আট কুঠুরি নয় দরজা - Aat kuthuri noi dorja by সমরেশ মজুমদার - Samaresh Majumder, chapter name আট কুঠুরি নয় দরজা - তিন

আট কুঠুরি নয় দরজা - তিন

হাঁ এই পরিকল্পনায় ঝুঁকি আছে। কিন্তু বন্ধুগণ, ইদুরের মত বেঁচে থাকা আর আমার পক্ষে সম্ভব নয় । হয় এখনই নয় আর কখনও নয়। বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় আকাশলাল কথাগুলো বলল। তার মুখের চেহারা ফ্যাকাশে, দেখলেই অসুস্থ বলে মনে হয়। বয়স পঞ্চাশের গায়ে, শরীর মেদহীন ।

       
ঘরের ভেতর শ্রোতা হিসেবে যে তিনজন মানুষ বসে আছে তাদের চিন্তিত দেখাচ্ছিল । তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটির নাম হায়দার আলি। ভাবতে গেলেই তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। সেই ভঙ্গি নিয়েই হায়দার বলল, ‘এখন আমাদের শেষবার চিন্তা করতে হবে । তুমি যখন প্রথম এই পরিকল্পনার কথা আমাকে বলেছ তখনও আমি পছন্দ করিনি, এখনও আমার ভাল লাগছে না। একটু ভুল মানেই তোমাকে চিরজীবনের জন্য হারাব। কিন্তু মুহূর্তে তোমার বেঁচে থাকাটা দেশের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী।

       
 কি ভাবে বেঁচে থাকা ? খেকিয়ে উঠল আকাশলাল, এইভাবে জলের তলায় দমবন্ধ করে? কোন কাজটা আমি করতে পারছি? আর কাজই যদি না করতে পারলাম, তাহলে বেচে থাকা আর মরে যাওয়ার মধ্যে কোনও তফাত নেই। আমি না থাকলে তুমি সেই কাজটা করবে, ডেভিড করবে, অজস্র মানুষ এগিয়ে আসবে। আমাকে কাজ করতে গেলে স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকতে হবে। এই শরীর নিয়ে ওরা আমাকে সেটা করতে দেবে না। পাচ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা এমনি করেনি সরকার।'

       
দ্বিতীয় মানুষটি যার নাম ডেভিড, নিচু গলায় বলল, ওটা এখন দশ লক্ষ হয়েছে।

       
তৃতীয় মানুষটি বয়সে নবীন, বলল, ‘ওরা আপনাকে পেলে যন্ত্রণা দেবে।  
 

      
‘জানি। আমি সব জানি । আকাশলাল হাসতে চেষ্টা করল ।

      
হায়দার আলি বলল, “কোনও সুযোগ না দিয়েই ওরা ইলেকট্রিক চেয়ারে বসাবে।'

      
সব জানি। তবু আমি ধরা দিতে চাই। এটাই শেষ কথা। আমি আর কতদিন আন্ডার গ্রাউন্ডে থাকব ? কোথায় থাকব ? দশ লক্ষ টাকা হয়েছে বলছ! এত টাকার লোভ সামনে থাকলে আমি নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারব না। এই গরিব দেশের সহজ মানুষগুলোকে লোভী করে তোলার কোনও অধিকার আমার নেই।" আকাশলাল নামতে চেষ্টা করল বিছানা থেকে। হায়দার আলি এগিয়ে যেতেই সে হাত নেড়ে জানাল ঠিক আছে।

      
ডেভিড বলল, সাধারণ মানুষ কিন্তু দশ লক্ষ টাকায় ভোলেনি। ভার্গিসকে নাজেহাল করতে আমি একটা লোককে পাঠিয়েছিলাম হেডকোয়ার্টাসে মিথ্যে খবর দিয়ে। সে কাজটা করে ফিরে এসেছে । মারধোর খেয়েছে কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। আপনার চিঠিটা নিশ্চয়ই ভার্গিস পেয়ে গেছে।'

    
 ‘ওকে আমার হয়ে ধন্যবাদ দিয়ো।' সাবধানে পা ফেলে আকাশলাল পাশের দরজা দিয়ে টয়লেটে ঢুকে গেল ।

    
ওরা তিনজন চুপচাপ বসে রইল । যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তিনরছর আগে আজ তা প্রায় বিধ্বস্ত । এক দিকে সামরিক শক্তির পাশব অত্যাচার অন্যদিকে তথাকথিত কিছু বিপ্লবীর বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও এখন যেটুকু আশা টিমটিম করে জুলছে তা যে আকাশকে কেন্দ্র করে তা এই তিনজনের চেয়ে বেশি কারও জানা নেই। তিনবছর ধরে শুধু আকাশকে নয় নিজেদের গোপনে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছে প্রতি মুহুর্তে। এদেশের মন্ত্রীপরিষদ এবং পুলিশ চিফ ভার্গিস নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যেতে পারবেন যেই তারা জানতে পারবেন আকাশলাল জীবিত নেই। মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে এই লড়াই থমকে যাবে আরও অনেক বছর। তিনজনের অস্বস্তির কারণ এখন এক ।

       
 টয়লেটের আয়নায় নিজের মুখ দেখছিল আকাশলাল । গাল বসে গিয়েছে। অনেকদিন পরে নিজের মুখটাকে ভাল করে দেখল সে। বয়সের আঁচড় নয়, অবহেলার প্রতিক্রিয়া মুখ জুড়ে। তবু রাস্তায় নামলে যে-কোনও মানুষ চিনতে পারবে তাকে। মুখের এই বিধ্বস্ত অবস্থাও তাদের বিভ্রান্ত করবে না। মানুষের মত কোনও প্রাণীর মুখ এক জন্মে এতবার বদল হয় না। অথচ তার তো দীর্ঘদিন ধরে একই রয়ে গেল । বাইরে বেরিয়ে আসার সময় মাথাটা একটু ঝিমঝিম করে উঠল। একটু দাড়াতে গিয়েই মত পাল্টাল সে । তিনজোড়া উদ্বিগ্ন চোখ তাকে দেখছে। ওদের আরও উদ্বিগ্ন করার কোনও মানে হয় না। ’

      
 বিছানায় ফিরে আসামাত্র দরজায় শব্দ হল। হায়দার আলি জানতে চাইল 'কে ওখানে? উত্তর এল, ডাক্তার এসেছেন।"

      
এ বাড়িতে এবং বাইরে রাস্তায় এখন চব্বিশ ঘন্টা পাহারা। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই খবর পৌছে যাবে এই ঘরে। হয়দার ভেতরে নিয়ে আসতে নির্দেশ দিল ।

     
ডাক্তার ঘরে ঢুকলেন। বালিশে হেলান দিয়ে আকাশলাল হাসল, আসুন ডাক্তার।'

     
ভাল। বেশ ভাল। কারও সাহায্য ছাড়াই টয়লেট যাচ্ছি।"

     হাঁটার
 সময় মাথা ঘুরছে না তো ?

       '
কাল অবধি ঘুরছিল, আজ আর হচ্ছে না।

       
আমি পরীক্ষা করব । আপনাকে বালিশ সরাতে হবে।'

       
ডাক্তারের নির্দেশ মান্য করল আকাশলাল। ডাক্তার পরীক্ষা করে যে সন্তুষ্ট হয়েছেন মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল । আকাশলাল স্বস্তি পেল।

        
এবার আপনাকে জামাটা খুলতে হবে । আকাশলাল জামার বোতাম খুলতেই বিশাল ক্ষতচিহ্ন বেবিয়ে এল। তার অনেকটাই শুকিয়ে গেলেও ওটা যে সাম্প্রতিক তা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয় ।

  
  
 আঙুল রাখলেন ডাক্তার, এখানে কোনও ব্যথা বোধ করেন?

     
বিন্দুমাত্র না।’

     
আমি একটা স্প্রে দিচ্ছি। দিনে দুবার ব্যবহার করলেই পরশুদিন পুরানো হয়ে যাবে।

     
"ধন্যবাদ। পরশুদিন তো অনেক সময় ।

       
না অনেক সময় নয়। আমার যে-কোনও পেশেন্টকে আমি আপনার অবস্থায় আরও দশদিন বাইরে যেতে দিতাম না। এখনও বলছি আপনি দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। এই কথাগুলো বলার সময় ডাক্তার যেভাবে ঘরের অন্য তিনজনের দিকে তাকালেন তাতে স্পষ্ট বোঝা গেল তিনি সমর্থন চাইছেন ।

     
ডেভিড উঠে এল পাশে, ‘ডাক্তার, আপনি ওকে সুস্থ বলবেন না ?

     
দ্রুত মাথা নাড়লেন ডাক্তার, না। একটা বড় পরীক্ষা ওর শরীরে করা হয়েছে। সেটার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্যেও সাতদিন নজরে রাখা দরকার।’

     
ডেভিড কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে হাত তুলে নিষেধ করল আকাশলাল, ‘অপারেশনের পর আটদিন কেটে গেছে। যা কিছু নজরদারি আপনি নিশ্চয়ই করে ফেলেছেন। না পারলে আমার কিছু করার নেই। আপনাকে আমি অনেক আগে বলেছি পরশু সকালে আমাকে রাস্তায় নামতেই হবে। তাই না ডাক্তার?

      
এবার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে ডাক্তার আবার নার্ভাস হলেন। এই মানুষটি মাথার দাম এখন দশ লক্ষ টাকা। একসঙ্গে এত টাকা তিনি কখনও দ্যাখেনি। আজ থেকে একমাস আগে যখন তাকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল তখন লোকটির ব্যক্তিত্ব দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন। এমন কি অপারেশন টেবিলে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে থাকা মানুষটিরও যেন তাকে হুকুম করে যাচ্ছিল। এদেশের মানুষের পক্ষে কথা বলার জন্যে লোকটা মরিয়া, শুধু এই বোধই তাকে বন্দি হওয়া সত্ত্বেও সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

      
তিনি বললেন, কিন্তু আপনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ নন।

     
 ‘আমি জানি। কিন্তু আমি এখন অনেক ভাল ।

      
'যদি আরও দিন দশেক সময় দিতেন-'

     
'অসম্ভব। ডাক্তার, আপনাকে আমি অনেকবার বলেছি আগামী পরশু আমার পক্ষে সবচেয়ে জরুরি দিন । এই শহরে এক লক্ষের ওপর মানুষ জড়ো হবে উৎসব উপলক্ষে। রাস্তাঘাট থিক থিক করবে। এই জমায়েতটাকে আমার প্রয়োজন।' কথা বরতে বলতে উঠে বসল আকাশলাল ।

     
আপনি ভয় পাবেন না। আমি স্বচ্ছদে হেঁটে যেতে পারব। এক কফি হবে?

     
ডাক্তার অবাক হলেন। মাথা নাড়লেন, না। তারপর বললেন, 'আপনার কি মাথায় কোনও যন্ত্রণা হচ্ছে ? অথবা মাথা ধরার মত অস্বস্তি ?

     
সামান্য। ওটা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না।

     
 ডাক্তার কাঁধ বাঁকালেন, এবার আমি ফিরে যেতে চাই।

     
 যাবেন। আপনার অর্ধেক কাজ হয়েছে এখনও অর্ধেক বাকি। আজ থেকে সাতদিনের বেশি আপনাকে আটকে রাখা হবে না। আর আমার ভাগ্য খারাপ হলে আপনার ভাগ্য ভাল হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনি পরশুই চলে যেতে পারবেন।

      
 'আমার পক্ষে ব্যাপারটা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

      
আমি জানি। কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। এই উপমহাদেশে আপনি একমাত্র সার্জেন যিনি কাজটা করতে পারেন। তাই আপনাকে আমাদের প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু আপানার পরিবারের সবাই জানেন যে আপনি সুস্থ আছেন। আপনার লেখা চিঠি তাদের কাছে নিয়মিত পৌছে দেওয়া হয়। ওঁরাও উদ্বিগ্ন নন।’ ’

       
চিঠিগুলো নিশ্চয়ই সেন্সর করেই দেওয়া হয়।" অবশ্য। আপনি নিশ্চয়ই আমাদের ঝুঁকি নিতে বলবেন না!

      
'আপনি জানেন আপনার জন্যে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।’

    
'অনেক টাকা ডাক্তার, মাঝে মাঝে আমারই লোভ হচ্ছে ।"

    
‘লোভ তো আমারও হতে পারে।'

    
"সেটাই স্বাভাবিক।’

    
"আশ্চর্য! আমি এবার আসতে পারি ?

    
'অবশ্য ।" ডেভিড ডাক্তারকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেল । বাইরে যে অপেক্ষায় ছিল সে তৎপর হল। ডাক্তার ঘুরে দাড়ালেন, 'আমি স্প্রে পাঠিয়ে দিচ্ছি।'

    
"ধন্যবাদ। আগামীকাল দেখা হবে ডাক্তার।'

     
ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন । দরজা বন্ধ হল ।

     
এবার তৃতীয়জন কথা বলল, ওরা চাদি হিলসের বাড়িটাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।

   
"সাবাস ।"

 
হায়দার বলল, ‘এর জন্যে ভার্গিসকে বেশ ভুগতে হবে। বাড়িটা মিনিস্টারের প্রেমিকার। বেচারা ।

    
ডেভিড বলল, "এই ভদ্রমহিলাকে কিন্তু আমরা ব্যবহার করতে পারতাম।"

    
আকাশলাল হাসল, সময় চলে যায়নি। তোমাদের ওপর যে সব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেগুলো এখন কি অবস্থায় আছে ? হঠাৎ মানুষটা সিরিয়াস হয়ে গেল।

    
হায়দার বলল, ‘প্রায় শেষ হয়ে গেছে।

   
'প্রায় কেন ?"

    
'শেষ হয়ে গেলে সাধারণ মানুষ এবং সেই সূত্রে পুলিশের নজরে এসে যাবেই, তাই শেষটুকু বাকি রাখা হয়েছে।"

    
'আমার পরিকল্পনার কথা তোমরা তিনজন জানো। সামান্য ভুল মানে আর ফিরে তাকাবার কোনও সুযোগ নেই। যেসব ব্যাপার তোমাদের এখনও সন্দেহ আছে তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।'

     
তরুন উশখুশ করছিল । এবার বলল, আমরা একজনকে আজই আশা করছিলাম। কিন্তু তার শহরে আসার সময়টা নিয়ে গোলমাল হচ্ছে ।

    
'গোলমাল হচ্ছে কেন ?"

    
'ভদ্রলোক এখনও এসে পৌছাননি।' '

     
তিনি কি রওনা হয়েছে ?

    
"হ্যা তাকে আজ বিকেলেও দেখা গেছে নীচে ।'

     
লোকটিকে খুঁজে বের করো। আমার পরিকল্পনার শেযটা ওর ওপর নির্ভর করছে হায়দার। ওকে আমার চাই। পরশু সকালে শেষবার আমরা কথা বলব। ততক্ষণ একেবারে আড়ালে থাকো সবাই ।

      
তিনটে মানুষ চুপচাপ ঘর ছেড়ে গেলে আকাশলাল কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। তিন বছর আগে সবকিছু যেমন উদ্দীপনাময় ছিল এখন তা নেই। সংগ্রামী বন্ধুদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে, কেউ কেউ ভার্গিসের জেলে পচছে। এখন তার সংগঠন যে অবস্থায় পৌছেছে তাতে বিরাট কিছু আশা করা বোকামি। হ্যা, এই দেশের মানুষ তার সঙ্গে আছে এখনও । এই কারণেই নতুন লড়াইয়ের কথা এখনও ভাবা যায়। আর তাই মাসের পর মাস লুকিয়ে চুরিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল তারা। এখনও কিছু অর্থ, কিছু বিশ্বস্ত মানুষ অবশিষ্ট আছে। আকাশলাল জানে, শেষ আঘাত হানার সুযোগ এক জীবনে একবারই আসে। এবং সেই সময়টা এখনই। বুকে হাত রাখল সে। শান্ত স্বাভাবিক। শুধু অপারেশনের লম্বা দাগটাই অস্বস্তির। বুকের ভেতরে একটাই আওয়াজ সেট। অবশ্য দুটো হবার কথাও নয়।

   
   
আশা করি তুমি বলবে না যে তোমারও কিছু বলার আছে! চিবিয়ে বিচিয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন ভার্গিস।

      
তার টেবিলের উল্টোদিকে চার জন কমিশনার র্যাস্কের অফিসার পাথরের মত মুখ করে দাড়িয়ে, ওঁদের থেকে খানিকটা আলাদা হয়ে এ সি সোম মাথা নিচু করে চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষা করছে। পুলিশ কমিশনারের ব্যঙ্গ উপেক্ষা করল একটু মরিয়া হয়েই, ‘আসলে ভুল হয়ে গিয়েছিল!

       
ভুল ? এটাকে ভূল বলা যায়? মিথ্যে কথাকে কোন অভিধানে ভূল বলা হয়েছে সোম? তুমি কিছু দ্যাখেনি। ওই বাড়ির জানালায় কোনও মানুষ আসেনি। কিন্তু তুমি গল্প বানিয়ে আমাকে বোকা বানালে । অথচ সেখানে পৌছে আমরা জঘন্য চিঠিটা পেলাম । তুমি কি করে জানলে ঠিক ওই বাড়িতেই চিঠিটা থাকবে?

     
‘আমি জানতাম না স্যার।'

       
জানতে । আমি যদি বলি তুমি ওই লোকটার হয়ে কাজ করছ?

     
"আমি ? চমকে উঠল সোম ।

      
হ্যা। নইলে ওই চিঠিটার কাছে আমাকে নিয়ে যাবে কেন? হাতের উল্টো পিঠ গালে ঘসলেন ভার্গিস, পুলিশ কমিশনারের চেয়ারটার ওপর একটা সেপাইয়ের লোভ থাকবে, তোমাকে আর কি দোষ দেব! তবে সেখানে বসতে গেলে বুদ্ধিটা ধারালো হওয়া দরকার। সত্যি কথাটা বলো।’

    
‘আমার বোকামি স্যার। আপনার সঙ্গে শহর দেখতে যাওয়ার সময় গেটে একটা লোককে ঝামেলা করতে দেখেছিলেন, মনে আছে নিশ্চয়ই। লোকটা দাবি করছিল যে, সে চিতাকে চাদি হিলসের ওই বাড়িতে দেখেছে।' সোম ঢোক গিলল ।

      
মাই গড: সঙ্গে সঙ্গে দশ লক্ষ টাকার লোভটা ছোবল মারল তোমাকে। আমার কাছে কৃতিত্ব নেবার জন্যে বানিয়ে বললে গল্পটা ?”

     
‘আজ্ঞে হ্যা স্যার।’

     
‘লোকটা কোথায় ?"

        
সোম সহকমীদের দিকে তাকাল। একজন অফিসার নিচু গলায় জবাব দিল, চিঠিটা পাওয়া মাত্র ওর সন্ধান নেওয়া হয়েছিল-'

     
‘পাওয়া যায়নি ? চিৎকার করলেন ভার্গিস।

       
হ্যা স্যার।'

     
"সেপাইদের অ্যারেস্ট করো।"

       
স্যার, সেপাইরা বলছে ওদের ওপর অর্ডার ছিল একটু আধটু ধোলাই দিয়ে ছেড়ে দিতে। এ সি সোম অর্ডারটা দিয়েছিলেন।'

     
"আচ্ছা! দশ লাখের ভাগিদার রাখতে চাওনি!'

     
"আই অ্যাম সরি স্যার!'

       
বুলডগের মত মুখটায় আরও ভাঁজ পড়ল, সোম মিনিস্ট্রি তোমাকে স্যাক করেছে। আমি তোমাকে জেলে পুরব । কিন্তু তবু তোমাকে একটা সুযোগ দিতে চাই। ফাইন্ড হিম, দুদিন সময় দিলাম। চাকরিটা পাবে না। কিন্তু প্রাণে বেঁচে যেতে পার। তোমাকে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় এ জীবনে দেখতে চাই না। মনে রেখো, দু-দিন। গেট লস্ট। এই দুদিন যেন তোমার মুখ দেখতে না পাই!’

      
‘ওকে মানে চিতার কথা বলছেন ? সোমের গলা স্বর থেকে বের হচ্ছিল না।

         
ভার্গিস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। ঝুঁকে টেবিলে কিছু খুঁজলেন। তারপর সেটা পেয়ে এগিয়ে এলেন, সোমের সামনে। সোম আরও কুঁকড়ে দাঁড়াল। টানটান হয়ে দাড়িয়ে ভার্গিস জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার পিঠটাকে দেখতে কেমন ?

      
‘পিঠ ? কখনও দেখিনি স্যার।’

      
'চেষ্টা করেছ কখনও ?

      
' না স্যার ' .

      
'চেষ্টা করো। এই আয়নাটা নাও। দুই ইঞ্চি আয়না। যেটা কখনও সরাসরি পারবে না সেটা অন্যের সাহায্য নিয়ে করতে চেষ্টা করো। চিতা তোমার পক্ষে আকাশকুসুম সোম, তুমি ওই লোকটাকে খুঁজে বের করো। আয়নাটাকে সোমের হাতে গুজে দিয়ে ভার্গিস চটপট ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে । তারপর ইশারা করলেন বেরিয়ে যেতে ।

        
প্রথম সোম পরে অফিসাররা বেরিয়ে গেলে রুমালে মুখ মুছলেন তিনি। হয়ে গেল। সারা জীবনের জন্যে সোমের বারোটা বেজে গেল। আর সি পি হবার স্বপ্ন দেখতে হবে না ওকে। দুদিন পরে জেলের সবচেয়ে খারাপ সেলটা ওর জন্যে বরাদ্দ করতে হবে । মিনিস্টারের দাতের ব্যথা এখন নিশ্চয়ই বেড়ে যাবে। চালাকি। তিনি টেলিফোন তুললেন। অ্যানাউন্স করে দাও এসি সোমকে স্যাক করা হয়েছে। ও আর ফোর্সে নেই।

আরাম করে চুরুট ধরালেন ভার্গিস । হঠাৎ তার মনে হল সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। লোকটা তাকে ফোন করবে পরশু সকাল নটায় । কেন ? নিশ্চয়ই কোনও মতলব আছে এর পেছনে। এত সাহস লোকটার কখনও হয়নি। হঠাৎ মনে হল সোমের সঙ্গে লোকটার যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভাবনাটাকে বাতিল করলেন তিনি। সোম বোকা এবং পদের জন্যে আর এবার টাকার প্রতি লোভ দেখালেও ফোর্সের সঙ্গে কখনই বিশ্বামঘাতকতা করবে না । পরশু সকাল পর্যন্ত লোকটার ফোনের অপেক্ষা করলে তার হাতে আর সময় থাকবে না। চিঠিটা যখন এখানেই পাওয়া গিয়েছে তখন খুবই স্বাভাবিক সে শহরেই আছে। তারই নাকের ডগায় অথবা পিঠের মাজখানে যেখানে তার হাত পৌছাচ্ছে না।

        
এই সময় টেলিফোন বাজল। অপারেটারের মাধ্যমে নয় সরাসরি লাইনটা এসেছে। ভার্গিস রিসিভার তুললেন, ‘হ্যালো!

       
ভার্গিস। সোমের কোর্টমার্শাল কবে ? মিনিস্টারের ছিমছাম গলা ।

     
‘কোর্টমার্শাল ? ভার্গিস ঢোক গিললেন, "এখনও ঠিক করিনি।'

     
'বোর্ড চাইছে না ও আর বেঁচে থাকুক।

     
“কিন্তু স্যার, ও একটা ভুল করেছে

     
‘দ্যাটস অর্ডার ।"

     
“কিন্তু আমার নেক্সট ম্যান-”

      
নেক্সট ? নেক্সটের নেক্সট থাকে ।" লাইনটা কেটে গেল ।

      
ঘাম মুছলেন ভার্গিস। টেলিফোনে খবর নিলেন সোম এখন কোথায়! জানলেন সোম এইমাত্র সিভিল পোশাকে হেডকোয়ার্টাস ছেড়ে চলে গেছে।

      
আরও মিনিট পনের অপেক্ষা করলেন ভার্গিস। তারপর হুকুম করলেন সোমের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শালের ব্যবস্থা নিতে ।