কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name দ্বিতীয় খণ্ড - নবম পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় খণ্ড - নবম পরিচ্ছেদ

শিকড়

আর একমাস গত হইয়া গেল।

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, কেবল আর এক মাস রহিল। এই এক মাস পরে আমরা স্বাধীন হইব। আর এক মাস গত হইয়া গেলে, আমাদিগকে আর বনবাসী হইয়া থাকিতে হইবে না। এই বিপুল বিভব লইয়া আমরা তখন দেশে যাইব।”

এক একটি দিন যায়, আর খেতু বলে, “কঙ্কাবতী, আর উনত্রিশ দিন রহিল। কঙ্কাবতী, আর আটাইশ দিন রহিল। কঙ্কাবতী, আর সাতাইশ দিন রহিল।”এইরূপে কুড়িদিন গত হইয়া গেল। কেবল আর দশ দিন রহিল। দশ দিন পরে কঙ্কাবতীকে লইয়া দেশে যাইবে, সেজন্য খেতুর মনে অসীম আনন্দের উদয় হইল। খেতুর মুখে সদাই হাসি!

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, তুমি এক কর্ম কর। কয়লা দ্বারা এই প্রাচীরের গায়ে দশটি দাগ দিয়া রাখ। প্রতিদিন প্রাতঃকালে উঠিয়া একটি করিয়া দাগ পুঁছিয়া ফেলিব, তাহা হইলে সম্মুখে সর্বদাই প্রত্যক্ষ দেখিব, ক-দিন আর বাকী রহিল।”

কঙ্কাবতী ভাবিল যে, দেশে যাইবার নিমিত্ত স্বামীর মন বড়ই আকুল হইয়াছে। প্রাচীরে তো দশটি দাগ দিলাম, যেমন এক একটি দিন যাইবে, তেমনি এক একটি দাগ তো মুছিয়া ফেলিলাম; তা তো সব হইবে। কিন্তু এক দিনেই কি দশটি দিন মুছিয়া ফেলিতে পারি না? এক দিনেই কি স্বামীর উদ্ধার করিতে পারি না? বাবা যা বলিয়া দিয়াছেন, তাই করিয়া দেখিলে তো হয়। আজ কি কাল যদি দেশে যাইতে পান, তাহা হইলে আমার স্বামীর মনে কতই না আনন্দ হইবে!এই দুই মাসের মধ্যে, পিতার কথা তাহার অনেক বার স্মরণ হইয়াছিল। মন্দ লোকে তাহার স্বামীকে গুণ করিয়াছে এই চিন্তা তাহার মনে বারবার উদয় হইয়াছিল। তবে মা বারণ করিয়া দিয়াছিলেন, সে জন্য এত দিন সে কোনও রূপ প্রতিকারের চেষ্টা করে নাই। এক্ষণে দেশে যাইবার নিমিত্ত স্বামীর ঘোরতর ব্যগ্রতা দেখিয়া কঙ্কাবতীর মন নিতান্ত অস্থির হইয়া পড়িল।

কঙ্কাবতী ভাবিল, বাবা পুরুষ মানুষ। পাহাড়-পর্বত বন-জঙ্গল, বাঘ-ভল্লুক, শিকড়-মাকড়, তন্ত্র-মন্ত্র, এ সকলের কথা বাবা যত জানেন, মা তত কি করিয়া জানিবেন? মা মেয়েমানুষ, ঘরের বাহিরে যান না। মা কি করিয়া জানিবেন যে, লোকে শিকড় দিয়া মন্দ করিলে তাহার কি উপায় করিতে হয়? শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিলেই সকল বিপদ কাটিয়া যায়, বাবা এই কথা বলিয়াছেন। এখনও দশ দিন আছে, স্বামী আমার দিন গণিতেছেন। যদি কাল তিনি বাড়ী যাইতে পান তাহা হইলে তাঁর কত না আনন্দ হইবে!এইরূপ কঙ্কাবতী সমস্ত দিন ভাবিতে লাগিল। একবার মনে ভাবে,― কি জানি, পাছে ভাল করিতে গিয়া মন্দ হয়। কাজ নাই, এ দশটা দিন চক্ষু-কর্ণ বুজিয়া চুপ করিয়া থাকি। বাবা যাহা করিতে বলিয়াছেন, মা তাহা বারণ করিয়াছেন।

আবার ভাবে, দুষ্টেরা আমার স্বামীর মন্দ করিয়াছে। দুষ্টদিগের দুরভিসন্ধি হইতে স্বামীকে আমি মুক্ত করিব। আমি যদি স্বামীকে মুক্ত করিতে পারি, তাহা হইলে তিনি কত না আমার উপর পরিতুষ্ট হইবেন।

ভাবিতে ভাবিতে সমস্ত দিন চলিয়া গেল। কি করিবে, কঙ্কাবতী কিছু স্থির করিতে পারিল না। রাত্রিতে কঙ্কাবতী এই চিন্তা করিতে লাগিল। তিলকসুন্দরী ও ভুশকুমড়োর গল্প মনে পড়িল।রাজপুত্র তিলকসুন্দরীর রূপে মুগ্ধ হইয়াছিলেন। তিলকসুন্দরীকে বিবাহ করিবার নিমিত্ত তাঁহার মন হইয়াছিল। তিলকসুন্দরীর সৎ-মা তাঁহার মাথায় একটি শিকড় দিয়া দিলেন। শিকড়ের গুণে তিলকসুন্দরী পক্ষী হইয়া গেল। উড়িয়া গিয়া গাছের ডালে বসিল। সৎ-মা কৌশল করিয়া আপনার কন্যা ভুশকুমড়োর সহিত রাজপুত্রের বিবাহ দিলেন। ভুশকুমড়োকে রাজপুত্র আদর করিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া তিলকসুন্দরী গাছের ডাল হইতে বলিল, “ভুশকুমড়ো কোলে। তিলকসুন্দরী ডালে!” রাজপুত্র মনে করিলেন,― পাখীটি কি বলে? রাজপুত্র সেই পাখীটিকে ডাকিলেন। পাখীটি আসিয়া রাজপুত্রের হাতে বসিল। সুন্দর পাখীটি দেখিয়া, রাজপুত্র তাহার মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। হাত বুলাইতে বুলাইতে মাথার শিকড়টি পড়িয়া গেল। পাখী তখন পুনরায় তিলকসুন্দরী হইল। রাজপুত্র তখন সৎ-মার দুষ্টাভিসন্ধি বুঝিতে পারিলেন। সৎ-মার কন্যা ভুশকুমড়োকে হেঁটে কাঁটা, উপরে কাঁটা দিয়া পুঁতিয়া ফেলিলেন। তিলকসুন্দরীকে লইয়া সুখে ঘরকান্না করিতে লাগিলেন।কঙ্কাবতীর সেই তিলকসুন্দরীর কথা এখন মনে হইল। আরব্য উপন্যাসে এই ভাবের যে গল্প আছে, তাহাও তাহার মনে পড়িল। সে ভাবিল,― দুষ্টগণ শিকড়ের দ্বারা এইরূপে লোকের মন্দ করে। আচ্ছা যাই দেখি, আমার স্বামীর মাথায় কোনও রূপ শিকড় আছে কি না।

এই মনে করিয়া সে অন্য ঘরে গিয়া বাতি জ্বালিল। বাতিটি হাতে করিয়া শয্যার পাশে দাঁড়াইয়া খেতুর মাথায় শিকড়ের অনুসন্ধান করিতে লাগিল। খেতু ঘোর নিদ্রায় অভিভূত। খেতু ইহার কিছুই জানে না।

সর্বনাশ! অনুসন্ধান করিতে করিতে কঙ্কাবতী খেতুর মাথায় একটি শিকড় দেখিতে পাইল।― বাবা যা বলিয়াছিলেন, তাই! দুষ্টলোকদিগের একবার দুরভিসন্ধি দেখ। ভাগ্যক্রমে আজ আমি মাথাটি অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম; তাহা না হইলে কি হইত?কঙ্কাবতী শিকড়টি খেতুর মাথা হইতে খুলিয়া লইতে চেষ্টা করিল। কিন্তু শিকড়টি মাথার চুলের সহিত দৃঢ়রূপে আবদ্ধ ছিল, খুলিয়া লইতে পারিল না। পাছে খেতু জাগিয়া উঠে, এই ভয়ে আর অধিক বল প্রয়োগ করিল না। পুনরায় অপর ঘরে গিয়া, সেস্থান হইতে কাঁচি লইয়া আসিল। চুলের সহিত শিকড়টি খেতুর মাথা হইতে কাটিয়া লইল। শিকড়টি তৎক্ষণাৎ বাতির অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া ফেলিল।

শিকড় পুড়িয়া ঘরের ভিতর অতি ভয়ানক তীব্র দুর্গন্ধ বাহির হইল। সেই গন্ধে কঙ্কাবতীর শ্বাস রোধ হইবার উপক্রম হইল। ভয়ে কঙ্কাবতী বিহ্বল হইয়া পড়িল। কঙ্কাবতীর সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল।

চমকিয়া খেতু জাগরিত হইল। মাথায় হাত দিয়া দেখিল যে, শিকড় নাই। বিহ্বলা, কম্পিত-কলেবরা, জ্ঞানহীনা কঙ্কাবতীকে সম্মুখে দণ্ডায়মানা, দেখিল। অচেতন হইয়া কঙ্কাবতী ভূতলশায়ী হয় আর কি, এমন সময় খেতু উঠিয়া তাহাকে ধরিল। বাতিটি তাহার হাত হইতে লইয়া আস্তে আস্তে বসাইল। কঙ্কাবতীর মুখে জল দিয়া কঙ্কাবতীকে সুস্থ করিবার নিমিত্ত চেষ্টা করিতে লাগিল।সুস্থ হইয়া কঙ্কাবতী বলিল, “আমি যে ঘোর কু-কর্ম করিয়াছি, তাহা আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি। আমাকে তুমি মা কর!”

এই বলিয়া, কঙ্কাবতী অধোবদনে বসিয়া কাঁদিতে লাগিল।

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, ইহাতে তোমার কোনও দোষ নাই। প্রথম তো অদৃষ্টের দোষ। তাহা না হইলে এত দিন গিয়া আজ এ দুর্ঘটনা ঘটিবে কেন? তাহার পর আমার দোষ। আমি যদি আদ্যোপান্ত সকল কথা তোমাকে প্রকাশ করিয়া বলিতাম, যদি তোমার নিকট কিছু গোপন না করিতাম, তাহা হইলে এ কাজ তুমি কখনই করিতে না, আজ এ দুর্ঘটনা ঘটিত না। শিকড়টি বাতির আগুনে পোড়াইয়া ফেলিয়াছ?”কঙ্কাবতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “হাঁ, শিকড়টি দগ্ধ করিয়া ফেলিয়াছি।”

খেতু বলিল, “তবে এখন তোমাকে বুকে সাহস বাঁধিতে হইবে। স্ত্রীলোক, বালিকার মত এখন আর কাঁদিলে চলিবে না। এই জনশূন্য অরণ্যের মধ্যে তুমি একাকিনী। তোমার জন্যই প্রাণ আমার নিতান্ত আকুল হইয়াছে। কঙ্কাবতী, প্রকৃত যাহারা পুরুষ হয়, মরিতে তাহারা ভয় করে না। অনাথিনী স্ত্রী প্রভৃতি পোষ্যদিগের জন্যই তাহারা কাতর হয়।

ব্যস্ত হইয়া কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “কেন? কি? আমাদের কি বিপদ হইবে? কি বিপদের আশঙ্কা তুমি করিতেছ?”

খেতু উত্তর করিল, “কঙ্কাবতী, যদি গোপন করিবার সময় থাকত, তাহা হইলে আমি গোপন করিতাম। কিন্তু গোপন করিবার আর সময় নাই। তোমাকে একাকিনী এ স্থান হইতে বাটী ফিরিয়া যাইতে হইবে। সুড়ঙ্গের ভিতর হইতে বাহির হইয়া ঠিক উত্তর মুখে যাইবে। প্রাতঃকাল হইলে সূর্য উদয় হইবে, সূর্যকে দক্ষিণদিকে রাখিয়া চলিলেই তুমি গ্রামে গিয়া পৌঁছিবে।”কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “আর তুমি?”

খেতু বলিল, “আমাকে এইখানেই থাকিতে হইবে। আমি এ স্থানের দ্রব্য ছুঁইয়াছি, এখান হইতে আমি টাকাকড়ি লইয়াছি, সুতরাং এখান হইতে আমি আর যাইতে পারিব না। আমাকে এইখানেই থাকিতে হইবে। সেইজন্য এখানকার কোনও দ্রব্য স্পর্শ করিতে তোমাকে মানা করিয়াছিলাম। এক্ষণে তুমি আর বিলম্ব করিও না। অট্টালিকা হইতে বাহির হইয়া সুড়ঙ্গপথে গমন করিবে। পর্বতের ভিতর হইতে বাহির হইয়া কোনও গাছতলায় রাত্রিটি যাপন করিবে। যখন প্রাতঃকাল হইবে, সূর্য উদয় হইবে, তখন কোন্ দিক উত্তর, অনায়াসেই জানিতে পারিবে। উত্তর-মুখে গেলেই গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইবে। কঙ্কাবতী, আর বিলম্ব করিও না।”

কঙ্কাবতী বলিল, “এ স্থান হইতে আমি যাইব? তোমাকে এইখানে রাখিয়া আমি এখান হইতে যাইব? এমন কথা তুমি কি করিয়া বলিলে? আমি ঘোরতর কুকর্ম করিয়াছি সত্য। আমি অপরাধিনী সত্য। আমি হতভাগিনী। কিন্তু তাই বলিয়া কি আমাকে দূর করিতে হয়? আমি বালিকা, আমি অজ্ঞান, আমি জানি না, না জানিয়া এ কাজ করিয়াছি। ভাল ভাবিয়া মন্দ করিয়াছি। আমার কি আর ক্ষমা নাই?”খেতু উত্তর করিল, “কঙ্কাবতী, তোমার উপর আমি রাগ করি নাই। রাগ করিয়া তোমাকে বলি নাই যে, তুমি এখান হইতে যাও। বড় বিপদের কথা, বড় নিদারুণ কথা, কি করিয়া তোমাকে বলি? এখান হইতে তোমাকে যাইতে হইবে। কঙ্কাবতী, নিশ্চয় তোমাকে এখান হইতে যাইতে হইবে, আর এখনই যাইতে হইবে। বিলম্ব করিলে চলিবে না। এখন তুমি পিতার বাটীতে গিয়া থাক, লোকজন সঙ্গে করিয়া দশ দিন পরে পুনর্বার এই বনের ভিতর আসিও। এই অট্টালিকার ভিতর যাহা কিছু ধনসম্পত্তি আছে, তাহা লইয়া যাইও। দশদিন পরে লইলে কোনও ভয় নাই, তখন তোমাকে কেহ কিছু বলিবে না। এই ধন-সম্পত্তি চারিভাগ করিবে। একভাগ তোমার পিতাকে দিবে, একভাগ রামহরি দাদা মহাশয়কে দিবে, একভাগ নিরঞ্জন কাকাকে দিবে, আর একভাগ তুমি লইবে। ব্রতনিয়ম ধর্মকর্ম দানধ্যান করিয়া জীবন যাপন করিবে। মনুষ্য-জীবন কয় দিন? কঙ্কাবতী, দেখিতে দেখিতে কাটিয়া যাইবে। তাহার পর এখন আমি যেখানে যাইতেছি, সেইখানে তুমি যাইবে। দুইজনে পুনরায় সাক্ষাৎ হইবে।”কঙ্কাবতী বলিল, “তোমার কথা শুনিয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে, প্রাণে বড় ভয় হইতেছে। হায়, আমি কি করিলাম। কি বিপদের কথা! কি নিদারুণ কথা! এখন কোথায় তুমি যাইবে? আমাকে ভাল করিয়া সকল কথা বল।”

খেতু বলিল, “তবে শুন। এই অট্টালিকার ভিতর যা ধন দেখিতেছ, ইহার প্রহরিণীস্বরূপ নাকেশ্বরী নামধারিণী এক ভয়ঙ্করী ভূতিনী আছে। সুড়ঙ্গের দ্বারে সর্বদা সে বসিয়া থাকে। সেই যে খল খল বিকট হাসি তুমি শুনিয়াছিলে, সে হাসি এই নাকেশ্বরীর। যে কেহ তাহার এই ধন,স্পর্শ করিবে মুহূর্তের মধ্যে সে তাহাকে খাইয়া ফেলিবে। আমি এই ধন লইয়াছি। কিন্তু যে শিকড়টি তুমি দগ্ধ করিয়া ফেলিয়াছ, সেই শিকড়ের দ্বারা এতদিন আমি রক্ষিত হইতেছিলাম। তা না হইলে এতদিন কোনকালে নাকেশ্বরী আমাকে খাইয়া ফেলিত। শিকড় নাই, এ কথা নাকেশ্বরী এখনও বোধ হয় জানিতে পারে নাই। কিন্তু শীঘ্রই সে জানিতে পারিবে। জানিতে পারিলেই সে এখানে আসিয়া আমাকে মারিয়া ফেলিবে। নাকেশ্বরীর হাত হইতে নিস্তার পাইবার কোনও উপায় নাই। এক তো এখান হইতে বাহিরে যাইবার অন্য উপায় নাই। তা থাকিলেও কোনও লাভ নাই। বনে যাই কি জলে যাই, গ্রামে যাই কি নগরে যাই, যেখানে যাইব, নাকেশ্বরী সেইখানে গিয়া আমাকে মারিয়া ফেলিবে।এই কথা শুনিয়া, কঙ্কাবতী খেতুর পা-দুটি ধরিয়া সেইখানে শুইয়া পড়িল।

খেতু বলিল, “কঙ্কাবতী, কাঁদিও না। কাঁদিলে আর কি হইবে? যাহা অদৃষ্টে ছিল, তাহা ঘটিল। সকলই তাঁহার ইচ্ছা। উঠ, যাও। আস্তে আস্তে সুড়ঙ্গ দিয়া বাহিরে যাও। এখনই নাকেশ্বরী এখানে আসিয়া পড়িবে। তাহাকে দেখিলে তুমি ভয় পাইবে। যাও, বাড়ী যাও। মার কাছে গেলে, তবু তোমার প্রাণ অনেকটা সুস্থ হইবে।”

কঙ্কাবতী উঠিয়া বসিল। আরক্ত-নয়নে আরক্ত-বদনে কঙ্কাবতী উঠিয়া বসিল। কঙ্কাবতীর মৃদু মনোমুগ্ধকারিণী সেই রূপ-মাধুরী উগ্রভাবাপন্ন হইয়া এখন অন্য প্রকার এক সৌন্দর্যের আবির্ভাব হইল।কঙ্কাবতী বলিল, “আমি তোমাকে এইখানে ছাড়িয়া যাই? তোমাকে এইখানে ছাড়িয়া নাকেশ্বরীর ভয়ে প্রাণ লইয়া আমি পলাইব? তা যদি করি, তো ধিক্ আমার প্রাণে, ধিক্ আমার বাঁচনে। শত ধিক আমার প্রাণে, শত ধিক্ আমার বাঁচনে। তোমার কঙ্কাবতী অল্পবুদ্ধি বালিকা বটে, সেইজন্য সে তোমার আজ্ঞা অবজ্ঞা করিয়াছে। তাই বলিয়া কঙ্কাবতী নরকের কীট নয়। নাকেশ্বরীর হাত হইতে তোমাকে উদ্ধার করিতে পারি ভাল, না পারি, তোমারও যে গতি, আমারও সেই গতি। যদি তোমার মৃত্যু তো আমারও মুত্যু। কঙ্কাবতী মরিতে ভয় করে না। তোমাকে ছাড়িয়া কঙ্কাবতী এ পৃথিবীতে থাকিতেও চায় না। কঙ্কাবতীর এই প্রতিজ্ঞা। কঙ্কাবতী নিশ্চয় নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিবে।”

খেতু কঙ্কাবতীর মুখপানে চাহিয়া দেখিল। কঙ্কাবতীর মুখ দেখিয়া বুঝতে পারিল যে, তাঁর প্রতিজ্ঞা অটল, অচল। কঙ্কাবতীর চক্ষে আর জল নাই, কঙ্কাবতীর মুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নাই। খেতু ভাবিল, কঙ্কাবতীকে আর যাইতে অনুরোধ করা বৃথা।