আগুনপাখি by হাসান আজিজুল হক, chapter name আমার একটি খোঁকা হলো

আমার একটি খোঁকা হলো

বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার একটি খোঁকা হলো। সি দিনই লিকিনি দোপরবেলায় এক কড়াই দুধ উথুলে পড়ে গেয়েছিল। গাই দুয়ে এনে জ্বাল দেবার লেগে দুধ চুলোয় বসিয়েছিল। কেউ আর খেয়াল করে নাই, আঁতুড়ঘরে আমাকে আর লতুন খোঁকাকে নিয়েই সবাই বেস্ত ছিল। এই ফাঁকে সেই উজ্জ্বলন্ত দুধ সব উথুলে উঠে কড়াই থেকে পড়ে গেল। তাই দেখে আমাদের বুবু, সেই বেধবা ননদ হায় হায় করে উঠলে শাশুড়ি শুদু বললে, দুধ নষ্ট হয়েছে হয়েছে। কেউ কোনো কথা বোলো না। বাড়িতে নতুন মানুষ এল— এ সোংসারের পেথম খোঁকা— আর দুধ উথুলে পড়ে গেল! এ বডড সুখের কথা। এবার সোংসারে ধন-দৌলত, সুখ আনন্দও উথুলে পড়বে। তোমরা কেউ এই নিয়ে আর কথা বোলো না।

তা কথা সত্যি বটে— বংশের পেথম ছেলে— লতুন ঝাড়ের গোড়াপত্তন। পেথম ছেলে পেথম লাতিন। আনন্দে সবাই ভাসতে লাগল। ই ছেলে যেন একা আমার ছেলে লয়। কত্তা ত মনেই করলে না যি তার ছেলে হয়েছে। উ ছেলে তো সবারই, ই বংশের ছেলে। মা বলে আমার খাতির বাড়ল, শাশুড়ি আড়লে আবডালে সবার কাছে বলতে লাগল, ঐ মেজবউ সোংসারের লক্ষ্মী, ঐ বউটি আসা থেকে সোংসারের বাড়-বাড়ন্ত শুরু হয়েছে। খুব পয়া আমাদের বউ। তা আমার খাতির আর আদর বাড়ল বটে, তা বলে খোঁকাকে একা আগুলে রাখতে পারলম না। সে হলো সবার চোখের মণি। ঘুরেফিরে সবাই এসে খালি তাকে দেখতে চায়। খোঁকাটি আমার শামলা, বাপের রঙ পেয়েছিল, ছেয়ালো ছেয়ালো হাত-পা, ডাগর ডাগর চোখ, ফুলের পাপড়ির মতুন ঠোঁট। সি যি কি সোন্দর! এমন ছেলের মুখ একবার দেখতে পেলে মায়ের এক লাখ বছর দুনিয়ায় বাঁচা হয়ে যায়। সবাই বলতে লাগল আসমান থেকে এক ফালি চাঁদ নেমে এয়েছে আমার কোলে। বড়ও হতে লাগল চাঁদের মতুন। আজ একটু, কাল একটু। আজ এটু আলো দেখি মুখে, কাল দেখি চোখে।।

দিন যায়, দিনের পর দিন যায়, দিন গড়িয়ে মাস যায়, মাস গড়িয়ে বছর যায়। সোংসার কের্‌মে কের্‌মে বড় হতে লাগল। সেজ দ্যাওরের বিয়ে হয়ে গেল। বাড়িতে লতুন বউ এল। তাপর একদিন শ্যাষ ননদটিরও বিয়ে হলো মাহা ধুমধাম করে। বিয়ে হলো দশ কোশ দূরের এক গাঁয়ে। সি ঘরও খুব আবস্তাপন্ন।

দু-একটো কষ্টের কথা সব মানুষেরই থাকে। আমারও কি ছিল না? ছিল বৈকি? পিতিকার হোক আর না হোক বলতে পারলে তো মনটা এটু খোলসা হয়। তা কাকে বলব? ইসব কথা তো শাশুড়ি-ননদকে বলার লয়।হয়তো তাদের নিয়েই কথা, তাদের বলব কি করে? এক কত্তাকে বলা যায়। তা সে এমন লোক যি ছামনে দাঁড়ালেই মনে হয় ই লোককে ইসব কথা বলা যায় না। মনে হয়, আমার আবার আলাদা কথা কি, নিজের লেগে ইয়াকে আবার কি বলব? সারা দিনে তাকে দেখতেই প্যাতম না। দেখা হতো শুদু অ্যানেক রেতে। শাশুড়ি য্যাতোকাল ছিল আমি ছেলম ঠিক যেন লতুন বউ। এতগুলিন ছেলের মা হয়েও লতুন বউ।

তা আমি আমার কথা বলব কি, একদিন রেতে কত্তা হঠাৎ বললে, একটা কথা বলি শোনো। ছোটবেলায় পাঠশালায় যাও নাই যাও নাই। তা বলে কি চিরকাল মূর্খ হয়ে থাকবে? একটু লেখাপড়া শেখা কি খারাপ?

কথা শুনে আমি তো সাত হাত পানিতে, ই আবার কি কথা! অ্যাকন আবার আমি কি ল্যাখাপড়া শিখব?

লেখাপড়া শেখার কোনো বয়েস নাই। একটু পড়তে লিখতে শিখলেই বুঝতে পারবে দুনিয়া কেমন করে চলছে।

তা জেনে আমার কি হবে? সোংসারে খাটতে খাটতে জান গেল। জানি, এই করেই জেবন যাবে। এই বয়েসে আমি কি আবার বি.এ. এম.এ. পাশ দেব?

লেখাপড়া শিখতে গেলে বি.এ. এম.এ. পাশ দিতে হয় না। যাই হোক, আমি বই কিনে আনব, দেখবে কদিনের মধ্যেই অক্ষর শিখে যাবে।

উ অ্যাকন আর আমি পারব না।

পারতে তোমাকে হবেই।

কত্তার মুখ দেখে বুঝতে পারলম, উ মানুষ যা করবে ঠিক করে, তা নিয়ে চ্যাঁচামেচি করে না, ভেতরে ভেতরেই ঠিক করে। আমি চুপ করে থাকলম। একটু বাদে কত্তা আস্তে আস্তে শ্যাষ কথাটো বললে, আলো আর আঁধারের যে তফাত— অক্ষর জানা আর না-জানা মানুষের মধ্যে ঠিক সেই তফাত।

কি আতাস্তরে যি পড়লম! কত্তা আমাকে কি বেপদের মদ্যে ফেললে! কিন্তুক সি মানুষকে যে চেনে নাই, সে চেনে নাই। একদিন ঠিকই আনলে বিদ্যেসাগরের বন্নপরিচয়ের পেথম ভাগ, একটো সেলেট আর পেনসিল। কত্তা এটুন শৌখিন ছিল, সারা বাড়িতে রেতে জ্বলত পিদিম আর লন্ঠন, কত্তার ঘরে জ্বলত একটো হেরিকেন। হেরিকেনের ত্যাকন অ্যানেক দাম। কত্তার ঘরে ছিল একটো বিদ্যাশি দামি হেরিকেন। কেউ জানতে পারলে না, অ্যানেক রেতে সবাই। ঘুমিয়ে পড়লে ঘরের দরজা বন্ধ করে সেই হেরিকেনের আলোয় ল্যাখাপড়া শেখাতে লাগলে আমাকে। সারাদিনের খাটা-খাটনির পরে চোখ জড়িয়ে আসত ঘুমে, কিছুতেই জেগে থাকতে পারতম না। কিন্তুক কত্তার কুনো মায়া নাই, সি কি তার তর্জন-গর্জন! শোয়া-ছেলে তিকুরে তিকুরে উঠত।

খোঁকা যি জেগে উঠবে?

তা উঠুক। মাথায় কি আছে কি তোমার! অক্ষরটা কি চোখে দেখতেও পাচ্ছ না? পেনসিল হাতে বসে আছ, হাত কি ঘুরছে না স্নেটের ওপর?

কি জানি মাথা কেমন গোলমাল লাগছে। বুঝতে পারছি, ঘুম আসছে। যাও, ওঠো, চোখে পানি দিয়ে এসো, নাহলে চোখে দু-ফোটা রেড়ির তেল দাও, ঘুম চলে যাবে।

বললে কেউ পেত্যয় যাবে না, ইকটু ইদিক-উদিক হলে মায়া-দয়া তো করতই না, বোকা গাধা মাথায়-গোবর ইসব বলে গাল তো দিতই, চুলের গোছ ধরে টান, কানের লতিতে একটা মোচড়, ইসবও ছিল। একদিন তো গালে ঠোনা মেরে হাত ধরে টেনে তুললে। সি কি রাগ বাপরে বাপ, যাও বেরিয়ে যাও ঘর থেকে, কখনো আসবে না এদিকে। একটা সামান্য কথা মাথায় ঢুকছে না তখন থেকে! যাও, বেরিয়ে যাও, দরকার নাই লেখাপড়ার।

কি  আর করি
, ঘর থেকে বেরিয়ে যেয়ে দুয়োরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলম। খানিক বাদে নিজেই আবার এসে ঘরে নিয়ে যেয়ে বললে,

যাও, শুয়ে পড়ো, আজ আর পড়তে হবে না।

হুঁ, এমনি করে আমি পড়তে শিখেছেলম। বিদ্যেসাগরের আ আ ক খ বইয়ের পিতিটি অক্ষর আমার চোখের পানিতে ভেজা বলে চোখ বুজলেই সেইসব অক্ষর দেখতে পাই। কালো কালো যত ছবি ছিল বইয়ে সব মনে পড়ে। অ্যাকনো সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে বুকের ভেতরটো হু হু করে। দু-মাসের মাথায় পড়তে লিখতে শেখা হয়ে গেল। পেথম পেথম বানান করে করে, পরে এমনিতে সব পড়তে পারতম। বাড়িতে ‘বঙ্গবাসী’ বলে একটো কাগজ আসত পোস্টাপিস থেকে। ভালো বুঝতে না পারলেও সেটো কখনো-সখনো পড়তম। কিন্তুক সবই লুকিয়ে লুকিয়ে। বাড়ির কেউ কিছু জানত না। কত্তা কিন্তুক কিছু বারণ করে নাই। তবে ননদ-শাশুড়িকে ইসব বলতে আমারই কেমন শরম লাগত।

আমাদের সোংসারের লেগে সেই সোমায়টো ছিল উঠতির সোমায়। সব সোংসারে এমন হয়। একটো উঠতির সোমায় আর একটো পড়তির সোমায়। শ্বশুরের মিত্যুর পর সোংসারে খারাপ দিন এয়েছিল। শ্বশুর গত হবার সাথে সাথে ভাই ভায়াদেরা সব সোংসার আলেদা করে নিলে। সবাই ভিনো হয়ে গেল। ঐ যি শ্বশুর অ্যানেক বিষয়সম্পত্তি লষ্ট করে ফেলেছিল, সেই লেগে সম্পত্তি ভাগ হবার সোমায়ে ভাইয়েরা নিজের নিজের সম্পত্তি পুষিয়ে নিলে। আমার বেধবা শাশুড়ির ভাগে পড়ল খুবই কম জমি। কিন্তুক তার ভাগে পড়েছিল সব ধনের সেরা ধন— এক পুতুর। সিরকম ধন থাকতে আবার ভাবনা! শুদু একটো ভয়, ইরকম ধন কারুর একার লয়, এমনকি শুদু একটো সোংসারেরও লয়। মায়ের তেমন পুত্তুর গোটা চাকলার। আমার শাশুড়ি সি কথাটো বুঝেই তবে দুনিয়া থেকে গেয়েছে।

কেমন করে সোংসারের উন্নতি-বরকতের অরম্বটো হলো সি কথাটা ইবার বলছি। আমার বিয়ের সোমায় বাপজি গয়না-গাটি যা দেবার তা দিয়েছিল। ত্যাকুনি জানা গেয়েছিল আমার সেই দাদি— বাপজির খালা— মরবার আগে আমার নামে তার সব জমি— ষোলে বিঘে জমি– লিখে দিয়ে গেয়েছিল। দাদির তিন কুলে কেউ ছিল না সি কথা আগে বলেছি, সেই লেগে সম্পত্তিটো নিয়ে কুনে হ্যাঙ্গামা-ফৈজত হয় নাই। বিয়ের পরে-পরেই ঐ সম্পত্তিটো বিক্রি করে দিয়ে কত্তা নিজেদের গাঁয়ের মাঠে পঁচিশ বিঘে জমি কিনলে। আমার নামে কিনেছিল, না সোংসারের সাজার করে দিয়েছিল ঐ জমি, আমি আজও জানি না। সবই তো শাশুড়ির সোংসারের – আমার তোমার কি? এই ছিল শিক্ষে। গোড়াতেই জেনে গেয়েছেলম কত্তার ছামনে কুনো জিনিস নিয়ে আমার আমার করা যাবে না। একবার কি একটো নিয়ে এইরকম আমার আমার করে কথা বলতে যেনে দেখেছেলম, কত্তা একদিষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে। মনে হলো, ই মানুষ আমাকে চেনে না, এখুনি হাত ধরে ঘর থেকে বার করে দেবে। সেই আমার চেরকালের লেগে শিক্ষে হয়ে গেল।

বারে বারে কত্তা কত্তা করছি, তা বলে কেউ যেন না মনে করে যি কত্তা বি.এ. এম.এ. পাশ দিয়েছিল। আমার শ্বশুর লিকিনি খুব ল্যাখাপড়া-জানা আলেম মানুষ ছিল। কিন্তুক কত্তা কোথা থেকে কি শিখেছিল আমি জানি না। আমাকে কুনোদিন বলে নাই। ক-বছর লিকিনি বাড়ি ছেড়ে বিবাগী হয়ে গেয়েছিল, নদী পেরিয়ে পুবের কুন। গাঁয়ে কুন এক পীরবাবার কাছে ফারসি পড়ত। এই গপ্পো অ্যানেকবার শুনেছি। তবে সিসব ডানপিটেমির গপ্পো, ল্যাখাপড়ার কথা লয়। যা-ই হোক, আমার খালি মনে হতো, এই মানুষ জানে না এমন কিছু কি ভূভারতে আছে? এই সোমায় সে গাঁয়ের ইশকুলে ছেলে পড়াইত। সেটো চাকরি ছিল কি না জানি না, পড়াইত এই জানি আর কত্তামার ছোট ছোট ছেলেদুটিকে লিয়ম ধরে পড়তে বসাইত।

একদিন দেখি বাড়ির ভেতরে এসে মায়ের সঙ্গে কি নিয়ে কথা বলচে। এমনিতে কিছুতেই বাড়ির ভেতরে ঢুকত না, থাকত তো বাইরের একটো ঘরে। বাড়ির ভেতরে এলে বুঝতে হতো গুরুতর কুনো কথা আছে। তা মায়ের সাথে কথা বলচে, আমাদের কারুর কাছে যাবার হুকুম নাই। দূর থেকে দেখছি, ছেলে কিসব বলচে আর মা খালি ঘাড় নেড়ে নেড়ে বলচে, না বাবা, তা হয় না। তা কোরো না। কি যি কথা হলো কিছুই বোঝলম না। বোঝলম রেতে। হেঁশেলের কাজকম্ম সেরে শেকল তুলে বাইরের ঘরে য্যাকন অ্যালম, কত্তা দেখলম ত্যাকনো বিছেনায় শোয় নাই। বসে আছে। খোঁকা তার বিছেনায় অসানে ঘুমুইছে। খুব ঘেমেছে দেখছি গলার কাছটোয় ভিজে গেয়েছে। ঠান্ডা লাগবে না কি হবে- আঁচল দিয়ে ঘামটো মুছিয়ে দিচি ত্যাকন কত্তা বললে, শোনো, কথা আছে। গলার স্বর খুব মোলায়েম। কথা কত্তা এমন করে তো বলে না। এটু অবাক হয়ে কাছে যেয়ে বসলম। কত্তা বললে, জীবনে সুযোগ দুর্যোগ দুই-ই আছে। সব সময় সুযোগ আসে না, আর সুযোগ আসে যেমন আচমকা, তেমনি চলেও যায় আচমকা। তা একটা সুযোগ এসেছে। পঁচিশ-তিরিশ বিঘে জমি একলাটে আছে। কদিন বাদে সেটা নিলাম হবে। রায়েদের জমি।

রায়েরা আবার কারা?

 

রায়েরা এ গাঁয়ের জমিদার। ওদের রবরবা আমাদের ছেলেবেলায় একআধটু দেখেছি, তবে আমাদের বাপচাচারা আরও ভালো জানত। এখন অবস্থা খুব পড়ে এসেছে। খেতে জোটে না। তাদেরই পঁচিশ-তিরিশ বিঘে জমি নিলাম হবে- ন-কড়ায় ছ-কড়ায় বিকিয়ে যাবে।

তা উ নিয়ে আমাদের কি ভাবনা? আমরা কি উদের কুনো উবগারে লাগব?

কথা শোনো, আমাদের এত বড় সোংসার, টেনে চলা খুব কঠিন। বাপজি তো সব প্রায় শেষ করে দিয়ে চলে গিয়েছে। নিলামটা ধরতে পারলে কাজ হয়। রায়েদের জন্যে খারাপ লাগছে খুব, হাতি খাদে পড়েছে। মানুষের দুর্দিনের সুযোগ নিতে নাই আমি জানি কিন্তু রায়েরা কিছুতেই এ জমি রক্ষা করতে পারবে না। আমি না নিলে আর কেউ নেবে।

কথা কটি বলে কত্তা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে। আমি তো অবাক- জমি নিতে হলে নাও গা— আমাকে শুদুবার কি আছে? আমি সঙ্গে সঙ্গে বললম, ই তো খুব ভালো কথা, নিলেম ডেকে নিতে পারলে সোংসারের লেগে খুব ভালো হয়। আমাকে আবার ই কথা শুদুইছ ক্যানে?

নিলাম তো আর খালি হাতে ডাকা যায় না? টাকা লাগবে না? অত টাকা কোথা থেকে পাব? কাচা টাকা আমার হাতে নাই। সংসারে। কারও কাছে একটি পয়সা নাই। পয়সাকড়ি যা থাকে আমার কাছেই থাকে। খোরাকির বাইরে ধান যা আছে তা বিক্রি করে আর কতো টাকা পাওয়া যাবে? বলে কত্তা আবার আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলে। আমি ফের অবাক, টাকাপয়সার কথা আমার কাছে ক্যানে? উ বিষয়ে তো আমি কিছুই জানি না। আমিও কত্তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকলম। -

টাকার কথা আমি কি বলব? আমার এই কথার পরে কত্তা এতক্ষণ বাদে আসল কথাটি বললে,

দ্যাখো, গয়না তুমি অনেক পেয়েছ, বাপের বাড়ি থেকে পেয়েছ, কত্তামার কাছ থেকেও পেয়েছ। কি হবে গয়না নিয়ে? কবার পরবে ঐ ভারী গয়না? একটু বয়েস হলে হয়তো আর কোনোদিন পরবে না। ঐ ওজনের লোহা বাড়িতে লুকিয়ে রেখে দিয়ে ভাবলেই হলো গয়না সবই আছে? একই কথা হলো না?

কথা শুনে আমি বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে আছি। দু-একটা পরার মতো গয়না রেখে দিয়ে সংসারের এমন একটা কাজে বাকি গয়নাগুলো দিয়ে দিলে কি হবে তোমার? সবাই জানবে সংসার গড়ে তুলতে কোন এক পরের বাড়ির মেয়ে এই মেজ বউ-ই এত বড় কাজ করেছে!

কত্তার কথা শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এল। এত নিষ্ঠুর, হায়রে এত কঠিন জান আমার সোয়ামির? কলজেটা ছিঁড়ে নিলেও তো এত কষ্ট হতো না। মেয়েমানুষের গয়না ছাড়া আর কি আছে! স্বামী চলে গেলেও গয়না থাকবে। আমার সেই গয়না অ্যাকন সব কেড়ে নেবে? চোখ-ভরা পানি নিয়ে কত্তার মুখের দিকে চেয়ে দেখতে গ্যালম, ঝাপসায় কিছুই দেখতে প্যালম না। তবে আমি এই ভবসংসারে কার ঠেয়ে যেয়ে দাঁড়াব? শুনতে প্যালম কত্তা বলছে, কেঁদো না। তুমি না দিলে গয়না আমি তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেব না। তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি মেয়েমানুষের কাছে গয়না কি! সন্তান গেলেও তারা গয়না ছাড়বে না।

কত্তার এই শেষ কথাটো যেন আগুনের ছ্যাকা দিয়ে আমার কলজেটো পুড়িয়ে দিলে। ই কি কথা, ই কি কথা, হায় হায়! চোখের পানি ত্যাকন ত্যাকনই শুকিয়ে গেল। একবার ঘুমনো ছেলের দিকে তাকালম, বালাইষাট, আমি হাজারবার লাখবার মরি তোর জানের লেগে! একবার কত্তার দিকে তাকালম। হেরিকেনের আলোয় অ্যাকন তার মুখটো দেখতে পেছি। দেখি কি, সি মুখে এটুও রাগরোষ নাই। আমার দিকে চেয়ে রয়েছে যে চোখদুটি তাতে কি যে ভরসা। তাই বটে, তাই বটে, মেয়েমানুষ এইরকমই বটে, নিরুপায়। আমি বললম, গয়না সব নিয়ে যাও। আমি মন খোলসা করে বলছি একটি গয়নাও আমি রাখতে চাই না।

না না, মোটা কঙ্কণ দুটো রেখে দাও। নিজে না পরো, ছেলের যখন বউ হবে, তাকে দিয়ে দিয়ো।

সেই রেতেই একটি একটি করে সমস্ত গয়নাগাটি পুটলিতে বেঁধে কত্তার হাতে তুলে দেলম। কদিন বাদেই জানতে পারলম, রায়েদের কাছ থেকে তিরিশ বিঘে জমি নিলেমে কেনা হয়েছে। কত্তা টাকা কি করে জোগাড় করেছিল সি আমি জানি না— গয়না বিক্রি করেছিল, না বন্দক রেখেছিল তা আর কুনোদিন শুদুই নাই তাকে। এমন মানুষ, যিদিন নিলেমে জমি পাওয়া গেল, সিদিন বাড়িতে ঢুকে পেথম মাকেই ডেকে বললে, মা, সংসারের আরও তিরিশ বিঘে জমি হলো।

এই পেথম দেখলম আমার শাশুড়ি এগিয়ে যেয়ে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললে, চিরজীবী হও বাবা, আল্লা তোমার হায়াত দারাজ করুক। এই বলে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলে। অথচ রেতে য্যাকন ঘরে গ্যালম কত্তা শুধু বললে, শুনেছ তো, নিলাম ডাকা হয়ে গিয়েছে? হিসেব করে ত্যাকন দেখলম দাদির ঠেঁয়ে পাওয়া আমার ষোলো বিঘে জমি, শ্বশুরের জমি, আর এই নিলেমের জমি একঠাই করলে পেরায় আশি-নববুই বিঘে জমি সোংসারের হয়েছে। গাঁয়ে এত জমি আর কারও নাই। সবারই সাধারণ আবস্তা। মোসলমানপাড়ায় দশ-পনেরো বিঘের বেশি জমি কারুর নাই। হিঁদুপাড়াতেও তাই, খুব বেশি হলে দু-চারজনার চল্লিশ-পঞ্চাশ বা ষাট বিঘে। মাহারাজার যে দুটি আত্মীয় ই গাঁয়ে আছে, তাদের জমি এট্টু বেশি বটে, তবু ষাট-সত্তর বিঘের বেশি হবে না। ইসব কথা কত্তার কাছেই শোনা। মন হলে কখনো কখনো ইসব কথা বলত।

কত্তাকে সারা জেবনে কুনোদিন নেশা করতে দেখি নাই। শখ করে কুনো সোমায় পান খেতে দেখেছি। তেমন সময়ে ফরসি হুকো টানতেও দেখেছি। খেত না, খেত না, য্যাকন খেত, ত্যাকন খুব আয়েশ করেই খেত। দামি অম্বুরি তামুক আনাত, পানের লেগে কিমাম কিনত। দেখে মনে হতো, এই বুঝি কত্তা পান ধরলে কিম্বা তামুক ধরলে। কিন্তুক এসব দু-মাস তিন মাস। তাপর তামুক হঠাৎ ছেড়ে দিলে, ফরসি হুকোটোও কোথা পড়ে থাকল। এমনি আজব মানুষ! তবে ইকথা বলব, য্যাকন পান ধরত কিম্বা হুঁকো খেত, মেজাজটো খুব শরিফ থাকত। কথা যা ঐরকম সোমায়েই বলত বেশি।

রায়েদের জমি যি কত্তা নিলেমে কিনে নিয়েছিল, তাতে আমার মনটো খুব খচখচ করত। মাঝে মাঝে মনে হত কত্তাও বোধায় এই নিয়ে আমাকে দুটো কথা বলতে চায়। কাজটো সে করেছে বটে, কিন্তু সি যেন নেহাত বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে বলেই করেছে। কথাটো এই যি জমি কি রায়েদের থাকত আমরা নিলেম না ডাকলে? কত্তা একদিন এমন করে রায়েদের কথা বললে তাতে মনে হলো যেন কেচ্ছা শুনছি। ফরসি টানতে টানতে শুরু করলে, এ গাঁয়ে মিদার যদি কেউ থাকে, তাহলে সে রায়েরা। এরা উচু বংশ, বামুন বংশ। গাঁয়ের আদ্দেকটার মালিক ছিল ওরাই। যেমন উচু মন, তেমনিই বেহিসাবি খরুচে। খাওয়া-পরায় সবই উড়িয়ে দিত। কিন্তু এদের কেউই মেজাজি ছিল না। সবাই বড় ঠান্ডা মানুষ। যে যা চাইত, ধরে বসত, দিয়ে দিত। এই করতে করতে সব শেষ করে দিলে। ছেলেপুলেরা কেউ গাঁ ছাড়লে না, লেখাপড়া শিখলে না, চোখের সামনে দেখলাম পঁচিশত্রিশ বছরের মধ্যে সব শেষ করে দিয়ে ফতুর হয়ে গেল। জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর অনেকেই এখন গাঁ ছেড়ে চলে গিয়েছে, ছেলেদের কেউ কেউ কলকাতা-টলকাতা গিয়ে বাড়ির চাকর বা রাধুনি-বামুনের কাজ করছে। ভিটেমাটি পড়ে আছে, সাপ-খোপ বাসা করেছে। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পাকা বাড়ি-ঘর, পুজোর মন্দির। ছাদ ফাটিয়ে বট-পাকুড় গাছ উঠেছে। বেনা ঘাস, গোয়াল-লতা, কন্টিকারির জঙ্গলে কাছে যাবার উপায় নাই। এই তো অবস্থা! দেখবে আর দুদিন বাদে ছোট রায় বুলি হাতে ভিক্ষে করতে বেরুবে। জমিগুলি আমি কিনলাম, খুবই খারাপ লাগে বটে তবে নিয়তি ঢুকেছে বংশে। মানুষের সংসারে নিয়মই এই উঠতে উঠতে আকাশে ঠেকবে মাথা, তারপরে পড়তে পড়তে একদিন মাটিতেই আশ্রয়। এ হবেই— সব বংশেই হয়। নিয়তির পথ কেউ বন্ধ করতে পারবে না।

আস্তে আস্তে ফরসি টানতে টানতে ইসব কথা একদিন কত্তা বলেছিল আমাকে। কথা বলতে পারত বটে মানুষটো, অমন আর কোথাও শুনি নাই। ইসব কথা চেরকালের লেগে মাথার ভেতরে ঢুকে গেল : দেখো, কদিনের মধ্যেই জমির টাকা খেয়ে ফুরিয়ে দেবে রায়েদের ছোট তরফ, বড় বড় আইবুড়ো মেয়েদের বিয়ে পর্যন্ত হবে না!

ঠিকই তাই, কদিন বাদেই শোনলম, ছোট রায় তাদের বেরাট বাড়িটো ভেঙে সেগুনকাঠের কড়ি-বরগা, নোকশা-করা কাঠের সাজ আর আর যা কিছু আছে নকড়ায়-ছকড়ায় বিকিয়ে দিচে। সব ঘর ভেঙে দিয়ে একপাশে মাত্তর একটি ঘর রেখে সেখানে বাস করবে, এগ্‌নের এক কোণে রান্নার লেগে বানিয়ে নেবে একটো ছোট চালাঘর। যাকগো, ই বাড়ি থেকে রায়েদের বাড়ির আর একটিও জিনিশ কেনা হলো না।