কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name দ্বিতীয় খণ্ড - সপ্তম পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় খণ্ড - সপ্তম পরিচ্ছেদ

বনে

পুঁটুলি হাতে করিয়া, কঙ্কাবতী ব্যাঘ্রের নিকট আসিয়া অধোবদনে দাঁড়াইল। ব্যাঘ্র মধুরভাষে বলিলেন, “কঙ্কাবতী, তুমি বালিকা। পথ চলিতে পারিবে না। তুমি আমার পৃষ্ঠে আরোহণ কর, আমি তোমাকে লইয়া যাই। তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্লেশ হইবে না।”

কঙ্কাবতী গাছ-কোমর বাঁধিয়া বাঘের পিঠের উপর চড়িয়া বসিল। ব্যাঘ্র বলিলেন, “কঙ্কাবতী, আমার পিঠের লোম তুমি দৃঢ়রূপে ধর। দেখিও, যেন পড়িয়া যাইও না।”

কঙ্কাবতী তাহাই করিল। ব্যাঘ্র বনাভিমুখে দ্রুতবেগে ছুটিলেন।বিজন অরণ্যের মাঝখানে উপস্থিত হইয়া ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “কঙ্কাবতী, তোমার কি ভয় করিতেছে?”

কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “তোমার সহিত যাইব, তাতে আবার আমার ভয় কি?”

কঙ্কাবতী এ কথা বলিল বটে, কিন্তু একেবারেই যে তাহার ভয় হয় নাই, তাহা নহে। বাঘের পিঠে সে আর কখনও চড়ে নাই, এই প্রথম। সুতরাং ভয় হইবার কথা।

ব্যাঘ্র বলিলেন, “কঙ্কাবতী, কেন আমি বাঘ হইয়াছি, সে কথা তোমাকে পরে বলিব। এ দশা হইতে শীঘ্রই আমি মুক্ত হইব, সেজন্য তোমার কোনও চিন্তা নাই। এখন কোনও কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিও না।”এইরূপ কথা কহিতে কহিতে দুইজনে যাইতে লাগিলেন। অবশেষে বৃহৎ এক অত্যুচ্চ পর্বতের নিকট গিয়া দুইজনে উপস্থিত হইলেন।

ব্যাঘ্র বলিলেন, “কঙ্কাবতী! কিছুক্ষণের নিমিত্ত তুমি চক্ষু বুজিয়া থাক। যতক্ষণ না আমি বলি, ততক্ষণ চক্ষু চাহিও না।”

কঙ্কাবতী চক্ষু বুজিল। ব্যাঘ্র দ্রুতবেগে যাইতে লাগিলেন। অল্পক্ষণ পরে খলখল করিয়া বিকট হাসির শব্দ কঙ্কাবতীর কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল।

কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “কি বিকট, কি ভয়ানক হাসি! ওরূপ করিয়া কে হাসিল?”ব্যাঘ্র উত্তর করিলেন, “সে কথা সব তোমাকে পরে বলিব। এখন শুনিয়া কাজ নাই। এখন তুমি চক্ষু উন্মীলন কর, আর কোনও ভয় নাই।”

কঙ্কাবতী চক্ষু চাহিয়া দেখিল যে,এক মনোহর অট্টালিকায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। শ্বেতপ্রস্তরে নির্মিত বহুমূল্য মণি-মুক্তায় অলংকৃত, অতি সুরম্য অট্টালিকা। ঘরগুলি সুন্দর,পরিষ্কৃত,নানা ধনে পরিপূরিত, নানা সাজে সুসজ্জিত। রজত, কাঞ্চন, হীরা, মাণিক, মুকুতা চারিদিকে রাশি রাশি স্তূপাকারে রহিয়াছে দেখিয়া কঙ্কাবতী মনে মনে অদ্ভুত মানিলেন। অট্টালিকাটি কিন্তু পর্বতের অভ্যন্তরে স্থিত। বাহির হইতে দেখা যায় না। পর্বত গাত্রে সামান্য একটি নিবিড় অন্ধকারময় সুড়ঙ্গ দ্বারা কেবল ভিতরে প্রবেশ করিতে পারা যায়। পর্বতের শিখরদেশ হইতে অট্টালিকার ভিতর আলোক প্রবেশ করে। কিন্তু আলোক আসিবার পথও এরূপ কৌশলভাবে নিবেশিত ও লুক্কায়িত আছে যে, সে পথ দিয়া ভূচর খেচর কেহ অট্টালিকার ভিতর প্রবেশ করিতে পারে না। অট্টালিকার ভিতর হইতে কেহ বাহিরে যাইতেও পারে না; অট্টালিকার ভিতর বসন,ভূষণ, খাট পালঙ্ক প্রভৃতি কোনও দ্রব্যের অভাব নাই। নাই কেবল আহারীয় সামগ্রী।অট্টালিকার ভিতর উপস্থিত হইয়া ব্যাঘ্র বলিলেন, “কঙ্কাবতী এখন তুমি আমার পৃষ্ঠ হইতে অবতরণ কর। একটুখানি এইখানে বসিয়া থাক, আমি আসিতেছি। কিন্তু সাবধান! এখানকার কোনও দ্রব্যে হাত দিও না, কোনও দ্রব্য লইও না। যাহা আমি হাতে করিয়া দিব, তাহাই তুমি লইবে,আপনা আপনি কোনও দ্রব্য স্পর্শ করিবে না?”

এইরূপ সতর্ক করিয়া ব্যাঘ্র সে স্থান হইতে চলিয়া গেলেন।

কিছুক্ষণ পরে খেতু আসিয়া কঙ্কাবতীর সম্মুখে দাঁড়াইল। খেতু জিজ্ঞাসা, “কঙ্কাবতী, আমাকে চিনিতে পার?”

কঙ্কাবতী ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল।খেতু পুনরায় বলিল, “কঙ্কাবতী, এই বনের মাঝখানে আসিয়া তোমার কি ভয় করিতেছে?”

কঙ্কাবতী মৃদুস্বরে উত্তর করিল, “না, আমার ভয় করে নাই। তোমাকে দেখিয়া আমার ঘোমটা দেওয়া উচিত, লজ্জা করা উচিত। তাহা আমি পারিতেছি না। তাই আমি ভাবিতেছি। তুমি কি মনে করিবে!”

খেতু বলিল, “না কঙ্কাবতী, আমাকে দেখিয়া তোমার ঘোমটা দিতে হইবে না, লজ্জা করিতে হইবে না। আমি কিছু মনে করিব না, তাহার জন্য তোমার ভাবনা নাই। আর এখানে কেবল তুমি আর আমি, অন্য কেহ নাই, তাতে লজ্জা করিলে চলিবে কেন? তাও বটে, আবার এখানে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নই। বিপদের আশঙ্কা বিলক্ষণ আছে।”কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “কি বিপদ?”

খেতু বলিল, “এখন সে কথা শুনিয়া তোমার কাজ নাই। তাহা হইলে ভয় পাইবে। এখন সে কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করিও না। তবে, এখন তোমাকে এইমাত্র বলিতে পারি যে, যদি তুমি এখানকার দ্রব্যসামগ্রী স্পর্শ না কর তাহা হইলে কোনও ভয় নাই, কোনও বিপদ হইবার সম্ভাবনা নাই। যেটি আমি হাতে তুলিয়া দিব সেইটি লইবে; নিজ হাতে কোনও দ্রব্য লইবে না। একবৎসর কাল আমাদিগকে এইখানে থাকিতে হইবে। তাহার পর এ সমুদয় ধনসম্পত্তি আমাদের হইবে। এই সমুদয় ধন লইয়া তখন আমরা দেশে যাইব। আচ্ছা কঙ্কাবতী, যখন আমি তোমাকে বিবাহ করি, তখন তুমি আমাকে চিনিতে পারিয়াছিলে?”কঙ্কাবতী উত্তর করিল, “তা আর পারি নি? এক বৎসর কাল তোমার জন্য পথপানে চাহিয়াছিলাম। যখন এক বৎসর গত হইয়া গেল, তখনও তুমি আসিলে না। তখন মা আর আমি হতাশ হইয়া পড়িলাম। মা যে কত কাঁদিতেন, আমি যে কত কাঁদিতাম, তাহা আর তোমাকে কি বলিব? কাল রাত্রিতে বাবা যখন বলিলেন যে, বাঘের সহিত আমি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব, আর সেই কথায় তুমি যখন বাহির হইতে বলিলে, তবে কি মহাশয় দ্বার খুলিয়া দিবেন? সেই গর্জনের ভিতর হইতেও একটু যেন বুঝিলাম যে, সে কাহার কন্ঠস্বর! তার পর আবার ঘরের ভিতর আসিয়া, যখন তুমি চুপি চুপি মার কানে ও আমার কানে বলিলে, কোনও ভয় নাই, তখন তো নিশ্চয়ই বুঝিলাম যে তুমি বাঘ নও।”

খেতু বলিল, “অনেক দুঃখ গিয়াচে। কঙ্কাবতী, তুমিও অনেক দুঃখ পাইয়াছ, আমিও অনেক দু:খ পাইয়াছি আর এক বৎসর কাল দুঃখ সহিয়া এইখানে থাকিতে হইবে। তাহার পর ঈশ্বর যদি কৃপা করেন তো আমাদের সুখের দিন আসিবে। দেখিতে দেখিতে এক বৎসর কাল কাটিয়া যাইবে। তখন এই সমুদয় ঐশ্বর্য আমাদের হইবে। আহা! মা নাই,এত ধন লইয়া যে কি করিব! তাই ভাবি, মা যদি বাঁচিয়া থাকিতেন, তাহা হইলে পৃথিবীতে যাহা কিছু পুণ্যকর্ম আছে সমস্ত আমি মাকে করাইতাম। যাহা হউক পৃথিবীতে অনেক দীন-দুঃখী আছে। কঙ্কাবতী, এখন কেবল তুমি আর আমি যতদূর পারি, দুই জনে জগতের দু:খমোচন করিয়া জীবন অতিবাহিত করিব।”কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করিল, “মাতার সৎকার কার্য সমাপ্ত করিয়া আমাকে বাটীতে রাখিয়া তাহার পর তুমি কোথায় গেলে, কি করিলে? ফিরিয়া আসিতে তোমার এক বৎসরের অধিক হইল কেন? তুমি ব্যাঘ্রের আকার ধরিলে কেন? সে সব কথা তুমি আমাকে এখন বলিবে না?”

খেতু বলিল, “না কঙ্কাবতী, এখন নয়। এক বৎসর গত হইয়া যাক, তাহার পর সব কথা তোমাকে বলিব।”

কঙ্কাবতী আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিল না।

কঙ্কাবতী ও খেতু পর্বত-অভ্যন্তরে সেই অট্টালিকায় বাস করিতে লাগিল। অট্টালিকার কোনও দ্রব্য কঙ্কাবতী স্পর্শ করে না! কেবল খেতু যাহা হাতে করিয়া দেয়, তাহাই গ্রহণ করে।অট্টালিকার ভিতর সমুদয় দ্রব্য ছিল, কেবল খাদ্য-সামগ্রী ছিল না। প্রতিদিন বাহিরে গিয়া খেতু বনের ফল-মূল লইয়া আসে, তাহাই দুইজনে আহার করিয়া কালযাপন করে। বাহিরে যাইতে হইলে, খেতু ব্যাঘ্ররূপ ধারণ করে। বাঘ না হইয়া খেতু বাহিরে কখনও যায় না। আবার অট্টালিকার ভিতর আসিয়া খেতু পুনরায় মনুষ্য হয়। কেন সে বাঘের রূপ না ধরিয়া বাহিরে যায় না, কঙ্কাবতী তাহা বুঝিতে পারে না, খেতু মানা করিয়াছে, সেজন্য জিজ্ঞাসা করিবারও জো নাই। এইরূপে দশমাস কাটিয়া গেল।

একদিন কঙ্কাবতী বলিল, “অনেকদিন মাকে দেখি নাই। মাকে দেখিতে বড় ইচ্ছা হয়। মাও আমাদের কোনও সংবাদ পান নাই। মাও হয়তো চিন্তিত আছেন। আমরা কোথায় গেলাম, কি করিলাম, মা, তাহার কিছুই জানেন না।”খেতু উত্তর করিল, “অল্প দিনের মধ্যে পুনরায় দেশে যাইব, সেজন্য আর তাঁহাদিগকে কোনও সংবাদ দিই নাই। আর লোকালয়ে যাইতে হইলেই আমাকে বাঘ হইয়া যাইতে হইবে, সেজন্য আর যাইতে বড় ইচ্ছাও হয় না। কি জানি কখন কি বিপদ ঘটে, বলিতে তো পারা যায় না। যাহা হউক, মাকে দেখিতে যখন তোমার সাধ হইয়াছে, তখন কাল তোমার এসাধ পূর্ণ করিব। কালসন্ধ্যার সময় মার নিকট তোমাকে আমি লইয়া যাইব। কঙ্কাবতী, বৎসর পূর্ণ হইতে আর কেবল দুই মাস আছে। যদি তোমার ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে এই দুই মাস তুমি না হয় বাপের বাড়ী থাকিও।”

কঙ্কাবতী বলিল, “না, তা আমি থাকিতে চাই না। তুমি এই বনের ভিতর নানা বিপদের মধ্যে একেলা থাকিবে, আর আমি বাপের বাড়ী থাকিব, তা কি কখনও হয়? মার জন্য মন উতলা হইয়াছে, কেবল একবার খালি মাকে দেখিতে চাই। দেখা-শুনা করিয়া আবার তখন ফিরিয়া আসিব।”