কুবের পুরীর রহস্য Kuber purir Rohoshyo by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name ফাউন্টেন পেনের গুপ্তকথা

ফাউন্টেন পেনের গুপ্তকথা

এতক্ষণ পর্যন্ত বিমল একটাও কথা কয়নি। দিলীপের সমস্ত কাহিনি শুনেও সে প্রথমে কিছু বললে না, চুপ করে কী ভাবতে লাগল।

কুমার জিজ্ঞাসা করলে, দিলীপবাবু, এমন কোনও লোককে আপনি জানেন কি, আপনার সঙ্গে বা আপনাদের পরিবারের সঙ্গে যার শত্রুতা আছে? দিলীপ বললে, না, এমন কারুকেই আমি জানি না।

আপনাদের সম্পত্তির আর কোনও উত্তরাধিকারী যে নেই, সে-বিষয়েও আপনি নিশ্চিত?

হ্যাঁ। আর সম্পত্তি তো ভারী! বছরে বারো-তেরোশো টাকা আয়!

হয়তো আপনার বাবার মৃত্যুর পর আপনি নিজের অজ্ঞাতসারেই অন্য কোনও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছেন। যাদের স্বার্থ আছে, হয়তো তারা আপনার স্বপক্ষের প্রমাণগুলো সরিয়ে ফেলতে চায়।

স্বপক্ষের প্রমাণ বলতে আপনি কী বোঝেন কুমারবাবু? চোরেরা একখানা হাতে-আঁকা ম্যাপ আর তিনটে ফাউন্টেন পেন সরিয়ে ফেলেছে। এগুলো কি আবার প্রমাণ?

বিমল এইবারে কথা কইলে। বললে, কুমার, যদিও তুমি ভুল যুক্তি অনুসরণ করছ, তবু একটা বিষয় বোধহয় কতকটা আন্দাজ করতে পেরেছ। ওই হাতে আঁকা ম্যাপখানা খুব বড়ো প্রমাণও হতে পারে! চোরেরা যে তিনটে ফাউন্টেন পেন নিয়ে গেছে, তাও হয়তো অকারণে নয়! ভৈরব খুব সম্ভব নিজের কোনও গৃঢ় স্বার্থসিদ্ধির জন্যেই ওই ম্যাপখানা চুরি করেছে। কিন্তু ম্যাপ ছাড়াও নিশ্চয় সে আরও কিছু চায়। সেই আরও কিছু বলতে কী বোঝাতে পারে? সেই আরও কিছু’র লোভেই কিষণ সিংকে হত্যা করা হয়েছে। তাকে বধ করবার আগে হয়তো যন্ত্রণা দিয়ে কিষণ সিংয়ের মুখ থেকে জেনে নেওয়া হয়েছে যে, তারিণীবাবু তার হাতে যা দিয়েছিলেন, তিনি সে-সব দিলীপবাবুর হাতে সমর্পণ করে এসেছেন। দিলীপবাবুর হাতে তিনি দিয়েছিলেন পাঁচশো টাকা আর একটা ফাউন্টেন পেন। চোরেরা যখন টাকার বদলে ভুল ফাউন্টেন পেনই চুরি করেছে, তখন বুঝতে হবে যে, ঠিক ওই জিনিসটিই তাদের দরকার। কিন্তু আসল ফাউন্টেন পেনটি এখনও দিলীপবাবুর কাছেই আছে। সেটি যদি এখানে থাকত তাহলে হয়তো এখনই আমি সমস্ত রহস্য ভেদ করতে পারতুম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কলমটি আমাদের হাতে নেই!

দিলীপ বললে, কলম আছে বিমলবাবু, কলম আমার সঙ্গেই আছে! চোরেদের অদ্ভুত প্রবৃত্তি দেখে বাবার সেই শেষ-স্মৃতিচিহ্নটিকে আমি বাড়িতে ফেলে আসতে ভরসা করিনি! এই বলে সে জামার ভিতর থেকে একটি ফাউন্টেন পেন বার করে সামনের টেবিলের উপরে রাখলে।।

বিমল আগ্রহভরে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল। তারপর কলমটির দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললে, এটি দেখেছি ওয়াটারম্যানের সবচেয়ে বড়ো সাইজের রেগুলার ফাউন্টেন পেন। এতে কালি ঢালতে হলে প্যাচ খুলে ড্রপারের সাহায্যে ফাঁপা ব্যারেলটিকে ভরতি করতে হয়। কলমটির আকারে কোনও নতুনত্ব বা অসাধারণ দেখছি না বটে, কিন্তু সে মুখের কথা শেষ না করেই কলমটি টেবিলের উপর থেকে তুলে নিলে এবং প্যাচ ঘুরিয়ে তার মুখের দিকটা খুলে ফেলে ব্যারেলের ভিতরে তীক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সহাস্যে বলে উঠল, যা ভেবেছি তাই! সব রহস্যই এইবারে পরিষ্কার হয়ে যাবে! কুমার! একটা ছোটো সন্না নিয়ে এসো তো!

কুমার তখনই উঠে গিয়ে একটি ছোটো সন্না এনে দিলে।

বিমল সন্নাটা ব্যারেলের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে খুব সরু করে পাকানো একখানা কাগজ টেনে বার করে ফেললে!

দিলীপ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, ও কী বিমলবাবু, ও কী! ব্যারেলের ভেতরে কাগজ!

বিমল বললে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই খুব দরকারি কাগজ! এইজন্যেই আপনার বাবা আপনাকে কলমটি খুব সাবধানে রাখতে বলেছিলেন! আর ভৈরবও বোধহয় এইরকম কিছু সন্দেহ করেই। ফাউন্টেন পেন চুরি করতে নিজে এসেছিল বা লোক পাঠিয়েছিল। এখন দেখা যাক, কাগজে কী লেখা আছে।

বিমল আস্তে আস্তে পাকানো কাগজখানি খুলতে লাগল। খুব পাতলা একখানা কাগজ ভালো করে পাকিয়ে ব্যারেলের ভিতরে পুরে রাখা হয়েছিল। তাতে খুদে খুদে হরফে লেখা আছে:

কল্যাণীয়েষু দিলীপ, আমার স্থান অতি অল্প, একেবারে কাজের কথা বলি।

আমার বাবা, অর্থাৎ তোমার ঠাকুরদাদা তিব্বত বেড়াতে গিয়ে পথে গুপ্তধনের সন্ধান পান। কিন্তু কোনও দুর্ঘটনায় তাকে খালি হাতে কেবল প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। তবে সে-জায়গাটির ম্যাপ তিনি এঁকে এনেছিলেন, সেখানি আমাদের লোহার সিন্দুকে আছে।

আমাদের বর্তমান অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে বলে আমিও ওই গুপ্তধনের সন্ধানে চলেছি। কিন্তু পথে বেরিয়ে এখন বুঝতে পারছি যে, ওই গুপ্তধনের ঠিকানা না জানলেও তার অস্তিত্ব আমি ছাড়া বাংলা দেশের অন্য লোকেও জানে। সেই শত্রুও আমার অনুসরণ করেছেহয়তো আমাকে কোনও বিপদে ফেলবে। যদি আমি কোনও মারাত্মক বিপদে পড়ি, তাহলে তুমি যাতে সব জানতে পারো আমি সেইজন্যেই এই পত্র লিখছি।

হিমালয়ের মানস সরোবরের কাছে রাবণ হ্রদ বা রাক্ষস তাল। গুপ্তধন সেইখানেই আছে। ম্যাপ দেখলেই সব জানতে পারবে। সাবধানতার জন্যে ম্যাপে রাক্ষস তালের নাম লেখা নেই। কারণ যদি ম্যাপখানা চুরি যায়, তাহলেও কেউ বুঝতে পারবে না যে, কোথাকার ম্যাপ! আমিও সাবধানতার মার নেই বলে ম্যাপখানা সঙ্গে নিলুম না কিন্তু তার সবটাই আমার মনের ভিতরে এমন ভাবে গাঁথা আছে যে, বিনা ম্যাপেই আমি কাজ চালাতে পারব।

গুপ্তধনের সমস্ত ইতিহাস আমি জানি না। তবে শুনেছি, বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের সময়ে যখন বৌদ্ধদের উপরে ভীষণ অত্যাচার আরম্ভ হয়, তখন একদল সন্ন্যাসী একটি পরাজিত রাজ্যের সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে তিব্বতে পালাবার পথে রাক্ষস তালের কাছে লুকিয়ে রাখে। সে ঐশ্বর্যের নাকি অন্ত নেই।

কিন্তু ঐশ্বর্যলাভে দুটি বাধা আছে বলে শুনেছি। প্রথমত, গুপ্তধন রক্ষা করে নাকি একদল প্রেতাত্মা! তিব্বতের লামারা এই ঐশ্বর্যের কথা জানে। এতদিনে তারা হয়তো গুপ্তধন সব সরিয়ে ফেলত, কিন্তু তারা কুসংস্কারে অন্ধ, ভূতের ভয়ে রত্নগুহার সন্ধান করে না। আর সন্ধান করার অন্য কারণ বোধ হয়, রত্নগুহার ঠিক ঠিকানা তাদের জানা নেই। কিন্তু ঠিকানা না জানলেও লামারা সর্বদাই সাবধান হয়ে থাকে, এ-অঞ্চলে কারুকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই সন্দেহ করে যে, সে বুঝি সন্ধান পেয়ে রত্নগুহা খালি করতে এসেছে! ওই লামারা অত্যন্ত হিংস্র, কারুর উপরে সন্দেহ করলেই তাকে হত্যা করতে ইতস্তত করে না। দ্বিতীয়ত, এখানে অত্যন্ত ডাকাতের উপদ্রব, বিদেশি পথিক দেখলে সর্বদাই আক্রমণ করতে প্রস্তুত।

তবু আমি ওখানেই যাচ্ছি, তার কারণ আমার বিশ্বাস আছে যে, লামাদের চোখে আমি ধুলো দিতে পারব! আর ভূত-প্রেত আমি মানি না। আমার মতে, ওই প্রেতাত্মাদের কথা রূপকথা ছাড়া আর কিছু নয়। খুব সম্ভব, এই ভূতের ভয়ের সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু লোভী লোকদের তফাতে রাখবার জন্যে। আর ডাকাতের ভয়? বুদ্ধি থাকলে তাদের চোখে ধূলো দেওয়া অসম্ভব নয়।

আমি যদি অকৃতকার্য হই, তাহলে তুমি বা তোমার বংশধর আমার পরে এই পথে আসতে পারো-অবশ্য সাহস ও যোগ্যতা থাকলে। ইতি।

আশীর্বাদক তোমার পিতা।

পত্রপাঠ শেষ হলে পর তিনজনেই খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।

সর্বপ্রথমে মুখ খুলে দিলীপ অভিভূত স্বরে বললে, এতক্ষণে সব বোঝা গেল! ভৈরব এই। জন্যেই কলম চুরি করতে চায়। গুপ্তধন!

কুমার বললে, কিন্তু আসল কলমটা না পেলেও ভৈরব ম্যাপখানা সরিয়ে ফেলতে পেরেছে। সে ম্যাপের অভাবে আপনার পক্ষে গুপ্তধন থাকা আর না থাকা দুইই এক কথা!

দিলীপ বললে, কিন্তু জায়গাটির সন্ধান যখন পেয়েছি তখন আমরা সবাই মিলে খুঁজলে আবার কি গুপ্তধন আবিষ্কার করতে পারব না?

কুমার হেসে বললে, কাজটা যদি এতই সোজা হত, তাহলে গুপ্তধন আজ আর সেখানে থাকত না—কেউ না কেউ তা খুঁজে বার করতই! তাকে ওভাবে খুঁজে বার করা অসম্ভব বলেই ম্যাপের দরকার হয়েছে। সে ম্যাপ যখন নেই, গুপ্তধন পাবার আশা তখন আর না করাই উচিত!

বিমল ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে বললে, কুমার, বোধ করি অতটা হতাশ হবার দরকার নেই। ব্যাপারটা এখন দাঁড়িয়েছে এইরকম: গুপ্তধন কোন দেশে আছে আমরা তা জানি, কিন্তু ঠিক ঠিকানাটি আমাদের জানা নেই। ভৈরবের কাছে ম্যাপ আছে, কিন্তু কোথায় গেলে গুপ্তধন পাওয়া যাবে, সেটা তার জানা নেই। একজন দরজার সামনে যেতে পারে, কিন্তু চাবির অভাবে দরজা খুলতে পারবে না। আর একজনের কাছে চাবি আছে, কিন্তু সে-চাবিতে কোন দরজা খুলতে হবে সেটা তার অজানা। বুঝতেই পারছ, দুই পক্ষেরই সমান অসুবিধা!

কুমার বললে, কাজেই ও-ব্যাপার নিয়ে আর মাথা না ঘামানোই ভালো! বিমল বললে, কিন্তু এখন দুই পক্ষে যদি একটা বোঝাপড়া হয়?

কুমার বিরক্ত কণ্ঠে বললে, ওই দুরাত্মা ভৈরবের সঙ্গে? মাপ করো ভাই, আমি ওর মধ্যে নেই!

বিমল বললে, তুমি বোধহয় ভৈরবের শয়তানি এখনও ভালো করে আন্দাজ করতে পারোনি! তারিণীবাবু যে শত্রুর জন্যে বিপদের ভয় করেছিলেন, কে সে? তিনি তাকে বাংলা দেশের লোকও বলেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে ওই ভৈরব ছাড়া আর কেউ নয়! তারও মৃত্যুর কারণ ওই ভৈরবই!

দিলীপ মহাক্রোধে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উঠে দাঁড়াল এবং তীব্র স্বরে বললে, আমি আমার পিতৃহন্তার সঙ্গে কোনও বোঝাপড়া করতে রাজি নই! আমি গুপ্তধন চাই না কেবল তাকে আর একবার দেখোতে চাই! তাকে খুন করে আমি কঁসি যেতেও প্রস্তুত।

কুমার বললে, ওই ভৈরবকে পেলে আমিও কিছু শিক্ষা দিতে চাই! তার সঙ্গে বোঝাপড়া অসম্ভব!

বিমল ধীর স্বরে বললে, কুমার, আমি কীরকম বোঝাপড়ার কথা বলছি আগে সেইটেই ভালো করে শোনো! আমি বন্ধুভাবে বোঝাপড়ার কথা বলছি না! আমার সন্দেহ হচ্ছে, দিলীপবাবুর উপরে ভৈরব তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখতে ভোলেনি। কারণ তারও সন্দেহ হয়েছে যে, গুপ্তধন কোন দেশে আছে দিলীপবাবু সে কথা জানেন। সুতরাং দিলীপবাবু এখন যদি হঠাৎ প্রকাশ্যেই হিমালয়ের দিকে যাত্রা করেন, তাহলে ভৈরবও তার পিছু না নিয়ে পারবে না!

কুমার বললে, তারপর?

তারপর আমরা আপাতত যখন অলস হয়ে বসে আছি তখন দিলীপবাবুর সঙ্গী হলে নিতান্ত মন্দ হবে কি? তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা! হয়তো ভৈরবকে কোনও ফাঁদে ফেলে আবার সেই ম্যাপখানা কেড়ে নেবারও সুযোগ পাওয়া যাবে?

কুমার মস্ত এক লাফ মেরে বলে উঠল, সাধু, সাধু, চমৎকার ফন্দি! বিমল, তুমি একটি জিনিয়াস!

বিমল বললে, কিন্তু অত বিপদ-আপদের মধ্যে দিলীপবাবু যেতে রাজি হবেন কি?

দিলীপ মহা-উৎসাহে বললে, ‘রাজি হব কী, রাজি হয়েছি! এক—গুপ্তধনের লোভ; দুইনরপিশাচ ভৈরবকে আর একবার দেখবার লোভ; তিন–আপনাদের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের বন্ধুরূপে পাবার লোভ! এই তিন-তিনটে লোভ সামলানো কি বড়ো সহজ কথা! কবে যাবেন বলুন—আমি প্রস্তুত!

বিমল চিৎকার করে বললে, রামহরি, রামহরি! রামহরি ঘরে ঢুকে বললে, অত চ্যাঁচানো হচ্ছে কেন, আমি কি কালা?

রামহরি, মোটঘাট বাঁধতে শুরু করো--আমরা গুপ্তধন আনতে যাব?

রামহরি চমকে উঠে বললে, কী! আবার গুপ্তধন? তোমাদের সঙ্গে এবারে আমি নেই জেনো!

রামহরি, অনেকগুলো ভূত নাকি সেই গুপ্তধনের ওপরে পাহারা দেয়! রামহরি শিউরে উঠে বললে, কী! আবার ভূত? তোমাদের সঙ্গে এবারে আমি নেই জেনো!

কিন্তু হপ্তাখানেক পরে বিমল, কুমার ও দিলীপ যেদিন হিমালয়ের উদ্দেশে যাত্রা করলে সেদিন দেখা গেল, তাদের পিছনে পিছনে চলেছে বেজায় বিরক্তমুখে শ্রীরামহরি এবং সর্বশেষে যাচ্ছে বেজায় খুশিভাবে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বাংলার কুকুর বাঘ!

(রত্নগুহার সন্ধানে যাত্রা করে যে-সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল দিলীপের ডায়েরি থেকে এখানে তা উদ্ধার করে দেওয়া হল। অর্থাৎ অতঃপর দিলীপই প্রধান বক্তা হয়ে নিজের ভাষায় সমস্ত বর্ণনা করবে।