মরলে বাঁচি
মহা হৈচৈ চলছে মিত্তিরদের বাড়ি। এমনিতেই ও বাড়ি কলহপ্রিয়ার বাড়ি বলে খ্যাত। বংশপরম্পরায় এরা কলহের জন্য খ্যাত, শোনা কথা বর্তমান মিত্তির গিন্নীর দিদিশ্বাশুড়ী সংঘাতিক ঝগড়াটে ছিলেন, তার শ্বাশুড়ির কথা এখনও লোকে ভোলে নি, আর ইনি.... সবার সেরা। তা এ হেন মিত্তির বাড়িতে লোক গিয়ে জড়ো হচ্ছে কারণ মিত্তির গিন্নীর যে চিরন্তন বুলি "আর সয় না, মল্লে বাঁচি " কথাটিকে সত্যিতে পরিণত করার জন্য মিত্তির গিন্নী তাদের বাড়ির পিছন দিকের পচা কুয়োয় ঝাঁপ দিতে যাচ্ছেন আর বড়ছেলে আর মেয়ে তাকে দুহাতে জড়িয়ে হাঁউমাঁউ করে চেঁচিয়ে কাঁদছে। মিত্তির গিন্নী তার সরু তীক্ষ্ণ গলায় চিল চিৎকার করছেন " আমায় ছাড়, আজ আমায় কেউ রুখতে পারবে না। হারামজাদা মিনসে সারাটা জীবন হাড়েমাসে ভাজা ভাজা করে খেলে, বুড়ো বয়সেও জ্বালিয়ে মারছে, নিজে হচ্ছে না এখব ছোটছেলে আর শয়তানী বৌয়ের সাথে জোট বেঁধে আমার পেচোনে লাগার উজ্জুগ করচে, এ আমি বেঁচে থাকতে হোতে দেব না, আজ আমার জীবনের শেষ দিন.. " মিত্তিরবাবুর বড় বৌ বড়ছেলে এ বাড়িতেই আছে। বড় বৌ গিন্নীর সইমার নাতনী। আর ছোটছেলে ছোটজাতে প্রেম করে বিয়ে করেছে বলে মিত্তির গিন্নী ঢুকতে দেন নি। এখন ছোটছেলে বাপকে জপিয়েছে পিছনের জমিটুকুতে সে একটা ঘর তুলে নেবে, ওখানেই থাকবে, আলাদা রেঁধে নেবে, মার রান্নাঘরে ঢুকবে না। মিত্তিরবাবু রাজী হয়েছেন। গিন্নীর ভাষায় " হ্যাংলা বুড়ো ডাবরের চবনপ্রাশ, কড়াপাকের সন্দেশ, ইলিশ মাছের পেটি ভাজা ছোট বৌএর থেকে ঘুষ খেয়ে শয়তানী করছে , ওই ডাইনী বৌকে ঢোকাচ্ছে। ও মদ্দানে মেয়েমানুষকে কেউ ঘরে আনে? বেটাছেলে মার্কা মেয়েছেলে " মিত্তির কত্তার মেজাজ চড়েছে বাজখাঁই হেঁড়ে গলায় হাঁক ছেড়েছেন " এ তোমার বাপের সম্পত্তি? এ আমার জমি, আমার যাকে ইচ্চে হয় দিয়ে যাব। মেয়েমানুষের কতায় উটবো বসবো সে বান্দা নরহরি মিত্তির নয় " ভাবা যায় মিত্তির গিন্নীর বাপ তোলা!! এরপরও কুরুক্ষেত্র না বাঁধাই অস্বাভাবিক।
পাড়ার লোক উঁকি মারছে, বাগানের মেন গেটে তালা বলে ঢুকতে পারছে না। মিত্তির গিন্নীর মুখকে সবাই ডারায়। কেউ একজন ছুটেছে ছোটছেলে বউকে ডেকে আনতে। কেউ আশঙ্কা করছে কি ভয়ানক ঘটনা ঘটতে চলেছে, কেউ মজা দেখছে। ছেলে মেয়ে দশাসই মিত্তির গিন্নীকে টেনে ধরে রাখতে পারছে না। ছেলেমেয়েরা বাপের মতো খেঁকুড়ে, বেঁটে রোগা রোগা চেহারার। মেয়ে আর বৌ চেঁচিয়ে উঠল " ও বাবা এসে ধর না, কেলেঙ্কারি না করে ছাড়বে না তোমরা? " নরহরি মিত্তির খ্যাঁকখ্যাঁক করে বলল " ধরতে না পারিস ছেড়ে দে, গিলে গিলে যা গতর বানিয়েছে, ও মজা কুয়োয় আটকে যাবে নিচে ঢুকবে না। " যদিও বা মিত্তির গিন্নীর গতি একটু শ্লথ হয়েছে, এবার তা তীব্রভাবে বেড়ে গেল। রাগে ওই মোটা শরীরে ধেই ধেই করে হাত পা ছুঁড়ে প্রায় নাচতে লাগলেন। বড় বৌএর বাচ্চা হবে বলে সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করছিল কিন্তু ভয়ে কাছে আসে নি। এবার মিত্তির গিন্নীর হাতপা ছোঁড়ায় তার রোগা পটকা মেয়ে প্রায় উড়ে এসে পড়ল তার ঘাড়ে, সে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। আর মিত্তির গিন্নী ছুটলেন কুয়োর দিকে তার টানে তার বড় ছেলেও মার হাত ধরে ঘেষটাতে ঘেষটাতে চলল। এদিকে ছোট ছেলে আর বৌ এসে পড়েছে। তারা হৈ চৈ দেখে দরজা খোলা না পেয়ে পাঁচিল টপকালো। ছেলে ছোটখাটো হলেও বৌ শ্বাশুড়ির মতোই লম্বা চওড়া।
মিত্তির গিন্নী ততক্ষণে কুয়োর ধারে ছুটে পৌঁছে গেছে। তখনই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। হঠাৎই মিত্তির গিন্নী " ওরে সব্বোনাশ রে "করে চিৎকার করে উঠল। ধড়ফড় করে পিছিয়ে এল। তখনই বড় ছেলে " ওরে শাল্লা, এ যে যমরাজ, গোখরো গো।" সে উল্টো দিকে দৌড় দিল। ততক্ষণে সবাই আতংকের সঙ্গে দেখল কুয়োর ভিতর থেকে উঠে এসেছে একটা সাপ। সাপটা ফণা তুলে দুলছে। "ওরে বাবারে মেরে ফেললে গো, বাঁচাও বাঁচাও " বলে, " গিন্নী মোটা শরীরে দৌড়ে পিছন ফিরে পালাতে গিয়ে সপাটে আছাড় খেলেন মাটিতে পড়ে থাকা এক মরা গাছের গুঁড়িতে। কাদায় পড়ে আর উঠতে পারলেন না। সাপটা তখনও দুলছে। তড়াক করে লাফিয়ে নামলেন উঠোনে নরহরি মিত্তির, হাতের লাঠি নিয়ে ' গেল গেল রে ' করে ছুটলেন গিন্নীর দিকে কিন্তু তার বিক্রম থাকলেও গিন্নীকে টেনে তোলার ক্ষমতা ছিল না। সবাই রুদ্ধশ্বাস আতঙ্কিত, সাপটা এবার ফণা গুটিয়ে কুয়ো পাড় থেকে নেমে আসছে মাটিতে। এতদিনে সত্যি যাচ্ছে মিত্তির গিন্নী। আসরে তখন নামলো ছোট বৌ, সে কোমরে আঁচল জড়িয়ে ছূটে এসে হ্যাঁচকা টানে শ্বাশুড়িকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। স্কুলে সব রকম খেলাধূলায় সে এতদিন ধরে অনেক ট্রফি জিতেছে এবার সংসারের ট্রফিটাও বোধহয় মেরে দিল। শ্বাশুড়ি হাঁফাতে হাঁফাতে চোখ বড় বড় করে তাকাল তারপর জ্ঞান হারালো। তখন লাঠি নিয়ে সাপ তাড়াতে লেগেছে নরহরি। হেঁড়ে গলায় ছেলেদের ডেকে বলছে " ওরে হাঁদা গঙ্গারামগুলো, ওরে শূয়ারেরা শিগগীর যা, সিঁড়ির তলায় কার্বোলিক এসিড আছে নে আয়। অকালকুষ্মাণ্ডগুলোর কোন বুদ্ধি শুদ্ধি হচ্ছে না। "
এখন পাড়ার লোক বুঝে গেছে এতদিনে মিত্তির বাড়ির যোগ্য উত্তর পুরুষ থুড়ি মহিলা এসে গেছে। মিত্তির গিন্নীর সেই থেকে তত গলা শোনা যায় না কিন্তু ছোট বৌ শ্বাশুড়ির জায়গা নিয়ে নিয়েছে, ঘর সংসার, হেঁসেল আর শ্বাশুড়িকে এখন সামলায়। গলা সমানই চলছে, চলবে।।