সোংসার সুখ-দুখের দুই সুতোয় বোনা বই-তো লয়
বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার খোঁকা হয়েছিল। তাপর আট বছরের মধ্যে আমাদের সোংসারে আর কুনো ছেলেপুলে হয় নাই। ভাশুরের বিয়ে কত্তার বিয়ের ক-বছর আগেই হয়েছিল। পেথম পেথম মনে হতো, বড় বউয়ের ছেলেমেয়ে হতে একটু সোমায় লাগছে। তা-পর এক বছর যায়, দু-বছর যায়, তিন বছর যায়, য্যাকন ছেলেপুলে হলো না, ত্যাকন বোঝা গেল উয়াদের আর সস্তান হবে না। ওষুধ-পত্তর করা হয়েছিল বৈকি। কিন্তুক কের্মে কের্মে সবাই আশা ছেড়ে দিলে। বড় বউ তাইলে বাঁজা। আর বড়কত্তা, আমার আলাভুলো ভাশুর, উ নিয়ে কুনোদিনই মাথা ঘামাইলে না। সে তো সোংসারের কুনো কিছুতেই থাকত না!
সেজ দ্যাওরের বিয়েটো হলো অ্যানেক পরে। তার বিয়ের বয়েস পেরিয়ে গেয়েছিল। তবে এট্টু দেরি হলেও কত্তাই উদ্যুগ করে বিয়ে দিলে। কিন্তুক বিয়ের তিন-চার বছর পরেও তার ছেলেপুলে কিছু হলো না। সেই লেগেই বলছেলম আট বছর ধরে সোংসারে ছেলে বলতে আমার ঐ খোঁকা। তা এই আবস্তায় সে আর একা আমার খোঁকা হয়ে ক্যানে থাকবে? সে হলো সবার চোখের মণি— জানের জান। একা সোংসারে দিন দিন ছিরিবৃদ্ধি। সবাই মনে করতে লাগল ঐ খোঁকাই এত সুখের মূল। তাকে নিয়ে কি যে করবে সি আর কেউ খুঁজে পেত না। সবকিছুতে আগে বড় খোঁকার কথা। বাড়িতে মন্ডা মিঠাই এলে বড় খোঁকা কই? যে য্যাকন বাইরে যেচে, কিছু একটো হাতে করে আনছে বড় খোঁকার লেগে। কত্তাই বরঞ্চ খোঁকার দিকে তেমন নজর দেয় না। সে হয়তো সোমায়ই পায় না। হয়তো ভাবত, ছেলে তো সবারই, আমি না দেখলেই বা কি, দেখার লোকের কি অভাব? ছোট বুনটির তাতোদিনে বিয়ে হয়ে গেয়েছিল বটে, তবে তারপরের ছোট ভাই দুটির ত্যাকনো বিয়ে হয় নাই। এই ল আর ছোট দ্যাওর দুটি আমার দুটি ভাই-ই ছিল, যা বলতম তা-ই শুনত আর খোঁকাকে খানিকক্ষণ না দেখলেই চোখে যেন আঁদার দেখত। এই করতে করতে আট বছর কেটে গেল। কি আচ্চয্যি মা, চোখের ছামনে আমার শামলা রঙের খোঁকা আট বছরেরটি হয়ে গেল। কি তার চোখে মায়া কি তার, মুখে লাজুক হাসি! সি আর কুনোদিন দেখলম না! ঠিক সোমায়ে তার হাতেখড়ি হলো। কত্তা নিজেই হাতেখড়ি দিলে। এই সোমায়ে, কি করে আমার মনে নাই, গাঁয়ে এক ওস্তাদজি এল। তাকে গায়ে আনা হলো, নাকি সে নিজেই এল, অ্যাকন আর বলতে পারব না। তার কাজ হলো খোঁকাকেই পড়ানো। গাঁয়ে, মোসলমান পাড়ায় তো পড়ার মতুন আর একটি ছেলেও ছিল না। কত্তা মাটির পাঁচির দিয়ে ঘেরা একটো বড় ভিটে কিনেছিল। একটি মাত্তর ছোট মেটে ঘর ছিল সিখানে, তাতে কুনো জানেলা নাই। আলকাতরা মাখানো একটিমাত্র দরজা ছিল। সেই ঘরে হলো ওস্তাদজির আস্তানা আর মোটে একজনা পোড়ো আমার খোঁকা। সবাই বলত কালা ওস্তাদজি, কানে সে কিছুই শুনতে পেত না। ভারি ভালো লোক, তিন-বেলা তার খাবার যেত আমাদের বাড়ি থেকে।
খোঁকার জন্মের চার বছর পর আমার একটো সত্তান লষ্ট হলো। সে-ও খোঁকা ছিল। পেট থেকে মরাই জন্মাইছিল। কে আর কি করবে? দু-দিন বাড়িটো থম ধরে থাকল, শুদু শাশুড়িকে মুখ ফুটে আহাজারি করতে শুনেছেলম। ত্যাকন দুনিয়া ফাঁকা ছিল, গভ্ভো লষ্ট হলে সবারই খুব গায়ে বাজত। ই ক্যানে হলো, ই ক্যানে হলো, এমন দুৰ্দৈব ক্যানে- শাশুড়ির খালি এই আপসোস! ইদিকে ছেলে হতে যেয়ে আমার পেরায় সব রক্ত বেরিয়ে গেল, মরার মতুন হলোম। শরীর শুকিয়ে কাটি হলো। মরা ছেলের মুখটো একবারই দেখেছেলম। সি না দেখাই ভালো ছিল। সোমায়ের অনেক আগেই সে দুনিয়াতে আসতে চেয়েছিল। যিদিন বাড়িতে এই বেপদ ঘটে, সিদিন কত্তা বাড়িতে ছিল কি না মনে করতে পারছি না। বোধায় ছিল না। বাড়ির বউয়ের সন্তান হবে ই ছিল মেয়েলি বেপার, বাড়ির পুরুষদের ই নিয়ে নিয়ে কুনো ভাবনাই ছিল না। তাদের তো কিছু করার নাই। হাড়িবউ দাই ঠিক করা আছে, সি ব্যবস্থা বছরকাবারি। বছরের শেষে দাই একটো সিদে পায়, শাড়ি-কাপড় পায়, চাল-ডাল পায়, পারলে কেউ কেউ নগদ-ও কিছু দেয়। সস্তান হলেও দেয়, না হলেও দেয়। বছর শেষে চোত মাসের মদ্যেই দেয়। আর সন্তান হলে তো কথাই নাই, ত্যাকন অ্যানেক কিছুই পায়। বড়লোকের বাড়ি হলে সোনা-রুপোর গয়নাও পায়। আমার বড় খোঁকা হলে তার দাই সোনার মাকড়ি পেয়েছিল। যাকগো, কত্তা সিদিন ছিল কি ছিল না মনে নাই, এতটুকুনি মরা ছেলে ন্যাকড়ায় জড়িয়ে একপাশে রাখা হয়েছে। রেতে ফিরে কত্তা কি একবার দাঁড়িয়ে দেখলে? কি জানি! ডাক্তারবদ্যির কুনো কথাই ছিল না। তাই ভাবি, ছেলে মলো, মা-ও তো মরতে পারত! তাই যেদি হতো, তাইলে কত্তা কি করত? ব্যাটাছেলে আবার কি করবে? মায়ের কথা শুনে দিনকতক বাদে আবার বিয়ে করত। একটো ফল দিয়ে ফলগাছ মরে গেয়েছে, তা আবার তার পাশে আর একটো ফলগাছ লাগাতে হবে না? ইসব কথা অ্যাকন মনে হয়, ত্যাকন কিন্তুক মনে হয় নাই। কত্তার মুখটো কেমন হয়েছিল ত্যাকন দেখি নাই, পরেও কুনোদিন কত্তা ই নিয়ে কুনো কথা বলে নাই।
বেপদের ছেঁয়া কি চেরকাল থাকে? ই বাড়িতেও থাকল না। একদিন খবর পাওয়া গেল ছোট যে বুনটির বিয়ে হয়েছিল দশ কোশ দুরের এক গাঁয়ে, সেই বুনের একটি খোঁকা হয়েছে। যেদিও সি অন্য বংশের বেপার, তাদের বাড়িতে পেথম বংশধর এয়েছে, তবু মেয়ে তো ই বংশের! সেই লেগে ই বাড়ি আনন্দের সাগরে ভাসতে লাগল। কত্তা তার ছোট বুনদের কি চোখে দেখত সিকথা আগে বলেছি। বিশেষ, তার এই ছোট বুনটিকে ভারি ভালোবাসত! সোস্বাদ পেয়েই কতো কি সামিগ্রি দিয়ে ঝুড়ি বাঁক ভরে লোক রওনা করিয়ে দিলে আর নিজে ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটল ছোট বুনের বাড়ি। গাঁয়েই যে বড় বুনের বিয়ে হয়েছিল, তার ত্যাকন বেশ কটো ছেলেমেয়ে হয়েছে, দুটি ভাগ্নে তো ত্যাকন বেশ ডাগরই হয়েছে, তবু ভিনগাঁয়ে ছোট বুনের খোঁকা হবার খবরে কত্তা কি খুশি যি হলো সি আমার অ্যাকনো মনে পড়ে।
আস্তে আস্তে সব আবার আগের মতুন হলো। ছোট দুটি দ্যাওর অ্যাকন জোয়ান মরদ হয়ে উঠেছে। দুজনাই বড় স্কুলে পড়ছিল। সেজ-জনা তো ল্যাখাপড়া করলে না, আমার বিয়ের আগেই বোধায় স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। অ্যাকন দেখছি ল-দ্যাওরের-ও মতিগতি ভালো লয়, স্কুল মনে হয় ছেড়েই দেবে। কত্তার কাছে এসে মাথা নামিয়ে দাঁড়ায়, পায়ের নোখ দিয়ে মাটি খোঁড়ে আর ব্যাবসা-ট্যাবসা করা যায় কিনা ভয়ে ভয়ে ভাইকে সেই কথা শুদোয়। তবে ছোট দ্যাওরটি মন দিয়ে স্কুলে পড়ছে। আমার খোঁকাও কালা ওস্তাদজির কাছ থেকে ছাড়ান পেয়ে স্কুলে ভত্তি হবে হবে করছে। এই সোমায়ে য্যাকন সবারই মনে হছিল সোংসারে শিগগিরি আর কুনো ছেলেমেয়ে আসবে না, সেইরকম সোমায় আমারই আর একটি খোঁকা হলো। বড় খোঁকার বয়েস ত্যাকন আট বছর।
বড় খোঁকা ছিল শামলা, সি রঙ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত, জানে শান্তি হতো। গরমকালে গাছের ছেঁয়ায় বসার মতুন মনে হতো। আর ই লতুন খোঁকার রঙ হলো গোরো ধপধপে। বড় খোঁকা হলো ঠিক তার বাপের মতুন– কত্তার গাঁয়ের রঙ-ও ছিল শামলা— লতুন খোঁকা হলো তার মামার মতো।
তাইলে সোংসারে ত্যাকনো পয্যন্ত ছেলেপুলে বলতে হলো আমার দুটি খোঁকাই। সেই কালে ছেলেমেয়ে কমবেশি নিয়ে কেউ কিছু ভাবত না। চাকরি করে কাঁচা টাকা আয় করে সবকিছু কিনে খাওয়া তো ত্যাকন ছিল না। সবাই গাঁয়ে-ঘরে থাকে, বাইরে আর কে যেচে? বাড়ির খেচে, বাড়ির মাখছে। শুদু কি মানুষ? গরু ছাগল কুকুর বেড়াল সবারই হক আছে। বলতে গেলে এক থালাতেই সবাই খেচে। পগারে, জমিতে, ড্যাঙ্গায় যিখানে ঘাস হয়েছে, সি ঘাস দুটো ছাগলে খেলেও যা, দশটো ছাগলে খেলেও তা-ই। ঘাস কি ফুরিয়ে যেচে? সব্বারই গরুছাগলে সি ঘাস খেতে পারবে। বাড়িতে একটো ছেলে, না দুটো ছেলে, না দশটো ছেলে সি হিসেব ক্যানে করবে লোকে? খাক না সবাই মিলে যাতোক্ষণ আছে। তাই দেখতম পেরায় সব বাড়িতেই পাঁচটো-ছটো ছেলেমেয়ে আছেই। দশ-বারোটো, পনেরোটা পয্যন্ত ছেলেমেয়ে হতো কারু করু। তবু গাঁ-ঘর ফাকাই লাগত, অ্যাকনকার মতুন গিস্-গিস করত না।
লতুন খোঁকার জন্ম হলো বলে বাড়িতে তাই আনন্দ বাড়ল বই কমল না। শাশুড়ি ননদ আমাকে নিয়েই বড়াং করতে লাগল। তারা বলত মেতর-বউয়ের পয়েই সব হচে। আয়-সম্পত্তি বাড়ছে, আবার দ্যাখো ক্যানে, বংশও বাড়ছে।
এই করতে করতে দিন পেরুইচে, মাস পেরুইচে, বছর পেরুইচে, শ্যাষে দু-বছর গেলে, আমার পরের খোঁকাটি দু-বছরেরটি হলে, একদিন জানা গেল সেজ বউ বারদার। এই কথা জেনে আমার আনন্দ হলো সবচেয়ে বেশি। এতদিন পেরায়ই মনে হতো সবারই সব সুখ যেন আমি একাই কেড়ে নিয়েছি। সুখ যি ভাগ করে নিতে হয়! নিজের সুখ কম করে নিলে তবে সেই সুখ বাড়ে। আমি সেজ বউয়ের খুব আদর-যত্ন করতে লাগলম। অনেক কাজ আর আমি তাকে করতে দেতম না, নিজেই করতম। -
গাঁয়ের খাওয়াদাওয়া ত্যাকন খুব শাদামাটা, একইরকম খাবার-দাবার সব বাড়িতে। সেই ভাত ডাল তরিতরকারি। মাছ গোশ্তো খুব কম।। মাছ যেদি বা মিলত, গোশতো খাওয়া খুবই কম। হিঁদুরা বোধায় সারা বছরেও একদিন গোশতো খেত না। মোসলমানরা মুরগি পুষত বলে ডিম আর মুরগির গোশ্তোটো কখনো কখনো খেতে পেত। সেজ বউয়ের খাওয়াটো যাতে ওরই মদ্যে একটু ভালো হয়, আমি সেই চেষ্টা করতম। তবে সে খুব সামান্য। কারও লেগে, কুনো কারণে আলাদা খাবার-দাবারের কথা ত্যাকন কেউ ভাবত না। ছেলেমেয়ে হবে, না হবে, ভূ-ভারতে রাতদিন হচে, ইয়ার লেগে আবার হ্যানো লয় ত্যানো করতে হবে ক্যানে। সি যা-ই হোক, দুধ আর ডিমটো আমি আলাদা করে সেজ বউকে জোর করে খাওয়াতম। দশ মাস দশ দিনের মাথায়,– কে জানে দশ মাস, না ন-মাস- সবাই দশ মাস দশ দিনই বলত, তাই বলছি, দশ মাস দশ দিনের মাথায় সেজ বউয়ের একটো মোটাসোটা খোঁকা হলো। আপনাআপনিই হলো। দাইবউ এসে দেখে খোঁকা হয়ে গেয়েছে। মাটিতে পড়ে ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদচে।
আর কুনো পাওনা নাই, আঁতুড়ঘরে ঢুকতেও হলো না। ই ছেলে তোমাকে কি দাই-মা বলে ডাকবে?
কথা শুনে দাইবউ লথ নেড়ে নেড়ে কি হাসতেই না লাগল। ইয়ার পরের কথাটো এইখানেই বলে দিছি। সেজ বউ আর কুনো সোমায় নিলে না— পরের বছর, এক বছর হয়েছে কি হয় নাই, তার আর একটো খোঁকা হলো।