দিলীপের ডায়েরি শুরু হল
কলকাতা থেকে বেরিলি, বেরিলি থেকে আলমোড়া, আলমোড়া থেকে আসকোট। আমরা এখন একেবারে হিমালয়ের বুকের ভিতরে, সমতল ক্ষেত্র থেকে সাড়ে চার হাজার ফুট উপরে উঠেছি।
পাহাড়ের পিছন থেকে চন্দ্র-সূর্যের উদয় ও অস্ত দেখছি, গিরি-নিঝরিণীর গান-ভরা নাচ দেখছি, পাইন গাছের নতুন বাহার দেখছি।
কিন্তু বাংলা দেশে যে জন্মেছে, কিংবা বাংলা দেশকে যে একবার ভালোবেসেছে, বাংলার বাইরেকার আর কোনও জায়গাই বোধহয় তার মনে ধরবে না! সেই ছয় ঋতুর বিচিত্র সমারোহ; সেই নানা ফুলের আতরমাখা বাতাস; সেই সিন্ধ সোনালি রোদের মিষ্ট পরশ; সেই কলাপাতার পতাকা ওড়ানো, তাল-নারিকেলের চামর ঢোলানো, অশথ-বটের ছায়া বিছানো কাচা-সবুজ স্বপ্ন দেখানো রঙিন বনভূমি, সেই শত নদীর তীরে তীরে দূর্বাশ্যামল সরস শয্যা, সেই পল্লিকুটিরে চারিদিক থেকে ভেসে আসা দোয়েল কোয়েল শ্যামা পাপিয়া ও বনকপোতের অশ্রান্ত সঙ্গীততরঙ্গ, এত ঐশ্বর্য একসঙ্গে পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে? চলেছি কোন নির্জন নিস্তব্ধ নীরস তৃষিত কঠিন পাষাণপুরে রত্নগুহার অন্বেষণে, কিন্তু বাংলা দেশের রসালো মাটিতে নিত্য যে সোনা ফলে, তার তুলনা কোথায়?
এইজন্যেই তো বাঙালি ‘কুনো’ নাম কিনেছে, সে তার সুখময় শোভাময় আনন্দময় গৃহকোণ ছেড়ে বাইরে পা বাড়াতে রাজি নয় এবং এইজন্যেই তো যে-বিদেশি একবার বাংলার স্বাদ পায়, সে আর বাংলাকে ভুলে স্বদেশে ফিরতে রাজি হয় না। কুয়াশার দেশ থেকে ছুটে আসে। ইংরেজরা, মরু-বালুর দেশ থেকে ছুটে আসে মারোয়াড়িরা, পাথরের দেশ থেকে ছুটে আসে কাবুলি আর নেপালিরা। বাংলার সোনা লুটছে যত বিদেশি এ-অঞ্চলের পাজামা পরা স্নান-ভীত ননাংরা লোকগুলোর সঙ্গে আলাপ করে আনন্দ হয় না এবং নাছোড়বান্দা মশা-মাছি-পিশুর উৎকট বন্ধুত্বও ভালো লাগে না। এখানকার ডাল আর চালের সঙ্গে কাকরের এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যে, মুখে দিলে মনে হয় একটা দাঁতও নিয়ে আর দেশে ফিরতে পারব না! এখানে দিনে রোদ আর শুকনো হাওয়া গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দেয় এবং রাতের ঠান্ডা দেয় বুকের রক্ত কনকনিয়ে জমিয়ে!
কিন্তু এতদূর এসেও আমার মনে একটুও শান্তি নেই। বাংলা দেশের সবুজ বুক ছেড়ে যারা এই শুকনো পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথে হোঁচট খেতে আসে, তারা হচ্ছে মানস সরোবরের তীর্থযাত্রী, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনওই সহানুভূতি নেই—পরকালের ভাবনা ভাববার বয়স আমাদের হয়নি। আপাতত আমরা কোনও দেবতা দর্শন করতে চাই না—আমাদের ধ্যানধারণা চায় এখন এক দানবকে! যার আশায় এতদূর আসা—সেই ভৈরব কোথায়?
ভারতের দেশ-দেশান্তর থেকে পাঞ্জাবি, মারোয়াড়ি, গুজরাটি, মারাঠি, মাদ্রাজি—নানা জাতের তীর্থযাত্রী আমাদের আশপাশ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, দু-একজন বাঙালিকেও দেখলুম, কিন্তু তাদের দলে ভৈরবকে আবিষ্কার করতে পারলুম না।
তাহলে কি আমাদের অনুমান একেবারেই মিথ্যা হয়ে দাঁড়াল? ভৈরব কি জানতে পারেনি যে, রত্নগুহার সন্ধানে আমরা এই পথে এসেছি? কিংবা জানতে পেরেও আমাদের পিছু নেওয়া দরকার মনে করেনি?
ইতিমধ্যে বিমল ও কুমারের সঙ্গে আমার এমন বন্ধুত্ব হয়েছে যে, আমরা কেউ কারুকে আর ‘বাবু’ বা ‘আপনি বলে ডাকি না। বিমল ও কুমার চমৎকার লোক! এই দুটি দুঃসাহসী লোক বার বার কল্পনাতীত বিপদ সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে এবং মৃত্যুর সঙ্গে বারংবার যুদ্ধে জয়ী হয়ে দেশ-বিদেশে এমন অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেছে কিন্তু তবু তাদের হাবভাবে ব্যবহারে এতটুকু গর্ব প্রকাশ পায় না!
আসকোট পাহাড়ের শিখরে আছে একটি কালীমন্দির এবং তার পদতলে এসে মিশেছে কালী ও গৌরী নামে দুটি নদী। এই নদী-সঙ্গমে আমাদের তাবু খাটানো হল---আজকের ঘুটঘুটে অমাবস্যার রাতটা আমরা এইখানেই পুইয়ে যাব।
আমরা একটা বড়ো ও একটা ছোটো তাবু এনেছিলুম। ছোটো তাবুতে রামহরি থাকত ও রান্নাবান্না করত এবং বড়ো তাবুতে বাঘাকে নিয়ে আমরা তিনজনে বাস করতুম।
এই আসকোটে অমাবস্যার রাতে প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা যে যার কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম। একে সারাদিন পাহাড়ে-পথ হাঁটা, তয় রাত্রে কনকনে পাহাড়ে-ঠান্ডা! ঘুম আসতে দেরি হল না।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম জানি না, আচম্বিতে বাঘার ভীষণ গর্জনে জেগে উঠলুম এবং সেই সঙ্গে শুনলুম বিষম এক ঝটাপটির শব্দ।
প্রথমে অন্ধকারে কিছুই নজরে পড়ল না। একবার ভাবলুম, তাবুর ভিতরে বাঘ কি ভালুক ঢুকেছে! উঠে পড়ে ভয়ে সিঁটিয়ে বিছানার এক কোণে সরে গিয়ে বসলুম, কিন্তু তারপরেই শুনলুম কে আর্তস্বরে বলে উঠল--উঃ! তারপরেই ধুপ ধুপ করে পায়ের শব্দ এবং শব্দটা যেন তাঁবুর ভিতর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল! বুঝলুম তাঁবুর মধ্যে কোনও জন্তু আসেনি, এসেছে মানুষই! কিন্তু কে সে? চোর?
ইতিমধ্যে বিমল ও কুমারও জেগে উঠে তাড়াতাড়ি টর্চ জ্বেলে ফেললে।
কিন্তু তাঁবুর ভিতরে আর কেউ নেই। কেবল বাঘা চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে লাফালাফি করে শিকল প্রায় ছিড়ে ফেলবার উপক্রম করছে।
বিমল একবার বাইরে গেল। তারপর ফিরে এসে বললে, বাইরে তো কারুকে দেখতে পেলুম না! বাঘা, তোর হল কী?
বাঘা সমানে চ্যাঁচাতে ও লাফাতে লাগল।
কুমার লণ্ঠন জ্বেলে বাঘার কাছে গিয়ে তাকে ভালো করে দেখে বললে, বিমল, তাবুর ভিতরে নিশ্চয় কেউ এসেছিল! এই দ্যাখো, বাধার মুখে রক্তের দাগ! যে এসেছিল, সে বাঘার কামড় খেয়ে চম্পট দিয়েছে! বাঘা যদি বাঁধা না থাকত, তাহলে সে আজ পালিয়েও বাঁচতে পারত না!
তাঁবুর দরজার কাপড়ে বিমল আর একটা নতুন আবিষ্কার করলে। একখানা রক্তাক্ত হাতের স্পষ্ট ছাপ!
বিমল বললে, দ্যাখো দিলীপ, যে এসেছিল তার হাতে আঙুল আছে ছয়টা!
আমি হতভম্বের মতো বললুম, ভৈরবেরও ডান হাতে যে ছয়টা আঙুল দেখেছি? বিমল সহাস্যে বললে, তাহলে ভৈরবই আজ আমাদের আদর করতে এসেছিল। কিন্তু এখানে যে বাঘার মতন সজাগ প্রহরী আছে, অতটা সে খেয়ালে আনেনি! ওরে বাঘা, ভৈরবের মাংস খেতে কেমন রে? খানিকটা কামড়ে তুলে নিতে পেরেছিস কী?
বাঘা তার পলাতক শত্রুর উদ্দেশে ক্রমাগত ধমক দিতে লাগল। কুমার বললে, ‘বাঘা বোধহয় ভৈরবকে ভীরু কাপুরুষ বলে গালাগাল দিচ্ছে! বিমল আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে বললে, আঃ, বাঁচলুম! তাহলে আমার অনুমান মিথ্যে নয়! ভৈরব লুকিয়ে আমাদের পিছু নিয়েছে। নিশ্চয় সে কোনও ছদ্মবেশ পরেছে! কিন্তু সে তাবুর ভিতরে ঢুকেছিল কেন? সে একা, না দল বেঁধে এসেছে?’.. মিনিট-দুয়েক পরেই বিচিত্র সুরে তার নাক ডেকে উঠল! অদ্ভুত মানুষ! বিপদ তার কাছে এত সহজ যে, ঘুম আসতে একটুও বিলম্ব হয় না!
অল্পক্ষণ পরে কুমারও ঘুমিয়ে পড়ল। আমি কিন্তু প্রায় শেষরাত পর্যন্ত জেগে রইলুম। তন্দ্রা আসে, আর ভেঙে যায়। খালি মনে হয়, কারা যেন ধারালো ছুরি নিয়ে অন্ধকারে পা টিপে টিপে আমার গলা কাটতে আসছে।
সকালে উঠে দেখি, তাবুর ভিতরে বিমল ও কুমার নেই। পাশের তাবুতে গিয়ে দেখলুম, রামহরি মাংস রান্না করছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, হা রামহরি, তোমার বাবুরা কোথায়?
রামহরি বললে, কোথায় যাচ্ছে, তারা কি বলে যাবার ছেলে? ফরসা হবার আগেই দুই স্যাঙাতে বেরিয়ে গেল, কোথায় যাচ্চো শুধোতে দুজনেই মুখ টিপে একটুখানি হাসলে, আর কিছু বললে না!
তাই তো রামহরি, এখনই পাহাড়ে-রোদে চারিদিক যেন ফেটে যাচ্ছে, তাহলে আজ আর দেখছি তবু তুলে বেরুনো হবে না?
ঘণ্টা-তিনেক বাইরে কোথায় কাটিয়ে বিমল ও কুমার ফিরে এল । আমি বললুম, তোমরা কোথায় ছিলে? আজ কি এখানেই থাকা হবে?
বিমল বললে, হ্যাঁ, আজ এখানেই বিশ্রাম। এই যে, রামহরির রান্নায় যে খাসা খোসবায় বেরুচ্ছে! আজ কী হচ্ছে, কারি না কোর্মা?
রামহরি বললে, স্টু।
স্টু? আরে কেয়াবাত! তার সঙ্গে?
জয়পুরি ঘিয়ে-ভাজা রুটি আর আলুর লপসি।
রামহরি, তোমার মতন মূর্তিমান রত্ন সঙ্গে থাকতে আমাদের আর রত্নগুহা খুঁজতে যাওয়া কেন?
রামহরি বললে, জানো সব, কিন্তু বোঝো কই? তোমরা যে জ্ঞানপাপী রত্নগুহার ভূতকে কোনওদিন ঘাড় থেকে নামতে দেবে না?
আমি বললুম, কিন্তু তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে সে কথা তো বললে না? কুমার বললে, কালকের রাতের অতিথিকে খুঁজছিলুম। আমি সাগ্রহে বললুম, তার কোনও খোঁজ পেলে নাকি?
বিমল বললে, কে জানে! তবে ডাকঘরের কাছে দেখলুম আট-দশজন মারোয়াড়ি জটলা করছে। তারা আমাদের দেখেই চলে গেল। তাদের মধ্যে একজন ছিল বেজায় ষণ্ডা যেমন লম্বায় তেমনি চওড়ায়। তার বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছে ব্যান্ডেজ বাঁধা আর ডান হাতে ছটা আঙুল। তার মুখে ছেলেমানুষি হাসি, কিন্তু চোখদুটো যেন আগুনের মতো জ্বলছে।
আমি বলে উঠলুম, নিশ্চয়ই সে ভৈরব বিশ্বাস! তার বাঁ হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা, কারণ বাঘা তাকে কামড়েছে। লম্বা-চওড়া চেহারা, মুখে শিশুর হাসি, জ্বলজ্বলে চোখ আর ডান হাতে ছুটা আঙুল! এ সেই শয়তান না হয়ে যায় না, এখানে এসে মারোয়াড়ি সেজেছে!
বিমল শুধু বললে, অসম্ভব নয়।
দুপুরে রামহরির হাতের অমৃতের মতো রান্না খেয়ে বেশ একটি দীর্ঘ দিবানিদ্রা দেওয়া গেল। বৈকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি, রামহরি চায়ের পিয়ালা আর ওমলেটের ডিশ নিয়ে হাসতে হাসতে আসছে! সেগুলি সদ্ব্যবহারের পর দু-চারটে গল্প করতে করতেই সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এল—এই পাহাড়ে-দেশে সন্ধ্যা খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবীর সঙ্গে দেখা করতে আসে!
বিমল বললে, দিলীপ, একটা কাজ করতে পারবে?
কী কাজ?
কাল আমরা বেরুব। তুমি একবার ডাকঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতে পারবে, পথে কোনও ডাকবাংলো আছে কি না?
তা পারব, কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেল যে?
বিংশ শতাব্দীর মানুষের কাছে অন্ধকারের কোনও ভয় নেই। পেট্রলের বড়ো লণ্ঠনটা নিয়ে যাও।
লণ্ঠনটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। অন্ধকার আকাশ, আবছায়ার মতো পাহাড় এবং মাঝে মাঝে অস্পষ্ট বাড়ি, ঘর ও গাছপালা দেখতে দেখতে আমি ডাকঘরের দিকে যাত্রা করলুম। দূর থেকে দু-একটা গোরু, কুকুরের ডাক বা ঢোলের আওয়াজ ভেসে আসছে, কোনও কোনও
বাড়ির ভিতর থেকে গৃহস্থালির নানারকম শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু পথে জনপ্রাণী নেই।
ফেরবার সময়ে কারুর আর কোনও সাড়া পেলুম না-নিশুত রাতের আগেই এ-সব দেশ যেন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন চতুর্দিককে মনে হয় জীবনহীনতার রাজ্য! সে-সময়ে পথেঘাটে দু-চারটে হিংস্র জন্তুর সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনাও থাকে।
সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই, একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিলুম। যেখান দিয়ে যাই, লণ্ঠনের
তীব্র আলোকে অন্ধকার যেন সভয়ে পিছিয়ে যায়।
হঠাৎ চোখে পড়ল, পাহাড়ের একটি পাথরে-বাঁধানো ঝরনার কাছে তিনজন লোক স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
আরও একটু এগিয়ে দেখলুম, লোকগুলোর পোশাক মারোয়াড়ির মতো। আমাকে দেখে তারাও এগিয়ে আসতে লাগল।
আমার বুকের কাছটা কেমন গুড়-গুড করে উঠল। তাদের দিকে না তাকিয়েই আমি হনহন করে এগিয়ে চললুম।
হঠাৎ পরিস্কার বাংলা ভাষায় কে বললে, শোনো দিলীপ, দাঁড়াও!
আমি সবিস্ময়ে ফিরে দেখলুম, মারোয়াড়ির পোশাক পরে ভৈরব বিশ্বাস একেবারে আমার কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে!
আমি বললুম, ভৈরববাবু? আপনি এখানে কেন? আর, এ কী বেশ!
ভৈরব হো হো করে হেসে উঠে বললে, তাহলে আমার মুখ এখনও তুমি ভোলোনি? কিন্তু তুমি এখানে কেন?
“আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি।
বেড়াতে এসেছ! এইটেই বেড়াতে আসবার দেশ বটে! কোন কোন দেশে তোমরা বেড়াতে যাবে?
ভৈরবের এই প্রশ্নের অর্থ বুঝলুম। সে জানতে চায়, কোন দেশে যাবার জন্যে আমরা যাত্রা করেছি। সেটা না জানতে পারলে তার চুরি-করা ম্যাপ কোনও কাজেই লাগবে না।
তার আশায় ছাই দেবার জন্যে আমি বললুম, ‘আমরা আসকোট থেকে কালী নদী পার হয়ে নেপালে বেড়াতে যাব।
নেপালে!'-বলেই সে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করলে, নেপালের কোথায় তোমরা যাবে?
কাটমাণ্ডুতে।
কাটমাণ্ডুতে? মিথ্যাকথা! বাংলা দেশ থেকে কাটমাণ্ডুতে যেতে হলে কেউ এ পথ দিয়ে যায় না!
আমি বিরক্ত স্বরে বললুম, আমার কথা যখন বিশ্বাস করবেন না, তখন আপনার সঙ্গে আমিও আর কথা কইতে চাই না!
আমি দু পা অগ্রসর হলুম।
তৎক্ষণাৎ ভৈরবের সঙ্গী দুজন দুই লাফে আমার সামনে গিয়ে পথ জুড়ে দাঁড়াল। আমি ক্রুদ্ধ স্বরে বললুম, ভৈরববাবু, এর অর্থ কী?
ভৈরব এগিয়ে এসে ডান হাত দিয়ে আমার কোটের কলার চেপে ধরলে। তারপর আমাকে একটা ঝাকানি দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললে, দিলীপ, আগুন নিয়ে খেলা কোরো না! দেখছ, রাত কী অন্ধকার, আর পথ কী নির্জন? এই বিদেশের পথে কাল সকালে যদি কোনও বাঙালির মৃতদেহ পড়ে থাকে, তাহলে কেউ তাকে চিনতে পারবে না!
সামনের অন্ধকারেরও চেয়ে গাঢ় আর একটা অন্ধকার আমার চোখের উপরে ঘনিয়ে এল। এরা কি আমাকে খুন করতে চায়?
কিন্তু মুখে যতটা সম্ভব সাহস দেখিয়ে আমি বললুম, ভৈরববাবু, আপনার উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পারছি না।
ভৈরব আমাকে আর একটা ঝকানি দিয়ে কর্কশ স্বরে বললে, এখন শোনো! অচেনা বিদেশ, রাত অন্ধকার আর পথ নির্জন। দ্যাখো, আমার হাতে এটা কী?
আমি স্তম্ভিত দৃষ্টিতে দেখলুম, সে গায়ের কাপড়ের ভিতর থেকে ফস করে প্রকাণ্ড একখানা চকচকে ছোরা বার করে ফেললে!
শুষ্ক কণ্ঠে বললুম, আপনি কী জানতে চান?
সত্যি করে বলল, তুমি কোন দেশে যাবে?
কী করব? বলব, কি বলব না? কোথায় কোন অতলে গুপ্তধন লুকানো আছে কিংবা নেই, তার লোভে নিজের প্রাণ নষ্ট করব?
ভৈরব দুই চক্ষে অগ্নিবর্ষণ করে বললে, চুপ করে রইলে যে বড়ো? বলল, তুমি কোথায় যাবে?
হঠাৎ কাছ থেকেই পরিচিত স্বরে শুনলুম, ভৈরববাবু, দিলীপ যদি না বলে তাহলে আমি বলতে পারি—আমরা কোথায় যাচ্ছি।
বিদ্যুৎবেগে ফিরে দেখি, পাশের একটা পাথরের আড়াল থেকে বিমল ও কুমার বেরিয়ে আসছে, তাদের দুজনেরই হাতে রিভলভার!
যে দুটো লোক আমার পথ জুড়ে দাঁড়িয়েছিল তারা তিরের মতো ছুটে অন্ধকারের ভিতরে মিলিয়ে গেল এবং ভৈরবও পালাবার উপক্রম করলে।
কিন্তু কুমার খপ করে তার একখানা হাত চেপে ধরলে!
বিমল হাসতে হাসতে বললে, দেখছেন ভৈরববাবু, রাত খুব অন্ধকার হলেও পথ খুব নির্জন নয়?
কুমারের হাত থেকে হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে ভৈরব বললে, কে তোমরা?
বিমল অত্যন্ত মিষ্ট স্বরে বললে, ভৈরববাবু, স্থির হোন। বেশি ছটফট করলে আমরাও রিভলভার ছুড়তে ইতস্তত করব না। আপনি তো নিজেই বলেছেন, এই বিদেশের পথে কোনও বাঙালির মৃতদেহ পড়ে থাকলে কাল সকালে কেউ তাকে চিনতে পারবে না?
ভৈরব তৎক্ষণাৎ স্থির হয়ে বললে, তোমরা কী চাও?
মাত্র একখানা ম্যাপ।
ম্যাপ? কীসের ম্যাপ?
কীসের ম্যাপ তা তুমিও জাননা, আমরাও জানি। যে ম্যাপখানা তুমি দিলীপের বাড়ি থেকে চুরি করেছিলে, আমরা সেইখানাই চাই।
ম্যাপ-ট্যাপ আমি কিছু জানি না। আমার হাত ছাড়ো, নইলে আমি চিৎকার করে তোক ডাকব।
তুমি চিৎকার করলে এখানে খালি প্রতিধ্বনিই উত্তর দেবে। কিন্তু তার আগেই আমি তোমাকে গুলি করে কুকুরের মতো মেরে ফেলব।
আমার কাছে কোনও ম্যাপ নেই।
তোমার কাছেই ম্যাপ আছে। অমন মূল্যবান জিনিস তুমি যে কাছছাড়া করেছ, কি অন্য কারুর কাছে রেখেছ, এ কথা আমি আমি বিশ্বাস করি না। নির্বোধ! এখনও কি বুঝতে পারছ না যে, তোমাকে ধরবার জন্যেই আজ আমরা ফাঁদ পেতেছি? আমরা জানি, তুমি আমাদের গতিবিধি লক্ষ করছ? আমরা জানি, রাত্রে নির্জন পথে দিলীপকে একলা পেলেই তোমরা ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে আমাদের গন্তব্য স্থানের কথা জানবার চেষ্টা করবে। আমরা জানি, গুপ্তধনের ঠিকানা পাওনি বলে তোমার আপশোশের সীমা নেই! মুখের মতো ফাদে যখন পা দিয়েছ, তখন ম্যাপখানা ফিরিয়ে না দিলে আর তোমার মুক্তি নেই!
ভৈরব তার ছেলেমানুষি হাসি হেসে বললে, ম্যাপের কথা আমি কিছুই জানি না।
বিমল গম্ভীর স্বরে বললে, কুমার, তুমি ভৈরবের হাত দুখানা ওর গায়ের কাপড় দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে ফ্যালো তো! ও যদি পালাবার চেষ্টা করে আমি তাহলে এখনই গুলি করে ওর ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব!
বিমল রিভলভার বাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কুমার আর আমি ভৈরবকে খুব কষে বেঁধে ফেললুম—দারুণ ক্রোধে তার মুখ রক্তবর্ণ হয়ে ফুলে উঠল, কিন্তু সে কোনও বাধা দিলে না।
বিমল বললে, এইবারে ওর জামাকাপড় ভালো করে খুঁজে দ্যাখো। ম্যাপ নিশ্চয়ই ওর কাছে আছে।
প্রথমে তার কোটের পকেট, তারপর ফ্লানেলের শার্ট, তারপর ভিতরকার মেরজাই খুঁজে পাওয়া গেল একটা মানিব্যাগ। সেই মানিব্যাগের মধ্যে পেলুম আমাদের হারামণি—অর্থাৎ রত্নগুহার সেই হাতে-আঁকা ম্যাপখানা!
বিমল বললে, ভৈরব, তুমি যে বেচারা কিষণ সিংকে খুন করেছ, তাও আমরা জানি। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ নেই বলে তোমাকে আমরা পুলিশের হাতে সঁপে দিতে পারলুম না। তুমি মহাপাপিষ্ঠ, যাও—আমাদের সুমুখ থেকে দূর হও!
সেই হাতবাঁধা অবস্থায় ভৈরব ধীরে ধীরে চলে গেল।
ফেরবার মুখে আমি বললুম, বিমল, শিকারিরা যেমন গোরু-ছাগলের লোভ দেখিয়ে বাঘকে ফঁদে ফেলে, তোমরা আমাকে ঠিক সেই ভাবেই আজ ব্যবহার করেছ!
বিমল উৎসাহের সঙ্গে বললে, হ্যাঁ, ঠিক সেই ভাবেই!
আমি আহত কণ্ঠে বললুম, কিন্তু অনেক সময়ে বাঘ সেই গোরু-ছাগলকে বধ করে, সেটাও জাননা তো?
বিমল হেসে বললে, অভিমান কোরো না বন্ধু, অভিমান কোরো না! যদিও তুমি আমাদের দেখতে পাওনি, তবু এটা জেনেনা যে, আমাদের দৃষ্টি বরাবরই তোমার উপরে ছিল!
কিন্তু আগে থাকতে এই কৌশলের কথা আমাকে জানালে কি ক্ষতি হত?
এ-সব বিপদে-আপদে তুমি এখনও আমাদের মতো অভ্যস্ত হওনি। হয়তো তুমি ভয় পেতে।
কুমার বলে উঠল, আরে, কেল্লা যখন এত সহজে ফতে হয়েছে, তখন এত কথা-কাটাকাটি আর মান-অভিমান কেন? এখন আনন্দ করো ভাই, আনন্দ করো! গুপ্তধনের ঠিকানা আমরা জানি, হারা ম্যাপ আবার ফিরে এসেছে, দুরাত্মার দুরাশায় ছাই পড়েছে, এখন কেবল আনন্দ করো!
বিমল ধীরে ধীরে বললে, কিন্তু বিনামেঘের বজ্র হয়তো এখন আমাদের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে!