পথের পাঁচালী by বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, chapter name ঊনবিংশ

ঊনবিংশ

 

অপু কাউকে একথা এখনও বলে নাই।–তাহার দিদিকেও না।


 

সেদিন চুপি চুপি দুপুরে সে যখন তাহার বাবার ওই বই-বোঝাই কাঠের সিন্দুকটা লুকাইয়া খুলিয়াছিল, সিন্দুকটার মধ্যে একখানা বই-এর মধ্যেই এই অদ্ভুত কথাটার সন্ধান পাইয়াছে!


 

উঠানের উপর বাঁশঝাড়ের ছায়া তখন পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ হয় নাই, ঠিক-দুপুরে সোনাডাঙার তেপান্তর মাঠের সেই প্রাচীন অশ্বখ গাছের ছায়ার মতো এক জায়গায় একরাশ ছায়া জমাট বাধিয়া ছিল।


 

একদিন সে দুপুরবেলা বাপের অনুপস্থিতিতে ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া চুপি চুপি বই-এর বাক্সটা লুকাইয়া খুলিল। অধীর আগ্রহের সহিত সে এ-বই ও-বই খুলিয়া খানিকটা করিয়া ছবি দেখিতে এবং খানিকটা করিয়া বই-এর মধ্যে ভালো গল্প লেখা আছে কি না দেখিতে লাগিল। একখানা বই-এর মলাট খুলিয়া দেখিল নাম লেখা আছে সর্ব-দৰ্শন-সংগ্ৰহ। ইহার অর্থ কি, বইখানা কোন বিষয়ের তাহা সে বিন্দুবিসর্গও বুঝিল না। বইখানা খুলিতেই একদল কাগজ-কাটা পোকা নিঃশব্দে বিবৰ্ণ মার্বেল কাগজের নিচে হইতে বাহির হইয়া উধৰ্বশ্বাসে যেদিকে দুই চোখ যায় দৌড় দিল। অপু বইখানা নাকের কাছে লইয়া গিয়া ঘ্ৰাণ হইল, কেমন পুরানো গন্ধ! মেটে রঙের পুরু পুরু পাতাগুলোর এই গন্ধটা তাহার বড় ভালো লাগে-গন্ধটায় কেবলই বাবার কথা মনে করাইয়া দেয়। যখনই এ গন্ধ সে পায় তখনই কি জানি কেন তাহার বাবার কথা মনে পড়ে।


 

অত্যন্ত পুরানো মার্বেল কাগজের বাধাই করা মলাটের নানাস্থানে চটা উঠিয়া গিয়াছে। এই পুরানো বই-এর উপরই তাহার প্রধান মোহ। সেজন্য সে বইখানা বালিশের তলায় লুকাইয়া রাখিয়া অন্যান্য বই তুলিয়া বাক্স বন্ধ করিয়া দিল।


 

লুকাইয়া পড়িতে পড়িতে এই বইখানিতেই একদিন সে পড়িল বড় অদ্ভুত কথোটা! হঠাৎ শুনিলে মানুষ আশ্চর্য হইয়া যায় বোট-কিন্তু ছাপার অক্ষরে বইখানার মধ্যে এ কথা লেখা আছে, সে পড়িয়া দেখিল। পারদের গুণ বৰ্ণনা করিতে করিতে লেখক লিখিয়াছেন-শকুনির ডিমের মধ্যে পারদ পুরিয়া কয়েকদিন রৌদ্রে রাখিতে হয়, পরে সেই ডিম মুখের ভিতর পুরিয়া মানুষ ইচ্ছা করিলে শূন্যমার্গে বিচরণ করিবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়।


 

অপু নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিল না,-আবার পড়িল-আবার পড়িল।


 

পরে নিজের ডালাভাঙা বাক্সটার মধ্যে বইখানা লুকাইয়া রাখিয়া বাহিরে গিয়া কথাটা ভাবিতে ভাবিতে সে অবাক হইয়া গেল।


 

দিদিকে জিজ্ঞাসা করে-শকুনিরা বাসা বঁধে কোথায় জানিস দিদি?


 

তাহার দিদি বলিতে পারে না। সে পাড়ার ছেলেদের-সতু, নীলু, কিন্নু, পটল, নেড়াসকলকে জিজ্ঞাসা করে। কেউ বলে সে এখানে নয়; উত্তর মাঠে উঁচু গাছের মাথায়। তাহার মা বকে—এই দুপুরবেলা কোথায় ঘুরে বেড়াস! অপু ঘরে ঢুকিয়া শুইবার ভান করে, বইখানা খুলিয়া সেই জায়গাটা আবার পড়িয়া দেখে-আশ্চর্য! এত সহজে উড়িবার উপায়টা কেউ জানে না? হয়তো এই বইখানা আর কাহারও বাড়ি নাই, শুধু তাহার বাবারই আছে; হয়তো এই জায়গাটা আর কেহ পড়িয়া দেখে নাই, শুধু তাহারই চোখে পড়িয়াছে এতদিনে।


 

বইখানার মধ্যে মুখ গুজিয়া আবার সে আঘাণ লয়-সেই পুরানো পুরানো গন্ধটা! এই বইয়ে যাহা লেখা আছে, তাহার সত্যতা সম্বন্ধে তাহার মনে আর কোন অবিশ্বাস থাকে না।


 

পারদের জন্য ভাবনা নাই-পারদ মানে পারা সে জানে। আয়নার পেছনে পারা মাখানো থাকে, একখানা ভাঙা আয়না বাড়িতে আছে, উহা জোগাড় করিতে পরিবে এখন। কিন্তু শকুনির ডিম এখন সে কোথায় পায়?


 

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে এক একদিন তাহার দিদি ডাকে-আয় শোন অপু, মজা দেখবি আয়। পরে সে একমুঠো পাতের ভাত লইয়া বাড়ির খিড়কি-দোরের বাঁশবাগানে গিয়া হ্যাঁক দেয়আয় ভুলো-তু-উ-উ-উ। ডাক দিয়াই দুৰ্গা ভাইয়ের দিকে হাসি হাসি মুখে চুপ করিযী চাহিয়া থাকে, যেন কি অপূর্ব রহস্যপুরীর দুয়ার এখনই তাঁহাদের চোখের সামনে খুলিয়া যায়! হঠাৎ কোথা হইতে কুকুরটা আসিয়া পড়িতেই দুৰ্গা হাত তুলিয়া বলিয়া উঠে-ওই এসেচে! কেথেকে এলো দেখলি?– খুশিতে সে হিহি। করিয়া হাসে।


 

রোজ রোজ এই কুকুরকে ভাত খাওয়ানোর ব্যাপারে দুর্গার আমোদ হয় ভারি।–তুমি হ্যাঁক দেও, কেউ কোথাও নাই, চারিদিকে চুপ! ভাত মাটিতে নামাইয়া দুৰ্গা চোখ বুজিয়া থাকে, আশা ও কৌতুহলের ব্যাকুলতায় বুকের মধ্যে টিপ চিপ করে; মনে মনে ভাবে-আজ ভুলো আসবে না বোধ হয়, দেখি দিকি কোথেকে আসে। আজ কি আর শুনতে পেয়েছে।–


 

হঠাৎ ঘন ঝোপে একটা শব্দ ওঠে—


 

চক্ষের নিমেষে বনজঙ্গলের লতাপাতা ছিঁড়িয়া খুঁড়িয়া হ্যাঁপাইতে হ্যাঁপাইতে ভুলো কোথা হইতে নক্ষত্ৰবেগে আসিয়া হাজির।


 

অমনি দুর্গার সমস্ত গা দিয়া একটা কিসের স্রোত বহিয়া যায়। বিস্ময় ও কৌতুকে তাহার মুখচোখ উজ্জ্বল দেখায়! মনে মনে ভাবে-ঠিক শুনতে পায় তো, আসে কোখোকে!! আচ্ছা কাল একটু চুপি চুপি ডেকে দেখবো দিকি, তাও শুনতে পাবে?


 

এই আমোদ উপভোগ করিতে সে মায়ের বকুনি সহ্য করিয়াও রোজ খাইবার সময় নিজে বরং কিছু কম খাইয়া কুকুরের জন্য কিছু ভাত পাতে সঞ্চয় করিয়া রাখে।


 

অপু কিন্তু দিদির কুকুর ডাকিবার মধ্যে কি আমোদ আছে তাহা খুঁজিয়া পায় না। দিদির ওসব মেয়েলি ব্যাপারের মধ্যে সে নাই। অধীর আগ্রহে ভোজনরত শীর্ণ কুকুরটার দিকে সে চাহিয়াও দেখে না, শুধু শকুনির ডিমের কথা ভাবে।


 

অবশেষে সন্ধান মিলিল। হীরু নাপিতের কাঁঠালতলায় রাখালেরা গরু বাঁধিয়া গৃহস্থের বাড়িতে তেল-তামাক আনিতে যায়। অপু গিয়া তাহদের পাড়ার রাখালকে বলিল-তোরা কত মাঠে মাঠে বেড়াস, শকুনির বাসা দেখতে পাস? আমায় যদি একটা শকুনির ডিম এনে দিস আমি দুটো পয়সা দেবো।


 

দিন-চারেক পরেই রাখাল তাহাদের বাড়ির সামনে আসিয়া তাহাকে ডাকিয়া কোমরের থলি হইতে দুইটা কালো রং-এর ছোট ছোট ডিম বাহির করিয়া বলিল-এই দ্যাখো ঠাকুর এনিচি।


 

অপু তাড়াতাড়ি হাত বাড়াইয়া বলিল-দেখি। পরে আহ্বাদের সহিত উলটাইতে-পালটাইতে বলিল-শকুনির ডিম! ঠিক তো?


 

রাখাল সে সম্বন্ধে ভুরি ভুরি প্রমাণ উত্থাপিত করিল। ইহা শকুনির ডিম কিনা। এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো কারণ নাই, সে নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া কোথাকার কোন উঁচু গাছের মগড়াল হইতে ইহা সংগ্ৰহ করিয়া আনিয়াছো-কিন্তু দুই আনার কমে দিবে না।


 

পারিশ্রমিক শুনিয়া অপু অন্ধকার দেখিল। বলিল, দুটো পয়সা দেবো, আর আমার কড়িগুলো নিবি? সব দিয়ে দেবো, এক টিনের ঠোঙা কড়ি-—সব। এই এত বড় বড় সোনাগোটে-দেখবি, দেখাবো?


 

রাখালকে সাংসারিক বিষয়ে অপুর অপেক্ষা অনেক কুঁশিয়ার বলিয়া মনে হইল। সে নগদ পয়সা ছাড়া কোনো রকমেই রাজি হয় না। অনেক দরদস্তুরের পর আসিয়া চার পয়সায় দাঁড়াইল। অপু দিদির কাছে চাহিয়া চিন্তিয়া দুটা পয়সা জোগাড় করিয়া তাহাকে চুকাইয়া দিয়া ডিম দুটি লইল। তাহা ছাড়া রাখাল কিছু কড়িও লইল। এই কড়িগুলা অপুর প্রাণ, অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যার বিনিময়েও সে এই কড়ি কখনও হাতছাড়া করিত না অন্য সময়; কিন্তু আকাশে উড়িবার আমোদের কাছে কি আর বেগুন-বীচি খেলা!


 

ডিমটা হাতে করিয়া তাহার মনটা যেন ফু-দেওয়া রবারের বেলুনের মতো হালকা হইয়া ফুলিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা সন্দেহের ছায়া তাহার মনে আসিয়া পৌঁছিল, এটুকু এতক্ষণ ছিল না, ডিম হাতে পাওয়ার পর হইতে যেন কোথা হইতে ওটুকু দেখা দিল খুব অস্পষ্ট। সন্ধ্যার আগে আপনমনে নেড়াদের জামগাছের কাটা গুড়ির উপর বসিয়া সে ভাবিতে লাগিল, সত্যি সত্যি উড়া যাইবে তো! সে উড়িয়া কোথায় যাইবে? মামার বাড়ির দেশে? বাবা যেখানে আছে সেখানে? নদীর ওপারে? শালিখা পাখি ময়না পাখির মতো ওই আকাশের গায়ে তারাটা যেখানে উঠিয়াছে?


 

সেই দিনই, কি তাহার পরদিন। সন্ধ্যার একটু আগে দুৰ্গা সলিতার জন্য ছেড়া নেকড়া খুঁজিতেছিল। তাকের হ্যাঁড়ি-কলসির পাশে গোঁজা সলিতা পাকাইবার ছোড়া-খোড়া কাপড়ের টুকরার তাল হাতড়াইতে হাতড়াইতে কি যেন ঠিক করিয়া তাহার পিছন হইতে গড়াইয়া মেজের উপর পড়িয়া গেল। ঘরের ভিতর অন্ধকার, ভালো দেখা যায় না, দুৰ্গা মেজে হইতে উঠাইয়া লইয়া বাইরে আসিয়া বলিল-ওমা কিসের দুটো বড় বড় ডিম এখানে। এঃ, পড়ে একেবারে গুড়ো হয়ে গিয়েচে– দেখেচো কি পাখি ডিম পেড়েচে ঘরের মধ্যে মা!


 

তাহার পর কি ঘটিল, সে কথা না তোলাই ভালো। অপু সেদিন রাত্ৰে খাইল না… কান্না..হৈ হৈ কাণ্ড। তাহার মা ঘাটে গল্প করে—ছেলেটার যে কি কাণ্ড, ওমা এমন কথা তো কখনও শুনি নি-শূনেচে সেজ ঠাকুরঝি, শকুনির ডিম নিয়ে নাকি মানুষে উড়তে পারে-ওই ওদের বাড়ির রাখাল ছোড়াটা, বদমায়েশের ধাড়ি। তাকে বুঝি বলেচে, সে কেথেকে দুটো ক্যাগের না কিসের ডিম এনে বলেচে,–এই নেও শকুনির ডিম। তাই নাকি, আবার চার পয়সা দিয়ে কিনোচে তার কাছে। ছেলেটা যে কি বোকা সে আর তোমার কাছে কি বলবো। সেজ ঠাকুরবি-কি করি যে এ ছেলে নিয়ে আমি!


 

কিন্তু বেচারি সর্বজয়া কি করিয়া জানিবে, সকলেই তো কিছু ‘সর্ব-দৰ্শন-সংগ্ৰহ পড়ে নাই, বা সকলেই কিছু পারদের গুণও জানে না।


 

আকাশে তাহা হইলে তো সকলেই উড়িত!