দ্বিতীয় খণ্ড - চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
মশা প্রভু
তিন সতীনে পুনরায় ঘোরতর বিবাদ বাধিল। রক্তবতী চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। মশার ঘরে কোলাহলের রোল উঠিল। এমন সময় মশা বাড়ী আসিলেন। ঘরে কলহ-কচকচির কোলাহল শুনিয়া মশার সর্বশরীর জ্বলিয়া গেল।
মশা বলিলেন, “এ যন্ত্রণা আর আমার সহ্য হয় না। তোমাদের ঝগড়ার জ্বালায় আমাদের ঘরের কাছে গাছের ডালে কাক-চিল বসিতে পারে না। যেখানে এরূপ বিবাদ হয় সেখানে লক্ষ্মী থাকেন না। তালুকে মনুষ্যদিগের শরীরে শোণিত শুষ্ক হইয়া যায়। ইচ্ছা হয় যে গলায় দড়ি দিয়া মরি, কি বিষ খাইয়া মরি। আত্মহত্যা করিয়া আমাকে মরিতে হইবে। এই সেদিন ধর্মে ধর্মে আমার প্রাণটি রক্ষা হইয়াছে। আমি একজন আফিমখোরের গায়ে বসিয়াছিলাম। তাহার রক্ত কি তিক্ত, এক শুঁড় রক্ত সব ফেলিয়া দিলাম। বার বার কুলকুচা করিয়া তবে প্রাণ রক্ষা হইল। মনে করিলাম অপঘাত মৃত্যুতে মরিব। তাই এত কাণ্ড করিয়া প্রাণ বাঁচাইলাম। কিন্তু তোমাদের জ্বালায় এত জ্বালাতন হইয়াছি যে বাঁচিতে আর আমার তিলমাত্র সাধ নাই।”এইরূপে মশা স্ত্রীগণকে অনেক ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন। অবশেষে তাহার রাগ পড়িলে তিনি একটু সুস্থির হইলে রক্তবতী গিয়া তাঁহার কোলে বসিলেন।
রক্তবতী বলিলেন, “বাবা, আমার পচাজল আসিয়াছে।”
মশা জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে আবার কে? পচাজল আবার কি?”রক্তবতীর মা উত্তর করিলেন, “ওগো একটি মানুষের কন্যা। সন্ধ্যা হইতে এখানে বসিয়া আছে। রক্তবতী তাহার সহিত পচাজল পাতাইয়াছে। আহা, বালিকা এখানে আসিয়া পর্যন্ত কেবল কাঁদিতেছে। বলে, আমি পতিহারা সতী। পতিকে নাকেশ্বরী খাইয়াছে। আমি লোকালয়ে যাইব, সেখান হইতে বৈদ্য আনিয়া আমার পতিকে ভাল করিব। আমি তাকে বলিলাম, বাছা একটু অপেক্ষা কর। কর্তাটি বাড়ী আসুন, তাঁহার সহিত পরামর্শ করিয়া তোমার একটা উপায় করা যাইবে। তুমি যখন রক্তবতীর পচাজল হইয়াছ, তখন তোমার দুঃখ মোচন করিতে আমরা যথাসাধ্য যত্ন করিব।― রক্তবতীর পচাজল হইবে, রক্তবতী পচাজলকে লইয়া সাধ আহ্লাদ করিবে, তোমার আর দুইটি রানীর প্রাণে সহিবে কেন? তাঁদের আবার ওই মানুষের ছানাটিকে পুষিতে সাধ হইল। সেই কথা লইয়া আমাকে তারা যা-না-তাই বলিল। তা আমার আর এখানে থাকিয়া আবশ্যক নাই। তুমি আমাকে বাপের বাড়ী পাঠাইয়া দাও। দিয়া দুই রানী লইয়া সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর-কন্না কর। আমি তোমার কন্টক হইয়াছি। আমি এখান হইতে যাই।”মশা জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে মানুষের কন্যাটি কোথায়?”
রক্তবতীর মা বলিলেন, “ওই বাহিরে বসিয়া আছে।”
রক্তবতী বলিলেন, “বাবা, তুমি আমার সঙ্গে এস। আমার পচাজল কোথায় আমি এখনই দেখাইয়া দিব।”
মশা ও রক্তবতী দুই জনে উড়িলেন। বিষণ্ণ বদনে অশ্রুপূরিত নয়নে যেখানে কঙ্কাবতী বসিয়াছিল, গুনগুন করিয়া দুই জনে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।রক্তবতী বলিলেন, “পচাজল, এই দেখ বাবা আসিয়াছেন।”
কঙ্কাবতী সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিয়া মশাকে নমস্কার করিল। কঙ্কাবতীকে ভাল করিয়া দেখিতে পাইবেন বলিয়া মশা গিয়া একটি ঘাসের ডগার উপর বসিলেন। তাহার পাশে আর একটি ঘাসের ডগার উপর রক্তবতী বসিলেন। মশার সম্মুখে হাত জোড় করিয়া কঙ্কাবতী দণ্ডায়মান রহিল।
অতি বিনীতভাবে কঙ্কাবতী বলিল, “মহাশয়, বিপন্না অনাথা বালিকা আমি। জনশূন্য এই গহন কাননে আমি একাকিনী। আমি পতিহারা সতী। আমি দুঃখিনী কঙ্কাবতী। প্রাণসম পতি আমার ভূতিনীর হস্তগত হইয়াছেন। আমার পতিকে উদ্ধার করিয়া দিন। আমি আপনার শরণ লইলাম।”মশা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কাহার সম্পত্তি?”
কঙ্কাবতী উত্তর করিল “মহাশয়, পূর্বে আমি পিতার সম্পত্তি ছিলাম। বাল্যকালে মনুষ্য-বালিকারা পিতার সম্পত্তি থাকে। এক্ষণে আমি আমার পতির সম্পত্তি।”
মশা বলিলেন, “উহু, সে কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি না। তুমি কোন্ মশার সম্পত্তি?”
কঙ্কাবতী উত্তর করিল, কোন মশার সম্পত্তি। সে কথা তো আমি কিছুই জানি না। কই আমি তো কোনও মশার সম্পত্তি নই।”
মশা বলিলেন, রক্তবতী, তোমার পচাজল দেখিতেছি পাগলিনী, উন্মত্তা। ইহার কোনও জ্ঞান নাই। সঠিক সত্য সত্য কথার উত্তর না পাইলে তোমার পচাজলের কি করিয়া আমি উপকার করি?”
রক্তবতী বলিলেন, “ভাই পচাজল, বাবা যে কথা জিজ্ঞাসা করেন, সত্য সত্য তাহার উত্তর দাও।”মশা বলিলেন, “শুন মনুষ্য-শাবক, এই ভারতে যত নর-নারী দেখিতে পাও ইহারা সকলেই মশাদিগের সম্পত্তি। যে মশা মহাশয় তোমার অধিকারী তাঁহার নিকট হইতে বোধ হয় তুমি পলাইয়া আসিয়াছ। সেই ভয়ে তুমি আমার নিকট সত্য কথা বলিতেছ না, আমার নিকট কথা গোপন করিতেছ। তোমার ভয় নাই, তুমি সত্য সত্য আমার কথার উত্তর দাও। আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি কোন্ মশার সম্পত্তি? কোন্ মশা তোমার গায়ে উপবিষ্ট হইয়া রক্তপান করেন? তাঁহার নাম কি? তাঁহার নিবাস কোথায়? তাঁহার কয় স্ত্রী? কয় পুত্র? কয় কন্যা? পৌত্র দৌহিত্র আছে কি না? তাঁহার জ্ঞাতি-বন্ধুদিগের তোমার উপর কোনও অধিকার আছে কিনা? তাঁহারা তোমাকে এজমালিতে রাখিয়াছেন, কি তোমার হস্তপদাদি বন্টন করিয়া লইয়াছেন? যদি তুমি বন্টিত হইয়া থাক, তাহা হইলে সে বিভাগের দলিল কোথায়? মধ্যস্থ দ্বারা তুমি বন্টিত হইয়াছ, কি আদালত হইতে আমিন আসিয়া তোমাকে বিভাগ করিয়া দিয়াছে? এই সব কথার তুমি আমাকে সঠিক উত্তর দাও। কারণ, আমি তোমাকে কিনিয়া লইবার বাসনা করি। আমার তালুকে অনেক মানুষ আছে। মানুষের অভাব নাই। আমার সম্পত্তি নরনারীগণের দেহে যা রক্ত আছে তাহাই খায় কে? তবে তুমি রক্তবতীর সহিত পচাজল পাতাইয়াছ, সেইজন্য তোমাকে আমি একেবারে কিনিয়া লইতে বাসনা করি। তাহা যদি না করি তাহা হইলে তোমার অধিকারী মশাগণ আমার নামে আদালতে অভিযোগ উপস্থিত করিতে পারেন। তোমাকে এখান হইতে তাঁহারা পুনরায় লইয়া যাইতে পারেন! আমার রক্তবতী তাহা হইলে কাঁদিবে। এখন বল তোমার মশা-প্রভুর নাম কি।”কঙ্কাবতী উত্তর করিলেন, “মহাশয়, আমি আপনাকে সত্য বলিতেছি। আমার মশা-প্রভুর নাম আমি জানি না। মনুষ্যেরা যে মশাদিগের সম্পত্তি তাহাও আমি এত দিন জানিতাম না। মশাদিগের মধ্যে যে মনুষ্যেরা বিতরিত, বিক্রীত ও বন্টিত হইয়া থাকে তাহাও আমি জানিতাম না। মশাদিগের যে আবার নাম থাকে তাহাও আমি জানি না। তা আমি কি করিয়া বলি যে, আমি কোন মশার সম্পত্তি?”
ক্রোধে মশা প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিলেন। রাগে তাঁহার নয়ন আরক্ত হইয়া উঠিল। মশা বলিলেন, “না, তুমি কিছুই জান না! তুমি কচি খুকীটি! গায়ে কখনও মশা বসিতে দেখ নাই! সে মশাগুলিকে তুমি চেন না! তাহাদের তুমি নাম জান না! তুমি ন্যাকা! পতিহারা সতী হইয়া কেবল পথে পথে কাঁদিতে জান!”মশার এইরূপ তাড়নায় কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিল। কঙ্কাবতীর পানে চাহিয়া রক্তবতী চক্ষু টিপিলেন। সে চক্ষু-টিপুনির অর্থ এই যে, পচাজল, তুমি কাঁদিও না। বাবা বড় রাগী মশা। একে রাগিয়াছেন, তাতে তুমি কাঁদিলে আরও রাগিয়া যাইবেন। চুপ কর। বাবার রাগ এখনই যাইবে।
রক্তবতী যাহা বলিলেন, তাহাই হইল। কঙ্কাবতীর কান্না দেখিয়া মশা আরও রাগিয়া উঠিলেন। মশা বলিলেন, “এ কোথাকার প্যানপেনে মেয়েটা র্যা। ভ্যানোর ভ্যানোর করিয়া কাঁদে দেখ।”
রক্তবতী বলিলেন, “আমার পচাজল মানুষের ছানা বই তো নয়। মানুষদের বুদ্ধি সুদ্ধি নাই, তা সকল মশাই জানে। নির্বোধ মশাকে সকলে মানুষ বলিয়া গালি দেয়। সকলে বলে, ‘অমুক মশা তো মশা নয়, ওটা একটা মানুষ। তা আমাদের মত পচাজলের বোধ-শোধ কেমন করিয়া হইবে? আমার পচাজলকে বাবা তুমি আর বকিও না।”মশা ভাবিলেন, সত্য কথা। মানুষের ছানাটাকে আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করা বৃথা। আমাকে নিজেই সকল সন্ধান লইতে হইবে।
মশা জিজ্ঞাসা করিলেন, “বলি হাঁগো মেয়ে, এখন তোমার বাড়ী কোন্ গ্রামে বল দেখি? তাহা বলিতে পারিবে তো?”
কঙ্কাবতী উত্তর করিল যে, তাহাদের গ্রামের নাম কুসুমঘাটী। মশা তৎক্ষণাৎ আপন অনুচরদিগকে কুসুমঘাটী পাঠাইলেন ও কঙ্কাবতীর প্রভুগণকে ডাকিয়া আনিতে আদেশ করিলেন। দূতগণ, কুসুমঘাটীতে উপস্থিত হইয়া অনেক সন্ধানের পর জানিতে পারিলেন যে, কঙ্কাবতীর অধিকারী তিনটি মশা। তাঁহাদের নাম গজগণ্ড, বৃহৎমুণ্ড ও বিকৃততুন্ড। রক্তবতীর পিতার নাম দীর্ঘশুন্ড। দূতগণ শুনিলেন যে কঙ্কাবতীর অধিকারিগণের বাস আকাশমুখ নামক শালবৃক্ষ। সেইখানে গিয়া কঙ্কাবতীর অধিকারিগণকে সকল কথা তাঁহারা বলিলেন। তাঁহারা দূতগণের সহিত আসিয়া অবিলম্বে দীর্ঘশুণ্ডের নিকট উপস্থিত হইলেন। অনেক বাদানুবাদ, অনেক দর কষা-কষির পর তিন ছটাক নররক্ত দিয়া কঙ্কাবতীকে দীর্ঘশুণ্ড কিনিয়া লইলেন। কঙ্কাবতীকে ক্রয় করিয়া তিনি কন্যাকে বলিলেন, “রক্তবতী এই নাও, তোমার পচাজল নাও। এই মানুষের ছানাটি এখন আমাদের নিজস্ব। ইহা এখন আমাদের সম্পত্তি।”