দ্বিতীয় খণ্ড - সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
নক্ষত্রদের বউ
খোক্কশের বাচ্চা ধরিয়া আকাশে উঠিবার কথা নাকেশ্বরী ও নাকেশ্বরীর মাসী বসিয়া বসিয়া শুনিল। তাহারা দুইজনে পরামর্শ করিতে লাগিল যে, যদি এই কাজটি নিবারণ করিতে পারা যায়, তাহা হইলে খর্বুর আর আমাদের দোষ দিতে পারিবে না, অথচ খাদ্যটিও আমাদের হাতছাড়া হইবে না।
মাসী বলিল, “বৃদ্ধ হইয়াছি। এখন পৃথিবীর অর্ধেক দ্রব্যে অরুচি। এইরূপ কোমল রসাল মাংস খাইতে এখন সাধ হয়। যদি ভাগ্যক্রমে একটি মিলিল, তাও বুঝি যায়!”
নাকেশ্বরী বলিল, “মাসী তুমি এক কর্মকর। তোমার ঝুড়িতে বসিয়া তুমি গিয়া আকাশে উঠ। সমস্ত আকাশ তুমি একেবারে চুনকাম করিয়া দাও। ভাল করিয়া দেখিয়া শুনিয়া চুনকাম করিবে কোথাও যেন একটু ফাঁক না রহিয়া যায়। তুমি তোমার চশমা নাকে দিয়া যাও, তাহা হইলে ভাল করিয়া দেখিতে পাইবে। চুনকাম করিয়া দিলে ছুঁড়ী আর আকাশের ভিতর যাইতে পথ পাইবে না, চাঁদও দেখিতে পাইবে না, চাঁদের মূল-শিকড়ও কাটিয়া আনিতে পারিবে না।”দুইজনে এইরূপ পরামর্শ করিয়া মাসী গিয়া ঝুড়িতে বসিল। ঝুড়ি হুহু শব্দে আকাশে উঠিল। সমস্ত আকাশে নাকেশ্বরীর মাসী চুনকাম করিয়া দিল।
অট্টালিকা হইতে বাহির হইবার সময়ে মশা দেখিলেন যে সেখানে একটি ঢাক পড়িয়া রহিয়াছে। মশা সেই ঢাকটি সঙ্গে লইলেন। বাহিরে আসিয়া কঙ্কাবতী ও মশা হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। যে বনে খোক্কশের বাচ্চা হইয়াছে, সেই বনে সকলে চলিলেন। সন্ধ্যার পর খোক্কশের গর্তের নিকট উপস্থিত হইলেন।
একবার আকাশ পানে চাহিয়া মশা বলিলেন, “কি হইল? আজ দ্বিতীয়ার রাত্রি, চাঁদ এখন উঠিলেন না কেন? মেঘ করে নাই, তবে নক্ষত্র সব কোথায় গেল? আকাশ এরূপ শুভ্রবর্ণ ধারণ করিল কেন?ধাড়ী খোক্কশ আপনার বাচ্চা চৌকি দিয়া গর্তে বসিয়া আছে। একে রাত্রি, তাতে নিবিড় অন্ধকার বন। দূর হইতে ধাড়ী খোক্কশ কঙ্কাবতীর গন্ধ পাইল।
ভয়ংকর চীৎকার করিয়া ধাড়ী খোক্কশ বলিল, “হাঁউ মাঁউ খাঁউরে, মঁনুষ্যের গঁন্ধ পাঁউরে! কে রা তোরা, এদিকে আসিস?”
মশা চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই কে?”
খোক্কশ বললেন, “আমরা আবার কে? আমরা খোক্কশ!”মশা বলিলেন, “আমরা আবার কে? আমরা ঘোক্কশ!”
এই উত্তর শুনিয়া খোক্কশের ভয় হইল খোক্কশ বলিল, “বাপ রে! তবে তো তোরা কম নয়? ক খ গ ঘ, আমি খ-য়ে তোরা ঘ-য়ে, আমার চেয়ে তোরা দুই পইঠা উঁচু! আচ্ছা, কেমন তোরা ঘোক্কশ, একবার কাশ দেখি, শুনি?”
মশা তখন সেই ঢাকটি ঢং ঢং করিয়া বাজাইলেন।
সেই শব্দ শুনিয়া খোক্কশ বলিল, “ওরে বাপ রে! তোদের কাশির কি শব্দ! শুনলে ভয় হয়, কানে তালা লাগে! তোরা ঘোক্কশ বটে!”খোক্কশ কিন্তু কিছু সন্দিগ্ধ চিত্ত। এরূপ অকাট্য প্রমান পাইয়াও তবু তাহার মনে সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল না। তাই সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা! তোরা কেমন ঘোক্কশ, তোদের মাথার একগাছা চুল ফেলিয়া দে দেখি?”
এই কথা বলিতে, মশা হাতীর কাছিগাছটি ফেলিয়া দিলেন। খোক্কশ তাহা হাতে করিয়া দেখিতে লাগিল। অনেক দেখিয়া শেষে বলিল, “ওরে বাপ রে! এই কি তোদের মাথার চুল! তোদের চুল যখন এত বড়, এত মোটা, তখন তোরা না জানি কত মোটা। তোদের সঙ্গে পারা ভার।”
তবুও কিন্তু খোক্কশের মনে সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল না। ভাবিয়া চিন্তিয়া খোক্কশ পুনরায় বলিল, “আচ্ছা তোরা যদি ঘোক্কশ, তবে তোদের মাথার একটা উকুন ফেলিয়া দে দেখি?”
মশা বলিলেন, “কঙ্কাবতী, শীঘ্র হাতীর পিঠ হইতে নামো।”তাহার পর মশা হাতীকে বলিলেন, “হাতী ভায়া! এইবার!”
এই কথা বলিয়া মশা হাতীটিকে ধরিয়া খোক্কশের গর্তে ফেলিয়া দিলেন। গর্তে পড়িয়া হাতী শুঁড় দিয়া খোক্কশের বাচ্চাটিকে ধরিলেন। খোক্কশের বাচ্চা ‘চ্যাঁ চ্যাঁ’ শব্দে ডাকিয়া স্বর্গ মর্ত্য পাতাল তোলপাড় করিয়া ফেলিল। শুঁড়বিশিষ্ট পর্বতাকার উকুন দেখিয়া, ত্রাসে খোক্কশের প্রাণ উড়িয়া গেল। খোক্কশ ভাবিল, ওদের মাথার উকুন আসিয়া তো আমার বাচ্চাটিকে ধরিল, ঘোক্কশেরা নিজে আসিয়া আমাকে না ধরে! এই মনে করিয়া খোক্কশ বাচ্চা ফেলিয়া উড়িয়া পলাইল।
মশা ও কঙ্কাবতী তখন সেই গর্তের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।মশা বলিলেন, কঙ্কাবতী, তুমি এখন ইহার পৃষ্ঠে আরোহণ কর। খোক্কশ-শাবকের পিঠে চড়িয়া তুমি এখন আকাশে গিয়া উঠ, চাঁদের শিকড় লইয়া পুনরায় এখানে আসিবে। তোমার প্রতীক্ষায় আমরা এক্ষনে বসিয়া রহিলাম। তুমি আসিলে আমরা খোক্কশের বাচ্চাটিকে ফিরাইয়া দিব। কারণ, এখনও এ স্তন্যপান করে, অতি শিশু। ইহাকে লইয়া আমরা কি করিব? যাহা হউক তুমি এখন আকাশের দোর্দণ্ড সিপাহীটার হাত হইতে, রক্ষা পাইলে হয়। শুনিয়াছি সে অতি ভয়ংকর দোর্দণ্ড-প্রতাপান্বিত সিপাহী, সাবধানে আকাশ উঠবে।”
আকাশ পানে চাহিয়া মশা পুনরায় বলিলেন, “কঙ্কাবতী, আমার কিন্তু আশ্চর্য বোধ হইতেছে। আজ দ্বিতীয়ার রাত্রি, চাঁদ উঠিবার সময় অনেকক্ষণ উর্ত্তীণ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু চাঁদও দেখিতে পাই না, নক্ষত্রও দেখিতে পাই না। অথচ মেঘ করে নাই। কালো মেঘে না ঢাকিয়া, সমস্ত আকাশ বরং শুভ্রবর্ণ হইয়াছে, ইহার অর্থ আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। ইহার কারণ কি? আকাশে উঠিলে হয়তো তুমি বুঝতে পারিবে। অতি সাবধানে আপনার কার্য উদ্ধার করিবে।”কঙ্কাবতী খোক্কশ-শাবকের পিঠে চড়িয়া আকাশের দিকে তাহাকে পরিচালিত করিল, দ্রুতবেগে খোক্কশ-শাবক উড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতী অবিলম্বে আকাশের নিকট গিয়া উপস্থিত হইল।
আকাশের কাছে গিয়া কঙ্কাবতী দেখিল যে, সমুদয় আকাশ চুন-কাম করা। কঙ্কাবতী ভাবিল এ কি প্রকার কথা। আকাশের উপর এরূপ চুনকাম করিয়া কে দিল?
আকাশের উপর উঠিতে কঙ্কাবতী আর পথ পায় না। যে দিকে যায়, সেই দিকেই দেখে চুনকাম। আকাশের এক ধার হইতে অন্য ধার পর্যন্ত ঘুরিয়া বেড়াইল পথ কিছুতেই পাইল না। সব চুনকাম। কঙ্কাবতী ভাবিল, ঘোর বিপদ! আকাশের উপর এখন উঠি কি করিয়া?হতাশ হইয়া আকাশের চারি ধারে কঙ্কাবতী পথ খুঁজিতে লাগিল। অনেকক্ষণ অন্বেষণ করিয়া, সহসা এক স্থানে একটি সামান্য ছিদ্র দেখিতে পাইল। সেই ছিদ্রটি দিয়া নক্ষত্রদের বউ উঁকি মারিতেছিল। কঙ্কাবতী সেই ছিদ্রটির নিকট গেল। কঙ্কাবতীকে দেখিয়া নক্ষত্রের বউ একবার লুকাইল, পুনরায় আবার ভয়ে ভয়ে উঁকি মারিতে লাগিল।
কঙ্কাবতী বলিল, “ওগো নক্ষত্রদের বউ! তোমার কোনও ভয় নাই। আমিও মেয়েমানুষ, আমাকে দেখিয়া আবার লজ্জা কেন বাছা?”
নক্ষত্রদের বউ উত্তর করিল, “কে গা মেয়েটি তুমি? তোমার কথাগুলি বড় মিষ্ট। অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতেছি, তুমি চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছ। তাই মনে করিলাম তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, কি তুমি খুঁজিতেছ? কিন্তু হাজার হউক, আমি বউ মানুষ, সহসা কি কাহারও সঙ্গে কথা কহিতে পারি? তাতে রাত্রি কাল। একটু আস্তে কথা কও বাছা! আমার ছেলে-পিলেরা সব শুইয়াছে, এখনই জাগিয়া উঠিবে, কাঁচা ঘুম ভাঙিলে কাঁদিয়া জ্বালাতন করিবে।”কঙ্কাবতী বলিল, “ওগো নক্ষত্রদের বউ! আমার নাম কঙ্কাবতী। আমি পতিহারা সতী, আমি বড় অভাগিনী। আকাশের ভিতর যাইবার নিমিত্ত পথ অন্বেষণ করিতেছি। তা, আজ এ কি হইয়াছে বাছা, পথ কেন পাই না? একবার আকাশের ভিতর উঠিতে পারিলে আমার পতির প্রাণ রক্ষা হয়। বাছা, তুমি যদি পথটি বলিয়া দাও তো আমার বড় উপকার হয়।”
নক্ষত্রদের বউ উত্তর করিল, “পথ আর বাছা, তুমি কি করিয়া পাইবে? এই সন্ধ্যাবেলা এক বেটী ভূতিনী-বুড়ী আসিয়া আকাশের উপর সব চুনকাম করিয়া দিয়াছে। তা যাই হউক, আমি চুপি চুপি তোমাকে আকাশের খিড়কি-দ্বারটি খুলিয়া দিই। সেই পথ দিয়া তুমি আকাশের ভিতর প্রবেশ কর।”
এই কথা বলিয়া, নক্ষত্রদের বউ চুপি চুপি আকাশের খিড়কি-দ্বারটি খুলিয়া দিল। সেই পথ দিয়া কঙ্কাবতী আকাশের উপর উঠিল।