চার - আধুনিক ব্যাঘ্র
অমাবস্যার রাত!
নিঝুম রাত করছে ঝাঁ ঝাঁ, নিরেট অন্ধকার করছে ঘুট্ ঘুট্!
তার ওপরে বিভীষিকাকে আরো ভয়ানক করে তোলার জন্যেই যেন কালো আকাশকে মুড়ে আরো-বেশি-কালো মেঘের পর মেঘের সারি দৈত্য-দানবের নিষ্ঠুর সৈন্য-শ্রেণীর মতো শূন্যপথে ধেয়ে চলেছে, দিশেহারা হয়ে!
মাঝে মাঝে দপদপ করে বিদ্যুতের পর বিদ্যুৎ জ্বলে জ্বলে উঠেছে-সে যেন জ্বালামুখী প্রেতিনীদের আগুন-হাসি।
যেন পৃথিবীময় পাগলের কান্না কেঁদে ছুটে ছুটে আর মাথা কুটে কুটে বুক চাপড়ে বেড়াচ্ছে!
...মানসপুর যেন এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে ডুবে প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে। সেখানে যে ঘরে ঘরে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হাতে করে সজাগ হয়ে বসে আছে, বাইরে থেকে এমন কোন সাড়াই পাওয়া যাচ্ছে না!
…খুব উঁচু একটা বটগাছের ডালে বসে কুমার নিজের রেডিয়মের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলে, রাত বারোটা বাজতে আর মোটে দশ মিনিট দেরি আছে!
বন্দুকটা ভালো করে বাগিয়ে ধরে কুমার গাছের ডালের উপরে যতটা-পারে সোজা হয়ে বসলো। সে নিজেই এই গাছটা পছন্দ করে নিয়েছে। যদি কোনো সাহায্যের দরকার হয়, তাই তার জন্যে চন্দ্রবাবু গাছের নিচেই এক চৌকিদারকে মোতায়েন রেখেছেন। ... এই গাছ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ ফুট দূরেই সেই নির্বোধ মোহনলালের বাসাবাড়ি। চন্দ্ৰবাবু নিজেও কাছাকাছি কোনো ঝোপঝাপের ভিতরে সদলবলে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন।
কুমার নিজের মনে মনেই বললে, আর আট মিনিট! আঃ, এ মিনিটগুলো যেন ঘড়ির কাঁটাকে জোর করে টেনে রেখেছে—এরা যেন তাকে এগুতে দিতে রাজি নয়। ... আর ছ’মিনিট! চন্দ্ৰবাবুর কথা যদি ঠিক হয়, তা হলে বারোটা বাজলেই সেই আশ্চর্য বাঘের চিৎকার শোনা যাবে। একেলে বাঘগুলোও কি সভ্য হয়ে উঠলো, ঘড়ি না দেখে মানুষের ঘাড় ভাঙতে বেরোয় না? ... হাওয়ার রোখা ক্রমেই বেড়ে উঠছে, গাছটা বেজায় দুলছে- শেষটা ধপাস করে প্রপাত ধরণীতলে না হই!... আর চারমিনিট!... আর তিনমিনিট… আর দুমিনিট!’-কুমারের হৃৎপিণ্ডটা বিষম উত্তেজনায় যেন লাফাতে শুরু করলে-ছিদ্রহীন অন্ধকারের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত আগ্রহদীপ্ত চোখদুটোকে ক্রমাগত বুলিয়ে সে তন্ন-তন্ন করে খুঁজতে লাগল—যে মূর্তিমান আতঙ্ক এখনি এখানে এসে আবির্ভূত হবে! কিন্তু তার কোনো খোঁজই মিললো না!
--আচ্ছা, বাঘ, যদি এদিকে না এসে অন্যদিকে যায়? কিন্তু যেদিকেই যাক, বাঘের ডাক তো আর সেতারের মিনমিনে আওয়াজ নয়, তার গর্জন আমি শুনতে পাবোই! আর বাঘের বদলে যদি এদিকে আসে ভুলু-ডাকাতের দল, তা হলেও বড় মন্দ মজা হবে না।!--আর আধ মিনিট!’
গোঁ-গোঁ-গোঁ-গোঁ করে আচম্বিতে ঝড় জেগে উঠে বটগাছটার উপরে ভীষণ একটা ঝাপটা মারলে-পড়তে পড়তে কুমার কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিলো!
--ঠিক রাত বারোটা!
--সঙ্গে সঙ্গে কান-ফাটানো এক ব্যাঘ্রের গর্জন! বাঘের ডাক যে এমন ভয়ানক আর অস্বাভাবিক হতে পারে, কুমারের সে-ধারণাই ছিলো না।--তার সমস্ত শরীর যেন শিউরে শিউরে মূৰ্ছিত হয়ে পড়বার মতো হলো!
আবার সেই গর্জন-একবার, দুইবার, তিনবার, সে গর্জন শুনে ঝড়ও যেন ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলো।
আকাশের কালো মেঘের বুক ছিঁড়ে ফালাফালা করে সুদীর্ঘ এক বিদ্যুতের লকলকে শিখা জ্বলে উঠলো--
এবং নিচের দিকে তাকিয়ে কুমার স্পষ্ট দেখলে, প্ৰকাণ্ড একটা ব্যাঘ্র সামনের জঙ্গলের ভিতর থেকে তীরের মতো বেরিয়ে এলো--
এবং অমনি তার বন্দুক ধ্রুম করে অগ্নিবৃষ্টি করলে!
--তার পরেই প্ৰথমে ব্যাঘ্রের গর্জন এবং সেই সঙ্গে মানুষের করুণ। আর্তনাদ।