তিন - পটলবাবু, চন্দ্ৰবাবু ও মোহনলাল
পরদিন কুমার মানসপুরে গিয়ে হাজির হলো।
সেখানে তখন ভীষণ বিভীষিকার সৃষ্টি হয়েছে।
আসছে কাল সেই কাল-অমাবস্যা আসছে এবং সেই অজানা শত্ৰু কাল আবার কোন পরিবারে গিয়ে হানা দেবে কেউ তা জানে না! সকলে এখন থেকে প্রস্তুত হচ্ছে, ধনীরা বাড়ির চারিদিকে ডবল করে পাহারা বসাচ্ছে, সাধারণ গৃহস্থদের কেউ কেউ সপরিবারে স্থানান্তরে পালাচ্ছে এবং কেউ কেউ বাড়ির মেয়েদের গ্রামান্তরে পাঠিয়ে দিচ্ছে-কারণ এই অদ্ভুত শত্রুর দৃষ্টি কেবল মেয়েদের দিকেই।
বিপদ থেকে আত্মরক্ষণ করা যায়, তাই নিয়ে তাদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা ও তর্কাতর্কির অন্ত নেই। চারিদিকে এখন থেকেই সরকারী চৌকিদারের সংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ বা ত্ৰিগুণ। কুমার আগে ঘুরে ঘুরে সমস্ত মানসপুরের অবস্থাটা ভালো করে দেখে নিলে। অধিকাংশ স্থানেই একটি লোকের মূর্তি বার বার তার চোখে পড়লো। সে-লোকটি খুব সপ্রতিভা ও ব্যস্তভাবেই সর্বত্র ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, এবং কোন দিক দিয়ে বিপদ আসবার সম্ভাবনা, সে-সম্বন্ধে ‘পল্লী-রক্ষা-সমিতি’র যুবকগণকে নানান রকম পরামর্শ দিচ্ছে।
একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে কুমার জানলে যে, তার নাম পটলবাবু। ধনী না হলেও গাঁয়ের একজন হোমরা-চোমরা মাতব্বর ব্যক্তি এবং ‘পল্লী-রক্ষা-সমিতি’র প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
কিন্তু পটলবাবুর চোখে কুমার এমন একটি বিশেষত্ব আবিষ্কার করলো, যা সে আর কোনো মানুষের চোখে দেখেনি।
পটলবাবুর গাঁয়ের রং মোষের মতো কালো, তাঁর দেহখানি লম্বায় খুব খাটো কিন্তু আড়ে বেজায় চওড়া, মাথায় ইস্পাতের মতো চকচকে টাক, কিন্তু ঠোঁটের উপরে ও গালে জানোয়ারের মতো বড়ো-বড়ো চুল—যেন তিনি বিপুল দাড়ি-গোঁফের দ্বারা মাথার কেশের অভাবটা পূরণ করে নিতে চান!
কিন্তু পটলবাবুর চেহারার মধ্যে আসল দ্রষ্টব্য হচ্ছে তার দুই চোখ। পটলবাবুর হাত-পা খুব নড়ছে, তাঁর মুখ অনবরত কথা কইছে, কিন্তু তার চোখদুটো ঠিক যেন মরা-মানুষের চোখ! শ্মশানের চিতার আগুনের ভিতর থেকে একটা মড়া যেন দানোয় পেয়ে জ্যান্ত পৃথিবীর পানে মিট-মিট করে তাকিয়ে দেখছে-পটলবাবুর চোখ দেখে এমনি-একটা ভাবই কুমারের মনকে নাড়া দিতে লাগলো।
চারিদিকে দেখে-শুনে কুমার, মানসপুর থানার ইনস্পেক্টর চন্দ্ৰবাবুর সন্ধানে চললো। কলকাতাতেই সে খবর পেয়েছিলো যে, চন্দ্ৰবাবুর জ্যেষ্ঠপুত্র অশোকের সঙ্গে স্কুলে ও কলেজে সে একসঙ্গে অনেককাল ধরে পড়াশুনা করেছিলো। অশোক এখন কলকাতায়। কিন্তু এখানে আসবার আগে সে বুদ্ধি করে অশোকের কাছ থেকে চন্দ্ৰবাবুর নামে নিজের একখানি পরিচয়পত্র আনতে ভোলেনি। কারণ সে বুঝেছিলো যে মানসপুরের রহস্য সমাধান করতে হলে চন্দ্ৰবাবুর কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা।
থানায় গিয়ে সে নিজের পরিচয়-পত্ৰখানি ভিতরে পাঠিয়ে দিলে। অল্পক্ষণ পরেই তার ডাক এলো।
চন্দ্ৰবাবু তখন টেবিলের সামনে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তাঁর বয়স হবে পঞ্চান্ন, বেশ লম্বা-চওড়া বলিষ্ঠ গৌরবর্ণ মূর্তি, মুখখানি হাসিতে উজ্জ্বল,—দেখলে পুরাতন পুলিশ কর্মচারী বলে মনে হয় না।
কুমারকে দেখিই চন্দ্রবাবু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে, হাত বাড়িয়ে তার একখানি হাত ধরে বললেন, তুমিই অশোকের বন্ধু কুমার? এই বয়সে তুমি এত নাম কিনোচো? তোমার আর তোমার বন্ধু বিমলের অদ্ভুত সাহস আর বীরত্বের কথা শুনে আমি তোমাদের গোঁড়া ভক্ত হয়ে পড়েছি। এসো, এসো, ভালো করে বোসো-ওরে চা নিয়ে আয় রে!
কুমার আসন গ্ৰহণ করলে পরে চন্দ্ৰবাবু বললেন, তারপর। হঠাৎ এখানে কি মনে করে? নতুন ‘অ্যাড্ভেঞ্চার’-এর গন্ধ পেয়েছো বুঝি?
কুমার হাসতে হাসতে বললে, আজ্ঞে হাঁ।
চন্দ্রবাবু গভীর হয়ে বললেন, ব্যাপারটা বড়োই রহস্যময়, বড়োই আশ্চর্য! জীবনে এমন সমস্যায় কখনো পড়িনি! কে বা কারা এ-রকম ভাবে মেয়ে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে? বাঘ? না ভুলু-ডাকাতের দল? সবাই সাবধান হয়ে আছে, চারিদিকে কড়া পাহারা, তার ভিতর থেকেই বারো-বারোটি মেয়ে চুরি গেলো, অথচ চোর ধরা পড়া দুরের কথা-তার টিকিটি পর্যন্ত কারুর চোখে পড়লো না। এও কি সম্ভব?--ব্যাপারটা যেরকম দাঁড়িয়েছে, আমার চাকরি বুঝি আর টেকে না! আসছে কাল অমাবস্যা, আমিও সেজন্যে যতটা-সম্ভব প্রস্তুত হয়ে আছি।--কাল একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবো! কিন্তু কালও যদি চোর ধরতে না পারি, তা হলে আমার কপালে কি আছে জানি না-উপরওয়ালারা নিশ্চয়ই ভাববেন, আমি একটি প্ৰকাণ্ড অপদার্থ।
কুমার শুধোলে, অমাবস্যার রাতে ঠিক কোন সময়ে মেয়ে চুরি যায়, তার কি কিছু স্থিরতা আছে?
চন্দ্ৰবাবু বললেন, এ-ব্যাপারের সবটাই আজগুবি! বিংশ শতাব্দীর এই সভ্য বাঘটি শুধু পাঁজি-পুঁথি পড়তেই শেখেনি,-কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি ধরে কাজ করতেও শিখেছে! প্রতিবারেই ঠিক রাত দুপুরের সময়ে তার প্রথম চীৎকার শোনা যায়!
—কিন্তু এ বাঘটা কি সত্যিই আসল বাঘ, না, সবাইকে ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করবার জন্যে কোনো হরবোলা, মানুষ অবিকল বাঘের ডাক নকল করে?
—সে-সন্দেহ করবারও কোনো উপায় নেই। প্রতিবারেই বাঘের অগুন্তি পায়ের দাগ আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি।
কুমারের চা এলো। চা পান করতে করতে নীরবে সে ভাবতে লাগলো। চন্দ্ৰবাবু বললেন, রহস্যের উপর রহস্য! আজি দিনকয় হলো মানসপুরে কে—একজন অচেনা লোক এসে বাসা বেঁধেছে, তাকে সর্বত্রই দেখা যায়, কিন্তু সে যে কে, তা কেউ জানেনা! লোকটার সমস্ত ব্যবহারই সন্দেহজনক! এখানকার মুকবির পটলবাবু বলেন, নিশ্চয়ই সে ভুলু-ডাকাতের চর! আপাতত ইচ্ছা থাকলেও আমরা তার সম্বন্ধে ভালো করে খোঁজ-খবর নিতে পারছি না, কারণ এই মেয়ে-চুরির হাঙ্গামার জন্যে আমার আর কোনো দিকেই ফিরে তাকাবার অবসর নেই। তবে তার ওপরেও কড়া পাহারা রাখতে আমি ভুলিনি।
কুমার বললে, লোকটার নাম কি?
—মোহনলাল বসু। শুনলুম, সে কোথাকার জমিদার, এখানে এসেছে বেড়াতে। যদিও এখানে সমুদ্রের হাওয়া বয়, কারণ খানিক তফাতেই সমুদ্র আছে, —কিন্তু এটাকি বেড়াতে আসবার জায়গা, বিশেষ এই বিভীষিকার সময়ে? ...তার পর শুনলুম। সে কাল গাঁয়ের অনেকের কাছে গল্প করে বেড়িয়েছে যে, তার বাড়িতে নাকি নগদ অনেক হাজার টাকা আছে! এমন বোকা লোকের কথা কখনো শুনেছ? আশপাশে প্রায়ই ভুলু-ডাকাত হানা দিয়ে বেড়াচ্ছে, সেটা জেনেও এ-কথাটা প্রকাশ করতে কি তার ভয় হলো না?...ভুলু-ডাকাতের কানে এতক্ষণ মোহনলালের টাকার কথা গিয়ে পৌঁচেছে, আর পটলবাবুর সন্দেহ যদি ভুল হয়, অর্থাৎ মোহনলাল যদি ভুলুডাকাতের চর না হয়, তাহলে আসছে কাল অমাবস্যার গোলমালে ভুলু যে তার বাড়িতে হানা দেবে, এটা আমি মনে টিক দিয়ে রেখেছি।
খানিকক্ষণ চিন্তিতভাবে নীরব থেকে চন্দ্ৰবাবু বললেন, এখন বুঝেছে, আমি কিরকম মুশকিলে ঠেকেছি? একেই এই মেয়ে-চুরির মামলা নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি, তার ওপরে কাল এ মোহনলালের বাড়ির আনাচে-কানাচেই আমাকে রাত কাটাতে হবে, কারণ শ্ৰীমান ভুলু-বাবাজী কাল হয়তো দয়া করে ওখানে পায়ের ধুলো দিলেও দিতে পারেন!
কুমার বললে, চন্দ্রবাবু, আপনি আমার একটি কথা রাখবেন?
—কি কথা ? তুমি যখন অশোকের বন্ধু তখন তুমি আমারও ছেলের মতো। সাধ্যমতো আমাকে তোমার আবদার রাখতে হবে বৈকি!
কুমার বললে, যতদিন-না এই মামলার কোনো নিস্পত্তি হয়, ততদিন আপনার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে থাকতে দেবেন কি ?
চন্দ্ৰবাবু খুব খুশিমুখে বললেন, এ কথা আর বলতে? তোমার মতো সাহসী আর বুদ্ধিমান সঙ্গী পেলে তো আমি বর্তে যাই! তুমি যদি আমার সঙ্গে থাকো, তাহলে আমি হয়তো খুব শীঘ্রই এ-মামলাটার একটা কিনারা করে ফেলতে পারবো।