কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name দ্বিতীয় খণ্ড - দশম পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় খণ্ড - দশম পরিচ্ছেদ

চুরি

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, যদি নিতান্ত তুমি এখান হইতে পলাইবে না, তবে তোমাকে সকল কথা বলি, শুন। তুমি বালিকা, তাতে জন-শূন্য এই বিজন অরণ্যের মধ্যে আমাদের বাস। ঘরের দ্বারে ভয়ঙ্করী নাকেশ্বরী। পাছে তুমি ভয় পাও, তাই এতদিন সকল কথা তোমাকে বলি নাই। এখন বলি, শুন। কিন্তু কথা আমার শেষ হইলে হয়। শিকড় পোড়ার গন্ধ পাইলেই বোধ হয় নাকেশ্বরী জানিতে পারিবে যে, আমার কাছে আর শিকড় নাই। তখনই সে ভিতরে আসিয়া আমার প্রাণবধ করিবে। আমার কথা শেষ হইতে না হইতে পাছে আসিয়া পড়ে সেই ভয়।“মাতার অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়া সমাপ্ত করিয়া আমি কাশী অভিমুখে যাত্রা করিলাম। কলিকাতা না গিয়া কি জন্য পশ্চিমাঞ্চলে যাত্রা করিলাম, সে কথা তোমাকে পূর্বেই বলিয়াছি। কাশীতে উপস্থিত হইয়া মাতার শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সমাপ্ত করিলাম। তাহার পর কাজ-কর্মের অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। সৌভাগ্যক্রমে অবিলম্বেই একটি উত্তম কাজ পাইলাম। অতিশয় পরিশ্রম করিতে হইত সত্য, কিন্তু বেতন অধিক ছিল। এক বৎসরের মধ্যে অনেকগুলি টাকা সঞ্চয় করিতে পারিব, এরূপ আশা হইল। কেবল মাত্র শরীরে প্রাণ রাখিতে যাহা কিছু আবশ্যক, সেইরূপ যৎসামান্য ব্যয় করিয়া অবশিষ্ট টাকা আমি তোমার বাপের জন্য রাখিতে লাগিলাম। কঙ্কাবতী, বলিতে গেলে জল খাইয়া আমি জীবনধারণ করিতে লাগিলাম। সমস্ত দিন পরিশ্রম করিয়া এক এক দিন সন্ধ্যাবেলা এরূপ ক্ষুধা পাইত যে, ক্ষুধায় দাঁড়াইতে পারিতাম না, মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাইবার উপক্রম হইত। কিন্তু রাত্রিতে আর কিছু খাইতাম না। জলখাবার নয় কেবল খালি জল, তাই পান করিয়া উদর পূর্ণ করিতাম। তাহাতে শরীর অনেকটা সুস্থ হইত। কিছুক্ষণের নিমিত্ত ক্ষুধার জ্বালাও নিবৃত্ত হইত। তাহার পর শয়ন করিলে নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িতাম, ক্ষুধার জ্বালা আর জানিতে পারিতাম না। জল আনিবার জন্য কাহাকেও একটি পয়সা দিতাম না। একটি বড় লোটা কিনিয়াছিলাম। সন্ধ্যার পর যখন আমাকে কেহ চিনিতে পারিবে না, সেই সময়ে আপনি গিয়া গঙ্গার ঘাট হইতে জল আনিতাম। কাশীতে গঙ্গার ঘাট বড় উচ্চ। জল আনিতে গিয়া একদিন অন্ধকার রাত্রিতে আমি পড়িয়া গিয়াছিলাম। হাতে ও পায়ে অতিশয় আঘাত লাগিয়াছিল। কোনও মতে উঠিয়া সেই ঘাটের একটি সোপানে বসিলাম। কঙ্কাবতী, সেইখানে বসিয়া কত যে কাঁদিলাম, তাহা আর তোমাকে কি বলিব। মনে মনে বলিলাম যে, হে ঈশ্বর! আমি কি পাপ করিয়াছি যে, তাহার জন্য আমার এ ঘোর শাস্তি! তারপর আরও কত কি যে ভাবিলাম, তাহা আর তোমাকে কি বলিব, কঙ্কাবতী?“আস্তে আস্তে পুনরায় জল লইয়া বাটী প্রত্যাগমন করিলাম। এইরূপ এক বৎসর গত হইল। এই সময়ের মধ্যে প্রায় দুই সহস্র টাকা সঞ্চয় করিয়াছিলাম। মনে করিলাম, এই টাকা পাইলে তোমার পিতা পরিতোষ লাভ করিবেন। তোমাকে আমি পাইব। টাকাগুলি লইয়া দেশাভিমুখে যাত্রা করিলাম। সমুদয় নগদ টাকা ছিল, নোট লই নাই। কারণ নোটের প্রতি আমাদের গ্রামের লোকের আস্থা নাই। একটি ব্যাগের ভিতর টাকাগুলি লইয়া রেলগাড়ীতে চড়িলাম। ব্যাগটি নিজের কাছে অতি যত্নে অতি সাবধানে রাখিলাম। পাছে কেহ চুরি করে, পাছে কেহ লয়, এই ভয়ে একবারও গাড়ী হইতে নামি নাই। যখন সন্ধ্যা হইল তখন বড় একটি স্টেশনে আসিয়া গাড়ী থামিল। সেখানে অনেকক্ষণ গাড়ী দাঁড়াইবে। আমার বড় ক্ষুধা পাইয়াছিল। তবুও জলখাবার কিনিবার জন্য গাড়ী হইতে আমি নামিলাম না। যে গাড়ীতে আমি বসিয়াছিলাম, সে গাড়ীতে আর একটি অপরিচিত লোক ছিল, অন্য আর কেহ ছিল না। সে লোকটি নিজের জন্য জলখাবার আনিতে গেল। যাইবার সময় সে আমাকে জিজ্ঞাসা করিল,― মহাশয়, আপনার যদি কিছু প্রয়োজন থাকে তো বলুন, আমি আনিয়া দিই। আমি উত্তর করিলাম, যদি তুমি আনিয়া দাও, তাহা হইলে আমি উপকৃত হইব। এই বলিয়া, জল-খাবার কিনিবার নিমিত্ত তাহাকে আমি পয়সা দিলাম। সে আমাকে জল-খাবার আনিয়া দিল। আমি তাহা খাইলাম। অল্পক্ষণ পরে আমার মাথা ঘুরিতে লাগিল। মনে করিলাম, গাড়ীর উত্তাপে এইরূপ হইয়াছে। একটু শুইলাম। শুইতে না শুইতে ঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলাম। চৈতন্য কিছুমাত্র রহিল না। প্রাতঃকাল হইলে অল্পে অল্পে জ্ঞানের উদয় হইল। কিন্তু মাথা বড় ব্যথা করিতে লাগিল, মাথা যেন তুলিতে পারি না। যাহা হউক জ্ঞান ফিরিয়া দেখি যে, “শিয়রে আমার ব্যাগ নাই। চারিদিকে চাহিয়া দেখি যে, গাড়ীতে সে লোকটা নাই। আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল।”অনেকক্ষণ পরে কঙ্কাবতীর চক্ষুতে জল আসিল, কঙ্কাবতী কাঁদিতে লাগিল।

খেতু বলিল, “কান পাতিয়া শুন দেখি, নাকেশ্বরীর কোনও সাড়া-শব্দ পাও কি না?”

কঙ্কাবতী একটু কান পাতিয়া শুনিল, তাহার পর বলিল, “না, কোনও রূপ সাড়া-শব্দ নাই।”

খেতু পুনরায় বলিল, “তবে শুন, তাহার পর কি হইল। নাকেশ্বরী না আসিতে আসিতে সকল কথা বলিয়া লই।”“যখন বুঝিলাম ষে, আমার টাকাগুলি চুরি গিয়াছে, তখন মনে করিলাম আজ আমার সকল আশা নির্মূল হইল। যে লোকটি আমার সঙ্গে গাড়ীতে ছিল, সে চোর। জল-খাবারের সহিত সে কোনও প্রকার মাদক দ্রব্য মিশাইয়া দিয়াছিল। সেই জল-খাবার খাইয়া যখন আমি অজ্ঞান হইয়া পড়ি, তখন সে আমার টাকাগুলি লইয়া পলাইয়াছে। কখন কোন্ স্টেশনে নামিয়া গিয়াছে, তাহা আমি কি করিয়া জানিব? সুতরাং চোর ধরা পড়িবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। তবু রেলের কর্মচারীদিগকে সকল কথা জানাইলাম। আমাকে সঙ্গে লইয়া সমস্ত গাড়ী তাঁহারা অনুসন্ধান করিলেন।

“কোনও গাড়ীতে সে লোকটিকে দেখিতে পাইলাম না। তখন আমি পৃথিবী শূণ্য দেখিতে লাগিলাম। কি করিব আর কঙ্কাবতী? আমি চুপ করিয়া রহিলাম। ভাবিতে লাগিলাম, এখন করি কি? যাই কোথায়? কলিকাতা যাই, কি কাশী ফিরিয়া যাই, কি দেশে যাই। তারপর মনে পড়িল যে, রানীগঞ্জের টিকিটখানি আর গুটি-কতক পয়সা ভিন্ন হাতে আর কিছুই নাই।“কলিকাতা কি কাশী না গিয়া বাড়ী যাইব, স্থির করিয়া রানীগঞ্জে নামিলাম। রানীগঞ্জ হইতে আমাদের গ্রামে আসিতে দুইটি পথ আছে। একটি রাজপথ, যাহা দিয়া অনেক লোক গতি-বিধি করে, দ্বিতীয়টি বনপথ, যাহাতে বাঘ-ভালুকের ভয় আছে, সেজন্য সে পথ দিয়া লোকে বড় যাতায়াত করে না। বনপথটি কিন্তু নিকট। সে পথটি দিয়া আসিলে পাঁচ দিনে আমাদের গ্রামে উপস্থিত হইতে পারা যায়, রাজপথ দিয়া গেলে ছয়দিন লাগে। রানীগঞ্জে যখন নামিলাম, তখন আমার হাতে কেবল চারিটি পয়সা ছিল। শীঘ্র গ্রামে পৌঁছিব, সে নিমিত্ত আমি বনপথটি অবলম্বন করিলাম। প্রথম দিনেই পয়সা কয়টি খরচ হইয়া গেল। পাহাড়-পর্বত, বন-উপবন, নদী-নিঝর্র অতিক্রম করিয়া চলিতে লাগিলাম। বনের ফলমূল যাহা কিছু পাই, তাহাই খাই। রাত্রিতে যে দিন গ্রাম পাই সে দিন কাহারও দ্বারে পড়িয়া থাকি। যে দিন গ্রাম না পাই সে দিন গাছতলায় শুইয়া থাকি। মনে করিলাম, আমাকে বাঘ-ভালুকে কিছু বলিবে না, তাহার জন্য কোনও চিন্তা নাই। আমাকে যদি বাঘ-ভালুকে খাইবে, তবে পৃথিবীতে এমন হতভাগা আর কে আছে যে, এ দুঃখ সব ভোগ করিবে?“এইরূপে চারিদিন কাটিয়া গেল। আমাদের গ্রাম হইতে যে উচ্চ পর্বতটি দেখিতে পাওয়া যায়, সন্ধ্যাবেলা আমি সেই পর্বতের নিম্নদেশে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই পর্বতটি এই, যাহার ভিতর এক্ষণে আমরা রহিয়াছি। এখান হইতে আমাদের গ্রাম প্রায় একদিনের পথ। কয় দিন অনাহারে ক্রমেই দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলাম। মনে করিলাম কাল প্রাতঃকালে আরও অধিক দুর্বল হইয়া পড়িব, তাহার চেয়ে সমস্ত রাত্রি চলি, সকাল বেলা গ্রামে গিয়া পৌঁছিব। এইরূপ ভাবিয়া সে রাত্রিতে আর বিশ্রাম না করিয়া ক্রমাগত চলিতে লাগিলাম। রাত্রি এক প্রহরের পর চন্দ্র অস্ত গেল। ঘোরতর অন্ধকারে বন আচ্ছন্ন হইল, আমি পথ হারাইলাম। নিবিড় বনের মধ্যে গিয়া পড়িলাম, কোনও দিকে আর পথ পাই না। এমন সময় সম্মুখে একটি মন্দির দেখিতে পাইলাম। মন্দিরটি দেখিয়া আমার মৃতপ্রায় দেহে পুনরায় প্রাণের সঞ্চার হইল। ভাবিলাম অবশ্য এই স্থানে লোক আছে। আর কিছু পাই না পাই, এখন একটু জল পাইলে প্রাণরক্ষা হয়। এই ভাবিয়া তৃষিত চাতকের ন্যায় ব্যগ্রতার সহিত মন্দিরের দিকে গেলাম। হা অদৃষ্ট! গিয়া দেখিলাম মন্দিরে দেব নাই, দেবী নাই, জনমানব নাই! মন্দিরটি অতি প্রাচীন, ভগ্ন; ভিতর ও বাহির বন্য বৃক্ষলতায় আচ্ছাদিত। বহুকাল হইতে জনমানবের সেখানে পদার্পণ হয় নাই। হা ভগবান! তোমার মনে আরও কত কি আছে! এই বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সেইখানে আমি শুইয়া পড়িলাম।”