কঙ্কাবতী - Konkaboti by Troilokyanath Mukhopadhyay, chapter name দ্বিতীয় খণ্ড - ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় খণ্ড - ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

বাঘ

খেতু চলিয়া গেলে, দ্বারের পাশে প্রাচীরে ঠেস দিয়া, অনেকক্ষণ ধরিয়া কঙ্কাবতী কাঁদতে লাগল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত দ্বার ঠেলিতে তাহার সাহস হইল না। অবশেষে সাহসে বুক বাঁধিয়া আস্তে আস্তে সে দ্বার ঠেলিতে লাগিল।

শয্যা হইতে উঠিয়া, বাটীর ভিতর বসিয়া, তনু রায় তামাক খাইতে-ছিলেন। কে দ্বার ঠেলিতেছে দেখিবার নিমিত্ত তিনি দ্বার খুলিলেন। দেখিলেন, কঙ্কাবতী।

কঙ্কাবতীকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “এ কি? কঙ্কাবতী যে, তুমি মর নাই? তাই বলি, তোমার কি আর মৃত্যু আছে! এতদিন কোথায় ছিলে? আজ কোথা হইতে আসিলে? এতদিন যেখানে ছিলে পুনরায় সেইখানে যাও। আমার ঘরে তোমার আর স্থান হইবে না।কঙ্কাবতী বাটীর ভিতর প্রবেশ করিল না। সেই মলিন আর্দ্রবস্ত্র পরিহিতা থাকিয়া দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়া কেবল কাঁদিতে লাগিল। পিতার কথায় কোনও উত্তর করিল না।

পিতার তর্জন-গর্জনের শব্দ পাইয়া, পুত্রও সত্বর সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইল।

ভাই বলিল, “এই যে, কালামুখ লইয়া ফের এখানে আসিয়াছেন, যাবেন আর কোন্ চুলোয়। কিন্তু তাহা হইবে না, এ বাড়ী হইতে তোমার অন্ন উঠিয়াছে। এখন আর মনে করিও না যে, জনার্দন চৌধুরী তোমাকে বিবাহ করিবে। বাবা, পাড়ার লোক জানিতে না জানিতে কুলাঙ্গারীকে দূর করিয়া দাও।”বচসা শুনিয়া কঙ্কাবতীর দুই ভগিনী বাহিরে আসিল। অবশেষে মাও আসিলেন। মা দেখিলেন, দুঃখিনী কঙ্কাবতী দীন দরিদ্র মলিন বেশে দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছে। স্বামী ও পুত্র বিধিমতে ভর্ৎসনা করিয়া তাড়াইয়া দিতেছেন।

কঙ্কাবতীর মা কাহাকেও কিছু বলিলেন না। স্বামী কি পুত্র কাহারও পানে একবার চাহিলেন না। কঙ্কাবতীর বক্ষঃস্থল একবার আপনার বক্ষঃস্থলে রাখিয়া গদগদ মৃদুভাষে বলিলেন, “এস, আমার মা এস, দুঃখিনী মাকে ভুলিয়া এতদিন কোথায় ছিলে মা?”

মার বুকে মাথা রাখিয়া কঙ্কাবতীর প্রাণ জুড়াইল। অন্তরে অন্তরে যে খরতর অগ্নি তাহাকে দহন করিতেছিল, সে অগ্নি এখন অনেকটা নির্বাণ হইল।তাহার পর, মা কঙ্কাবতীর হাত ধরিলেন। অপর হাত দিয়া আর একটি মেয়ের হাত ধরিলেন। স্বামী ও পুত্রকে তখন সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “তোমরা কঙ্কাবতীকে দূর করিয়া দিবে? কঙ্কাবতীকে ঘরে স্থান দিবে না? বটে, এ দুধের বাছা কি হেন দুষ্কর্ম করিয়াছে যে, মা বাপের কাছে ইহার স্থান হইবে না? মান-সম্ভ্রম, পুণ্য ধর্ম লইয়া তোমরা এখানে সুখে স্বচ্ছন্দে থাক। আমরা চারিজন হতভাগিনী এখান হইতে বিদায় হই। এস মা, আমরা সকলে এখান হইতে যাই। দ্বারে দ্বারে আমরা মুষ্টিভিক্ষা করিয়া খাইব, তবু এই মুনি-ঋষিদের অন্ন আর খাইব না।”

তিন কন্যা ও মাতা, সত্য সত্যই বাটী হইতে প্রস্থান করিবার উপক্রম করিলেন। তখন তনু রায়ের মনে ভয় হইল।তনু রায় বলিলেন, “গৃহিণী, কর কি? তুমিও যে পাগল হইলে দেখিতেছি। এখন এ মেয়ে লইয়া আমি করি কি? এ মেয়ের কি আর বিবাহ হইবে? সেইজন্য বলি ওর যেখানে দুই চক্ষু যায় সেইখানে ও যাক, ওর কথায় আর আমাদের থাকিয়া কাজ নাই।”

তনু রায়ের স্ত্রী বলিলেন, “কঙ্কাবতীর বিবাহ হইবে না? আচ্ছা, সে ভাবনা তোমার ভাবিয়া কাজ নাই। সে ভাবনা আমি ভাবিব। কিন্তু তোমার তো প্রকৃত সে চিন্তা নয়! তোমার চিন্তা যে, জনার্দন চৌধুরীর টাকাগুলি হাত-ছাড়া হইল। যাহা হউক, তোমার গলগ্রহ হইয়া আর আমরা থাকিব না। যেখানে আমাদের দুই চক্ষু যায়, আমরা চারিজনে সেইখানে যাইব। মেয়ে তিনটির হাত ধরিয়া দ্বারে দ্বারে আমি ভিক্ষা করিব।”স্ত্রীর এইরূপ উগ্র মূর্তি দেখিয়া তনু রায় ভাবিলেন, ঘোর বিপদ! নানারূপ মিষ্ট বচন বলিয়া স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন। স্ত্রীর অনেকটা রাগ পড়িয়া আসিলে শেষে তনু রায় বলিলেন, “দেখ। পাগলের মত কথা বলিও না। যাও বাড়ীর ভিতর যাও। যাও মা কঙ্কাবতী, বাড়ীর, ভিতর যাও।”

মা, কঙ্কাবতী ও ভগিনী দুইটি বাড়ীর ভিতর চলিয়া গেলেন। কঙ্কাবতী পুনরায় বাপ-মার নিকট রইল। বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, আদ্যোপান্ত সমুদয় কথা কঙ্কাবতী মাকে বলিল কঙ্কাবতী নিজে, কি কঙ্কাবতীর মা, এ সমুদয় কথা অন্য কাহাকেও কিছু বলিলেন না।কঙ্কাবতীকে তনু রায় সর্বদাই ভর্ৎসনা করেন, সর্বদাই গঞ্জনা দেন। কঙ্কাবতী সে কথায় কোনও উত্তর করে না, অধোবদনে চুপ করিয়া শুনে।

তনু রায় বলেন, “এমন রাজা-হেন পাত্রের সহিত তোমার বিবাহ স্থির করিলাম। তোমার কপালে সুখ নাই, তা আমি কি করিব? জনার্দন চৌধুরীকে কত বুঝাইয়া বলিলাম, কিন্তু তিনি আর বিবাহ করিবেন না। এখন এ কন্যা লইয়া আমি করি কি? পঞ্চাশ টাকা দিয়াও কেহ এখন ইহাকে বিবাহ করিতে চায় না।”

স্ত্রী-পুরুষে মাঝে মাঝে এই কথা লইয়া বিবাদ হয়। স্ত্রী বলেন, “কঙ্কাবতীর বিবাহের জন্য তোমাকে চিন্তা করিতে হইবে না। এক বৎসর কাল চুপ করিয়া থাক। কঙ্কাবতীর বিবাহ আমি নিজে দিব। যদি আমার কথা না শুন, যদি অধিক বাড়াবাড়ি কর, তাহা হইলে মেয়ে তিনটির হাত ধরিয়া তোমার বাটী হইতে চলিয়া যাইব।”তনু রায় বৃদ্ধ হইয়াছেন। স্ত্রীকে এখন তিনি ভয় করেন, এখন স্ত্রীকে যাহা-ইচ্ছা তাহাই বলিতে বড় সাহস করেন না।

এইরূপে দেখিতে দেখিতে এক বৎসর কাটিয়া গেল। খেতুর দেখা নাই, খেতুর কোনও সংবাদ নাই। কঙ্কাবতীর মুখ মলিন হইতে মলিনতর হইতে লাগিল, কঙ্কাবতীর মার মনে ঘোর চিন্তার উদয় হইল। কঙ্কাবতীর বিবাহ বিষয়ে স্বামী কোনও কথা বলিলে এখন আর তিনি পূর্বের ন্যায় দম্ভের সহিত উত্তর করিতে সাহস করেন না। বৎসর শেষ হইয়া যতই দিন গত হইতে লাগিল, তনু রায়ের তিরস্কার ততই বাড়িতে লাগিল। কঙ্কাবতীর মা অপ্রতিভ হইয়া থাকেন, বিশেষ কোনও উত্তর দিতে পারেন না।

এক দিন সন্ধ্যার পর তনু রায় বলিলেন, “এত বড় মেয়ে হইল, এখন এ মেয়ে লইয়া আমি করি কি? সুপাত্র ছাড়িয়া কুপাত্র মিলাও দুর্ঘট হইল।”কঙ্কাবতীর মা উত্তর করিলেন, “আজ এক বৎসর অপেক্ষা করিলে, আর অল্পদিন অপেক্ষা কর। সুপাত্র শীঘ্রই মিলিবে।”

তনু রায় বলিলেন, “এক বৎসর ধরিয়া তুমি এই কথা বলিতেছ। কোথা হইতে তোমার সুপাত্র আসিবে, তাহা বুঝিতে পারি না। তোমার কথা শুনিয়া আমি এই বিপদে পড়িলাম। সে দিন যদি কুলাঙ্গারীকে দূর করিয়া দিতাম, তাহা হইলে আজ আমাকে এ বিপদে পড়িতে হইত না। এখন দেখিতেছি, সেকালের রাজারা যাহা করিতেন আমাকেও তাহাই করিতে হইবে। ব্রাহ্মণ না হয়, চণ্ডালের সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইবে। মনুষ্য না হয়, জীব জন্তুর সহিত কন্যার বিবাহ দিতে হইবে। রাগে আমার সর্ব শরীর জ্বলিয়া যাইতেছে। আমি সত্য বলিতেছি, যদি এই মুহূর্তে বনের বাঘ আসিয়া কঙ্কাবতীকে বিবাহ করিতে চায় তো আমি তাহার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিই। যদি এই মুহুর্তে, বাঘ আসিয়া বলে, রায় মহাশয়, দ্বার খুলিয়া দিন তো আমি তৎক্ষণাৎ দ্বার খুলিয়া দিই।”এই কথা বলিতে না বলিতে বাহিরে ভীষণ গর্জনের শব্দ হইল। গর্জন করিয়া কে বলিল, “রায় মহাশয়, তবে কি দ্বার খুলিয়া দিবেন?”

সেই শব্দ শুনিয়া তনু রায় ভয় পাইলেন, কিসে এরূপ গর্জন করিতেছে, কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। দেখিবার নিমিত্ত আস্তে আস্তে দ্বার খুলিলেন। দ্বার খুলিয়া দেখেন না, সর্বনাশ! এক প্রকাণ্ড ব্যাঘ্র বাহিরে দণ্ডায়মান!

ব্যাঘ্র বলিলেন, “রায় মহাশয়! এই মাত্র আপনি সত্য করিলেন যে, ব্যাঘ্র আসিয়া যদি কঙ্কাবতীকে বিবাহ করিতে চায়, তাহা হইলে ব্যাঘ্রের সহিত আপনি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিবেন। তাই আমি আসিয়াছি এক্ষণে আমার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিন, না দিলে এই মুহূর্তে আপনাকে খাইয়া ফেলিব।”তনু রায় ভীত হইয়াছিলেন সত্য, ভয়ে এক প্রকার হতজ্ঞান হইয়াছিলেন সত্য, কিন্তু তবুও আপনার ব্যবসায়টি বিস্মরণ হইতে পারেন নাই।

তনু রায় বলিলেন, “যখন কথা দিয়াছি তখন অবশ্যই তোমার সহিত আমি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব। আমার কথার নড় চড় নাই। মুখ হইতে একবার কথা বাহির করিলে সে কথা আর আমি কখনও অন্যথা করি না। তবে আমার নিয়ম তো জানেন? আমার কুল-ধর্ম রক্ষা করিয়া যদি আপনি বিবাহ করিতে পারেন তো করুন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই।”

ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “কত হইলে আপনার কুল-ধর্ম রক্ষা হয়?”তনু রায় বলিলেন, “আমি সদ্বংশজাত ব্রাহ্মণ। সন্ধ্যা-আহ্নিক না করিয়া জল খাই না। এরূপ ব্রাহ্মণের জামাতা হওয়া পরম সৌভাগ্যের কথা। আমার জামাতা হইতে যদি মহাশয়ের অভিলাষ থাকে, তাহা হইলে তোমাকে আমার সম্মান রক্ষা করিতে হইবে। কিঞ্চিৎ অর্থব্যয় করিতে হইবে।”

ব্যাঘ্র উত্তর করিলেন, “তা বিলক্ষণ জানি। এখন কত টাকা পাইলে মেয়ে বেচিবেন তাহা বলুন।”

তনু রায় বলিলেন, “এ গ্রামের জমিদার মান্যবর শ্রীযুক্ত জনার্দন চৌধুরী মহাশয়ের সহিত আমার কন্যার সম্বন্ধ হইয়াছিল। দৈব ঘটনাবশতঃ কার্য সমাধা হয় নাই। চৌধুরী মহাশয় নগদ দুই সহস্র টাকা দিতে স্বীকার করিয়াছিলেন। তিনি মনুষ্য, ব্রাহ্মণ, স্বজাতি। আপনি তাহার কিছুই নন। সুতরাং আপনাকে কিছু অধিক দিতে হইবে।”ব্যাঘ্র বলিলেন, “বাটীর ভিতর চলুন। আপনাকে আমি এত টাকা দিব যে আপনি কখনও চক্ষে দেখেন নাই, জীবনে স্বপনে কখনও ভাবেন নাই।”

এই কথা বলিয়া তর্জন গর্জন করিতে করিতে ব্যাঘ্র বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। তনু রায়ের মনে তখন বড় ভয় হইল। তনু রায় ভাবিলেন, এইবার বুঝি সপরিবারে খাইয়া ফেলে। নিরুপায় হইয়া তিনিও, ব্যাঘ্রের পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাটীর ভিতর গেলেন।

বাহিরে ব্যাঘ্রের গর্জন শুনিয়া এতক্ষণ কঙ্কাবতী, কঙ্কাবতীর মাতা ও ভগিনীগণ ভয়ে মৃতপ্রায় হইয়াছিলেন। তনু রায়ের পুত্র তখন ঘরে ছিল না, বেড়াইতে গিয়াছিল।যেখানে কঙ্কাবতী প্রভৃতি বসিয়াছিল, ব্যাঘ্র গিয়া সেইখানে উপস্থিত হইলেন। সেইখানে সকলের সম্মুখে তিনি একটি বৃহৎ টাকার তোড়া ফেলিয়া দিলেন।

ব্যাঘ্র বলিলেন, “খুলিয়া দেখুন, ইহার ভিতর কি আছে।”

তনু রায় তোড়াটি খুলিলেন; দেখিলেন, তাহার ভিতর কেবল মোহর! হাতে করিয়া, চশমা নাকে দিয়া, আলোর কাছে লইয়া, উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন ষে, মেকি মোহর নয়, প্রকৃত স্বর্ণমুদ্রা। সকলেই আশ্চর্য হইলেন যে, এত টাকা বাঘ কোথা হইতে আনিল? তনু রায়ের মনে আনন্দ আর ধরে না।তনু রায় ভাবিলেন, “এত দিন পরে এইবার আমি মনের মত জামাই পাইলাম।”

প্রদীপের কাছে লইয়া তনু রায় মোহরগুলি গণিতে বসিলেন।

এই অবসরে, ব্যাঘ্র ধীরে ধীরে কঙ্কাবতী ও কঙ্কাবতীর মাতার নিকট গিয়া বলিলেন, “কোনও ভয় নাই।”

কঙ্কাবতী ও কঙ্কাবতীর মাতা চমকিত হইলেন। কাহার সে কণ্ঠস্বর; তাহা তাঁহারা সেই মুহূর্তেই বুঝিতে পারিলেন। সেই কণ্ঠস্বর শুনিয়া তাঁহাদের প্রাণে সাহস হইল। কেবল সাহস কেন? তাঁহাদের মনে অনির্বচনীয় আনন্দের উদয় হইল। কঙ্কাবতীর মাতা মৃদুভাবে বলিলেন, “হে ঠাকুর! যেন তাহাই হয়।”ব্যাঘ্র এই কথা বলিয়া, পুনরায় তনু রায়ের নিকটে থাবা পাতিয়া বসিলেন। তোড়ার ভিতর হইতে তনু রায় তিন সহস্র স্বর্ণ-মুদ্রা গণিয়া পাইলেন।

ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে এখন?” তনু রায় উত্তর করিলেন, “এখন আর কি? যখন কথা দিয়াছি তখন এই রাত্রিতেই তোমার সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব। সে জন্য কোনও চিন্তা করিও না। আর মনে করিও না যে ব্যাঘ্র বলিয়া তোমার প্রতি আমার কিছুমাত্র অভক্তি হইয়াছে। না না আমি সে প্রকৃতির লোক নই। কাহারে কিরূপ মান-সম্ভ্রম করিতে হয় তাহা আমি ভালরূপ বুঝি। জনার্দন চৌধুরী দূরে থাকুক, যদি জনার্দন চৌধুরীর বাবা আসিয়া আজ আমার পায়ে ধরে, তবুও তোমাকে ফেলিয়া তাঁহার সহিত আমি কঙ্কাবতীর বিবাহ দিব না।”তাহার পর তনু রায় স্ত্রীকে বলিলেন, “তুমি আমার কথার উপর কথা কহিও না; তাহা হইলে অনর্থ ঘটিবে। আমি নিশ্চয় ইহাকে কন্যা সম্প্রদান করিব। ইহার মত সুপাত্র আর পৃথিবীতে পাইব না। এ বিষয়ে আমি কাহারও কথা শুনিব না। যদি তোমরা কান্নাকাটি কর তাহা হইলে এই ব্যাঘ্রকে বলিয়া দিব, এ এখনই তোমাদিগকে খাইয়া ফেলিবে।”

তনু রায়ের স্ত্রী উত্তর করিলেন, “তোমার যাহা ইচ্ছা, তাহাই কর। আমি কোনও কথায় থাকিব না।”

যাঁহার টাকা আছে তাঁহার কিসের ভাবনা? সেই দণ্ডেই তনু রায় পুত্রকে ডাকিতে পাঠাইলেন। সেই দন্ডেই প্রতিবাসী প্রতিবাসিনিগণ আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই দণ্ডেই নাপিত পুরোহিত আসিল। সেই দণ্ডেই বিবাহের সমস্ত আয়োজন হইল।সেই রাত্রিতেই ব্যাঘ্রের সহিত কঙ্কাবতীর বিবাহ কার্য সমাধা হইল। প্রকাণ্ড বনের বাঘকে জামাই করিয়া কার না মনে আনন্দ হয়? আজ তনু রায়ের মনে তাই আনন্দ ধরে না।

প্রতিবাসীদিগকে তিনি বলিলেন, “আমার জামাইকে লইয়া তোমরা আমোদ-আহ্লাদ করিবে। আমার জামাই যেন মনে কোনও রূপ দুঃখ না করে।”

জামাইকে তনু রায় বলিলেন, “বাবাজি! বাসর-ঘরে গান গাহিতে হইবে। গান শিখিয়া আসিয়াছ তো? এখানে কেবল হালুম-হালুম করিলে চলিবে না। শালী-শালাজ তাহা হইলে কান মলিয়া দিবে। বাঘ বলিয়া তাহারা ছাড়িয়া কথা কহিবে না।”বর না চোর! ব্যাঘ্র ঘাড় হেঁট করিয়া রহিলেন। বাসর ঘরে গান গাহিয়াছিলেন কি না, সে কথা শালী-শালাজ ঠানদিদিরা বলিতে পারেন। আমরা কি করিয়া জানিব?

প্রভাত হইবার পূর্বে ব্যাঘ্র তনু রায়কে বলিলেন, “মহাশয়, রাত্রি থাকিতে থাকিতে জনসমাজ পরিত্যাগ করিয়া বনে আমাকে পুনরাগমন করিতে হইবে। অতএব আপনার কন্যাকে সুসজ্জিতা করিয়া আমার সহিত পাঠাইয়া দিন। আর বিলম্ব করিবেন না।”

প্রতিবাসিনিগণ কঙ্কাবতীর চুল বাঁধিয়া দিলেন। কঙ্কাবতীর মাতা কঙ্কাবতীর ভাল কাপড়গুলি বাছিয়া বাছিয়া বাহির করিলেন।তাহা দেখিয়া তনু রায় রাগে আরক্ত-নয়নে স্ত্রীকে বলিলেন, “তোমার মত নির্বোধ আর এ পৃথিবীতে নাই। যাহার ঘরে এরূপ লক্ষ্মী-ছাড়া স্ত্রী তাহার কি কখনও ভাল হয়? বাঘের কিসের অভাব? কাপড়ের দোকানে গিয়া হালুম করিয়া পড়িবে, দোকানী দোকান ফেলিয়া পলাইবে, আর বাঘ কাপড়ের গাঁঠরি লইয়া চলিয়া যাইবে। স্বর্ণকারের দোকানে গিয়া বাঘ হালুম করিয়া পড়িবে, প্রাণের দায়ে স্বর্ণকার পলাইবে, আর বাঘ গহনাগুলি লইয়া চলিয়া যাইবে। দেখিয়া শুনিয়া যখন এরূপ সুপাত্রের হাতে কন্যা দিলাম, তখন আবার কঙ্কাবতীর সঙ্গে ভাল কাপড়-চোপড় দেওয়া কেন? তাই বলি তোমার মত বোকা আর এ ভূ-ভারতে নাই।”তনু রায় লক্ষ্মীমন্ত পুরুষ, বৃথা অপব্যয় একেবারে দেখিতে পারেন না। যখন তাঁহার মাতার ঈশ্বর-প্রাপ্তি হয়, তখন মাতা বিছানায় শুইয়া ছিলেন। নাভিশ্বাস উপস্থিত হইলে, মাকে তিনি কেবল মাত্র একখানি ছেঁড়া মাদুরে শয়ন করাইলেন। নিতান্ত পুরাতন নয় এরূপ একখানি বস্ত্র তখন তাঁহার মাতা পরিয়াছিলেন। কণ্ঠ-শ্বাস উপস্থিত হইলে সেই বস্ত্রখানি তনু রায় খুলিয়া লইলেন। আর একখানি জীর্ণ ছিন্ন গলিত নেকড়া পরাইয়া দিলেন। এইরূপ টানা হেঁচড়া করিতে ব্যস্ত থাকায় মৃত্যুসময়ে তিনি মাতার মুখে এক বিন্দু জল দিতে অবসর পান নাই; কাপড় ছাড়াইয়া ভক্তিভাবে যখন পুনরায় মাকে শয়ন করাইলেন তখন দেখিলেন যে মার অনেকক্ষণ হইয়া গিয়াছে।

স্বামীর তিরস্কারে তনু রায়ের স্ত্রী দুই একখানি ছেঁড়া-খোঁড়া নেকড়া-চোকড়া লইয়া একটি পুঁটুলি বাঁধিলেন। সেইটি কঙ্কাবতীর হাতে দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে, ঠাকুরদেবতাদের ডাকিতে ডাকিতে, কন্যাকে বিদায় দিলেন।