আকাল আর যুদ্ধুর দুনিয়ায় কেউ বাঁচবে না
কি ভায়ানক দিন এল! এমন খরানি বাপের জন্মে দেখেছি বলে মনে হয় না। আকাশের দিকে চাইলে চোখ পুড়ে যেচে, আসমানের নীল রঙ লাল হয়ে গেয়েছে। এক-একটো দিন যেন পাহাড়ের মতুন বুকে চেপে থাকছে— কিছুতেই পেরুইতে পারা যেচে না। সাথে আছে আবার যুদ্ধু আর আকাল। গেরস্তর নিত্যদিনের যা যা লাগে, তা যি শুদু আক্রা তাই লয়, পাওয়াই যেচে না। পেঁদনের কাপড়ের কথা আর কি বলব, সি তো পাওয়াই যেচে না। কেরাসিন নাই। কয়লার চুলো অ্যানেকদিন থেকেই বাড়িতে আছে, খুব ধুমো আর রান্নায় গন্ধ হয় বলে ঘসি আর কাঠের জ্বালটই ই বাড়িতে বেশি চলে। গাছ কেটে কেটে শ্যায, অ্যাকন গাছই পাওয়া যেচে কম। কয়লাটো এতদিন পাওয়াও যেছিল, দামেও শস্তা ছিল বলে কয়লা আনা হছিল এদানিং বেশি। সেই কয়লাও অ্যাকন আর পাওয়া যেচে না। নুন নাই, ট্যানাকাঠি নাই, চিনি নাই। চিনির অভাবে তেমন অসুবিধা হতো না, কারণ ই দিকের লোকে গুড়ই খায় বেশি। কিনতেও পাওয়া যায়, গাঁয়ের সালে নিজের নিজের সোংসারের গুড় তৈরিও হয়। ইবার কারুর বাড়িতে গুড় নাই, আমাদের বাড়িতেও নাই, অ্যাকন শুনছি মুদির দোকানেও নাই। যা বা এক-আধটু আছে গরিবের তা কিনে খাবার কুনো উপয় নাই, এমনি দাম! গাঁয়ের তিনটো মুদির দোকানের দুটো বন্ধ, কুনো জিনিশ আনতে পারছে না, দোকানে রাখতে পারছে না কুনো জিনিশ দামের চোটে। দোকান খোলা রেখে কি করবে? বাইরের জিনিশ– কাপড়, কেরাসিন, কয়লা, নুন, চিনি ইসব কোথাও নাই। আর আর সামিগ্রি— চাল, ডাল, খাবার তেল, মশলা, ইসব গেরস্তদের কিছু কিছু থাকলেও গরিব মানুষদের কোথা থেকে থাকবে? তাদের কিনেই খেতে হয় ইসব জিনিশ। পয়সা তো কুনোদিনই নাই গাঁয়ের মানুষের হাতে, রুপোর টাকা-আধুলি-সিকি গরিবরা চোখেই দেখে না। উসব আসবে কোথা থেকে? ধান বেচে, চাল বেচে, টাকা পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তুক বেচার মতুন ধান-চাল কজনার আছে! কুনোরকমে এট্টু ধান-চাল জোগাড় করতে পারলে লোকে তাই নিয়ে দোকানে যায়, ঐটি দোকানিকে দিয়ে মাপিয়ে দোকানিকে বিক্রি করে আধ পয়সার, সিকি পয়সার জিনিস কেনে। তবে সোংসার চলে। ইসব অ্যাকন বন্ধ। সব দাঁত টিপে ঘরে বসে আছে। রাঁধা-বাড়া, শখ-আল্লাদ সব গেয়েছে। যার খ্যামতা আছে, কুনোরকমে দুটো চাল ফুটিয়ে মাড়সুদ্দু খেচে, ছেলেপুলেকে খাওয়াচ্ছে। কি কষ্টের কথা, গরু-মোষের লেগে মাড় রেখে দিয়েছি— উ পাড়ার এক বউ সেই মাড় চেয়ে নিয়ে গেল। কি, না মেয়ে তিনটো না খেয়ে আছে! এটু মাড় খেয়েও প্যাট ঠান্ডা করার রাস্তা নাই। মাড়টুকুনি না পেলে— কেউ কেউ হয়তো তাও পায় নাই— সি বাড়িতে ছেলেমেয়ে নিয়ে সবাইকে উপোস করতে হবে। ওমা, আমার কি হবে? জেবনে যি এমন ভাতের আকাল দেখি নাই, শুনি নাই।
কার লেগে কি করব! অ্যাকন জষ্টিমাসের মোটে আধেক যেচে, সারা বর্ষা পড়ে আছে, তা বাদে শেরাবন ভাদরের আলেদা আকাল। আছে। ইদিকে ধান ছাড়া ফসল নাই, অঘ্ঘান মাসে দু-চারটি আউশ হয় বটে, সি কিছুই না। সবাই তা পায়ও না! আসল ফসল আমন ধান, সেই পোষ মাসে। ঐ-ই একমাত্তর সারা বছরের খোরাক আর ঐ বেচেই আর যা যা লাগে তার বেবস্তা করতে হয়! তাইলে এতগুলিন দিন কেমন করে পেরুবে মানুষ? আবার শুনছি শহরে চালের দাম দ্বিগুণ হয়েছে, কেনে হয়েছে কে জানে? সি লিকিনি ফাগুন-চোতেই হয়েছে। গাঁয়ে তেমন বোঝা যেত না বটে। বোঝা যাবেই বা ক্যানে, গাঁয়ে চালই নাই, তা দাম বাড়ল না কমল জেনে কি হবে? খুব ভয় লাগছে, খুব ভয় লাগছে।
আর হুজুগের শ্যাষ নাই। পেত্যেকদিন লতুন লতুন হুজুগ। যুদ্ধুর আবস্তা খুব খারাপ হচে। বিটিশরা অ্যাকন সব জায়গা থেকেই লিকিনি পালাইচে। আমাদের এই বেরাট দাশের লাগোয়া উদের আর একটো দ্যাশ আছে। সি দ্যাশের নাম হচে বর্মা। সি দ্যাশ বিটিশদের কাছ থেকে লিকিনি দখল করে নিয়েছে। আর একটো কথা খুব উঠেচে– জাপানিরা বোমা ফেলবে ই দ্যাশে। এই কথা নিয়ে গান বাঁধা হচে। মাঠে-ঘাটে ছেলে-ছোকরারা গাইছে, সারেগামাপাধানি, বোম ফেলেছে জাপানি। সি বোমা অবশ্যি অ্যাকনো পড়ে নাই। যি কুনোদিন পড়বে আর পড়লে ই দ্যাশের আর কুনো চিন্ন থাকবে না। জাপানিরা কম লয়, ওরাই ঐ বর্মা দখল করে নিয়েছে, অ্যাকন ই দ্যাশের দিকে এগিয়ে আসছে, ই দ্যাশটোও দখল করে নেবে বিটিশদের হাত থেকে। তার এগু বোমা ফেলে সব ছিতিছান-বিতিবান করে দেবে। জাপানিদের নাম আমরা আগে তেমন শুনি নাই। জাপানি কুন দ্যাশ? কেমন সি দ্যাশের লোক? তাদের সব আমাদের মতুন মা-ভাই-বুন-সোংসার আছে তো!
তা হুজুগের আর দোষ কি? সারা দ্যাশ আম্রিকার গোরা পল্টনে ভরে গেয়েছে। গাড়িঘোড়া সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে তারা সব জায়গায় হাজির। দ্যাশের সবকিছু তাদের লেগেই। চাল-ডাল-আটা-গরু-ছাগল-ডিম-মুরগি আগে তাদের যা লাগবে সব দিয়ে তাপর ই দাশের মানুষরা পাবে। এসবের অ্যানেক কিছুই চেরকাল ই দাশের মানুষ নিজেরাই করে আসছে নিজেদের লেগে। কেনাকিনির অত চল ছিল না। অ্যাকন সব দালাল হয়েছে, গা-গঞ্জ থেকে গরু-ছাগল-ডিম-মুরগি ইসব কিনে নিয়ে যেচে, তাতে গেরস্তরা দুটো পয়সা পেচে ঠিক, পয়সার লেগেই সব বেচে দিচে। আগে নিজেরা কিছু খেত মাখত, অ্যাকন কাঁচা পয়সার লেগে সবই বিককরি করছে, নিজেদের লেগে কিছুই রাখছে না। অবশ্যি উসব কিনে খাবার লোক আগে ছিল না, আর অ্যাকন তো নাই-ই। তাছাড়া কেউ কিনতে গেলে পল্টনের লোক এসে হাড়গোড় ভেঙে দেবে। যুদ্ধু ছাড়া অ্যাকন আর কুনো কথা নাই। গোরা পল্টনের গা থেকে লিকিনি কেমন একটো বেটকা গন্ধ পাওয়া যায়, বললে না কেউ পেত্যয় যাবে সেই বোটকা গন্ধ অ্যাকন সারা দ্যাশে, পল্টন কাছে থাকুক আর না থাকুক। ই গন্ধই অ্যাকন যুদ্ধুর গন্ধ। রুগির ঘরে সেই গন্ধ, ভাতের থালায় সেই গন্ধ, ছলের গায়ে সেই গন্ধ। চামড়া শুকোনোর গন্ধ।
অ্যানেকদিন থেকে আসমানের উড়োজাহাজের দিকে আর কেউ তাকিয়েও দ্যাখে না। দেখে কি করবে? গোঁ গোঁ আওয়াজ করে আসে, কখনো কখনো খুব নিচু দিয়ে আসে, কান যেন ফাটিয়ে দেয়, কখনো আসে খুব উচু দিয়ে, শব্দও শুনতে পাওয়া যায় না। জাপানিরা বোমা ফেলবে এই হুজুগ ওঠার পর থেকে অ্যাকন আবার লোকে পেরায় সব সোমায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বোমা ফেললে তো উড়োজাহাজ থেকেই ফেলবে। কি করে বোঝা যাবে কুনটো ফেলবে আর কুনটো ফেলবে না। সব উড়োজাহাজ কি এক রকম, না আলেদা আলেদা? আজকাল আসছে অ্যানেক বেশি, আর আসছেও অ্যানেকবার করে। মাঝে মাঝে পাঁচটো-সাতটো একসাথে গুড়গুড় শব্দ করতে করতে গাছপালার ঠিক ওপর দিয়ে উড়ে যেচে। আগে ডিগবাজি মেরে মেরে খেলা করত— অ্যাকন সিসব দেখি না। দু-একটো দেখি একা একা আসছে, আসমান দিয়ে কোনাকুনি আসছে গুট গুট আওয়াজ করতে করতে- অ্যানেকটো সোমায় লাগছে আকাশ পেরিয়ে যেতে। সি চলে গেলে সব আওয়াজ বন্ধ। দোপরবেলায় বাড়িতেও কুনো সাড়াশব্দ নাই।
আমাদের বড় ভাগ্নেটি, মা মরে গেলে কত্তা যাকে ই বাড়িতে এনেছিল, সে অ্যাকন খুব রূপের এক যোবক। সে শহরে একটো চাকরি পেয়েচে। এই মেলেটারির চাকরি। জাপানি বোমার হুজুগের পরেই এই চাকরি। সে বললে, একটো আপিসে বেবস্থা আছে, বোমা ফেলার লেগে উড়োজাহাজ এলে অ্যানেক আগেই লিকিনি জানতে পারা যাবে আর ত্যাকনই একটো হুইসিল না সাইরিন কি বাজিয়ে দেবে। সি আওয়াজ এত জোরে হবে যি সারা শহরের লোক জানতে পারবে আর সবাই সাবধান হয়ে যাবে। কি সাবধান? সারা শহরে গত্ত খুঁড়ে রেখে দিয়েছে এক-একটো খালের মতুন। সাইরিন বাজলেই যে যেখানে আছে, সেই খালের ভেতরে ঢুকবে, ছেলেমেয়ে-বউ-বিবি সব নিয়ে সেইখানে বসবে। বোমার উড়োজাহাজ চলে গেলে আবার অন্য রকম সাইরিন বাজলে সবাই উঠে আসবে। আরও একটা বেবস্থার কথা শোনলম। যেখানে-সেখানে বালির বস্তার দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। বোমা যেদি পড়েই তাইলে বোমার ভেতরে যিসব ভায়ানক জিনিস আছে, তা ঐ গত্তে ঢুকতে পারবে না, বালির দেয়ালও ভাঙতে পারবে না। ভাগ্নেটি এই চাকরি করছে, মাঝে মাঝে য্যাকন আসে, ত্যাকন এইসব কথাই শুনি তার কাছে। বেশ চাকরি করছে, মাইনে পেচে। বোমা ই পয্যন্ত পড়ে নাই।