পুরুষ - Purush by রত্না চক্রবর্তী - Ratna Chakraborty , chapter name বাই

বাই

আমাকে আমার বাবা মা যখন দত্তক নিয়েছিলেন তখন আমার বয়স তিনমাস।শুনেছি অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছিলেন আমার বাবা মা।কেন এনেছিল? না নি:সন্তান বলে আমায় নিয়ে আসেনি ওরা।ওদের আগেই একটা ছেলে ছিল।তবু কেন এনেছিল?ওদের বড় ছেলে সুনন্দ গোস্বামী আর এই  সম্পত্তির দেখাশোনা করার জন্য।কারণ ওদের বড় ছেলে ঠিক স্বাভাবিক নয়।ছোট থেকে এটা শুনেই আমি বড় হয়েছি।আমার সামনেই মা বলত-"সুনন্দটাকে বড় হলে কে দেখবে বল?একটা আপনজন তো চাই।আমার অনিন্দ্যকে তাই ভগবান পাঠিয়েছেন।"এখন ভাবলে হাসি পায়।আপন জন কি কেয়ার টেকারের প্রতিশব্দ?হ্যাঁ কেয়ার টেকারই তো।তা যদি না হত তবে নিজের সন্তানের জন্য বাবা মা যা যা করেছে সেগুলো কি করতে পেরেছে না করেছে আমার জন্য।সুনন্দ গোস্বামীর জন্য দামী প্রাইভেট ডাক্তার।আমার বেলা পাড়ার সাধারণ এম.বি.বি.এস।সুনন্দ গোস্বামীর এক একজন টীচার পার সিটিং এ ২০০ টাকা ঘন্টা পিছু নেয়।বাবা মা ওই হাবা ছেলের জন্য এইভাবে পয়সা ঢেলেছে।আর আমার জন্য কোচিং।যুক্তি অবশ্য ওদের ছিল।সুনন্দ নামের পাগলটার জন্য এত খরচ।ও তো অসুস্থ।তাই সেই দায় মাথায় নিয়ে আমার ভাগে সবকিছু কম।মেনে নিতে পারতাম আমি।কিন্তু নাটকটা সহ্য হত না।ছেলের নাটক।আমি নাকি ওদের ছোট ছেলে। দয়া করেছে আমার অনিন্দ্য নামের পাশে গোস্বামীর সারনেমটা ব্যবহার করতে দিয়ে।কিন্তু বলতে পারেন আমি কেন কৃতজ্ঞতায় গদগদ হব?কি পেয়েছি আমি এদের থেকে?সারা জীবন শুধু শুনে এসেছি সুনন্দ গোস্বামীর জন্য আনা হয়েছে আমাকে।কেন?না বাবা মায়ের অবর্তমানে কে দেখবে পাগলটাকে।আরে বাবা এত যখন চিন্তা এসাইলামে দে।আমার ঘাড়ে এই বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কেন?মা মাঝে মাঝেই চোখ মুছে বলত-"সনু'র যা অবস্থা।ওর তো শরীরে কিছু নেই।হার্ট এত দুর্বল।ভয় হয় আমি থাকতে থাকতে যেন ওর কিছু না হয়।আমি যে সহ্য করতে পারব না ঠাকুর।"

  ছোট্ট বেলায় ওই পাগলটা যাকে আমায় ডাকতে শেখানো হয়েছে দাদা, সে তার বাঁকা বাঁকা আঙ্গুল গুলো দিয়ে আমার গায়ে হাত বুলাতো আর দাঁত বার  করে জড়ানো গলায় বলত-"বাই,বাই।" আমার ভাল্লাগ তো না।সরিয়ে দিতাম।কিন্তু ওই পাগলটা জ্বলজ্বলে চোখে দাঁত বার করে আবার আমার মুখের কাছে মুখ এনে বলত-"বাই বাই"।ধাক্কা দিয়ে দিয়েছিলাম একদিন।সে জন্য মা বাবা পাড়া প্রতিবেশী সবার সব্বার কাছে কত কথা শুনতে হয়েছিল।সবচেয়ে রাগ হত মায়ের কথা শুনে।দত্তক নিলেও মা তো মাই।মা কেন দাদাকে সাপোর্ট করত সবসময়?কেন বুঝত না আমার ভাল্লাগে না পাগলটার সাথে খেলতে।আমার ইচ্ছা করে বাইরে গিয়ে পার্কে আমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে।কিন্তু পাগলটা যেতে পারত না বলে আমারো যাওয়া বন্ধ।

আমিও পড়াশুনায় ভালো ছিলাম।ফার্স্ট থেকে ফিফথ পোজিশানের মধ্যে থাকতাম বরাবর।মা বাবা খুশী হত না তা নয়।কিন্তু যখন পাগলটা ট্যারা ব্যাঁকা করে দুটো শব্দ লিখত মা ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করত।বাবা গিফট দিত।একবার মাকে বলেছিলাম-"ভারী তো দুটো শব্দ লিখেছে দাদা।আমি ঢের ভালো লিখতে পারি।"

মা চুপ করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।তারপর হঠাৎ জড়িয়ে ধরেছিল আমায়।আমার কেমন কান্না পেয়ে গিয়েছিল।মা আমাকে আদর করলেই আমার এমন হত।মা বলেছিল-"অনি বাবা তুমি তো সুস্থ বল।দাদার কত শরীর খারাপ তুমি তো জানো।ওর আঙ্গুল বাঁকা।তাই এই দুটো কথা লিখতেই ওর কত কষ্ট হয়েছে বল।ওকে তো মোটিভেট করতে হবে।"আমি চুপ করে থাকি।কিন্তু মনে মনে ভাবি আমি সুস্থ সেটা কি আমার দোষ।আমারও তো ইচ্ছে করত প্রাইজ পেতে।কই এত আনন্দ তো পেত না কেউ, ওর জন্য যা পেত লোকে।আচ্ছা,অসুস্থ হওয়াটা কি কোয়ালিফিকেশন?

তবু একরাশ বিরক্তি নিয়ে ছিলাম একরকম।ছোটবেলায় যেগুলো বলে ফেলে সবার জ্ঞান শুনতে হত একটু  বড় হতে সেগুলো লুকিয়ে রাখতে শিখে গিয়েছিলাম।বুঝতে দিতাম না আমার ঘেন্না ওই পাগলটার জন্য।কিন্তু ভিতরে ভিতরে গা গুলিয়ে যেত পাগলটার "বাই বাই "ডাকটা শুনলে। আমি যত এড়াতে চাইতাম ও তত আমার কাছেই আসত, দিনরাত বাই বাই করে পাগল করে দিত।

হয়ত এভাবেই ঘেন্না করে পাশাপাশি থেকে কেটে যেত।কিন্তু ও যে আমার চরম শত্রু সেটা বুঝে গিয়েছিলাম থার্ড ইয়ার পাশ করার পর।কলেজে ঢোকার পর আমার একটা নিজস্ব জগত তৈরী হয়েছিল।বন্ধুদের নিয়ে বেশ মজায় থাকতাম।এই রকমই একদিন আলাপ হয়েছিল গুঞ্জার সঙ্গে।মিষ্টি মেয়েটা কি করে যে আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারি নি।কলেজে বিশেষ কেউ জানত না আমার ব্যাপারে বা আমার পরিবারের ব্যাপারে।গুঞ্জাকে সব বলেছিলাম।ওর চোখে জল এসেছিল  আমার জন্য।আমার জন্য প্রথম কেউ আমায় প্রাওরিটি দিয়ে ভাবছে।কলেজের ওই তিনটে বছর আমার জীবনের স্বর্ণালী সময়।অদ্ভুত ব্যাপার জানেন, তখন না দাদার উপর রাগটাও এতটা হত না। আসলে ভালোবাসা নিয়ে যে ট্যাগ অফ ওয়্যারটা আমার আর দাদার মধ্যে চলছিল, গুঞ্জা সেই যুদ্ধে আমায় জিতিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু থার্ড ইয়ারের পর গুঞ্জা ওর বাড়িতে সবকিছু জানালো।গুঞ্জার বাবা মা,আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন।গুঞ্জার বাবার আমাকে অপছন্দ হয় নি।কিন্তু যে মুহুর্তে শুনলেন আমি দত্তক সন্তান, আমার অরিজিন অনাথাশ্রমে আর আমার বাড়িতে একটি পাগল দাদা আছে মুখ গম্ভীর হয়ে গেল তার।

গুঞ্জা খুব কেঁদেছিল।বলেছিল-"বাবা বলেছেন তোমার সাথে বিয়ে দেবেন না।পাগল দাদার দায়িত্ব নিই আমি, এটা বাবা ভাবতেই পারছেন না।না দিন।কিন্তু আমিও তোমার ছাড়া অন্য কারো হতে পারব না। আমি সারাজীবন বিয়েই করব না।"

সেদিন রাগে মাথা আগুন হয়ে গিয়েছিল।বাড়ি এসে তছনছ করে ছিলাম সবকিছু।পাগলাটা ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে ডাকছিল-"বাই এ বাই..বাই লেগে গেতে। "ইচ্ছে করছিল ওর মাথাটা দেওয়ালে সপাটে ঠুকে দিই।বাবা আমার এইচ.এসের সময়ই মারা গিয়েছিল।মনে মনে ভাবি- "মা যতদিন আছে জাস্ট ততদিন।তারপর পাগলটাকে এসাইলামে পাঠাব। "মা বলে ওর নাকি বেশীদিন আয়ু নেই। কিন্তু  কবে মরবে ও বলতে পারেন?ও-ই ও-ই আমার একমাত্র পথের কাঁটা।মনে মনে বলি-"বের করব আমি কাঁটা,কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলব।আমার জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।আমি দেখতে পাচ্ছি।কিন্তু কিচ্ছু করতে পারছি না।হে ঈশ্বর বলতে পার কি করে এই কাঁটা সরবে আমার জীবন থেকে?"

পথটা পেয়ে গেলাম খুব তাড়াতাড়ি।আমি আমার ঘরে শুয়ে গান শুনছিলাম।ইদানীং পাগলটা বুঝতে পারে যে আমি ওকে পছন্দ করি না।তাই খুব একটা কাছে ঘেঁষে না।কিন্তু আজ ওর কি হল কে জানে নিজে থেকেই আমার ঘরে এল।ওর সরু লিকলিকে আঙ্গুলে ছোটবেলার মত আমায় সুড়সুড়ি দিতে চেষ্টা করল।আমি এক ঝটকায় সরিয়ে দিলাম ওকে।ও দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বলতে লাগল-"বাই বাই"।আবার উঠে এসে আমায় কাতুকুতু দিতে চেষ্টা করল।আমি ওকে ধাক্কা দিলাম।পরে গিয়ে একটানা করুণসুরে ঘ্যানঘেনে কাঁদতে লাগল।আমি বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলাম।আর তখনই শুনলাম ভিতরে মর্মান্তিক চিৎকার করছে দাদা।ছুটে ঘরে গিয়ে দেখি ওর মুখ সাদা হয়ে গেছে।চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।হাঁফরের মত শ্বাস নিচ্ছে।আমি কাছে গিয়ে বললাম -"কি হয়েছে?কি হয়েছে?এরকম করছ কেন?"কিছু বলতে পারছে না।ব্যঁকা আঙ্গুল তুলে সামনে দেখালো।দেখলাম একটা আরশোলা হাত চারেক দূরে বসে শুঁড় নাড়াচ্ছে। আমি টেবিলের নীচ থেকে ঝাঁটা নিয়ে ওটাকে তাড়ালাম।কিন্তু দাদাকে স্বাভাবিক করার জন্য সেদিন ডাক্তারকাকুকে বাড়িতে ডাকতে হল।ডাক্তারকাকু ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেলেন।মাকে বললেন-"দেখুন ওর হার্ট তো দুর্বল।এরকম ভয় পাওয়া ওর জন্য ভালো নয়।"

রাতে গুঞ্জা ফোন করল।ও ফোনে কাঁদছিল।ওর বাবার সাথে আজ খুব ঝামেলা হয়েছে ওর।ওর বাবা ওর জন্য সম্বন্ধ স্থির করেছেন।গুঞ্জা বলেছে    যে  কিছুতেই বিয়ে করবে না।আমি ভাবি কতদিন গুঞ্জা পারবে এইভাবে আটকাতে।কিছু একটা করতেই হবে।ডাক্তারকাকুর কথাগুলো কানে ভাসতে থাকে।

কাল কালিপূজো।ডাক্তারকাকু থাকবেন না।মায়ের নিমন্ত্রণ আছে পাড়ার এক কাকীমার বাড়ি।আমি এংলো পাড়ার পুরানো একটা দোকান থেকে একটা হেলোজেনের মুখোশ কিনলাম।বাজীর শব্দে পাগলটা কান চাপা দিয়ে শুয়ে থাকে এমনিতেই।মা বারবার বলে গেছে ওর পাশে বসে থাকতে।আমি ওর কেয়ার টেকার কিনা।আমি আমার ঘরে গিয়ে কালো কোটটা পরে নিলাম।মুখে মুখোশটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল এরকম চেহারা দেখলে আমারও ভয় করত।দাদার ঘরে আগেই হালকা আলো জ্বেলে রেখেছিলাম।আস্তে আস্তে ওর ঘরে এলাম।আমায় দেখে ওর চোখে ফুটে উঠল আতংক।ওর মুখ সাদা হয়ে যাচ্ছে।ও হাঁফরের মত হাফাচ্ছে।বিস্ফারিত চোখ।আমি এগিয়ে যাচ্ছি ওর দিকে।ও চিৎকার করে উঠল-"বাই বাই। বাঁচা বাই।"খাট থেকে পরে যাচ্ছে ও।প্রাণপপনে ডাকছে আমায়।মাকে নয়, ডাক্তারকাকুকে নয়, তার 'থাকুরকেও' নয়, আমায় ডাকছে ও।আমার যেন কি হয়ে গেল।ছুটে পালিয়ে এলাম নিজের ঘরে।মুখোশটা খুলে ছুঁড়ে ফেললাম।কোটটাও খুলে ছুটে গেলাম দাদার ঘরে।পরে গেছে ও।শক্ত হাতে জড়িয়ে তুলে নিলাম ওকে।বললাম-"ভয় নেই আমি তো আছি।"দাদা খামচে ধরেছে আমার হাত।নখ ফুটে যাচ্ছে।আমি ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলাম।বললাম-"কোন ভয় নেই।কোন ক্ষতি হতে দেব না তোমার।আরশোলাটার মত সব খারাপ দূর করে দেব।"দাদা তখন গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলে চলেছে-"বাই বাই।বাঁচা।"আমি তখন মোবাইলে ফোন করে চলেছি ডাক্তার কাকুকে। ডাক্তারকাকু তো নেই, আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম আমি ছুটে বেরিয়ে এলাম বাড়ি খোলা রেখে, আমি ছুটছি..... আমি ছুটছি.....একটা ডাক্তার চাই, নয়ত হাসপাতাল,  দাদাকে বাঁচাতেই হবে....।