প্রধান পাত্রগণের পরিচয়
বিমল ও কুমার স্থির করেছে, এ-জীবনে তারা বিবাহ করবে না।
সকলেই জানেন, তাদের জীবন হচ্ছে মহা-ডানপিটের জীবন এবং সে জীবন হচ্ছে সত্যসত্যই পদ্মপাতায় জল বিন্দুর মতো, যে কোনও মুহূর্তে টুপ করে ঝরে পড়তে পারে! যে-সব ভয়াবহ বিপদ মানুষের কল্পনারও অতীত, তাদেরই সঙ্গে দিন-রাত তাদের কারবার। তারা কখনও পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলগ্রহে যায় এবং যখন পৃথিবীতেও থাকে তখন কখনও যায় ময়নামতীর মায়াকাননে আদিম দানব-জীবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে, কখনও মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে যকের ধনের সন্ধানে আসামের পরিত্যক্ত বৌদ্ধমঠে বা আফ্রিকার অসভ্য মানুষ ও সিংহ-হিপোগরিলার দেশে এবং কখনও হিমালয়ের মেঘাবৃত শিখরে উঠে দেখা করে ভয়ঙ্কর নর-দৈত্যদের সঙ্গে।
এমন অসাধারণ জীবন নিয়ে সাধারণ মানুষের মতো বিবাহ করা চলে না। কোথায় থাকবে। তারা, আর কোথায় থাকবে তাদের বউ? হয়তো কবে তারা উত্তর মেরুর তুষার-মরুর মধ্যে পথ হারিয়ে শ্বেত-ভাল্লুকদের দেশে মাসের পর মাস প্রবাস-যাপন করতে বাধ্য হবে, আর এদিকে তাদের বউরা ঘরের কোণে বসে চোখের জলে বুক ভাসাতে থাকবে। হয়তো কবে তাদের খেয়াল হবে চন্দ্রলোকে যাবার জন্যে, আর খেয়ালমতো কাজ করে এ-জন্মে আর দেশে ফিরে আসা হবে না! তখন স্বামী থাকতেও তাদের বউদের হতে হবে অনাথা বিধবার মতো! এইসব বুঝেসুঝেই তারা পণ করে বসেছে, এ-জীবনে কোনওদিন টোপরও পরবে না-- গাঁটছড়া বাঁধবে না!
কিন্তু তারা ধনী এবং বিখ্যাত। তাদের নাম জানে না দেশে এমন লোক নেই। এ-রকম দুটি সৎপাত্র যে চিরকুমার হয়ে পাওনাগণ্ডা থেকে তাদের ফাঁকি দেবে, ঘটকঠাকুররা মোটেই এমন অভাবিত ব্যাপার ভাবতে রাজি নন!
অতএব ঘটকের দল বিমল ও কুমারকে প্রায়ই বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করতে ছাড়ে না। কিন্তু তারা যে কী উপায়ে ঘটকদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করে, আজকের এই ঘটনা থেকেই সেটা বেশ জানা যাবে।
কুমার চেঁচিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে ও বিমল দুই চক্ষু মুদে টেবিলের উপরে দুই পা তুলে দিয়ে চেয়ারে বসে বসে শুনছে, এমন সময়ে আচম্বিতে হল এক ঘটকের আবির্ভাব।
কুমারের শিথিল হাত থেকে ফস করে খসে পড়ল খবরের কাগজ এবং বিমলের পা দুটো আবার টপ করে নেমে পড়ল টেবিলের তলায়! ঘটকঠাকুর তার সাড়ে তেরোটা তালি-মারা বাটভাঙা বেরঙা ছাতাটা সযত্নে ক্রোড়দেশে রক্ষা করে একখান চেয়ারের উপরে এমন জাঁকিয়ে উপবেশন করলে যে বেশ বোঝা গেল, অতঃপর বহুক্ষণের মধ্যে সে আর ওঠবার নাম মুখেও আনবে না। দুই বন্ধুর অবস্থা হল বিরাট হাউইটজার কামানের মুখে অসহায় দুই আসামির মতো!
বিমল ও কুমার অনেকক্ষণ ধরে আপত্তি জানিয়েও সেই নাছোড়বান্দা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ঘটককে বিদায় করতে পারলে না।
বিমল তখন নাচার হয়ে বললে, আচ্ছা, আমি বিয়ে করতে রাজি। কিন্তু বউটি আমার মনের মতো হওয়া চাই।
ঘটক খুব খুশি হয়ে আনন্দ-গদগদ স্বরে বললে, আমার হাতে সবচেয়ে ভালো যে পাত্রীটি আছে, তাকে নিশ্চয়ই আপনার পছন্দ হবে। সে তো যে সে বউ নয়, একেবারে ডানাকাটা পরী!
বিমল গম্ভীর হয়ে বললে, পাত্রী এরোপ্লেন চালাতে জানে?
ঘটক আকাশ থেকে পড়ে বললে, সে কী বাবু, বাঙালির মেয়ে এরোপ্লেন চালাবে কী?
পাত্রী বন্দুক ছুঁড়তে পারে?
ঘটক মাথা নেড়ে বললে, নিশ্চয়ই পারে না। তবে আপনি শেখালে শিখতে পারে।
সে ঘোড়ায় চড়তে, কুস্তি আর বক্সিং লড়তে পারে?
ঘটক বিস্ময়ের চরমে উঠে বললে, ঘরের বউ কুস্তি লড়বে কী!
বিমল দৃঢ়স্বরে বললে, তাহলে আপনি পথ দেখতে পারেন। যে-মেয়ে ও-সব বিদ্যে জানে না, তার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া অসম্ভব।
ঘটক কুমারের দিকে ফিরে বললে, মশায়েরও কি ওই মত?
কুমার বললে, আমরা দুজনে একসঙ্গে খাই, একসঙ্গে বেড়াই, একসঙ্গে ঘুমোই-মরবারও সাধ আছে একসঙ্গে। কাজেই আমাদের মতামতও একরকম।
ঘটক তবু হাল ছাড়তে রাজি না হয়ে বললে, কিন্তু বিমল বাধা দিয়ে বললে, আর কিন্তু টিন্তু নয়! আপনার বিদায় নিতে দেরি হচ্ছে বলে ওই দেখুন বাঘা নিজেই খবরদারি করতে এসেছে!
ঘটক ফিরে দেখলে ঠিক তার চেয়ারের পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে প্রকাণ্ড একটা কুকুর, মস্ত মস্ত ধারালো দাঁত বার করে! সে দাঁতগুলো দেখবার পরেও আর কোনও যুক্তি দেখানো চলে না! অতএব ঘটক হতাশ ভাবে উঠে ঘর থেকে সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল।
কুমার হাসতে হাসতে আবার খবরের কাগজখানা তুলে নিলে এবং বিমল আবার দুই চক্ষু মুদে টেবিলের উপরে দুইপা তুলে দিলে। কিন্তু কুমার পড়া শুরু করবার আগেই পুরাতন ভৃত্য রামহরি ঘরের ভিতরে ঢুকে বললে, খোকাবাবু, একটি বাবু দেখা করতে চান। বিমল আজ আর খোকা নয়, কিন্তু রামহরি তার পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে নারাজ।
বিমল বিরক্ত স্বরে বললে, আবার কোন মহাপ্রভু জ্বালাতে এলেন? ঘটক-টটক নয় তো?
কুমার বললে, তাহলে হয়তো কোনও কনের বাপ এসেছে। ঘটকের কাছে পার আছে কিন্তু কনের বাপের হাত ছাড়ানো সোজা নয়! হয়তো এসেই দু পা জড়িয়ে ধরবে!
শুনেই বিমল চমকে উঠে টেবিলের উপর থেকে নিজের পা দুটো নামিয়ে ফেলে তাড়াতাড়ি আবার চেয়ারের তলায় ঢুকিয়ে দিলে!
রামহরি হেসে ফেলে বললে, না, যে-বাবুটি এসেছেন, সে-বাবুটি তোমাদেরই বয়সি হবেন। এত কম বয়সে কেউ কনের বাপ হতে পারে না!
রামহরি বললে, না, বাবুটিকে ঘটক বলে তো মনে হচ্ছে না! বিমল আশ্বস্ত স্বরে বললে, আচ্ছা, লোকটিকে নিয়ে এসো।
ঘরের ভিতরে যে-লোকটি এসে ঢুকল তার বয়স বাইশ-তেইশের বেশি হবে না। জোয়ান চেহারা, ফরসা রং।
আগন্তুক ঘরে ঢুকেই বললে, আপনি বিমলবাবু, আর আপনি কুমারবাবু তো? কাগজে আপনাদের ফটো আমি দেখেছি।
কুমার হেসে বললে, দেখছি আমরা বড়োই বিখ্যাত হয়ে পড়েছি। কিন্তু আপনার নাম আর এখানে আসবার কারণ তো আমরা জানি না।
আগন্তুক বললে, আমার নাম হচ্ছে দিলীপকুমার চৌধুরী, দেশ রাধানগর। বিশেষ এক বিপদে পড়ে আপনাদের কাছে ছুটে এসেছি।
বিপদের নাম শুনেই বিমল সাগ্রহে উঠে সোজা হয়ে বসল।
কুমার বললে, বিপদে পড়ে আমাদের মতো অচেনা লোকের কাছে এসেছেন কেন?
দিলীপ বললে, আপনাদের সঙ্গে চোখাচোখি দেখা না হলেও বাংলা দেশের কারুর কাছেই আপনারা বোধ হয় অচেনা নন। আপনাদের অদ্ভুত কার্তিকলাপ কে না জানে? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার এই বিপদে আপনারা যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন।
কুমার বললে, তাহলে আর বাজে কথা না বলে, গোড়া থেকে আপনার বিপদের সব কথা খুলে বলুন। কিছু লুকোবেন না, কারণ সমস্ত না জানলে আমরা আপনার কোনও উপকারেই লাগব না।
দিলীপ বললে, মশাই, এসে পর্যন্ত দেখছি, একটা মস্ত-বড়ো বিশ্রী কুকুর দরজার ফাক দিয়ে কটমট করে আমার পানে তাকিয়ে আছে। ওটাকে তাড়িয়ে দিন, নইলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে কোনও কথা বলতে পারব না।
কুমার ফিরে দেখলে, তাদের প্রিয় কুকুর বাঘা দরজার ওপাশে মাটির উপরে সামনের দুই থাবা পেতে বসে অত্যন্ত গম্ভীর মুখে দিলীপকে নিরীক্ষণ করছে! সে হেসে উঠে বললে, আপনি আমাদের চেনেন, ওকে চেনেন না! ও যে আমাদের বাঘা!
বাঘা! কিন্তু ও যে দেখছি নেড়ি কুত্তা!
কুমার গম্ভীর স্বরে বললে, বাঘা, বাঘা আমাদেরই মতো নেটিভ বটে! আমরা স্বদেশের ধুলোকেও ভালোবাসি, তাই বিলিতি কুকুর পুষি না। আমরা হচ্ছি কবি ঈশ্বর গুপ্তের ভক্ত। আমরা—তাঁর ভাষায় :
কত রূপ স্নেহ করি,
দেশের কুকুর ধরি,
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া!
কোনও বিলিতি কুকুরই বাঘার চেয়ে বুদ্ধিমান আর জোয়ান নয়। আপনি চেয়ারে বসে নির্ভয়ে সব কথা বলুন, বাঘাকে কোনও ভয় নেই, ও খালি আপনার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে--আপনি ভালো, না মন্দ লোক!
দিলীপ আর কিছু না বলে একখানা চেয়ারের উপরে বসে নিজের কাহিনি শুরু করলে।