আট কুঠুরি নয় দরজা - Aat kuthuri noi dorja by সমরেশ মজুমদার - Samaresh Majumder, chapter name আট কুঠুরি নয় দরজা - পাঁচ

আট কুঠুরি নয় দরজা - পাঁচ

দূরত্বটা অনেকখানি। ঢালু মাঠ যেখানে শেষ হচ্ছে সেখানেই ঝোপের শুরু । জানলায় দাড়িয়ে জোৎস্নায় ভেসে যাওয়া আকাশের নীচেটা শান্ত, স্বাভাবিক। স্বজন গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুমি বোধ হয় ভুল দেখেছ।"

            
অসম্ভব। আমি স্পষ্ট দেখেছি। পৃথার গলায় এখন স্বাভাবিকতা এসেছে।

            
ঠিক কোন জায়গাটায়?

           
পৃথা আঙুল তুলে জায়গাটা দেখাল। এখন সেখানে কিছু নেই। পৃথিবীটা এখন নিরীহ এবং সুন্দর। স্বজন হেসে ফেলল ।

            
পৃথা ভ্ৰ তুলল, হাসছ যে ?

            
'একটা ইংরেজী ছবি দেখেছিলাম। বাজে হরর ফিলা। তাতে ছিল, এই রকম একটা নির্জন বাংলোতে কয়েকটা ছেলেমেয়ে বাধ্য হয়ে রাত কাটাতে আশ্রয় নিয়েছে আর বাংলোর পাশের কবরখানা থেকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীর নিয়ে মৃতের উঠে আসছে বাংলোর ভেতরে ঢোকার জন্যে।’

'আই, তুমি কিন্তু আমাকে ভয় দেখাচ্ছে!’

             
'অসম্ভব। আজকাল কেউ ভূতের ভয় পায় না।"

             
‘অন্য জায়গায় পেতাম না, এখানে পাচ্ছি। স্পষ্ট দেখলাম দুটো পা বেরিয়ে এল, আবার এখন উধাও হয়ে গেছে।’

              
স্বজন ফিরে এল। একটা চেয়ার টেনে আরাম করে বসল। তার মাথায় এখন নীচের ঘরের কফিনটা পাক খাচ্ছে। খুব বেশী দিন মারা যায়নি মানুষটা। এই বাংলোর কেউ হলে তাকে নিশ্চয়ই কফিনে ভরে পচার জন্যে ফেলে রাখবে না। কেউ একা একা মরে কফিনে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারে না। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে দ্বিতীয় মানুষ ওই মৃতদেহের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু যদি কেউ কাউকে হত্যা করে তাহলে এমন নির্জন জায়গায় মৃতদেহকে সাক্ষী হিসেবে রেখে যাবে কেন ? মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেললেই তো চুকে যেত!

              
নীচে গিয়ে কি দেখলে ? পৃথা জানলায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল।

              
চমকে তাকাল স্বজন । সত্যি কথাটা সে বেশিক্ষণ চেপে রাখতে পারবে না। তাই সরাসরি বলে দিল, ‘গন্ধটা একটা মানুষের শরীরের। দেহটা কফিনে রাখা ছিল। কোনও ভাবে ঢাকনাটা একটু খুলে যাওয়ায় গন্ধ উঠে আসছে ওপরে।'

                  
পৃথার গলা থেকে চাপা আর্তনাদ ছিটকে বেরোতেই সে দুই হাতে মুখ চাপা দিল। তারপর দৌড়ে চলে এল স্বজনের কাছে, আমি থাকব না, কিছুতেই থাকব না এখানে। পায়ের তলায় একটা পচা মড়া নিয়ে কেউ থাকতে পারে না। ভয়ে সে সাদা হয়ে গেছে।

                 
স্বজন বলল, “কোথায় যাবে ? আশেপাশে কোনও মানুষের বাড়ি নেই। আর চিতাটার কথা ভুলে যেয়ো না। এখানে এই বন্ধ ঘরে আমরা অনেকটা নিরাপদ। দরজা বন্ধ করে দিলে গন্ধটা তেমন তীব্র থাকছে না। রাতটুকু এইভাবেই কাটাতে হবে।'

                 
কিন্তু ওটা যদি ড্রাকুলা হয় ?

                 
‘পাগল!'

                  
না পাগলামি নয়। ড্রাকুলার দিনের বেলায় কফিনেই শুয়ে থাকে। রাত হলে রক্ত খেতে বেরিয়ে পড়ে। এটা সাহেবরাও বিশ্বাস করে!'

                  
ড্রাকুলা বলে কিছু নেই। ভূতপ্ৰেত অলীক কল্পনা। মানুষের সময় কাটানোর জন্যে গল্প তৈরি হয়েছিল কোন এক কালে। চলো, শোওয়ার ব্যবস্থা করা যাক ' স্বজন উঠে পড়লেও তার মুখে অস্বস্তি ছিল ।

                
‘শোবে মানে ? তুমি এখানে ঘুমানোর কথা ভাবতে পারছ ?

                 
‘চেষ্টা করা যাক। খামোকা রাতটা জেগে কাটিয়ে খারাপ করে কি লাভ ?

                 
আমি ঘুমাতে পারব না জেদি দেখাল পৃথাকে।

                 
দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরল স্বজন, তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন ? সকাল হলেই দেখবে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।" -

                
ওই পচা মানুষটা ?

                
হয়তো কেউ খুন করে রেখে গেছে!

               
‘খুন ? কেঁপে উঠল পৃথা ।

               
আমি জানি না। যাই হোক আমাদের কি আজ রাতে তো খুন হয়নি। পৃথকে জড়িয়ে ধরেই স্বজন পাশের ঘরের দিকে এগোল । সিড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিলে ভাল করে । শোওয়ার ঘরে পৌছে খাটটাকে দেখল। একটা ভারী বেড কভার পাতা আছে । আঙুল বুলিয়ে দেখা গেল তাতে ধুলোর পরিমাণ নেই বললেই চলে। এ বেড কভার না তুলোই শুয়ে পড়ল স্বজন । শুয়ে বলল, 'আঃ' পৃথা একপাশে বসল আড়ষ্ট হয়ে ।

              
স্বজন বলল, ‘শুয়ে পড়ো। নীচে থেকে উঠে আসার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি, তোমার আর কোনও ভয় নেই।"

             
কথাটা শুনে পৃথা একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল, ‘তুমি আচ্ছা মানুষ। হুট করে অন্যের বিছানায় শুয়ে পড়লে । একটু পরেই নাক ডাকবে।

             
“আমার নাক ডাকে না ।"

            
'একদিন টেপ করে রেখে শোনাব।"

‘            
আলোটা নিভিয়ে দেবে ?"

              অসম্ভব।
 

            
যা ইচ্ছে। তুমি এবার শোবে ?

            
অগত্যা পৃথা কোনও রকমে শরীরটাকে বিছানায় ছড়িয়ে দিল। তার ভঙ্গিতে বিন্দুমাত্র স্বস্তি ছিল না। স্বজন ওর শরীরে হাত রাখতেই আপত্তি বেরিয়ে এল, প্লিজ, না ।

স্বজন হাসল, “আমার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না।"

          
‘আমার এখন কিছুই ভাল লাগছে না।’ -

          
স্বজন চুপ করে গেল। ডান হাত সরিয়ে এনে চোখে চাপা দিল। কাল শহরে পৌছেই থানায় খবর দিতে হবে । পুলিশের কাজ পুলিশ করবে। সন্ধে থেকে একটার পর একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল আজ।

         
এভাবে শোওয়া যায় না পৃথা উঠে বসল।

        
"কেন ?"

        
বেডকভারটা বডড খসখসে। তোমার গায়ে লাগছে না ?”

       
"একটু লাগছে।’

       
উঠো । এটা সরাই। নীচে নিশ্চয়ই বেডশীট আছে। পৃথা নেমে পড়ল খাট থেকে।

       
অগত্যা স্বজনকে উঠতে হল । একটুখানি শুয়ে শরীর আরামের স্বাদ পেয়ে গেছে। সে বেডকভারের একটা প্রান্ত মুঠোয় নিয়ে টানতেই বালিশসমেত সেটা খোসার মত উঠে আসছিল বিছানা থেকে । সাদা ধবধবে চাদর দেখা যেতে আচমকা দুজনেই পাথর হয়ে গেল। বিছানার ঠিক মাঝখানে সাদা চাদর জুড়ে চাপ বাধা কালচে দাগটা । দাগটা যে রক্তের তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

        
পৃথা বিস্ফারিত চোখে দাগটাকে দেখছিল। স্বজন একটু সম্বিত পেতেই বিছানায় ঝুকে দাগটাকে ভাল করে দেখল। রক্ত শুকিয়ে গেলে এরকম দাগ হয়। এখানে কারও রক্তপাত হয়েছিল। শরীর সরিয়ে নেওয়ার পর বেডকভার দিয়ে সেটাকে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল । সে সোজা হয়ে দাড়িয়ে বেডকভারের উল্টোপিঠটা দেখল। হ্যা, সেখানেই হালকা দাগ লেগেছে। রক্তপাতের কিছু সময়ের মধ্যেই ওটাকে ঢাকা হয়েছে। স্বজন বেডকভারটাকে ছুড়ে দিল দাগটার ওপর। অনেকটা আড়ালে পড়ে গেলেও ভারতবর্ষের ম্যাপের নীচের দিক হয়ে খানিকটা দেখা যেতে লাগল।

        
স্বজন পৃথাকে বা হাতে জড়িয়ে ধরে পাশের সোফা-কাম-বেডের কাছে চল এল।

        
সোফাটাকে চওড়া করে পৃথাকে সেখানে বসাল। পৃথা কথা বলল, আমি আর পারছি না।

        
'বি স্টেডি পৃথা।

       
‘আমার মনে হচ্ছে এখান থেকে কোনও দিন বেরোতে পারব না।"

       
*আর ছয় ঘন্টা পরেই ভোর হয়ে যাবে।'

        
ছয় ঘন্টা অনেক সময়। তার আগেই-? পৃথা নিঃশ্বাস ফেলল, নীচের লোকটাকে নিশ্চয়ই ওই বিছানায় খুন করা হয়েছে। আমি শুনেছি অপঘাতে যারা মরে তাদের আত্মা অতৃপ্ত থাকে। কেঁপে উঠল সে ।

       
'আত্মা বলে কিছু নেই।'

      
"তুমি হিন্দু হয়েও একথা বলছ ?

       
মানে ? খ্রিষ্টানরাও যদি আত্মা বিশ্বাস না করে তাহলে ঘোস্ট আসে কোথেকে। কিসু নেই। আজ পর্যন্ত কাউকে পেলাম না যে ভূত দেখেছে, সবাই বলবে শুনেছি।

      
"তুমি সব জেনে বসে আছ! তাহলে লোকে প্লানচেট করে কেন ?

      
"ওটা এক ধরণের সম্মোহন। বোগাস ।"

      
‘আমার ঠাকুমা নিজের চোখে ভুত দেখেছিলেন। পাশের বাড়ির একটা ছেলে নাকি আত্মহত্যা করেছিল, তাকে । ঠাকুমা মিথ্যে বলেছিলেন ?

       
উনি বিশ্বাস করেছিলেন দেখেছেন। আসলে কল্পনা করেছিলেন। তোমার নার্ভ ঠিক নেই এখন। সোফায় শুয়ে পড়ো, আমি পাশে আছি।'

        
স্বজনের কথায় পৃথা কান দিল না। এই সময় বাতাস উঠল। পাহাড় থেকে দল বেধে হাওয়ারা নেমে এসে জঙ্গলে চিরুনি চালাতে শুরু করল। অদ্ভুত এক শব্দমালার সৃষ্টি হল তার ফলে। বাংলোর দেওয়ালে, জানলায় হাওয়ার ধাক্কা লাগতে লাগল। পৃথা জড়িয়ে ধরল স্বজনকে। আর তখনই টুপ করে নিভে গেল আলো। স্বজন বলল, যাচ্চলে! লোডশডিং?

       
পৃথা অন্য রকম গলায় বলল, মোটেই লোডশেডিং নয়।

       
"তাহলে ফিউজটা গিয়েছে। দেখতে হয়।"

       
পৃথা আঁকড়ে ধরল স্বজনকে, না, কোথাও যাবে না তুমি।

      
"আশ্চর্য! অন্ধকারে বসে থাকবে ?

       
তাই থাকব। আমাকে ছেড়ে যাবে না তুমি!

       
অতএব স্বজন উঠল না। বাইরে হাওয়ার শব্দ একটানা চলছে। কাঢ়ের জানলার ওপাশে জ্যোৎস্না অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে। পৃথা ফিসফিস করে বলল, আমার একটা কথা রাখবে ?

       
"বলো ।

       
"চলো, গাড়িতে গিয়ে বসে থাকি।"

       
"চিতাটা ?”

       
'ওটা এতক্ষণে চলে গিয়েছে। গাড়িতে অনেক আরাম লাগবে।"

        
স্বজন ভাবল । টেলিফোনটা ডেড হয়ে যাওয়া, বিদ্যু চলে যাওয়া, নীচের ঘরে কফিনে গলিত মৃতদেহ আর বিছানায় রক্তের দাগ সত্ত্বেও সে নিজেকে এতক্ষণ শক্ত রাখতে পারছে। গাড়ির ভেতরটা আরামদায়ক হবে না। কাচ ভেঙে ফেললে তো হয়েই গেল। তবু এই বাংলোর বাইরে গেলে মনের চাপ কমে যেতে পারে। সে যখন পৃথার অনুরোধ রাখবে বলে সিদ্ধান্ত নিল ঠিক তখনই কঠোর সিড়িতে আওয়াজ উঠল। ভারী পায়ের আওয়াজ ।

        
অন্ধকার ঘরে পৃথা স্বজনকে আঁকড়ে বসেছিল। আওয়াজটা প্রথমে বারান্দার একেবারে ওপাশে চলে গেল। গিয়ে থামল। স্বজন ফিসফিসয়ে বলল, ছাড়ো।

        
সেই একই গলায় পৃথা জানতে চাইল, কেন ?

        
মানুষ হলে কথা বলব।’

        
না। মানুষ নয়।’

       
উঃ, অকারণে ভয় পাচ্ছ।’

             
স্বজন উঠতে চাইলেও পারল না। শব্দটা আবার ফিরে আসছিল। বারান্দায় কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে খটখট আওয়াজটা একেবারে ওই ঘরের জানলার সামনে চলে আসতেই স্বজন গলা তুলল, কে ?

             
হয়তো ভেতরে ভেতরে নার্ভাস থাকার কারণেই চিৎকারটা অহেতুক জোরালো হল। নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে স্বজন ছুটে গেল কাচের জানলার পাশে । তারপর হো হো করে হেসে উঠল বাংলো কাঁপিয়ে । সিটকে বসে থাকা পৃথা সেই হাসি শুনে অবাক, ভয়ের কিছু নেই বুঝে ছুটে এল পাশে, কি হয়েছে ?

             
‘স্বচক্ষে ভূত দ্যাখে ।

             
পৃথা দেখল। প্রাণীটি অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। আকারে একটা ছোটখাটো মোযের মত কিন্তু স্বাস্থ্যবান। সে জিজ্ঞাসা করল, “এটা কি ?

            
"বাইসন । বাচ্চা বাইসন ।"

            
উঃ, কি ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। কিন্তু চিতাটা কিছু বলছে না ওকে? পৃথার গলায় খুশি চমকে উঠল 'ওমা, দ্যাখো দ্যাখো, কী আদুরে ভঙ্গি করছে।'

          
 ‘এরা সবসময় দলবেঁধে থাকতে ভালবাসে। চিতার সাধ্য নেই-এদের কাছে যাওয়ার। এর দলটা নিশ্চয়ই কাছে পিঠে আছে। দুষ্টুমি করতে নিশ্চয়ই ইনি দলছাড়া হয়েছেন। এসব জায়গায় বাইসন থাকা খুবই স্বাভাবিক ।

           
বাইরে বের হলে ও আমার কাছে আসবে। এই প্রথম পৃথকে সহজ, স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল । স্বজন হাসল, ’ওর দলের সবাই তোমাকে পিষে ফেলবে।"

         
 এইসময় শব্দ হল। বুনো ঝোপঝাড় থেকে পাহাড়ের মত চেহারার এক একটা বাইসন বেরিয়ে আসতে লাগল মাঠে । তাদের কেউ ঘাস খাচ্ছিল। ওদের দেখতে পাওয়া মাত্র বাচ্চা বাইসনটা দ্রুত বারান্দা থেকে নেমে গেল। জ্যোৎস্নার আলো পরিণত বাইসনদের ওপর পড়ায় তাদের শরীরের শক্তি সম্পর্কে কোনও সন্দেহ রইল না। গোটা দশেক বাইসন খোলা ঢালু মাঠে জ্যোৎস্না মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পৃথার মনে পড়ল কাছাকাছি একটা লাইন, মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায়। সে দেখল বাচ্চা বাইসনটা মিশে গিয়েছে দলের সঙ্গে ।

         
 ক্রমশ দলটা উঠে আসছিল। বাংলোর সামনে দিয়ে গাড়িটাকে মাঝখানে রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল । হঠাৎ একজনের কী খেয়াল হল, যাওয়ার সময় মাথা নামিয়ে গাড়িটার দরজার নীচেটাকে ওপরে তুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সেটা ডিগবাজি খেয়ে গেল। চারটে চাকা আকাশের দিকে মুখ করে স্থির হয়ে রইল।

           
পৃথার গলা থেকে ছিটকে এল, সর্বনাশ!

           
স্বজন জ্যোৎস্নায় গাড়িটার তলা দেখতে পাচ্ছিল। কোনদিন ওখানে চোখ যাওয়ার সুযোগই হয়নি। যে পাস্পে সাভিসিং এর জন্যে গাড়ি পাঠাত, তারা যে এতকাল ফাকি মেরেছে তা এখন স্পষ্ট। সে বলল, ‘অল্পের ওপর দিয়ে গেল!'

          
পৃথা বলল, ‘ওরা চলে গেছে।’

          
হ্যা, এখন মাঠ ফাকা। চাদ নেমে গেছে অনেকটা । স্বজন বলল, ‘চলো, ওই সোফাতেই রাত কাটানো যাক ৷”

        
 ‘গাড়িটাকে সোজা করা যাবে না?

        
‘কেন?"

        
‘আমি এখানে থাকতে চাই না। তুমি বললে, বাইসনদের চিতা ভয় পায়। তাহলে নিশ্চয়ই সেটা এখন ধারে কাছে নেই।"

        
‘হয়তো নেই।'

        
‘তাহলে ভয় কি ?

       
 অগত্যা স্বজন রাজি হল। দরজা খুলে বারান্দায় পা দিতেই বুঝল হাওয়ার দাপট কম নয়। ঝড় বললেই ঠিক বলা হবে। ওপাশের গাছের ডালগুলো বেকেচুরে যাচ্ছে। পৃথা বরাদার রেলিং ধরে চারপাশে নজর রাখছিল। না, চিতাটার কোনও চিহ্ন নেই। নীচে নেমে গাড়িটাকে সোজা করতে চেষ্টা করল স্বজন। যতই হালকা হোক তার একার পক্ষে ওটাকে উপুড় করা সম্ভব হচ্ছিল না।

       
পৃথা নেমে এসে হাত লাগাল। অনেক চেষ্টার পর গাড়িটা চারচাকার ওপর দাঁড়াল। কিন্তু গিয়ার নড়ে যাওয়ায় গড়াতে লাগল সামনে । পেছনে দাড়ানো স্বজন ওর গতি আটকাতে পারল না। গড়াতে গড়াতে সোজা মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল গাড়িটা।

       
 দৌড়ে কাছে এসে, ঝোপঝাড় সরিয়ে ওরা দেখল একটা বড় গাছের গায়ে আটকে গেছে গাড়িটা। সে পৃথকে বলল, 'ঠেলে ওপরে তুলতে হবে।

       
পৃথা জিজ্ঞাসা করল, কেন?

      
 "এখানে থাকবে নাকি ?”

         
‘কাল সকালে ঠেলব। এখন টায়ার্ড লাগছে।’

           
যা ইচ্ছে।' সে গাড়ির দরজা খুলল। সামনের দরজাটা বেঁকে গিয়েছে। পেছনটা ঢুকে গিয়ে ব্যাকসিটটাকে চেপে দিয়েছে। গাড়িতে ঢুকতে গেলে ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাই ভরসা। আগে পৃথা পরে সে ভেতরে ঢুকল। ঢুকে হেডলাইট জালাল । সঙ্গে সঙ্গে গাছপালার মধ্যে দিয়ে তীব্র আলো ছিটকে গেল। নিভিয়ে দিল স্বজন পরমুহুর্তেই।

         
গাড়ির জানলা বন্ধ। সিটটাকে পেছনে হেলিয়ে দিয়ে পৃথা বলল, 'আঃ।

        
“ভাল লাগছে ?

        
“নিশ্চয়ই । মনে হচ্ছে বাড়িতে ফিরে এলাম’ ।

         
‘তোমাকে নমলি দেখাচ্ছে ।" -

         
পৃথা হাসল। এখান থেকে গাছপালার ফাক দিয়ে বাংলোটাকে দেখা যাচ্ছে। ভৌতিক বাংলোর যে ছবি সে জানতে তার সঙ্গে একটুও পার্থক্য নেই। আজ বিকেলেও বোঝা যায়নি এমন কান্ড ঘটতে পারে।

          
পৃথা বলল, শোন, আর শহরে যাওয়ার দরকার নেই। কাল সকাল হলে ফিরে চল। এত বাধা পড়ছে যখন—’

           
"সকালের কথা সকালেই ভাবা যাবে।'

          
“মানে ?”

          
‘আমি ভাবছি বাইসনের দলটা যদি আবার ফিরে আসে তাহলে ওদের পায়ের তলায় গাড়িটার সঙ্গে আমরাও পাউডার হবো।’ - -

          
‘আবার ফিরতে পারে ? .

          
'যাওয়ার সময় তো আমাকে কিছু বলে যায়নি।'

           
হ্যাট। খালি ঠাট্টা করো। পৃথা বিরক্ত হল, না, ফিরবে না।

          
একটু একটু করে হাওয়া কমে গেল। জ্যোৎস্নার রং এখন ফিকে। ভোর হতে এখনও অনেক বাকি। অন্ধকারের একটা পাতলা আবরণ মিশছে জ্যোৎস্নার গায়ে। ওরা চুপচাপ বসে ছিল। মাঝে মাঝে রাতের অচেনা পাখিরা চেচিয়ে উঠছে এদিৰ ওদিক ।

          
পৃথা হঠাৎ বলল, কাল ফিরে যাবে তো ?

          
‘না ।"

          
"কেন?

           
‘ফিরে যাওয়ার মতো কোনও কারণ ঘটেনি।

           
“আমার ভাল লাগছে না ।"

            
না লাগছেও উপায় নেই। আমার শহরে কিছু কাজ আছে।

            
মানে ? তুমি কাজ নিয়ে এসেছ নাকি ?

            
ঠিক তা নয়, যাচ্ছি যখন তখন করে নিতাম।"

            
না কোনও কাজ ক.... যাবে না। আমরা এবার বেড়াতে এসেছি।’

           
'এখন ঝগড়া কোরো না। স্বজন কথাটা বলতেই একটা গাড়ির আওয়াজ কানে এল। আওয়াজটা ক্রমশ কাছে আসছে।

             পৃথা বলল, এত রাত্রেও নীচের রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। আমরা ওখানে থাকলে লিফট পেতাম। তোমার
যে কী বুদ্ধি হল এদিকে উঠে এলে!'

            
ওরা গাছপাতার ফাক দিয়ে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু একটা গাড়ি যখন বাক নিয়ে বাংলোর দিকে এগিয়ে গেল তখন স্পষ্ট দেখতে পেল। গাড়িটা বাংলোর সামনে এসে থেমে গেল ।

            
পৃথা বলল, চলো।

            
চুপ! কথা বোলো না! স্বজন সতর্ক করল।

           
"কেন?"

           
এই গাড়িতে কারা এল জানি না। সেই লোকটার খুনিও হতে পারে ।

           
পৃথা বলল, আমাদের দেখতে পাবে না।

            
না । জঙ্গলের আড়ালে আছে গাড়িটা '

            
ওরা দেখল ওপাশে হেডলাইট নিভল। দরজা খুলল। একটা মানুষ গাড়ি থেকে নেমে বাংলোটাকে দেখল। তারপর পকেট থেকে লাইটার বের করে সিগারেট ধরাল। সিগারেটটা ঠোটেই চাপা ছিল। লাইটারের আলোয় মুখটা স্পষ্ট বোঝা গেল না। লম্বা দোহারা লোকটা এখন গাড়ির সামনে-দাড়িয়ে একাকী ।