শিকার Shikar by রত্না চক্রবর্তী Ratna Chakraborty , chapter name শিকার

শিকার

অগ্নিদা কোলকাতায় এসেই জ্বরে পড়বে তা সিঁথি আর ময়ূখ কেউই ভাবে নি।  তা এবার প্রায় একবছর পর এল অগ্নিদা। অগ্নিদা ওদের হিরো, কত আশা ছিল কত জায়গায় ঘুরবে বেড়াবে, অগ্নিদার কাছে দারুণ দারুণ গল্প শুনবে জঙ্গলের,  তা কিছুই হল না ভাইরাল ফিবারের জ্বালায়। দুদিন তো এত জ্বর কথাই বলতে পারেনি।  কিন্তু ওরা রোজ এসেছে, অগ্নিদার কাকীমা ঢুকতে দেয় নি অগ্নিদার ঘরে, বলেছেন " এই জ্বরটা খুব ছোঁয়াচে জানিস দরকার নেই এখন ঢুকে। " কাল থেকে জ্বরটা কমেছে কিন্তু ভিষন দুর্বল, বাইরে যাবার প্রশ্নই নেই। অতএব ঘরে বসেই চলবে গল্প, ক্যারাম, তাস আর দাবা, সিঁথি ও অগ্নির মত দারুণ দাবা খেলে,ময়ূখ ক্যারাম। সিঁথি আজ অগ্নিকে হারাতে পারল।

বোঝাই যাচ্ছে অগ্নিদা এখনো বেশ কাহিল আছে। আর একদান খেলার বদলে কোল বালিশটা টেনে নিয়ে কাত হয়ে শুলো। মুখে রুচি নেই বলে কাকীমা আলুমরিচ করে নিয়ে এলেন। অগ্নিদা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরী করে। প্রতিবারই জঙ্গলের নানা ইন্টারেস্টিং ইন্টারেস্টিং গল্প বলে। ময়ূখ বলল " অগ্নিদা তুমি কখন বাঘ বা ভাল্লুককে চোখের সামনে শিকার করতে দেখেছ যেমন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিততে দেখায়, সিংহ জেব্রা শিকার করছে, চিতা হরিণ ধরল, ওই রকম আর কি? "

সিঁথিও উৎসাহী হয়ে বলল " যে কোন শিকার ধরছে এমন ঘটনা, ভয়ানক তো বটেই, তুমি দেখছ?  বলনা! "

অগ্নিদা একটু চুপ করে থেকে বলল " ভয়ানক... মারাত্মক ভয়ানক, আশ্চ...র্য,এটা নভেম্বরের শেষ না?  হ্যাঁ আজ তো  শনিবার!  ঠিক আজকেই মনে হল! "

 ওরা খুব কৌতুহলী হয়ে উঠল, অগ্নিদার চোখ মুখ কেমন অদ্ভুত হয়ে উঠেছে,  এমনটা কখনও দেখেনি। ওরা অগ্নিদার কাছে আরো ঘন হয়ে এল, কৌতুহলী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অগ্নিদা অনেকক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল, তারপর বোধহয় শীত লাগল একটু কেঁপে উঠল, জ্বরটা আবার আসছে নাকি!  অগ্নিদা পায়ের কাছে ভাঁজ করে রাখা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিল।

 খুব আবছা গলায় বলতে শুরু করল "এটা গত বছরের কথা এই রকমই সময়, বেশ কদিন শোনা যাচ্ছিল একটা বাঘ খুব উৎপাত করছে কাছাকাছি গ্রামগুলিতে, এখানকার মানুষগুলো খুবই গরীব,     যাদের  দুএকজনের গরু আছে, তারা এদের কাছে বড়লোক, বেশির ভাগ জঙ্গলে মধু কাঠ পাতা সংগ্রহ করে আর ছাগল চড়ায়, ছাগল পোষে, মুরগী পোষে। অনেকে শহরের কাঠচেরাই কলে কাজও করে। প্রায়ই বাঘ এসে ছাগল নিয়ে চলে যাচ্ছে। গরীব মানুষগুলোর বড় ক্ষতি হচ্ছে। খাওয়ার নুনটুকুও প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়। কে আর এদের খবর নেয়। সবাইকে বলে দেওয়া হল  ছাগল মুরগী যেন বাইরে না থাকে, ঘরে তুলে রাখে রাতে। ঘরই বা কই!   এর মধ্যে একটু অবস্থা ভালো বলরামের, তার গাভী একটা বাছুর দিল। সাতদিনের সেই বাছুরটাকে বাঘে নিয়ে গেল। এদের নিজেদেরই থাকার জায়গা নেই সবই ঝুপড়ীতে থাকে, উঠানে একটু জায়গা বাঁখারি দিয়ে ঘিরে গোয়াল, অমজবুত.. বাঘ ঢুকে বাছুর নিয়ে চলে গেছে বাড়ির সবার গরুর চিৎকারে ঘুম ভেঙেছে, অস্বাভাবিক ডাকে বাইরে এসে দেখে এই কান্ড। সঙ্গে সঙ্গে টিন ক্যানেস্তারা পেটাতে পেটাতে লাঠি সোঁটা কুড়ুল নিয়ে লোক বেরিয়ে পড়েছে, বাঘ বেশি দূর পালাতে পারেনি, বাছুরটাকে ফেলে রেখে চলে গেছে। বকনা বাছুর ছিল, মরে গেছে। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল বলরামের বৌ লক্ষ্মী ঘোর অকল্যাণ , এত বড় ক্ষতি মানা বড় কষ্টের, বনবিভাগের পক্ষ থেকে সর্তক করে দেওয়া হল বনে যেন দল বেঁধে ঢোকে, কোথায় বিপদ ঘটলেই টিন বাজায়, সঙ্গে লাঠি সড়কি, কুড়ুল দা যার যা আছে নিয়ে বার হয়। সেদিনও এমন চাঁদের আলো ছিল আকাশে, আমার কাজের লোক সুদামার দুদিন হল জ্বর হয়েছে, গায়ে এলার্জী বেরিয়েছে, আমি তাকে জোর করে এলার্জীর ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছি। নভেম্বরের শেষ হলেও বেশ ঠান্ডা পড়েছে, আসলে গাছগাছালি আর ফাঁকা জায়গা। সময়টা পূর্ণিমার কাছাকাছি,  আমি জানলার পর্দাটা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। ঝিম ধরা চাঁদের আলোয় মাখামাখি বাইরেটা, অন্ধকারেও গাছের মাথাগুলো কেমন আলো পড়ে ঝকঝক করছে। এই আলোর মধ্যে কেমন একটা মায়া, একটা আবছা ভয়ের, ঠিক ভয়ও নয় রহস্যের ভাব মিশে থাকে। কেন জানি না ঘুম এল না, আমি জিমকরবেট অমনিবাসটা নামিয়ে পড়তে লাগলাম। কতক্ষণ তন্ময় হয়ে পড়েছি জানি না, হঠাৎ একটু দূরে ফেউএর আওয়াজ শুনতে পেলাম। খাটের উপর সোজা হয়ে বসলাম। বাঘ বেরিয়েছে তারই সতর্ক বার্তা। দূরে কোথাও ঘুম ভাঙা পাখির দল হঠাৎই ডেকে উঠে চুপ করে গেল। আমি বসে রইলাম, আর কোথাও কোন শব্দ নেই। বসতির দিক থেকে কোন চেঁচামেচি শোনা যায় কিনা কান খাড়া করে তাই শুনতে লাগলাম। নাহ, নিস্তব্দ। বাঘ জঙ্গলে শিকারে বেরিয়েছে তবে গাঁয়ের দিকে বোধহয় নয়। কিছুক্ষণ বসে থেকে বই পেজ মার্ক করে রেখে শুয়ে পড়লাম। একসময় কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। ঘুম ভাঙল কেমন একটা অস্বস্তিতে, প্রথমে বুঝিনি, তারপর শুনলাম একটা কান্নার আওয়াজ আসছে, প্রথমে ভাবলাম সুদামা নাকি ঘুমের ঘোরে কাঁদছে...  সঙ্গে সঙ্গে বাইরের ঘরে গিয়ে দেখি না সে একটা কম্বল চাপা দিয়ে গভীর ঘুমে ডুবে আছে, মনের ভুল....ঘরে চলে এলাম আর আবার পরিষ্কার শুনতে পেলাম একটা কান্নার শব্দ, অল্পবয়সী ছেলের গলা বোধ হল, বিস্মিত হলাম, এত রাতে কে কাঁদে আমার বাড়ির কাছে, আমার  বাড়ি তো জঙ্গলের প্রবেশ মুখে, বসতির কাছে নয়, এখানে এত পরিষ্কার কে কাঁদছে, শালটা তুলে গায়ে দিলাম আর কি ভেবে বন্দুকটাও সঙ্গে নিলাম, আমাদের স্যার বলেন জঙ্গলে আর যাই ভুলে যাও বন্দুকটা নিতে কখনও ভুলো না।

সুদামার পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলাম, চোর ডাকাতের ভয় নেই কিন্তু জন্তু জানোয়ার তো আছে। সুদামা অবশ্য দরকারে রান্নাঘরের ছোট দরজা দিয়ে বাইরে আসতে পারবে আর আমি অন্ধকারে যাবই বা কোথায়, এই সামনেটাই দেখব, শব্দটা কোথা থেকে আসছিল। বাইরে জোৎস্নার চন্দন মাখানো লনটা। এখানে কেউ নেই, আবার কান্নার শব্দটা উঠল, কেমন গায়ে কাঁটা দেওয়া কান্না, ভয় ব্যথা মেশানো.. আমি দ্রুত পদে এগিয়ে গেলাম, গেটখুলে বাইরে এসে দেখি সামনের ঝাঁকড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে বার চোদ্দ বলে মনে হল পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ছেলেটাকে, আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম,"  এই কে রে?  কি হয়েছে, এখানে এত রাতে কি করছিস?  " ছেলেটা কান্না থামাল না, আমার দিকে তাকালো, অন্ধকারেও বোঝা গেল তার চোখমুখ চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে, পরণে ময়লা সার্টটাও ভেজা লাগল। আমি এগিয়ে যেতেই তার কান্না আরো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, বোবার মত কেমন একটা শব্দ করে আঙ্গুল তুলে জঙ্গলের দিকে দেখালো, আর ওই দিকে চলতে শুরু করল ছেলেটা পা টেনে টেনে কিন্তু অতি দ্রুতগতিতে চলতে লাগল, বিস্মিত আমিও ওর পিছনে হাঁটা লাগালাম, ওখানে কেউ কোন বিপদে পড়েছে, ছেলেটার কেউ হবে , ছেলেটা আমায় তাই ডাকতে এসেছিল বোধহয়, ভিতরে ঢুকতে সাহস পায় নি, গেটে ও তো বন্ধ ছিল। আমি ওর পিছনে চলতে লাগলাম, ও বসতির দিকেই এগোতে লাগল জঙ্গলের পথ ধরে, তখনও ও কাঁদছিল, আমি আর কিছু না বলে শক্ত হাতে বন্দুক ধরে ওর পিছনে চলতে লাগলাম। ছেলেটা অনেকটা আগে, মনে হচ্ছে  খোঁড়া কিন্তু এত জোর দৌড়াচ্ছে কি করে!! আর একটু এগিয়েই ছেলেটি ফের ডুকরে কেঁদে উঠল, ওর কান্না ভেজা মুখটা দেখে বুকটা মুচড়ে উঠল, ও একপাশে সরে গিয়ে হাত তুলে একটু দূরে ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটা দেখাল, ও দাঁড়িয়ে রইল, আমি এগিয়ে গেলাম। ছেলেটা পিছনে রইল, আমি সাবধানে নি:শব্দে এগোতেই গন্ধটা পেলাম, বাঘের গন্ধ.. শক্ত হাতে বন্দুক চেপে ধরে এগোলাম, মোটা গুঁড়িটার পিছনে সে শিকার নিয়ে বসেছ, হাওয়া উলটো দিকে বলে সে আমার উপস্থিতি টের পায় নি, আমি এগিয়ে চললাম, ঠিক সেই সময় হোঁচট খেলাম কিছুতে, শুকনো পাতায় শব্দ উঠল মচমচ। সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘোরাল বাঘটা, চাঁদের আলোয় তার রক্তাক্ত হিংস্র মুখ, শিকারকে আড়াল করে দাঁড়াল, আমি কেঁপে উঠলাম, সেও উঠে দাঁড়াল,  ওকে মারতে পারব  না, হুকুম নেই, কিন্তু আত্মরক্ষার অধিকার কাউকে দিতে হয় না, বন্দুক নিশানায় আছে, ঠিক সেই সময় বাঘটা একটু সরে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল, বোধহয় আক্রমণের সুবিধার জন্য আর তখনই আমার চোখে পড়ল শিকারটা... ছেলেটার মুখটা আমার দিকেই ফেরানো ছিল নিস্পন্দ, নিস্পলক। কেঁপে উঠলাম। আপনিই  চাপে বন্দুকের গুলি বেরিয়ে গেল, মাথার মধ্যে যেন কি গোলমাল, বাঘটা আক্রমণের বদলে লাফ মেরে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল, চোখের সামনে ছেলেটার আধখাওয়া দেহটা আর পায়ের কাছে ওর একটা কাটা পা, ওটাতেই হোঁচট খেয়েছিলাম..... একটু বাদেই বসতি থেকে টিন বাজানোর আওয়াজ উঠেছিল। সুদামাও বন্দুকের শব্দে ঘুম ভেঙে পিছনের দরজা খুলে খুঁজতে চলে এসেছিল। ওরাও এসে পড়েছিল। আমি শুধু স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম " অগ্নিদার গলাটা ফিসফিসে হয়ে এসেছিল, ঘরের মধ্যে আলোও কমে এসেছিল, সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আমরাও স্থানুর মতো বসেছিলাম। কাকিমা এসে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে ঘরে ধূপ জ্বেলে দিয়ে গেলেন। অগ্নিদা বলল " ছেলেটার পেট নেমেছিল, বার তিন বাবা দাঁড়িয়েছিল মাঠে যাবার সময়, তারপর বোধহয় একাই গিয়েছিল পায়খানা করতে। বনে শিকারের খোঁজেছিল সেও...। সবাই জানে ফেউএর ডাকে, বাঘের গন্ধে আমি বেরিয়ে ছিলাম, কাউকেই কিছু বলিনি কখনো,  আজ তোদের কথায় মনে পড়ল সেই হতভাগ্য ছেলেটার কথা... আত্মাটা বোধহয় আধখাওয়া শরীরটাকে বাঁচাতে এসেছিল রে।।