়ে দিয়েছ বলে?
দেখ মাহমুদ, সব কাজে তোর এই বেয়াড়াপনা ভালো লাগে না আমার, বুঝলি? তীব্র গলায় ওকে আক্রমণ করেছে মা–এক পয়সার মুরোদ নেই, মুখে শুধু বড় বড় কথা।
আরো অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটি করেছে ওরা। কিন্তু এ-ধরনের তর্কের সহজে মীমাংসা হয় না। হয়ও নি।
মাহমুদের ঘরে পানি পড়ছিলো। ওর বইপত্রগুলো আর বিছানাটা এক পাশে টেনে রেখে যেখানে যেখানে পানি পড়ছিলো সেখানে একটা করে মাটির পাত্র বসিয়ে দিলেন সালেহা বিবি। একরাশ সুরকির গুঁড়ো ঝরে পড়লো ওঁর সামনে। সালেহা বিবি উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কোথেকে পড়লো। তারপর চিন্তিত মুখে চলে গেলেন সেখান থেকে।
সারা সকাল বৃষ্টি হলো। সারা দুপুর।
বিকেলের দিকে মেঘ সরে গিয়ে আকাশে সূর্য উঁকি দিলো। সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়লো দিগন্তে।
তসলিম এসেছিলো। তাকে নিয়ে পা টিপে টিপে ছাতে ওঠে হাসিনা। আকাশের ছবি নেবে।
তসলিম বললো, তোমার ক্যামেরা কেনার কী হলো?
হাসিনা বললো, দুলাভাই বলছিলেন বাজারে এখন ভালো ক্যামেরা নেই, এলে কিনে দেবেন উনি।
কিনে দেবেন না ছাই ছাতে এসে তসলিম বললো, বাজারে কত ক্যামেরা, আমাকে টাকা দিয়ে দাও না, আমি কিনে দেবো।
হাসিনা বললো, আচ্ছা।
তসলিম গিয়ে ছাতের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলো। হাসিনা চাপা গলায় চিৎকার করে উঠলো, ওখানে দাঁড়াবেন না, ভেঙ্গে পড়বে। এ পাশটায় আসুন।
কার্নিশের পাশে এসে বসলো ওরা। ক্যামেরাটা খুলে, কি আকাশের ছবি নিতে হয় ওকে দেখালো তসলিম আরো কাছে সরে ওর কাধের ওপর একখানা হাত রেখে ঝুঁকে পড়ে দেখছিলো হাসিনা। লেন্সের মধ্য দিয়ে দেখতে পেলো আকাশটা আবার মেঘে ছেয়ে আসছে। বাতাসে বিক্ষিপ্তভাবে ছুটছে তারা।
ক্যামেরা বন্ধ করে তসলিম বললো, বৃষ্টি আসতে পারে আবার, নিচে চলো।
কাঁধে রাখা হাতটায় একটা জোরে চাপ দিয়ে হাসিনা বললো, উঁহু, এখন আসবে না।
তসলিম বললো, বাজি ধরো, ঠিক আসবে।
আসুক, আমি এখন উঠবো না।
কেন?
আমার বসে থাকতে ভালো লাগছে।
তসলিম মুখ ফিরিয়ে তাকালো ওর দিকে। হাসিনা ফিক করে হাসলো একটু। তারপর আঁচল দিয়ে ঠোঁটজোড়া ঢেকে সে বসে রইলো চুপ-চাপ। বৃষ্টি এলো না। সন্ধ্যা নেমে এলো।
রাতের অন্ধকার বাইরের পৃথিবী থেকে আড়াল করে নিয়ে গেলো ওদের। তসলিম বললো, রাত হয়ে গেছে, নিচে চলো।
উঁহু। কাঁধের ওপর থেকে হাতটা নামিয়ে নিলো হাসিনা। অন্ধকারে একজোড়া কটাকটা চোখের দিকে নীরবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অকস্মাৎ দু-হাতে ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিলো তসলিম। হাসিনা কোন বাধা দিলো না, শুধু অস্ফুটস্বরে কি যেন বললো, শোনা গেল না।
হাসিনা-আ। নিচে থেকে মায়ের গলা ভেসে এলো। একবার। দুবার তিনবার।
অপূর্ব শিহরনের দুজনে কঁপিছিলো ওরা। বাহুবন্ধন শিথিল হয়ে এলো ধীরে ধীরে। ছুটে ছাদ থেকে নেমে এলো হাসিনা।
মা, মাগো, ওমা, দৌড়ে এসে সালেহা বিবিকে জড়িয়ে ধরলো সে, মা, আমায় ডেকেছো মা?
ওকি অমন করছিস কেন?
জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলো হাসিনা। চোখেমুখে আবির ছড়ানো। মাকে ছেড়ে দিয়ে—দুলু বসেছিলো মেঝেতে—তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগলো হাসিনা–দুলু, দুলু-উ-উ। তোমার পুতুলগুলো কোথায়? চলো, দুজনে খেলবো আমরা।
কী খেলবে তুমি, পুতুল, পুতুল?
না, তোমার পুতুলের সঙ্গে আমার পুতুলের বিয়ে দেবো আজ।
দুলু খুশি হলো, আপা আজ তার সঙ্গে পুতুল খেলবে।
কিন্তু খানিকক্ষণ পুতুল নিয়ে বসে আপার আর মন বসলো না। ছুটে সে রান্নাঘরে মায়ের কাছে চলে এলো– মা, আজ কি পাক করছো মা?
সালেহা বিবি তরকারিতে লবণ ছিঁটিয়ে দিয়ে বললো, নতুন কিছু না, রোজ যা রান্না হয়, তাই।
মা আমি রাঁধবো, তুমি ঘরে যাও।
তরকারির কড়াই থেকে চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন সালেহা বিবি। রান্না ঘরের ধার যে ঘেঁষে না তার আজ হঠাৎ পাক করার শখ হলো কেন? থাক, তোমাকে রাধতে হবে না, লেখাপড়া করো গিয়ে যাও।
মা, আমি তোমার পাশে বসবো মা। মায়ের পাশে এসে বসে পড়লো হাসিনা। খানিকক্ষণ পর আবার উসখুস করে উঠে গেলো সেখান থেকে। নিজের ঘরে এসে টেবিলের ওপর থেকে আয়নাটা তুলে নিয়ে বসলো সে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানাভাবে নিজেকে দেখলো হাসিনা। হেসে দেখলো। মুখখানা গম্ভীর করে দেখলো। কপট রাগ করে, ঠোঁটজোড়া বাঁকিয়ে কারো সঙ্গে যেন কথা বললো সে।
হ্যারিকেনের আলোয় বসে বই-এর ওপর চোখ বুলাচ্ছিলো মাহমুদ। ভাইয়া কি করছো? ওর সামনে এসে ঝুঁকে পড়ে কি পড়ছে দেখলো হাসিনা, ভাইয়া, তুমি একটা বিয়ে করো ভাইয়া, আমাদের বুঝি ভাবী দেখতে ইচ্ছে করে না?
কী ব্যাপার, আমার বউ দেখার জন্যে হঠাৎ তোমার মন কেঁদে উঠলো কেন? বইয়ের পাতার ওপর চোখ রেখে জবাব দিলো মাহমুদ–যাও, নিজের বিয়ের কথা চিন্তা করো গিয়ে।
হাসিনার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। ‘ধ্যাৎ, আমি বিয়ে করবো না’ বলে সেখান থেকে পালিয়ে এলো হাসিনা। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পা জোড়া উপরের দিকে তুলে দোলনার মত দোলাল সে। তারপর বালিশে মুখ গুঁজে চোখ বুজলো। মিটিমিটি হাসলো। চোখের পাতায় একটি মুখ ভাসছে বারবার আর একটি ছবি। বালিশটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরলো হাসিনা।
সারারাত একটানা বৃষ্টি হলো।
সকালেও।
অপরাহ্নে তখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছিলো বাইরে।
হাসমত আলী অফিসে গেছেন, মাহমুদ তার প্রেসে। বৃষ্টির জন্যে, হাসিনা আর খোকন কেউ স্কুলে যায় নি আজ। সালেহা বিবি ভরে যাওয়া মাটির পাত্রগুলো থেকে পানি ফেলে দিয়ে আবার বসিয়ে দিচ্ছিলেন পুরোনো জায়গায়।
টপটপ পানি পড়ছে ফাটলগুলো থেকে চুইয়ে। মাঝে মাঝে সুরকির গুড়ো, ইটের কণা।
দুয়ারে কড়া নাড়ার মৃদু শব্দ হতে, দরজা খুলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো হাসিনা–মা, মাগো, কে এসেছে দেখে যাও, মা।
একটা চামড়ার সুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো মরিয়ম ৷ জড়িয়ে ধরে তাকে ভিতরে নিয়ে এলো হাসিনা। দুলু ছুটে এসে আঁচল ধরে দাঁড়ালো তার।
মা ডেকে শুধালো–কে এসেছেরে হাসি?
হাসিনা জবাব দিলো, আপা এসেছে। সুটকেসটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিলো হাসিনা।
মরিয়ম দুলুকে কোলে তুলে আদর করলো।
দাদার ঘরে উঁকি মেরে মাহমুদ আছে কিনা দেখলো মরিয়ম।
হাসিনা বললো, সেই ভোরে বেরিয়ে গেছে।
মায়ের খাটের ওপর এসে বসলো মরিয়ম। চারপাশে তাকিয়ে বললো, ইস, ভীষণ পানি পড়ছে তো?
কিরে, তুই একা এলি, জামাই আসেনি? কুয়োতলা থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে বললেন সালেহা বিবি। জামাই এলো না কেন?
মরিয়ম ম্লান হয়ে বললো, কাজের ভীষণ চাপ।
খোকন বললো, আমার জন্যে টফি আনিস নি আপা!
এনেছি। আশেপাশে তাকিয়ে সুটকেসটা খোঁজ করলো মরিয়ম। হাসিনা বললো, ওটা ও-ঘরে রেখে এসেছি, নিয়ে আসি।
সুটকেস নিয়ে এলে, খুলে দুটো টিন বের করলো মরিয়ম। বিস্কিট আর টফি। বিস্কিটের টিনটা মায়ের হাতে দিয়ে সে বললো, এটা রেখে দাও মা। নাস্তার সময় দিও।
মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মেয়ের পাশে এসে বসলেন তিনি।
টফির টিনটা খুলে খোকন আর দুলুকে কয়েকটা টফি দিলো মরিয়ম। হাসিনাকেও দিলো। সালেহা বিবির হাতে একমুঠো টফি গুঁজে দিতে তিনি হেসে বললেন, আমায় কেন?
মরিয়ম বললো, খাও মা।
হাসিনা বললো, মাকে মিছিমিছি দিচ্ছিস আপা। মা কি খাবে? এই রাক্ষস দুটোর পেটে যাবে সব। বলে তর্জনী দিয়ে দুলু আর খোকনকে দেখালো হাসিনা।
খোকন জিভ বের করে ভেংচি কাটলো।
ওকে অনুসরণ করে দুলুও জিভ বের করলো হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে। হাসিনা দাঁতমুখ খিঁচে বললো, আবার বের কর না, একেবারে কেটে দেবো।
একটা টফি কাগজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুখে দিলেন সালেহা বিবি। বারকয়েক চুষে বললো, বেশ মিষ্টিতো। তুই খাচ্ছিস না কেন, একটা খা-না।
মরিয়ম সুটকেসের ডালাটা বন্ধ করলো ধীরে ধীরে। মায়ের অনুরোধ কানে গেলো না ওর।
মুঠোয় ধরে রাখা টফিগুলো আঁচলে বেঁধে রাখলেন সালেহা বিবি। হাসমত আলীকে আজ খাওয়াবেন একটা আর মাহমুদকে।
এতক্ষণে ইতিউতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ভালো করে নজরে পড়ে নি সালেহা বিবির। এবার মেয়ের দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, হ্যাঁরে মরিয়ম, তুই অমন শুকিয়ে গেছিস কেন, অসুখ করেছিলো নাকি?
এই ভয়টাই এতক্ষণ করছিলো মরিযম। মায়ের চোখে কিছু এড়াবে না তা জানতো সে। গত এক মাসে শরীরটা অনেক খারাপ হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারে মরিয়ম। দিনে রাতে অবিচ্ছিন্ন চিন্তার স্রোতে ডুবে থাকলে, আঘাতে আর যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হলে শরীর ভালো থাকার কথা নয়।
ওকে চুপ থাকতে দেখে মা আবার বললো, কি হয়েছিলো?
হাসিনা বললো, তাইতো তোকে বড্ড রোগা লাগছে আপা।
মরিয়ম পরক্ষণে একটা মিথ্যা কথা বললো, ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয়েছিলো।
ওর মুখখানা কোলে নিয়ে মা বললো, বেশ মেয়েতো, অসুখ করেছিলো আমাদের একটু খবর দিতে পারলি না? আমরা কি পর হয়ে গেছি তোর?
হাসিনা বললো, খবর পাঠালে আমি দেখতে যেতাম।
চোখ ফেটে কান্না আসছিলো মরিয়মের। একটু কাঁদতে পারলে বোধ হয় শান্তি পেত সে। কিন্তু কেঁদে সকলকে বিব্রত করতে চায় না মরিয়ম। মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে সে বললো, কাপড়টা বদলিয়ে নিই মা।
সাঁঝরাতে আকাশ ফর্সা হয়ে তারা দেখা দিলো। একটা মেঘও আকাশে নেই এখন।
সালেহা বিবি বললো, তারা উঠলে কি হবে, এ-সময়ে আকাশকে একটুকুও বিশ্বাস নেই, দেখবে আবার ঝুপঝুপ করে নেবে আসবে একটু পরে।
হাসমত আলী বললো, বাড়িওয়ালার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। দুএকদিনের মধ্যে মিস্ত্রী পাঠাবে।
দু-একদিনের কথা বলেছে তো, দেখবে দশ দিন লাগবে। স্বামীর কথার ওপর মন্তব্য করলেন সালেহা বিবি। বলে মরিয়মের দিকে তাকালেন তিনি। সবার চোখ এ মুহূর্তে তার ওপর গিয়ে পড়েছে। কারণ মনসুর বলেছিলো–একটা ভালো বাসা দেখে ওদের নিয়ে যাবে। স্নানমুখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো মরিয়ম। বাবা কিংবা মায়ের দিকে তাকাতে ভয় হলো ওর। যদি তারা সে ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করে। তাহলে এখন কোন জবাব দিতে পারবে না সে। মনসুর যে অনেক বদলে গেছে সে খবর তো কারো জানা নেই।
একটু পরে সেখান থেকে উঠে হাসিনার কামরায় চলে গেলো মরিয়ম। হ্যাঁরে হাসি, তসলিম এসেছিলো না, চলে গেছে?
কি একটা কাগজ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো হাসিনা। ও আসতে কাগজটা লুকিয়ে ফেলে সে বললো, হ্যাঁ, চলে গেছে।
ওটা কিরে?
না কিছু না। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বই নিয়ে বসলো হাসিনা। ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করো নি? উনি এসেছেন তো।
তাই নাকি! আঁচলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আবার বেরিয়ে এলো মরিয়ম।
বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে, নিঃশব্দে সিগারেট টানছিলো মাহমুদ। ভাইয়া কেমন আছো? মরিয়ম এসে বসলো মেঝের উপর।
মরিয়ম যে। পা-জোড়া নাবিয়ে নিলো মাহমুদ–বাবার বাড়ি সফর করতে এসেছে বুঝি।
মরিয়ম মৃদু গলায় বললো, তুমি তো একটা দিনও গেলে না।
বার কয়েক ঘনঘন সিগারেটে টান দিলো মাহমুদ। তারপর ছাই ফেলে বললো, তুমি জানতে আমি যাবো না, তবু মিছে অভিমান করছো। ভাবছো আমি বড় নির্দয়। সত্যি আমি তাই। কারো জন্যে আমার কোন অনুভূতি নেই। বাবা, মা, ভাই বোন এই যে, কতগুলো শব্দের সৃষ্টি করেছে তোমরা, একটা অর্থহীন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এর কোন মূল্য আছে? অন্তত আমার কাছে নেই। সিগারেটে একটা জোরটান দিয়ে ধোয়া ছাড়লো মাহমুদ। তারপর আবার বললো, আমি তো দুটি সম্পর্ক ছাড়া আর কোন কিছুর অস্তিত্ব দেখি না। ওই বড় লোকের বাচ্চাগুলো যারা মুরগির মত টাকার ওপর বসে বসে তা দিচ্ছে আর আমরা গরিবের বাচ্চারা যাদের ওরা ছোটলোক বলে। এই দুটো সত্য ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না আমার। তুমি হয়তো মনে বড় আঘাত পাচ্ছে, কিন্তু কি আর বলবো বলো, ওরা হলো আমাদের মা, বাপ আর আমরা ওদের ছা-পোষা, জীব। থাকগে কেমন আছো বলো–সিগারেটের গোড়াটা ছুড়ে ফেলে দিলো মাহমুদ।
মরিয়ম আঙুল দিয়ে মেঝেতে দাগ কাটতে কাটতে বললো, ভালো।
ভালো যে থাকবে তা জানতাম। ছাদের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলে মাহমুদ–তোমার মত কপাল কজন পেয়ে থাকে। বাড়ি-গাড়ি, অর্থ সবই পেয়েছে তুমি। আর আমাদের অবস্থাটা একবার দেখো, সারাদিন খেটে এসে এমন খাদের মধ্যে শুয়ে আছি। টপটপ করে ঘরের মধ্যে বৃষ্টি পড়ছে। এটা নিশ্চয়ই আরামদায়ক নয়, কী বলো? মরিয়মকে কোন কথা না বলতে দেখে মাহমুদ আবার বললো, মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো, পুরুষ হয়ে না জন্মে যদি তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে হয়ে জন্মাতাম তাহলে বেশ হতো। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো মাহমুদ। মরিয়ম তবু কোন কথা বলছে না দেখে আবার বললো, হ্যাঁ, তোমার সেই বান্ধবীটির কি খবর বলতো?
মরিয়ম মুখ তুলে তাকালো, কার কথা বলছো?
মাহমুদ বললো, সেই যে–কি নাম যেন–যাক-গে বাদ দাও তার কথা, ওসব জেনে আমার কোন কাজ নেই। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বিড়ি আছে কিনা খুঁজে দেখলো সে।
সালেহা বিবি এসে খাবার জন্য ডেকে গেলেন সকলকে। ও-ঘর থেকে হাসিনার গলা শোনা গেলো–আপা খাবি চল।
মরিয়ম উঠে পড়লো, ভাইয়া খাবে না?
যাও আসছি–মাহমুদ উঠে বসলো।
রান্না ঘরটা ভিজে থাকায় শোবার ঘরে খাটের পাশে একটা মাদুর বিছিয়ে খাওয়ার আয়োজন করেছেন সালেহা বিবি। অনেকদিন পরে একসঙ্গে খেতে বসলো ওরা। দুলুকে নিয়ে হাসমত আলী বসলেন সবার ডান দিকটায়। তার পাশে বসলো মাহমুদ। তারপর হাসিনা আর মরিয়ম। একেবারে বা পাশটায় খোকন। সালেহা বিবি বসলেন সবার দিকে মুখ করে মাঝখানটায়। নিজে খাবেন এবং সকলকে পরিবেশন করবেন তিনি। অনেকদিন পর এক সঙ্গে খেতে বসে আনন্দের আভা জেড়ে উঠলো সবার চোখে-মুখে। সালেহা বিবি সবচেয়ে খুশি। ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে বসিয়ে খাওয়ানোর তৃপ্তি ও আনন্দ যে কি পরিমাণ সেটা শুধু মা-ই জানেন। তাদের খাওয়ার মাঝখানে আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলো। বাইরে তাকিয়ে, হাতটা ধুয়ে নিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন সালেহা বিবি।
হাসিনা বললো, কোথায় যাচ্ছ মা।
সালেহা বিবি বললেন, আবার বৃষ্টি এলো, মাটির ভাণ্ডগুলো জায়গা মত আছে কিনা দেখে আসি, নইলে সব ভিজে যাবে।
মরিয়ম বললো, খেয়ে নাও মা, এই তো বৃষ্টি এলো, অত তাড়াতাড়ি ভিজবে না।
মাহমুদ বললো, ভিজলে ভিজুক, তোমাকে আবার খাওয়ার মাঝখানে উঠতে বললো কে?
আবার বসে পড়লেন সালেহা বিবি। কিন্তু বসেও স্বস্তি পেলেন না তিনি, বারবার উপরের দিকে তাকাতে লাগলেন। কোথায় পানি পড়ছে কে জানে। এক মুখ ভাত চিবোতে মাহমুদ বললো, বাবার সেই পুরোনো ছাতাটা আছে তো ঘরে?
সালেহা বিবি জবাব দিলেন, আছে, কেন?
আমার প্রেসে যেতে হবে।
এই বৃষ্টির মধ্যে?
হ্যাঁ। আজ রাতে অনেকগুলো প্রুফ দেখতে হবে আমায়, সব জমা হয়ে আছে।
সকলে একবার করে তাকালো মাহমুদের দিকে। তারপর নীরবে খেতে লাগলো।
অনেকদিন পর নিজের সেই পুরোনো বিছানায় শুয়ে আজ কেমন নতুন নতুন ঠেকছিলো মরিয়মের। হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে চুপচাপ উদাম বৃষ্টির রিমঝিম গান শুনছিলো আর ভাবছিলো মনসুরের কথা। লিলি বলে, সে ভুল করেছে। হয়তো তাই। সব কিছু ওকে খুলে না বললেও হতো। তাহলে মনসুর নিশ্চয় এমন ব্যবহার করতো না তার সাথে। যেমন চলছিলো সব কিছু তেমনি চলতো। হাসি আর আনন্দের অফুরন্ত স্রোতে ভাসতো ওরা দুজনে। কিন্তু সত্যকে ঢেকে রাখার কি অর্থ হতে পারে। মরিয়ম জাহেদকে ভালোবেসেছিলো। হ্যাঁ, সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলো। মনসুরকেও সে তেমনি ভালবেসেছে। নিজের সকল সত্তা আর সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে আপনার করে নিতে চেয়েছে। দুটোই সত্য। মরিয়ম বুঝতে পারে না এ সত্যের সহজ স্বীকৃতিতে ভুল কোথায়। সেকি মিথ্যের মুখোশ পরলে মনসুর সন্তুষ্ট হতো? দুবার কি মানুষ প্রেমে পড়তে পারে না? মনসুর কেন এমন হয়ে গেলো? হাসিভরা জীবনের মাঝখানে অশ্রু কেন এলো? ভাবতে গিয়ে দুচোখ সজল হয়ে এলো মরিয়মের। ফাটল বেয়ে টপটপ পানি ঝরে পড়ছে নিচে। সেদিকে চেয়ে চেয়ে এক সময় সে মনে মনে ঠিক করলো ফিরে গিয়ে মনসুরকে তার এই যন্ত্রণার কথা খুলে বলবে মরিয়ম। করজোড়ে তার কাছে পুরোনো দিনগুলো আবার ভিক্ষে চাইবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সে। জানালা গলিয়ে আসা বাতাসে চুলগুলো উড়ছে ওর। এতক্ষণে মরিয়ম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
মেঝেতে বিছানো মাদুরটার ওপর বালিশটা বুকের নিচে দিয়ে উপুড় হয়ে পা-জোড়া ছড়িয়ে দিয়েছে হাসিনা দরজার দিকে। সামনে একটা সাদা কাগজ আর কলম। হ্যারিকেনের আলোটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে অদূরে চৌকির ওপরে শোয়া মরিয়মের দিকে তাকিয়ে ধীরেধীরে ব্লাউজের ভেতর থেকে একটা চিঠি বের করলো হাসিনা। তসলিমের চিঠি। বিকেল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তিন-চারবার চিঠিখানা আগাগোড়া পড়েছে। তবু উত্তর দেবার আগে আরেকবার পড়ে নিলো সে। তারপর অতি যত্নসহকারে গোটা গোটা করে লিখলো হাসিনা—প্রিয় লিখেই কেটে দিলো। কী সম্বোধন করা যেতে পারে? সে লিখেছে ‘হাসি’ সম্বোধন করে। বারকয়েক কাটা ছেড়ার পর হাসিনা লিখলো—
তসলিম,
“তুমি আমাকে অনেক অনেক ভালবাস, আমাকে ছাড়া বাঁচবে না লিখেছ। আমারও তাই মনে হয়। সেদিন বিকেল থেকে কিছু ভাল লাগছে না আমার। তোমাকে সব সময় দেখতে ইচ্ছে করে। আমার হাতের লেখা ভীষণ খারাপ। আর তোমার মত সুন্দর করে গুছিয়ে আমি লিখতে পারি না। বাবা মা কেউ-এ ব্যাপারটা জানে না। সত্যি তোমার জন্য মনটা আমার সব সময় খারাপ হয়ে থাকে। তুমি আমাকে ভালবাস, কিন্তু আমি দেখতে ভীষণ বিশ্রী। তুমি কত সুন্দর!”
এখানে এসে চোখজোড়া ঘুমে জড়িয়ে আসছিলো হাসিনার। অসমাপ্ত চিঠিটা খাতার মধ্যে লুকিয়ে সেটা বালিশের তলায় রেখে দিলো সে। হ্যারিকেনটা নিভিয়ে দিয়ে সেখানেই শুয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে ঘুমের সমুদ্রে তলিয়ে গেলো হাসিনা। ঠোঁটের কোণে শুধু ছড়িয়ে রইলো এক টুকরো প্রশান্ত হাসি।
এ-ঘরে বাতি নিভে গেলেও ও-ঘরে আলো জ্বলছিলো। হাসমত আলী আর সালেহা বিবি তখনও জেগে। টিমটিমে হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে পুরো বাড়িটা একবার ঘুরে গেলেন সালেহা বিবি। নতুন কোথাও পানি পড়ছে কিনা। দরজাটা বন্ধ না খোলা দেখে গেলেন। হাসিনার গায়ের কাপড়টা উঠে গিয়েছিলো, উপুড় হয়ে সেটা নামিয়ে দিলেন তিনি। তারপর নিজের কামরায় ফিরে এসে হ্যারিকেনটা রাখলেন মেঝের উপর। ওরা কি ঘুমিয়ে পড়েছে শোবার আয়োজন করতে করতে শুধোলেন হাসমত আলী।
হ্যাঁ। কুয়োতলার দিকটার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে খাটের ওপর এসে বসলেন সালেহা বিবি।
বাইরে বৃষ্টি ঝরছে রিমঝিম। একটানা বর্ষণ। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস দেয়ালের গায়ে লেগে করুণ বিলাপে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, পৃথিবীর চোখে অশ্রু ঝরছে, বিষন্ন ব্যথার চাপে?
বাতিটা নিভিয়ে দাও। শুয়ে পড়লেন হাসমত আলী।
হ্যারিকেনটা নিভিয়ে দিতে অন্ধকার গ্রাস করে নিলো ঘরটা। কোথায় একটা টিকটিকি ডেকে উঠলো টিকটিক শব্দে। দু-হাতে নিজের জায়গাটা হাতড়ে নিয়ে কাত হলেন সালেহা বিবি। মাঝখানে দুলু আর খোকন।
দুপাশে-ওঁরা দু-জন, হাসমত আলী আর সালেহা বিবি।
খানিকক্ষণ পর সালেহা বিবি ডাকলেন, শুনছো?
উঁ। সারা দিলেন হাসমত আলী।
ঘুমুচ্ছো নাকি?
না।
কাল মরিয়মকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবো?
কোনটা?
মনসুর যে বলেছিলো একটা নতুন বাসায় নিয়ে যাবে আমাদের।
মাহমুদের সঙ্গে আলোচনা করো।
বাইরে বৃষ্টির উদাম নৃত্য চলছে। ভেতরে টপটপ বৃষ্টি পড়ছে ফাটলগুলো বেয়ে। মাঝে মাঝে ভেজা সুরকির গুড়ো।
শুনছো? আবার সালেহা বিবির গলা।
কী?
এ বাড়িতে থাকা আর ঠিক হবে না। আমার ভীষণ ভয় করে।
হাসমত আলীর কাছ থেকে এবার কোন উত্তর পেলেন না সালেহা বিবি। মৃদু নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে তার। একটু পরে তিনিও তন্দ্রার কোলে ঢলে পড়লেন।
এখন সকলে গভীর ঘুমে অচেতন।
তখনো বৃষ্টি থামে নি। ইলশেগুঁড়ির মত ঝরছে।
প্রেসের কাজ শেষ করে, দুচোখ ঘুম নিয়ে, ভোর হবার কিছু আগে বাসার পথে ফিরে এল মাহমুদ।
গলির মাথায় তিন-চারখানা ফায়ার বিগ্রেডের লাল গাড়ি দাঁড়ানো। গলির ভেতরে আবছা অন্ধকারে লোকজন ভিড় করে আছে। ওকে দেখে চিনতে পেরে অনেকে অবাক চোখে তাকালো। দু-একজন এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো, আপনি কি বাইরে ছিলেন নাকি?
কোথায় ছিলেন আপনি?
কোত্থেকে এসেছেন?
ছেলে বুড়োরা ওকে ঘিরে দাঁড়ালো। দু-পাশের জীর্ণ দালান ভাঙ্গা জানালাগুলো দিয়ে বাড়ির ঝি-বউ-এর- উঁকি মেরে দেখলো ওকে।
প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকালো মাহমুদ। গলিতে এত ভিড় কেন, ফায়ার বিগ্রেডের লোকগুলোই বা এত ছুটোছুটি করছে কেন?
আহা বেচারা! কে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জানালার ওপাশ থেকে।
কেউ কি বেঁচে নেই?
বোধ হয় না।
সমস্ত দেহটা অজানা শঙ্কায় শিরশির করে উঠলো মাহমুদের। মনে হলো হাত-পাগুলো সব ভেঙ্গে আসছে তার। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও পাচ্ছে না সে। তবু দু-হাতে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেলো মাহমুদ। সকলে নীরবে পথ ছেড়ে দিলো তাকে। সবাই ভেবেছিলো বাসার সামনে এসে একটা তীব্র আর্তনাদে ফেটে পড়বে সে। কিন্তু সে আর্তনাদ করলো না, থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। সামনের ভগ্নস্তূপটার দিকে নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মাহমুদ। বাতি হাতে ফায়ার বিগ্রেডের লোক ছুটোছুটি করছে। উদ্ধারের কাজ চালাচ্ছে ওরা।
পেছনের বাড়ির সরু বারান্দাটার ওপর থপ করে বসে পড়লো মাহমুদ। মনে হলো এ মুহূর্তে অনুভূতিগুলো তার মরে গেছে। সে যেন এক শূন্যতায় ডুবে গিয়ে, ফাপা বেলুনের মত বাতাসে দুলছে। না, মাথাটা ঘুরছে ওর। দেহটা টলছে। কিন্তু, হৃদয়ে কোন জ্বালা নেই।
ধীরে ধীরে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
মাহমুদ তেমনি বসে।
একটা কথাও এতক্ষণে বলে নি সে। কী বলবে?
পাড়ার লোকেরা আলাপ করছিলো নিজেদের মধ্যে। মাঝরাতে একটা ভয়ংকর শব্দে জেগে উঠে হকচকিয়ে গিয়েছিলো সকলে। এমন ভয়াবহ শব্দ কোথা থেকে এলো? পরে তারা একে একে দেখতে পেলো হাসমত আলীর বাড়িটা ধ্বসে পড়েছে। ঘর ছেড়ে সকলে ছুটে বেরিয়ে এলো। কিন্তু অন্ধকারে ভাঙ্গা ইটের স্তুপ ছাড়া আর কিছু নজরে এলো না কারো।
ইটের স্তুপ সরিয়ে একটা মৃতদেহ বের করে, স্ট্রেচারে তুলে এনে ওর সামনে মুহূর্ত কয়েকের জন্য দাঁড়ালো ফায়ারবিগ্রেডের চারজন লোক। একনজর তাকিয়ে, দাঁতে দাত চেপে চোখজোড়া অন্যদিকে সরিয়ে নিলো মাহমুদ। মাথাটা থেতলে গেছে মরিয়মের। কি কদাকার লাগছে এখন তাকে। মারা গেছে সে। কেন মরলো? কেনই বা সে গতকাল আসতে গিয়েছিলো এখানে। না এলে সে নিশ্চয় মরতো না। ওদের বাড়ি নিশ্চয় ধ্বসে পড়বে না এভাবে। তাহলে, মৃত্যুই কি তাকে টেনে এনেছিলো এখানে? হাসিনার মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হলো একটু পরে। গলাটা ভেঙ্গে গেছে তার। ঝুলে আছে দেহ থেকে; মাহমুদের মনে হলো ওর ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি লেগে আছে। মেয়েটা কি হাসতে হাসতে মারা গেছে? ও বয়সে যদি মারা যেতে হলো তবে সে জন্মেছিলো কেন? আর এখন সে কোথায় আছে? মৃত্যুর পর কোথায় যায় মানুষ কাল রাতে তাদের সকলকে দেখেছে মাহমুদ। হাসছিলো। কথা বলছিলো। হেঁটে বেড়াচ্ছিলো এ ঘর থেকে সে ঘরে। এখন তারা কোথায়? তাদের দেহগুলো এখনো দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু তারা নেই। কেন এমন হলো!
চারপাশে লোকজনের কোলাহল বেড়েছে এখন। মানুষের ভিড়। ছেলে বুড়ো জোয়ান মরদ গিজগিজ করছে এসে। মাহমুদ উদাস দৃষ্টি মেলে তাকালো সবার দিকে। খবর পেয়ে থানা থেকে একদল পুলিশও এসেছে।
দুলুর মৃতদেহটা ষ্ট্রেচারে করে সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। মাথার মগজগুলো সব বেরিয়ে গেছে ওর। সারাদেহ রক্তে চবচব করছে।
আহা, বাচ্চাটা–৷ কে যেন আফসোস করছিলো।
বাচ্চা নয়, কুত্তার বাচ্চা। নইলে অমন করে মরতে হলো কেন? দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে উঠলো মাহমুদ। পরক্ষণে ওর মনে হলো, তাই তো সেও মারা যেতে পারতো। রাতে বাসায় থাকলে সেও মরতো আর এমনি ষ্ট্রেচারে করে মৃতদেহটা নিয়ে যাওয়া হতো তার। তারপর কবর দেয়া হতো আজিমপুর গোরস্থানে। তারপর কি হতো? কোথায় থাকতো, কোথায় যেত মাহমুদ ভাবতে গিয়ে তার মনে হলো দেহের লোমগুলো সব খাড়া হয়ে গেছে। ঘাম দিচ্ছে সারা গায়ে।
হাসমত আলী সাহেবের বড় ছেলে আপনি, তাই না? সামনে একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে।
কেন, কি চাই আপনার? অদ্ভুত গলায় জবাব দিলো মাহমুদ।
যারা মারা গেছেন তাদের সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে একটা রিপোর্ট নিতে হবে।
কী করবেন রিপোর্ট নিয়ে? হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো মাহমুদ– পারবেন আজরাইলকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসে ঝোলাতে? পারবেন ওই–ওই বড়লোকের বাচ্চাগুলোকে শূলে চড়াতে? কী করবেন আপনারা রিপোর্ট নিয়ে?
পুলিশ অফিসার হকচকিয়ে গেলেন।
ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন বললো, পুলিশ লাইনের লোকগুলোর মাথায় কি গোবর পোরা থাকে নাকি মশাই? এ সময়ে তাকে জ্বালাতে গেছেন কেন? আর সময় নেই?
অল্প কটা কথা বলে রীতিমত হাপাচ্ছিলো মাহমুদ। দুহাতে কপালটা চেপে ধরে চুপচাপ বসে রইলো সে। সারা দেহ বেয়ে ঘাম ঝরছে তার।
বিকেলে আজিমপুর গোরস্থানে কবরস্থ করা হলো মৃতদেহগুলোকে। খবর পেয়ে মনসুর এসেছিলো। বোবা হয়ে গেছে সে। সব কিছু কেমন আকস্মিক আর অস্বাভাবিক মনে হলো তার।
এতক্ষণে মাহমুদের সঙ্গে একটা কথাও হয়নি তার। দু-জনে নির্বাক। গোরস্থান থেকে বেরিয়ে এসে কাঁপা গলায় বললো, কোথায় যাবেন এখন, ভাইজান?
মাহমুদ নীরবে পথ চলতে লাগলো।
পেছন থেকে এসে ওর একখানা হাত চেপে ধরলো মনসুর। ঢোক গিলে বললো, আমার ওখানে চলুন ভাইজান।
এতক্ষণে ওর দিকে তাকালো মাহমুদ। একটা অর্থহীন দৃষ্টি তুলে দেখলো তাকে। তারপর ধীরে ধীরে হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে টলতে টলতে সামনে এগিয়ে গেলো সে। মনসুর কাতর গলায় বললো, আমাকে ভুল বুঝবেন না।
মাহমুদের কানে কথাটা এলো কিনা বোঝা গেল না। আগের মত পথ চলতে লাগলো সে। পুরো সন্ধেটা পথে পথে ঘুরে কাটিয়ে দিলো মাহমুদ। সেও মরতে পারতো, কিন্তু বেঁচে গেছে; অদ্ভুতভাবে বেঁচে গেছে সে। কাল যারা ছিল আজ তারা নেই। নেই একথা ভাবতে গিয়ে বিশ্বাস হলো না তার। মনে হলো তারা বেঁচে আছে। তাদের কথাবার্তা সব শুনতে পাচ্ছে সে। দেখতে পাচ্ছে তাদের। কিন্তু তারা নেই। এ জীবনে দ্বিতীয়বার আর সেই রক্ত-মাংসের দেহগুলোকে দেখতে পাবে না মাহমুদ। তারা গেছে। চিরতরে ছেড়ে গেছে এই পৃথিবীর মায়া। সারা দেহটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে এলো। মাথার শিরাগুলো বুঝি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
বিশ্রামাগারের দোরগোড়ায় পা রাখতে, কেরোসিন কাঠের কাউন্টারের ওপাশ থেকে খোদাবক্স ঝুঁকে পড়ে তাকালো ও দিকে।
খবরটা ইতিমধ্যে কানে এসেছে তার। কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে এসে ওর পাশে দাঁড়ালো খোদবক্স। আস্তে ওর পিঠের ওপর একখানা হাত রেখে মৃদু গলায় বললো, আমি সব শুনেছি মাহমুদ সাহেব। কি আর করবেন, সব খোদার ইচ্ছা।
মাহমুদ তার লাল টকটকে একজোড়া চোখ মেলে তাকালো ওর দিকে। তারপর অকস্মাৎ দুহাতে ওর গলাটা টিপে ধরে চিৎকার করে উঠলো সে, সব খোদার ইচ্ছা, শালা জুচ্চুরির আর জায়গা পাও নি। গলাটা টিপে এখনি মেরে ফেলবো তোমায়, দেখি কোন্ খোদা বাঁচাতে আসে, শয়তানের বাচ্চা কোথাকার।
তীব্র আর্তনাদ করে ছিটকে পিছিয়ে গেল খোদাবক্স। রেস্তোরাঁয় আর যারা ছিলো তারা সকলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
টলতে টলতে আবার বাইরে বেরিয়ে এলো মাহমুদ।
আরো অনেকক্ষণ রাস্তায় ঘুরে বেড়ালো সে।
মাঝ রাতে প্রেসে এসে লম্বা হয়ে বেঞ্চটার ওপর শুয়ে পড়লো মাহমুদ। ম্যানেজার তাকে দেখে কি যেন জিজ্ঞেস করলো। কিছু কানে গেলো না ওর। লাল চোখজোড়া মেলে একবার তাকিয়ে আবার চোখ মুদলো সে। ম্যানেজার উঠে এসে ঝুঁকে পড়ে দেখলো ওকে, তারপর গায়ে হাত লাগতে আঁতকে উঠলো। পরপর চারটে দিন জ্বরে অচৈতন্য হয়ে রইলো মাহমুদ।
প্রলাপ বকলো।
ঘুমোল।
আবার প্রলাপ বকলো।
চতুর্থ দিনের মাথায় জ্ঞান ফিরে আসতে চোখ খুলে মাহমুদ দেখলো একটা পরিচিত মুখ ঝুঁকে পড়ে দেখছে তাকে। প্রথমে মনে হলো মরিয়ম। তারপর মনে হলো হাসিনা। অবশেষে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো, লিলি। লিলি দাঁড়িয়ে।
আমি কোথায় আছি এখন? কাতর গলায় প্রশ্ন করলো মাহমুদ। সারা মুখে বিস্ময়। লিলি মাথার কাছ থেকে পাশে এসে বসলো তার। বললো, কেমন লাগছে এখন আপনার?
আমার কি হয়েছে? কোথায় আছি আমি? মা, ওরা কোথায়? একসঙ্গে তিনটি প্রশ্ন করলো মাহমুদ। বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটে নি তার।
লিলি মুখখানা সরিয়ে নিলো অন্য দিকে।
ধীরে ধীরে সব কিছু মনে পড়লো মাহমুদের। মা, বাবা, মরিয়ম, হাসিনা, দুলু, খোকন–একে একে সবার কথা মনে পড়লো তার। মৃতদেহগুলো ভেসে উঠলো চোখের উপর। তাইতো, তারা সকলে মারা গেছে। আজিমপুর গোরস্থানে কবর দেয়া হয়েছে তাদের। কেন এমন হলো? কেন তারা মারা গেল? সারা বুক যন্ত্রণায় ফেটে পড়তে চাইলো তার। বোবা দৃষ্টি মেলে অসহায়ভাবে সে তাকালো লিলির দিকে।
লিলি ঝুঁকে পড়ে আবার জিজ্ঞেস করলো, কেমল লাগছে এখন আপনার? চারদিন ধরে অচৈতন্য হয়ে আছেন। মনসুর সাহেবসহ কত জায়গায় খুঁজেছি আপনাকে, শেষে প্রেসে গিয়ে দেখলাম জ্বরে বেহুশ হয়ে আছেন। এখন কেমন লাগছে আপনার?
একে-একে বিশ্রামাগারে যাওয়া আর প্রেসে এসে বেঞ্চের ওপর শুয়ে পড়ার ছবিটা ভেসে উঠলো চোখে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মৃতদেহগুলো আবার দেখা দিলো চোখে। বুকটা শূন্যতায় হু হু করে উঠলো। হঠাৎ বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো মাহমুদ। এই প্রথম চোখ ফেটে কান্না এলো তার। বেদনা জড়িত গলায় সে বললো, কেন এমন হলো বলতে পারেন, কেন এমন হলো? আমার যে কেউ রইলো না আর, কেউ না, আমি কেমন করে বাঁচবো।
ধীরে ধীরে মুখখানা ওর মাথার ওপর নাবিয়ে আনলো লিলি। দু-চোখে অশ্রু ঝরছে তার। কান্নাভরা গলায় সে কানে কানে বললো, আমি আছি, আমি যে তোমার, ওগো বিশ্বাস করো। আমি আছি, ওগো একবার মুখখানা তুলে তাকাও আমার দিকে, একবার চেয়ে দেখো।
উপসংহার
সকালের ডাকে আসা চিঠিখানা বারকয়েক নেড়েচেড়ে দেখলো লিলি। আঁকাবাঁকা অক্ষরে মাহমুদের নাম আর ঠিকানা লেখা। অপরিচিত হস্তাক্ষর।
দুপুরে সে বাসায় এলে লিলি বললো, তোমার চিঠি এসেছে একখানা। টেবিলের ওপর রাখা আছে।
খামটা ছিড়ে চিঠিখানা পড়লো মাহমুদ।
শাহাদাত লিখেছে ভৈরব থেকে।
মাহমুদ,
অনেক দিন তোমার কোন খোঁজ-খবর পাই নি। জানি না কেমন আছো। আজ বড় বিপদে পড়ে চিঠি লিখছি তোমাকে। জানি এ বিপদ থেকে তুমি কেন কেউ উদ্ধার করতে পারবে না আমায়। তবু মানসিক অশান্তির চরম মুহূর্তে নিজের দুঃখের কথা ব্যক্ত করার মতো তুমি ছাড়া আর কাউকে পেলাম না। তাই লিখছি।
আমেনার যক্ষ্মা হয়েছে।
ঢাকা থাকতেই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছিলো। এখন বোধ হয় তার শেষ দিন ঘনিয়ে এলো।
তুমি হয়তো অবাক হয়ে ভাবছো, এতদিন পরে এ খবরটা তোমাকে জানাতে গেলাম কেন। আসলে আমিও এ ব্যাপারে প্রায় অজ্ঞ ছিলাম। আমাকে সে কিছুতেই জানতে দেয় নি। মাঝে মাঝে লক্ষ করতাম, একটানা অনেকক্ষণ ধরে খক্খক করে কাশতো সে। বড় বেশি কাশতো। কখনো কখনো তার কাপড়ে রক্তের ছিটেফোটা দাগ দেখে প্রশ্ন করেছি। কিন্তু কোন উত্তর পাই নি। আবার, একদিন রাতে অকস্মাৎ রক্তবমি করতে করতে মুছা গেল সে। ডাক্তার ডাকলাম। রোগী দেখে তিনি ভীষণ গালাগাল দিলেন আমায়। বললো, তক্ষুনি ঢাকায় নিয়ে যেতে।
কিন্তু, আমেনা কিছুতে রাজী হলো না।
তার স্বভাব তোমার অজানা নয়।
একদিন ভাইদের অমতে সে বিয়ে করেছিলো আমায়। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো মাথা উঁচিয়ে। সেসব কথা তুমি জানো। ভাইদের কাছ থেকে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছিলো তাকে। আজ তাদের সামনে তিল তিল করে মরতে সে রাজী নয়। টাকা-পয়সার জন্যে হাত পাতবে এ কথা কল্পনাও করতে পারে না সে।
এদিকে আয় বড় কমে গেছে। দোকানের অবস্থা খুব ভালো নয়। লোকের হাতে টাকা নেই, চাহিদা
থাকলেও জিনিসপত্র কিনবে কি দিয়ে?
জীবনে কিছুই করতে পারলাম না মাহমুদ।
আমেনার জন্যও যে এ মুহূর্তে কিছু করতে পারবো, ভরসা হয় না। সারাটা জীবন ও শুধু আমাকে দিয়ে গেলো। ওকে আমি কিছু দিতে পারলাম না। দোয়া করো, ওর সঙ্গে আমিও যেন কবরে যেতে পারি।
এ দুনিয়াতে এর চেয়ে বড় কোন চাওয়া কিংবা পাওয়া আর নেই আমার। ছেলে-মেয়েগুলোর জন্য মাঝে মাঝে ভাবনা হয়। খোদা দিযেছেন, খোদাই চালিয়ে নেবেন ওদের। এতক্ষণ শুধু নিজের কথা লিখলাম, কিছু মনো করো না।
তোমাদের দিনকাল কেমন চলছে জানিও। লিলি কেমন আছে? মিতাকে আমার চুম্বন দিয়ো।
তোমার শাহাদাত।
চিঠিখানা একবার পড়ে শেষ করে আবার পড়লো মাহমুদ। তারপর চোয়ালে হাত রেখে অনেকক্ষণ বসে বসে কিছু ভাবলো সে। মিতাকে কোলে নিয়ে লিলি এসে দাঁড়ালো পাশে। মৃদু গলায় শুধালো কার চিঠি ওটা?
মাহমুদ বললো, শাহাদাত লিখেছে।
লিলি জানতে চাইলো, ওরা ভালোতো?
মাহমুদ চিঠিখানা এগিয়ে দিলো ওর দিকে।
লিলির পড়া শেষ হলে মাহমুদ আস্তে করে বললো, আমাকে এক্ষণি আবার বেরুতে হচ্ছে লিলি |
এই বেলায় কোথায় যাবে? লিলি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।
মাহমুদ ধীর গলায় বললো, আমেনাকে এখানে নিয়ে আসার জন্যে একখানা টেলিগ্রাম করবো ভাবছি।
লিলির মুখখানা অকস্মাৎ স্নান হয়ে গেলো। ইতস্তত করে সে বললো, এখানে আনবে?
মাহমুদ লক্ষ করলো লিলি ভয় পেয়েছে। একটা যক্ষ্মা রোগীকে বাসায় আনা হবে, বিশেষ করে যে ঘরে একটি বাচ্চা মেয়ে রয়েছে সেখানে, ভাবতে আতঙ্ক বোধ করছে লিলি।
ওর খুব কাছে এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বললো, আমার যদি কোন কঠিন অসুখ হয় তাহলে কি আমাকে তুমি দূরে সরিয়ে দিতে পারবে লিলি? তবে ওর জন্যে তুমি ভয় করছো কেন?
লিলি গম্ভীর কষ্ঠে জবাব দিলো, ওটা যা ছোঁয়াচে রোগ-না, ওকে এখানে আনতে পারবে না তুমি। মিতাকে বুকের মধ্যে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরলে সে।
দেখো তোমাদের এ স্বভাবটা আমার একেবারে পছন্দ হয় না, সহসা রেগে উঠলো মাহমুদ সব সময় নিজেকে নিয়ে চিন্তা করো তোমরা। লিলির চোখে-মুখে কোন ভাবান্তর হলো না। মিতাকে কোলে নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে।
মাহমুদ নীরব।
পায়ের শব্দে লিলি ফিরে তাকিয়ে দেখলো বাইরে বেরিয়ে গেল মাহমুদ। রাস্তায় নেমে, কাছের পোস্টাফিস থেকে শাহাদাতকে একখানা টেলিগ্রাম করে দিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে এলো মাহমুদ। এসে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পড়লো সে।
লিলি এখনও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাতের নখ খুঁটছে। মিতাকে সে একটু আগে শুইয়ে দিয়েছে তার দোলনায়।
ঈষৎ তন্দ্রায় চোখজোড়া জড়িয়ে আসছিলো মাহমুদের। লিলির ডাকে চোখ মেলে তাকালো সে।
লিলি কোমল কণ্ঠে ডাকলো, শুনছো?
মাহমুদ আস্তে শুধালো, কী?
আমি বলছিলাম কি, টেলিগ্রাম করে কি হবে, ওর কাছে এসে বসলো লিলি–তারচে, তুমি নিজে গিয়ে দেখে এসো ওকে।
লিলির কণ্ঠস্বরটা এখন সহানুভূতির সুরে ভরা।
মাহমুদ দুহাতে ওকে কাছে টেনে নিয়ে মৃদু স্বরে বললো, আমি জানতাম লিলি, তুমি ওকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না।
লিলি সলজ্জ হেসে ঘুমন্ত তার দিকে তাকালো এক পলক, কিছু বললো না। কাল মিতার জন্মদিন। রাতে শুয়ে শুয়ে সে ব্যাপারে আলোচনা করেছে ওরা। মাহমুদ বলেছে বেশি লোককে ডাকা চলবে না, ওতে অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য ক্ষুণ্ণ হয়।
ওর বাহুর উপর মাথা রেখে লিলি শুধিয়েছে, তুমি কাকে বলতে চাও?
মাহমুদ মৃদু স্বরে বলেছে, রফিককে বলবো, আর বলবো নঈমকে।
আমি মনসুরকে বলে দিয়েছে, বউকে সঙ্গে নিয়ে সে আসবে। লিলি আস্তে করে বলেছে, তসলিমকেও খবর দিয়েছি।
মাহমুদ সংক্ষেপে বলেছে, ঠিক আছে।
তারপর ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা।
ভোরে উঠে হাতমুখ ধুয়ে চা-নাস্তার পরে মাহমুদ যখন বেরুতে যাবে তখন লিলি স্মরণ করিয়ে দিলো, যাদের বলার আছে এই বেলা বলে এসো। আর শোন, ভৈরব কবে যাচ্ছো তুমি?
যাওয়ার পথে থামলো মাহমুদ। থেমে বললো, দেখি, কাল কিংবা পরশু যাবো। আমেনা যখন মেয়ে নিশ্চয় আসতে চাইবে না, টেলিগ্রামটা পেয়েছে কিনা কে জানে। কাটা কাটা কথাগুলো বলে রাস্তায় নেমে এলো সে।
জিন্নাহ এভিনুতে নতুন অফিস করেছে রফিক।
এখন আর অন্যের অধীনে কাজ করছে না, সে নিজস্ব কোম্পানি খুলেছে একটা। স্বাধীন ব্যবসা। বড় বড় কনট্রাক্ট পাচ্ছে আজকাল। রাস্তা মেরামত, বাড়ি ঘর তৈরি কিংবা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ইট, চুন, সুরকি ও লোহা-লক্কর সরবরাহের কনট্রাক্ট। প্রেস হয়ে যখন রফিকের অফিসে এসে পৌঁছলো মাহমুদ, তখন বেশ বেলা হয়েছে। বাইরের ঘরে কয়েকজন কর্মচারী নীরবে কাজ করছে। তাদের একপাশে নঈমকে দেখতে পেলো মাহমুদ। মস্ত বড় একটা খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন হিসেব করছে। ওর দিকে চোখ পড়তে ইশারায় কাছে ডাকলো, মাহমুদ যে, কি মনে করে?
মাহমুদ বললো, কাল মিতার জন্মদিন, তাই তোমাদের নেমন্তন্ন করতে এলাম। রফিক আছে কি?
আছে। পর্দা ঝুলানো চেম্বারটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে নঈম বললো, একটু আগে এসেছে। যাওনা, দেখা করো গিয়ে। এই শোনো–।
হঠাৎ কি মনে হতে ওকে আবার কাছে ডাকলো নঈম–তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে, ভীষণ সিরিয়াস কথা, বসো বলছি।
মাহমুদ বসলো।
সামনে খোলা খাতাটা বন্ধ করে এক পাশে ঠেলে রেখে দিলো নঈম।
চার পাশে তাকিয়ে নিয়ে চাপা গলায় ধীরে ধীরে বললো, রফিক একটা মেয়েকে ভালবাসতো মনে আছে তোমার?
হ্যাঁ, মাহমুদ মাথা দুলিয়ে সায় দিলো?
সে মেয়েটা এখনো তাকে ভালোবাসে।
হুঁ।
আজ কদিন ধরে রফিক কি বলছে জানো?
না।
বলছে–বলতে গিয়ে বার কয়েক নড়েচড়ে বসলো নঈম–রফিক বলছে মেয়েটাকে নাকি আমাকে বিয়ে করতে হবে।
সেকি? মাহমুদ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। তুমি করতে যাবে কেন?
দেখতো মজা। ঠোঁটের ফাঁকে মিটিমিটি হাসলো নঈম। এককালে ভালবাসতো রফিক একথা ঠিক, এখন সেসব কোথায় উবে গেছে। কিন্তু মেয়েটা ভীষণ হ্যাংলা, কিছুতে ওর পিছু ছাড়বে না। এখন হয়েছে কি–বলতে গিয়ে আরো সামনে ঝুঁকে এলো সে, চাপা গলায় বললো, মেয়েটা প্রেগনেন্ট হয়ে গেছে। এবোরসন করার জন্য চাপ দিয়েছিলো রফিক। কিন্তু মেয়েটা কিছুতে রাজী হচ্ছে না। মাঝখান থেকে বড় বিপদে পড়ে গেছে রফিক। তাই আজ কদিন ধরে সে আমায় ধরে বসেছে। বলছে আমার বেতন আরো বাড়িয়ে দেবে আর বিয়ের খরচ-পত্র সব নিজে বহন করবে। নঈম হাসলো।
মাহমুদ নীরব। সারা দেহ পাথর হয়ে গেছে।
ওকে চুপ থাকতে দেখে নঈম আবার বললো, বন্ধু হিসেবে ওর এ দুঃসময়ে ওকে বাঁচানো উচিত সেকথা আমি বুঝি কিন্তু– কিছু বলতে গিয়ে ইতস্তত করছিলো নঈম। সহসা উঠে দাঁড়ালো মাহমুদ।
ওকি চললে কোথায়? বসো। নঈম অবাক চোখে তাকালো ওর দিকে। মাহমুদ মৃদু গলায় বললো, কাজ আছে, চলি এখন।
রফিকের সঙ্গে দেখা করবে না?
না।
দ্রুতপায়ে বেরিয়ে আসছিলো মাহমুদ। পেছনে রফিকের উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ালো সে। আরে মাহমুদ যে, ওকি, এসে চুপি চুপি আবার চলে যাচ্ছো? মাহমুদকে পেয়ে অধীনস্থ কর্মচারীদের উপস্থিতি যেন ভুলে গেছে সে। এগিয়ে এসে ওর একখানা হাত চেপে ধরে বললো, এসো তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার, চেম্বারে এসো।
মাহমুদ বললো, না, আমার কাজ আছে, যাই এখন।
কাজ কাজ আর কাজ। কাজ কি শুধু তোমার একলার। আমি বেকার নই। আমারও কাজ আছে। এসো, একটু বসে যাবে। মাহমুদকে সঙ্গে নিয়ে চেম্বারে ফিরে আসার পথে আড়চোখে একবার নঈমের দিকে তাকালো রফিক। লম্বা খাতাটার ওপর ঝুঁকে পড়ে গভীর মনোযোগসহকারে হিসেব মিলাচ্ছে সে।
সোনালি রঙের কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে দুঠোঁটের ফাকে গুঁজে দিলো রফিক, আরেকটা সিগারেট মাহমুদকে দিলো, তারপর বললো, তোমরা আসো না। এলে কত ভাল লাগে সে আর কি বলবো। এইতো সারাদিন ব্যস্ত থাকি। যখর একটু অবকাশ পাই তখন তোমাদের কাছে পাই নে! কেমন আছো বলো। বউ আর মেয়ে ভালো আছে তো? কলিং বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডাকলো, দুকাপ চা আনার ফরমায়েশ দিলো। তারপর আবার বলতে লাগলো খোদাবক্সের দোকানে আজকাল যাও না? আমিও যাই না অনেকদিন হলো। সেদিন পাশ দিয়ে আসছিলাম। দেখলাম বেশ চলছে ওর রেস্তোরাঁ। আজকাল রেকর্ডে সারাদিন ধরে হিন্দি গান বাজায় সে। দেয়ালে অনেকগুলো ফিল্মস্টারের ছবি বুলিয়ে রেখেছে, তাই না? একটানা কথা বলে গেলেও মাহমুদ লক্ষ করলো অবচেতন মনে কি যেন ভাবছে রফিক।
চা খেয়ে নিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো সে। চেয়ারে হেলান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললো, নঈমের আমি একটা বিয়ে দিতে চাই, দিন দিন ও বড় খেয়ালি হয়ে যাচ্ছে, ওর সংসারী হওয়া উচিত। আড়চোখে একবার মাহমুদের দিকে তাকালো সে।
মাহমুদ বললো, তুমি নিজে কি চিরকুমার থাকবে নাকি?
না, না, মোটেই না। সামনে এগিয়ে টেবিলের ওপর দুহাতের কনুই রেখে পরক্ষণে জবাব দিলো, তবে হ্যাঁ, আপাতত ও ধরনের কোন প্ল্যান নেই আমার। সময় কোথায় বল, সময় থাকলে তবু চিন্তা করা যেতো।
মাহমুদ মৃদু হাসলো।
রফিক ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সহসা বললো, নঈমকে তুমি একটু বোঝাতে পারো? তোমার কথা সে নিশ্চয় শুনবে। ওর জন্যে ভালো একটি মেয়ে ঠিক করেছি আমি। কিন্তু, ও রাজী হচ্ছে না। বললাম, সব খরচ আমার তবু–
আরো কিছু যেন বলতে যাচ্ছিলো সে, মাহমুদ মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো, ওর জন্যে অত মাথা ঘামিয়ে মূল্যবান নষ্ট করা কি উচিত? বলে উঠে দাঁড়ালো মাহমুদ। চলি আজ।
আরে শোন, দাঁড়াও। রফিক পেছনে থেকে ডাকলো। কি জন্যে এসেছিলে কিছু বললে না তো?
এমনি। বলে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে এলো সে। পাখার নিচে বসেও এতক্ষণে রীতিমত ঘেমে উঠেছে মাহমুদ।
মিতার জন্মদিনে বড় রকমের কোন আয়োজন করে নি ওরা। কিছু প্যাস্ট্রি, ডালমুট আর কলা। এক কাপ করে চা সকলের জন্যে। বিকেলে আমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে এলো।
মনসুর আর সেলিনা। তসলিম আর নঈম। ছোট ঘরে বেশি লোককে বসাবার জায়গা নেই। তাই অনেককে বলতে পারেনি ওরা। তবু ছোটখাট আয়োজনটা বেশ জমে উঠলো অনেকক্ষণ।
মিতাকে আগের থেকে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিলো লিলি। কোলে নিয়ে সবাই আদর করলো তাকে।
সেলিনা বললো, দেখতে ঠিক মায়ের মত হয়েছে।
মনসুর বললো, রঙটা পেয়েছে বাবার।
লিলি বললো মেয়ে হয়ে বিপদ হলো, ছেলে হলে তোমাদের জামাই বানাতাম।
সেলিনা বললো, আমার কিন্তু ছেলে হবে, দেখো লিলি আপা।
মনসুর বললো, আমি কিন্তু মেয়ে চাই।
সেলিনা ঠোঁট বাকিয়ে বললো, তুমি চাইলেই হলো নাকি?
হয়েছে মান-অভিমানের পালাটা তোমরা বাসায় গিয়ে করো–লিলি হেসে বললো।
এখন সবাই মিলে মিতার স্বাস্থ্য পান করবে এসো।
মেয়েকে মাহমুদের কোলে বাড়িয়ে দিয়ে, খাবারগুলো এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখলো লিলি।
সবার অনুরোধে নঈম একটা গান শোনালো ওদের।
তারপর খাওয়ার পালা।
প্যাস্ট্রি। ডালমুট। কলা। সবশেষে চা ৷
তসলিমের দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে লিলি মৃদু হেসে বললো, তুমি একা এলে, রানুকে আনলে না যে?
তসলিম লজ্জা পেয়ে বললো, আসার কথা ছিলো। কিন্তু বাসা থেকে বেরুতে পারেনি ও।
লিলি মুখ টিপে আবার হাসলো ওর বাবা-মা বুঝি ওকে কড়া নজরে রেখেছে আজকাল?
তসলিম দ্রুত ঘাড় নাড়িয়ে বললো, হ্যাঁ।
মনসুর চায়ের কাপে চুকুম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বিয়ের দিন তারিখ কি এখনো ঠিক হয় নি?
না, এখনো কথাবার্তা চলছে। মৃদু জবাব দিলো তসলিম। লিলি আবার ঠোঁট টিপে হাসলো, বেচারা বড় অস্থির হয়ে পড়েছে। তসলিম লজ্জায় লাল হয়ুএ গিয়ে বললো, হুঁ তোমাকে বলেছে আর কী। শুধু শুধু বাজে কথা বলো।
চা-নাস্তা শেষ হলে আরো অনেকক্ষণ গল্প করলো ওরা। সিমেনা নিয়ে আলোচনা করলো। পত্র-পত্রিকা আর রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হলো। তারপর একে একে বিদায় নিয়ে চলে গেলো সবাই।
মিতাকে কোলে নিয়ে আদর করছিলো মাহমুদ। লিলি বললো তোমার কি হয়েছে বলতো, সবাই বললো, তুমি একটা কথাও বললে না?
মাহমুদ হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, তুমি তো জানো লিলি, অতিরিক্ত হুল্লোড় ভালো লাগে না আমার।
তাই বলে বুঝি একটা কথাও বলতে হবে না? কপট অভিমান করে লিলি বললো, ওরা কি মনে করলো বল তো?
কেন, তুমিতো কথা বলেছে সবার সাথে। মাহমুদ জবাব দিলো মৃদু গলায়। মিতা ঘুমিয়ে পড়েছে কোলে।
লিলি বিছানায় নিয়ে শোয়াল তাকে। কপালে একটু চুমু খেয়ে আদর করলো। গায়ের কাপড়টা মিতার আস্তে করে টেনে দিলো সে।
টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে সার সার বই। মাহমুদ বইগুলো উলটে খোঁজ করছিলো খাতাটা।
লিলি কাছে এসে বললো, কি খুঁজছো?
মাহমুদ বললো, আমার সেই খাতাটা সেই লাল কভার দেয়া।
লিলি বললো, তুমি বসো, আমি খুঁজে দিচ্ছি।
মিতার পাশে এসে বসলো মাহমুদ। লিলি বইগুলো উল্টে পাল্টে খোঁজ করছিলো খাতাটা। হঠাৎ একটা বই থেকে কি যেন পড়ে গেলো মাটিতে। উপুড় হয়ে ওটা হাতে তুলে নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো লিলি।
মাহমুদ বললো, কি ওটা? বলতে বলতে লিলির পেছনে এসে দাঁড়ালো সে।
লিলির হাতে একখানা ফটো। গ্রুপ ফটো। হাসমত আলী, মাহমুদ, সালেহা বিবি, মরিয়ম, হাসিনা সকলে আছে। তসলিম তুলেছিলো ওটা, আজও মনে আছে মাহমুদের।
ফটোর দিকে চেয়ে মৃদু গলায় লিলি জিজ্ঞেস করলো, ক-বছর হলো?
মাহমুদ ওর কাঁধের ওপর হাত জোড়া রেখে বললো, পাঁচ বছর।
পাঁচটা বছর চলে গেছে, তাই না? লিলির দৃষ্টি তখনো হাতে ধরে রাখা ফটোটার উপর। ধীরে ধীরে মাহমুদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর মুখে চোখ তুলে তাকালো লিলি। চোখজোড়া পানিতে টলমল করছে ওর।
দুজনে মৌন।
দুজনে নীরব।
মাহমুদের গলা জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো লিলি। বুকটা অস্বাভাবিক কাঁপছে ওর। অসহায়ের মত কাঁপছে।
ওর ঘনকালো চুলগুলোর ভেতর সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে মাহমুদ মৃদু গলায় বললো, কেন কাঁদছো লিলি। জীবনটা কি কারো অপেক্ষায় বসে থাকে? আমাদেরও একদিন মরতে হবে। তখনো পৃথিবী এমনি চলবে। তার চলা বন্ধ হবে না কোনদিন। যে-শক্তি জীবনকে চালিয়ে নিয়ে চলেছে তার কি কোন শেষ আছে লিলি?