ষোড়শ
এবার বাড়ি হইতে যাইবার সময় হরিহর ছেলেকে সঙ্গে করিয়া লইয়া চলিল। বলিল-বাড়ি থেকে কিছু খেতে পায় না, তবুও বাইরে বেবুলে দুধটা, ঘিটা-ওর শরীরটা সারবে এখন।
অপু জন্মিয়া অবধি কোথাও কখনও যায় নাই। এ গাঁয়েরই বকুলতলা, গোঁসাইবাগান, চালতোতলা, নদীর ধার-বড়জোর নবাবগঞ্জ যাইবার পাকা সড়ক-এই পর্যন্ত তাহার দৌড়। মাঝে মাঝে বৈশাখ কি জ্যৈষ্ঠ মাসে খুব গরম পড়লে তাহার মা বৈকালে নদীর ঘাটে দাঁড়াইয়া থাকিত। নদীর ওপারের খড়ের মাঠে বাবলা গাছে গাছে হলুদ রং-এর ফুল ফুটিয়া থাকিত, গরু, চরিত, মোটা গুলঞ্চলতা-দুলানো শিমুল গাছটাকে দেখিলে মনে হইত যেন কতকালের পুরাতন গাছটা। রাখালেরা নদীর ধারে গরুকে জল খাওয়াইতে আসিত, ছোট্ট একখানা জেলেডিঙি বাহিয়া তাহাদের গায়ের অঙ্কুর মাঝি মাছ ধরিবার দোয়াড়ি পাতিতে যাইত, মাঠের মাঝে মাঝে ঝাড় ঝাড় সৌদালি ফুল বৈকালের ঝিরঝির বাতাসে দুলিতে থাকিত-ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ এক-একদিন ওপারের সবুজ খড়ের জমির শেষে নীল আকাশটা যেখানে আসিয়া দূর গ্রামের সবুজ বনরেখার উপর ঝুকিয়া পড়িয়াছে, সেদিকে চাহিয়া দেখিতেই তাহার মনটা যেন কেমন হইয়া যাইত-সে সব প্রকাশ করিয়া বুঝাইয়া বলিতে জনিত না। শুধু তাহার দিদি ঘাট হইতে উঠিলে সে বলিত-দিদি দিদি, দ্যাখা দ্যাখ ওইদিকে-পরে সে মাঠের শেষের দিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিত-ওই যে? ওই গাছটার পিছনে? কেমন অনেক দূর, না?
দুৰ্গা হাসিয়া বলিত-অনেক দূর-তাই দেখাচ্ছিলি? দূর, তুই একটা পাগল!
আজ সেই অপু সর্বপ্রথম গ্রামের বাহিরে পা দিল। কয়েকদিন পূর্ব হইতেই উৎসাহে তাহার রাত্ৰিতে ঘুম হওয়া দায় হইয়া পড়িয়াছিল, দিন গুনিতে গুনিতে অবশেষে যাইবার দিন আসিয়া গেল।
তাহাদের গ্রামের পথটি বাঁকিয়া নবাবগঞ্জের সড়ককে ডাইনে ফেলিয়া মাঠের বাহিরে আষাঢ়ু-দুৰ্গাপুরের কঁচা রাস্তার সঙ্গে মিশিয়াছে। দুর্গাপুরের রাস্তায় উঠিয়াই সে বাবাকে বলিল-বাবা, যেখান দিয়ে রেল যায় সেই রেলের রাস্তা কোন দিকে?
তাহার বাবা বলিল-সামনেই পড়বে এখন, চলো না। আমরা রেল লাইন পেরিয়ে যাব এখন–
সেবার তাঁহাদের রাঙী গাইয়ের বাছুর হারাইয়াছিল। নানা জায়গা খুঁজিয়াও দুই তিন দিন ধরিয়া কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। সে তাহার দিদির সঙ্গে দক্ষিণ মাঠে বাছুর খুঁজিতে আসিয়াছিল। পৌষ মাস, ক্ষেতে ক্ষেতে কলাই গাছের ফলে দানা বাঁধিয়াছে, সে ও তাহার দিদি নিচু হইয়া ক্ষেত হইতে মাঝে মাঝে কলাই ফল তুলিয়া খাইতেছিল-তাহাদের সামনে কিছুদূরে নবাবগঞ্জের পাকা রাস্তা, খেজুর গুড় বোঝাই গরুর গাড়ির সারি পথ বাহিয়া ক্যাঁচ ক্যাঁচ করিতে করিতে আষাঢ়ুর হাটে যাইতেছিল।
তাহার দিদি পাকা রাস্তার ওপারে বহুদূরে ঝাপসা মাঠের দিকে একদৃষ্টি চাহিয়া; কি দেখিতেছিল, হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল—এক কাজ করবি অপু, চল যাই আমরা রেলের রাস্তা দেখে আসি, যাবি?
অপু বিস্ময়ের সুরে দিদির মুখের দিকে চাহিয়া বলিল-রেলের রাস্তা-সে যে অনেক দূর! সেখানে কি করে যাবি?
তাহার দিদি বলিল—বেশি দূর বুঝি। কে বলেচে তোকে-ওই পাকা রাস্তার ওপারে তো–
অপু বলিল-নিকটে হলে তো দেখা যাবে? পাকা রাস্তা থেকে দেখা যায়—চলদিকি দিদি, গিয়ে দেখি।
দুইজনে অনেকক্ষণ নবাবগঞ্জের সড়কে উঠিয়া চাহিয়া চাহিয়া দেখিল। তাহার দিদি বলিলবড় অনেক দূর, না। যাওয়া যাবে না–
–কিছু তো দেখা যায় না-অত দূর গেলে আবার আসব কি করে? তাহার সতৃষ্ণ দৃষ্টি কিন্তু দূরের দিকে আবদ্ধ ছিল, লোভও হইতেছিল, ভয়ও হইতেছিল। হঠাৎ তাহার দিদি মরীয় ভাবে বলিয়া উঠিল-চল যাই দেখে আসি অপু-কতদূর আর হবে? দুপুরের আগে ফিরে আসবো এখন, হয়তো রেলের গাড়ি যাবে এখন-মাকে বলবো বাছুর খুঁজতে দেরি হয়ে গেল–
প্রথমে তাহারা একটুখানি এ-দিক ও-দিক চাহিয়া দেখিল কেহ তাহাদিগকে লক্ষ করিতেছে কিনা। পরে পাকা রাস্ত হইতে নামিয়া পড়িয়া দুপুর রোদে ভাই বোনে মাঠ বিল জলা ভাঙিয়া সোজা দক্ষিণ মুখে ছুটিল। দৌড়, দৌড়, দৌড়-নবাবগঞ্জের লাল রাস্তা ক্ৰমে অনেক দূর পিছাইয়া পড়িল-রোয়ার মাঠ, জলসত্ৰতলা, ঠাকুরঝি পুকুর বামধারে, ডানধাবে দূরে দূরে পড়িয়া রহিলসামনে একটা ছোট বিল নজরে আসিতে লাগিল। তাহার দিদি হাসিয়া তাহার দিকে চাহিয়া বলিলমা টের পেলে কিন্তু-পিঠের ছাল তুলবে। অপু একবার হাসিল—মরীয়ার হাসি। আবার দৌড়, দৌড় দৌড়,-জীবনে এই প্রথম বাধাহীন, গণ্ডিহীন মুক্তির উল্লাসে তাহাদের তাজা তরুণ রক্ত তখন মাতিয়া উঠিয়াছিল-পরে কি হইবে, তাহা ভাবিবার অবসর কোথায়?
পরে যাহা হইল, তাহা সুবিধাজনক নয়। খানিক দূরে গিয়া একটা বড় জলা পড়িল একেবারে সামনে-হোগলা আর শোলা গাছে ভরা, তাহার উপব তাহার দিদি পথ হারাইয়া ফেলিল-কোনো গ্রামও চোখে পড়ে না।–সামনে কেবল ধানক্ষেত, জলা, আর বেত-ঝোপ।। ঘন বেতীবনের ভিতর দিয়া যাওয়া যায় না, পাঁকে জলে পা পুতিয়া যায়, রৌদ্র এমন বাড়িয়া উঠিল যে, শীতকালেও তাহাদের গা দিয়া ঘাম ঝরিতে লাগিল-দিদির পরনের কাপড় কাটায় নানা স্থানে ছিঁড়িয়া গেল, তাহার নিজের পাযে দু’তিন বার কাটা টানিয়া টানিয়া বাহির করিতে হইল-শেষে রেলরাস্তা দূরের কথা, বাড়ি ফেরাই মুশকিল হইয়া উঠিল। অনেক দূরে আসিয়া পড়িয়ছে, পাকা রাস্তাও আর দেখা যায় না, জল ভাঙিয়া ধানক্ষেত পার হইয়া যখন তাহারা বহু কষ্টে আবার পাকা রাস্তায় আসিয়া উঠিল তখন দুপুর ঘুরিয়া গিয়াছে। বাড়ি আসিয়া তাহার দিদি বুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা বলিয়া তবে নিজের ও তাহার পিঠ বাঁচাইল।
সেই রেলের রাস্তা আজ এমনি সহজভাবেই সামনে পড়িবে—সেজন্য ছুটিতে হইবে না, পথ হারাইতে হইবে না-বকুনি খাইতে হইবে না!
কিছু দূর গিয়া সে বিস্ময়ের সহিত চাহিয়া দেখিল নবাবগঞ্জের পাকা সড়কের মতো একটা উঁচু রাস্তা মাঠের মাঝখান চিরিয়া ডাইনে বাঁয়ে বহুদূর গিয়াছে। রাঙা রাঙা খোয়ার রাশি উঁচু হইয়া ধারের দিকে সাবি দেওয়া। সাদা সাদা লোহার খুঁটির উপর যেন একসঙ্গে অনেক দড়ির টানা বাধা-যতদূর দেখা যায়, ওই সাদা খুঁটি ও দড়ির টানা বাধা দেখা যাইতেছে—
তাহার বাবা বলিল-ওই দ্যাখো খোকা, রেলের রাস্তা—
অপু একদৌড়ে ফটিক পার হইয়া রাস্তার উপর আসিয়া উঠিল। পরে সে রেলপথের দুইদিকে বিস্ময়ের চোখে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল। দুইটা লোহা বরাবর পাতা কেন? উহার উপর দিয়া রেলগাড়ি যায়? কেন? মাটির উপর দিয়া না গিয়া লোহার ওপর দিয়া যায় কেন? পিছলাইয়া পড়িয়া যায় না? কেন? ওগুলোকে তার বলে? তাহার মধ্যে সোঁ সোঁ কিসের শব্দ? তারে খবর যাইতেছে? কাহারা খবর দিতেছে? কি করিয়া খবর দেয়? ওদিকে কি ইস্টিশান? এদিকে কি ইস্টিশান?
সে বলিল-বাবা, রেলগাড়ি কখন আসবে? আমি রেলগাড়ি দেখবো বাবা।
–রেলগাড়ি এখন কি করে দেখবে?…সেই দুপুরের সময় রেলগাড়ি আসবে, এখনও দুঘণ্টা দেরি!
–তা হোক বাবা, আমি দেখে যাবো, আমি কখখনো দেখিনি-হ্যাঁ বাবা-ও রকম কোরো না, ওই জন্য তোমায় কোথাও আনতে চাইনে—এখন কি করে দেখবে? সেই দুপুর একটা অবধি বসে থাকতে হবে তা হলে এই ঠায় রোদুরে, চল আসবার দিন দেখাবো।
অপুকে অবশেষে জল-ভরা চোখে বাবার পিছনে পিছনে অগ্রসর হইতে হইল।
তুমি চলিয়া যাইতেছ…তুমি কিছুই জানো না, পথের ধারে তোমার চোখে কি পড়িতে পারে, তোমার ডাগর নবীন চোখ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধায় চারিদিককে গিলিতে গিলিতে চলিয়াছে–নিজের আনন্দের এ হিসাবে তুমিও একজন দেশ-আবিষ্কারক। অচেনার আনন্দকে পাইতে হইলে পৃথিবী ঘুরিয়া বেড়াইতে হইবে, তাহার মানে নাই। আমি যেখানে আর কখনও যাই নাই, আজ নতুন পা দিলাম, যে নদীর জলে নতুন স্নান করিলাম, যে গ্রামের হাওয়ায় শরীর জুড়াইল, আমার আগে সেখানে কেহ আসিয়াছিল। কিনা, তাহাতে আমার কি আসে যায়? আমার অনুভূতিতে তাহা যে অনাবিষ্কৃত দেশ। আমি আজ সর্বপ্রথম মন, বুদ্ধি, হৃদয় দিয়া উহার নবীনতাকে আস্বাদ করিলাম যে।
আমডোব! ছোট্ট চাষাদের গাঁ-খান-কেমন নামটি! মেয়ে বা উঠানে বিচালি কাটিতেছে, ছাগল বাঁধিতেছে, মুরগিকে ভাত খাওয়াইতেছে, বড় লোকেরা পাট শুকাইতেছে, বাঁশ কাটিতেছে—দেখিতে দেখিতে গাঁ পিছনে ছাড়িয়া একেবারে বাইরের মাঠ…বিলে জল থই থই করিতেছে…উড়ি ধানের ক্ষেতে বক বসিয়া আছে, নাল ফুলের পাতা ও ফুটন্ত ফুলে জল দেখা যায় না।
খলসেমবির বিলের প্রান্তে ঘন সবুজ আউশ ধানের ক্ষেতেব উপবকার বৃষ্টিধৌত, ভাদ্রের আকাশের সুনীল প্রসার। সারা চক্রবাল জুড়িয়া সূর্যাস্তের অপরূপ বর্ণচ্ছটা, বিচিত্র রং-এর মেঘের পাহাড়, মেঘের দ্বীপ, মেঘের সমুদ্র, মেঘের স্বপ্নপুরী.খোলা আকাশের সহিত এরকম পরিচয় তাহাব এতদিন হয় নাই, মাঠের পারের দূরের দেশটা এবার তাহার রহস্য-অবগুণ্ঠন খুলিল আট বছরের ছেলেটির কাছে।
যাইতে যাইতে বড় দেরি হইল। তাহার বাবা বলিল-তুমি বড্ড হাঁ-করা ছেলে, যা দ্যাখো তাতেই হাঁ করে থাকো কেন অমন? জোরে হাঁটো।
সন্ধ্যার পর তাহারা গন্তব্য স্থানে পৌঁছিল। শিষ্যের নাম লক্ষ্মণ মহাজন, বেশ বড় চাষী ও অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। বাহিরের বড় আটচালা ঘরে মহা আদরে তাঁহাদের থাকিবার স্থান করিয়া দিল।
লক্ষ্মণ মহাজনের ছোটভাইয়ের স্ত্রী সকালে স্নান করিবার জন্য পুকুরের ঘাটে আসিয়াছে–জলে নামিতে গিয়া পুকুরের পাড়ে নজর পড়াতে সে দেখিল পুকুরপাড়ের কলাবাগানে একটি অচেনা ছোট ছেলে একখানি কঞ্চি হাতে কলাবাগানের একবার এদিক একবার ওদিক পায়চারি করিতেছে ও পাগলের মতো আপন মনে বকিতেছে। সে ঘড়া নামাইয়া কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল—তুমি কাদের বাড়ি এসেছ, খোকা?
অপুর যত জারিজুরি তাহার মায়ের কাছে। বাহিরে সে বেজায় মুখচোরা।
প্রথমটা অপুর মাথায় আসিল যে টানিয়া দৌড় দেয়। পরে সংকুচিত সুরে বলিল-ওই ওদের বাড়ি–
বধূটি বলিল-বটুঠাকুরদের বাড়ি? বটুঠাকুরের গুরুমশায়ের ছেলে? ও!
বধূ সঙ্গে করিয়া তাহাকে নিজের বাড়িতে লইয়া গেল। তাহদের বাড়ি পৃথক-লক্ষ্মণ মহাজনের বাড়ি হইতে সামান্য দূরে, কিন্তু মধ্যে পুকুরটা পড়ে।
বধূর ব্যবহারে অপুর লাজুকতা কাটিয়া গেল। সে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া ঘরের জিনিসপত্র কৌতুহলের সহিত চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল। ওঃ কত কি জিনিস!..তাহাদের বাড়িতে এ রকম জিনিস নাই। এরা খুব বড়লোক তো। কড়ির আলনা, রং-বেরং-এর ঝুলন্ত শিকা, পশমের পাখি, কাঁচের পুতুল, মাটির পুতুল, শোলার গাছ-আরও কত কি!-দু-একটা জিনিস সে ভয়ে ভয়ে হাতে তুলিয়া নাড়িয়া চড়িয়া দেখিল।
বধূ এতক্ষণ ভালো করিয়া ছেলেটির মুখের দিকে চাহিয়া দেখে নাই-কাছের গোড়ায় দেখিয়া মনে হইল যে, এ এখনও ভারি ছেলেমানুষ, মুখের ভাব যেন পাঁচ বছরের ছেলের মতো কচি। এমন সুন্দর অবোধ চোখের ভাব সে আর কোনো ছেলের চোখে এ পর্যন্ত দেখে নাই-এমন রং, এমন গড়ন, এমন সুন্দর মুখ, এমন তুলি দিয়া আঁকা ডাগর ডাগর নিষ্পাপ চোখ-অচেনা ছেলেটির উপর বধূর বড় মমতা হইল।
অপু বসিয়া নানা গল্প করিল—বিশেষ করিয়া কল্যকার রেলপথের কথাটি। খানিকটা পরে বধূ মোহনভোগ তৈয়ারি করিয়া খাইতে দিল। একটা বাটিতে অনেকখানি মোহনভোগ, এত ঘি দেওয়া যে আঙুলে ঘিয়ে মাখামাখি হইয়া যায়। অপু একটুখানি মুখে তুলিয়া খাইয়া অবাক হইয়া গেলএমন অপূর্ব জিনিস আব সে কখনও খায় নাই তো!–মোহনভোগে কিসমিস দেওয়া কেন? কই তাহার মায়ের তৈরি মোহনভোগে তো কিসমিস থাকে না? বাড়িতে সে মা’র কাছে আবদার ধরে — মা, আজ আমাকে মোহনভোগ করে দিতে হবে! তাহার মা হাসিমুখে বলে-আচ্ছা ওবেলা তোকে করে দেবো-পরে সে শুধু সুজি জলে সিদ্ধ করিয়া একটু গুড় মিশাইয়া পুলটিসের মতো একটা দ্রব্য তৈয়ারি করিয়া কঁসার সরপুরিয়া থালাতে আদর করিয়া ছেলেকে খাইতে দেয়। অপু তাহাই খুশির সহিত এতদিন খাইয়া আসিয়াছে, মোহনভোগ যে এরূপ হয় তাহা সে জনিত না। আজ কিন্তু তাহাব মনে হইল এ মোহনভোগে আর মাযের তৈয়ারি মোহনভোগে আকাশ-পাতাল তফাত!, সঙ্গে সঙ্গে মায়ের উপর করুণায় ও সহানুভূতিতে তাহার মন ভরিয়া উঠিল। হয়তো তাহার মাও জানে না যে, এ রকমের মোহনভোগ হয়!—সে যেন আবছায়া ভাবে বুঝিল, তাহার মা গরিব, তাহারা গরিবতাই তাহাদেব বাড়ি ভালো খাওয়া-দাওয়া হয় না।
একদিন পাড়ার এক ব্ৰাহ্মণ প্রতিবেশীর বাড়ি অপুর নিমন্ত্রণ হইল। দুপুর বেলা সে-বাড়ির একটি মেয়ে আসিয়া অপুকে ডাকিয়া লইয়া গেল। ওদের রান্নাঘরের দাওয়ায় যত্ন করিয়া পিড়ি পাতিয়া জল ছিটাইয়া অপুকে খাবার জায়গা করিয়া দিল। যে মেয়েটি অপুকে ডাকিতে আসিয়াছিল, নাম তার অমলা, বেশ টকটকে ফরসা রং, বড় বড় চোখ, বেশ মুখখানি, বয়স তার দিদির মতো। আমলার মা কাছে বসিয়া তাহাকে খাওয়াইলেন, নিজের হাতের তৈয়ারি চন্দ্রপুলি পাতে দিলেন। খাওয়ার পরে আমলা তাহাকে সঙ্গে করিয়া বাড়ি দিয়া গেল। সেদিন বৈকালে খেলিতে খেলিতে অপুর পায়ের আঙুল হঠাৎ বাগানের বেড়ার দুই বাঁশের ফাঁকে পড়িয়া আটকাইয়া গেল। টাট্কা-চেরা নতুন বাঁশের বেড়া, আঙুল কাটিয়া রক্তারক্তি হইল, অমলা ছুটিয়া আসিয়া পা-খানা বাঁশের ফাঁক হইতে বাহির না করিলে গোটা আঙুলটাই কাটা পড়িত। সে চলিতে পাবিতেছিল না, আমলা তাহাকে কোলে করিয়া গোলার পাশ হইতে পাথরকুচির পাতা তুলিয়া বাটিয়া আঙুলে বাঁধিয়া দিল। পাছে বাবার বকুনি খাইতে হয়, এই ভয়ে অপু একথা কাহারও কাছে প্রকাশ করিল না।
সে রাত্রে শূইয়া অপু শুধু অমলারই স্বপ্ন দেখিল। সে অমলার কোলে বেড়াইতেছে, আমলার কাছে বসিয়া আছে, আমলার সঙ্গে খেলা করিতেছে, আমলা তাহার পায়ের আঙুলে পটি বাঁধিয়া দিতেছে, সে ও অমলা রেলরাস্তায় দুটাছুটি করিয়া বেড়াইতেছে-অমলার হাসি ভরা চোখমুখ ঘুমের ঘোরে। সারারাত নিজের কাছে কাছে। ভোরে সে শুধু খুঁজতে লাগিল অমলা কখন আসে। আরও সব ছেলেমেয়েরা আসিল, খেলা আরম্ভ হইয়া গেল, ক্ৰমে বেশ বেলা হইল-কিন্তু অমলার দেখা নাই। বাড়ির ভিতর হইতে বধূ খাবার খাইবার জন্য ডাকিয়া পাঠাইল-রোজ সকালে বিকালে বধূ নিজের হাতে খাবার তৈয়ারি করিয়া তাহাকে খাওয়াইত-খাওয়া শেষ করিয়া আসিবার সময় সে বধূকে জিজ্ঞাসা করিল-সকালে কি অমলাদিদি এসেছিল? না, সে আসে নাই। ক্ৰমে আরও বেলা হওয়াতে খেলা ভাঙিয়া গেল। তাহার বাবা তাহাকে স্নান করিবার জন্য ডাকিল। তবুও কোথায় অমলা? অভিমানে তাহার মন ছাপাইয়া উঠিল, বেশ, নাই বা আসিল? আমলার সহিত তাহার জন্মের তো আড়ি—আর যদি সে কখনও তাহার সহিত কথা কয়! বৈকালেও খেলা আরম্ভ হইল, আর সকলেই আসিল-অমলা নাই। পাঁচ ছয়টি ছেলেমেয়ে খেলিতে আসিলেও অপুর মনে হইল, কাহার সহিত সে খেলিবে? কেহই উপযুক্ত খেলার সাখী বলিয়া মনে হইল না। উৎসাহহীন ভাবে সে খানিকক্ষণ খেলা করিল, তবুও আমলার দেখা নাই।
পরদিন সকালে আমলা আসিল। অপু কোনো কথা বলিল না। অমলা যেখানে বসে, সে তাহার ত্ৰিসীমানায় ঘেষে না, অথচ মাঝে মাঝে আড়াচোখে চাহিয়া দেখে, সে যে রাগ করিয়া এরূপ করিতেছে, আমলা তাহা বুঝিয়াছে কিনা। আমলা সত্যই প্রথমটা বুঝিতে পারে নাই, পরে যখন সে বুঝিল যে, কিছু একটা হইয়াছে নিশ্চয়, তখন সে কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল–কি খোকা, কথা বলচো না কেন?… কি হয়েচে?
অপু অতশত বোঝে না, সে অভিমানে ঠোঁট ফুলাইয়া বলিল-কি হয়েচে বইকি! তা কিছু কি আর হয়েচে? কাল আসিনি কেন?
অমলা অবাক হইয়া বলিল-আসিনি, তাই কি?–সেইজন্যে রাগ করেচ?
অপু ঘাড় নাড়াইয়া জানাইল, ঠিক তাই। অমলা খিলখিল করিয়া হাসিয়া অপুকে হাত ধরিয়া লইয়া চলিল বাড়ির ভিতর। সেখানে বধূ সব শুনিয়া প্রথমটা হাসিয়া খুন হইল, পাবে মুখে হাসি টিপিয়া বলিল-তা হলে অমলা, তোমার আর এখন বাড়ি যাওয়ার জো নেই তো দেখচি-কি আর করবে, খোকা যখন তোমাকে ছাড়তে পারে না, তখন এখানেই থেকে যাও।–আর না হয়–
বধূর কথার ভঙ্গিতে অমলা কি জানি কি একটা ঠাওরাইয়া লজ্জিত প্রতিবাদের সুরে বলিলআচ্ছা যাও বৌদি-ও-রকম করলে কিন্তু কক্ষনো আর তোমাদের বাড়ি–
খানিকক্ষণ পরে অপু অমলার সঙ্গে তাঁহাদের বাড়ি গেল। আমলা তাহাদের আলমারি খুলিয়া কাঁচের। বড় মেম-পুতুল, মোমের পাখি, গাছ, আরও কত-কি দেখাইল। কালীগঞ্জের স্নানযাত্রার মেলা হইতে সে-সব নাকি কেনা, অপু জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল। নতুন নতুন খেলার জিনিস—একটা রবারের বাঁদর, সেটা তুমি যেদিকে যাও, তোমার দিকে চাহিয়া চোখ পিটুপিট্ করিবে—একটা কিসের পুতুল, সেটার পেট টিপিলে দুহাতে মৃগীরোগীব মতো হঠাৎ হাত পা ছুড়িয়া খঞ্জনী বাজাইতে থাকে-সকলের চেয়ে আশ্চর্যের জিনিস হইতেছে একটা টিনের ঘোড়া, রানুদির কোকা তাহাদের বাড়ির দালানের ঘড়িতে যেমন দম দেয়, ওইরকম দম দিয়া ছাড়িয়া দিলে সেটা খড়খড় করিয়া মেঝের উপর চলিতে থাকে-অনেক দূর যায়—ঠিক যেন একেবারে সত্যিকারের ঘোড়া। সেইটা দেখিয়া অপু অবাক হইয়া গেল। হাতে তুলিয়া বিস্ময়ের সহিত উলটাইয়া-পালটাইয়া দেখিয়া আমলার দিকে চাহিয়া বলিল-এ কি রকম ঘোড়া, বেশ তো! এ কোথা থেকে কেনা, এর দাম কত?
তাহার পর আমলা তাহাকে একটা সিঁদুরের কৌটা খুলিয়া দেখাইল-সেটার মধ্যে রাঙা রংএর একখানা ছোট রাংতার মতো কি। অপু বলিল-ওটা কি? রাংতা?
অমলা হাসিয়া বলিল-রাংতা হবে কেন?–সোনার পাত দেখনি অপু?
অপু সোনার পাত দেখে নাই। সোনার রং কি অত রাঙা? সোনার পাতখানা নাড়িয়া চড়িয়া ভালো করিয়া দেখিতে লাগিল। অমলার সহিত বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে সে ভাবিল—আহ্বা, দিদিটার ও-সব খেলনা কিছুই নেই-মরে কেবল শূকনো নাটাফল আর রীড়ার বিচি কুড়িয়ে, আর শুধু পরের পুতুল চুরি করে মার খায়!..তাহার দিদির বয়সি অন্য কোনো মেয়ের খেলনার ঐশ্বৰ্য কৃত বেশি, তাহা সে এ পর্যন্ত কোনো দিন দেখে নাই, আজ তুলনা করিয়া দেখিবার সুযোগ পাইয়া দিদির প্রতি অত্যন্ত করুণায় তাহার মনটা যেন গলিয়া গেল। তাহার পয়সা থাকিলে সে দিদিকে একটা কলের ঘোড়া কিনিয়া দিত-আর একটা রবারের বাঁদর…তুমি যেদিকে যাও, তোমার দিকে চাহিয়া সেটা চোখ পিট্পিট্ করে…
বধূর কাছে একজোড়া পুরানো তাস ছিল, ঠিক একজোড়া বলা চলে না, সেটা নানা জোড়া তাসের পরিত্যক্ত কাগজগুলি এক জায়গায় জড়ো করা আছে মাত্র-অপু সেগুলি লইয়া মধ্যে মধ্যে নাড়ে চাড়ে। রানুদির বাড়িতে মাঝে মাঝে দুপুরবেলা তাসের আডিডা বাসিত, সে বসিয়া বসিয়া খেলা দেখিত। টেক্কা, গোলাম, সাহেব, বিবি-কাগজ ধরা লইয়া মারামারি হয়।–বেশী খেলা! সে তাস খেলিতে জানে না, তাহার মা দিদি কেহই জানে না। এক-এক দিন তাহার মা তাস খেলিতে যায়, তাহার মাকে লইয়া কেহ বসিতে চায় না, সকলে বলে, ও কিছু খেলা জানে না; এক এক দিন তাহার মা তাস খেলিতে বসে, এমন ভাব দেখায় যেন সে খুব পাকা খেলোয়াড়-খানিকক্ষণ পরেই কিন্তু ধরা পড়ে। কেউ বলে, ও বৌ, একি? এখানে টেক্কা মেরে বসলে যে! দেখলে না ও-হাতে রংয়ের গোলাম কাঁটুলে?–তোমার চোখের সামনে যে? তাহার মা তাড়াতাড়ি অজ্ঞতা ঢাকিতে যায়, হাসিয়া বলে, তাই তো! বড় তো ভুল হয়ে গেছে, ও ঠাকুরঝি, মোটেই তো মনে নেই। পরে সে আবার খেলিতে থাকে, মুখ টিপিয়া হাসে, এর ওর দিকে চায়, এমন ভাবটা দেখায় যে তাহার কাছে সকলের হাতের তাসের খবরই আছে, এবার একটা কিছু না করিয়া সে ছাড়িবে না-কিন্তু খানিকটা পরে একজন অবাক হইয়া বলিয়া উঠে-একি বৌমা, দেখি? ওমা আমার কি হবে! তোমার হাতে যে, এমন বিস্তি ছিল, দেখাওনি?–তাহার মা মুখ টিপিয়া হাসিয়া বিজ্ঞের ভাব করিয়া বলে,–আছে, আছে, ওর মধ্যে একটা কথা আছে! ইচ্ছে করেই দেখাই নি। সে আসলে বিন্তি কিসে হয় সব জানে না।–তাহার খেলুড়ে রাগ করিয়া বলে-ওর মধ্যে আবার কথাটা কি শুনি? এমন হাতটা নষ্ট কল্লে? দাও তুমি তাস সেজবৌকে, দাও, তোমার আর খেলতে হবে না-ঢ়ের হয়েছে। তাহার মা অপমান ঢাকিতে গিয়া আবার হাসে-যেন কিছুই হয় নাই, সবই ঠাট্টা, উহারা ঠাট্টা করিয়া বলিতেছে, সেও সেই ভাবেই লইতেছে।…
সে যদি একজোড়া তাস পায় তবে, সে, মা ও দিদি খেলে। খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরবেলা তাদের বাড়ির বনের ধারের দিকের সেই জানালোটা.যেটার কবাটগুলোর মধ্যে কি পোকায় কাটিয়া সরিষার মতো গুঁড়া করিয়া দিয়াছে…নাড়া দিলে ঝুরঝুর করিয়া ঝরিয়া পড়ে, পুরানো কাঠের গুঁড়ার গন্ধ বার হয়—জানালার ধারের বন থেকে দুপুরের হাওয়ায় গন্ধভেদালি লতার কটু গন্ধ আসে, রোয়াকের কালমেঘের গাছের জঙ্গলে দিদির পরিচিত কাঁচপোকাটা একবার ওড়ে, আবার বসে, আবার ওড়ে আবার বসে-নির্জন দুপুরে তারা তিনজনে সেই জানালাটির ধারে মাদুর পাতিয়া বসিয়া আপন মনে তাস খেলিবে। কিসে কিসে বিস্তি হয় তাদের নাই-বা থাকিল জানা, তাদের খেলায় বিস্তি না দেখাইতে পারিলেও চলিবে- সেজন্য কেহ কহাকেও উঠাইয়া দিবে না, কোন অপমানের কথা বলিবে না, কোন হাসি-বিদ্যুপ করিবে না, যে যেরূপ পারে সেইরূপই খেলিবে। খেলা লইয়া কথা-নাই বা হইল বিন্তি দেখানো!
সন্ধার পরে বধূর ঘরে অপুর নিমন্ত্রণ ছিল। খাইতে বসিয়া খাবার জিনিসপত্র ও আয়োজনের ঘটা দেখিয়া সে অবাক হইয়া গেল। ছোট একখানা ফুলকাটা রেকবিতে আলাদা করিয়া নুন ও নেবু কেন? নুন নেবু তো মা পাতেই দেয়। প্রত্যেক তরকারির জন্যে খাবার আলাদা আলাদা বাটি!— তরকারিই বা কত! অত বড় গলদা চিংড়ির মাথাটা কি তাহার একার জন্য?
লুচি! লুচি। তাহার ও তাহার দিদির স্বপ্নকামনার পারে এক রূপকথার দেশের নীল-বেলা আবছায়া দেখা যায়.কত রাতে, দিনে, ওলের ডাটোচচ্চড়ি ও লাউ-হেঁচকি দিয়া ভাত খাইতে খাইতে, কত জল-খাবার-খাওয়া-শূন্য সকালে বিকালে, অন্যমনস্ক মন হঠাৎ লুব্ধ উদাস গতিতে ছুটিয়া চলে সেখানে-যেখানে গরম রোদে দুপুরবেলা তাহদের পাড়ার পাকা রাঁধুনী বীবু রায় গামছা কঁধে ঘুরিয়া বেড়ায়, সদ্য তৈয়ারি বড় উনুনের উপর বড় লোহার কড়াই-এ ঘি চাপানো থাকে, লুচিভাজার অপূর্ব সুধা-বুচি-ত্মাণ আসে, কত ছেলেমেয়ে ভালো কাপড়-জামা পরিয়া যাতায়াত করে, গাঙ্গুলি বাড়ির বড় নাটমন্দির ও জলপাই-তলা বিছাইয়া গ্ৰীষ্মের দিনে শতরঞ্চ পাতা হয়, একদিন মাত্র বছরে সে দেশের ঠিকানা খুঁজিয়া মেলে-সেই চৈত্র বৈশাখ মাসে রামনবমী দোলের দিনটাতাহাদের সেদিন নিমন্ত্রণ থাকে ওপাড়ার গাঙ্গুলি বাড়ি। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে সে সুদিনের উদয় হইল কি করিয়া! খাইতে বসিয়া বার বার তাহার মনে হইতেছিল, আহা, তাহার দিদি। এ রকম খাইতে পায় নাই কখনও!
পরদিন সকালে আবার খেলা আরম্ভ হইল। অমলা আসিতেই অপু ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিল-আমি আর অমলাদি একদিকে, আর তোমরা সব একদিকে–
খানিকটা খেলা হইবার পর অপুর মনে হইল অমলা তাহাকে দলে পাওয়ার অপেক্ষা বিশ্বকে দলে পাইতে বেশি ইচ্ছক। ইহার প্রকৃত কারণ অপু জানিত না-অপু একেবারে কাঁচা খেলুড়ে, তাহাকে দলে লওয়ার মানেই পরাজয়-বিশ্ব ডানপিটে ছেলে, তাহাকে দৌড়িয়া ধরা কি খেলায় হারানো সোজা নয়। একবার অমলা স্পষ্টই বিরক্তি প্রকাশ করিল। অপু প্ৰাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিল যাহাতে সে জেতে, যাহাতে আমলা সন্তুষ্ট হয়-কিন্তু বিস্তর চেষ্টা সত্ত্বেও সে আবার হারিয়া গেল।
সে-বার দল গঠন করিবার সময় অমলা ঝুঁকিল বিশুর দিকে।
অপুর চোখে জল ভরিয়া আসিল। খেলা তাহার কাছে হঠাৎ বড় বিস্বাদ মনে হইল-অমলা বিশুর দিকে ফিরিয়া সব কথা বলিতেছে, হাসিখুশি সবই তাহার সঙ্গে। খানিকটা পরে বিশু কি কাজে বাড়ি যাইতে চাহিলে অমলা তাহাকে বার বার বলিল যে, সে যেন আবার আসে। অপুর মনে অত্যন্ত ঈর্ষ হইল, সারা সকালটা একেবারে ফাঁকা হইয়া গেল! পরে সে মনে মনে ভাবিল-বিশৃণু খেলা ছেড়ে চলে যাচ্ছে-গেলে খেলার খেলুড়ে কমে যাবে, তাই অমলাদি ওইরকম বলচে, আমি গেলে আমাকেও বলবে, ওর চেয়েও বেশি বলবে। হঠাৎ সে চলিয়া যাইবার ভান করিয়া বলিল-বেলা হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই, নাইবো।
অমলা কোনো কথা বলিল না, কেবল কামারদের ছেলে নাড়ুগোপাল বলিল-আবার ওবেলা এসো ভাই!
অপু খানিক দূর গিয়া একবার পিছনে চাহিল।–তাহাকে বাদ দিয়া কাহারও কোনো ক্ষতি হয় নাই, পুরাদমে খেলা চলিতেছে, অমলা মহা উৎসাহে খুঁটির কাছে বুড়ি হইয়া দাঁড়াইয়াছে—তাহার। দিকে ফিরিয়াও চাহিতেছে না।
অপু আহত হইয়া অভিমানে বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল, কাহারও সঙ্গে কোনো কথা বলিল না। ভারি তো অমলাদি। না চাহিল তাহাকে-তাতেই বা কি?..
দুই দিন পরে হরিহর ছেলে লইয়া বাড়ি আসিল।
এই মোটে কয়দিন, এরই মধ্যে সর্বজয়া ছেলেকে না দেখিয়া আর থাকিতে পারিতেছিল না।
দুৰ্গার খেলা কয়দিন হইতে ভালোরকম জমে নাই, অপুর বিদেশ-যাত্রার দিনকতক আগে দেশী কুমড়ার শূকনো খোলার নীেকা লইয়া ঝগড়া হওয়াতে দুজনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হইয়া গিয়াছিলএখন আরও অনেক কুমড়ার খোলা জমিয়াছে, দুর্গা কিন্তু আর সেগুলি জলে ভাসাঁইতে ঝায় নাকেন মিছিমিছি এ নিয়ে ঝগড়া করে তার কান ম’লে দিলাম? আসুক সে ফিরে, আর কক্ষনো তাব সঙ্গে ঝগড়া নয়, সব খোলা সেই নিয়ে নিক।
বাড়ি আসিয়া অপু দিন পনেরো ধরিয়া নিজের অদ্ভুত ভ্ৰমণকাহিনী বলিয়া বেড়াইক্ষে লাগিল। কত আশ্চর্য জিনিস সে দেখিয়াছে এই কয়দিনে! রেলের রাস্তা, যেখান দিয়া সত্যিকারের রেলগাড়ি যায়! মাটির আতা, পেঁপে, শস্য-অবিকল যেন সত্যিকার ফল। সেই পুতুলটা, যেটার পেট টিপিলে। মৃগীরোগীর মতো হাত-পা ছুড়িয়া হঠাৎ খঞ্জনী বাজাইতে শুরু করে! অমলাদি। কতদূর যে সে গিয়াছিল, কত পদ্মফুলে ভরা বিল, কত অচেনা নতুন গা পার হইয়া কত মাঠের উপরকার নির্জন পথ বাহিয়া, সেই যে কোন গাঁয়ে পথের ধারের কামার-দোকানে বাবা তাহাকে জল খাওয়াইতে লইয়া গেলে, তাহারা তাহাকে বাড়ির মধ্যে ডাকিয়া লইয়া গিয়া যত্ন করিয়া পিঁড়ি পাতিয়া বসাইয়া দুধ, চিড়ে, বাতাসা খাইতে দিয়াছিল! কোনটা ফেলিয়া সে কোনটার গল্প করে!
রেলরাস্তার গল্প শুনিয়া তাহার দিদি মুগ্ধ হইয়া যায়, বার বার জিজ্ঞাসা করে-কত বড় নোয়াগুনো দেখলি অপু? তার টাঙানো বুঝি? খুব লম্বা? রেলগাড়ি দেখতে পেলি? গেল?
না-রেলগাড়ি অপু দেখে নাই। ওইটাই কেবল বাদ পড়িয়াছে—সে শুধু বাবার দোষে। মোটে ঘণ্টা চার-পাঁচ রেলরাস্তার ধারে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলেই রেলগাড়ি দেখা যাইত-কিন্তু বাবাকে সে কিছুতেই বুঝাইয়া উঠিতে পারে নাই।
বেলা হইয়া যাওয়াতে ব্যস্ত অবস্থায় সর্বজযা তাড়াতাড়ি অন্যমনস্কভাবে সদর দরজা দিয়া ঢুকিয়া উঠানে পা দিতেই কি যেন একটা সরু দড়ির মতো বুকে আটকাইল ও সঙ্গে সঙ্গে কি যেন একটা পটাং করিয়া ছিঁড়িয়া যাইবার শব্দ হইল এবং দুদিক হইতে দুটা কি, উঠানে ঢিলা হইয়া পড়িয়া গেল। সমস্ত কার্যটি চক্ষের নিমেষে হইয়া গেল, কিছু ভালো করিয়া দেখিবার কি বুঝিবার পূর্বেই।
অল্পখানিক পরেই অপু বাড়ি আসিল। দরজা পার হইয়া উঠানে পা দিতেই সে থমকাইয়া দাঁড়াইয়া গেল—নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিল না-এ কি! বা রে, আমার টেলিগিরাপের তার ছিঁড়লে কে?
ক্ষতির আকস্মিকতায্য ও বিপুলতায় প্রথমটা সে কিছু ঠাহর করিতে পারিল না। পরে একটু সামলাইয়া লইয়া চাহিযা দেখিল উঠানের মাটিতে ভিজা পায্যের দাগ এখনও মিলায় নাই। তাহাব মনের ভিতর হইতে কে ডাকিয়া বলিল—ম ছাড়া আর কেউ নয়। ককখনো আর কেউ নয়, ঠিক মা! বাড়ি ঢুকিযা সে দেখিল মা বসিয়া বসিযা বেশ নিশ্চিন্ত মনে কাঁঠালবীচি ধুইতেছে। সে হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িল এবং যাত্রা দলের অভিমনুর মতো ভঙ্গিতে সামনেব দিকে ঝুঁকিয়া বাঁশির সপ্তমের মতো রিনারিনে তীব্র মিষ্টসুবে কহিল-আচ্ছা মা, আমি কষ্ট করে ছোটাগুলো বুঝি বন বাগান ঘেঁটে নিয়ে আসি নি?
সর্বজয়া পিছনে চাহিয়া বিস্মিতভাবে বলিল–কি নিয়ে এসেচিস? কি হয়েচে—
আমার বুঝি কষ্ট হয় না? কীটায় আমার হাতপা ছড়ে যায় নি বুঝি?
–কি বলে পাগলের মতো? হযেচে কি?
—কি হয়েচে! আমি এত কষ্ট করে টেলিগিরাপের তার টাঙালাম আর ছিড়ে দেওয়া হয়েচে না?
—তুমি যত উদঘুট্টি কাণ্ড ছাড়া তো এক দণ্ড থাকো না বাপু!-পথের মাঝখানে কি টাঙানো রয়েচে-কি জানি টেলিগিরিাপ কি কি-গিরাপ, আসচি তাড়াতাড়ি ছিড়ে গেল।–তা এখন কি করবো বলো– পরে সে পুনরায় নিজ কাজে মন দিল।
উঃ! কি ভীষণ হৃদয়হীনতা! আগে আগে সে ভাবিত বটে যে, তাহার মা তাহাকে ভালোবাসে। অবশ্য যদিও তাহার সে ভ্রান্ত ধারণা অনেকদিন ঘুচিয়া গিয়াছে—তবুও মাকে এতটা নিষ্ঠুর পাষাণীরূপে। কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই। কাল সারাদিন কোথায় নীলমণি জেঠার ভিটা, কোথায় পালিতদের বড় আমবাগান, কোথায় প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের বাঁশবন-ভয়ানক ভয়ানক জঙ্গলে একা ঘুরিয়া বহু কষ্ট উঁচু ডাল হইতে দোলানো গুলঞ্চলত কত কষ্টে জোগাড় করিয়া সে আনিল, এখুনি রোল-রেল খেলা হইবে, সব ঠিকঠাক, আর কি না…
হঠাৎ সে মাকে একটা খুব কড়া, খুব রূঢ়, খুব একটা প্ৰাণ-বিধানো কথা বলিতে চাহিল—এবং খানিকটা দাঁড়াইয়া বোধ হয় অন্য কিছু ভাবিয়া না পাইয়া আগের চেয়েও তীব্র নিখাদে বলিল-আমি আজ ভাত খাবো না যাও-কখখনো খাবো না–
তাহার মা বলিল-মা খাবি না খাবি যা-ভাত খেয়ে একেবারে রাজা করে দেবেন। কিনা? এদিকে তো রান্না নামাতে তার সয় না-না খাবি যা, দেখবো ক্ষিদে পেলে কে খেতে দ্যায়?
ব্যস! চক্ষের পলকে-সব আছে, আমি আছি তুমি আছ–সেই তাহার মা কাঁটালবীচি ধুইতেছে-কিন্তু অপু কোথায়? সে যেন কপূরের মতো উবিয়া গেল! কেবল ঠিক সেই সময়ে দুর্গা বাড়ি ঢুকিতে দরজার কাছে তাহাকে পাশ কাটাইয়া ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া যাইতে দেখিয়া বিস্মিত সুরে ডাকিয়া বলিল-ও অপু, কোথায় যাচ্ছিস আমন করে, কি হয়েচে, ও অপু শোন–
তাহার মা বলিল-জানিনে আমি, যত সব অনাছিষ্ট কাণ্ড বাপু তোমাদের, হাড় মাস কালি হয়ে গেল।–কি এক পথের মাঝখানে টাঙিয়ে রেখেচে, আসচি, ছিড়ে গেল-তা এখন কি হবে? আমি কি ইচ্ছে করে ছিাঁড়চি? তাই ছেলের রাগ-আমি ভাত খাবো না-না খাস যা, ভাত খেয়ে সব একেবারে স্বগগে ঘণ্টা দেবে কিনা তোমরা?
মাতাপুত্রের এরূপ অভিমানের পালায় দুৰ্গাকেই মধ্যস্থ হইতে হয়-সে। অনেক ডাকাডাকির পরে বেলা দুইটার সময় ভাইকে খুঁজিয়া বাহির করিল। সে শুল্কমুখে উদাসীনয়নে ও-পাড়ার পথে রায়েদের বাগানে পড়ন্ত আমগাছের গুড়ির উপর বসিয়া ছিল।
বৈকালে যদি কেহ আপুদের বাড়ি আসিয়া তাহাকে দেখিত তবে সে কখনই মনে করিতে পারিত না যে, এ সেই অপু-যে আজ সকালে মায়ের উপর অভিমান করিয়া দেশত্যাগী হইয়াছিল। উঠানের এ-প্ৰস্ত হইতে ও-প্রাস্ত পর্যন্ত তার টাঙানো হইয়া গিয়াছে। অপু বিস্মযের সহিত চাহিয। চাহিয়া দেখিতেছিল, কিছুই বাকি নাই, ঠিক যেন একবারে সত্যিকার রেলরাস্তার তার।
সে সতুদের বাড়ি গিয়া বলিল-সতুদা, আমি টেলিগিরাপের তার টাঙিয়ে রেখেচি আমাদের বাড়িব উঠানে, চল রেল-রেল খেলা করি–আসবে?
–তার কে টাঙিয়ে দিল রে?
–আমি নিজে টাঙালাম। দিদি ছোটা এনে দিয়েছিল—
সতু বলিল-তুই খেলগে যা, আমি এখন যেতে পাববো না—
অপু মনে মনে বুঝিল, বড় ছেলেদের ড্রাকিযা দল বাঁধিয খেলার জোগাড় করা তাহাব কর্ম নয়। কে তাহার কথা শুনিবে? তবুও আর একবার সে সত্যুর কাছে গেল। নিরাশ মুখে রোয়াকের কোণটা ধরিয়া নিরুৎসাহভাবে বলিল-চল না। সত্যুদ, যাবে? তুমি আমি আর দিদি খেলবো এখন? পরে সে প্রলোভনজনক ভাবে বলিল-আমি টিকিটের জন্যে এতগুলো বাতাবি নেবুব পাতা তুলে এনে রেখেচি। সে হাত ফাক করিয়া পরিমাণ দেখাইল।-যাবে?
সতু আসিতে চাহিল না। অপু বাহিরে বড় মুখ-চোরা, সে আর কিছু না বলিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেল। দুঃখে তাব চোখে প্রায় জল আসিতেছিল-এত করিয়া বলিতেও সতুদা শুনিল না!
পরদিন সকালে সে ও তাহার দিদি দুজনে মিলিয়াইট দিয়া একটা বড় দোকানঘর বাঁধিয়া জিনিসপত্রের জোগাড়ে বাহির হইল। দুৰ্গা বনজঙ্গলে উৎপন্ন দ্রব্যের সন্ধান বেশি রাখে-দুজনে মিলিয়া নোনাপাতার পান, মোট আলু, ফলের আলু, রাধালতা ফুলের মাছ, তেলাকুচির পটল, চিচ্চিড়ের বরবটি, মাটির ঢেলার সৈন্ধব লবণ-আরও কত কি সংগ্ৰহ করিয়া আসিয়া দোকান সাজাইতে বড় বেলা করিয়া ফেলিল। অপু বলিল-চিনি কিসের করবি রে দিদি?
দুৰ্গা বলিল-বাঁশতলার পথে সেই টিবিটায় ভালো বালি আছে-মা চাল-ভাজা ভাজাবার জন্যে আনে! সেই বালি চল আনি গো-সাদা চক চক করচে-ঠিক একেবারে চিনি–
বাঁশবনে চিনি খুঁজিতে খুঁজতে তাহারা পথের ধারের বনের মধ্যে ঢুকিল। খুব উঁচু একটা বন, চটকা গাছের আগাড়ালে একটা বড় লতার ঘন সবুজ আড়ালে, টুকটুকে রাঙা, বড় বড় সুগোল কি ফল দুলিতেছে। অপু ও দুৰ্গা দুজনেই দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। অনেক চেষ্টায় গোটা কয়েক ফল নিচের দিকে লতার খানিকটা অংশ ছিঁড়য়া তলায় পড়িতেই মহা আনন্দে দুজনে একসঙ্গে ছুটিয়া গিয়া সেগুলিকে মাটি হইতে তুলিয়া লইল।
পাকা ফল মোটে তিনটি। প্ৰধানত বিপণি-সজ্জার উদ্দেশ্যেই তাহা দোকানে এরূপ ভাবে রক্ষিত হইল যে, খরিদার আসিলে প্রথমেই যেন নজরে পড়ে। পুরাদমে বেচাকেনা আরম্ভ হইয়া গেল। দুৰ্গা নিজেই পান কিনিয়া দোকানের পান প্ৰায় ফুরাইয়া ফেলিল। খেলা খানিকটা অগ্রসর হইয়াছে এমন সময় সদর দরজা দিয়া সতুকে ঢুকিতে দেখিয়া অপু মহা আনন্দে তাহাকে আগাইয়া আনিতে দৌড়িয়া গেল—ও সত্যুদা, দ্যাখো না কি রকম দোকান হয়েচে, কেমন ফল দ্যাখো। আমি আর দিদি পেড়ে আনলাম-কি ফল বলো দিকি? জানো?
সতু বলিল-ও তো মাকাল ফল-আমাদের বাগানে ক-ত ছিল!
সতু আসিতে অপু যেন কৃতাৰ্থ হইয়া গেল। সত্যুদা তাহাদের বাড়িতে তো বড় একটা আসে না-তা ছাড়া সত্যুদা বড় ছেলেদের দলের চাই। সে আসাতে খেলার ছেলেমানুষিটুকু যেন ঘুচিয়া গেল।|
অনেকক্ষণ পুরা মরসুমে খেলা চলাবার পর দুৰ্গা বলিল-ভাই আমাকে দুমণ চাল দাও, খুব সবু, কাল আমার পুতুলের বিয়ের পাকা দেখা, অনেক লোক খাবে—-
সতু বলিল-আমাদের বুঝি নেমন্তন্ন, না?
দুৰ্গা মাথা দুলাইয়া বলিল-না বই কি! তোমরা তো হলে কনে-যাত্রী-কাল সকালে এসে নকুতো করে নিয়ে যাবো—সতুদা, রানুকে বলবে আজ রাত্তিরে যেন একটু চন্দন বেটে রাখে। কাল সকালে নিয়ে আসব–
দুৰ্গার কথা ভালো কবিয়া শেষ হয় নাই এমন সময় সন্তু দোকানে বিক্রয়ার্থ রক্ষিত পণ্যেৰ মধ্য হইতে কি-একটা তুলিয়া লইয়া হঠাৎ দৌড় দিয়া দরজার দিকে ছুটিল-সঙ্গে সঙ্গে অপুও, ওরে দিদি রে-নিয়ে গেল রে—বলিয়া তাহার রিনারিনে তীব্র মিষ্ট গলায় চিৎকার করিতে করিতে তাহার পিছনে পিছনে ছুটিল।
বিস্মিত দুৰ্গা ভালো করিয়া ব্যাপাবটা কি বুঝিবার আগেই সন্তু ও অপু দৌড়াইয়া দরজার বাহির হইয়া চলিয়া গেল! সঙ্গে সঙ্গে খেলাঘরের দিকে চোখ পড়িতেই দুৰ্গা দেখিল, সেই পাকা মাকাল ফল তিনটির একটিও নাই!..
দুৰ্গা একছুটে দরজার কাছে আসিয়া দেখিল, সন্তু গাবতলার পথে আগে আগে ও অপু তাহা হইতে অল্প নিকটে পিছু পিছু ছুটিতেছে। সত্যুর বয়স অপুর চেয়ে তিন চার বৎসরের বেশি, তাহা ছাড়া সে অপুর মতো ওরকম ছিপছিপে মেয়েলি গড়নের ছেলে নয়।–বেশ জোরালো হাত-পা- ওয়ালা ও শক্ত-তাহার সহিত ছুটিয়া অপুর পারিবার কথা নহে-তবুও যে সে ধরি-ধরি করিয়া তুলিয়াছে, তাহার একমাত্র কারণ এই যে সন্তু ছুটিতেছে। পরের দ্রব্য আত্মসাৎ করিয়া এবং অপু ছুটিতেছে প্ৰাণের দায়ে।
হঠাৎ দুৰ্গা দেখিল যে সন্তু ছুটিতে ছুটিতে পথে একবারটি যেন নিচু হইয়া পিছনে ফিরিয়া চাহিল—সঙ্গে সঙ্গে অপুও হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িল-সন্তু ততক্ষণ ছুটিয়া দৃষ্টির বাহির হইয়া চালতেতলার পথে গিয়া পড়িয়াছে।
দুর্গা ততক্ষণে দৌড়িয়া গিয়া অপুর কাছে পৌঁছিল। অপু একদম চোখ বুজিয়া একটু সামনের দিকে নিচু হইয়া বুকিয়া দুই হাতে চোখ রাগড়াইতেছে-দুৰ্গা বলিল-কি হয়েছে রে অপু?
অপু ভালো করিয়া চোখ না চাহিয়াই যন্ত্রণার সুরে দু’হাত দিয়া চোখ রগড়াইতে রাগড়াইতে বলিল-সতুদা চোখে ধুলো ছুড়ে মেরেচে। দিদি-চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না রে—
দুৰ্গা তাড়াতাড়ি অপুর হাত নামাইয়া বলিল-সরসর দেখি-ওরকম করে চোখ রাগড়াস নে, দেখি?–
অপু তখনই দু’হাত আবার চোখে উঠাইয়া আকুল সুরে বলিল-উষ্ণু ও দিদি-চোখের মধ্যে কেমন হচ্ছে-আমার চোখ কানা হয়ে গিয়েচে দিদি–
–দেখি দেখি ওরকম করে চোখে হাত দিসনে-সর-পরে সে কাপড়ে ফু পাড়িয়া চোখে ভাপ দিতে লাগিল। কিছু পরে অপু একটু একটু চোখ মেলিয়া চাহিতে লাগিল-দুর্গা তাহার চোখের পাতা তুলিয়া অনেকবার ফু দিয়া বলিল-এখন বেশ দেখতে পাচ্ছিস?–আচ্ছা তুই বাড়ি যা..আমি ওদের বাড়ি গিয়ে ওর মাকে আর ঠাকমাকে সব বলে দিয়ে আসচি-রানুকেও বলবো-আচ্ছা দুষ্ট ছেলে তো-তুই যা আমি আসছি। এখখনি—
রানুদের খিড়কি দরজা পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া দুর্গা কিন্তু আর যাইতে সাহস করিল না। সেজঠাকুবুনকে সে ভয় করে। খানিকক্ষণ খিড়কির কাছে দাঁড়াইয়া ইতস্তত করিয়া সে বাড়ি ফিরিল। সদর দরজা দিয়া ঢুকিয়া সে দেখিল অপু দরজার বাম ধারের কবাটখানি একটুখানি সামনে ঠেলিয়া দিয়া তাহারই আড়ালে দাঁড়াইয়া নিঃশব্দে কাঁদিতেছে। সে ছিচৰ্কাদুনে ছেলে নয়, বড় কিছুতেই সে কখনও কঁদে না-রাগ করে, অভিমান করে বটে, কিন্তু কঁদে না। দুৰ্গা বুঝিল আজ তাহার অত্যন্ত দুঃখ হইয়াছে, অত সাধের ফলগুলি গেল…তাহা ছাড়া আবার চোখে ধূলা দিয়া এরূপ অপমান করিল! অপুর কান্না সে সহ্য করিতে পারে না।–তাহার বুকের মধ্যে কেমন যেন করে।
সে গিয়া ভাইয়ের হাত ধরিল-সান্ত্বনার সুরে বলিল-কাঁদিস নে অপু-আয় তোকে আমার সেই কড়িগুলো সব দিচ্চি-আয়-চোখে কি আর ব্যথা বাড়চে?…দেখি, কাপড়খানা বুঝি ছিড়ে ফেলেচিস?
খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরবেলা অপু কোথাও বাহির না হইয়া ঘরে থাকে। অনেকদিনের জীর্ণ পুরাতন কোঠ-বাড়ির পুরাতন ঘর। জিনিসপত্র, কাঠের সেকালের সিন্দুক, কটা রং-এর সেকালের বেতের প্যাট্ররা, কড়ির আলনা, জলচৌকিতে ঘর ভরানো। এমন সব বাক্স আছে যাহা অপু কখনও খুলিতে দেখে নাই, তাহাতে রক্ষিত এমন সব হ্যাঁড়ি-কলসি আছে, যাহার অভ্যস্তরস্থ দ্রব্য সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
সব-সুদ্ধ মিলিয়া ঘরটিতে পুরানো জিনিসের কেমন একটা পুরানো পুরানো গন্ধ বাহির হয়সেটা কিসের গন্ধ সে জানে না, কিন্তু সেটা যেন বহু অতীত কালের কথা মনে আনিয়া দেয়। সে অতীত দিনে অপু ছিল না, কিন্তু এই কড়ির আলনা ছিল, ওই ঠাকুরদাদার বেতের বাঁপিটা ছিল, ওই বড় কাঠের সিন্দূকটা ছিল, ওই যে সৌদালি গাছের মাথা বনের মধ্যে হইতে বাহির হইয়া আছে, ওই পোড়াজঙ্গলে-ভরা জায়গাটাতে কাহাদের বড় চণ্ডীমণ্ডপ ছিল, আরও কত নামের কত ছেলেমেয়ে একদিন এই ভিটাতে খেলিয়া বেড়াইত, কোথায় তারা ছায়া হইয়া মিলাইয়া গিয়াছে, কতকাল আগে!
যখন এক ঘরে থাকে, মা ঘাটে যায়–তখন তাহার অত্যস্ত লোভ হয়। ওই বাক্সটা, বেতের ঝাঁপিটা খুলিয়া দিনের আলোয় বাহির করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখে কি অদ্ভুত রহস্য উহাদের মধ্যে গুপ্ত আছে। ঘরের আড়ার সর্বোচ্চ তাকে কাঠের বড় বারকোশে যে তালপাতার পুথির স্তুপ ও খাতাপত্ৰ আছে, বাবাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিয়াছিল সেগুলি তাহার ঠাকুরদাদা রামর্চাদ তর্কালঙ্কারের—তাহার বড় ইচ্ছা ওইগুলি যদি হাতের নাগালে ধরা দেয়, তবে সে একার নিচে নামাইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখে। এক-একদিন বনের ধারে জানালাটায় বসিয়া দুপুরবেলাসে সেই ছেড়া কাশীদাসের মহাভারতখানা লইয়া পড়ে, সে নিজেই খুব ভালো পড়িতে শিখিয়াছে, আগেকার মতো আর মুখে শুনিতে হয় না, নিজেই জলের মতো পড়িয়া যায় ও বুঝিতে পারে। পড়াশুনায় তাহার বুদ্ধি খুব তীক্ষ্ণ, তাহার বাবা মাঝে মাঝে তাহাকে গাঙ্গুলিবাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে বৃদ্ধদের মজলিশে লইয়া যায়, রামায়ণ কি পাঁচালী পড়িতে দিয়া বলে, পড়ে তো বাবা, এদের একবার শুনিয়ে দাও তো? বৃদ্ধেরা খুব তারিফ করেন, দীনু চাটুজ্যে বলেন–আর আমার নাতিটা, এই তোমার খোকারই বয়স হবে, দুখানা বর্ণপরিচয় ছিঁড়লে বাপু, শুনলে বিশ্বাস করবে না, এখনও ভালো করে অক্ষর চিনলে না-বাপের ধারা পেয়ে বসে আছে-ওই যে-কদিন আমি আছি রে বাপু, চক্ষু বুজলেই লাঙলের মুঠো ধরতে হবে। পুত্ৰগর্বে হরিহরের বুক ভরিয়া যায়। মনে মনে ভাবে-ও কি তোমাদের হবে? কল্পে তো চিরকাল সুদের কারবার!-হলামই বা গরিব, হাজার হোক পণ্ডিত-বংশ তো বটে, বাবা মিথ্যেই তালপাত ভরিয়ে ফেলেন নি পুথি লিখে, বংশে একটা ধারা দিয়ে গিয়েছেন, সেটা যাবে কোথায়?
তাহাদের ঘরের জানলার কয়েক হাত দূরেই বাড়ির পাঁচিল এবং পাচিলের ওপাশ হইতেই পাঁচিলের গা ঘেষিয়া কি বিশাল আগাছার জঙ্গল আরম্ভ হইয়াছে। জানালায় বসিয়া শুধু চোখে পড়ে সবুজ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ভাট্রিশেওড়া গাছের মাথাগুলো, এগাছে ওগাছে দোদুল্যমান কত রকমের লতা, প্রাচীন বাঁশঝাড়ের শীর্ষ বয়সের ভারে যেখানে সৌদালি, বন-চালতা গাছের উপর কুকিয়া পড়িয়াছে, তাহার নিচের কালো মাটির বুকে খঞ্জন পাখির নোচ! বড় গাছপালার তলায় হলুদ, বনকচু, কটু ওলের ঘন সবুজ জঙ্গল ঠেলাঠেলি করিয়া সূর্যের আলোর দিকে মুখ ফিরাইতে প্ৰাণপণ করিতেছে, এই জীবনের যুদ্ধে যে গাছটা অপারগ হইয়া গৰ্বদৃপ্ত প্রতিবেশীর আওতায় চাপা পড়িয়া গিয়াছে, তাহার পাতাগুলি বিবর্ণ, মৃত্যুপাণ্ডুর ডাটা গলিয়া আসিল,-মরণাহত দৃষ্টির সম্মুখে শেষশরতের বন-ভরা পরিপূর্ণ ঝলমলে রৌদ্র, পরগাছার ফুলের আকুল আর্দ্র সুগন্ধ মাখানো পৃথিবীটা তাহার সকল সৌন্দর্য রহস্য, বিপুলতা লইয়া ধীরে ধীরে আড়ালে মিলাইয়া চলিয়াছে।
তাহাদের বাড়ির ধার হইতে এ বনজঙ্গল একদিকে সেই কুঠির মাঠ, অপরদিকে নদীর ধার পর্যন্ত একটানা চলিয়াছে। অপুর কাছে। এ বন অফুরন্ত ঠেকে, সে দিদির সঙ্গে কতদূর এ বনের মধ্যে তো বেড়াইয়াছে, বনের শেষ দেখিতে পায় নাই—শুধু এইরকম তিক্তিরাজ গাছের তলা দিয়া পথ, মোটা মোটা গুলঞ্চলতা-দুলানো থোলো থোলো বানচালতার ফল চারিধারে। সুড়ি পথটা একটা আমবাগানে আসিয়া শেষ হয়, আবার এগাছের ও গাছের তলা দিয়া বন-কলমি, নাটা-কঁটা, ময়না-ঝোপের ভিতর দিয়া চলিতে চলিতে কোথায় কোন দিকে লইয়া গিয়া ফেলিতেছে, শুধুই বন-ধুধুলের লতা কোথায় সেই ত্ৰিশূন্যে দোলে, প্রাচীন শিরীষ গাছের শ্যাওলা-ধরা ডালের গায়ে পরগাছার ঝাড় নজরে আনে!
এই বন তার শ্যামলতার নবীন স্পর্শটুকু তার আর তার দিদির মনে বুলাইয়া দিয়াছিল। জম্মিয়া অবধি এই বন তাহদের সুপরিচিত, প্রতি পলের প্রতিমুহূর্তের নীরব আনন্দে তাঁহাদের পিপাসুহৃদয় কত বিচিত্র, কত অপূর্ব রসে ভরিয়া তোলে। বর্ষাসতেজ, ঘন সবুজ ঝোপের মাথায় নাটা-কঁটার সুগন্ধ ফুলের হলুদ রং-এর শিষ, আসন্ন সূর্যাস্তের ছায়ায় মোটা ময়না-কাটা ডালের আগায় কাঠবিড়ালীর লঘুগতি আসাযাওয়া, পত্রপুস্পফলের সে প্রাচুর্য সবাকার অপেক্ষা যখন ঘন বনের প্রাস্তবতী, ঝোপঝাপের সঙ্গীহীন বঁকা ডালে বনের কোনো অজানা পাখি বসিয়া থাকে, তখন তাহার মনের বিচিত্র, অপূর্ব, গভীর আনন্দরসের বর্ণনা সে মুখে বলিয়া কাহাকেও বুঝাইতে পারে না। সে যেন স্বপ্ন, যেন মায়া, চারিপাশ ঘিরিয়া পাখি গান গায়, কুর ঝুরি করিয়া ঝরিয়া ফুল পড়ে, সূর্যাস্তের আলো আরও ঘন ছায়াময় হয়।
এই বনের মধ্যে কোথায় একটা মজা পুরানো পুকুর আছে, তারই পাড়ে যে ভাঙা মন্দিরটা আছে, আজকাল যেমন পঞ্চানন্দ ঠাকুর গ্রামের দেবতা, কোনো সময় ওই মন্দিরের বিশালাক্ষী দেবী সেই রকম ছিলেন। তিনি ছিলেন গ্রামের মজুমদার বংশের প্রতিষ্ঠিত দেবতা, এক সময়ে কি বিষয়ে যে তিনি মন্দির পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন, আর কখনও ফিরিবেন না। অনেক কালের কথা, বিশালাক্ষীর পূজা হইতে দেখিয়াছে এরূপ কোনো লোক আর জীবিত নাই, মন্দির ভাঙিয়া চুরিয়া গিয়াছে, মন্দিরের সম্মুখের পুকুর মজিয়া ডোবায় পরিণত হইয়াছে, চারিধার বনে ছাইয়া ফেলিয়াছে, মজুমদার বংশেও বাতি দিতে আর কেহ নাই।
কেবল-সেও অনেকদিন আগে-গ্রামের স্বরূপ চক্ৰবতী ভিন-গাঁ হইতে নিমন্ত্রণ খাইয়া ফিরিতেছিলেন-সন্ধ্যার সময় নদীর ঘাটে নামিয়া আসিতে পথের ধারে দেখিলেন একটি সুন্দরী ষোড়শী মেয়ে দাঁড়াইয়া। স্থানটি লোকালয় হইতে দূরে, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, পথে কেহ কোথাও নাই, এ সময় নিরালা বনের ধারে একটি অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়েকে দেখিয়া স্বরূপ চক্রবর্তী দস্তুর মতো বিস্মিত হইলেন। কিন্তু তিনি কোনো কথা কহিবার পূর্বেই মেয়েটি ঈষৎ গর্বমিশ্রিত অথচ মিষ্টসুরে বলিল-আমি এ গ্রামের বিশালাক্ষী দেবী। গ্রামে অল্পদিনে ওলাওঠার মড়ক আরম্ভ হবেবলে দিয়ো চতুর্দশীর রাত্রে পঞ্চানন্দতলায় একশ আটটা কুমড়ো বলি দিয়ে যেন কালীপূজা করে। কথা শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গেই স্তম্ভিত স্বরূপ চক্ৰবতীর চোখের সামনে মেয়েটি চারিধারে শীত-সন্ধ্যার কুয়াশায় ধীরে ধীরে যেন মিলাইয়া গেল। এই ঘটনার দিন কয়েক পরে সত্যই সেবার গ্রামে ভয়ানক মড়ক দেখা দিয়াছিল।
এ সব গল্প কতবার শুনিয়াছে। জানালার ধারে দাঁড়াইলেই বিশালাক্ষী ঠাকুরের কথা তাহার মনে ওঠে। দেবী বিশালাক্ষীকে একটিবার দেখিতে পাওয়া যায় না? হঠাৎ সে বনের পথে হয়তো গুলঞ্চের লতা পাড়িতেছে–সেই সময়–
খুব সুন্দর দেখিতে, রাঙাপাড় শাড়ি পরনে, হাতে গলায় মা-দুর্গার মতো হার বালা।
–তুমি কে?
-আমি অপু।
–তুমি বড় ভালো ছেলে, কি বর চাও?
সে বিছানায় গিয়া শোয়। এক একবার বিরবিরে হাওয়ায় কত কি লতাপাতার তিক্তমধুর গন্ধ ভাসিয়া আসে, ঠিক দুপুরবেলা, অনেক দূরের কোনো বড় গাছের মাথার উপর হইতে গাঙচিল টানিয়া টানিয়া ডাকে, যেন এই ছোট্ট গ্রামখানির অতীত ও বর্তমান সমস্ত ছোটখাটো দুঃখ শাস্তি দ্বন্দ্বের উর্ধে, শরৎ-মধ্যাহ্নের রৌদ্রভরা, নীল নির্জন আকাশ-পথে, এক উদাস, গৃহবিবাগী পথিকদেবতার সুকণ্ঠের অবদান দূর হইতে দূরে মিলাইয়া চলিয়াছে।
কখন সে ঘুমাইয়া পড়ে বুঝিতে পারে না, ঘুমাইয়া উঠিয়া দেখে বেলা একেবারে নাই। জানালার বাহিরে সারা বনটায় ছায়া পড়িয়া আসিয়াছে, বাঁশঝাড়ের আগায় রাঙা রোদ।
প্রতিদিন এই সময়-ঠিক এই ছায়া-ভরা বৈকালটিতে, নির্জন বনের দিকে চাহিয়া তাহার অতি অদ্ভুত কথা সব মনে হয়। অপূর্ব খুশিতে মন ভরিয়া ওঠে, মনে হয় এ রকম লতাপাতার মধুর গন্ধভরা দিনগুলি ইহার আগে কবে একবার যেন আসিয়াছিল, সে সব দিনের অনুভূত আনন্দের অস্পষ্ট স্মৃতি আসিয়া এই দিনগুলিকে ভবিষ্যতের কোন অনির্দিষ্ট আনন্দের আশায় ভরিয়া তোলে। মনে হয় একটা যেন কিছু ঘটিবে, এ দিনগুলি বুঝি বৃথা যাইবে না—একটা বড় কোনো আনন্দ ইহাদের শেষে অপেক্ষা করিয়া আছে যেন!
এই অপরাহুগুলির সঙ্গে আজন্মসাখী সুপরিচিত এই আনন্দভরা বহুরূপী বনটার সঙ্গে কত রহস্যময়, স্বপ্ন-দেশের বার্তা যে জড়ানো আছে! বাঁশঝাড়ের উপরকার ছায়া-ভরা আকাশটার দিকে চাহিয়া সে দেখিতে পায়, এক তরুণ বীরের উদারতার সুযোগ পাইয়া কে প্রাথী একজন তাহার অক্ষয় কবচ-কুণ্ডল মাগিয়া লইতে হাত পাতিয়াছে, পিটুলি-গোলা পান করিয়া কোথাকার এক ক্ষুদ্র দরিদ্র বালক খেলুড়েদের কাছে দুধ খেয়েছি, দুধ খেয়েছি বলিয়া উল্লাসে নৃত্য করে-ওই যে গ্লোড়ো ভিটার বেলতলাটা-ওইখানেই তো শরশয্যাশায়িত প্ৰবীণ বীর ভীষ্মদেবের মরণাহত ওষ্ঠে তীক্ষ্ণবাণে পৃথিবী ফুড়িয়া অৰ্জ্জুন ভোগবতীধারা সিঞ্চন করিয়াছিলেন। প্রথম যৌবনে সরযুতািটর কুসুমিত কাননে মৃগয়া করিতে গিয়া রাজা দশরথ মৃগভ্ৰমে যে জল আহরণগত দরিদ্র বালককে বধ করেন-সে ঘটিয়াছিল ওই রানুদিদিদের বাগানের বড় জাম গাছটার তলায় যে ডোবা-তাহারই ধারে।
তাহাদের বাড়ি একখানা বই আছে, পাতাগুলো সব হলদে, মলাটটার খানিকটা নাই, নাম লেখা আছে ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, কিন্তু লেখকের নাম জানে না, গোড়ার দিকের পাতাগুলি ছিঁড়িয়া গিয়াছে। বইখানা বড় ভালো লাগে।–তাহাতে সে পড়িয়াছে–
অদূরে দেখিানু হ্রদ, সে হ্রদের তীরে
রাজরথী একজন যান গড়াগড়ি
ভগ্নঊরু! দেখি উচ্চে উঠিনু কাঁদিয়া
এ কি কুস্বপন নাথ দেখাইলা মোরে!
কলুইচণ্ডী ব্ৰতের দিন মায়ের সঙ্গে গ্রামে উত্তর মাঠে যে পুরানো মজা পুকুরের ধারে সে বনভোজন করিতে যায়-কেউ জানে না-চারিধারে বনে ঘেরা সেই ছোট্ট পুকুরটাই মহাভারতের সেই দ্বৈপায়ন হ্রদ। ওই নির্জন মাঠের পুকুরটার মধ্যে সে ভগ্নউবু, অবমানিত বীর থাকে একা একা, কেউ দেখে না, কেউ খোঁজ করে না। উত্তর মাঠের কলাবেগুনের ক্ষেত হইতে কৃষাণেরা ফিরিয়া আসে, জনমানুষের চিহ্ন থাকে না কোনো দিকে-সোনাডাঙা মাঠের পারের অনাবিষ্কৃত, বসতিশূন্য, অজানা দেশে চন্দ্ৰহীন রাত্রির ঘন অন্ধকার ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে, তখন হাজার হাজার বছরের পুরাতন মানব-বেদনা কখনও বা দরিদ্র পিতার প্রবঞ্চনা-মুগ্ধ অবোধ বালকের উল্লাসে, কখনও বা এক ভাগ্যহত, নিঃসঙ্গ অসহায় রাজপুত্রের ছবিতে তাহার প্রবর্ধমান, উৎসুক মনের সহানুভূতিতে জাগ্রত ও সার্থক হয়। ওই অজ্ঞাতনামা লেখকের বইখানা পড়িতে পড়িতে কতদিন যে তাহার চোখের পাতা ভিজিয়া আসিয়াছে!
তাহার বাবা বাড়ি নাই। বাড়ি থাকিলে তাহাকে এক মনে ঘরে বসিয়া দপ্তর খুলিয়া পড়িতে হয়। একেবারে বেলা শেষ হইয়া যায়। তবুও ছুটি হয় না। তাহার মন ব্যাকুল হইয়া ওঠে। আর কতক্ষণ বসিয়া বসিয়া শুভঙ্করীর আর্য মুখস্থ করিবে? আজ আর বুঝি সে খেলা করিবে না? বেলা বুঝি আর আছে? বাবার উপর ভারি রাগ হয়, অভিমান হয়।
হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে ছুটি হইয়া যায়। বইদপ্তর কোনোরকমে ঝুপ করিয়া এক জায়গায় ফেলিয়া রাখিয়া ছায়াভরা উঠানে গিয়া খুশিতে সে নাচিতে থাকে।
অপূর্ব অদ্ভুত বৈকাল ট্রা.নিবিড় ছায়ােভরা গাছপালার ধারে খেলাঘর.গুলঞ্চলতার তার টাঙানো… খেজুর ডালের বাঁপ…বনের দিক থেকে ঠাণ্ড ঠাণ্ডা গন্ধ বাহির হয়.রাঙা রোদটুকু জেঠমহাশয়দের পোড়ো ভিটায় বাতাবিলেবু গাছের মাথায় চিক্ চিক করে…চকচকে বাদামী রঙ-এর ডানাওয়ালা তেড়ো পাখি বনকলামি ঝোপে উড়িয়া আসিয়া বসে…তাজা মাটির গন্ধ…ছেলেমানুষের জগৎ ভরপুর আনন্দে উছলিয়া ওঠে, কাহাকে সে কি করিয়া বুঝাইবে সে কি আনন্দ!
সন্ধ্যার পর সর্বজয়া ভাত চড়াইয়াছিল। অপু দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বসিয়া আছে। খুব অন্ধকার, একটানা বিবি পোকা ডাকিতেছে।
অপু জিজ্ঞাসা করিল-পুজোর আর কদিন আছে, মা?
দুৰ্গা বঁটি পাতিয়া তরকারি কাটিতেছিল। বলিল, আর বাইশ দিন আছে, না মা?
সে হিসাব ঠিক করিয়াছে। তাহার বাবা বাড়ি আসিবে, অপুর, মায়ের, তাহার জন্য পুতুল, কাপড়, আলতা।
আজকাল সে বড় হইয়াছে বলিয়া তাহার মা অন্য পাড়ায় গিয়া নিমন্ত্রণ খাইতে দেয় না। লুচি খাইতে কেমন তাহা সে প্রায় ভুলিয়া গিয়াছে। ফুটুফুটে কোজাগরী পূর্ণিমার জ্যোৎস্না-ভরা রাত্রে বাঁশবনের আলোছায়ায় জাল-বুনানি পথ বাহিয়া সে আগে আগে পাড়ায় পাড়ায় বেড়াইয়া লক্ষ্মীপূজার খই-মুড়ি ভাজা আঁচল ভরিয়া লইয়া আসিত। বাড়িতে বাড়িতে শাঁখ বাজে, পথে লুচিভাজার গন্ধ বাহির হয়, হয়তো পাড়ার কেউ পূজার শীতলের নৈবেদ্য একখানা তাহাদের বাড়িতে পাঠাইয়া দেয়। সেও অনেক খই-মুড়ি আনিত, তাহার মা দুইদিন ধরিয়া তাহাদের জলপান খাইতে দিত, নিজেও খাইত। সেবার সেজ ঠাকরুন বলিয়াছিল-ভদ্র লোকের মেয়ে আবার চাষা লোকের মতো বাড়ি-বাড়ি ঘুরে খই-মুড়ি নিয়ে বেড়াবে কি? ওসব দেখতে খারাপ.ওরকম আর পাঠিয়ে না। বৌমা-সেই হইতে সে আর যায় না।
দুৰ্গা বলিল-তাস খেলবে?
–তা। যা, ও ঘর থেকে তাসটা নিয়ে আয়, একটু খেলি—
দুৰ্গা বিপন্নমুখে অপুর দিকে চাহিল।
অপু হাসিয়া বলিল-চল আমি দাঁড়াচ্চি—
তাহাদের মা বলিল-আহ্যাঁ-হা, মেয়ের ভয় দেখে আর বাঁচিনে, সারাদিন বলে হেঁটি-মাটি ওপর করে বেড়াবার সময় ভয় থাকে না, আর রাত্ৰিতে এঘর থেকে ওঘর যেতে একেবারে সব আড়ষ্ট;…
শিষ্যবাড়ি হইতে অপুর আনা সেই তাসজোড়াটা। তাস খেলায় তিনজনেরই কৃতিত্ব সমান। অপু এখনও সব রং চেনে না-মাঝে মাঝে হাতের তাস বিপক্ষদলের খেলোয়াড় মাকে দেখাইয়া বলে, এটা কি রং, বুইতন? দ্যাখো না মা–
দুর্গার মন আজ খুব খুশি আছে। রাত্রিতে রান্না প্রায়ই হয় না, ওবেলার বাসি ভাত তবকারি থাকে। আজ ভাত চড়িয়াছে, তরকারি রান্না হইবে, ইহাতে তাহার মহা আনন্দ। আজ যেন একটা উৎসবের দিন। অপু বলিল-তাস খেলতে খেলতে সেই গল্পটা বলে না। মা, সেই শ্যামলঙ্কার গল্পটা?
হঠাৎ সে মায়ের কোলে মাথা রাখিয়া শূইয়া পড়ে। মায়ের গায়ে হাত বুলাইতে বুলাইতে আবদারের সুরে বলে—সেই ছড়াটা বলে না। মা, সেই–শ্যামলঙ্কা বাটনা বাটে মাটিতে লুটায় কেশ।
দুৰ্গা বলে-খেলার সময় ছড়া বললে খেলা কি করে হবে অপু? ওঠ—
সর্বজয়া বলিল-দুগগা, পাতালকোঁড় আজ কোথায় পেলি রে? –সেই যে গোঁসাইদের বড় বাগানটা আছে? সেই রাষ্ট্ৰী গাই খুঁজতে একবার তুই আবি আমি, অপু? সেখানে অনেক ফুটেছিল, কেউ টের পায়নি, মা, খুব বন কি না? তা হলে লোকে তুলে নিয়ে যেত–
অপু বলিল-সেখানে গিইছিলি? উঃ, সে যে বড় বন রে দিদি! ‘
সর্বজয়া সস্নেহে বার বার ছেলের দিকে চাহিয়া দেখিতেছিল। সেদিনকার সেই অপু -আয় চাঁদ আয় চাদ, খোকনের কপালে টি-ই-ই-ই দিয়ে যা—বলিলে বার বার কলের পুতুলের মতো চাদের মতো কপালখনি অঙ্গুলিবদ্ধ হস্তের দিকে ঝুকাইয়া দিত, সে কি না। আজ তাস খেলিতে বসিয়াছে! তাহার কাছে দৃশ্যটা বড় অভিনব ঠেকে। অপু খেলিতে না পারিলে বা আশা করিয়া কোনো পিটু জিতিতে না পারিলে কিংবা অপুর হাতে খারাপ তাসগুলো গিয়া নিজের হাতে ভালো তাস আসিলে, বিপক্ষদলের খেলোয়াড় হইয়াও তাহার মনে কষ্ট হইতেছিল।
দুৰ্গা বলিল-আজ কি হয়েছে জানো মা—
অপু বলিল-যাঃ, তা হলে তোর সঙ্গে আড়ি করবো, বলে দ্যাখ-
–করগে যা আড়ি-শোনো মা, ও পোস্তদানার নাম জানে না, আজ রাজীদের বাড়ি পোস্তদানা রদুরে দিয়েচে, ও বল্পে, কি রাজীদি? রাজী বল্পে, যষ্টিমধু, খেয়ে দ্যাখ-ও খেয়ে এলো মা সেখানে দাঁড়িয়ে, বুঝতে পাল্পে না যে পোস্ত-এমন বোকা-না মা?
অপু মুখে বলিল বটে কিন্তু দিদির সহিত সে আড়ি করিবে না। সেই যে যেদিন তাহাঙ্ক পাকা মাকাল ফলগুলো সত্যুদা লইয়া পলাইয়াছিল, সেদিন তাহার দিদি সারাদিন বন বাগান খুঁজিয়া সন্ধ্যার সময় কোথা হইতে আঁচলে। বাঁধিয়া একরাশ মাকাল ফল আনিয়া তাহার সম্মুখে খুলিয়া দেখাইয়া বলিয়াছিল–কেমন হল এখন? বড় যে কাঁদছিলি সকালবেলা? সে সন্ধ্যায় কিসে সে বেশি আনন্দ পাইয়াছিল—মাকাল ফলগুলো হইতে কি দিদির মুখের, বিশেষ করিয়া তাহার ডাগর চোখের মমতা ভরা স্নিগ্ধ হাসি হইতে-তাহা সে জানে না।
-ছক্কার খেলা অপু বুঝে সুজে খেলিস?-দুর্গা মহাখুশির সহিত তাস কুড়াইয়া সাজাইতে লাগিল।
–কি ফুলের গন্ধ বেরুচ্চে, না দিদি?
তাহাদের মা বলিল, তাহদের জেঠামশায়দের ভিটার পিছনে ছাতিমগাছ আছে, সেই ফুলের গন্ধ। অপু ও দুর্গা দুজনেই আগ্রহের সুরে জিজ্ঞাসা করিল-হ্যাঁ মা, ওই ছাতিমতলায় একবার বাঘ এসেছিল বলেছিলে না? কিন্তু তাহার মা তাড়াতাড়ি তাস ফেলিয়া উঠিয়া বলিল-ওই যাঃ ভাত পুড়ে গেল, ধরাগন্ধ বেরিয়েছে-ভাতটা নামিয়ে দাঁড়া বলচি– খাইতে বসিয়া দুৰ্গা বলিল-পাতালকোঁড়ের তরকারিটা কি সুন্দর খেতে হয়েচে মা!
তাহার মুখ স্বগীয় তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিল।
সঙ্গে সঙ্গে অপুও বলিল-বাঃ খেতে ঠিক মাংসের মতো, না দিদি? পাতালকোঁড় এক জায়গায় কত ফুটে আছে মা, আমি ভাবি ব্যাঙের ছাতা, তাই তুলি নে—
উভয়ের উচ্ছসিত প্রশংসা-বাক্যে সর্বজয়ার বুক গর্বে ও তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিল। তবুও কি আর উপযুক্ত উপকরণ সে পাইয়াছে? লোকের বাড়িতে ভোজে রাঁধিতে ডাকে সেজঠাকরুনকে, ডাকুক না দেখি একবার তাহাকে, রান্না কাহাকে বলে সেজঠাকরুনকে সে-হ্যাঁ।
সর্বজয়া বলিল-অপুর হাতে জল ঢেলে দে দুগগা, ও কি ছেলেব কাণ্ড? ওই রাস্তার মাঝখানে মুখ ধোয়? রোজই রাত্ৰে তুমি ওই পথের উপর–
কিন্তু অপু আর এক পাও নড়িতে চাহে না, সম্মুখের সেই ভাঙা পাচিলের ফাক, অন্ধকার বাঁশবন, ঝোপ-জঙ্গলের অন্ধকার ঝিঙের বিচির মতো কালো। পোড়ো ভিটেবাড়ি…আরও অজানা কত কি বিভীষিকা! সে বুঝিতে পারে না যেখানে প্ৰাণ লইয়া টানাটানি সেখানে পথের উপর আঁচানোটাই কি এত বেশি; তাহার পরে সকলে গিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। রাত্রি গভীর হয়, ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাসে হেমন্তের আঁচ-লাগা শিশিরাদ্র নৈশ বায়ু ভরিয়া যায়। মধ্যরাত্রে বেণুবনশীর্ষে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের স্নান জ্যোৎস্না উঠিয়া শিশিরসিক্ত গাছপালায়, ডালে-পাতায় চিকচিক্ করে। আলো-আঁধারের অপরূপ মায়ায় বনপ্রাস্ত ঘুমন্ত পরীর দেশের মতো। রহস্য-ভরা। শন শন করিয়া হঠাৎ হয়তো এক ঝলক হাওয়া সৌদালির ডাল দুলাইয়া, তেলাকুচা ঝোপের মাথা কঁপাইয়া বহিয়া যায়।
এক-একদিন এই সময়ে অপুর ঘুম ভাঙিয়া যাইত।
সেই দেবী যেন আসিয়াছেন, সেই গ্রামের বিস্মৃত অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিশালাক্ষী।
পুলিনশালিনী ইছামতীর ডালিমের রোয়ার মতো স্বচ্ছ জলের ধারে, কুচা শ্যাওলা ভরা। ঠাণ্ডা কাদায় কতদিন আগে যাহাদের চরণ-চিহ্ন লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, তীরের প্রাচীন সপ্তপর্ণটাও হয়তো যাদের দেখে নাই, পুরানো কালের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর মন্দিরে তারাই এক সময়ে ফুল-ফল-নৈবেদ্যে পূজা দিত, আজকালকার লোকেরা কে তাঁহাকে জানে?
তিনি কিন্তু এ গ্রামকে এখনও ভোলেন নাই।
গ্রাম নিযুতি হইয়া গেলে অনেক রাত্রে, তিনি বনে বনে ফুল ফুটাইয়া বেড়ান, বিহঙ্গ-শিশুদের দেখাশুনা করেন, জ্যোৎস্না-রাত্রের শেষ প্রহরে ছোট্ট ছোট্ট মৌমাছিদের চাকগুলি বুনো-ভাওরা, নাটুকান, পুয়ো ফুলের মিষ্ট মধুতে ভরাইয়া দেন।
তিনি জানেন কোন ঝোপের কোণে বাসক ফুলের মাথা লুকাইয়া আছে, নিভৃত বনের মধ্যে ছাতিম ফুলের দল কোথায় গাছের ছায়ায় শূইয়া,ইছামতীর কোন বাঁকে সবুজ শ্যাওলার ফাঁকে ফাঁকে নীল-পাপড়ি কলমিফুলের দল ভিড় পাকাইয়া তুলিতেছে, কঁটা গাছের ডালপালার মধ্যে ছোট্ট খড়ের বাসায় টুনটুনি পাখির ছেলেমেয়েরা কোথায় ঘুম ভাঙিয়া উঠিল।
তার রূপের স্নিগ্ধ আলোয় বন যেন ভরিয়া গিয়াছে। নীরবতায়, জ্যোৎস্নায়, সুগন্ধে, অস্পষ্ট আলো-আঁধারের মায়ায় রাত্রির অপরূপ শ্ৰী।
দিনের আলো ফুটিবার আগেই কিন্তু বনলক্ষ্মী কোথায় মিলাইয়া যান, স্বরূপ চক্ৰবতীর পর তাহাকে কেহ কোনোদিন দেখে নাই।