অমাবস্যার রাত Omaboswar Raat by হেমেন্দ্রকুমার রায় Hemendra Kumar Roy, chapter name দুই - বাঘার বিপদ

দুই - বাঘার বিপদ

খবরের কাগজখানা হাত থেকে নামিয়ে রেখে কুমার নিজের মনেই বললে, “এ প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করব, আমি ‘বঙ্গদেশ’-এর রিপোর্টার ঠিক আন্দাজ করেছেন, এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে-হাঁ,আশ্চর্য কোনো রহস্য! উপরি-উপরি বারোটি মেয়ে অদৃশ্য, অমাবস্যার রাত, অদ্ভুত বাঘের আবির্ভাব আর অন্তর্ধান, তার ওপরে আবার ভুলু-ডাকাতের দল। কারুর সঙ্গে কারুর কোনো সম্পর্ক বোঝা যাচ্ছে না, সমস্তই যেন অস্বাভাবিক কাণ্ড। ... এ-সময়ে বিমল যদি কাছে থাকত। কিন্তু আজ সাত আট দিন ধরে রামহরিকে নিয়ে সে যে কোথায় ডুব মেরে আছে, শিবের বাবাও বোধ হয় তা জানেন না!”

একখানা পঞ্জিকা নিয়ে তার ভিতরে চোখ বুলিয়ে কুমার আবার ভাবতে লাগল, হুঁ, পরশু। আবার অমাবস্যার রাত আসবে, মানসপুর থেকে হয়তো আবার এক অভাগী নারী অদৃশ্য হবে! আমার যে এখনি সেখানে উড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে! এমন একটা ‘অ্যাডভেঞ্চার’- এর সুযোগ তো ছেড়ে দিলে চলবে না, বিমলের কপাল খারাপ, তাই নিজের দোষেই এবারে সে ফাঁকে পড়লো, আমি কি করবো?...বাঘা, বাঘা!

বাঘা তখন ঘরের এককোণে বসে একপাল মাছির সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ করছিলো। মাছিদের ইচ্ছা, বাঘার গায়ের উপরে তারা মনের আনন্দে খেলা করে বেড়ায়, কিন্তু তার দেহটা যে মাছিদের বেড়াবার জায়গা হবে, এটা ভাবতেও বাঘা রাগে পাগল হয়ে উঠেছিলো। বড়ো-বড়ো হাঁ-করে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সে এক-একবারে একাধিক মাছিকে গ্রাস করে ফেলছিলো-কিন্তু মাছিরাও বিষম নাছোড়বান্দা, প্রাণের মায়া ছেড়ে ভন ভন ভন ভন করতে করতে বাঘার মাথা থেকে ল্যাজের ডগা পর্যন্ত বার-বার তারা ছেয়ে ফেলছিলো। যে-বাঘা আজ জলে-স্থলে শূন্যমার্গেকত মানব, দানব ও অদ্ভুত জীবের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে, বিমল ও কুমারের সঙ্গে যার নাম এই বাংলাদেশে বিখ্যাত, তুচ্ছ একদল মক্ষিকার আক্রমণ আজ তাকে যেরকম কাবু করে ফেলেছে। তা দেখলে শত্রুরও মায়া হবে! এমনি সময়ে কুমারের ডাক শুনে সে গা ও ল্যাজ ঝাড়তে ঝাড়তে তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।

কুমার বললে, বাছা বাঘা! বিমলও নেই রামহরিও নেই-খালি তুমি আর আমি! অমাবস্যার রাত, বাঘের গর্জন, ডাকাতের দল, মানুষের পর মানুষ অদৃশ্য! শুনে কি তোমার ভয় হচ্ছে?

বাঘা কান খাড়া করে মনিবের সব কথা মন দিয়ে শুনলে। কি বুঝলে জানি না, কিন্তু বললে, ঘেউ ঘেউঘেউ!

—বাঘা, এ বড়ো যে-সে ব্যাঘ্র নয়, বুঝেছো? এ তোমার চেয়েও চালাক! এ তিথি নক্ষত্র বিচার করে কাজ করে। এর সঙ্গে আমরা পাল্লা দিতে পারবো কি?

--ঘেউ ঘেউ ঘেউ!

—তার ওপরে আছে ভুলু-ডাকাতদের দল। পুলিশও তাদের কাছে হার মেনেছে, খালি তোমাকে আর আমাকে তারা গ্রাহ্য করবে কি ?

—ঘেউ ঘেউ ঘেউ! —বলেই বাঘা টপ করে মুখ ফিরিয়ে ল্যাজের ডগা থেকে একটা মাছিকে ধরে গপ করে গিলে ফেললে।

একখানা খাম ও চিঠির কাগজ বার করে কুমার লিখতে বসলে, —

ভাই বিমল,

একবার এক জায়গা থেকে দলে দলে মানুষ অন্তৰ্হিত হচ্ছিল শুনে সে ব্যাপারটা আমরা দেখতে গিয়েছিলুম। কিন্তু সেই কৌতুহলের ফলে বন্দী হয়ে আমাদের যেতে হয়েছিল পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলগ্রহে।

এবারেও মানসপুরে মানুষের পর মানুষ (কিন্তু কেবল স্ত্রীলোক) অদৃশ্য হচ্ছে। শুনেই আমার চড়ুকে পিঠ আবার সড়সড় করছে। আমি আর বাঘা তাই ঘটনাস্থলে চললুম। জানি না এবারেও আমাদের আবার পৃথিবী ছাড়তে হবে কি না!

খবরের কাগজের রিপোর্টও এই খামের ভিতরে দিলুম। এটা পড়লেই তুমি বুঝতে পারবে, কেন আমি তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করতে পারলুম না। আসছে পরশু অমাবস্যা, আজ যাত্রা না করলে যথাসময়ে মানসপুরে গিয়ে পৌঁছতে পারবো না।

বিমল, তোমার জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে। এবারের ‘অ্যাডভেঞ্চার’ এ তুমি বেচারি ফাঁকে পড়ে গেলে। কি আর করবে বলো, যদি প্ৰাণ নিয়ে ফিরি, আমার মুখে সমস্ত গল্প শুনো তখন।

ইতি--

তোমার

কুমার