আগুনপাখি by হাসান আজিজুল হক, chapter name রাখাল যেমন করে গরু ডাকিয়ে নিয়ে যায় তেমনি করে এই একটো-দুটো

রাখাল যেমন করে গরু ডাকিয়ে নিয়ে যায় তেমনি করে এই একটো-দুটো

একটো-দুটো মানুষই ঘরো ভালোমানুষদের ডাকিয়ে নিয়ে গাড়ায় ফেলে। শহরগঞ্জেই এমন খারাপ মানুষ বেশি বোধায়। দাঙ্গাহাঙ্গামা সব সোমায় শহরেই শুরু হয় এই লেগে। গাঁয়ের মানুষ শহরে গেলে সব ভুলে যায়, তার পাড়াপড়শি থাকে না, ভাইবন্ধু থাকে না। সে কাউকে চেনে না। পাশের বাড়িতে যে থাকে তাকেও লয়। ছোট দ্যাওরের শহরের বাসায় দু-একবার গেয়েছি বটে কিন্তুক কিছুতেই জান টেকে নাই।

হিঁদু-মোসলমানের হিড়ি যেদি পাড়াগাঁয়েই চলে এল, তাইলে টাউন শহর কি বাদ থাকবে? ঠিক, একদিন খবর এল, মউকুমা টাউনের ইসুফ মিয়েকে তার নিজের বাড়ির ভিতরে যেয়ে মেরে এয়েছে হিঁদুরা। খুব নাম করা মোকাদিম এই ইসুফ মিয়ে। তার চামড়ার ব্যাবসা। মোসলমানদের মদ্যে তো বটেই, হিদুঁদের মদ্যেও এমন আবস্তাপন্ন মানুষ বেশি নাই। নিজেদের গাঁয়ের বাড়িতে সে থাকে না। ব্যাবসার লেগে শহরে একটো বেরাট রাজবাড়ির মতুন বাড়ি বানিয়েছিল। সিদিন সে বসে ছিল বাইরের ঘরে। একই ছিল। এই সোমায় পাঁচ-সাতজনার একটি দল সিং-দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকল। তাদের হাতে টাঙি, খাঁড়া, রামদা— এই সব। অ্যাই, অ্যাই, কে, কে, কি চাই, বাড়ির চাকরবাকররা এইসব বলতে বলতেই তারা বাইরের ঘরের পাকা বারেন্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। শোনলম, ইসুফ মিয়ে চোখ তুলে তাকিয়েই দলটোকে দেখতে পেয়েছিল। সাবধান হবার কুনো সোমায় পায় নাই। সে উঠে দাঁড়িয়ে তোমরা কারা, কি চাই— শুদু এই কথাটি বলতে পেরেছিল, তখুনি তার ঘাড়ে পড়ল পেথম খাঁড়ার কোপ।

তাপর জান-পরান দিয়ে ইসুফ মিয়ে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে ছুটে পালাইছে, গায়ে মাথায় পড়ছে দুদ্দাড় করে লাঠির বাড়ি। ঝুঁঝিয়ে রক্ত ঝরছে সব্বাঙ্গ দিয়ে আর গোটা দলটো আসছে তার পেছু পেছু। ই ঘর উ ঘর, কতো ঘর ই বাড়ির তার হিশেব নাই। ইসুফ মিয়ে একবার পালঙ্কের আড়ালে লুকুইছে, একবার আলমারির পেছনে দাঁড়াইছে, নাই, রক্ষা নাই, টাঙ্গি খাঁড়া লাঠি সব এক সাথে চলল। শ্যাষে রান্নাঘরে ঢুকে আর কুনোদিকে সে যেতে পারলে না, হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। দেখতে দেখতে খাঁড়া টাঙি রামদায়ের কোপে ইসুফ মিয়ের শরীল সাত টুকরো হয়ে চারিদিকে ছিটিয়ে পড়ল।

আমি নিজে তো যাই নাই, নিজের চোখে দেখিও নাই, কিন্তুক এই বেবরণ শুনেই আমি যেন সব ঘটনা চোখের ছামনে দেখতে প্যালম। তারপর থেকে খালি ওয়াক দিতে লাগল প্যাটের ভেতর। কিছু খেতে গেলেই বমি আসছে। কিন্তুক কিছুতেই বমি হচে না। রেতে ঘুমুইতে যেয়ে চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পেচি ইসুফ মিয়েকে একদল লোক একসাথে কোপাইছে।

সত্য আর ইসুফ মিয়ের মিত্যুর বেত্তান্ত শোনবার পর ভেবেছেলম আর হয়তো এমন খবর কুনোদিন শুনতে হবে না। তাই কি কখনো হয়? আমি শুনছি না, জানছি না বলে কি দাঙ্গা বন্ধ হবে? শুনতে চাই নাই তবু কদিন বাদেই শুনতে প্যালম পাশের গাঁয়ের মোসলমানদের একটি ছেলে জেলার বড় শহরে স্কুলে পড়ত। আমার খোঁকার বয়েসি। মনে হচে যেন দেখেছি ছেলেটিকে, খোঁকার সাথে একবার দুবার এয়েছে ই বাড়িতে। সে মোকাদিম বাড়ির ছেলে না হোক আবস্তাপন্ন গেরস্থ ঘরের ছেলে বটে। শহরে তাদের নিজেদের ছোট বাড়িতে সেই সোমায়ে সে একই ছিল, আর কেউ ছিল না বাড়িতে। একদিন দোপর বেলায় আজরাইল এল তার জান কবচ করতে। কোথাও পালাইতে পারলে না। ছুটে যেয়ে বাড়ির খাটা পাইখানায় লুকিয়েছিল। সেইখানেই খাঁড়া বগী ছোরা ছুরি কিরিচ নিয়ে একদল হিঁদু যেয়ে তাকে কেটে কুচি কুচি করলে। আহা, জড়াপুটুলি পাকিয়ে পায়খানা-ভরা পাতনাতেই সে মুখ গুঁজে মরে পড়ে থাকল।

এই দুটি ভায়ানক খবরের পরে আমার দ্যাওর আর গাঁয়ের সব মোসলমানরা বলতে লাগল, মোসলমান সব মেরে শ্যাষ করবে হিঁদুরা, দ্যাশে একটি মোসলমানকে আর তারা বাঁচিয়ে রাখবে না। বিশেষ করে দ্যাওর-রা এক-একদিন এক-একটি গুজব নিয়ে আসতে লাগল। কুনোদিন এসে বলছে, সাত গাঁয়ের হিঁদু এক হয়েছে, মা কালীর পুজো দিয়ে কপালে সিঁদুর লেপে খাঁড়া হাতে করে তারা সব সাঁঝরেতে ই গাঁয়ে এসে হামলা করবে মোসলমানদের ওপর। কুনোদিন বলছে, অত সোজা হবে না, মোসলমানকে যারা চেনে নাই, তারা চেনে নাই। পাশের মোসলমান গাঁয়ের সব মোসলমান আজ সেজে আসছে। আগে এই গাঁয়ের হিঁদুকটোকে সাফ করবে, তবে অন্য কথা।

এইবার আমি কি করব? হিঁদু আর মোসলমানকে আলেদা না করে কি করব? কিন্তুক যাতো আলেদা করতে যেচি তাতো যেন পাঁকে ডুবে যেচি। খালি মনে হচে দুজনা মোসলমানের এমন মরণের কথা। শুনেই কি ভাবছি হিঁদু জাতটোই এমনি? তাইলে কি দুজন হিঁদুর মোসলমানের হাতে এমুন মরণের কথা শুনলে ভাবতে হবে মোসলমান জাতও ঐ রকম? তাইলে সত্য-র যি মাকে দেখে এয়েছি সে আর ইসুফ মিয়ের মা যদি অ্যাকনো বেঁচে থাকে, সেই থুত্থুড়ি বুড়ি মা-টো কি আলেদা?

খবর সোমানে আসত লাগল। হাজার হাজার মোসলমান যেমন মরছে হাজার হাজার হিঁদুও লিকিন তেমনি মরছে। কারা কম, কারা বেশি ভেবে লাভ নাই। বাড়ির কাজকর্ম ছেড়ে বাইরের ঘরের জানেলা দিয়ে পাড়ার রাস্তার দিকে চেয়ে থাকি। ছেলেমেয়েরা কাছে আসে না, কোথা কোথা ঘুরে বেড়ায়। মেয়েটি থাকে ননদের কাছে। একা বসে আকাশ-পাতাল ভাবছি। সব ঠিক আছে, পাখি ডাকছে, বাতাস বইছে, আসমান ভেঙে মানুষের মাথার ওপর পড়ছে না, রাস্তা পথ ঘাট যেখানকার যেমন তেমনি আছে- এর মধ্যে খালি মানুষ মানুষকে মারছে! কলকেতার রাস্তায় ডেরেন দিয়ে কলকল করে মানুষের রক্ত বয়ে যেছে। মোসলমানের রক্ত, হিঁদুর রক্ত। আলেদা কিছুই লয়, একই রক্ত। ঐ ডেরেনে হিঁদু-মোসলমান এক।

কত্তাকে বলতে সে বললে, পড়তে কি ভুলে গিয়েছ? পড়ে দ্যাখো না? কাগজ আসা তো এখনো বন্ধ হয় নাই! পড়লেই বুঝতে পারবে, সব কিছু খালি তোমার এই পাড়াগাঁয়েই হচ্ছে না। সারা দেশে আগুন জ্বলছে। কলকাতায় হিন্দু বেশি, মুসলমান কম, কাজেই সেখানে মুসলমান মারা পড়েছে বেশি। মোটকথা এখন আর স্বাধীনতা-টাধিনতার কথা নাই, স্বাধীনতা দাও আর না দাও, দেশ ভাগ করে দাও।

তাপর একদিন কত্তা বললে, গান্ধি নোয়াখালি গিয়েছে। সেখানে মুসলমান বেশি, খুব হিঁদু মারা যাচ্ছে। বিহারে মুসলমান মরছে বেশি। গান্ধি কলকাতাকে একরকম করে থামিয়েছে, নোয়াখালি বিহারকেও হয়তো এখন থামাতে পারবে, কিন্তুক ইংরেজরা যা চেয়েছিল তাই হলো। হিন্দু-মুসলমান দুই জাতকে চিরদিনের মতো একে-অপরের শত্রু করে দিলে। পাকিস্তানের নাম করে জিন্না ইংরেজদের কাজটিকেই করে দিলে আর ক্ষমতার লোভে পড়ে নেহেরু-রাও তাই করলে। প্যাটেল, শ্যামা মুখুজ্জে মুসলমানদের আলাদা করে দিতে চেয়েছিল, তাই হলো। গান্ধি এখন একঘরে। দরজায় দরজায় তাকে কেঁদে মরতে হবে।

কত্তার সব কথা ভালো বুঝতে পারলম না। শুধু এই বোঝলম, বেপদ মুটেই শ্যাষ হয় নাই, মাহা বেপদ নেমে আসছে, সব লন্ডভন্ড হবে। এই দাঙ্গাই হবে অছিলা। মানুষ যি আবার সব ভুলে যাবে, আবার হিঁদু-মোসলমান একসাথে বসবাস করবে, সুখে-দুখে দিন কাটাবে, এর কাজ উ করবে, ওর কাজ ই করবে, সবই হবে কিন্তুক তার এগু সব ওলটপালট হয়ে যাবে।

দাঙ্গা আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল। ঠিক যেন যুদ্ধ আকাল মাহামারীর মতুন। এই আমাদের জেবনেই ওগুনো সব এল, আবার চলেও গেল। উসব তো মানুষের সোংসারে সব সোমায়ে ঘটে না, আসে আবার চলে যায়। ই দাঙ্গাও বোধায় তাই। দাঙ্গা তো জেবনের লিয়ম লয়, শান্তিই জেবনের লিয়ম/ মনে হলো, সারা দ্যাশের মানুষের ভারি জ্বর হয়েছিল, জ্বরে গা পুড়ে যেছিল, চোখ হয়েছিল করমচার মতুন লাল, পিয়াসে বুকের ছাতি ফেটে যেছিল আর মাথা গোলমাল হয়ে শুদু ভুল বকছিল। সেই জ্বর এইবার ছাড়ছে।

এইরকম সোমায়ে, কে আর খবর দেবে, কত্তাই একদিন খবর দিলে, যাও, দেশ তোমার স্বাধীন হয়েছে।

তাই? আমাকে এটু বুঝিয়ে বলো— আমি ব্যাগোতা করে ফেললম্। হ্যাঁ, ইন্ডিয়া স্বাধীন হলো, দুশো বছর বাদে ব্রিটিশ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু যাবার সময় দেশটাকে কেটে দুভাগ করে দিয়ে গেল। দুভাগ কেন, তিন ভাগ! যেখানে যেখানে হিন্দু বেশি সেইসব জায়গা নিয়ে হিন্দুস্থান, আর যেখানে যেখানে মোসলমান বেশি সেসব জায়গা নিয়ে পাকিস্তান। বাঙালি মুসলমানদের জন্যে পুব-পাকিস্তান। আর একটি ভাগ।

সব হিঁদু সব মোসলমান এই দুই দ্যাশে চলে যাবে?

তাই কি হয় নাকি? যেখানে হিন্দু বেশি সেখানে কিছু কিছু মুসলমান থাকবে আবার যেখানে মুসলমান বেশি, সেখানে হিন্দুও কিছু থাকবে।

আলেদা করবে বলে এমন করলে ক্যানে?

দাঁড়াও দাঁড়াও, আরও একরকম ভাগ হয়েছে বললাম না? আমাদের এই বাংলা ভাগ হয়েছে আর পাঞ্জাব বলে আর একটি দেশও ভাগ হয়েছে। বাংলায় মুসলমান বেশি, হিন্দু কম। তুমি বোধহয় জানো না, বাংলা-বলা লোক ধরলে মুসলমানই বেশি। সেই হিশেবে গোটা বাংলাকেই পাকিস্তানে ঢোকাতে হয়! হিন্দু নেতারা কি তাই হতে দেবে? বাংলাও এখন দুভাগ হয়েছে– যেদিকে হিন্দু বেশি সেই বাংলা হিন্দুস্থানে আর যেদিকে মুসলমান বেশি সেই বাংলা পাকিস্তানে ঢুকেছে।

বাঃ, ই আবার কিরকম কথা? ইখানকার সব মোসলমান পাকিস্তানে চলে যাবে, আর পাকিস্তানের সব হিঁদু হিন্দুস্থানে চলে আসবে?

না, আসবে না। গোঁজামিলই চলতে থাকবে। তুমি যদি মুসলমানের হিশেব করো, তাহলে তোমাকে এই দেশ ছেড়ে দিতে হবে—এ দেশ আর তোমার নয়, তোমাকে যেতে পুব-পাকিস্তান। পুব-পাকিস্তানের হিন্দুদেরও চলে আসতে হবে এখানে। হয়তো তোমার এই বাড়িতে আসবে কোনো হিন্দু গেরস্থ।

কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

নাক তো চাও নাই— কাজেই নাক পাও নাই তবে নরুন একটা পেয়েছ- ঐ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো।

এই বলে কত্তা বেরিয়ে গেল।