অমাবস্যার রাত Omaboswar Raat by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name পাঁচ - মানুষ শিকার

পাঁচ - মানুষ শিকার

বাঘের ডাক আর মানুষের আর্তনাদ থামতে-না-থামতেই সারি সারি লন্ঠনের ও বিজলীমশালের (ইলেকট্রিক টর্চ) আলোতে চারিদিকের অন্ধকার যেন খণ্ড খণ্ড হয়ে গেলো! ঝোপঝাপের ভিতর থেকে দলেদলে পুলিশের লোক গোলমাল করতে করতে বেরিয়ে আসতে লাগলো।

কুমারও তর তর করে গাছের উপর থেকে নেমে এলো। কিন্তু নেমে এসে গাছের নিচে চৌকিদারকে আর দেখতে পেলে না। নিশ্চয়ই বাঘের ডাক শুনেই পৈতৃক প্রাণটি হাতে করে সে চম্পট দিয়েছে।

মুখ তুলেই দেখে, চন্দ্ৰবাবু একহাতে রিভলভার আর এক হাতের বিজলী-মশাল নিয়ে ছুটতে ছুটিতে তার দিকেই আসছেন।

কাছে এসেই চন্দ্ৰবাবু উত্তেজিত স্বরে বললেন, কুমার, তুমিই কি বন্দুক ছুড়েছ?

কুমার বললে, আজ্ঞে হাঁ। আমি বাঘটাকে দেখেই বন্দুক ছুঁড়েছি, কিন্তু আর্তনাদ করে উঠলে একজন মানুষ!

বাঘাটাকে তুমি কোনখানে দেখেছ!

খুব কাছেই। ঐ যে, ঐখানে!

চন্দ্ৰবাবু সেইদিকে বিজলী-মশালের আলো ফেলে বললেন, কই, ওখানে তো বাঘের চিহ্নও নেই। কিন্তু মাটির ওপরে ওখানে কে বসে আছে?--দু-পা এগিয়েই তিনি বিস্মিত স্বরে বললেন, আরে এ যে আমাদের পটলবাবু!

কুমার এগিয়ে দেখলে পটলবাবু মাটিতে বসে গায়ের চাদরখানা দিয়ে নিজের ডান পাখানা বাঁধবার চেষ্টা করছেন।

চন্দ্ৰবাবু বললেন, এ কি পটলবাবু, আপনি এখানে কেন? আপনার পায়ে কি হয়েছে, চাদর জড়াচ্ছেন যে!

পটলবাবু যন্ত্রণায়মুখ বিকৃত করে বললেন, যে-জন্যে আপনারা এখানে, আমিও সেইজন্যেই এখানে এসে লুকিয়েছিলুম! কিন্তু ঐ ভদ্রলোক যে গুলি করে আমার একখানা পায়ের দফা একেবারে রফা করে দেবেন তা তো জানতুম না! গুলিটা যদি আমার মাথায় কি বুকে লগত তা হলে কি হতো বলুন?

কুমার অপ্রস্তুতস্বরে বললে, কিন্তু আমি যে স্বচক্ষেবাঘটাকে দেখেই বন্দুক ছুঁড়েছি! আপনার পায়ে কেমন করে গুলি লাগলো কিছুই তো বুঝতে পারছি না!

ক্রুদ্ধস্বরে পটলবাবু বললেন, বাঘকে দেখে বন্দুক ছুঁড়েছেন না, ঘোড়ার ডিম করেছেন! কাছেই কোথায় একটা বাঘ ডেকেছিল বটে, কিন্তু এখানটায় কোনো বাঘ আসেনি। এখানে বাঘ এলে আমি কি দেখতে পেতুম না? আপনি স্বপ্নে বাঘ দেখে আৎকে উঠেছেন!

ঠিক মাথার উপরকার একটা গাছ থেকে কে বলে উঠল, না, কুমারবাবু সজাগ হয়েই বাঘ দেখেছেন-আমিও সজাগ হয়েই বাঘ দেখেছি। পটলবাবু যেখানে বসে আছেন, বাঘটা ঠিক ঐখানেই এসে দাঁড়িয়েছিলো!

সকলে আশ্চর্য হয়ে উপর পানে তাকিয়ে দেখলে, গাছের গুড়ি ধরে একজন লোক নিচে নেমে আসছে!

চন্দ্রবাবু সবিস্ময়ে বললেন, একি, মোহনলালবাবু যে! গাছের ওপরে চড়ে আপনি এতক্ষণ কী করছিলেন।

কুমারের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে মোহনলাল বললে, গাছে বসে ঐ ভদ্রলোকও যা করছিলেন, আমিও তাই করছিলুম। অর্থাৎ দেখছিলুম বিপদ কোনদিক দিয়ে আসে!

মোহনলালের বয়স হবে প্রায় চুয়াল্লিশ, মাথায় কাঁচা-পাকা বাবরি-কাটা চুল, মুখেও কাঁচাপাকা গোঁফ ও ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি, রং শ্যামবর্ণ, দেহখানি খুব লম্বা-চওড়া-দেখলেই বোঝা যায়, বয়সে পৌঢ় হলেও তাঁর গায়ে রীতিমতো শক্তি আছে।

চন্দ্ৰবাবু বললেন, আপনি বাঘের কথা কি বলছিলেন না?

মোহনলাল বললে, হাঁ। পটলবাবু যেখানে বসে আছেন, বিদ্যুতের আলোতে ঠিক ঐখানেই আমি একটা মস্ত বড় বাঘকে স্বচক্ষে দেখেছি। তারপরেই বন্দুকের আওয়াজ হল-সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম বাঘের গর্জন আর মানুষের আর্তনাদ! তারপরে এখন দেখছি, এখানে বাঘের বদলে রয়েছেন পটলবাবু।”

পটলবাবুর মরা মানুষের-চোখের মতো চোখদুটো হঠাৎ একবার জ্যান্ত হয়ে উঠেই আবার ঝিমিয়ে পড়ল। তারপর তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন, এখানে যে বাঘ-টাঘ কিছু আসেনি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছি আমি নিজে। বাঘটা এখানে এলে আমি এতক্ষণ জ্যান্ত থাকতুম না।

চন্দ্ৰবাবুও সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, পটলবাবুর এ যুক্তি মানতে হবে। আপনারা দুজনেই ভুল দেখেছেন!

পটলবাবু বললেন, দুজনে কেন, একশো জনে ভুল দেখলেও কোনো ক্ষতি ছিল না, কিন্তু সত্যি-সত্যি বন্দুক ছোড়াটা অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। এঃ, আমার ঠ্যাংখানার দফা একেবারে রফা হয়ে গেছে---উঃ! আমি যে আর উঠতেও পারছি না।

কুমার বেচারী একদম হতভম্বের মতো হয়ে গেল! সে যে বাঘটাকে দেখেছে এবং তাকে দেখেই বন্দুক ছুঁড়েছে, এ-বিষয়ে তার কিছুমাত্ৰ সন্দেহ ছিলনা, অথচ অন্যের সন্দেহভঞ্জন করবার জন্যে কোনো প্রমাণই তার হাতে নেই।

মোহনলাল একটা বিজলী-মশাল নিয়ে মাটির উপরে ফেলে বলে উঠল, “এই দেখুন চন্দ্ৰবাবু, বাঘ যে এখানে এসেছিল তার স্পষ্ট প্রমাণ দেখুন! এই দেখুন, কাঁচামাটির ওপরে বাঘের থাবার দাগ! এই দেখুন, ঐ ঝোপটার ভেতর থেকে থাবার দাগগুলো এইখানে এগিয়ে এসেছে! কিন্তু কী আশ্চর্য! দেখুন চন্দ্ৰবাবু দেখুন!

চন্দ্ৰবাবুও বাঘের পায়ের দাগগুলো দেখে সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, এ কী ব্যাপার! পায়ের দাগ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে, বাঘট এদিক পানেই এসেছে বটে, কিন্তু সে যে এখান থেকে আবার ফিরে গেছে, পায়ের দাগ দেখে সেটা মনে হচ্ছে না তো!

আশেপাশে যে-লোকগুলো ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল তারা প্রত্যেকেই চমকে উঠল এবং সভয়ে বারংবার চারিদিকে তাকাতে লাগিল—কি-জানি বাঘটা যদি কাছেই কোনো জঙ্গলে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে!

পটলবাবু বললেন, বন্দুকের শব্দ শুনেই বাঘাটা হয়তো লম্বা একটা লাফ মেরে পাশের কোনো ঝোপের ভেতরে গিয়ে পড়েছে! কিন্তু এখানে কোনো বাঘ এসেছে বলে এখনো আমি মানতে রাজি নই-কারণ আমি নিজে কোনো বাঘ দেখিনি!

বাঘের পায়ের দাগগুলো আরো খানিকক্ষণ পরখ করে মোহনলাল বললে, না বাঘ যে এখানে এসেছিল, সে-বিষয়ে আর কোনোই সন্দেহ নেই! এখান থেকে সবচেয়ে কাছের ঝোপ হচ্ছে অন্তত চল্লিশ হাত তফাতে। কোনো বাঘই এক-লাফে অতদূর গিয়ে পড়তে পারে না! কিন্তু কথা হচ্ছে, বাঘাটা তবে গেল কোথায়?”

পটলবাবু বললেন, সে-কথা নিয়ে পরে অনেক মাথা ঘামাবার সময় পাবেন। আপাতত আপনারা আমাকে একটু সাহায্য করুন দেখি,-আমার আর দাঁড়াবার শক্তি নেই! এঃ, ঠ্যাংখানার দফা একেবারে রফা করে দিয়েছে দেখছি! কুমারবাবু, মস্ত শিকারী আপনি! বাঘ মারতে এসে মারলেন কিনা মানুষকে! আর মানুষ বলে মানুষ-একেবারে আমাকেই।

লজ্জায়, অনুতাপে কুমার মাথা না হেঁট করে পারলে না।

মোহনলাল কোনো দিকেই না চেয়ে আপনমনে তখনো বাঘের পায়ের দাগগুলো পরীক্ষা করতেই ব্যস্ত ছিল।

পটলবাবু টিটকিরি দিয়ে বললেন, বাঘের পা থেকে ধুলোয় দাগ হয় বটে, কিন্তু সে দাগ থেকে আর আস্ত বাঘ জন্মায় না মোহনলালবাবু! মিছেই সময় নষ্ট করছেন।

মোহনলাল মাথা না তুলেই বললে, আমার যেন মনে হচ্ছে, এই বাঘের পায়ের ভেতর থেকেই আসল বাঘ আমাদের কাছে ধরা দেবে!

পটলবাবুর মরা চোখ আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল ক্ষণিকের জন্যে—তিনি বললেন, বলেন কি মশাই? দাগ থেকে জন্মাবে আস্ত বাঘ, এ কোন যাদুমন্ত্রে?

মোহনলাল বললে, যে-যাদুমন্ত্রে মাটিতে পায়ের দাগ রেখে বাঘ শূন্যে উড়ে যায়!

চন্দ্ৰবাবু বললেন, কথা-কাটাকাটি করে লাভ নেই। চলুন, পটলবাবু, আপনি জখম হয়েছেন, আপনাকে আমরা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।

—ঠিক সেই মুহুর্তে দূর থেকে সুতীক্ষ্ন ফুটবল-বাঁশির আওয়াজ শোনা গেল। চন্দ্ৰবাবু সচমকে বলে উঠলেন, আমার গুপ্তচরের বাঁশি। সবাই ঝোপের ভেতর লুকিয়ে পড়—সবাই ঝোপের ভেতর লুকিয়ে পড়! শিগগির আলো নিবিয়ে দাও!

কুমার শুধোলে, ব্যাপার কি চন্দ্ৰবাবু? এ বাঁশির আওয়াজের মানে কি?

চন্দ্ৰবাবু বললেন, আমার গুপ্তচর বাঁশির সঙ্কেতে জানিয়ে দিলে যে, ভুলু-ডাকাতের দল এইদিকেই আসছে। তারা আসছে নিশ্চয় মোহনলালবাবুর বাড়ি লুঠ করতো! ...কিন্তু মোহনলালবাবু কোথায় গেলেন? পটলবাবুই বা কোথায়?

মোহনলাল ও পটলবাবু একেবারে অদৃশ্য! কুমার বললে, বোধ হয়, ভুলু-ডাকাতের নাম শুনেই ভয়ে তাঁরা চম্পট দিয়েছেন।

--তাঁই হবে। এসো কুমার, আমরাও এই ঝোপটার ভেতর গিয়ে অদৃশ্য হই’-বলেই কুমারের হাত ধরে টেনে চন্দ্রবাবু পাশেই একটা জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলেন!

বিপদের উপরে বিপদ! ঠিক সেই সময়ে আকাশের অন্ধকার মেঘগুলো যেন ছাঁদা হয়ে গেল-ঝুপ-ঝুপ করে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরে নিরানন্দের মাত্রা যেন পূর্ণ করে তুললে।

চন্দ্রবাবু বলেলেন, কুমার, তোমার বন্দুকে টোটা পুরে নাও-- এবার আর বাঘ নয়, হয়তো আমাদের মানুষ শিকারই করতে হবে।

কুমার বললে, সে-অভ্যাস আমার আছে। এর আগেও আমাকে মানুষ-শিকার করতে হয়েছে!