কুবের পুরীর রহস্য Kuber purir Rohoshyo by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name দিলীপের কাহিনি

দিলীপের কাহিনি

আমাদের রাধানগর হচ্ছে বেশ একখানা বড়ো গ্রাম। যদিও সেখানে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ প্রভৃতির চেয়ে নিম্নজাতির দলই বেশি ভারী।

গাঁয়ের পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাউরী নদী। তার সঙ্গে গঙ্গার যোগ আছে। সেইজন্যে রাধানগরের ঘাটে অনেক দূর দেশের নৌকো আর ইস্টিমার এসে লাগে। এই বাউরী নদীর তীরেই আমাদের বাড়ি।

ছেলেবেলাতেই আমার মা মারা যান—তার মুখও আমার মনে পড়ে না। মাস-ছয়েক আগে আমার ঠাকুরদাদাও ইহলোক ত্যাগ করেন ঠাকুরমা অনেক আগেই স্বর্গে গিয়েছিলেন। ঠাকুরদাদা মারা যাবার সময়ে বাবাকে কী বলে যান তা জানি না, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই বাবা সর্বদাই যেন কী চিন্তা করতেন। তারপর মাস তিনেক আগে হঠাৎ তিনি তীর্থযাত্রা করেন।

আমি বাবার একমাত্র সন্তান। আগে আমাদের খুব বড়ো জমিদারি ছিল, কিন্তু ঠাকুরদাদা বিষয়-সম্পত্তির অধিকাংশই নষ্ট করে ফেলেন। এখন সামান্য কিছু জমিজমা আছে, আর আমার কোনও ভাগীদারও নেই, তাই কোনওরকমে মোটা ভাত-কাপড়ের সংস্থান হয়। আমাদের অবস্থার এই পরিবর্তনে বাবা বড়ো কাতর হয়ে পড়েছিলেন, এর জন্যে সর্বদাই দুঃখিত মুখে থাকতেন। আমার বাবার নাম তারিণীচরণ চৌধুরী, আর ঠাকুরদাদার নাম ছিল শ্যামাপদ চৌধুরী।

বাবা তীর্থযাত্রা করবার দিন-পনেরো পরেই কিষণ সিং নামে এক ভদ্রলোকের চিঠিতে হঠাৎ এক দুঃসংবাদ এল। আলমোড়ার কাছে এক জঙ্গলে বাবাকে নাকি ডাকাতের দল আক্রমণ ও আহত করে এবং কিষণ সিং তাঁকে পথ থেকে তুলে এনে বাঁচাবার অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি।

হঠাৎ পিতৃহীন হয়ে আমার মনের অবস্থা কী রকম হল এখানে সেটা আর বর্ণনা করবার চেষ্টা করব না। এমনই হতভাগ্য আমি যে, পিতার দেহের সত্ত্বার পর্যন্ত করতে পারিনি। কারণ সেই পত্রেই জানা গেল যে, তার নশ্বর দেহ দাহ করে ফেলা হয়েছে।

এইবারে আমার আসল বিপদের কথা শুনুন।

বাবার শ্রাদ্ধাদি কাজ যখন শেষ হয়েছে, তখন হঠাৎ একদিন একটি লোক আমাদের গ্রামে এসে হাজির হলেন। লোকটি আমাদের বাড়িতে এসে এই বলে আত্মপরিচয় দিলেন: আমার নাম ভৈরবচন্দ্র বিশ্বাস। আমি কলকাতায় থাকি। তোমার বাবা তারিণীবাবু যখন আলমোড়ায় কিষণ সিংয়েব বাসায় মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন, তখন আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলুম।

তোমার বাবা অন্তিমকালে আমাকে যে অনুরোধ করে গিয়েছিলেন, সেই অনুরোধ রক্ষা করবার জন্যেই আজ আমাকে এখানে আসতে হয়েছে।

তিনি বাবার অন্তিমকালের বন্ধু শুনে আমি তাড়াতাড়ি সসম্মানে তাকে একেবারে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এসে বসালুম।

ভৈরববাবু দেখতে অত্যন্ত লম্বা ও দোহারা। তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তিনি নিয়মিত কুস্তি লড়েন ও অন্যান্য ব্যায়াম করেন। তার বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হবে না, কিন্তু এই বয়সেই মাথার আধখানা টাকে ভরা। শ্যামবর্ণ, গোঁফ-দাড়ি কামানো। কিন্তু তার ছোটো ছোটো অত্যন্ত তীব্র চক্ষু দুটির সঙ্গে মুখের মিষ্ট ও ছেলেমানুষি-মাখা সরল হাসি কেমন যেন খাপ খাচ্ছিল না।।

আমি তাকে বাবার শেষ-অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলুম।

তিনি করুণ ভাবে বললেন, আহা, সে কথা আর শুনতে চেয়ো না, শুনলে তোমার কষ্ট হবে।

আমি বললুম, তাহলে বাবা কেন যে আপনাকে আমার কাছে আসবার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন, সেই কথাই বলুন!

ভৈরববাবু বললেন, বেশি কথা তিনি কিছুই বলেননি—বলতে পারেননি। তবে মারা যাবার মিনিট-দুয়েক আগে তিনি আমার দুই হাত চেপে ধরে আকুল স্বরে বলেছিলেন—রাধানগরে আমার ছেলে দিলীপ আছে, তার মাথার ওপরে কেউ নেই। আমার যে-সব দলিল আর কাগজপত্তর আছে সেগুলো দেখে যদি আপনি সুব্যবস্থা করে দেন, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পারি।' এই তার শেষ কথা। আমি স্বীকার করলুম। তারপরেই তার মৃত্যু হল।

সেই ঘরেই বাবার লোহার সিন্দুক ছিল। আমি সিন্দুক খুলে ভিতরকার সমস্ত কাগজপত্তর ভৈরববাবুর সামনে বার করে দিলুম। তিনি খুব মন দিয়ে সমস্ত কাগজপত্তর পরীক্ষা করতে লাগলেন। ছোট্ট একটা ক্যাশবাক্সে একখানা খামের ভিতরে একটুকরো কাগজ ছিল, সেইটেই তিনি প্রায় দশমিনিট ধরে দেখলেন। তারপর কাগজখানা আবার বাক্সের ভিতরে রেখে দিয়ে বললেন, “দিলীপ, তোমার কাগজপত্রের ভিতরে কোনও গোলমাল নেই, তবে তোমার বাবা এত ব্যস্ত আর চিন্তিত হয়েছিলেন কেন, সেটা তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আর কোনওখানে কি তোমার বাবার আর কোনও কাগজপত্তর আছে?

আমি বললুম, আজ্ঞে না।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা কয়ে তিনি বিদায়গ্রহণ করলেন। যাবার সময়ে লক্ষ করলুম, ভৈরববাবুর ডান হাতে আঙুল আছে ছয়টা!

ভৈরববাবু অতক্ষণ ধরে একটুকরো কাগজ নিয়ে কী লক্ষ করছিলেন তা জানবার জন্যে মনে কেমন কৌতুহল হল। ক্যাশবাক্সটা আবার খুললুম। খামের ভিতর থেকে কাগজের টুকরোটা বের করে ভাজ খুলে দেখলুম, তার ভিতরে খালি একটা ম্যাপ আঁকা আছে! কোথাকার ম্যাপ সে-সব কিছুই জানবার উপায় নেই, খুব পুরোনো কালি দিয়ে টানা গুটিকয় লাইন এবং হাতের অক্ষরে লেখা রয়েছে, পাহাড়’, ‘গুহা’, ও সরোবর’ প্রভৃতি।

এই তুচ্ছ ম্যাপখানা ভৈরববাবু এতক্ষণ ধরে দেখেছিলেন কেন? অনেকক্ষণ ভেবেও কিছুই বুঝতে না পেরে, বোঝবার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে কাগজপত্তর সব আবার সিন্দুকের ভিতরে পুরে রাখলুম।

এইবার থেকে আপনারা বিশেষ মন দিয়ে আমার কথা শুনুন। কারণ এর পরের ঘটনাগুলির কারণ জানবার জন্যেই আমি আপনাদের দ্বারস্থ হয়েছি।

ভৈরববাবুর আগমনের দিন-তিনেক পরে আমি একটা দরকারি কাজে পাশের গাঁয়ে গিয়েছিলুম। সেখান থেকে ফিরতে আমার রাত হয়ে যায়। বাড়িতে ফিরে এসে উপরে উঠে দেখি, আমার উপরকার বসবার ঘরের দরজাটা খোলা রয়েছে। অথচ যাবার সময়ে এ-ঘরের দরজায় আমি যে নিজের হাতে তালা বন্ধ করে গিয়েছিলুম, সে বিষয়ে আমার কোনওই সন্দেহ নেই। চাকরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলুম, সে কিন্তু কিছুই বলতে পারলে না।

ঘরে ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়ল, লোহার সিন্দুকটা খোলা! তাড়াতাড়ি তার ভিতরটা পরীক্ষা করে দেখলুম, দামি কিছুই চুরি যায়নি!

ঘরের মেঝেতে সেই ছোটো ক্যাশবাক্সটা কাত হয়ে পড়েছিল। সেটা খুলে অবাক হয়ে দেখি, তার ভিতর থেকে সেই ম্যাপ-সুদ্ধ খামখানা অদৃশ্য হয়েছে!

বাড়ির সমস্ত ঘর পরীক্ষা করে আর কিছু হারিয়েছে বলে মনে হল না। হরিয়েছে শুধু সেই তুচ্ছ ম্যাপখানা যে বাজে কাগজখানা হয়তো আমি নিজেই কোনওদিন বাক্স থেকে বার করে ছুড়ে ফেলে দিতুম!

হতভম্ব হয়ে ভাবতে লাগলুম, বাড়িতে চোর এল, দরজার তালা ভাঙলে, লোহার সিন্দুক খুললে, কিন্তু নিয়ে গেল কেবল এক টুকরো কাগজে হাতে-আঁকা একখানা ম্যাপ! এমন অসম্ভব কথা কেউ কখনও শুনেছে?

কেন জানি না, কেবলই সন্দেহ হতে লাগল, এই অদ্ভুত রহস্যের সঙ্গে সেই ভৈরববাবুর একটা কোনও সম্পর্ক আছেই! এই ম্যাপ দেখবার জন্যে ভৈরববাবুর অতিরিক্ত আগ্রহ তো তার মুখে-চোখে স্পষ্টই ফুটে উঠতে দেখেছি! আর সেই আগ্রহেই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, মাপখানা অন্তত তার চক্ষে কম মূল্যবান নয়!

এই ঘটনার হপ্তাখানেক পরে আমার বাড়িতে আর এক মূর্তি এসে হাজির! পশ্চিমের লোক, বয়সে প্রৌঢ়, আধময়লা জামাকাপড়। নাম বললে, কিষণ সিং। নিবাস আলমোড়ায়!

তাকে আদর করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলুম, কারণ এই কিষণ সিংই আমাকে বাবার মৃত্যু-সংবাদ জানিয়েছিলেন এবং অন্তিমকালে বাবার সেবা-শুশ্রুষা করেছিলেন।

তাঁর মুখে বাবার মৃত্যুর যে শোচনীয় কাহিনি শুনলুম এখানে সে কথাও বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। নিজের দুঃখ আমার নিজের বুকের ভিতরেই লুকানো থাক।

সমস্ত শোনবার পরে কিষণ সিংকে জিজ্ঞাসা করলুম, তিনি কেন এত দূরে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?

কিষণ সিং ভাঙা ভাঙা বাংলায় যা বললেন তার মর্ম হচ্ছে এই: ‘বাবুজি, তারিণীবাবু যখন মারা যান, তার একটু আগেই আমাকে ডেকে বললেন, ‘কিষণ সিং, তুমি নিঃস্বার্থ ভাবে অন্তিমকালে আমার যে সেবা করলে, তার পুরস্কার ভগবানই তোমাকে দেবেন। কিন্তু তুমি যদি আমার আর একটি উপকার করো, তাহলে তোমাকে আমি কিছু পুরস্কার দিতে পারি। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কী উপকার? তারিণীবাবু বললেন, 'আমার পকেটে আটশো টাকার নোট আছে। তোমরা সদলবলে এসে পড়াতে ডাকাতরা সেগুলো নিয়ে যেতে পারেনি। ওই পকেটেই একটি বড়ো ফাউন্টেন পেনও আছে। পাঁচশো টাকা আর ওই ফাউন্টেন পেনটি নিয়ে তুমি যদি দেশে গিয়ে আমার ছেলেকে দিয়ে আসতে পারো, তাহলে বাকি তিনশো টাকা তোমাকে আমি পুরস্কার দিয়ে যাব। আমি বললুম, বাবুজি, পুরস্কার পাবার আশায় আমি অসময়ে আপনার উপকার করতে চাই না। ও টাকা আর কলম আমি ডাকে আপনার ছেলের কাছে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু তারিণীবাবু বললেন, না কিষণ সিং, ও তিনশো টাকা তুমি না নিলে আমি মরেও শান্তি পাব না। আর ডাকে নয়, কলম আর টাকা তোমাকে নিজে গিয়ে আমার ছেলের হাতে দিয়ে আসতে হবে। তাকে বলবে, সে যেন তার বাপের এই শেষ দান কলমটিকে ভালো করে রেখে দেয়। তখন আমি বাধ্য হয়ে তার কথামতোই কাজ করব বলে স্বীকার করলুম। তারপর তারিণীবাবু আর বেশিক্ষণ বেঁচে ছিলেন না।...এই নিন বাবুজি, আপনার বাপের শেষ-দান পাঁচশো টাকা আর ফাউন্টেন পেন!

কিষণ সিং তাঁর পেট-কাপড়ের ভিতর থেকে পাঁচখানা একশো টাকার নোট আর একটি ফাউন্টেন পেন বার করে আমার হাতে দিলেন এবং আবার বললে, বাবুজি, বাকি তিনশো টাকাও আমি সঙ্গে করে এনেছি। আমি গরিব মানুষ, তিনশো টাকা আমার কাছে অনেক টাকা। কিন্তু উপকারের দামের মতন ও-টাকা নিতে আমার মন সরছে না।

সেই দরিদ্র সাধু কিষণ সিংয়ের হাত ধরে আমি অভিভূত স্বরে বললুম, কিষণ সিং, তুমি দেবতা! ও-সমস্ত টাকাই তুমি যদি নিজে যেচে না দিতে, তাহলে তো আমি কিছুই জানতে পারতুম না। কিন্তু আমার বাবা তোমাকে যা দিয়ে গেছেন, আমি কিছুতেই তা আর ফিরিয়ে নিতে পারব না।

কিষণ সিং সেইদিন সন্ধ্যার সময়েই বিদায়গ্রহণ করলেন। যাবার সময়ে বলে গেলেন, ‘বাবুজি, একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। তারিণীবাবু মারা যাবার আগে আর একবার বলেছিলেন, ও-কলমটা আপনি খুব সাবধানে রাখবেন যেন ওটা হারিয়ে না যায়?

আমারও আর একটা কথা মনে পড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলুম, আচ্ছা কিষণবাবু, একটা কথা বলতে পারেন? আমার বাবা যখন মারা যান, তখন সেখানে ভৈরববাবু বলে কোনও বাঙালি ভদ্রলোক হাজির ছিলেন?

কিষণ সিং বললেন, বাঙালি ভদ্রলোক? আপনার বাবা মারা যান আমার বাসায়। তিনি ছাড়া আর কোনও বাঙালিই সেখানে ছিলেন না! শুনে বিস্মিত হলুম। কিষণ সিং চলে যাবার পরেও মনের ভিতরে অনেকক্ষণ ধরে বারংবার এই প্রশ্নই জাগতে লাগল--কে এই ভৈরববাবু, কী তার উদ্দেশ্য?

সেদিন সারাদিন আকাশে মেঘ জমেছিল। সন্ধ্যার পর থেকেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। একে পল্লিগ্রাম, তায় দুর্যোগের রাত। চারিদিক খুব শীঘ্রই নিসাড় হয়ে পড়ল—একটা কুকুরেরও চিৎকার পর্যন্ত শোনা যায় না।

বাবার শেষ স্মৃতিচিহ্ন সেই কলমটি নিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলুম, বাবার সঙ্গে তো আরও অনেক জিনিস ছিল, কিন্তু তিনি এই কলমটি বিশেষ করে আমাকে দিয়ে গেলেন কেন? আর এই কলমটিকে খুব সাবধানে রাখতেই বা বলে গেলেন কেন?

এই-সব কথা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, হঠাৎ বাহির থেকে তীব্র ও উচ্চ এক আর্তনাদে চতুর্দিকের স্তব্ধতা যেন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।

বলেছি, আমাদের বাড়ি নদীর ঠিক উপরেই। আর্তনাদটা এল নদীর দিক থেকেই।

ধড়মড় করে উঠে বসে জানলা খুলে দিলুম। হু-হু করে জোলো বাতাস ঘরের ভিতরে ছুটে এল। বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করলুম, কিন্তু সেই নিরেট অন্ধকার ভেদ করে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলুম না!

আবার সেই ভয়ানক আর্তনাদ!

বেশ শুনলুম, কে যেন আর্তস্বরে চেঁচিয়ে বলছে—দিলীপবাবু! বাবুজি! রক্ষা করো, রক্ষা করো!

এ যে সেই কিষণ সিংয়ের গলা!

এক লাফে খাট থেকে নীচে নেমে পড়ে একগাছা মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে তখনই আমি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলুম। বেগে ছুটতে ছুটতে যখন নদীর ধারে গিয়ে পড়লুম, তখন চারিদিক আবার নীরব হয়ে পড়েছে কারুর কোনও আর্তনাদই শোনা যাচ্ছে না! নদীর কলকল শব্দ আর বৃষ্টির টিপটিপ ধ্বনি ও থেকে থেকে বাতাসের হাহাকার ছাড়া এই অন্ধ পৃথিবীর কোথাও আর কেউ যেন জেগে নেই।

এখন এখানে বিদেশি কিষণ সিং কী করতে পারে? এবং অমন বিপদগ্রস্তের মতো আমারই বা নাম ধরে ডাকবে কেন? সে কি জলপথে এখান থেকে যাচ্ছিল, হঠাৎ ঝড়ে নৌকো ডুবে গেছে?

লাঠির উপরে ভর দিয়ে খানিকক্ষণ সেইখানে দাঁড়িয়ে রইলুম, কিন্তু রাত্রের নিস্তব্ধতা আর কেউ ভাঙলে না। তখন আমারই শুনতে ভুল হয়েছে ভেবে ধীরে ধীরে আবার বাড়ির দিকে ফিরে এলুম।

হঠাৎ খানিক তফাত থেকে আমার বাড়ির দোতলার ঘরের দিকে চোখ গেল। আমার শয়নগৃহের খোলা জানলা দিয়ে দেখা গেল, ঘরের ভিতরে একটা আলো নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে! যেন কেউ ল্যাম্পটা নিয়ে ঘরের ভিতরে এদিকে-ওদিকে চলা-ফেরা করছে।

সেদিন আমার চাকরটা পর্যন্ত ছুটি নিয়ে কোথায় নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল—বাড়িতে ছিলুম আমি কেবল একা! তবে এ কী কাণ্ড? আমার শোবার ঘরে কে ঢুকেছে? আলো জ্বেলে ঘুরেফিরে কী খুঁজছে?

দ্রুতপদে আবার বাড়ির দিকে ছুটলুম-অমনি অন্ধকারের ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ স্বরে বাইরের কোথায় একটা বাঁশি বেজে উঠল—সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘরের আলোটা দপ করে নিবে গেল!

আমি প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলুম—চোর, চোর, চোর!

সেই অন্ধকারের ভিতরেই অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনলুম-যেন কারা ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে! তাহলে চোরেদের দলে অনেক লোক আছে?

তাদের ধরবার চেষ্টা করা বৃথা বুঝে আমি আবার নিজের বাড়িতেই ফিরে এলুম। উপরে উঠে দেখলুম, আমার শয়নঘরে আর আলো জ্বলছে না!

ফের আলো জ্বেলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলুম, ঘরের মেঝেতে অনেকগুলো কাদামাখা পায়ের দাগ! নিশ্চয় এখানে কারা এসে ঢুকেছিল!

কিন্তু, কেন? আমার মতন গরিব মানুষের বাড়ি হঠাৎ যত চোরের তীর্থের মতো হয়ে উঠল কেন?

যারা এসেছিল তারা যে ঘরের জিনিসপত্তর ঘেঁটে গেছে, তাও বেশ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই তো হারায়নি!

তবে?

হঠাৎ টেবিলের উপরে নজর পড়ল। সেখানে আমার তিনটে ফাউন্টেন পেন ছিল, কিন্তু এখন একটাও দেখা যাচ্ছে না! ...তবে কি অতগুলো চোর এসেছিল শুধু ওই তিনটে ফাউন্টেন পেন চুরি করতে? না, আমি এসে পড়াতে তারা আর কিছু নিয়ে পালাতে পারেনি? ...সেদিনের চোরেরা চুরি করলে একটুকরো কাগজ, আর আজকের চোরেরা নিয়ে গেল কেবল তিনটে কলম! চোরেদের ঘরে কি কাগজ-কলমের এতই অভাব?

বাবার সেই কলমটির কথা মনে পড়ে গেল। বাইরে আর্তনাদ শুনে কলমটা আমি তাড়াতাড়ি বালিশের তলায় খুঁজে রেখে বেরিয়ে গিয়েছিলুম। ছুটে গিয়ে বালিশ তুলে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুমনা, বাবার শেষ-স্মৃতিচিহ্ন যথাস্থানেই আছে, চোরেরা তার সন্ধান পায়নি!

পরের দিন নদীর ধারে বিষম একটা হট্টগোল শুনে গিয়ে যা দেখলুম তা আবার বর্ণনা করতে-বা মনে আনতেও দুঃখ-কষ্টে বুক যেন ভেঙে যায়।

ঘাটের তলায় একটা মৃতদেহ ভাসছে, তার সর্বাঙ্গে নিষ্ঠুর আঘাতের চিহ্ন! আর, সে মৃতদেহ হচ্ছে পরোপকারী, ধার্মিক ও নিরীহ কিষণ সিংয়ের! নিজের বাক্যরক্ষা ও আমার উপকার করতে এই বিদেশ-বিভুয়ে এসে হতভাগ্যের আজ প্রাণ গেল! বেচারা এখানকার আর কারুকেই চেনেন না, তাই মৃত্যুকালেও তিনি আমারই নাম ধরে ডেকে সাহায্যভিক্ষা করেছিলেন, কিন্তু সে আর্ত-প্রার্থনা শুনেও আমি তার কোনও উপকারই করতে পারিনি। এ-অনুতাপ আমার জীবনেও যাবে না। আমি মহাপাপী!

বিমলবাবু, কুমারবাবু! এখন বুঝতে পারছেন তো, কেন আমি দেশ ছেড়ে আপনাদের কাছে ছুটে এসেছি? কিষণ সিংয়ের হত্যাকাণ্ডের পরেও দেশে থাকতে আর আমার ভরসা হয়নি। আমি বেশ বুঝতে পারছি, কোনও সাংঘাতিক শত্রুর শনিদৃষ্টি পড়েছে আমার উপরে! এ শত্রু যেমন সহজে চুরি করে, তেমন সহজেই করে মানুষ খুন! অষ্টপ্রহর মনে হচ্ছে, এরা যেন আমার চারপাশে ওত পেতে বসে আছে, আমার প্রত্যেক গতিবিধি লক্ষ করছে এবং যে-কোনও মুহূর্তে রক্তপিপাসু পিশাচের মতো আমার ঘাড়ের উপরে লাফিয়ে পড়তে পারে!

কারণ কিষণ সিংয়ের হত্যাকাণ্ডের পরেও দেখেছি, সন্ধ্যা হলেই কারা যেন আমার বাড়ির কাছে আনাচে-কানাচে ঝোপেঝাপে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়! রাত্রে আচমকা ঘুম ভেঙে যায়, ছাদে যেন কাদের পায়ের শব্দ শুনি, কে, কে? বলে চেঁচিয়ে উঠি, আবার পায়ের শব্দ শুনি, কারা যেন তাড়াতাড়ি পালিয়ে যায়।

কে ওই ভৈরববাবু? জীবনে কখনও তাঁকে দেখিনি, বাবার মুখেও তার নাম শুনিনি! কিন্তু তিনি কেমন করে বাবার মৃত্যুর কথা, কিষণ সিংয়ের কথা আর আমার কথা জানলেন? আমার কাগজপত্র ও বিশেষ করে সেই হাতে-আঁকা ম্যাপ দেখবার জন্যে তার অত আগ্রহ কেন? আর সেই ম্যাপখানা তারপরেই চুরি গেল কেন? কোথাকার ম্যাপ সে-খানা? লোহার সিন্দুকের মধ্যে সেখানাকে অত যত্ন করে রাখাই হয়েছিল কেন?

আমার বাবার শোচনীয় মৃত্যুর মধ্যে কি কোনও রহস্যময় কারণ আছে? এত জিনিস থাকতে তিনি মৃত্যুর সময়ে আমায় একটা ফাউন্টেন পেন পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন কেন? আর কলমটা অতি-সাবধানে রক্ষা করতেই বা বললেন কেন? এ-রকম ফাউন্টেন পেন তো পৃথিবীর সর্বত্রই প্রত্যহ হাজার হাজার বিক্রি হচ্ছে!

কিষণ সিংকে কে হত্যা করলে—কেন হত্যা করলে?

আর সেই হত্যাকাণ্ডের প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আমার বাড়িতে একদল চোর ঢুকে কেবল তিনটে ফাউন্টেন পেন নিয়েই সরে পড়ল কেন? তারা কি বাবার সেই কলমটাই খুঁজতে এসেছিল?

কিন্তু, কেন? এই-সব প্রশ্নের কোনও সদুত্তরই পাওয়া যাচ্ছে না।

শুনেছি, আপনারা এইরকম রহস্যময় অনেক ঘটনার কিনারা করেছেন। এখন আপনারাই বলুন, আমার কর্তব্য কী?

আমি একেবারে অন্ধকারে পড়ে আছি। হয়তো আমার জীবনও নিরাপদ নয়। নিজের অজ্ঞাতসারেই আমি এ কোন অপূর্ব ও বিপজ্জনক নাটকের নায়ক হয়ে পড়েছি?