ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড এম্পায়ার by আইজাক আসিমভ, chapter name প্রথম পর্ব : দ্য জেনারেল - ২. জাদুকর

প্রথম পর্ব : দ্য জেনারেল - ২. জাদুকর

কামরায় চারজন ব্যক্তি চারটা পৃথক টেবিলে বসেছে, এবং কামরাটা মূল ভবন থেকে আলাদা, যেন অনুমতি ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে না পারে। তারা দ্রুত একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, তারপর অলসভাবে তাকিয়ে থাকল যার যার টেবিলের দিকে। টেবিলে চারটা বোতল এবং সমান সংখ্যক পূর্ণ গ্লাস, কিন্তু কেউ সেগুলো স্পর্শ করেনি।

দরজার কাছে বসা লোকটা টেবিলে মৃদু লয়ে তাল ঠুকল, তারপর বলল, “ এভাবে বসে থাকবে তোমরা? কে প্রথম কথা বলবে, এটা কোনো ব্যাপার?”

“তা হলে তুমিই বল প্রথমে,” ঠিক বিপরীত দিকের বিশালদেহী ব্যক্তি বলল। “তোমার দুশ্চিন্তাই সবচেয়ে বেশি।”

নিরানন্দ ভঙ্গিতে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল সিনেট ফোরেল। “কারণ তোমাদের ধারণা আমি সবচেয়ে ধনী। বেশ-নাকি তোমরা চাও যেভাবে শুরু করেছিলাম সেভাবে চালিয়ে যাই আমি। আশা করি ভুলে যাওনি যে আমার নিজস্ব ট্রেড ফ্লিট ওদের স্কাউট শিপকে ধরেছে।”

“তোমার ফ্লিট সবচেয়ে বড়,” তৃতীয়জন বলল, “এবং সেরা পাইলট; এভাবেও বলা যায় তুমি সবচেয়ে ধনী। ঝুঁকিটা ভয়ংকর; এবং আমাদের জন্য অনেক বেশি।”

আবারও ঠোঁট চাটল সিনেট ফোরেল। “জায়গা বুঝে ঝুঁকি নেওয়ার গুণটা আমি বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। লাভের পরিমাণ যখন অনেক বেশি হয় তখন বড় ঝুঁকি নেওয়া যায়। যেমন শত্রুদের মহাকাশযান দেখার পর নিজেদের কোনো ক্ষতি না করে এবং ওদেরকে সতর্ক না করেই সেটাকে ধরে ফেললাম।”

ফাউণ্ডেশন-এর সবাই জানে ফোরেল মহান হোবার ম্যালোর বংশধর। সবাই তাকে ম্যালোর অবৈধ পুত্র হিসেবে মেনে নিয়েছে।

ধীরে ধীরে ঘোট চোখগুলো কয়েকবার পিটপিট করল চতুর্থজন। তার পাতলা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে শব্দগুলো যেন হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল, “আমরা খুব ভাগ্যবান এটা ভেবে খুশি হওয়ার কিছু নেই, মহাকাশযান আটকে রাখায় ওই তরুণ বরং আরো রেগে উঠবে।”

“তোমার ধারণা ওর রাগ করার জন্য একটা উদ্দেশ্য দরকার?” তিরস্কারের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল ফোরেল।

“হ্যাঁ, এবং আমরা ঠিক তাই করছি অথবা কষ্ট করে ওকে একটা উদ্দেশ্য তৈরি করে নিতে হবে না। হোবার ম্যালো বা স্যালভর হার্ডিন কাজ করতেন অন্যভাবে। পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রতিপক্ষকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিতেন।”

ফাঁধ নাড়ল ফোরেল। “এই মহাকাশযান তার গুরুত্ব প্রমাণ করেছে। আমরা এটাকে লাভজনক দামে বেচতে পারব।” জন্ম বণিকের কণ্ঠে সন্তুষ্টির সুর। “তরুণ পুরোনো এম্পায়ার থেকে এসেছে।”

“আমরা জানি,” বিশালদেহী দ্বিতীয়জন গমগমে গলায় বলল

“আমরা সন্দেহ করেছিলাম,” হালকা গলায় সংশোধন করে দিল ফোরেল। “পয়সাঅলা কেউ এসে যদি বন্ধুত্ব এবং বাণিজ্যের প্রস্তাব দেয় তাকে নিরাশ করা উচিত হবে না, অন্তত যতক্ষণ না প্রমাণ হচ্ছে যে এর ভেতরে কোনো কূটকৌশল আছে। কিন্তু এখন-”

তৃতীয়জন যখন কথা বলল তার গলায় একটা আর্তভাব ফুটে উঠল। “আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। লোকটাকে ছেড়ে দেওয়ার আগেই সবকিছু জেনে নিতে হবে। সেটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।”

“এটার ফায়সালা হয়ে গেছে,” বলল ফোরেল। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার মতো করে হাত নেড়ে বিষয়টা থামিয়ে দিল সে।

“সরকার অনেক বেশি নরম,” অভিযোগের সুরে বলল তৃতীয়জন। “মেয়র একটা ইডিয়ট।

চতুর্থজন পালাক্রমে বাকি তিনজনের দিকে তাকাল। মুখ থেকে সিগারের অবশিষ্টাংশ নামিয়ে ফেলে দিল তার ডানদিকের একটা সুটে। চোখের পলকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সেটা।

তিরস্কারের সুরে বলল সে, “আশা করি যে ভদ্রলোক কথাগুলো বলেছেন তিনি অভ্যাসবশেই বলেছেন। কষ্ট করে একথা মনে করিয়ে দিতে চাই না যে আমরাই সরকার।”

সম্মতির গুঞ্জন উঠল সবার ভেতর।

চতুর্থজনের দৃষ্টি টেবিলের উপর নিবদ্ধ। “তা হলে সরকারের নিয়ম নীতি নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। এই তরুণ–এই আগম্ভক একজন সম্ভাব্য ক্রেতা হতে পারে। কিন্তু তোমরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছ সে অ্যাডভান্স কন্টাক্ট হিসেবে কাজ করছে। আমাদের ভেতরে একটা ভদ্রলোকের চুক্তি থাকার পরেও তোমরা চেষ্টা করছ।”

“তুমিও করেছ,” গজগজ করে বলল দ্বিতীয়জন।

“আমি জানি,” শান্ত সুরে বলল চতুর্থজন।

“তা হলে আগে কি করেছি ভুলে যাও।” অধৈর্য ভঙ্গিতে বাধা দিল ফোরেল। “এখন কী করব সেটা ভাবো। যদি তাকে বন্দি করে রাখি বা মেরে ফেলি কী হবে তখন? তার আসল উদ্দেশ্য এখনো আমরা জানি না, সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে একটা লোককে মেরে ফেললেই পুরো এম্পায়ার ধ্বংস হবে না। হয়তো তার ফেরার অপেক্ষায় অন্যদিকে নেভির পর নেভি অপেক্ষা করছে।”

“ঠিক,” একমত হল চতুর্থজন। “আটক মহাকাশযান থেকে কি জানতে পেরেছ তুমি।”

“অল্প কথাতেই সব বলে দেওয়া যাবে,” বলল ফোরেল,মুখে দন্ত বিকশিত হাসি। “সে একজন ইম্পেরিয়াল জেনারেল বা সেই সমপর্যায়ের কিছু একটা। তরুণ বয়সেই নিজের সামরিক দক্ষতা প্রমাণ করেছে। অন্তত: আমি তাই জেনেছি-এবং নিজের লোকদের কাছে সে একজন আদর্শ। কোনো সন্দেহ নেই এই লোকের সম্বন্ধে তারা যা বলেছে অর্ধেকই মিথ্যে, কিন্তু তারপরেও বলতে হবে সে এক আশ্চর্য মানুষ। বেশ রোমান্টিক ক্যারিয়ার।”

“এই ‘তারা কারা?” প্রশ্ন করল দ্বিতীয়জন।

“আটক মহাকাশযানের নাবিক। শোন, তাদের সব বক্তব্য আমি মাইক্রোফিল্মে রেকর্ড করে নিরাপদ স্থানে রেখেছি। পরে ইচ্ছা হলে তোমরা দেখতে পারবে। প্রয়োজন মনে করলে ওই লোকগুলোর সাথে তোমরা নিজেরা কথা বলতে পারো। আমি শুধু মূল বিষয়গুলো বলছি।”

“কথা বের করলে কীভাবে? কীভাবে জানো ওরা সত্যি কথা বলছে?”

ভুরু কোঁচকালো ফোরেল। “আমি ভালোমানুষের মতো ব্যবহার করিনি। হুমকি দিয়েছি, ভয় দেখিয়েছি, নির্দয়ের মতো প্রোব ব্যবহার করেছি। ওরা কথা বলেছে। বিশ্বাস করো সত্যি কথাই বলেছে।”

“প্রাচীন যুগে” অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল তৃতীয়জন, “ব্যবহার করা হতো পিওর সাইকোলজি। ব্যথাহীন এবং তুমি নিশ্চয়ই জানো তাতে মিথ্যা কথা বলার কোনো সুযোগই থাকতো না।”

“বেশ, প্রাচীন যুগের অনেক কিছুই ভালো ছিল,” শুকনো গলায় বলল ফোরেল। “এখন বর্তমান যুগ।”

“সে কি চায় এখানে,” ক্লান্ত অথচ একগুয়ে গলায় বলল চতুর্থজন। “এই অদ্ভুত রোমান্টিক চরিত্রের জেনারেল?”

তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকাল ফোরেল। “তোমার কি ধারণা সে তার অধীনস্থদের সাথে রাষ্ট্রের সব বিষয় নিয়েই কথা বলবে? ওরা কিছুই জানে না। চেষ্টা করেও কোনো কথা বের করতে পারিনি, গ্যালাক্সি জানে।”

“অর্থাৎ আমাদের সামনে একটাই পথ-”

“নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” আবার নিঃশব্দে টেবিলের উপর আঙুল দিয়ে তাল ঠুকতে লাগল ফোরেল! “এই তরুণ এম্পায়ারের একজন সামরিক নেতা, অথচ ভান করছে যেন একজন ধনী ব্যক্তি পেরিফেরির এই অদ্ভুত কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নক্ষত্রগুলো ভ্রমণে বেরিয়েছে। এটাই প্রমাণ করে যে আসল উদ্দেশ্য সে আমাদের জানাতে চায় না। এম্পায়ার একবার আমাদের হামলা করার চেষ্টা করেছিল, এই ঘটনার সাথে এটা যোগ দিলেই একটা অশুভ সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রথম হামলা ব্যর্থ হয়েছিল। সেকারণে এম্পায়ার আমাদের ভালবাসবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।”

“তুমি কিছুই জানতে পারোনি, রক্ষনাত্মক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল চতুর্থজন, “তুমি কোনো তথ্যই বের করতে পারোনি?”

“আমি কিছুই বের করতে পারবো না।” অলস সুরে জবাব দিল ফোরেল। “কোথাও বাণিজ্যিক বিদ্রোহের কোনো খবর নেই। একতা আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“দেশ প্রেম?” তৃতীয়জনের কণ্ঠে অবজ্ঞার সুর।

“গোল্লায় যাক দেশপ্রেম।” শান্ত সুরে বলল ফোরেল। “তোমার কি ধারণা ভবিষ্যৎ সেকেণ্ড এম্পায়ারের জন্য আমি তিল পরিমাণ নিউক্লিয়ার ইমেনেশন ত্যাগ করব? কোনো ট্রেড মিশনের উপর ঝুঁকি নেব? তোমার কি মনে হয় এম্পায়ারের আগ্রাসন তোমার বা আমার ব্যবসায়ে সাহায্য করবে? যদি এম্পায়ার বিজয়ী হয় তখন যুদ্ধের সুফল ভোগ করার জন্য ভূঁইফোঁড়ের মতো অনেকেই দাঁড়িয়ে যাবে।”

“ঠিকই বলেছে।” শুকনো গলায় বলল চতুর্থজন।

আচমকা নিজের নীরবতা ভাঙল দ্বিতীয়জন। রাগের সাথে এমনভাবে চেয়ারে নড়ে চড়ে বসল যার ফলে শরীরের ওজনে আর্তনাদ করে উঠল চেয়ারটা। “কিন্তু এই কথা বলে লাভ কী? এম্পায়ার জিততে পারবে না, পারবে? সেলডন নিশ্চয়তা দিয়েছেন আমরাই সেকেণ্ড এম্পায়ার তৈরি করব। এটা শুধু মাত্র আরেকটা ক্রাইসিস। আগে আরো তিনটা হয়েছিল।”

“আরেকটা ক্রাইসিস, হ্যাঁ!” ধ্যানমগ্ন সুরে বলল ফোরেল। “কিন্তু প্রথম দুটোর ক্ষেত্রে পথ দেখানোর জন্য ছিলেন স্যালভর হার্ডিন; তৃতীয়বারে ছিলেন হোবার ম্যালো। তাদের কেউই এখন আমাদের সাথে নেই।”

বাকি সবার দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে আবার শুরু করল সে, “সেলডনের সাইকোহিস্টোরির যে নিয়মের উপর নির্ভর করে আমরা ভরসা পাই তার ভেতর সম্ভবত এমন কোনো চালক আছে যার জন্য বিশেষ করে ফাউণ্ডেশন-এর জনগণের নিশ্চিত স্বাভাবিক উদ্যোগের প্রয়োজন হয়। সেলডন ল’এর সহায়তা পেতে হলে আগে নিজেকে চেষ্টা করতে হবে।”

“সময়ের প্রয়োজনেই মানুষ তৈরি হয়,” বলল তৃতীয়জন। “আরেকটা প্রবাদ।”

“এটার উপর পুরোপুরি নির্ভর করা যায় না,” স্বীকার করল ফোরেল। “আমার · মনে হচ্ছে, যদি এটা চার নম্বর ক্রাইসিস হয় তা হলে সেলডন পূর্বানুমান করে রেখেছেন। যদি করে রাখেন তা হলে এটা ঠেকানো যাবে এবং কোনো-না-কোনো উপায় অবশ্যই আছে।

“এম্পায়ার আমাদের চেয়ে শক্তিশালী; সবসময়ই ছিল। কিন্তু এই প্রথমবার আমরা তার সরাসরি আক্রমণের স্বীকার হচ্ছি, ফলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাকে ঠেকানো যাবে, কিন্তু সরাসরি শক্তি প্রয়োগ না করে ঠেকাতে হবে পূর্বের ক্রাইসিসগুলোর সময়ে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে সেরকমই কোনো পদ্ধতিতে। শত্রুর দুর্বল দিক খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।”

“সেই দুর্বল দিকটা কী?” জিজ্ঞেস করল চতুর্থজন। “তোমার কোনো ধারণা?”

“না। এই কথাটাই আমি বলার চেষ্টা করছি। আমাদের অতীতের মহান নেতারা সবসময়ই শত্রুর দুর্বল দিক খুঁজে বের করে সেদিকেই লক্ষ্য স্থির করতেন। কিন্তু এখন-”

তার কণ্ঠে ফুটে উঠল অসহায়ত্ব, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বলল না।

তারপর চতুর্থজন বলল, “আমাদের গুপ্তচরের প্রয়োজন।”

আগ্রহের সাথে তার দিকে ঘুরল ফোরেল। “ঠিক! এম্পায়ার কখন আক্রমণ করবে জানি না। নিশ্চয়ই একটা সময় ধরা আছে।”

“হোবার ম্যালো নিজে ইম্পেরিয়াল ডমিনিয়নের ভেতরে ঢুকেছিলেন।” দ্বিতীয়জনের প্রস্তাব।

কিন্তু মাথা নাড়ল ফোরেল। “এত সরাসরি কিছু করা যাবে না। অমাদের বয়স নেই; এবং সকলেই লাল ফিতা আর প্রশাসনিক জটিলতায় ফেঁসে আছি। আমাদের প্রয়োজন তরুণ একজন যে এখনো সরাসরি ফিল্ডে কাজ করছে।”

“স্বাধীন বণিক?” জিজ্ঞেস করল চতুর্থজন। এবং মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলল ফোরেল, “যদি এখনো সময় থাকে।”