শিকার Shikar by রত্না চক্রবর্তী Ratna Chakraborty , chapter name রঘু

রঘু

 


চাকরের  সাথে মালিকের বাড়ির ছেলের বন্ধুত্ব হয় না কিন্তু তপু আর রঘুর অন্তরের বন্ধুত্ব হয়েছিল। কারণটা ছিল খুবই গভীরতপু মালিকের ঘরের হলেও মা বাবা মরা জেঠা জেঠির ঘাড়ে পড়া আপদ বালাই আর রঘু ক্যানিং এর অনেক ভিতরের গ্রাম থেকে আনা মা বাপ মরা  কাজ করার ছেলে, ভাত- কাপড় আর পঞ্চাশটাকা হাত খরচের শর্তে আনা। রঘু বয়সে একটু বড়ই ছিল তপুর থেকে কিন্তু তার অপুষ্ট চেহারার জন্য এক বয়সীই  লাগত। আর রঘু মজ্জাগত ভাবে তপুকে সমীহ করত আর তপু 'মোটা মোটাবই পড়ত বলে নিরক্ষর ছেলেটা তার বড় ভক্ত ছিল। রঘু থাকত চিলেকোঠার এডবেস্টর ঢাকা আর সব বাতিল হাবিজাবির আবর্জনার সাথে। আর তপু শুতো নিচের ছোট একটা ঘরে। তপুর সাথে বাড়ির লোকেরা কেমন উদাসিনভাবে কথা বলত, কেউ ওকে ডেকে কথা বলত না, বাড়ির সবাই বেড়াতে গেলে তপু বাড়িতেই থাকত।বাড়িতে লোকজন এলে তাকে কেউ ডাকত না। খেতেও দিত, জামা কাপড় ছিল কিন্তু মমতা বা ভালোবাসা ছিল না। তপু বড়রাস্তার ওপারে সরকারি ইস্কুলে পড়ত। তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু কেউ কখনো দিতে যেত না। বড়রাস্তা পার হয়ে যেতে তার প্রথম প্রথম ভয় ভয় করত। সে খুব ভীতু শান্ত প্রকৃতির ছেলে। আর তার জীবনে  তার বাবা মার  এক্সিডেন্ট ভয়ানক ছাপ ফেলে ছিল। তার মা তাকে কখনও একলা রাস্তায় বার হতে দিত না। সেই মা বাবা বাস এক্সিডেন্টে এক সাথে চলে গেল। তপুর জন্মদিনের শপিং করে ফিরছিল তারা। তার বাবামা জেঠুর মতো বড়লোক না হলেও তারা বেশ  সুখেই ছিল, ভালই ছিল। খাওয়া পরা, সুখশান্তির অভাব ছিল না। তার মামার বাড়ির ও কেউ ছিল না, কাজেই জেঠুর কাছেই এসে পড়েছিল।  রঘু এসেছিল তপুর মাসখানেক আগে। সে শহরের না হলেও খুব চৌখোশ ছেলে। গ্রামে থাকতেও নানা রকম কাজ করতে হতো, পথঘাট চেনা,চলাফেরা করায় তার অসুবিধা হতো না। প্রথমদিন যখন তপু ইস্কুল যাচ্ছিল, তখন রঘু গিয়েছিল ইস্ত্রিওয়ালার কাজ থেকে বাবুর সার্ট আনতে। সে দেখেছিল তপু একবার দুপা এগুচ্ছে আর গাড়ি দেখে পিছিয়ে যাচ্ছে। তার বড় মায়া হয়েছিল।সে নিজেই এগিয়ে এসে হাত ধরেছিল তপুর। তারপর গাড়ির মধ্যে দিয়ে সাবধানে রাস্তা পার করিয়ে দিয়েছিল। তপু কিছু বলে নি, শুধু লাজুক হাসি হেসেছিল। সেই বন্ধুত্বের শুরু। তপু অন্ধকারকে ভয় পায়, বিশাল ফাঁকা জায়গাকে ভয় পায়। আগে জেঠুরা কোথাও গেলে সে খুব ভয় পেত। চোখ বুজে তার তক্তপোষে শুয়ে থাকত। চুপচাপ কাঁদত।এখন জেঠুরা চলে গেলেই বরং বেশি মজা হয়।সারাদিন দুজনে মজার খেলা খেলে। তপুর সুটকেসে একটা লুডো ছিল, সে তার মার সাথে দুপুরবেলা খেলত। এখন সেটা বার করে রঘু আর তপু খেলত। তপু চুপিচুপি রঘুকে 'অজ আম' লেখা শেখাতো।রঘু একটু বেশি খেত, খেতে খুব ভালোবাসত।  অল্প খাবার হলে তার মুখ শুকনো হত। তপুর খাওয়া খুব কম ছিল। দাভাইয়ের বন্ধুরা এলে কখন কখনও তাকে চকলেট, বা পেস্টির কি চিপস দিত। সে তার ভাগের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখত, রঘুকে দিত। তপুকে জামা কাপড় নিজে কাচতে হতো কেউ কেচে দিত না। কাচার লোক ছিল সে শুধু জেঠু জেম্মা আর দাভাইয়ের জামা কাপড় কাচত। তপু কাচতে পারত না রঘু লুকিয়ে কেচে দিত। যেহেতু তপুকে কেউ খেয়ালই করত না তাই কেউ জানতেও পারত না। লোডশেডিংয়ে রঘু আগে তপুর ঘরে মোমবাতি জ্বেলে দিত সে ভয় পায় বলে। তপুর আপনজনের অভাবটা রঘু অনেকটা পূরণ করেছিল।

কিন্তু তপুর ভাগ্যে আপনজন সইল না। দাভাই ভালো চাকরি পেল, আমেরিকায় চলে যাবে। বাড়িতে বিরাট পার্টি দিল জেঠু। কত আত্মীয় বন্ধুবান্ধব এল, কত্ত খাওয়া দাওয়া। দাভাই এই প্রথম তাকে আর রঘুকে দুটো টিশার্ট দিল। রঘুকে পঞ্চাশ টাকা আর তাকে বড় ক্যাডবেরি দিল। দাভাই চলে গেল।  অনেক খাবার বেঁচে ছিল। দাভাইকে প্লেনে তুলে দিয়ে জেঠু জেম্মা ড্রাইভার কাকুর জিম্মায় বাড়ি রেখে জেম্মার ভাইয়ের বাড়ি চলে গেল দুদিনের জন্য। রঘুকে বলে গেল "গ্যাস জ্বালার দরকার নেই, স্টোভে সিদ্ধ ভাত চড়াবি দুজনের মত,টেবিলে মাখন বার করা আছে নিয়ে খাবি। রাতে ফ্রিজ থেকে পাঁউরুটি বার করে চিনি দিয়ে খেয়ে নিবি। " তপুর আনন্দই হয়ে ছিল। ড্রাইভার কাকা তো দিনরাত টিভি দেখবে আর পাশের বাড়ির ড্রাইভার  ইদ্রীসচাচাকে ডেকে এনে তাস খেলবে।এসি চালিয়ে বসে থাকবে।  এদুদিন রঘু আর তপু স্বাধীন। সারাদিন তারা খেলল। রাতে কিন্তু রঘু পাঁউরুটি খেতে রাজি হল না।অনেক মাংস বেঁচে ছিল। ফ্রিজে ছিল, জেম্মা বার করে দিয়ে রঘুকে বলে গিয়েছিল পরদিন ময়লা ফেলার গাড়িতে ফেলে দিতে। কিন্তু রঘু বলল " ইস, এত মাংসো, ফিস্ফাই ফেলে পাঁউরুটি কে গিলবে, আমি মাংসো গরম করে খাব। "তপু বলল " খেও না, কেমন গন্ধ লাগছে না? " রঘু বলল "দূর এট্টু গরমমশলার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেই দারুণ হবে। " রঘু খেতেও পারতো, খেলেও প্রচুর। মাঝরাত থেকে শুধু পায়খানা আর ঘর। বার ছয়েক যাওয়ার পর তপু ভয় পেল। রঘু বলল "কিচ্চু হবে না,ফ্রিজে থামসাপের বোতল আছে না? খেয়ে নিচ্ছি। " কিন্তু এর পর রঘু পেটের ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠল, এবার বমি শুরু হল। তপু ড্রাইভার কাকুকে ডাকতে গেল। সে তখন ঘুমে কাদা, কোনক্রমে চোখ মেলে বলল "এত রাতে কোতায় যাব, পেটে চুনের বেড় দিলে সেরে যাবে। কাল ভোরে দেকবোখন কি করা যায়। " রঘু  এরপর আর পায়খানায় যেতেও পারল না ঘরেই পায়খানা  বমি করতে লাগল, ক্রমে নেতিয়ে পড়ল। তপু ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগল। বাড়িতে যে আর কেউ নেই। রঘু কোনক্রমে আচ্ছন্ন চোখ মেলে বলল "কাঁদিস না, ভয় নেই, আমি আছি, আমি থাকব তোমার সাথে। " রঘু আর কোন কথা বলেনি। ভোরে যখন আর রঘু সাড়া দিচ্ছে না,হাত পা ঠান্ডা তখন তপু ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকল ড্রাইভার কাকুকে। সব দেখে শুনে ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেল ড্রাইভার কাকু পাড়ার ছেলেদের নিয়ে কিন্তু রঘু বাঁচল না, রাস্তাতেই মারা গেল। জেঠুরা ফিরে এলেন ড্রাইভার কাকুর ফোন পেয়ে। জেম্মার সঙ্গে এল রিনি দিদি, জেম্মার ভাইয়ের মেয়ে। সে এবার থেকে এখানে থাকবে,এখান থেকেই পড়বে। এসেই জেঠু জেম্মা খুব খানিক ঝামেলায় পড়লেন, পাড়ার লোকেরা বলতে লাগল, 'এভাবে দুটো ছোটছেলেকে একা ফেলে যাওয়া ঠিক হয় নি, ড্রাইভার কাকুর আগেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল' কিন্তু রঘুর বাপমা কেউ ছিল না বলে দাদা এসে কান্নাকাটি করলেও তত ঝামেলা করল না। জেঠু তাকে বেশ কিছু টাকাও দিল। কিন্তু ড্রাইভার কাকু মিথ্যা বললেন তপুর নামে, তিনি বললেন তিনি জানতেনই না, ওরা তাকে জানাই নি। জেম্মার খুব রাগ করলেন, রিনিদিদি বলল "পিসে একটা অপদার্থ পুষছে, ওর জন্যই তোএত কথা শোনাল পাড়ার লোকেরা। ও ডাকতে পারে নি ড্রাইভারকেএকটা হাঘরে গিলে মরেছে আর তার জন্য দায়ী  বাড়ির লোকএইজন্যই বলে ছোটলোকেদের ভালো করতে নেই।" তপু রিনিদিকে আগেও একবার দেখেছে, রিনিদি কেন কে জানে তাকে ভিষণ ঘেন্না করে, কেমন যেন  আক্রোশের দৃষ্টিতে তাকায়।  হয়তো  ভুল ভাবে.. ভাবে জেঠু জেম্মার আদরের ভাগ পায় সে... কি ভুল ধারণা । তপু না থাকলে সে খুশি হত। তার ঘরটা রিনিদিকে দেওয়া হল, আর তাকে পাঠানো হল রঘুর চিলেকোঠার ঘরে।  তপুর ঘরে ঢুকে খুব মন কেমন করে উঠল রঘুর জন্য। দেওয়ালে পেরেকের সঙ্গে টাঙানো রঘু ধরা দুটো ঘুড়ি, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা রঘু কুকুর তাড়ানো  মোটা লাঠিটা। একটা মানুষ তার হয়েছিল যে তাকে আবার আপনজনের মতো ভালোবাসত। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছল তপু। রঘুর দাদা এসে তার পোঁটলাটা আর দাভাইয়ের দেওয়া টিশার্টটা নিয়ে গেছে, জেম্মা আরো কিছু দাভাইয়ের জামাকাপড় দিয়েছেন। কিন্তু চড়কের মেলার সময় রঘু একটা টর্চ কিনেছিল শখ করে সেটা র‍য়ে গেছে একটা তাকে। তপু আলতো করে হাত বুলালো টর্চটাতে।  গরমের ভর দুপুর, চারদিক নিঝুম, হঠাৎই একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক যেন স্নেহের পরশ বুলিয়ে গেল তার সারা গায়ে মাথায়। তপু ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। নির্মেঘ আকাশ। তার মনে হল, এ রঘুর আদর।আশ্চর্য  সে ভীতু হলেও একথা ভেবে তার ভয় করল না একটুও। বরং তার ভয় হল ঘরটার একটা পাল্লা ভাঙা ছোট্ট জানলা আর সেটা খুললে ফাঁকা ছাদ, অন্ধকারকে সে বড় ভয় পায়, রাতে কি করবে। বৃষ্টি হলে বাজ পড়লেও সে ভয় পায়। আর এই ঘরের চালে বৃষ্টি পড়লে বড় ভয়ানক শব্দ হয়। নীচের ঘরে এ সমস্যা ছিল না। রাতে তপু প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে ঠাকুরের নাম করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। রাতে সে স্বপ্ন দেখল রঘু বলল "বেশ মজা হল বল, তুমি এখন থেকে আমার ঘরে থাকবে, আমি তোমায় সবসময় দেখতে পাব। তুমি ভয় পেও না আমি জেগে থাকি রাতে তুমি শান্তিতে ঘুমোও। " ঘুম ভেঙে তপু দেখল ভোর হয়েছে, তার মনটা কেমন একটা শান্তিতে ভরে গেল, রঘু কিন্তু তার মা বাবার মতো একেবারে চলে যায় নি। আধো অন্ধকারে একবার তাকে রাখা টর্চটা আপনি জ্বলে উঠল, তপু শব্দ করে হাসল "রঘু"।

মুশকিল হল রিনিদিদিকে নিয়ে। রিনিদিদি সবসময় তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টায় থাকে। রিনিদিদির ওড়না লেগে কাঁচের ফুলদানি পড়ে ভাঙলো, রিনিদিদি চিৎকার করে উঠল  " কিরে ইচ্ছে করে ফেলে ভাঙলি ফুলদানিটা কি মিচকে শয়তান ছেলেরে তুই।"বিষ্ময়ে তপু কথা বলতে পারলো না, জেম্মা কঠিন চোখে তাকালেন তপুর দিকে। তপু ভয়ে কাঁটা হয়ে গেল। ঠিক তখনই তার পিছনে দাঁড়ানো  রিনিদিদির মাথার উপর সুন্দর কাঁচের বোতলে রাখা মানিপ্ল্যানটা ভেঙে পড়ল রিনিদিদির মাথায়। ব্যথা পেয়েছে রিনিদিদি, কেঁদে উঠেছে। তপু বলল "আমি ওটা ভাঙি নি, আপনিই ভেঙেছে এইরকম। " জেম্মা যেন অবাক হলেন বললেন "তাইতো কি হল রে" কথা আর এগোল না, রিনিদিদির কপাল কেটে গেছে, সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রিনিদিদির কিন্তু আক্রোশ গেল না। রিন জানত তপু খুব ভিতু। তাই রাতের বেলা চুপিচুপি কালো চাদর মুড়ি দিয়ে তার উপর একটা মুখোশ পরে তপুর ঘরে গেল। ঘরটা বেশ গরম। কিন্তু বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইতে লাগল। তপুর আর ভয় করে না সে জানে রঘু আছে তাই সে আরামে নিশ্চিন্ত মনে পাশ ফিরে শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। রিনি পা ঠুকে তার পায়ের ঘুঙুরে শব্দ করল যাতে তপুর ঘুম ভাঙে কিন্তু তপুর ঘুম ভাঙল না। কিন্তু ঘরের মধ্যে টর্চ জ্বলে উঠল, আলোটা রিনির মুখের উপর পড়ল। রিমি আঁতকে উঠল, কে রে বাবা! তপু তো ঘুমাচ্ছে! তবে কি পিসেমশাই? সে ধরা পরার ভয়ে হুড়োহুড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেল, আর কি ভাবে পা হড়কে পড়ে গিয়ে কোমরে প্রচন্ড ব্যথা পেল। শব্দ পেয়ে তার পিসি আর পিসেমশাই একসাথে "কি হল, কি হল" করে ছুটে এলেন। রিনি তখন উঠতে পারছে না। কোনরকমে চাদরটায় মুখোশটা মুড়ে ছুঁড়ে দিয়েছে এককোনে। এত রাতে রিনি কেন সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল? তার জবাবে রিনি বলল  উপরে কিরকম একটা বিদঘুটে শব্দ হচ্ছে শুনে সে উঠে তপুকে দেখতে যাচ্ছিল, হঠাৎ পা পিছলে...। রিনির পিসেমশাই সিঁড়ি দিয়ে উপরে গেলেন, তপুকে অঘোরে ঘুমাতে দেখে নিচে এসে বললেন "না উপরে কিছু তো হয় নি! সে তো মোষের মতো নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে। " রিনির পিসি রিনি পর দরদী মনের জন্য প্রশংসা করতে লাগলেন, এমন বিপদের জন্য দুঃখ করতে লাগলেন। শুধু রিনি ভাবতে লাগল টর্চের আলোটা কে জ্বেলেছিল! তবে কি চোর ঢুকেছিলনাকাল হয়ে রিনির রাগ বেড়ে গেল কিন্তু শিক্ষা হল না। তপুর খুব পছন্দ ছিল জেঠার একটা সুন্দর পেন একটা পেন থেকে চার রকম রঙের লেখা পড়ে। সে প্রায়ই পেনটা টেবিলে পড়ে থাকলে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করত। রিনি কিছুদিন থেকে টুকটাক খাবার যেগুলো তপুর ও প্রিয় সেগুলো চুরি করে খেয়ে নিত। আবার তপুর জেম্মার মনে না থাকলেও ইচ্ছা করে বলত " পিসি কাল এখানে একটা জেমসের প্যাকেট ছিল দেখছি না তো... পিসি ফ্রিজে রাখা আইস্ক্রিম দুটোর একটা কে খেল গো? " এমনটা প্রায়ই হত। জেঠু কিছু না বললেও, জেম্মা বলত "বাড়িতে তো চারটি প্রাণি, চাকরবাকর ও নেই তুই আমি যখন খাই নি, তোর পিসে ঠান্ডা খায় না তাহলে আর কে বাকি বল?"  ছাদের উপর জলের ট্যাঙ্কের পাশে  খালি কাপটা পাওয়াও যায়। অপমানে দুঃখে তপুর চোখ জলে ভরে যায়। এরপর একদিন জেঠুর বন্ধুর দেওয়া সেই সুন্দর কলমটা পাওয়া গেল না। রিনি বারবার জোর দিয়ে বলতে লাগল সে দেখেছে তপু কি একটা টেবিলের উপর থেকে চুপিচুপি নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে উপরের ঘরে চলে গিয়েছিল। জেঠু বলল "কি রে পেনটা তোর পছন্দের, তুই নিয়েছিসচাইতে হতো, না বলে নিলে তো চুরি করা হয়। আমার বংশের ছেলে হয়ে চুরি করলি।জেঠুর গলায় রাগ না কেমন একটা দুঃখ  ঘেন্নার সুর শোনা গেল। জেম্মা বললেন " শোন ভাই তোমার বংশের কিন্তু ওর মা সে তো অন্য ঘরের মেয়ে, তার স্বভাব কি আমরা জানি? " এতদিনে এই প্রথম শান্ত ভিতু চুপচাপ তপু চিৎকার করে কেঁদে উঠল " না আমি চোর নই, চুরি করে খাই নি কোনদিন, পেন আমি নিইনি, আমার মা চোরকে ঘেন্না করত, আমার দাদু পুলিশে চাকরি করতেন। "বলতে বলতে তপু উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ল, হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে পড়ল। জেম্মা কেমন থতিয়ে গেলেন,জেঠুর মুখটা কেমন করুণ, বিষন্ন হয়ে গেল। রিনি থামতে দিল না, সে বলল " ঠিক আছে আমি দেখছি তোর ঘরে আছে কিনা, তাহলেই তো বোঝা যাবে তুই নিয়েছিস কি নিস নি। " জেঠু বোধহয় বাঁধা দিতে যাচ্ছিলেন তার আগেই রিনি তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। ওপর থেকে শোনা গেল জিনিস পত্র নাড়াচাড়ার শব্দ। তারপরই হঠাৎ রিনির মর্মান্তিক চিৎকার শোনা গেল আর কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ। জেম্মা "ওরে কি হলো " বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। জেঠু চিন্তিত মুখে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তপু তেমনই বসে ফোঁপাতে লাগল, আজ আর সে উপরে ছুটল না। জেঠিমা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন " কি সর্বনাশ হলো গো! ও রিনি, রিনি রে...." রিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল মাটিতে, তার মাথার পিছন দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছিল , রঘুর কুকুর তাড়ানো মোটা লাঠিটার পাশে পড়ে থাকা থেকেই বোঝা গেল ওটার আঘাতেই এই দুর্ঘটনা। মনে হয় জিনিস পত্র টানাটানি করতে গিয়ে ওটা আচমকা মাথায় এসে পড়েছে। রিনিপিসি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ডাক্তারবাবু নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে বললেন কারণ রিনির জ্ঞান ফিরলেও রিনি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। মাথায় আঘাত লাগার জন্য রিনি দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছিল। রিনি জ্ঞান ফেরার পর এক কথাই বলে যাচ্ছিল, "রঘু ঘরের কোনে দাঁড়িয়েছিল, সেই তার মাথায় লাঠির বাড়ি দিয়েছিল।তপুর জেঠু বিশ্বাস করে নি।উত্তেজিত  ছিলচোখের ভুল বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তপুর জেম্মা বলেছিল " এই সব চুরি , ফুলদানি ভাঙা সবই রঘুর আত্মার কাজ, ছোঁড়াটা সংসারটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। কি আপদই জুটেছিল। " তপু জানে রিনিদিদি ঠিকই দেখেছিল।

 এখন রিনিদিদি এবাড়িতেই থাকে, রিনিদিদির আর রাগ নেই তপুর উপর, তপুই এখন তার ভরসা, আশ্রয়। সে গল্প বই পড়ে শোনায়, হাত ধরে বারান্দায় বসায়।কিন্তু রিনিদিদি ছাদে কিছুতেই যাবে না।,সেখানে রঘু যে আছে। এটা তপুও জানে, সে যে রোজ খেলা করে রঘুর সাথে কিন্তু সেটা কাউকে জানতে দেয় না।।