কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name দ্বিতীয় খণ্ড - অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় খণ্ড - অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

দুর্দান্ত সিপাহী

আকাশের ভিতর গিয়া কঙ্কাবতী খোক্ষশ-শাবককে একটি মেঘের ডালে বাঁধিয়া দিল। তাহার পর পদব্রজে আকাশের মাঠ দিয়া চলিতে লাগিল। চারিদিকে দেখিল, নানা বর্ণের নক্ষত্র সব ফুটিয়া রহিয়াছে। নক্ষত্র ফুটিয়া আকাশকে আলো করিয়া রাখিয়াছে। অতি দূরে চাঁদ চাকার মত আকাশের উপর বসিয়া আছেন।

কঙ্কাবতী আকাশের ভিতর প্রবেশ করিলে চাঁদ সংবাদ পাইলেন যে, তাঁহার মূল-শিকড় কাটিতে মানুষ আসিতেছে। খন্তা, কুড়ুল লইয়া এক মানবী উন্মত্তার ন্যায় ছুটিয়া আসিতেছে। এই দুঃসংবাদ শুনিয়া চাঁদের মনে ত্রাস হইল। ভয়ে চাঁদ কাঁপিতে লাগিলেন।চাঁদ মনে করিলেন, “কেন যে মরিতে সুন্দর হইয়াছিলাম। তাই তো আমার প্রতি সকলের আক্রোশ! যদি সুন্দর না হইতাম, তাহা হইলে কেহ আর আমার মুল-শিকড় কাটিতে আসিত না। একে তো রাহুর জ্বালায় মরি, তাহার উপর আবার যদি মানুষের উপদ্রব হয়, তাহা হইলে আর কি করিয়া বাঁচি! যদি আমার গলা থাকিত, তো আমি গলায় দড়ি দিয়া মরিতাম। তা যে ছাই, এ পোড়া শরীর কেবল চাকার মত! গলা নাই তা আমি কি করিব? দড়ি দিই কোথা?”

নানারূপ খেদ করিয়া, অতিশয় ভীত হইয়া চাঁদ আকাশের সিপাহীকে ডাকিতে পাঠাইলেন। আকাশের সিপাহী সকল দিকে বীরপুরুষ বটে, কেবল কর্ণে কিছু হীনবল, একটু কালা। অতিশয় চীৎকার করিয়া কোনও কথা না বলিলে তিনি শুনিতে পান না। সিপাহী আসিয়া উপস্থিত হইলে অতি চীৎকার করিয়া চাঁদ তাঁহাকে সকল কথা বলিলেন।চাঁদ তাহাকে বলিলেন, “আমার মুল-শিকড় কাটিতে মানুষ আসিতেছে।”

সিপাহী ভাবিলেন যে, চাঁদ তাঁহাকে কালা মনে করিয়া এত হাঁ করিয়া কথা কহিতেছেন। সিপাহীর তাই রাগ হইল।

সিপাহী বলিলেন, “নাও! আর অত হাঁ করিতে হইবে না। শেষকালে চিড় খাইয়া, চারিদিক ফাটিয়া, দুইখানা হইয়া যাইবে।”

এইবার একটু হাঁ কম করিয়া, চাঁদ পুনরায় বলিলেন, “আমার মূল-শিকড় কাটিতে মানুষ আসিতেছে।”সিপাহী বলিলেন, “অত আর চুপি চুপি কথা কহিতে হইবে না। কোথাও ডাকাতি করিবে না কি যে অত চুপি চুপি কথা। যদি কোথাও ডাকাতি কর তো আমায় কিন্তু ভাগ দিতে হইবে।”

চাঁদ ভাবিলেন, সিপাহী-লোকের সঙ্গে কথা কওয়া দায়। কথায় কথায় রাগিয়া উঠে।

চাঁদ পুনরায় বলিলেন, “না, ডাকাতি করিবার কথা বলি নাই। আমি কোথাও ডাকাতি করিতে যাইব না। আমি বলিতেছি যে, আমার মূল-শিকড় কাটিতে মানুষ আসিতেছে।”

সিপাহী এতক্ষণে চাঁদের কথা শুনিতে পাইলেন।সিপাহী বলিলেন, “তোমার মূল-শিকড় কাটিতে মানুষ আসিতেছে? তা বেশ, কাটিয়া লইয়া যাইবে। তার আর কি?”

চাঁদ বলিলেন, “তুমি আকাশের চৌকিদার, তুমি আমাকে রক্ষা করিবে না?”

সিপাহী উত্তর করিলেন, “তোমাকে রক্ষা করিতে গিয়া যদি আমার মুল-শিকড়টি কাটা যায়? তখন?”

চাঁদ বলিলেন, “যদি তুমি এরূপ সমূহ বিপদ হইতে আমাকে রক্ষা না করিবে, তবে তুমি আকাশের মাহিনা খাও কি জন্য?”সিপাহী উত্তর করিলেন, “রেখে দাও তোমার মাহিনা! না হয় কর্ম ছাড়িয়া দিব; পৃথিবীতে গিয়া কনেস্টেবিলি করিয়া খাইব। আমা হেন প্রসিদ্ধ দুর্দান্ত সিপাহী পাইলে, সেখানে তাহারা লুফিয়া লইবে। সেখানে এমন মুল-শিকড় কাটাকাটি নাই। সেখানে দাঙ্গাহাঙ্গামা হয় বটে, তা দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় আমি তফাৎ তফাৎ থাকিব। দাঙ্গাহাঙ্গামা সব হইয়া গেলে দাঙ্গাবাজেরা আপনার আপনার ঘরে চলিয়া গেলে, তখন আমি রাস্তার দু-চারিজন ভাল মানুষ ধরিয়া কাছারিতে লইয়া গিয়া হাজির করিব। তবে এখন আমি যাই। কারণ, মানুষটি যদি আসিয়া পড়ে! শেষে যদি আমাকে পর্যন্ত ধরিয়া টানাটানি করে?”

এই কথা বলিয়া, দুর্দান্ত সিপাহী সেখান হইতে অতি দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন। নিরুপায় হইয়া, যা থাকে কপালে,- এই মনে করিয়া চাঁদ আকাশে গা ঢালিয়া দিলেন।মেঘের ডালে খোক্কশ বাঁধিয়া আকাশের মাঠ দিয়া কঙ্কাবতী অতি দ্রুতবেগে চাঁদের দিকে ধাবমান হইল।

চারিদিকে জনরব উঠিল যে, আকাশবাসী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সকলের মূল-শিকড় কাটিতে পৃথিবী হইতে মনুষ্য আসিয়াছে। আকাশবাসীরা সকলে আপনার আপনার ছেলেপিলে সাবধান করিয়া ঘরে খিল দিয়া বসিয়া রহিল। নক্ষত্রগণের পলাইবার জো নাই, তাই নক্ষত্রগণ বন উপবনে, ক্ষেত্র উদ্যানে, যে যেখানে ফুটিয়াছিল, সে সেইখানে বসিয়া মিট মিট করিয়া জ্বলিতে লাগিল। চাঁদের পলাইবার জো নাই, কারণ জগতে আলো না দিয়া পলাইলে জরিমানা হইবে। চাঁদ তাই বিরসমনে ম্লানবদনে ধীরে ধরে আকাশের পথে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।

ক্রমে কঙ্কাবতী চাঁদের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল।চাঁদ ভাবিলেন, এইবার তো দেখিতেছি, আমার মুল-শিকড়টি কাটা যায়! এখন আমি-সুদ্ধ না যাই, তবেই রক্ষা। ইহারে বিশ্বাস কি? যদি বলিয়া বসে যে, বাঃ দিব্য চাঁদটি, কাপড়ে বাঁধিয়া লইয়া যাই, তাহা হইলে আমি কি করিতে পারি? কাজ নাই বাপু, আমি চক্ষু বুজিয়া, থাকি, নিঃশ্বাস বন্ধ করি, মড়ার মত কাঠ হইয়া থাকি। মানুষটা মনে করিবে যে, এ মরা চাঁদ লইয়া আমি কি করিব? আমাকে সে আর ধরিয়া লইয়া যাইবে না।

বুদ্ধিমন্ত চাঁদ এইরূপ মনে মনে পরামর্শ করিয়া চক্ষু বুজিলেন, নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া রহিলেন।

চাঁদকে বিবর্ণ, বিষণ্ণ, মৃত্যু-ভাবাপন্ন দেখিয়া কঙ্কাবতী ভাবিল, বাঃ চাঁদটি বা মরিয়া গেল! মূল-শিকড়টি কাটিয়া লইব, সেই ভয়ে চাঁদের বা প্রাণত্যাগ হইল! আহা, কেমন সুন্দর চাঁদটি ছিল! কেমন চমৎকার জ্যোৎস্না হইত, কেমন পূর্ণিমা হইত। সে সকল আর হইবে না চিরকাল অমাবস্যার রাত্রি থাকিবে। লোকে আমায় কত গালি দিবে।একটু ভাল করিয়া দেখিয়া কঙ্কাবতী পুনরায় মনে মনে বলিল, না, “চাঁদ মরে নাই। বোধ হয় মূর্ছা গিয়াছে। তা ভালই হইয়াছে কাটিতে কুটিতে হইলে, ডাক্তারেরা প্রথম ঔষধ শুঁকাইয়া অজ্ঞান করেন, তারপর করাত দিয়া হাত-পা কাটেন। ভালই হইয়াছে যে, চাঁদ আপনা-আপনি অজ্ঞান হইয়াছে। মূল-শিকড় কাটিতে ইহাকে আর লাগিবে না। কিন্তু শিকড়টি একেবারে দুইখণ্ড করিয়া কাটা হইবে না, তাহা হইলে চাঁদ মরিয়া যাইবে। আমার কেবল একতোলা শিকড়ের ছালের প্রয়োজনমত ততটুকু আমি কাটিয়া লই।”

এইরূপ ভাবিয়া চারিদিক ঘুরিয়া, কঙ্কাবতী অবশেষে চাঁদের মুল-শিকড়টি দেখিতে পাইল। ছুরি দিয়া উপর উপর মূল-শিকড়ের ছাল চাঁছিয়া তুলিতে লাগিল।

অল্পক্ষণের নিমিত্ত চাঁদ অতি কষ্টে যাতনা সহ্য করিলেন, তার পর আর সহিতে পারিলেন না। চাঁদ বলিলেন, উঃ! লাগে যে!”কঙ্কাবতী বলিল, “ভয় নাই। এই হইয়া গেল!”

তাড়াতাড়ি কঙ্কাবতী চাঁদের মূল-শিকড় হইতে এক তোলা পরিমাণ ছাল তুলিয়া লইল।

তখন চাঁদ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার শিকড় পুনরায় গজাইবে তো?”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “গজাইবে বই কি! চিরকাল কি আর এমন থাকিবে। ইহার উপর একটু কাদা দিয়া দিও, মন্দ লোকের দৃষ্টি পড়িয়া বিষাইয়া উঠিবে না।”

চাঁদ জিজ্ঞাসা করিলেন, “যদি ঘা হয়?”কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “যদি ঘা হয় তাহা হইলে ইহার উপর একটু লুচি-ভাজা ঘি দিও।”

চাঁদ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি বুঝি মেয়ে-ডাক্তার? দাঁতের গোড়ার ঔষধ জান? আমার দাঁতের গোড়া বড় কন কন করে।”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল “আমি মেয়ে-ডাক্তার নই। তবে এই বয়সে আমি অনেক দেখিলাম, অনেক শুনিলাম, তাই দুটো একটা ঔষধ শিখিয়া রাখিয়াছি। তোমার দাঁতের গোড়া আর ভাল হইবে না। লোকের দাঁত কি চিরকাল সমান থাকে? তুমি কত কালের চাঁদ হইলে, মনে করিয়া দেখ দেখি? কবে সেই সমুদ্রের ভিতর হইতে বাহির হইয়াছ! এখন আর ছেলে-চাঁদ হইতে সাধ করিলে চলিবে কেন?”চাঁদ বলিলেন, “ছেলে-চাঁদ হইতে চাই না। ঘরে আমার অনেকগুলি ছেলে-চাঁদ আছে। আশীর্বাদ কর তাহারা বাঁচিয়া বর্তিয়া থাকুক, তাহা হইলে এর পর দেখিতে পাইবে, আকাশে কত চাঁদ হয়। আকাশের চারিদিকে তখন চাঁদ উঠবে। এখনই আমার ছেলেমেয়েগুলি বলে, “বাবা, অমাবস্যার রাত্রিতে তুমি শ্রান্ত হইয়া পড়, সন্ধ্যাবেলা বিছানা হইতে আর উঠিতে পারনা। তা যাই না? আমরা গিয়া আকাশে উঠি না?” আমি তাদের মানা করি। আকাশের একধার হইতে অন্য ধার পর্যন্ত, পথটুকু তো আর কম নয়। তারা ছেলেমানুষ, অত পথ গড়াইতে পারিবে কেন?”

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার ছেলেমেয়েগুলি কত বড় হইয়াছে?”চাঁদ উত্তর করিলেন, “বড় মেয়েটি একখানি কাঁসির মত হইয়াছে। কেমন চকচকে কাঁসি! তেঁতুল দিয়া মাজিলেও তোমাদের কাঁসির সেরূপ রং হয় না। মেজ ছেলেটি একখানি খত্তালের মত হইয়াছে। মাঝে আরও অনেকগুলি ছেলেমেয়ে আছে। কোলের মেয়েটি একটু কালো। তোমরা যে সেকালে পাথুরে পোকার টিপ পরিতে, সেই তত বড় হইয়াছে। কিন্তু কালো হউক, মেয়েটির শ্রী আছে। বড় হইলে, এর পর যখন আকাশে কালো চাঁদ উঠবে, তখন তোমরা বলিবে, হাঁ চটক-সুন্দরী বটে। তাহার কালো কিরণে জগতে চকচকে অন্ধকার হইবে, সমুদয় জগৎ যেন বারনিশ চামড়ায় মুড়িয়া যাইবে। তা, যাই হউক, এখন দাঁতের গোড়ার কি হইবে? কি হয়ে খাইতে পারি না। ডাঁটা চিবাইতে যে বড় লাগে। ভাল যদি কোনও ঔষধ থাকে তো আমাকে দিয়া যাও।”

কঙ্কাবতী বলিল, “চাঁদ, তুমি এক কাজ কর, আমার সঙ্গে তুমি চল। তোমার শিকড় পাইয়াছি পতি আমার এখন ভাল হইবেন। পতি আমার কলিকাতায় থাকেন। কলিকাতায় দন্তকারেরা আছে। তোমার পোকা-ধরা পচা দাঁতগুলি সাঁড়াশি দিয়া তাহারা তুলিয়া দিবে, নূতন কৃত্রিম দন্ত পরাইয়া দিবে।”এই কথা শুনিয়া চাঁদের ভয় হইল, চাঁদ বলিলেন, আমার মূল-শিকড়ে ব্যথা হইয়াছে, আমি এখন গড়াইতে পারিব না, তত দূর আমি যাইতে পারব না।”

কঙ্কাবতী বলিল, “তার ভাবনা কি? আমি তোমাকে কাপড়ে বাঁধিয়া লইয়া যাইব।”

চাঁদের প্রাণ উড়িয়া গেল। চাঁদ ভাবিলেন, “যা ভয় করিয়াছিলাম তাই। কেন মরিতে ইহার সহিত কথা কহিয়াছিলাম। চক্ষু বুজিয়া চুপ করিয়া থাকিলেই হইত।”

চাঁদ বলিলেন, “আমার দাঁতের গোড়া ভাল হইয়া গিয়াছে, আর ব্যথা নাই। সে জন্য তোমাকে আর কষ্ট করিতে হইবে না, আমি বড় ভারী, আমাকে তুমি লইয়া যাইতে পারিবে না। এখন যাও, বাড়ী যাও। বিলম্ব করিলে তোমার বাড়ীর লোকে ভাবিবে।”কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “কি বলিলে? তুমি ভারী! বাপের বাড়ী থাকিতে তোমার চেয়ে বড় বড় বগি-থালা আমি ঘাটে লইয়া মাজিতাম। এই দেখ, তোমাকে লইয়া যাইতে পারি কি না!”

এই কথা বলিয়া কঙ্কাবতী আকাশের উপর আঁচলটি পাতিল। চাঁদটিকে ধরিয়া আঁচলে বাঁধে আর কি। এমন সময় চাঁদের স্ত্রী চাঁদের ছানা-পোনা লইয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে আছাড়ি-পিছাড়ি খাইতে খাইতে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চাঁদনীর কান্নায় আকাশ ফাটিয়া যাইতে লাগিল। চাঁদের ছানা-পোনার কান্নায় কঙ্কাবতীর কানে তালা লাগিল।

চাঁদনী কাঁদিতে লাগিলেন, “ওগো, আমি দুর্দান্ত সিপাহীর মুখে শুনিলাম যে, মানুষে তোমার মূল-শিকড় কাটিবে। ওগো, আমি সে পোড়ারমুখী মানুষীর কি বুকে ধান ভানিয়াছি যে, সে আমার সহিত এরূপ শত্রুতা সাধিবে! আমাকে যদি বিধবা হইতে হয়, তাহা হইলে তারও আমার মত হাত হইবে। সে বাপ-ভাইয়ের মাথা খাইবে।”চাঁদের ছানা-পোনাগুলি কঙ্কাবতীর কাপড় ধরিয়া টানিতে লাগিল, আর বলিতে লাগিল, ওগো, তোমার পায়ে পড়ি। বাবার তুমি মূল-শিকড় কাটিও না, বাবাকে ধরিয়া লইয়া যাইও না।”

চাঁদের ছোট মেয়েটি, যেটি পাথুরে পোকার টিপের মত, সেই মেয়েটি মাঝে মাঝে কাঁদে, মাঝে মাঝে রাগে, আর কঙ্কাবতীকে গালি দিয়া বলে, “অভাগী, পোড়ারমুখী, শালা।” আবার সে কঙ্কাবতীকে গায়ের চারিদিকে আচড়ায় কামড়ায় আর চিমটি কাটে। তার চিমটির জ্বালায় কঙ্কাবতী ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িল।

কঙ্কাবতী বলিল, “ওগো, ও চাঁদনী! তোমার মেয়ে সামলাও বাছা, তোমার এ ছোট মেয়েটি চিমটি কাটিয়া আমার গায়ের ছাল-চামড়া তুলিয়া লইতেছে!”চাঁদনী উত্তর করিলেন “হাঁ, মেয়ে সামলাব বই কি? তুমি আমার সর্বনাশ করিবে, আর আমি মেয়ে সামলাব। কেন বাছা? তোমার আমি কি করিয়াছি যে, তুমি আমার সর্বনাশ করিবে? মুল-শিকড়টি কাটিয়া তুমি আমার পতির প্রাণবধ করিবে?”

কঙ্কাবতী বলিল, “না গো না। একটুখানি শিকড়ের আমার আবশ্যক ছিল, তা আমি উপর উপর চাঁছিয়া লইয়াছি। অধিক রক্তও পড়ে নাই, কিছুই হয় নাই। তুমি বরং চাঁদকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ? তার পর তোমার স্বামী বলিলেন যে, তাঁর দাঁত নড়িতেছে। তাই মনে করিলাম যে কলিকাতায় লইয়া যাই দাঁত ভাল করিয়া পুনরায় তোমার স্বামীকে আকাশে পাঠাইয়া দিব। তাতে আর কাজ নাই বাছা, এখন তোমরা সব চুপ কর। আর তোমার এই মেয়েটিকে বল, আমায় যেন আর চিমটি না কাটে।”

এই কথা শুনিয়া চাঁদনী আশ্বস্ত হইলেন। চাঁদের ছেলে-পিলেদেরও কান্না থামিল।চাঁদনী বলিলেন, “তোমার যদি বাছা, কাজ সারা হইয়া থাকে, তবে তুমি এখন বাড়ী যাও। তোমার ভয়ে আকাশ একেবারে লণ্ডভণ্ড হইয়া গিয়াছে। আকাশবাসীরা সব ঘরে খিল দিয়া বসিয়া আছে। সবাই সশঙ্কিত।”

কঙ্কাবতী বলিল, “আমার কাজ সারা হইয়াছে সত্য, কিন্তু আমার কতকগুলি নক্ষত্র চাই। আমাদের সেখানে নক্ষত্র নাই। আহা! এখানে কেমন চারিদিকে সুন্দর সুন্দর সব নক্ষত্র ফুটিয়া রহিয়াছে! আমি মনে করিয়াছি, কতকগুলি নক্ষত্র এখান হইতে তুলিয়া লইয়া যাইব। এখান হইতে অনেক দূরে আমার খোক্কশ বাঁধা আছে। কি করিয়া নক্ষত্রগুলি তত দূর লইয়া যাই? একটি মুটে কোথায় পাই?”

চাঁদনী বলিলেন, “আর বাছা! তোমার ভয়ে ঘর হইতে আজ কি লোক বাহির হইয়াছে যে তুমি মুটে পাইবে? দোকানী -পসারী সব দোকান বন্ধ করিয়াছে, আকাশের বাজার-হাট আজ সব বন্ধ। পথে জনপ্রাণী নাই! আমিই কেবল প্রাণের দায়ে ঘর হইতে বাহির হইয়াছি।”এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় কঙ্কাবতী দেখিতে পাইল যে, মেঘের পাশে লুকাইয়া কে একটি লোক উঁকিঝুঁকি মারিতেছে। কঙ্কাবতী ভাবিল, ওই লোকটিকে বলি খোক্কশের বাচ্চার কাছ পর্যন্ত নক্ষত্রগুলি দিয়া আসে। এইরূপ চিন্তা করিয়া কঙ্কাবতী তাহাকে ডাকিল। কঙ্কাবতী বলিল, “ওগো শুন। একটা কথা শুন।”

কঙ্কাবতী যেই এই কথা বলিয়াছে, আর লোকটি উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া পলাইল। কঙ্কাবতী তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়াইল। কঙ্কাবতী বলিতে লাগিল, “ওগো, একটু দাঁড়াও, আমার একটা কথা শুন, তোমার কোনও ভয় নাই।”

আর ভয় নাই! কঙ্কাবতী যতই তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যায়, আর লোকটি ততি প্রানপণে দৌড়িতে থাকে। কঙ্কাবতী মনে করিল, লোকটি কি দৌড়িতে পারে! বাতাসের মত যেন উড়িয়া যায়।কঙ্কাবতী তাহাকে কিছুতেই ধরিতে পারিল না, কিন্তু দৈবক্রমে এক ঢিপি মেঘ তাহার পায়ে লাগিয়া সে হোঁচোট খাইয়া পড়িয়া গেল। পড়িয়াও পুনরায় উঠতে কত চেষ্টা করিল, কিন্তু উঠিতে না উঠিতে কঙ্কাবতী গিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিল।

কঙ্কাবতী তাহার গায়ে হাত দিয়া দেখে যে, তাহার গায়ে হাড় নাই, মাস নাই, কিছুই নাই। দেহ তার অতি লঘু দুইটি অঙ্গুলি দ্বারা কঙ্কাবতী তাহাকে ধরিয়া তুলিল। চক্ষুর নিকট আনিয়া নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল যে, কেবল দুই চারিটি তালপাতা দিয়া তাহার শরীর নির্মিত। তালপাতের হাত, তালপাতের পা, তালপাতের নাক-মুখ। সেই তালপাতের উপর জামাজোড়া-পরা। তাহার শরীর দেখিয়া কঙ্কাবতী অতিশয় বিস্মিত হইল।

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে?”লোকটি উত্তর করিল, “আমি আকাশের দুর্দান্ত সিপাহী। আবার কে? এখন ছাড়িয়া দাও বাড়ী যাই। আঙ্গুল দিয়া অমন করিয়া টিপিও, না।”

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার শরীর তালপাতা দিয়া গড়া?”

দুর্দান্ত সিপাহী বলিলেন, “তালপাতা দিয়া গড়া হইবে না তো কি দিয়া গড়া হইবে? ইঁট পাথর চুন সুরকি দিয়া রেক্তার গাঁথুনী করিয়া আমার শরীর গড়া হইবে না কি? এত দেশ বেড়াইলে, এত কাণ্ড করিলে, আর তালপাতার সিপাহীর নাম কখনও শুননি? এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে আমাকে কে না জানে? বীর-পুরুষ দেখিলেই লোকে আমার সহিত উপমা দেয়। এখন ছাড়িয়া দাও, বাড়ী যাই। ভাল এক মূল-শিকড় কাটাকাটি হইয়াছে বটে!”কঙ্কাবতী এখন বুঝিল যে, ছেলা-বেলা যে সেই তালপাতার সিপাহীর কথা শুনিয়াছিল, তাহার বাস আকাশে, পৃথিবীতে নয়। আর সেই-ই আকাশের দুর্দান্ত সিপাহী!

কঙ্কাবতী বলিল, “দেখ দুর্দান্ত সিপাই! তোমাকে আমার একটি কাজ করিতে হইবে। তা না করিলে তোমাকে আমি কিছুতেই ছাড়িব না। এখান হইতে এক বোঝা নক্ষত্র আমি তুলিয়া লইয়া যাইব। কিছু দূর মোটটি তোমাকে লইয়া যাইতে হইবে।”

সিপাহী আর করেন কি? কাজেই সম্মত হইলেন। কঙ্কাবতীর আঁচলে আর কতটি নক্ষত্র ধরিবে? তাই কঙ্কাবতী ভাবিতে লাগিল, কি দিয়া নক্ষত্রগুলি বাঁধিয়া লই?সিপাহী বলিলেন, “অত আর ভাবনা-চিন্তা কেন? চল আমরা আকাশ-বুড়ীর কাছে যাই। কদমতলায় বসিয়া চরকা কাটিয়া সে কত কাপড় করিয়াছে। তাহার কাছ হইতে একখানি গামছা চাহিয়া লই।”

কঙ্কাবতী ও সিপাহী আকাশ-বুড়ির নিকট গিয়া একখানি গামছা চাহিল। অনেক বকিয়া-ঝকিয়া আকাশ-বুড়ী একখানি গামছা দিলেন। তখন কঙ্কাবতী আকাশের মাঠে নক্ষত্র তুলিতে লাগিল। বাছিয়া বাছিয়া, ফুটন্ত-ফুটন্ত, আধ-কুঁড়ি, আধ-ফুটন্ত নানাবর্ণের নক্ষত্র তুলিল। সেইগুলি গামছায় বাঁধিয়া মোটটি সিপাহীর মাথায় দিল।

সিপাহী ভাবিলেন, “এতকাল আকাশে চাকরি করিলাম, কিন্তু মুটেগিরি কখনও করিতে হয় নাই। ভাগ্যক্রমে আকাশের লোক সব আজ দ্বারে খিল দিয়া বসিয়া আছে। কেহ যদি আমার এ দুর্দশা দেখিত, তাহা হইলে আজ আমি মরমে মরিয়া যাইতাম।”মোটটি মাথায় করিয়া, সিপাহী আগে আগে যাইতে লাগিলেন। কঙ্কাবতী তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে খোক্কশের বাচ্চার নিকটে আসিয়া দুইজনে উপস্থিত হইলেন। সিপাহীর মাথা হইতে নক্ষত্রের বোঝাটি লইয়া তখন কঙ্কাবতী বলিল, “এখন তুমি যাইতে পার, তোমাকে আর আমার প্রয়োজন নাই।” এই কথা বলিতে না বলিতে সিপাহী এমনি ছুট মারিলেন যে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেলেন। কঙ্কাবতী ভাবিল তালপাতার সিপাহী কি না! তাই এত দ্রুতবেগে ছুটিতে পারে।

মোটটি লইয়া কঙ্কাবতী খোক্কশের বাচার পিঠে চড়িল। খোক্কশের পিঠে চড়িয়া আকাশ হইতে পৃথিবীর দিকে পুনরায় অবতরণ করিতে লাগিল।আকাশ হইতে পৃথিবী একেবারে কম দূরের পথ নহে। কঙ্কাবতী খোক্কশের ছানার পিঠে বসিয়া বসিয়া কি করে? তাহার পুটুলিটি খুলিয়া কঙ্কাবতী এক ছড়া মালা গাঁথিল ―এই মালাটি খেতুর জন্য। খেতু বাঁচিয়া উঠলে নক্ষত্রের মালাটি কঙ্কাবতী খেতুর গলায় পরাইয়া দিবে। কঙ্কাবতী নামিতে নামিতে আরও দুইটি মালা গাঁথিল― একটি তাহার নিজের জন্য, আর একটি পচাজলের জন্য।

যেখানে মশা ও হাতী কঙ্কাবতীর প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, অবিলম্বে কঙ্কাবতী সেইখানে উপস্থিত হইল। শিকড়-লাভে কৃতকার্য হইয়াছে শুনিয়া মশা ও হাতীর আনন্দের আর অবধি রহিল না। খোক্কশের বাচ্চাটিকে পুনরায় তাহার গর্তে ছাড়িয়া দিয়া, মশা ও কঙ্কাবতী হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন ও পর্বত-অভ্যন্তরস্থিত সেই অট্টালিকার দিকে যাত্রা করিলেন।অট্টালিকায় উপস্থিত হইয়া, কঙ্কাবতী চাঁদের মূল-শিকড়টুকু খর্বুরের হস্তে অর্পণ করিল। খর্বুর তাহার এক তোলা ওজন করিয়া সাতটি গোলমরিচের সহিত অতি সাবধানে শিলে বাটিলেন। ঔষধটুকু বাটা হইলে, ব্যাঙকে তাহা সেবন করাইলেন। ঔষধ সেবন করিয়া ব্যাঙের হুড় হুড় করিয়া বমন আরম্ভ হইল। পেটে যাহা কিছু ছিল, সমুদয় বাহির হইয়া পড়িল। ব্যাঙ বলিলেন, “ব্যাঙাচি-অবস্থায়, জলে কিল কিল করিতে করিতে আমি যাহা কিছু খাইয়াছিলাম, তাহা পর্যন্ত বাহির হইয়া গিয়াছে, উদরে আর আমার কিছুই নাই।”

বমনের সহিত সেই ক্ষুদ্র পিপীলিকাগুলি বাহির হইয়া পড়িল। খর্বুর অতি যত্নে তাহাদিগকে বমনের ভিতর হইতে বাছিয়া লইলেন। তাহার পর একটি পিপীলিকা লইয়া, তাহার উদর হইতে অতি সূক্ষ্ম সন্নার দ্বারা খেতুর পরমায়ুটুকু বাহির করিতে লাগিলেন। এইরূপে খুঁটিয়া খুঁটিয়া সমস্ত পিপীলিকাগুলি হইতে পরমায়ুবাহির করা হইলে খর্বুর বলিলেন, “এ কি হইল? পরমায়ু তো অধিক বাহির হইল না। এ যৎসামান্য পরমায়ুটুকু লইয়া কি হইবে? ইহাতে তো কোনও ফল হইবে না?”খর্বুর বিষণ্ণচিত্ত হইলেন, মশা হতাশ হইলেন, ব্যাঙের চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল, কঙ্কাবতী নীরবে বসিয়া রহিল। অদৃশ্যভাবে অবস্থিত নাকেশ্বরী ও তাহার মাসী পরিতোষ লাভ করিল।

যাহা হউক, সেই যৎসামান্য পরমায়ুটুকু লইয়া খর্বুর খেতুর নাকে নাস দিয়া দিলেন। খেতু চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিল।

খেতু বলিল, “কি অঘোর নিদ্রায় আমি অভিভূত হইয়াছিলাম! কঙ্কাবতী, তুমি আমাকে জাগাইতে পার নাই? দেখ দেখি কত বেলা হইয়া গিয়াছে?”কঙ্কাবতী বলিল, “সাধ্য থাকিলে আর জাগাইতাম না?”

খেতু তাহার পর চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। দেখিল, কঙ্কাবতীর চক্ষু দিয়া জল পড়িতেছে। খর্বুর, মশা ও ব্যাঙ বিষণ্ণ বদনে বসিয়া আছেন।

খেতু জিজ্ঞাসা করিল, “কঙ্কাবতী, তুমি কাঁদিতেছ কেন? আর এঁরা কারা?”

কঙ্কাবতী কোনও উত্তর করিল না। খেতু একটু চিন্তা করিয়া পুনরায় বলিল, আমার সকল কথা এখন মনে পড়িতেছে। আমার মাথায় শিকড় ছিল না বলিয়া আমাকে নাকেশ্বরী খাইয়াছিল। কঙ্কাবতী, তুমি বুঝি ইহাদিগকে ডাকিয়া আনিয়া আমাকে সুস্থ করিয়াছ? তবে আর কান্না কেন? আমি তো এখন ভাল আছি। কেবল আমার মাথা অল্প অল্প ব্যথা করিতেছে। আমি আর একবার শুই। কঙ্কাবতী, তুমি আমার মাথাটি একটু টিপিয়া দাও। আমার মাথা বড় বেদনা করিতেছে। অসহ্য বেদনা করিতেছে। প্রাণ বুঝি আমার বাহির হয়! ওগো, তোমরা সকলে আমার কঙ্কাবতীকে দেখিও। আমার কঙ্কাবতীকে তাহার মার কাছে দিয়া আসিও। হা ঈশ্বর!”

খেতুর মৃত্যু হইল।

ঘাড় হেঁট করিয়া সকলে নীরবে বসিয়া রহিলেন। কাহারও মুখে বাক্য নাই। সকলের চক্ষু দিয়া জলধারা পড়িতে লাগিল। কেবল কঙ্কাবতী স্থির হইয়া রহিল। কঙ্কাবতীর শরীর অবশ হইয়া আসিল। কঙ্কাবতী মুর্চ্ছিতা হইয়া পড়িল ।