বরফ গলা নদী by জহির রায়হান, chapter name তারও আগে যা ঘটেছিল

তারও আগে যা ঘটেছিল

সরু গলিটা জুড়ে ধীরে ধীরে এগুতে লাগলো রিক্সাটা। কিছুদূর এলে, মরিয়ম বললো, এবার নামতে হবে লিলি। সামানে আর রিক্সা যাবে না। বলতে বলতে রিক্সা থেকে নেমে পড়লো সে। তার পিছু পিছু লিলিও নামল নিচে।

চারপাশে নোঙরা আবর্জনা ছড়ানো। কলার খোসা, মাছের আমিষ, মরা ইঁদুর, বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পায়খানা–সব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। দুর্গন্ধে এক-মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।

আঁচলে নাক ঢেকে লিলি বললো, আর কতদূর?

এই তো আর অল্প একটু–বলে সামনে হাত দিয়ে দেখালো মরিয়ম।

এদিকে গলিটা আরো সরু হয়ে গেছে। একজনের বেশি লোক পাশাপাশি হেঁটে যেতে পারে না। মরিয়ম আগে লিলিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে। নাকে ওর শাড়ি দিতে হয় নি, রোজ দুবেলা এ পথে আসা যাওয়া করতে করতে এসব দুর্গন্ধ ওর নাক-সহ্য হয়ে গেছে। আরো খানিকটা পথ হেঁটে এসে একটা আস্তর-ওঠা লাল দালানের সামনে দাঁড়ালো মরিয়ম।

লিলি বললো, এটা বুঝি তোমাদের বাসা?

মরিয়ম মাথা নেড়ে সায় দিলো, হ্যাঁ।

দোরগোড়ায় একটা নেড়ি কুকুর বসে বসে গা চুলকাচ্ছিলো।

ওদের দেখে এক পাশে সরে গেলো সে। এতক্ষণে নাকের উপর চেপে রাখা আঁচলটা নামিয়ে নিলো লিলি।

দরজাটা পেরুলে একটা সরু বারান্দা। দুপাশে দুটো কামরা। একটিতে মাহমুদ থাকে। আরেকটিতে মরিয়ম আর হাসিনা। বারান্দার শেষ প্রান্তে আরো একটি কামরা আছে। ওটাতে মা আর বাবা থাকেন। দুলু আর খোকনও থাকে ওখানে। ও ঘরটার পেছনে পাকঘর আর কুয়োতলা। কুয়োতলায় যেতে হলে মা-বাবার কামরার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অন্য কোন পথ নেই।

ভেতরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিলো লিলি।

মরিয়ম বললো, এসো।

ওর নিজের কামরাটায় লিলিকে এনে বসালো মরিয়ম। একপাশে চওড়া একখানা চৌকির ওপর বিছানা পাতা। দুটো বালিশ পাশাপাশি সাজানো। একটা হাসিনার আর একটা মরিয়মের। দেয়ালে ঝোলান আলনার সাথে তাদের কাপড়গুলো সুন্দর করে গোছানো। তার নিচে একটা কেরোসিন কাঠের টেবিল। টেবিলে বই-খাতা রাখা। আর কোন আসবাব নেই ঘরে। আছে একটা মাদুর। ওটা মেঝেতে বিছিয়ে পড়ে ওরা।

বিছানার ওপর এসে বসলো লিলি, এটা বুঝি তোমার ঘর?

হাতের বই-খাতাগুলো টেবিলের ওপর রেখে মরিয়ম জবাব দিলো, হ্যাঁ, হাসিনা আর আমি থাকি এখানে।

এ ঘরে অপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে দুলু এসে উঁকি মারছিলো ভেতরে। ওকে দেখে মরিয়ম বললো, দুলু, মা কোথায় রে?

দুলু ভাঙ্গা গলায় বললো, পাকঘরে।

মরিয়ম বললো, আমার ছোট বোন দুলু, সবার ছোট ও।

লিলি কাছে ডাকলো ওকে, এস, এদিকে এস।

ওর ডাক শুনে গুটিগুটি পায়ে পিছিয়ে গেলো দুলু। তারপর ছুটে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো সে।

মরিয়ম বললো, তুমি বসো লিলি, আমি এক্ষুণি আসছি। বলে আলনা থেকে গামছাটা নামিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে।

মায়ের ঘরটা খালি। বাবা অফিস থেকে ফেরেন নি এখনো। খোকন আর হাসিনা স্কুলে। মাহমুদ বোধ হয় এখনো ঘুমুচ্ছে ওর ঘরে। সারা রাত ডিউটি দিয়ে এসে সারাদিন ঘুমোয় ও।

কুয়ো থেকে এক বালতি পানি তুলে, মুখ হাত ধোবার জন্যে কাপড়টা গুটিয়ে নিয়ে ভালো করে বসলো মরিয়ম।

পাকঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে মা শুধালেন, কে এসেছে রে মরিয়ম?

মরিয়ম মুখে পানি ছিটোতে ছিটোতে জবাব দিলো, আমার এক বান্ধবী।

মা জানতে চাইলেন, এক সঙ্গে পড়তো বুঝি?

মরিয়ম বললো, হ্যাঁ।

মা আর কোন প্রশ্ন করলেন না। ভাতগুলো মজে এসেছে, এখনি নামিয়ে ফেন ঢালতে হবে। তারপর জলের কড়াটা চড়িয়ে দিতে হবে চুলোর উপর। মরিয়ম পাকঘরে এসে ঝুঁকে পড়ে বললো, এক কাপ চা দিতে পারবে, মা?

সালেহা বিবি বললেন, দেখি, চা পাতা আছে কিনা, বলে চুলোর পেছনে রাখা কৌটোগুলোর দিকে হাত বাড়ালেন তিনি। অনেকগুলো কৌটা রাখা আছে সেখানে। কোনটাতে মরিচ, কোনটায় হলুদ, রসুন কিংবা পেয়াজ। মাঝখান থেকে একটা তুলে নিয়ে খুলে দেখলেন সালেহা বিবি। তারপর বললেন, দুকাপ আন্দাজ আছে। তুই যা আমি করে পাঠিয়ে দিচ্ছি। হঠাৎ কি মনে হতে পেছন থেকে তাকে আবার ডাকলেন সালেহা বিবি, শুধু চা দেবো?

কিছু আছে কি? মরিয়ম প্রশ্ন করলো, থাকলে দাও।

মা ঘাড় নাড়লেন, নেই। থাকবার কি উপায় আছে ওই দুলু আর খোকনটার জন্যে। কাল মাহমুদ কিছু বিস্কুট এনেছিলো, সাধ্য কি যে লুকিয়ে রাখবো। আজ সকালে বের করে দুজনে খেয়ে ফেলেছে।

‘যদি পার, বাইরে থেকে কিছু আনিয়ে দিও মা।’ যাবার সময় বলে গেলো মরিয়ম। মায়ের ঘর থেকে সে শুনতে পেলো, ও ঘরে কার সঙ্গে কথা বলছে লিলি। বোধ হয় হাসিনা ফিরেছে স্কুল থেকে। বাংলাবাজারে পড়ে সে ক্লাস এইটে। লম্বা দোহারা গড়ন। রঙটা শ্যামলা। সরু নাক। মুখটা একটু লম্বাটে ধরনের। বাড়ির অন্য সবার চেয়ে চেহারা একটু ভিন্ন রকমের ওর। চোখ জোড়া বড় হলেও তার মণিগুলো কটা কটা। বাঁ চোখের নিচে একটা সরু কাটা দাগ। ছোটবেলায় দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে বঁটির ওপর পড়ে গিয়ে কেটে গিয়েছিলো। সে চিহ্নটা এখনো মুছে যায় নি।

এ ঘরে এসে মরিয়ম দেখলো লিলির পাশে বসে গল্প জমিয়েছে হাসিনা। আপনার শাড়িটা কত দিয়ে কিনেছেন?

লিলি বললো, মনে নেই, বোধ হয় আঠারো টাকা।

হাসিনা বললো, কি সুন্দর, আমিও কিনবো একখানা। কোত্থেকে কিনেছেন আপনি?

লিলি জবাব দিলো নিউ মার্কেট থেকে।

হাসিনা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শাড়িটা দেখতে লাগলো। ওর ওই স্বভাব- কারো পরনে একটা ভালো শাড়ি কিংবা ব্লাউজ দেখলে অমনি তার দাম এবং প্রাপ্তিস্থান জানতে চাইবে এবং সেটা কেনার জন্য বায়না ধরবে। কিনে না দিলে কেঁদেকেটে একাকার করবে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রাখবে হাসিনা। মরিয়ম এসে বললো, ওর সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে কি লিলি ও আমার ছোট বোন হাসিনা।

লিলি হেসে বললো, নতুন করে পরিচয় দিতে হবে না, ও নিজেই আলাপ করে নিয়েছে।

হাসিনা বললো, আপার কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। বলে হঠাৎ কি মনে হতে ওর দিকে ঘুরে বসে সে আবার বললো, আচ্ছা আপনি বলুন তো, আপা সুন্দর না আমি সুন্দর। ওর প্রশ্ন শুনে হেসে দিলো লিলি। মরিয়ম বললো, নতুন কেউ এলেই ওই এক প্রশ্ন ওর–আপা সুন্দর, না আমি সুন্দর।

ক-দিন বলেছি তুমি সুন্দর, তুমি সুন্দর, আমি কুৎসিত, হলো তো?

গলার স্বর শুনে মনে হলো ও রাগ করেছে। আসলে মনে মনে হাসছে মরিয়ম। কারণ সে জানে যে, হাসিনার চেয়ে ও অনেক বেশি সুন্দর। রঙটা ওর ফর্সা, ধবধবে। মায়ের দেহ-লাবণ্যের উত্তরাধিকারী হয়েছে সে। চেহারাটাও মায়ের মত সুশ্রী। আর চোখজোড়া খুব বড় না হলেও হাসিনার মত কটা নয়।

মা বলেন, ও ঠিক আমার মত হয়েছে, স্বভাবটাও আমারই পেয়েছে সে, আর তোরা হয়েছিস তোদের বাবার মত ছন্নছাড়া।

এ নিয়ে রোজ মায়ের সঙ্গে ঝগড়া বাধায় হাসিনা। বলে, তুমি তো সব সময় ওর প্রশংসাই করো, আমরা যেন কিছু না।

শুনে মা হাসেন।

লিলিও হাসলো আজ। হেসে বললো, মরিয়ম ঠিকই বলেছে। ও দেখতে কুৎসিত। তুমি ওর চেয়ে অনেক সুন্দর হাসিনা।

শুনে হাসিনা বড় খুশি হলো। লিকলিকে বেণিজোড়া দুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বললো, আপনি বসুন, আমি এক্ষুণি আপনার জন্য চা বানিয়ে আনছি। বলে ঘর থেকে বেরুতে যাবে এমন সময় বারান্দায় মাহমুদের তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেলো, ক’দিন বলেছি আমার বইপত্র ঘাঁটাঘাটি করিস নে, তবু রোজ তাই করবি। এরপর আমি তোকে মাথার ওপরে তুলে আছাড় মারবো হাসিনা।

হাসিনার খোঁজে এ ঘরে এসে মুহূর্তে চুপসে গেলো মাহমুদ। লিলির দিকে অপ্রস্তুত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো সে। তারপর যেমন হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলো, তেমনি দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

ও চলে যেতে আঁচলে মুখ চেপে ঘরময় লুটোপুটি খেলো হাসিনা। মরিয়ম ধমকের সুরে বললো, আবার হাসছে দেখ না, লজ্জা-শরম বলে কিছু যদি থাকতো। ক’দিন দাদা নিষেধ করে দিয়েছে ওর বইপত্র না ঘটতে তবু– কথাটা শেষ করলো না মরিয়ম।

একদিন মাহমুদের বই ঘাঁটতে গিয়ে একটা এক টাকার নোট পেয়েছিলো হাসিনা। আরেক দিন একটা আট আনি। সেদিন থেকে যখনি মাহমুদ বাইরে বেরিয়ে যায় তখনি ওর বইপত্র ওলটায় গিয়ে সে। মরিয়মের ধমক খেয়ে চুপ করে গেলো হাসিনা। পরক্ষণে কি মনে হতে লিলির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো, আপনার ক্যামেরা আছে লিলি আপা?

লিলি বললো, কেন ক্যামেরা দিয়ে কি করবে তুমি?

হাসিনা বললো, ছবি তুলবো।

তাই নাকি? লিলি মৃদু হেসে বললো, না ভাই, ক্যামেরা আমার নেই। বিমর্ষ হয়ে লিলির জন্য চা আনতে গেলো হাসিনা।

একটা পিরিচে দুটো সন্দেশ আর দুটো রসগোল্লা। পাশে রাখা দুকাপ গরম চা। দেখে চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো হাসিনার। নাচের তালে জোড় ঘুরনী দিয়ে টুপ করে বসে পড়লো সে, মা আমি একটা খাবো। বলে এক মুহূর্তও দেরি না করে পিরিচ থেকে একটা রসগোল্লা তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলো সে।

সালেহা বিবি কড়াইতে পানি ঢেলে ডাল চড়াচ্ছিলেন, পেছনে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি–ওকি হচ্ছে, ওকি হচ্ছে হাসিনা।

রসগোল্লাটা গিলে ফেলে হাসিনা বললো, অমন করছো কেন, একটা তো খেয়েছি, আরো তিনটে আছে।

সালেহা বিবির ইচ্ছে হলো চুলের গোছা ধরে মুখে একটা চড় বসিয়ে দিতে ওর, শুধু তিনটে ইয়ে মেহমানের সামনে কেমন করে দেয়, অ্যাঁ? তোদের নিয়ে আর পারি নে আমি। খাওয়ার জন্য এত হা-হা কেন তোদের, রসগোল্লা কি দেখিস নি জীবনে?

মায়ের ভর্ৎসনা শুনে মুখ কালো করলো হাসিনা। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো ওর। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমায় যে তুমি দেখতে পারো না তা আমি জানি। আপার মেহমান এসেছে বলে আজ মিষ্টি আনিয়েছো। আমার কেউ এলে এক কাপ চা-ও দিতে না।

আঁচলে চোখ মুছে ধুপধাপ শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলো সে। এখন ছাদে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে হাসিনা।

শুধু একটা সন্দেশ খেলো লিলি।

দুলু এসে উঁকি দিচ্ছিলো দোর গোড়ায়। তার হাতে একটা সন্দেশ তুলে দিলো সে। অবশিষ্ট একটা রসগোলা পড়ে রইলো প্লেটের ওপর। সালেহা বিবি অনুরোধ করলেন, কি হাত তুলে বসে রইলে যে, ওটা খেয়ে নাও।

লিলি বললো, না, আর খাবো না। মিষ্টি বেশি খাই নে আমি। মরিয়ম তুমি খাও। হাসিনা গেলো কোথায়?

মরিয়ম কিছু বলার আগে সালেহা বিবি জবাব দিলেন, কোথায়, ছাদে গিয়ে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছে। বলে আর সেখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলেন না তিনি। চুলোর ওপর ডাল চড়িয়ে এসেছেন সে কথা মনে পড়তে দুলুর হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন সালেহা বিবি। দুলুর চোখজোড়া তখনো পিরিচে অসহায়ভাবে পড়ে থাকা রসগোল্লাটার দিকে নিবদ্ধ ছিলো। যাবার পথেও বার কয়েক সেদিকে তাকিয়ে গেলো সে।

 

শহরে সন্ধ্যা নামার অনেক আগে এখানে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বাইরে যখন বিকেল এ গলিতে তখন রাত। আর বাইরে যখন ভোর হয় তখনো এ গলিতে তমসায় ঢাকা থাকে। অনেক বাধা ডিঙিয়ে, অনেক প্রাসাদের চুড়ো পেরিয়ে তবে এখানে প্রবেশের অধিকার পায় সূর্য। এ পাড়ার বাসিন্দাদের বড় সাধনার ধন সে। তাই বেলা দুপুরে যখন এক চিলতে রোদ এসে পড়ে এই হীন দালানগুলোর ওপর তখন তার বাসিন্দারা বড় চঞ্চল হয়ে উঠে। ভিজে কাপড়-চোপড়গুলো রোদে বিছিয়ে দেয় তারা। খানিক পরে ধীরে ধীরে আবার সূর্যটা নেমে যায় পশ্চিমে। কে যেন জোর করে টেনে নিয়ে যায় তাকে। তখন এখানে অন্ধকার। অন্ধকার শুধু। বাইরে চোখ পড়তে লিলি বললো, চলো, এবার উঠা যাক মরিয়ম, রাত হয়ে এলো। মরিয়ম বললো, একটু বসো, মাকে বলে আসি।

গলির মাথায় এসে লিলিকে বিদায় দিলো মরিয়ম। ও বাসায় যাবে এখন। মরিয়ম যাবে নারিন্দায়, ছাত্রী পড়াতে। রিক্সায় উঠে লিলি বললো, কাল আবার দেখা হবে ম্যারি।

আদর করে মাঝে মাঝে মরিয়মকে ম্যারি বলে সম্বোধন করে সে।

ও চলে গেলে কিছুক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে রইল মরিয়ম। তারপর মাথার ওপরের কাপড়টা আরো একটু টেনে দিয়ে রাস্তার পাশ ধরে এগিয়ে গেলো সে।

রোজ পায়ে হেঁটে ছাত্রীর বাড়ি যায় মরিয়ম।

পায়ে হেঁটে ফিরে আসে।

রিক্সায় যদি আসা-যাওয়া করে তাহলে হিসেব করে দেখেছে সে যা পায় তার অর্ধেকটা ব্যয় হয়ে যায়। তাছাড়া হাঁটতে যে খুব খারাপ লাগে ওর, তা নয়। মাসের শেষে ত্ৰিশটা টাকা পাওয়ার আনন্দ হাঁটার ক্লান্তির চেয়ে অনেক বেশি অনেক সুখপ্রদ।

দুপাশের দোকানপাট, লোকজন দেখতে দেখতে এমনি পায়ে চলার পথে অনেক কিছু ভাবে মরিয়ম। বাবার কথা। মায়ের কথা। মাহমুদের কথা। আর নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া সেই বিপর্যয়ের কথা। অনেক কিছু ভাবে মরিয়ম। ইদানীং সেলিনার বড় বোনের দেবর মনসুরের কথাও মাঝে মাঝে ভাবনার মধ্যে এসে যায়। সেলিনা ওর ছাত্রীর নাম।

মনসুর আজকাল বড় বেশি আসা-যাওয়া করছে ওদের বাসায়। প্রায় বিকেলেই আসে। বিশেষ করে মরিয়ম যখন সেলিনাকে পড়াতে যায় তখন। মরিয়ম ভাবে এবার থেকে লোকটা এলে তার সাথে আর কথা বলবে না সে। কে জানে মনে কী আছে লোকটার। কোন বদ উদ্দেশ্যও তো থাকতে পারে। মানুষের মনের খবর জানা সহজ নয়। জাহেদকে কত কাছ থেকে দেখেছিলো মরিয়ম তবুও কি তার মনের গোপন কথাটি জানতে পেরেছিলো কোনদিন? যদি এক মুহূর্ত আগেও জানতে পারতো তাহলে এমন একটা বিপর্যয় ঘটতে দিতো না মরিয়ম।

দোরগোড়ায় পা দিতেই ভেতরে মনসুরের গলার স্বর শোনা গেলো।

আজ আগে থেকেই এসে বসে আছে লোকটা।

ওর সামনে দিয়ে নিঃশব্দে ভেতরে চলে এলো মরিয়ম।

সোজা সেলিনার ঘরে।

ওর ঘরটা বড় সুন্দর করে সাজানো আর বেশ পরিপাটি। একপাশে নতুন কেনা একখানা খাটের উপর সেলিনার বিছানা। নীল রঙের একখানা বেড কভার দিয়ে ঢাকা। মাথার কাছে একটা গোল টিপয়, তার উপর ফুলদানিতে বহু বর্ণের ফুল সাজানো। দেখে মনে হয় তাজা ফুল। আসলে কাগজের তৈরি।

দেয়ালে কয়েকখানা ছবি টাঙ্গানো। কোন এক শিল্পীর আঁকা একখানা পোট্রেট।

এ ঘরে ছিলো না সেলিনা। খবর পেয়ে এসে কপালে হাতের তালু ঠেকিয়ে বললো, আজ পড়বো না আপা, শরীরটা ভালো লাগছে না।

মরিয়ম সহানুভূতির সাথে বললো, কি হয়েছে?

ধপ করে বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে সেলিনা জবাব দিলো, মাথাটা ভীষণ ধরেছে আপা।

মরিয়ম জানে এটা মিথ্যে কথা। যেদিন পড়ায় ফাঁকি দেবার ইচ্ছে থাকে সেদিন একটা কিছু ছুতো বের করে বসে সেলিনা। কোনদিন মাথা ব্যথা। কোনদিন পেট কামড়। কোনদিন বমি বমি ভাব। মরিয়ম কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, সত্যি তোমার মাথা ব্যথা করছে সেলিনা?

সেলিনা পাশ ফিরে শুয়ে বললো, তুমি সব সময় আমায় সন্দেহ কর আপা।

মরিয়ম বললো, এতদূর হেঁটে এসে না পড়িয়ে ফিরে যেতে আমার খারাপ লাগে কিনা, তাই।

ওই যা, হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সেলিনা, তুমি বসো আপা, আমি এক্ষুণি আসছি। বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলো সে। খানিকক্ষণ পরে আবার ফিরে এলো। হাতে তিনখানা দশ টাকার নোট। মরিয়মের হাতে নোটগুলো গুঁজে দিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো সেলিনা, সত্যি বলছি আপা, মাথাটা আজ ভীষণ ধরেছে।

মরিয়ম জানে হাজার বুঝালেও, ওকে আর এখন পড়াতে বসানো যাবে না। এখানে বুঝি হাসিনার সঙ্গে মিল আছে ওর। হাসিনাও এমনি ফাঁকি দেয় লেখাপড়ায়। গালাগাল করেও বইয়ের সামনে বসানো যায় না। এঘর থেকে ওঘরে পালিয়ে বেড়ায়। ছাদে গিয়ে বসে থাকে।

বাবা বলেন, ছোট বেলায় তোমরাও এমন ছিলে। এখনও কম বয়স ওর, বুদ্ধি হয় নি, বুদ্ধি হলে তখন আর বকবিকি করতে হবে না; আপনা থেকেই পড়তে বসবে।

মা বলেন, ওর বুঝি অল্প বয়স? আসছে মাসে তেরো পেরিয়ে চৌদ্দয় পড়বে। ও বয়সে মরিয়মকে দেখি নি। ওকে পড়তে বলতে হতো? আসলে তুমি ওকে বড় বেশি লাই দিচ্ছো। দেখবে ওর কিছু হবে না জীবনে।

বাবা সব সময় হাসিনার পক্ষ নেন। মা মরিয়মের। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কথাই ভাবছিলো মরিয়ম।

সেলিনা জিজ্ঞেস করলো, কি ভাবছো আপা?

না, কিছু না। হাতের নোটগুলো ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়ে মরিয়ম বললো, তাহলে আমি চলি সেলিনা, তোমার মাকে বলো আমি এসেছিলাম। কাল আবার দেখা হবে, কেমন?

সেলিনা পাশ ফিরে শুয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো, আচ্ছা।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে পা বাড়াতে গতি যেন শ্লথ হয়ে এলো তার। বৈঠকখানা ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনসুর। লম্বা গড়ন। সরু দেহ। পরনে একটা ঢোলা পায়জামা আর গায়ে ঘি রঙের মিহি পাঞ্জাবি। পায়ের শব্দে ওর দিকে ফিরে তাকালো মনসুর। একেবারে ওর মুখোমুখি। চোখজোড়া মাটিতে নামিয়ে নিয়ে ওর পাশ কেটে চলে যাবে ভাবছিলো মরিয়ম।

একি এসেই ফিরে চললেন যে? চলার পথে তার প্রতিরোধ করলো মনসুর।

সেলিনা আজ পড়বে না। ছোট্ট উত্তরটা দিয়ে চলে যাচ্ছিলো মরিয়ম।

মনসুর বললো, চলুন আমিও যাবো ওপথে।

ওর নিজের তরফ থেকে কোন আমন্ত্রণ না জানালেও, কিছুদূর পিছুপিছু তারপর পাশাপাশি রাস্তায় নেমে এলো মনসুর।

আজ প্রথম নয়। এর আগেও এ ধরনের প্রস্তাব সে পেয়েছে মনসুরের কাছ থেকে। শুধু প্রস্তাব নয়, মরিয়মকে বাসার কাছাকাছি এগিয়ে দিয়েও গেছে সে।

মরিয়মের ভালো লাগে নি। বড় বিরক্তিকর মনে হয়েছে এই অনাহুত সঙ্গদান। কথাবার্তা যে খুব হয়েছে রাস্তায় তা নয়। একদিন জিজ্ঞেস করছিলো, মরিয়ম কোথায় থাকে। আর একদিন জানতে চেয়েছিলো, পরীক্ষা কেমন দিয়েছ মরিয়ম। এছাড়া এমনও দিন গেছে, যে দিন সারা পথ নীরবে হেটেছে ওরা। বাসার কাছাকাছি তেমাথায় এসে মনসুর বলেছে আচ্ছা আসি এবার। আপনি তো ও পথে যাবেন, আমি এ পথে। কিছুদূর গিয়ে লোকটা রিক্সা নিয়েছে তা ঠিক লক্ষ্য করেছে মরিয়ম। মরিয়ম জানে বেশ টাকা-পয়সা আছে লোকটার, রিক্সা কেন ইচ্ছা করলে মোটরে চড়ে চলাফেরা করতে পারে। তবু এ পথটা মরিয়মের সঙ্গে হেঁটে আসতো মনসুর।

রাস্তায় নেমে মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিলো মরিয়ম; কেন সে নিষেধ করলো না লোকটাকে? ইচ্ছে করলে তো মুখের ওপর জবাব দিতে পারতো। বলতে পারতো আপনি সঙ্গে আসুন তা পছন্দ হয় না আমার। দয়া করে আর পিছু নেবেন না। ইচ্ছে করলে আরো রূঢ় গলায় আসতে নিষেধ করতে পারতো মরিয়ম। তবু কেন, একটা কথাও বলতে পারলো না সে?

পাশাপাশি আসছিলো মনসুর। ইতিমধ্যে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়েছে সে। বার কয়েক তাকিয়েছে মরিয়মের দিকে। মৃদু ঘামছিলো মরিয়ম।

হঠাৎ হাত বাড়িয়ে একটা রিক্সা থামালো সে। মনসুরকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অনেকটা তাড়াহুড়ার সাথে রিক্সায় উঠে বসলো মরিয়ম।

বেশ কিছুদূর আসার পর একবার পেছন ফিরে তাকালো সে। দেখলো এদিকে চেয়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে মনসুর। দেখে প্রথমে হাসি পেলো তার। হেসে নিয়ে সে ভাবলো এমন ব্যবহারটা হয়তো উচিত হয় নি। লোকটা তাকে অভদ্র বলে মনে করতে পারে কিংবা অতি দাম্ভিক। এর কোনটিই নয় মরিয়ম। মনসুরের এই গায়েপড়াভাব তার ভালো লাগে না, এটাই হলো আসল কথা। কথাটা মনসুরকে ভদ্রভাবে বলে দিলেও তো পারতো সে। তাই ভালো ছিলো হয়তো। একটু আগের অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্যে মনে মনে অনুতপ্ত হলো মরিয়ম। কিন্তু পরক্ষণে আবার মনে হলো, সে অন্যায় কিছু করে নি। জাহেদের সঙ্গেও এমনি রূঢ় ব্যবহার করা উচিত ছিলো তার। পারে নি বলেই মরিয়মকে তার শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে আজও। সব পুরুষই সমান। ওরা চায় শুধু ভোগ করতে। প্রেমের কোন মূল্যই নেই ওদের কাছে। আর এই দেহটাকে পাবার জন্য কত রকম অভিনয়ই না করতে পারে ওরা।

গলির মাথায় রিক্সাটাকে বিদায় দিয়ে দিলো মরিয়ম।

এ পথটা হেঁটে যেতে হবে তাকে।

অন্ধকার গলিতে বিজলী বাতির প্রসার এখনো হয় নি। কয়েকটা কেরোসিনের বাতি আছে। টিমটিম করে সেগুলো জ্বলে। তাও সব সময় নয়। মাঝে মাঝে দুষ্ট্র ছেলেরা ঢিল মেরে চিমনিগুলো ভেঙ্গে দেয়। তখন অন্ধকারে ডুবে থাকে গলিটা।

বাঁ হাতে শাড়িটা গুটিয়ে নিয়ে আবর্জনার স্তুপগুলি এড়িয়ে সাবধানে এগুতে লাগলো মরিয়ম। দুপাশে জীর্ণ দালানগুলোতে এর মধ্যে ঘুমের আয়োজন চলছে। সামনের বারান্দায় বসে কেউ কেউ গল্প করছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সুর করে পড়ার আওয়াজও আসছে এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে। বুড়োদের সাংসারিক আলাপ-আলোচনা। আদেশ-উপদেশ। আশাআকাজক্ষার অভিব্যক্তিগুলোও গলি বেয়ে হাঁটতে গেলে সহজেই কানে আসে।

বাসার কাছাকাছি আসতে ও পাশের দোতলা বাড়ি থেকে ঝপ্‌ করে এক বালতি পানি কে যেন ঢেলে দিলো মরিয়মের গায়ে। সর্বাঙ্গ ভিজে গেলো। প্রথম কয়েক মুহূর্ত একেবারে হকচকিয়ে গেলো মরিয়ম। মুখ তুলে উপরের দিকে তাকাতে দেখলো, যে পানি ফেললো সে এইমাত্র মুখখানা সরিয়ে নিয়ে গেলো তার। এমনি প্রায় হয়। রাস্তায় কেউ আছে কি নেই দেখে না তারা। ময়লা আবর্জনা এমন কি বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের পায়খানাও জানালা গলিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। কারো মাথায় পড়লো কিনা লক্ষ্য নেই। রাগে সমস্ত দেহ জ্বালা করে উঠলো মরিয়মের। পরক্ষণে রীতিমত কান্না পেলো তার। সবে গতকাল শাড়িটা ধুয়ে পরেছে। কে জানে কিসের পানি। ভাবতে গিয়ে সারা দেহ রিরি করে উঠলো। মনে হলো সে এক্ষুণি বমি করবে।

ওকে দেখে হাসিনা হট্টগোল বাঁধিয়ে দিলো। একি আপা ভিজে চুপসে গেছিস যে? কি হয়েছে অ্যাঁ। উপর থেকে পানি ফেলেছে বুঝি, এ হে হে, কি নোংরা পানি গো। মেঝেতে থুথু ফেললো হাসিনা। ওমা, মা, দেখে যাও।

মরিয়ম স্যান্ডেলজোড়া দ্রুত খুলে রেখে কুয়োতলার দিকে যেতে যেতে বললো, আমার ছাপা শাড়িটা আর গামছাটা একটু দিয়ে যা হাসিনা।

মা নামাজ পড়ছিলেন।

বাবা হ্যারিকেনের আলোয় বসে খোকনকে পড়াচ্ছিলেন। ‘হুমায়ুনের মৃত্যুর পর আকবর দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন।’ হাসিনার চিৎকার শুনে এবং মরিয়মের সাবান নিয়ে কুয়োতলার দিকে তাড়াহুড়া করে চলে যেতে দেখে বই থেকে মুখ তুলে তাকালেন তিনি, কি হয়েছে অ্যাঁ। কী হয়েছে? মরিয়ম কিছু বললো না।

শাড়ি আর গামছা হাতে চাপা আক্রোশে পাড়ার লোকদের যমের বাড়ি পাঠাতে পাঠাতে একটু পরে এ ঘরে এল হাসিনা।

হাসমত আলী আবার মুখ তুললেন, বই থেকে, কি হয়েছে অ্যাঁ?

হাসিনা মুখ বিকৃত করে বললো, আপার গায়ে কারা নোংরা পানি ঢেলে দিয়েছে।

কারা ঢাললো কোথায় ঢাললো? হাসমত আলী ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। হাসিনা কুয়োতলায় শাড়ি আর গামছাটা রেখে এসে বললো, আপা আসছিলো, উপর থেকে কারা এক বালতি পানি ঢেলে দিয়েছে ওর গায়ে।

হাসমত আলী শুনে বললেন, চোখ বন্ধ করে হাঁটে নাকি, দেখে হাঁটতে পারে না।

তোমার যত বেয়াড়া কথা। নামাজের সালাম ফিরিয়ে সালেহা বিবি বললেন, উপর থেকে যারা ময়লা পানি ফেলে তাদের চোখ কি কানা হয়েছে? তারা মানুষ দেখে না? খোদা কি তাদের চোখ দেয় নি?

স্ত্রীর কথায় প্রতিবাদ না করে চুপ হয়ে গেলেন হাসমত আলী। একটুকাল নীরব থেকে সালেহা বিবি বাকি নামাজটা শেষ করবার জন্যে নিয়ত বাধলেন। সহজে ঘটনাটার ইতি করে দিয়ে হাসিনা শান্তি পাচ্ছিলো না। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এসে পাশের বাড়ির বউটিকে ডেকে সব কিছু শোনালো সে। আপা আসছিলেন হঠাৎ তার মাথায় এক বালতি ময়লা পানি ঢেলে দিয়েছে কে। আল্লা করুক, যে হাতে পানি ঢেলেছে সে হাতে কুষ্ঠ হোক তার, কুষ্ঠ হয়ে মরুক।

উত্তরে, পাশের বাড়ির বউটি জানালো–কিছুদিন আগে তার ছোট দেবর আসছিলো এমনি রাতে, তার মাথার উপর একরাশ ছাই ফেলে দিয়েছিলো। লোকগুলো সব ইয়ে–।

নিচে এসে হাসিনা দেখলো মরিয়ম স্নান সেরে ফিরে এসেছে। বসে বসে চুলে চিরুনি বুলাচ্ছে সে। সামনে টেবিলের ওপর তিনখানা দশ টাকার নোট। দেখে চোখজোড়া বড় বড় করে ফেললো হাসিনা। তারপর ছোঁ মেরে নোটগুলো তুলে নিয়ে বললো, তুই বুঝি আজ টাকা পেয়েছিস আপা? আমাকে লিলি আপার মত একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে, নইলে আমি এগুলো আর দেবো না,–সত্যি দেবো না বলছি, কিনে দিবি কিনা বল না আপা। দুহাতে মরিয়মকে জড়িয়ে ধরলো হাসিনা। মরিয়ম বললো, এখন না, স্কুলের চাকরিটা যদি পেয়ে যাই তাহলে কিনে দেবো, কথা দিলাম।

তার কোন ঠিক-ঠিকানা আছে? অনিশ্চয়-নির্ভর হতে রাজী হলো না হাসিনা। কবে যে চাকরি হবে–হয় কি না তাই কে জানে। শাড়ি যদি না কিসে দিস, একটা ব্লাউজ পিস কিনে দিবি বল?

মরিয়ম কথা দিলো, একটা ব্লাউজ-পিস সে কিনে দেবে। আশ্বস্ত হয়ে টাকাগুলো ফিরিয়ে দিতে রাজী হলো হাসিনা। কিন্তু তক্ষুণি দিলো না, ওগুলো কিছুক্ষণ থাকে ওর কাছে। হাতে নিয়ে, আঁচলে বেঁধে ব্লাউজের মধ্যে রেখে এবং আবার বের করে নানাভাবে নোটগুলোর উষ্ণতা অনুভব করলো সে।

ভাত খেতে বসে সালেহা বিবি বললেন, দে ওগুলো ট্রাঙ্কে রেখে দি, তোর কোন ঠিক আছে, কোথায় হারিয়ে ফেলবি। দে এদিকে।

এক লোকমা ভাত মুখে তুলে দিয়ে হাসিনা সরোষ দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে, তারপর নীরবে ভাতগুলো চিবোতে লাগলো।

গোল হয়ে তারা বসেছিলো খেতে। বুড়ো হাসমত আলী, আর তার দুই মেয়ে মরিয়ম আর হাসিনা। সালেহা বিবিও খাচ্ছিলেন এবং পরিবেশন করছিলেন সকলকে। খোকন আর দুলু খেয়েদেয়ে অনেক আগে শুয়ে পড়েছে। মাহমুদ রোজ সন্ধ্যায় বেরিয়ে যায় ডিউটিতে, ফেরে সেই ভোর রাতে। আজ তার অফ-ডে। তবু রাত এগারোটার আগে ফিরবে না সে। অফিসে, রেস্তোঁরায় বন্ধুদের বাড়িতে আড্ডা দিয়ে তবে ফিরবে বাসায়। খাবারটা ওর ঘরে ঢেকে রেখে দেন সালেহা বিবি। ফিরে এসে খেয়ে ঘুমোয় মাহমুদ।

মরিয়মের পাতে এক চামচ ঝোল পরিবেশন করে সালেহা বিবি বললেন, কাল গিয়ে একখানা শাড়ি কিনে এনো নিজের জন্যে। একটা বাড়তি শাড়ি নেই–।

মরিয়ম কিছু বলবার আগে হাসিনা জবাব দিলো, আর আমার জন্যে একটা ব্লাউজ-পিস।

সালেহা বিবি ধমকে উঠলেন, ওসব বাজে আবদার করো না।

হাসিনা সরোষ দৃষ্টিতে আরেকবার তাকালো মায়ের দিকে।

হাসমত আলী এতক্ষণ নীরবে ভাত খাচ্ছিলেন, সামনের দুটো দাঁত পড়ে গেছে বহু আগে, উপর পাটির দাঁতগুলো বড় নড়বড়ে, যে-কোন মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে, তাই কতার সাথে ভাত খান খুব আস্তে আস্তে। দাঁতের ফাঁকে আটকে-যাওয়া একটা সরু কাঁটা আঙুল দিয়ে বের করে নিয়ে হাসমত আলী বললেন, তোমার স্কুলের চাকরিটার কি হলো?

কথাটি মরিয়মকে উদ্দেশ্য করে।

মুখের কাছে তুলে আনা হাতের গ্লাসটা থালার ওপর নামিয়ে রেখে বাবার দিকে চালো মরিয়ম। বাবার প্রশ্নটা যেন ঠিক বুঝতে পারে নি সে।

ওকে চুপ থাকতে দেখে হাসিনা বললো, তোর স্কুলের চাকরিটার কি হলো জিজ্ঞেস করছেন বাবা। এতক্ষণ কি ভাবছিলি আপা?

মরিয়ম অপ্রতিভ গলায় জবাব দিলো, তিন-চার দিনের মধ্যে জানা যাবে। বলে ভাতের থালায় মুখ নামালো সে। এতক্ষণ সেই অবাঞ্ছিত ঘটনাটির কথা ভাবছিলো মরিয়ম। সত্যি মনসুরের সঙ্গে অমন বিশ্রী ব্যবহার না করলেই ভালো হতো। কে জানে, লোকটার হয়তো কোন অসৎ উদ্দেশ্য ছিলো না। নেইও। মরিয়ম মিছামিছি সন্দেহ করছে তাকেই নিজের অশোভনতার জন্যে মনে মনে লজ্জিত হলো সে।

খাওয়া হলে পরে, রোজ এঁটো থালা-বাসনগুলো ধুয়ে-মুছে গুছিয়ে রাখার কাজে মাকে সহায়তা করে মরিয়ম।

সালেহা বিবি মেয়ে-ভাগ্যে সুখ অনুভব করলেও মাঝে মাঝে বাধা দিয়ে বলেন, থাক না, এগুলো আমিই করবো, তুই ঘরে যা।

মরিয়ম বলে, তুমি সারাদিন খাটো মা, তুমি যাও। ওগুলো আমি গুছিয়ে রাখবো।

আনন্দে মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সালেহা বিবির। মেয়ে তাঁর দুঃখ কষ্ট বোঝে। তাঁর শ্রমের স্বীকৃতি দেয়। এতেই তাঁর আনন্দ। তারা সুখী হোক। মা-বাবাকে সন্তুষ্ট রাখুক, এই চান তিনি। আর বেশি কিছু নয়।

খেয়েদেয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলো মরিয়ম।

হাসিনা বসে বসে পড়ছিলো, নিচে মাদুর পেতে। বুকের নিচে একটা বালিশ রেখে আড় হয়ে শুয়ে পড়ে সে। পড়ার ফাঁকে, মাঝে মাঝে একটু ঘুমিয়ে নেয়। জেগে আবার পড়ে। আবার ঘুমোয়। এ তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে।

এ জন্যে ওকে ধমকায় মরিয়ম। আজও ধমকালো, ও কী হচ্ছে, উঠে সিধে হয়ে বসে পড়। শুয়ে শুয়ে পড়তে নেই ক’দিন বলেছি তোমায়?

বই থেকে মুখ না তুলেই হাসিনা জবাব দিলো, আমার যেভাবে ভালো লাগবে সেভাবে পড়বো, তোমার তাতে কি?

মরিয়ম বললো, এভাবে পড়লে বুকে ব্যথা করবে।

করুক, তাতে তোমার কি? বইটা বন্ধ করে রেখে একটু ঘুমিয়ে নেবার জন্যে বালিশে মাথা রাখলো হাসিনা। মরিয়ম কী যেন বলতে যাচ্ছিলো। দুয়ারে কড়া নাড়ার শব্দ হতে কথাটা আর বললো না উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।

মাহমুদ এসেছে বাইরে থেকে বগলে কতকগুলো বই। হাতে একটা কাগজের মোড়ক। মোড়কটা ওর হাতে তুলে দিয়ে মাহমুদ বললো, নাও, এটা তোমাদের জন্যে এনেছি।

মরিয়ম সকৌতুকে তাকিয়ে বললো, এর মধ্যে কী?

কী, তা আলোতে নিয়ে গিয়ে দেখতে পাচ্ছো না? বিরক্ত গলায় জবাব দিলো মাহমুদ। যাও একটা বাতি নিয়ে এসো চটপট করে।

ওঘর থেকে সব শুনতে পেয়ে বাতি হাতে দৌড়ে এলো হাসিনা, কি এনেছেরে আপা, দেখি দেখি।

দাঁড়াও দেখবে, অমন আদেখলেপনা করো না। এসব ভালো লাগে না আমার।

নিজের ঘরে এসে বইগুলো মেঝেতে নামিয়ে রাখলো মাহমুদ। তার ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই। একটা কাপড় রাখার আলনাও নয়। মেঝেতে পাশাপাশি তিনটে মোটা মাদুর বিছানো। এক পাশে তার স্তুপীকৃত খবরের কাগজ। তায়ে তায়ে রাখা। বাকি তিন পাশে শুধু বই, মাঝখানে ওর শোবার বিছানা। বিছানা বলতে একটা সতরঞ্জি, একটা চাদর আর একটা বালিশ।

মরিয়মের হাত থেকে মোড়কটা নিয়ে ওদের বসতে বললো মাহমুদ। নিজেও বসলো। তারপর আস্তে করে বললো, এর ভেতরে কী আছে তা দেখবার আগে তোমাদের কিছু বলতে চাই আমি।

হাসিনা ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, বলো।

মরিয়ম গম্ভীর।

মাহমুদ ওদের দুজনের দিকে ক্ষণকাল স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে বললো, দুর্ঘটনাবশত হোক আর যেমন করেই হোক, তোমরা আমার বোন। তাই নয় কি?

হাসিনা আঁচলে মুখ টিপে বললো, হ্যাঁ।

মরিয়ম কিছু বললো না। নীরবে মাথা নাড়লো।

মাহমুদ আবার বললো, তোমাদের প্রতি আমার একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে, তা বিশ্বাস করো?

দুজনে ঘাড় নোয়ালো ওরা। হ্যাঁ।

মোড়কটা খুলতে খুলতে মাহমুদ বললো, তোমাদের জন্য কিছু চুলের ফিতা আর মাথার কাটা এনেছি আমি। দেখো পছন্দ হয় কিনা?

ফিতাজোড়া মাহমুদের হাত থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে হাসিনা বললো, কি সুন্দর নাচতে নাচতে মাকে দেখাবার জন্যে নিয়ে গেলো সে।

মরিয়ম উঠলো, মাহমুদ বললো, বসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।

মরিয়ম বললো, তুমি ভাত খাবে না?

না, এক বন্ধুর বাসা থেকে খেয়ে এসেছি আমি। মাথা নেড়ে ওকে নিষেধ করলো মাহমুদ। তোমার সঙ্গে যে মেয়েটি আজ এসেছিলো সে কে জানতে পারি কি? অবশ্য তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে।

মরিয়ম বললো, ওর নাম লিলি, আমার সঙ্গে পড়তো কলেজে।

মাহমুদ বললো, থাক তার নাম আমি জানতে চাই নি। জানতে চেয়েছিলাম ওর সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কি, জেনে খুশি হলাম।

সহসা দুজন ওরা নীরব হয়ে গেলো। পাশের ঘর থেকে মা, বাবা আর হাসিনার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মৌনতা ভেঙ্গে মাহমুদ বললো, তুমি কি করবে ঠিক করেছো?

মরিয়ম বললো, এখনো কিছু ঠিক করি নি, দেখি স্কুলের চাকরিটার কি হয়।

মাহমুদ বললো, তোমার বান্ধবী লিলি না কি নাম বললে, সে কি করে শুনি?

মরিয়ম দাদার দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো, সেও একটা চাকরির খোঁজে আছে।

হুঁ। মাহমুদ ক্ষণকাল চুপ থেকে বললো, যাও, এখন ঘুমোবো আমি।

কাগজে মোড়ানো চুলের কাটাগুলো তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলো মরিয়ম। ও চলে গেলে একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো মাহমুদ। হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা হ্যারিকেনটা নিভিয়ে দিলো সে।

এখন সমস্ত ঘরটা অন্ধকারে ঢাকা।

চারপাশে তাকালে এই অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।

সিগারেটের মাথায় শুধু এক টুকরো আলো। বিড়ালের চোখের মত জ্বলছে। ভাষা নামক মানুষের আদিম প্রবৃত্তিও বোধ হয় চিরন্তন এমনি করে জ্বলে। পাশ ফিরে শুয়ে মাহমুদ ভাবলো। প্রধান সম্পাদক আজ কথা দিয়েছেন, আসছে মাস থেকে দশ টাকা বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হবে তার। যদি তিনি তার কথা রাখেন তাহলে, এই বাড়তি দশ টাকা প্রতি মাসে ভাই বোনদের জন্যে খরচ করবে মাহমুদ। আর যদি ছলনার নামান্তর হয়, তাহলে?

আর ভাবতে ভালো লাগে না মাহমুদের। সিগারেটটা অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু সহসা তার ঘুম আসে না। সহস্ৰ চিন্তা এসে মনের কোণে ভিড় জমায়। মাঝে মাঝে মনে হয় রোজ রাতে এমনি এমনি ভাবনার জাল বুনতে বুনতে হয়তো জীবনটা একদিন শেষ হয়ে যাবে তার। জ্বলে জ্বলে ক্ষয়ে যাওয়া মোমবাতির মত ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাবে সবকিছু।

নিউজ সেকশনের লম্বা ঘরটা এখন চোখের ওপর ভাসে।

অনেক আশা নিয়ে একদিন ‘মিলন’ পত্রিকায় চাকরি নিয়েছিলো মাহমুদ। সাব-এডিটরের চাকরি। মাসে পঞ্চাশ টাকা বেতন। অর্থের চেয়ে আদর্শ সাংবাদিক হওয়ার বাসনাই ছিলো প্রবল। কালে কালে একদিন লুই ফিশার হবে।

শুনে সিনিয়ার সাব-এডিটর আমজাদ হোসেন শব্দ করে হেসে উঠেছিলেন সেদিন। লুই ফিশার হবে? বেশ বেশ। অতি উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বটে। বছর খানেক কাজ করো। তারপর লুই ফিশার কি চিংড়ি ফিশার দুটোর একটা নিশ্চয় হতে পারবে।

বুড়োটার ওপর চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছিলো মাহমুদের। গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছিলো তাকে।

আহা, শুধু শুধু বেচারাকে অমন হতাশ করে দিচ্ছেন কেন?

আরেকজন বলেছিলো, টেবিলের ওপাশ থেকে।

তারপর।

তারপর আর ভাবতে পারে না মাহমুদ। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

সকালে ঘুম ভাঙতে মুখ-হাত ধুয়ে বাইরে বেরুবে বলে ভাবছিলো মাহমুদ। এক টুকরো পাউরুটি আর এক কাপ চা এনে ওর সামনে নামিয়ে রেখে সালেহা বিবি বললেন, তুই কি বেরুবি এখন?

হ্যাঁ, দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা জামা নাবিয়ে নিয়ে মাহমুদ বললো, আমায় একটা কাজে যেতে হবে।

খানিকক্ষণ ইতস্তত করে সালেহা বিবি বললেন, তোর বাবার শরীরটা আজ ভালো নেই। বাজারটা একটু দিয়ে যা।

মাহমুদ কোন জবাব দিলো না তার কথার। যেন শুনতে পায় নি এমনি ভাব করে নীরবে পাউরুটির টুকরোটা ছিঁড়ে খেতে লাগলো সে। মা আবার বললেন, কিরে কিছু বলছিস না। যে? টাকা আনবো?

‘না।’ মাহমুদ নির্বিকারভাবে জবাব দিলো, আমার কাজ আছে বললাম তো।

কোনদিন তোর কাজ না থাকে? সালেহা বিবি গভীর হয়ে গেলেন। বুড়োটা রোজ বাজার করে এনে খাওয়ায়, এ বুড়ো বয়সে তাকে কষ্ট দিতে লজ্জা হয় না তোদের?

রুটির টুকরোটা পিরিচের উপর নামিয়ে রেখে মাহমুদ বললো, আর আমি আহ্লাদে ঘুরে বেড়াই তাই না মা? রাতের পর রাত যে আমায় তোমাদের জন্য জেগে কাজ করতে হয় তার কোন মূল্য নেই, না? চায়ের পেয়ালাটা সামনে থেকে সরিয়ে দিলো মাহমুদ। রুটির পিরচটাও দূরে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।

রাগে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেলো সালেহা বিবির। উষ্ণ গলায় তিনি জবাব দিলেন, তুই সারারাত জেগে কাজ করিস আর বুড়োটা কি বসে খায়? সারা জীবনে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে রোজগার করে এনে খাইয়েছেন।

হয়েছে, এবার থামো তুমি মা। জামাটা গায়ে দিতে দিতে জবাব দিলো মাহমুদ, ও কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। তবু রোজ এক বার শোনাবে তুমি।

ওকি, চা-টা কি অপরাধ করলো? খেয়ে নে না। ওটা। বাজারের প্রসঙ্গ ভুলে গিয়ে ছেলেকে চা খাওয়ানোর প্রতি লক্ষ্য দিলেন সালেহা বিবি। ওকি, চলে যাচ্ছিস কেনো, চা-টা খেয়ে যা।

থাক, ওটা তুমি খাওগে।। হনহন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো মাহমুদ। ও চলে যেতে ক্ষোভে দুঃখে চোখ ফেটে কান্না এলো সালেহা বিবির। আঁচলে চোখ মুছে ব্যথা জড়ানো স্বরে নিজেকে ধিক্কার দিলেন তিনি, কোন দুঃখে পেটে ধরেছিলাম তোদের।

কথাটা কানে এলো হাসমত আলীর। ও ঘর থেকে গলা উচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?

স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনে নীরব হয়ে গেলেন সালেহা বিবি। এসব কথা স্বামীকে জানতে দিতে চান না। তিনি। তাহলে তিনি মনে আঘাত পাবেন। হাসমত আলীও কোন উত্তর না পেয়ে চুপ করে গেলেন।

মরিয়ম এসে বললো, একটু পরে আমি বাইরে বেরুবো মা। বাজারের টাকাটা দিয়ে দিও।

মা অবাক হয়ে বললেন, তুই যাবি?

মরিয়ম বললো, তাতে কিছু এসে যাবে না, খোকনকে সঙ্গে দিও।

হাসমত আলী এতক্ষণ মা-মেয়ের আলাপ শুনছিলেন, শেষ হলে বললেন, ও কেন, আমি যাবো বাজারে।

সালেহা বিবি বললেন, তোমার শরীর খারাপ লাগছে, বলেছিলে না?

ও, কিছু না। আস্তে আস্তে জবাব দিলো হাসমত আলী।

 

ঘর থেকে সেই যে হন হন করে বেরিয়ে এলো মাহমুদ, তারপর অনেকপথ মাড়িয়ে এ গলি ও গলি পেরিয়ে, বিশ্রামাগারের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। দুটো বাই লেন এসে যেখানে মিলেছে তারই সামনে একটি ছোট্ট রেস্তোরাঁ। ভেতরে ঢুকতে কেরোসিন কাঠের কাউন্টারের ওপার থেকে ম্যানেজার খোদাবক্স বলে উঠলো, ইয়ে হয়েছে মাহমুদ সাহেব, আজকের খবরের কাগজ পড়েছেন?

কোণের টেবিলে তিনটে ছেলে গোল হয়ে বসেছিলো, তাদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মাহমুদ জবাব দিলো, না, আজকের কাগজ তো আমি পড়িনি। ওর গলার স্বরটা রুক্ষ।

খোদাবক্স বুঝতে পারলো আজ মেজাজটা ভাল নেই ওর। তাই গলাটা আরো একটু মোলায়েম করে বললো, একটা ভালো চাকরির বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে আজ।

মাহমুদ কিছু বলার আগেই বাকি তিনজন একসঙ্গে কথা বলে উঠলো, তাই নাকি, দেখি দেখি পত্রিকাটা।

কোলের ওপর থেকে পত্রিকাটা নিয়ে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিলো খোদাবক্স। তার খদ্দেরদের বেকারত্ব ঘুচুক, তারা ভালো চাকরি পাক এটা সে আন্তরিকভাবে কামনা করে। অবশ্য ভালো চাকরি পেলে হয়তো এ রেস্তোরাঁয় আর আসবে না, অভিজাত রেস্তোরাঁয় গিয়ে চা খাবে। এদিক থেকে ওদের হারাবার ভয়ও আছে খোদাবক্সের। কিন্তু বাকি টাকাগুলো ওদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে, এই তার সান্ত্বনা। তাছাড়া ভালো চাকরি পেলেই যে ওরা তাকে ত্যাগ করবে সেটা ভাবাও ভুল। হাজার হােক চক্ষু লজ্জা বলে একটা প্রবৃত্তি আছে মানুষের। দুর্দিনে ওদের বাকিতে খাইয়েছে খোদাবক্স, সে কথা কি এত সহজে ভুলে যাবে ওরা? অবশ্য না-ছেড়ে যাবার আরেকটা কারণ আছে।

সেটা হলো শ’খানেক হাত দূরের মেয়ে-স্কুলের ওই লাল দালানটা। ওখানকার সব খবরই রাখে খোদাবক্স। কোন মেয়েটি বিবাহিতা, আর কোনটি কুমারী। কোন মেয়েটির বাবা বড় চাকুরে আর কোনটির বাবা কেরানী। সব খবর রাখে খোদাবক্স। উৎসাহী খদ্দেরদের পরিবেশন করে সে। তাদের অতৃপ্ত আত্মাকে তৃপ্ত করে।

পত্রিকাটি মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো। তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর বিছিয়ে চারজন এক সঙ্গে ঝুঁকে পড়লো ওরা।

একটা প্ৰাইভেট ফার্মে পার্সেনাল এ্যাসিস্টেন্টের চাকরি।

মাসে দেড়শ টাকা বেতন।

খোদাবক্সের কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে, নাম-ঠিকানা টুকে নিল মাহমুদ।

খোদাবক্স একগাল হেসে বললো, কেমন বলি নি, খুব ভালো চাকরি?

মাহমুদ বললো, হবে না, শুধু শুধু কাগজ-কালি খরচ করা।

রফিক বললো, তবু দেখা যাক না একবার কপাল ঠুকে।

নঈম বড় রোগাটে, চেহারাখানাও তার বড় ভালো নয়, বললো, আমার মুখ দেখেই ব্যাটারা বিদায় করে দেবে।

খোদাবক্স বললো, সব খোদার ইচ্ছে, চারজন একসঙ্গে চেষ্টা করে দেখুন না–একজনের হয়েও যেতে পারে।

এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে মাহমুদ চুপচাপ পত্রিকার পাতা ওল্টাতে লাগলো। চা খাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ এখানে বসে থাকবে সে। এটা সেটা নিয়ে তর্ক করবে। আর মাঝে মাঝে একটু অন্যমনস্ক হয়ে ভাববে, আশা নামক প্রবৃত্তিটি কত দুৰ্দমনীয়। পুরো একটা বছর ‘মিলন’ পত্রিকার চাকরি করার পর আশার ক্ষীণ অস্তিত্বও লোপ পাওয়া উচিত ছিলো। তবু এখনো যে কেমন করে তার রেশ জেগে আছে মনে, ভেবে বিস্মিত হয় মাহমুদ। লুই ফিশার হওয়ার কল্পনায় যে-একদিন বিভোর ছিলো। সে আজ আর তেমনি স্বপ্ন দেখতে পারে না।

প্রাত্যহিক ঘটনার অভিজ্ঞতায় স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে তার।

একদিনের কথা মনে পড়ে। সেদিন রাতে ডিউটি ছিলো তার। নিউজ সেকশনের লম্বা টেবিলটায় সকলে কর্মব্যস্ত। এ সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলি পৌঁছায় এসে। তাই কাজের ভিড় বেড়ে যায়। হাতের কাছে একটা ছোট্ট সংবাদ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো মাহমুদ। পঁচিশ বছরের একজন শিক্ষিত যুবক বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। খবরটা কি ছাপতে দিবো? নিউজ এডিটরের দিকে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ।

কাগজটা হাতে নিয়ে খবরটা পড়লেন নিউজ এডিটর। তারপর ওটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বললেন, বাদ দিন, স্পেস নেই।

কেন স্পেস তো অনেক আছে! কথাটা হঠাৎ বলে ফেললো মাহমুদ।

সরোষ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে নিউজ এডিটর গম্ভীর গলায় বললেন, স্পেস আছে কি নেই সেটা আপনার জানবার কথা নয়।

তারপর নীরব হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায়। ছিলো না তার। এমনি ঘটনা প্ৰায়ই ঘটতো।

একদিন কোন একটা জনসভায় লোক সমাবেশ নিয়ে তর্ক বেধে গেলো স্টাফ রিপোর্টারের সঙ্গে।

রিপোর্টার বলছিলেন, সভায় পাঁচহাজারের বেশি লোক হয় নি। মাহমুদ বললো, মিথ্যে কথা। পঞ্চাশ হাজারের উপরে এসেছিলো লোক।

রিপোর্টার বললেন, আপনি চোখে বেশি দেখেন।

মাহমুদ বললো, আমি যদি বেশি দেখে থাকি আপনি তাহলে কম দেখেন।

কম দেখতে হয় বলেই দেখি। দুঠোঁটে এক টুকরো হাসি ছড়িয়ে চুপ করে গেলেন স্টাফ রিপোর্টার।

সিনিয়র সাব-এডিটর আমজাদ হােসেন এতক্ষণ নীরবে ঝগড়া শুনছিলেন। ওদের। দুজনে থামলে একটা পান মুখে পুরে দিয়ে বললেন, মাহমুদ সাহেব এখনো একেবারে বাচ্চা রয়ে গেছেন আপনি। লোক যে কেমন করে বাড়ে আর কেমন করে কমে তার কিছুই বোঝেন না–বলে শব্দ করে এক প্রস্থ হেসে উঠলেন তিনি।

বয় এসে সামনে চা নামিয়ে রাখতে ভাবনায় ছেদ পড়লো।

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মাহমুদ বললো, তুমিও ঘাবড়িয়ো না খোদাবক্স, সামনের মাস থেকে দশ টাকা বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হবে আমার, তার থেকে কিছু কিছু করে এক বছরে সব পাওনা পরিশোধ করে দেবো তোমার। বুঝলে?

খোদাবক্স একমুখ হেসে বললো, তাই নাকি? বড় ভালো কথা, বড় ভালো কথা, শুনে বড় খুশি হলাম।

নঈম বললো, এর পরে আমাদের এক কাপ করে চা খাওয়ান উচিত তোমার মাহমুদ।

মাহমুদ নির্বিকার গলায় বললো, ‘খাও’ বলে বয়কে ওদের তিন কাপ চা দেবার জন্যে আদেশ করলো সে। খোদাবক্সকেও এক কাপ দিতে বললো। বয় চা নিয়ে এলে পর সামনে ঝুঁকে পড়ে মাহমুদ বললো, দশ টাকা যদি বাড়ে আমার, তাহলে রোজ একটা করে সিগারেট খাওয়াবো তোমাদের।

নঈম খুশি হয়ে বললো, আমার যদি এ চাকরিটা হয়ে যায়, তাহলে রোজ এক কাপ করে চা খাওয়াবো।

রফিক কিছু বললো না। ও একটু অন্যমনস্ক আজ।

তাহলে এ চাকরিটার জন্য তুমি দরখাস্ত করছাে? মাহমুদ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।

হ্যাঁ। তুমিও করো। নঈম জবাব দিলো।

রফিক উঠে যাচ্ছিলো। নঈম চেঁচিয়ে উঠলো, ওকি যাচ্ছে কোথায়, বসো।

রফিক বললো, আর কতো বসবো? বোধ হয় আসবে না আজ।

মাহমুদ জিজ্ঞেস করবে ভাবছিলো, সে কে?

নঈম বললো, আরেকটু বসো, এই এসে পড়বে আজ বোধ হয় ঘোড়ার গাড়িটা কোথাও আটকে পড়েছে; কে জানে হয়তো রেলওয়ে ক্রসিং-এর ওখানে হবে।

মাহমুদ এতক্ষণে বুঝলো একটি মেয়ের অপেক্ষা করছে রফিক। ঘোড়ার গাড়িতে করে আসবে মেয়েটি। এখান থেকে রফিক দেখবে তাকে। শুধু চোখের দেখা।

মেয়ের কথা উঠতে খোদাবক্স বললো, আপনাকে কত করে বলেছিলাম মাহমুদ সাহেব, সেই মেয়েটার সঙ্গে ঝুলে পড়ুন, তাহলে কি আজকে আপনার এই অবস্থা হতো? এতদিনে হ্যাট-টাই পরে মোটর গাড়ি হাঁকতেন।

তার দিকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানলো মাহমুদ। কিছু বললো না। নঈম বললো, হ্যাঁ, তাইতো আজকাল যে মেয়েটিকে আর দেখি নে তো, বিয়ে হয়ে গেছে বুঝি?

খোদাবক্স মুখখান বিকৃত করে বললো, বিয়ে হয়ে যাবে না তো কী? ওরা হলো বড় লোকের মেয়ে, বড় মহাৰ্য বস্তু। ও কি ফেলনা যে পড়ে থাকবে? কত ছেলে লাইন বেঁধে থাকে বিয়ে করার জন্য।

হয়েছেও তাই। এইতো গেলো মাসে মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। ছেলেটির বড় জোড় বরাত, বিয়ের কিছুদিন পরেই স্কলারশিপ বাগিয়ে আমেরিকায় চলে গেছে।

নঈম প্রশ্ন করলো, আর সে মেয়েটি?

মেয়েটিকে কি রেখে যাবে নাকি? খোদাবক্স জবাব দিলো, সঙ্গে করে নিয়ে গেছে আমেরিকায়।

পত্রিকার উপর ঝুঁকে পড়ে মাহমুদ একটা খবর পড়ায় মনোযোগী হবার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতে মন বসাতেই পারলো না সে। কাগজটা মুড়ে রেখে অনেকটা বিরক্তির সাথে উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর আকস্মিক ভাবে ‘চলি’ বলে বিশ্রামাগার থেকে বেরিয়ে এলো মাহমুদ। বেরুবার পথে সে শুনতে পেলো নঈম বলছে–আহা, যাবে আর কি, বসো না। ঘোড়ার গাড়িটা আসতে আজ বড় দেরি হচ্ছে, এসে পড়বে এক্ষুণি। বসো, আরেক কাপ চা খাও।

বুঝতে কষ্ট হলো না মাহমুদের, রফিককে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছে নঈম।

 

বিশ্রামাগার থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে ভাবছিলো মাহমুদ, পেছনে কে যেন নাম ধরে ডাকলো। ফিরে তাকিয়ে দেখে শাহাদাত দাঁড়িয়ে।

পরনে একটা পায়জামা, গায়ে পাঞ্জাবি আর হাতে গুটিকয় বই।

কিহে, এখানে কোথায় এসেছিলে?

পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হতে মনটা ভালো হয়ে গেলো মাহমুদের।

শাহাদাত বললো, প্রেসের কিছু টাকা পাওনা ছিলো একজনের কাছে। দু-বছর আগের টাকা, হেঁটে হেঁটে সারা হলুম, আজ দেবো কাল দেবো করে ব্যাটা শুধু ঘুরাচ্ছে আমায়।

মাহমুদ গম্ভীর হয়ে বললো, বাকি দাও কেন?

শাহাদাত বললো, আগে কয়েকটা কাজ করিয়েছিলো তাই দিয়েছি।

হুঁ। মাহমুদ চুপ করে গেলো।

খানিকক্ষণ পর শাহাদাত আবার বললো, তুমি তো, আজকাল আর ওদিকে আসো না, আমেনা প্রায়ই তোমার কথা জিজ্ঞেস করে। আসো না একদিন।

মাহমুদ বললো, আসবো।

শাহাদাত শুধালো, কবে?

মাহমুদ বললো, সে দেখা যাবে পরে। এসো তোমাকে এক কাপ চা খাওয়াই।

পুরোনো বন্ধুকে সাথে নিয়ে আবার বিশ্রামাগারে ফিরে এলো মাহমুদ।

কোণের একখানা টেবিলে এসে দুজনে বসলো ওরা।

নঈম আর রফিক ঝুঁকে পড়ে নিজেদের মধ্যে কি যেন আলাপ করছে। খোদাবক্স কাউন্টার থেকে মুখ তুলে মাহমুদকে এবং বিশেষ করে শাহাদাতকে লক্ষ্য করলো, উৎসুক চোখে। নতুন খদ্দের। এর আগে কখনো দেখে নি তাকে।

এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলো মাহমুদ।

শাহাদাত বললো, তুমি খাবে না?

না। এই একটু আগে এক কাপ খেয়ে বেরিয়েছি।

পকেট হাতড়ে বিড়ি আছে কিনা দেখলো মাহমুদ। বিড়ি নেই। মুখখানা গুমোট করে বসে রইলো সে।

শাহাদাত শুধালো, কি হয়েছে?

মাহমুদ বললো, না, কিছু না। চুপ করে কেন, কথা বলো, ছেলে-মেয়েরা সব কেমন আছে?

ওদের কথা আর বলে না, হতাশ গলায় বললো শাহাদাত, বড়টার পেটের অসুখ আর ছোটটা সর্দি-কাশিতে ভুগছে।

হুঁ। টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে হাতের তালুতে মুখ রাখলে মাহমুদ। বয় এসে সামনে চা নামিয়ে রাখতে বললো, নাও, চা খাও।

শাহাদাত নীরবে চা খেতে লাগলো।

মাহমুদ চুপচাপ।