নবম
অপুদের বাড়ি হইতে কিছু দূরে একটা খুব বড় অশ্বখ গাছ ছিল। কেবল তাহার মাথাটা উহাদের দালানের জানোলা কি রোয়াক হইতে দেখা যায়। অপু মাঝে মাঝে সেইদিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিত। যতবার সে চাহিয়া দেখে, ততবার তাহার যেন অনেক– অনেক–অনেক দূরের কোন দেশের কথা মনে হয়–কোন দেশ, এ তাহার ঠিক ধারণা হইত না–কোথায় যেন কোথাকার দেশ-মা’র মুখে ওই সব দেশের রাজপুত্ত্বরদের কথাই সে শোনে।
অনেক দূরের কথায় তাহার শিশুমনে একটা বিস্ময়মাখানো আনন্দের ভাবের সৃষ্টি করিত। নীল রং-এর আকাশটা অনেক দূর, ঘুড়িটা-কুঠির মাঠটা অনেক দূর-সে বুঝাইতে পারিত না, বলিতে পারিত না কাহাকেও, কিন্তু এসব কথায় তাহার মন যেন কোথায় উড়িয়া চলিয়া যাইত–এবং সর্বাপেক্ষা কৌতুকের বিষয় এই যে, অনেক দূরের এই কল্পনা তাহার মনকে অত্যন্ত চাপিয়া তাহাকে যেন কোথায় লইয়া ফেলিয়াছে–ঠিক সেই সময়েই মায়ের জন্য তাহার মন কেমন করিয়া উঠিত, যেখানে সে যাইতেছে সেখানে তাহার মা নাই, অমনি মায়ের কাছে। যাইবার জন্য মন আকুল হইয়া পড়িত। কতবার যে এ রকম হইয়াছে। আকাশের গায়ে অনেক দূরে একটা চিল উড়িয়া যাইতেছে-ক্রমে ছোট্ট-ছোট্ট-ছোট্ট হইয়া নীলুদের তালগাছের উঁচু মাথাটা পিছনে ফেলিয়া দূর আকাশে ক্ৰমে মিলাইয়া যাইতেছে—চাহিয়া দেখিতে দেখিতে যেমন উড়ন্ত চিলটা দৃষ্টিপথের বাহির হইয়া যাইত, অমনি সে চোখ নামাইয়া লইয়া বাহিরাবাটী হইতে এক দৌড়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠিয়া গৃহকার্যরত মাকে জড়াইয়া ধরিত। মা বলিত–দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের কাণ্ড দ্যাখো–ছাড়–ছাড়—দেখছিস সকড়ি হাত?..ছাড়ো মানিক আমার, সোনা আমার, তোমার জন্যে এই দ্যাখো চিংড়িমাছ ভাজছি–তুমি যে চিংড়িমাছ ভালোবাসো? হ্যাঁ, দুষ্টুমি করে না।–ছাড়ো–
আহারাদির পর দুপুরবেলা তাহার মা কখনও কখনও জানালার ধারে আঁচল পাতিয়া শুইয়া ছেঁড়া কাশীদাসী মহাভারতখানা সুর করিয়া পড়িত। বাড়ির ধারে নারিকেল গাছটাতে শঙ্খচিল ডাকিত, অপু নিকটে বসিয়া হাতের লেখা ক-খ লিখিতে লিখিতে একমনে মায়ের মুখের মহাভারত পড়া শুনিত। দুর্গাকে তাহার মা বলিত, একটা পান সেজে দে তো দুগগা। অপু বলিত, মা সেই ঘুটে কুড়োনোর গল্পটা? তাহার মা বলে– ঘুটে কুড়োনোর কোন গল্প বল তো–ও সেই হরিহোড়ের? সে তো অন্নদামঙ্গলে আছে, এতে তো নেই? পরে পান মুখে দিয়ে সুর করিয়া পড়িতে থাকিত–
রাজা বলে শুন শুন মুনির নন্দন।
কহিব অপূর্ব কথা না যায় বর্ণন।।
সোমদত্ত নামে রাজা সিন্ধু দেশে ঘর।
দেবদ্বিজে হিংসা সদা অতি–
অপু আমনি মায়ের মুখের কাছে হাতখানি পাতিয়া বলিত, আমায় একটু পান? মা চিবানো পান নিজের মুখ হইতে ছেলের প্রসারিত হাতের উপর রাখিয়া বলিত–এঃ, বড্ড তেতো–এই খয়েরগুলোর দোষ, রোজ হাটে বারণ করি ও-খয়ের যেন আনে না, তবুও–
জানালার বাহিরে বাঁশবনের দুপুরের রৌদ্র-মাখানো শেওড়া ঘেটু বনের দিকে চাহিয়া চাহিয়া মহাভারতের-বিশেষত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা শুনিতে শুনিতে সে তন্ময় হইয়া যায়। মহাভারতের সমস্ত চরিত্রের মধ্যে কর্ণের চরিত্র বড় ভালো লাগে তাহার কাছে। ইহার কারণ কর্ণের উপর তাহার কেমন একটা মমতা হয়। রথের চাকা মাটিতে পুতিয়া গিয়াছে–দুই হাতে প্ৰাণপণে সেই চাকা মাটি হইতে টানিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছেন– সেই নিরস্ত্ৰ অসহায়, বিপন্ন কর্ণের অনুরোধ মিনতি উপেক্ষা করিয়া অৰ্জ্জুন তীর ছাড়িয়া তাঁহাকে মারিয়া ফেলিলেন!! মায়ের মুখে এই অংশ শুনিতে শুনিতে দুঃখে অপুর শিশুহৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠিত, চোখের জল বাগ মানিত না-চোখ ছাপাইয়া তাহার নরম তুলতুলে গাল বাহিয়া গড়াইয়া পড়িত–সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দুঃখে চোখে জল পড়ার যে আনন্দ, তাহা তাহার মনোরাজ্যে নব অনুভূতির সজীবত্ব লইয়া পরিচিত হইতে লাগিল। জীবনপথের যে দিক মানুষের চোখের জলে, দীনতায়, মৃত্যুতে, আশাহত ব্যর্থতায়, বেদনায় করুণ–পুরোনো বইখানার ছেঁড়া পাতার ভরপুর গন্ধে, মায়ের মুখের মিষ্ট সুরে, রৌদ্র ভরা দুপুরের মায়া-অঙ্গুলি-নির্দেশে, তাহার শিশুদৃষ্টি অস্পষ্টভাবে সে পথের সন্ধান পাইত। বেলা পড়িলে মা গৃহকার্যে উঠিয়া গেলে, সে বাহিরে আসিয়া রোয়াকে দাঁড়াইয়া দূরের সেই অশ্বখ গাছটার দিকে এক এক দিন চাহিয়া দেখে–হয়তো কড়া চৈত্র-বৈশাখের রৌদ্রে গাছটার মাথা ধোঁয়া-ধোঁয়া অস্পষ্ট, নয়তো বৈকালের অবসন্ন রাঙা রোদ অলসভাবে গাছটার মাথায় জড়াইয়া আছে–সকলের চেয়ে এই বৈকালের রাঙা-রোদ-মাখানো গাছটার দিকে চাহিয়াই তাহার মন কেমন করিত। কৰ্ণ যেন ওই অশ্বখ গাছটার ওপারে আকাশের তলে, অনেক দূরে কোথায় এখনও মাটি হইতে রথের চাকা দুই হাতে প্ৰাণপণে টানিয়া তুলিতেছে–রোজই তোলে–রোজই তোলে–মহাবীর, কিন্তু চিরদিনের কৃপার পাত্র কর্ণা বিজয়ী বীর অর্জন নহে–যে রাজ্য পাইল, মান পাইল, রথের উপর হইতে বাণ ছড়িয়া বিপন্ন শক্ৰকে নাশ করিল বিজয়ী কর্ণ-—যে মানুষের চিরকালের চোখের জলে জাগিয়া রহিল, মানুষের বেদনায় অনুভূতিতে সহচর হইয়া বিরাজ করিল–সে।
এক-একদিন মহাভারতের যুদ্ধের কাহিনী শুনিতে শুনিতে তাহার মনে হয় যুদ্ধ জিনিসটা মহাভারতে বড় কম লেখা আছে। ইহার অভাব পূর্ণ করিবার জন্য এবং আশ মিটাইয়া যুদ্ধ জিনিসটা উপভোগ করিবার জন্য সে এক উপায় বাহির করিয়াছে। একটা বাখ্যারি কিংবা হালকা কোন গাছের ডালকে অস্ত্ৰীস্বরূপ হাতে লইয়া সে বাড়ির পিছনে বাঁশবাগানের পথে অথবা বাহিরের উঠানে ঘুরিয়া বেড়ায় ও আপন মনে বলে–তারপর দ্রোণ তো একেবারে দশ বাণ ছুড়লেন, অর্জন করলেন কি, একেবারে দুশোটা বাণ দিলেন মেরে! তারপর-ওঃ-—সে কি যুদ্ধ! কি যুদ্ধ! বাণের চোটে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল! (এখানে সে মনে মনে যতগুলি বাণ হইলে তাহার। আশা মিটে তাহার কল্পনা করে, যদিও তাহার কল্পনার ধারা মা’র মুখে কাশীদাসী মহাভারতে বর্ণিত যুদ্ধের প্রণালী সম্বন্ধে যাহা শুনা আছে তাহা অতিক্রমে করে না) তারপর তো অর্জন করলেন কি, ঢাল আর তরোয়াল নিয়ে রথ থেকে লাফিয়ে পড়লেন–পরে এই যুদ্ধ! দুৰ্যোধন এলেন–ভীম এলেন–বাণে বাণে আকাশ অন্ধকার করে ফেলেচে–আর কিছু দেখা গেল না। মহাভারতের রথিগণ মাত্র অষ্টাদশ দিবস যুদ্ধ করিয়া নাম কিনিয়া গিয়াছেন, কিন্তু রক্ত-মাংসের দেহে জীবন্ত থাকিলে তাঁহারা বুঝিতে পারিতেন, যশোলাভের পথ ক্রমশই কিরূপ দুৰ্গম হইয়া পড়িতেছে। বালকের আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তি করিতে তাঁহারা মাসের পর মাস সমানভাবে অস্ত্ৰচালনা করিতে পারিতেন কি?
গ্রীষ্মকালের দিনটা, বৈশাখের মাঝামাঝি।
নীলমণি রায়ের ভিটার দিকে জঙ্গলের ধারে সেদিন দুপুরের কিছু পূর্বে দ্রোণগুরু বড় বিপদে পড়িয়াছেন–কপিধ্বজ রথ একেবারে তাঁহার ঘাড়ের উপরে, গান্তীব-ধনু হইতে ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ মুক্ত হইবার বিলম্ব চক্ষের পলক মাত্র, কুরুসৈন্যদলে হাহাকার উঠিয়াছে—এমন সময় শেওড়া বনের ওদিক হইতে হঠাৎ কে কৌতুকের কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল–ও কি রে অপু? আপু চমকিয়া উঠিয়া আকর্ণ-টানা জ্যা-কে হঠাৎ ছাড়িয়া দিয়া চাহিয়া দেখিল তাহার দিদি জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়াইয়া তাহার দিকে চাহিয়া খিল খিল করিয়া হাসিতেছে। অপু চাহিতেই বলিল–হ্যাঁরে পাগলা, আপন মনে কি বিকচিস বিড়বিড় করে, আর হাত পা নাড়ছিস? পরে সে ছুটিয়া আসিয়া সস্নেহে ভাই-এর কচি গালে চুমু খাইয়া বলিল-পাগল! কোথাকার একটা পাগল, কি বকছিলি রে আপন মনে?
অপু লজ্জিতমুখে বার বার বলিতে লাগিল–যাঃ…বিকছিলাম বুঝি?…আচ্ছা, যাঃ–
অবশেষে দুৰ্গা হাসি থামাইয়া বলিল-আয় আমার সঙ্গে…
পরে সে অপুর হাত ধরিয়া বনের মধ্যে লইয়া চলিল। খানিক দূর গিয়া হাসিমুখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল—দেখেচিস?…কত নোনা পেকেচে?…এখন কি করে পাড়া যায় বল দিকি?
অপু বলিল–উঃ, অনেক রে দিদি!–একটা কঞ্চি দিয়ে পাড়া যায় না?
দুৰ্গা বলিল-তুই এক কাজ কর, ছুটে গিয়ে বাড়ির মধ্যে থেকে আঁকুশিটা নিয়ে আয় দিকি? আঁকুশি দিয়ে টান দিলে পড়ে যাবে দেখিস এখন–
অপু বলিল–তুই এখানে দাঁড়া দিদি, আমি আনচি–
অপু আঁকুশি আনিলে দুজনে মিলিয়া বহু চেষ্টা করিয়াও চার-পাঁচটার বেশি ফল পাড়িতে পারিল না–খুব উচুগাছ, সর্বোচ্চ ডালে যে ফল আছে তাহা দুৰ্গা আঁকুশি দিয়াও নাগাল পাইল না। পরে সে বলিল–চল আজ। এইগুলো নিয়ে যাই, নাইবার বেলায় মাকে সঙ্গে আনবো–মার হাতে ঠিক নাগাল আসবে। দে নোনাগুলো আমার কাছে, তুই আঁকুশিটা নে। নোলক পরবি?
একটা নিচু ঝোপের মাথায় ওড়কলমি লতায় সাদা সাদা ফুলের কুড়ি, দুৰ্গা হাতের ফলগুলো নামাইয়া নিকটের ফুলের কুড়ি ছিড়িতে লাগিল। বলিল–এদিকে সরে আয়, নোলক পড়িয়ে দি–
তাহার দিদি ওড়কলমি ফুলের নোলক পরিতে ভালোবাসে, বনজঙ্গল সন্ধান করিয়া সে প্রায়ই খুজিয়া আনিয়া নিজে পড়ে ও ইতিপূর্বে কয়েকবার অপুকেও পরাইয়াছে। অপু কিন্তু মনে মনে নোলক-পরা পছন্দ করে না। তাহার ইচ্ছা হইল, বলে, নোলকে তাহার দরকার নাই। তবে দিদির ভয়ে সে কিছুই বলিল না। দিদিকে চটাইবার ইচ্ছা তাহার আদৌ নাই, কারণ দিদিই। বনজঙ্গল ঘুরিয়া কুলটা, জামটা, নোনাটা, আমড়াটা সংগ্ৰহ করিয়া তাহাকে লুকাইয়া খাওয়ায়, এমন সব জিনিস জুটাইয়া আনে, যাহা হয়তো কুপথ্য হিসাবে উহাদের খাইতে নিষেধ আছে, কাজেই অন্যায় হইলেও দিদির কথা না শুনা তাহার সাহসে কুলায় না।
একটা কুড়ি ভাঙিয়া সাদা জলের মতো যে আঠা বাহির হইল, তাহার সাহায্যে দুৰ্গা অপুর নাকে কুড়িটি আঁটিয়া দিল, পরে নিজেও একটা পরিল–তারপর ভাইয়ের চিবুকে হাত দিয়া নিজের দিকে ভালো করিয়া ফিরাইয়া বলিল–দেখি, কেমন দেখাচ্ছে? বাঃ বেশ হয়েচে, চল মাকে দেখাইগে–
অপু লজ্জিতমুখে বলিল–না দিদি—
–চল না–খুলে ফেলিসনে যেন।–বেশ হয়েচে–
বাড়ি আসিয়া দুৰ্গা নোনাফলগুলি রান্নাঘরের দাওয়ায় নামাইয়া রাখিল। সর্বজয়া রাঁধিতেছিল––দেখিয়া খুব খুশি হইয়া বলিল–কোথায় পেলি রে?
দুৰ্গা বলিল–ওই লিচু-জঙ্গলে–অনেক আছে, কাল গিয়ে তুমি পাড়বে মা? এমন পাকা-একেবারে সিদুরের মতো রাঙা–
সে আড়াল ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া বলিল–দ্যাখো মা–
অপু নোলক পরিয়া দিদির পিছনে দাঁড়াইয়া আছে। সর্বজয়া হাসিয়া বলিল–ও মা! ও আবার কে রে?–কে চিনতে তো পারছি নে–
অপু লজ্জায় তাড়াতাড়ি নাকের ডগা হইতে ফুলের কুড়ি খুলিয়া ফেলিল। বলিল–ওই দিদি পরিয়ে দিয়েছে–
দুৰ্গা হঠাৎ বলিয়া উঠিল–চল রে অপু, ওই কোথায় ডুগডুগি বাজচে, চল, বাঁদর খেলাতে এসেছে ঠিক, শিগগির আয়–
আগে আগে দুৰ্গা ও তাহার পিছনে পিছনে অপু ছুটিয়া বাটীর বাহির হইয়া গেল। সম্মুখের পথ বাহিয়া, বাঁদর নয়, ও-পাড়ার চিনিবাস ময়রা মাথায় করিয়া খাবার ফেরি করিতে বাহির হইয়াছে। ও-পাড়ায় তাহার দোকান, তা ছাড়া সে আবার গুড়ের ও ধানের ব্যবসাও করে। কিন্তু পুঁজি কম হওয়ায় কিছুতেই সুবিধা করিতে পারে না, অল্পদিনেই ফেল মারিয়া বসে। তখন হয়তো মাথায় করিয়া হাটে হাটে আলু, পটল, কখনও পান বিক্রয় করিয়া বেড়ায়। শেষে তাতেও যখন সুবিধা হয় না, তখন হয়তো সে বুলি ঘাড়ে করিয়া জাত-ব্যবসা আরম্ভ করে। পরে হঠাৎ একদিন দেখা যায় যে, আবার পাথুরে চুন মাথায় করিয়া বিক্রয় করিয়া বেড়াইতেছে। লোকে বলে একমাত্র মাছ ছাড়া এমন কোনো জিনিস নাই, যাহা তাহাকে বিক্রয় করিতে দেখা যায় নাই। কাল দশহরা, লোকে আজ হইতেই মুড়কি সন্দেশ কিনিয়া রাখিবে। চিনিবাস হরিহর রায়ের দুয়ার দিয়া গেলেও এ বাড়ি ঢুকিল না। কারণ সে জানে এ বাড়ির লোকে কখনও কিছু কেনে না। তবুও দুর্গঅপুকে দরজায় দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল–চাই নাকি?
অপু দিদির মুখের দিকে চাহিল। দুর্গ চিনিবাসের দিকে ঘাড় নাড়িয়া বলিল–নাঃ–
চিনিবাস ভুবন মুখুজ্যের বাড়ি গিয়া মাথার চাঙাড়ি নামাইতেই বাড়ির ছেলেমেয়েরা কলরব করিতে করিতে তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। ভুবন মুখুজ্যে অবস্থাপন্ন লোক, বাড়িতে পাঁচ-ছয়টা গোলা আছে, এ গ্রামে অন্নদা রায়ের নিচেই জমিজমা ও সম্পত্তি বিষয়ে তাহার নাম করা যাইতে পারে।
ভুবন মুখুজ্যের স্ত্রী বহুদিন মারা গিয়াছেন। বর্তমানে তাঁহার সেজ ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী এ সংসারের কত্রী।
সেজ-বৌ-এর বয়স চল্লিশের উপর হইবে, অত্যন্ত কড়া মেজাজের মানুষ বলিয়া তাঁহার খ্যাতি আছে।
সেজ-বৌ একখানা মাজা পিতলের সরায় করিয়া চিনিবাসের নিকট হইতে মুড়কি, সন্দেশ, বাতাসা দশহরা পূজার জন্য লইলেন। ভুবন মুখুজ্যের ছেলেমেয়ে ও তাঁহার নিজের ছেলে সুনীল সেইখানেই দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাদের জন্যও খাবার কিনিলেন। পরে অপুকে সঙ্গে লইয়া দুৰ্গা চিনিবাসের পিছন পিছন ঢুকিয়া উঠানে আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে দেখিয়া সেজ-বৌ নিজের ছেলে সুনীলের কাঁধে হাত দিয়া একটু ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন– যাও না, রোয়াকে উঠে গিয়ে খাও না। এখানে ঠাকুরের জিনিস, মুখ থেকে ফেলে এঁটো করে বসবে।
চিনিবাস চাঙাড়ি মাথায় তুলিয়া পুনরায় অন্য বাড়ি চলিল। দুর্গ বলিল-আয় অপু, চল দেখিগে টুনুদের বাড়ি–
ইহারা সদর দরজা পার হইতেই সেজ-বৌ মুখ ঘুরাইয়া বলিয়া উঠিলেন-দেখতে পারিনে বাপু। ছড়িটার যে কী হ্যাংলা স্বভাব-নিজের বাড়ি আছে, গিয়ে বসে কিনে খেগে যা না? তা না, লোকের দোর দোর, যেমন মা তেমনি ছা–
ইহাদের বাটীর বাহির হইয়া দুৰ্গা ভাইকে আশ্বাস দিবার সুরে বলিল–চিনিবাসের ভারি তো খাবার! বাবার কাছ থেকে দেখিস রথের সময় চারটে পয়সা নেবো।–তুই দুটো, আমি দুটো। তুই আর আমি মুড়কি কিনে খাবো–
খানিকটা পরে ভাবিয়া ভাবিয়া অপু জিজ্ঞাসা করিল–রথের আর কতদিন আছে রে দিদি?