দ্বিতীয় খণ্ড - ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
পরিশেষ
বৈদ্য বলিলেন, “এই যে নিদ্রাটি দেখিতেছেন, ইহা সুনিদ্রা। বিকারের ঘোর নহে। বিকার কাটিয়া গিয়াছে। নাড়ী পরিষ্কার হইয়াছে। এক্ষণে বাড়ীতে যেন শব্দ হয় না। নিদ্রাটি যেন ভঙ্গ হয় না!”
বৈদ্য প্রস্থান করিলেন। অঘোর অচৈতন্য হইয়া রোগী নিদ্রা যাইতে লাগিল। বাড়ীতে সকলেই চুপি চুপি কথা কহিতে লাগিলেন। বাড়ীতে পিপীলিকার পদশব্দটি পর্যন্ত নাই।
মাতা কাছে বসিয়া রহিলেন। এক একবার কেবল কন্যার নাসিকার নিকট হাত রাখিয়া দেখিতে লাগিলেন, রীতিমত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বহিতেছে কি না।আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া মা আজ বাইশ দিন কন্যার নিকট এইরূপে বসিয়া আছেন। প্রাণসম কন্যাকে লইয়া যমের সহিত তুমুল যুদ্ধ করিতেছেন। প্রবল বিকারের উত্তেজনায় কন্যা যখন উঠিয়া বসে, মা তখন আস্তে আস্তে পুনরায় তাহাকে শয়ন করান। বিকারের প্রলাপে কন্যা যখন চীৎকার করিয়া উঠে, মা তখন তাহাকে চুপ করিতে বলেন। সুধাময় মার বাক্য শুনিয়া বিকারের আগুনও কিছুক্ষণের নিমিত্ত নির্বাণ হয়।
কন্যা নিদ্রিত, চক্ষু মুদ্রিত করিয়া আছে। বহুদিন অনাহারে, প্রবল দুরন্ত জ্বরে, ঘোরতর বিকারে দেহ এখন তাহার শীর্ণ, মুখ এখন মলিন! তবুও তাহার মধুর রূপ দেখিলে সংসার সুন্দর বলিয়া প্রতীতি হয়। অনিমেষ নয়নে মা সেই অপূর্ব রূপরাশি অবলোকন করিতেছেন।রাত্রি প্রভাত হইল। বেলা হইল। তবুও রোগীর নিদ্রাভঙ্গ হইল না। মা কাছে বসিয়া রহিলেন। নিঃশব্দে ভগিনী আসিয়া মার কাছে বসিলেন।
রোগীর ওষ্ঠদ্বয় একবার ঈষৎ নড়িল। অপরিস্ফুট স্বরে কি বলিল। শুনিবার নিমিত্ত ভগিনী মস্তক অবনত করিলেন। শুনিতে পাইলেন না, বুঝিতে পারিলেন না।
আবার ওষ্ঠ নড়িল, রোগী আবার কি বলিল। মা এইবার সে কথা বুঝিতে পারিলেন।
মা বলিলেন, “খেতু খেতু করিয়াই বাছা আমার সারা হইল, আজ কয়দিন মুখে কেবল ওই নাম। এখন যদি চারিহাত এক করিতে পারি, তবেই মনের কালি যায়।”মার সুমধুর কন্ঠ-স্বর কন্যার কর্ণ-কুহরে প্রবেশ করিল। সম্পূর্ণরূপে জাগরিত হইয়া, ধীরে ধীরে সে চক্ষু উন্মীলন করিল। বিস্মিতবদনে চারিদিক নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।
মা বলিলেন, “বিকার সম্পূর্ণরূপ এখনও কাটে নাই। চক্ষুতে এখনও সুদৃষ্টি হয় নাই। আজ উনিশ দিন মা আমার কাহাকেও চিনিতে পারে নাই।”
ভগিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কঙ্কাবতী, তুমি আমাকে চিনিতে পার?”
কঙ্কাবতী অতি মৃদুস্বরে উত্তর করিল, “পারি, তুমি বড় দিদি!”ভগিনী পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইনি কে বল দেখি?”
কঙ্কাবতী বলিল, “মা।”
তনু রায় ঘরের ভিতর আসিলেন। তনু রায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কঙ্কাবতী, আজ কেমন আছ মা?”
কঙ্কাবতী বলিল, “ভাল আছি বাবা।”
তনু রায় একটু কাছে বসিলেন। স্নেহের সহিত কন্যার গায় মাথায় একটু হাত বুলাইলেন। তাহার পর বাহিরে চলিয়া গেলেন।কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “মা, আমার কি অতিশয় পীড়া হইয়াছিল ?”
মা বলিলেন, “হাঁ বাছা, আজ বাইশ দিন তুমি শয্যাগত। তোমার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না। এবার যে তুমি বাঁচিবে, সে আশা ছিল না।”
কঙ্কাবতী বলিল, “মা, আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিয়াছি। স্বপ্নটি আমার মনে এরূপ গাঁথা রহিয়াছে যে, প্রকৃত ঘটনা বলিয়া আমার বিশ্বাস হইতেছে। এখন আমার মনে নানা কথা আসিতেছে। তাহার ভিতর আবার কোনটি সত্য কোনটি স্বপ্ন, তাহা আমি স্থির করিতে পারিতেছি না। তাই মা, তোমাকে গুটিকতক কথা জিজ্ঞাসা করি। আচ্ছা মা, জনার্দন চৌধুরীর স্ত্রী-বিয়োগ হইয়াছে, সে কথা সত্য?”মা বলিলেন, “সে কথা সত্য। তাই লইয়াই তো আমাদের যত বিপদ।”
কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “মা, বরফ লইয়া কি দলাদলি হইয়াছিল, সে কথা কি সত্য?”
মা উত্তর করিলেন, “হাঁ বাছা, সে কথাও সত্য। সেই কথা লইয়া পাড়ার লোকে খেতুর মাকে কত অপমান করিয়াছিল।”
কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “তিনি এখন কোথায় মা?”মা বলিলেন, “তিনি আসেন এই। সমস্ত দিন এইখানেই থাকেন। আমার চেয়ে তিনি তোমাকে ভালবাসেন। তাঁহার হাতে তোমাকে একবার সঁপিয়া দিতে পারিলেই এখন আমার সকল দুঃখ যায়। কর্তার মত হইয়াছে, সকলের মত হইয়াছে, এখন তুমি ভাল হইলেই হয়।”
কঙ্কাবতী বুঝিল যে, তবে খেতুর মার মৃত্যু হয় নাই, সে কথাটি স্বপ্ন।
কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল এই দলাদলির পর আমার জ্বর হয়, না মা?”
মা বলিলেন, “এই সময় তোমার জ্বর হয়। তুমি একেবারে অজ্ঞান অচৈতন্য হইয়া পড়। তোমার ঘোরতর জ্বর-বিকার হয়। আজ বাইশ দিন।”কঙ্কাবতী বলিল, “তাহার পর মা, আমি নদীর ঘাটে গিয়া একখানি নৌকার উপর চড়ি না মা?”
মা বলিলেন, “বালাই, তুমি নৌকায় চড়িবে কেন মা? সেই অবধি তুমি শয্যাগত।”
কঙ্কাবতী বলিল, “মা, কত যে কি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখিয়াছি, তাহা আর তোমায় কি বলিব। সে সব কথা মনে হইলে হাসিও পায়, কান্নাও পায়। স্বপ্নে দেখিলাম কি মা, যে গায়ের জ্বালায় আমি নদীর ঘাটে গিয়া জল মাখিতে লাগিলাম। তাহার পর একখানি নৌকাতে চড়িয়া নদীর মাঝখানে গেলাম। নৌকাখানি আমার ডুবিয়া গেল। মাছেরা আমাকে তাদের রানী করিল, তাহার পর কিছুদিন গোয়ালিনী মাসীর বাড়ীতে রহিলাম। সেখান হইতে শ্মশানঘাটে গেলাম। তাহার পর পুনরায় বাড়ী আসিলাম। এক বৎসর পরে আমাদের বাটীতে একটি বাঘ আসিল। সেই বাঘের সহিত আমি বনে গেলাম। তার পর ভূতিনী, ব্যাঙ, মশা, কত কি দেখিলাম। তার পর মা আকাশে উঠিলাম, কত কি করিলাম, কত কি দেখিলাম, স্বপ্নটি যেন আমার ঠিক সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে। হাঁ মা, সে দলাদলির কি হইল?”মা উত্তর করিলেন, “সে দলাদলি সব মিটিয়া গিয়াছে। যখন তোমার সমূহ পীড়া, যখন তুমি অজ্ঞানে অভিভূত হইয়া পড়িয়া আছ, আজ আট নয় দিনের কথা আমি বলিতেছি, সেই সময় জনার্দন চৌধুরীর একটি পৌত্রের হঠাৎ মৃত্যু হইল। জনার্দন চৌধুরী সেই পৌত্রটিকে অতিশয় ভালবাসিতেন। তিনি শোকে অধীর হইয়া পড়িলেন। সেই সময় গোবর্ধন শিরোমণিরও সংকটাপন্ন পীড়া হইল। আর আমাদের বাটিতে তো তোমাকে লইয়া সমূহ বিপদ। জনার্দন চৌধুরীর সুমতি হইল। তিনি রামহরিকে আনিতে পাঠাইলেন। রামহরি সপরিবারে কলিকাতা হইতে দেশে আসিল। রামহরির সহিত জনার্দন চৌধুরী অনেকক্ষণ পরামর্শ করিলেন। তাহার পর রামহরি নিরঞ্জনকে ডাকিয়া আনিল। রামহরি, নিরঞ্জন, আমাদের কর্তাটি ও খেতু সকলে মিলিয়া জনার্দন চৌধুরীর বাটীতে গেলেন। জনার্দন চৌধুরী বলিলেন, আমি পাগল নাকি যে এই বৃদ্ধ বয়সে আমি পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম। নিরঞ্জনকে আমি দেশত্যাগী করিয়াছি। খেতু বালক, তাহার প্রতি আমি ঘোরতর অত্যাচার করিয়াছি। এই কথা বলিয়া তিনি নিরঞ্জনকে অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া তাঁহার ভূমি ফিরিয়া দিলেন। নিরঞ্জন এখন নিজের বাটীতে বাস করিতেছেন। খেতুকে অনেক আশীর্বাদ করিয়া জনার্দন চৌধুরী সান্ত্বনা করিলেন। আমাদের কর্তাটি আর সে মানুষ নাই। এক্ষণে তাঁহার মনে স্নেহ-মায়া দয়া-ধর্ম হইয়াছে। বিপদে পড়িলে লোকের এইরূপ সুমতি হয়। তোমার দাদাও এখন আর সেরূপ নাই। মাকে যেরূপ আস্থা-ভক্তি করিতে হয়, সুপুত্রের মত তোমার দাদাও এক্ষণে আমাকে আস্থা-ভক্তি করে। তোমার পীড়ার সময় তোমার দাদা অতিশয় কাতর হইয়াছিল। তুমি ভাল হইলে খেতুর সহিত তোমার বিবাহ হইবে। এবার আর এ কথার অন্যথা হইবে না। তোমার পীড়ার সময় খেতু, খেতুর মা, রামহরি, সীতা প্রভৃতি সকলেই প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছেন। এক্ষণে সকল কথা শুনিলে, এখন আর অধিক কথা শুনিয়া কাজ নাই। এখনও তুমি অতিশয় দুর্বল। পুনরায় অসুখ হইতে পারে।”কঙ্কাবতী অনেক দিন দুর্বল রহিল। ভাল হইয়া সারিতে তাহার অনেক বিলম্ব হইল। সীতা তাহার নিকট আসিয়া সর্বদা বসিত। স্বপ্ন-কথা সে সীতার নিকট সমুদয় গল্প করিল। সীতা মাকে বলিল, বউদিদি খেতুকে বলিলেন, এইরূপে কঙ্কাবতীর আশ্চর্য স্বপ্নকথা পাড়ার স্ত্রী-পুরুষ সকলেই শুনিল। স্বপ্ন-কথা আদ্যোপান্ত শুনিয়া কঙ্কাবতীর উপর সীতার বড় অভিমান হইল।
সীতা বলিল, “সমুদয় নক্ষত্রগুলি তোমরা নিজে পরিলে, আর তোমার পচাজলকে দিলে। আমার জন্য একটিও রাখিলে না। আমাকে তুমি ভালবাস না। তুমি তোমার পচাজলকে ভালবাস। আমি তোমার সহিত কথা কহিব না।”
কঙ্কাবতী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিল। পূর্বের ন্যায় পুনরায় সবল হইল। পীড়া হইতে সারিয়া কঙ্কাবতী সম্মুখে একটু-আধটু বাহির হইত। একদিন খেতু কঙ্কাবতীদের বাটীতে গিয়াছিল। সেইখানে একটি মশা উড়িতেছিল। খেতু সেই মশাটিকে ধরিয়া কঙ্কাবতীকে জিজ্ঞাসা করিল, “দেখ দেখি কঙ্কাবতী। এই মশাটি তো তোমার ‘পচাজল’ নয়? সে হয়তো তোমাকে খুঁজিতে আসিয়াছে।”লজ্জায় কঙ্কাবতী গিয়া ঘরে লুকাইল। সেই অবধি আর খেতুর সম্মুখে বাহির হইত না।
কঙ্কাবতী উত্তমরূপে আরোগ্য লাভ করিলে শুভ দিনে শুভ লগ্নে খেতু ও কঙ্কাবতীর শুভ-বিবাহ-কার্য সম্পন্ন হইল। ঘোরতর দুঃখের পর এই কার্য সুসম্পন্ন হইল সে জন্য সপ্তগ্রাম সমাজের লোক সকলেই আনন্দিত হইলেন। বিশেষতঃ জনার্দন চৌধুরী পরম প্রীতিলাভ করিলেন। তাঁহার বৃদ্ধ বয়স ও কফের ধাত কিন্তু সেজন্য তিনি কিছুমাত্র উপেক্ষা করেন নাই।
বিবাহের দিন সমস্ত রাত্রি তিনি তনু রায়ের বাটীতে উপস্থিত ছিলেন। চুপি চুপি তিনি কলিকাতা হইতে প্রচুর পরিমাণে বরফ আনয়ন করিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ-ভোজনের সময় পরিহাসচ্ছলে সকলকে তিনি বলিলেন, “বর যে একেলা ‘বরখ’ খাইয়া প্রাণ সুশীতল করিবে তাহা হইবে না, আমরাও আমাদের শরীর যৎসামান্য স্নিগ্ধ করিব।”দেশের লোক, যাঁহারা কখনও বরফ দেখে নাই, আজ বরফ দেখিয়া সকলেই চমৎকৃত হইল। আগ্রহের সহিত সকলেই সুস্নিগ্ধ বরফ-জল পান করিল। বাড়ীতে দেখাইবার জন্য অনেকেই অল্প কাঁচা বরফ লইয়া গেল।
শূদ্রভোজনের সময় গদাধর ঘোষ তিন লোটা বরফ জল পান করিল। আর প্রায় এক সের সেই করাতের মত কর্তনশীল ‘বরখ’ দন্ত দ্বারা চিবাইয়া খাইল।
তাহার পর কি হইল? তাহার পর আমার গল্পটি ফুরাইল। ন’টে গাছটির কপালে যাহা লেখা ছিল, তাহাই ঘটিল। সেই ঘটনা লইয়া কত অভিযোগ উপস্থিত হইল।