দুনিয়ায় আর থাকা লয়, গিন্নি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল
ল-দ্যাওর সব কথা বেশ ভালো করে বলতে পারে। দশ দিনের বাদলঝড়-হাওয়া থেমে গেলে মাঠ দেখে এসে সে বলেছিল, সারামাঠে একটি দানা ফলবে না, একটি ধানের শীষও টিকবে না। তার কথাই সত্যি হলো। আজ ননদকে সাক্ষী রেখে সে বললে, মাঠের সব পানি নেমে গেলে মাঠ দেখে বলেছেলম না যি, ইবার আর মাঠে আমন ধানের কোনো গন্ধ নাই, এক কাঠা ধানও কেউ পাবে না? বলি নাই? জমির কাছে গেলেই আমরা বুঝতে পারি, তাতে নিশ্বেস আছে, না নাই! জমির অসুখ-বিসুখ আছে, নিশ্বেসের কম-বেশি আছে, মরতে মরতে মরে পাথর হয়ে যাওয়া আছে– জমি যে না চেনে, সে কি তা বুঝতে পারবে? তখুনি বুঝেছেলম আমরা, মাঠকে মাঠ একদম কালা ঠান্ডা। কালো কাদা বার করা জমি। তার ওপরে সরু সরু বগরোঁয়ার মতুন সব ধানের চারা যা আছে, দু-দিন বাদেই শুকিয়ে যাবে।
পর পর দুই সন তাইলে ফসল মারা গেল। গতবার হয়েছিল খরানি আর ইবার ঝড়-বাদল। অ্যাকন দুনিয়ার দিকে তাকাইলে তা কি বোঝবার বাগ আছে? কোথা বাদল, কোথা সেই অঝোর পানি, কোথা সেই ইবলিশি হাওয়া আর কোথাই বা সেই পাষাণের মতুন আসমান। অ্যাকন ধান পাকার সোমায়, সোনা-মাখানো ধান। আসমান ভরা রোদ হবে, জানভরা ঠান্ডা হি হি বাতাস হবে, তা সবই হয়েছে, সবই হবে, শুদু মাঠে একদানা ধান নাই। ছিল যুদ্ধ, তাতেই লোক মরতে শুরু করেছিল, গাঁইয়ের আদ্দেকের বেশি মানুষ অ্যাকন ন্যাংটো থাকছে, দিনের বেলায় বেরুইতে পারছে না। যারা বেরুইচে, ভাগ্যিস তাদের শরম নাই— বুড়ো-বুড়ি, রোগে-শোকে মরা মানুষ- তাদের ইজ্জত থাকল, না থাকল না, কে সি কথা ভাবছে? কিছুই নাই, কিছুই নাই! যুদ্ধতেই এই! এবার যোগ হলো আকাল। দু-বছর ধরে জমানো ধান খেয়ে খেয়ে অ্যাকন আমাদের বাকি আছে পুরনো ধানের আর মাত্তর একটি মরাই। এতে আর ক-দিন চলবে?
কত্তা কতোদিন আর বাড়ির ভেতরে আসে না। কোট-কাচারি, আমলা-ফয়লা অ্যাকন আর কেউ নাই, পেয়াদা-দফাদাররাও নাই। পালকিটো পড়ে আছে, রং চটে গেয়েছে। কাঠ ভেঙে ভেঙে পড়ছে, ঘোড়া একটো আছে বটে এখনো। ঘোড়ায় চেপে কত্তা কতোদিন কোথাও যায় না!
সেই কত্তা হঠাৎ একদিন আগের মতুন হৈ হৈ করে কথা বলতে বলতে বুনের নাম ধরে ডেকে বাড়িতে এসে ঢুকল। বাড়ির মাহিন্দারটোর মাথায় বেরাট একঝুরি ভত্তি ফল। সোজা উত্তর-দুয়োরি যে ঘরে গিন্নি শুয়ে আছে, সেই ঘরে ঢুকে মাহিন্দার ছোড়াটোকে ঝুরি নামাইতে বললে। শীতকালের দিন, সব ফলমূল অ্যাকন পাওয়া যায় সত্যি! তাই বলে এতরকম ক্যানে? সব পচে লষ্ট হবে। আপেল নাশপাতি বেদানা কমলা আঙুর কিসমিস খেজুর ইসব তো আছেই, আরও কতোরকম আছে আমরা তার নাম জানি না। গিন্নির মাথার কাছে বসে তার একটি শুকনো হাত তুলে নিয়ে কত্তা বললে, মা, অনেকদিন আসি নাই তোমার কাছে, একবার আমার কথা শোনো। গিন্নি চোখ মুজে ছিল, তেমনি মুজেই থাকল। শুনতে পেলে কিনা, ঘুমিয়ে আছে কিনা বুঝতে পারা গেল না। এই কিছুদিন আগে পয্যন্তও গিন্নির জেগে থাকা, ঘুমিয়ে থাকা আলেদা আলেদা ছিল। জেগে আছে, না ঘুমিয়ে আছে– পষ্ট বুঝতে পারা যেত। জেগে থাকত যাকন, টক টক করে চেয়ে থাকত, ঘুমুইলে সমানে ঘুমুইত। এই কদিন হলো সব সোমায় চোখ মুজে থাকছে যেন চেয়ে থাকবার খ্যামতা নাই, চোখের পাতা বুজে বুজে যেচে। কত্তা আরও কবার মা মা করে ডাকলে কিন্তুক গিন্নি চোখের পাতা মেলতে পারলে না। জাগা আর ঘুমুনো তার কাছে একাকার হয়ে গেয়েছে।
সারা ঘরে রুগির গন্ধ। সি গন্ধ এমনিই যি ঘরে ঢুকলেই বমি আসে। পেশাব-পায়খানা এখনো আমিই পরিষ্কার করি আর কাউকে করতে দিই না। কিন্তুক যাতেই করি গন্ধ হবেই। আজ ছ-মাসেরও বেশি হলো গিন্নি শুয়ে আছে ঘরের মুদুনির দিকে চেয়ে চেয়ে। কোমরে পিঠে দগদগে ঘা হয়ে গেয়েছে। এত ধুইয়ে দি, ওষুধ দি, ঘা দিন দিন বেড়েই যেচে। গিন্নি মাঝে মাঝে তাকায় আমার দিকে— কি যি আছে সেই চাউনিতে, কেউ বলতে পারবে না। একবার একবার মনে হয় বৈকি আর কতো দিন। মনে হয়, আর নিজেই শরমে মরে যাই। কত্তা আবার ডাকলে, মা, শোনো। বহু কষ্টে গিন্নি চোখ মেললে, মনে হলো এইবার বোধায় কত্তাকে সেই কথাটো বলবে, যি কথা আমাকে অ্যানেকদিন বলেছে। সি কথাটি এই, দুনিয়ায় বেঁচে থাকার লিয়ম আছে, তার বেশি বাঁচতে নাই। আগের দুনিয়া আছে, পরের দুনিয়াও আছে। সব দুনিয়া সবার জন্যে লয়। ভাবলম, এইকথাই বোধায় বলবে কত্তাকে। কিন্তুক গিন্নির ঠোটদুটি টিপে আটকানো, শুদু চোখদুটি মেলে কত্তার দিকে চেয়ে আছে। কত্তা আবার বললে, মা শোনো, বাজারে যতো ফলমূল পাওয়া যায়, একটা একটা করে সব এনেছি। আর তো কিছু খেতে পারো না তুমি! তবু তোমার জন্যে নয়, এনেছি আমার জন্যে, আর হয়তো কোনোদিন সুযোগ পাবো না। মা, শুধু আমার মুখের দিকে চেয়ে, আমার সামনে একটু কিছু খাও। এই বলে কত্তা গিন্নির শুকনো হাতটি আর একটু নিজের দিকে টানতে গেল। ত্যাকন দেখলম, হাতটো কেমন সরতে লাগল, সরতে সরতে কত্তার হাত থেকে খসে পড়ে তার কোলে এসে পড়ল, তাপর কোল থেকে আস্তে করে মেঝেতে পড়ল। গিন্নির চোখদুটি ত্যাকনো তেমনি করে চেয়ে আছে।
একটু বাদেই কত্তা বুঝলে তার মা আর নাই।