দ্বাদশ
বৈশাখ মাসের দিন। প্রায় দুপুর বেলা।
সর্বজয়া বাটনা বাটিতে বাটিতে ডান হাতের কাছে রক্ষিত একটা ফুলের সাজিতে (অনেকদিন হইতে ফুলের সহিত ইহার কোনো সম্পর্ক নাই, মশলা রাখিবার পাত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়) মশলা খুঁজতে গিয়া বলিল–আবার জিরে-মরিচের পুঁটুলটা কোথায় নিয়ে পালালি? বড্ড জ্বালাতন কচ্চিস অপু-রাঁধতে দিবিনে? তারপর একটু পরেই বোলো এখন–মা ক্ষিদে পেয়েছে।
অপুর দেখা নাই।
–দিয়ে যা বাপ আমার, লক্ষ্মী আমার-কেন জ্বালাতন কচ্চিস বল দিকি? দেখচিস বেলা হয়ে যাচ্ছে।
অপু রান্নাঘরের ভিতর হইতে দুয়ারের পাশ দিয়া ঈষৎ উঁকি মারিল, মায়ের চোখ সেদিকে পড়িতেই তাহার দুষ্টুমির হাসি-ভরা টুকটুকে মুখখানা শামুকের খোলার মধ্যে ঢুকিয়া পড়িবার মতো তৎক্ষণাৎ আবার দুয়ারের আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল। সর্বজয়া বলিল—দ্যাখ্ দিকি কাণ্ড–কেন বাপু দিক্ করিস। দুপুরবেলা? দিয়ে যা–
অপু পুনরায় হাসিমুখে ঈষৎ উঁকি মারিল।
—ওই আমি দেখতে পেয়েছি–আর লুকুতে হবে না, দিয়ে যা—
—হি-হি-হি–আমোদের হাসি হাসিয়া সে আবার দুয়ারের আড়ালে মুখ লুকাইল।
সর্বজয়া ছেলেকে ভালোরূপেই চিনিত। যখন অপু ছোট্ট খোকা দেড়বছরেরটি, তখন দেখিতে সে এখনকার চেয়েও টুকটুকে ফরসা ছিল। সর্বজয়ার মনে আছে, সে তাহার ডাগর চোখ দুটিতে বেশ করিয়া কাজল পরাইয়া কপালের মাঝখানে একটি টিপ পরাইয়া দিত ও তাহার মাথায় একটা নীল রং-এর কম দামের ঘন্টিওয়ালা পশমের টুপি পরাইয়া, কোলে করিয়া সন্ধ্যার পূর্বে বাহিরের রকে দাঁড়াইয়া ঘুম পাড়াইবার উদ্দেশ্যে সুর টানিয়া টানিয়া বলিত–
আয় রে পাখি-ই-ই লেজঝোলা,
আমার খোকনকে নিয়ে-এ-এ-গাছে তোলা…
খোকা ট্যাঁপা-ট্যাঁপা ফুলো-ফুলো গালে মায়ের মুখের দিকে হ্যাঁ করিয়া চাহিয়া থাকিত, পরে হঠাৎ কি মনে করিয়া সম্পূর্ণ দন্তহীন মাড়ি বাহির করিয়া আহ্বাদে আটখানা হইয়া মলা-পরা অসম্ভবরদীপ ছোট্ট পায়ে মাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া মায়ের পিঠের দিকে মুখ লুকাইত। সর্বজয়া হাসিমুখে বলিত-ওমা, খোকা আবার কোথায় লুকুলো? তাই তো, দেখতে তো পাচ্ছিনে! ও খোকা!… পরে সে ঘাড়ের দিকে মুখ ফিরাইতেই শিশু আবার হাসিয়া মুখ সামনের দিকে ফিরাইত এবং নির্বোধের মতো হাসিয়া মায়ের কঁধে মুখ লুকাইত। যতই সর্বজয়া বলিত-ওম, কই আমার খোকা কই-আবার কোথায় গেলা-কই দেখি, ততই শিশুর খেলা চলিত। বার বার সামনে পিছনে ফিরিয়া সর্বজয়ার ঘাড়ে ব্যথা হইলেও শিশুর খেলার বিরাম হইত না। সে তখন একেবারে আনকোরা টাট্কা, নতুন সংসারে আসিয়াছে।। জগতের অফুরন্ত আনন্দভাণ্ডারের এক অণুর সন্ধান পাইয়া তাহার অবোধ মন তখন সেইটাকে লইয়াই লোভীর মতো বার বার আস্বাদ করিয়াও সাধ মিটাইতে পারিতেছে না।–তখন তাহকে থামায় এমন সাধ্য তাহার মায়ের কোথায়? খানিকক্ষণ এরূপ করিতে করিতে তাহার ক্ষুদ্র শরীরে শক্তির ভাণ্ডার ফুরাইয়া আসিত- সে হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হইয়া হই তুলিতে থাকিস্ত-সর্বজয়া ছোট্ট হ্যাঁ-টির সামনে তুড়ি দিয়া বলিত-ষাট ষাটএই দ্যাখো দেয়ালা করে করে। এইবার বাছার আমার ঘুম আসচে। পরে সে মুগ্ধ নয়নে শিশুপুত্রের টিপ-কাজলপরী, কচি মুখের দিকে চাহিয়া বলিত-কত রঙ্গই জানে সনকু আমার-তবুও তো এই যোটের দেড় বছরের! হঠাৎ সে আকুল চুম্বনে খোকার রাঙা গাল দুটি ভরাইয়া ফেলিত। কিন্তু মায়ের এই গাঢ় আদরের প্রতি সম্পূৰ্ণ ঔদাসীন্য প্রদর্শন করিয়াই শিশুর নিদ্রাতুর আঁখিপাতা ঢুলিয়া আসিত, সর্বজয়া খোকার মাথাটা আস্তে আস্তে নিজের কঁধে রাখিয়া বলিত-ওমা, সন্দেবোলা দ্যাখে ঘুমিয়ে পড়লো! এই ভাবছি সন্দেটা উৎবুলে দুধ খাইয়ে তবে ঘুম পাড়াবো-দ্যাখো কাণ্ড!
সর্বজয়া জানিত-ছেলে আট বছরের হইলে কি হইবে, সেই ছেলেবেলাকার মতো মাযের সহিত লুকোচুরি খেলিবার সাধ তাহার এখনও মিটে নাই।
এমন সব স্থানে সে লুকায় যেখান হইতে অন্ধও তাহাকে বাহির করিতে পারে; কিন্তু সর্বজয়া দেখিয়াও দেখে না-এক জায়গায় বসিয়াই এদিকে ওদিকে চায়, বলে-তাই তো! কোথায় গেল? দেখতে তো পাচ্ছিনে!..অপু ভাবে-মাকে কেমন ঠকাইতে পারা যায়! মায়ের সহিত এ খেলা করিয়া মজা আছে। সর্বজয়া জানে যে, খেলায় যোগ দিবার ভান করিলে এইরূপ সারাদিন চলিতে পারে, কাজেই সে ধমক দিয়া কহিল-তা হলে কিন্তু থাকলো পড়ে রান্নাবান্না। অপু, তুমি ওই রকম করো, খেতে চাইলে তখন দেখবে মজাটা–
অপু হাসিতে হাসিতে গুপ্তস্থান হইতে বাহির হইয়া মশলার পুঁটুলি মায়ের সামনে রাখিয়া দিল।
তাহার মা বলিল, যা একটু খেলা করগে যা বাইরে। দেখগে যা দিকি তোর দিদি কোথায আছে! গাছতলায় দাঁড়িয়ে একটু হ্যাঁক দিয়ে দাখ দিকি। তার আজ নাইবার দিন-হতচ্ছাড়া মেয়ের নাগাল পাওয়ার জো আছে? যা তো লক্ষ্মী ছেলে–
কিন্তু এখানে মাতৃ-আদেশ পালন করিয়া সুপুত্ৰ হইবার কোনো চেষ্টা তাহাব দেখা গেল না। সে বাটনা-বাটা-রত মায়ের পিছনে গিয়া কি করিতে লাগিল।
–হু-উ-উ-উ-উ-উম্–
সর্বজয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল অপু বড়ি দেওয়ার জন্য চালের বাতায় রক্ষিত একটা পুরানো চট আনিয়া মুড়ি দিয়া মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়া বসিয়া আছে।
–দ্যাখো দ্যাখো, ছেলের কাণ্ড দ্যাখো একবার। ও লক্ষ্মীছাড়া, ওতে যে সাত-রাজ্যির ধুলো। ফ্যাল ফ্যাল-সাপ-মাকড় আছে না কি আছে। ওর মধ্যে-আজি কদিন থেকে তোলা রয়েছে–
–হু-উ-উ-উম—(পূর্বাপেক্ষা গম্ভীর সুরে)
–নাঃ, বল্লে যদি কথা শোনে-বাবা আমার, সোনা আমার, ওখানা ফ্যাল-আমার বাটনার ঠাত—দুষ্টুমি কোরো না ছিঃ!
থলে-মোড়া মূর্তিটা হামাগুড়ি দিয়া এবার দুই কদম আগাঁইয়া আসিল। সর্বজয়া বলিল-ছুঁবি ছুঁবি-ছুঁও না মানিক আমার–ওঃ, ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গিাইচি-ভারি ভয় হয়েছে মামার!
অপু হি-হি করিয়া হাসিয়া থলেখানা খুলিয়া এক পাশে রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মাথার চুল, মুখ, চোখের ভুবু, কান ধুলায় ভরিয়া গিয়াছে। মুখ কঁচুমাচু করিয়া সে সামনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাঁত কিছু কিচু করিতেছে।
-ওমা আমার কি হবে! হ্যাঁরে হতভাগা, ধুলো মেখে যে একেবারে ভূত সেজেছিস? উঃ–ওই পুরানো থলেটার ধুলো! একেবারে পাগল!
ধূলিধূসরিত অবোধ পুত্রের প্রতি করুণা ও মমতায় সর্বজয়ার বুক ভরিয়া আসিল; কিন্তু অপুর পরনে বাসি কাপড়-নাহিয়া-ধুইয়া ছোঁয়া চলে না বলিয়া বলিল-গামছাখানা নে, ওই দিয়ে ধুলোগুলো আগে ঝেড়ে ফ্যাল। ছেলে যেন কি একটা।
খানিকটা পরে ছেলেকে রান্নাঘরে পাহারার জন্য বসাইয়া সে জল আনিতে বাহির হইয়া যাইতেছে, দেখে দরাজ দিয়া দুর্গা বাড়ি ঢুকিতেছে। মুখ রৌদ্রে রাঙা, মাথার চুল উসকোথুসকো, অথচ ধুলোমাখা পায়ে আলতা পরা। একেবারে মায়ের সামনে পড়াতে আঁচলে বাঁধা আম দেখাইয়া টোক গিলিয়া কহিল—এই পুণ্যপুকুরের জন্যে ছোলার গাছ আনতে গেলাম রাজীদের বাড়ি, আম পেড়ে এনেছে ভাগ হচ্ছে, তাই রাজীর পিসিমা দিলে।
–আহা, মেয়ের দশা দ্যাখো, গায়ে খড়ি উড়াচে, মাথার চুল দেখলে গায়ে জ্বর আসে–পুণ্যিপুকুরের জন্য ভেবে তো তোমার রাত্তিরে ঘুম নেই!-পরে মেয়ের পায়ের দিকে চাহিয়া কহিল-ফের বুঝি লক্ষ্মীর চুবড়ি থেকে আলতা বের করে পরা হয়েচে?
দুৰ্গা আঁচল দিয়া মুখ মুছিয়া উসকোথুসকো চুল কপাল হইতে সরাইয়া বলিল-লক্ষ্মীর চুবড়ির আলতা বইকি! আমি সেদিন হাটে বাবাকে দিয়ে আলতা আনালোম এক পয়সার, তার দরুন দু’পাতা আলতা আমার পুতুলের বাক্সে ছিল না বুঝি?
হরিহর কলকে হাতে রান্নাঘরের দাওয়ায় আগুন লাইতে আসিল।
সর্বজয়া বলিল-ঘণ্টায় ঘণ্টায় তামাকে আগুন দি কোথা থেকে? সুদৱীকাঠের বন্দোবস্ত করে রেখেচোঁ। কিনা একেবারে! বাঁশের চেলার আগুন কতক্ষণ থাকে যে আবার ঘড়ি-ঘড়ি তামাক খাওয়ার আগুন জোগাবো? পরে আগুন তুলিবার জন্য রক্ষিত একটা ভাঙা পিতলের হাতাতে খানিকটা আগুন উঠাইয়া বিরক্তমুখে সামনে ধরিল। পরে সুর নরম করিয়া বলিল-কি হল?
—এক রকম ছিল তো সবই ঠিক, বাড়িসুদ্ধ সবাই মন্তর নেবার কথাই হয়েছিল, কিন্তু একটু মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। মহেশ বিশ্বেসের শ্বশুরবাড়ির বিষয়-আশয় নিয়ে কি গোলমাল বেধেছে, বিশ্বেস মশায় গিয়েচে সেখানে চলে-সে-ই আসল মালিক কিনা। তাই আবার একটু পিছিয়ে গেল; আবার এদিকেও তো অকাল পড়চে আষাঢ় মাস থেকে।
–আর সেই যে বাসের জায়গা দেবে, বাস করাবে বলছিল, তার কি হল?
—এই নিয়ে একটু মুশকিল বেধে গেল। কিনা! ধরে যদি মন্তর নেওয়া পিছিয়ে যায়, তবে ওকথা আর কি করে ওঠাই?
সর্বজয়া খুব আশায় আশায় ছিল, সংবাদ শুনিয়া আশাভঙ্গ হইয়া পড়িল। বলিল, তা ওখানে না হয়, অন্য কোন জায়গায় দ্যাখো না? বিদেশে মান আছে, এখানে কেউ পোছে? এই দ্যাখে আমকাঁঠালের সময়ে একটা আম-কাঁঠাল ঘরে নেই-মেয়েটা কাদের বাড়ি থেকে আজ দুটো আধাপচা আমি নিয়ে এল।—পরে সে উদ্দেশে বাড়ির পশ্চিম দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল-এই ঘরের দোর থেকে ঝুড়ি-ঝুড়ি আমি পেড়ে নিয়ে যায়-বাছারা আমার চেয়ে চেয়ে দ্যাখে,-এ কি কম কষ্ট!
বাগানের কথার উল্লেখে হরিহর বলিল-উঃ, ও কি কম ধড়িবাজ নাকি! বছরে পচিশ টাকা খাজনা ফেলে-বোলে হোত, তাই কিনা লিখে নিলে পাঁচ টাকায়! আমি গিয়ে এত করে বললাম, কাক, আমার ছেলেটা মেয়েটা আছে, ওই বাগানে আম-জোম কুড়িয়ে মানুষ হচ্ছে। আমার তো আর কোথাও কিছু নেই। আর ধরুন, আমাদের জ্ঞাতির বাগান-আপনার তো ঈশ্বর ইচ্ছেয় কোনো অভাব নেই, দুটো অত বড় বাগান রয়েছে, আম জাম নারকেল সুপারি-আপনার অভাব কি? বাগানখানা গিয়ে ছেড়ে দিন গে যান! তা বল্পে কি জানো? বল্পে, নীলমণি দাদা বেঁচে থাকতে ওর কাছে নাকি তিনশো টাকা ধার করেছিল, তাই আমনি করে শোধ করে নিল। শোন কথা। নীলমণি দাদার বড় অভাব ছিল কিনা, তাই তিনশো টাকার জন্যে গিয়েছে ভুবন মুখুজ্যের কাছে হাত পাততে। বৌদিকে ভালোমানুষ পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নিলে আর কি!
–ভালোমানুষ তো কত! সেও নাকি বলেছে, যে জ্ঞাতিশত্তুর-পর-হাতে বাগান থাকলে তো আর কিছু পাওয়া যাবে না, ফল-পাকুড় এমনিই খাবে, তার চেয়ে কিছু কম জমাতেও যদি বন্দোবস্ত হয়, খাজনাটা তো পাওয়া যাবে।
হরিহর বলিল-খাজনা কি আর আমি দিতাম না? বাগান জমা দেবে, তাই কি আমায় জানতে দিলে? বৌদিকে-লুচি-মোহনভোগ খাইয়ে হাত করে চুপি চুপি লিখিয়ে নিলে।…