Putul Nacher Itikatha by Manik Bandopadhya, chapter name অধ্যায়-৩

অধ্যায়-৩

মতির জন্য পাত্র দেখিতে গিয়া কালের ধারে বটগাছের তলে হারু ঘোষ অপঘাতে প্রাণ দিয়াছিল।গ্রামে কি মতির পাত্র মিলিত না? হারুর ছিল উচ্চ আশা। ছেলেবেলা হারু স্কুলে পড়িয়াছিল, বড় হইয়া হার বড়লোক হইয়াছিল। তারপর গরিব হইয়া পড়িলেও মনটা হারুর বিশেষ বদলায় নাই। গাওদিয়ার গোপ-সমাজ পরিহাস করিয়া তাহাকে বলিত ভম্বরলোক। বিশেষ করিয়া বলিত নিতাই। নিতাইয়ের অবস্থা ভালো, চালচলনও তাহার অনেকটা ভদ্রলোকের মতো, তবু হারু তো তাহাকে খাতির করিত না। নিতইয়ের এক ভাগ্নে আছে, তার নাম সুদেব। সুদেবের ঘরবাড়ি জমিজমা আছে, পেটে ইংরেজি বাংলা বিদ্যাও কিছু আছে, বয়সটা কেবল একটু বেশি, প্রায় ছত্রিশ। সুদেবের সঙ্গে মতির বিবাহ দিবার কত চেষ্টাই যে নিতাই করিয়াছিল বলিবার নয়। হারু রাজি হয় নাই। বাজিতপুরে ম্যাট্রিকুলেশন-পাস পত্রিটি দেখিতে গিয়া তাই না অকালে হারু স্বর্গে গেল।

হারু নাই, হারুর ছেলে পরাণ বাপের মতো চালাকও নয়, গোয়ারও নয়। গাওদিয়ার গোপ-সমাজ মতির বিবাহের জন্য আবার একটু ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। পরাণকে তাহারা অনেক কথা বুঝায়। বলে গায়ের মেয়ে গায়ে থাকাই তো ঠিক। জানাশোনা ঘরে দিলে মেয়ে সুখে থাকিবে। দুধ-বেচা গোপের ঘরেও তো বোনকে দিবার কথা তাহারা বলিতেছে না, সুদেবের ঘর তো বনেদি ঘরের মতো। কেন দোমনা হচ্ছিস বল তো পরাণ? বাজিতপুরের ছেলেটা তো ফসকে গেছে।

সুদেবের সঙ্গে মতির বিবাহ? রসালো ফলের মতো অমন কোমল রঙ যে মতির, প্রতিমার মতো অমল নিখুঁত মুখ? প্রস্তাবটা পরাণের পছন্দ হয় না। কিন্তু অত লোকের কাছে স্পষ্ট না বলিবার মতো মনের জোরও তাহার নাই। নিমরাজি হইয়া সে বলিয়াছে, বাড়িতে আর শশীর মত থাকিলে সে আপত্তি করিবে না।

ছোটবাবু লোক ভালো। কিন্তু নিজের সমাজে হিতৈষী গণ্যমান্য লোক থাকতে ছোটবাবুকে মুরুবিব ঠাওরালে পরাণ? ঘরের কথায় পরকে ডাকলে?

আজ একজন বলিয়াছে, ছোটবাবু হরদম আসেন যান, না বটে?

একথাটা পছন্দ করে নাই পরাণ দুপক্ষের পছন্দ শেষপর্যন্ত কিসে গিয়া ঠেকিত বলা যায় না। কিন্তু হারুর আকস্মিক মৃত্যুর পর পরাণ বড় দমিয়া গিয়াছিল। কলহ না করিয়া বাড়িতে অসুখের ছুতা দিয়া সে উঠিয়া আসিয়াছে।

মতির জ্বর কিন্তু কমিয়া গিয়াছে। বর্ষার গোড়ার দিকে তাহাকে ম্যালেরিয়ায় শশীর দামি কুইনাইন জ্বরটা একেবারে ঠেকাইতে পারে নাই। এবার গা ষ্টুড়িয়া কয়েকবার তাহাকে ওষুধ দিয়া শশী আশ্বাস দিয়াছে, আর জ্বর হইবে না। জ্বরে ভুগিয়া মতির বিশেষ ক্ষতি হইয়াছে মনে হয় না। ম্যালেরিয়া ধরিবার আগে হঠাৎ সে মোটা হইতে আরম্ভ করিয়াছিল। মাঝে মাকে জ্বরে পড়িয়া এটা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। মতির সুন্দর গড়নটি চর্বিতে ঢাকিয়া গেলে বড় আপসোসের কথা হইত।

এখনো প্রতি সপ্তাহে মতিকে শশী একটা করিয়া ইনজেকশন দেয়। সকালে বাড়িতে যে কজন রোগী আসে তাদের ব্যবস্থা করিয়া, কালো ব্যাগটি হাতে করিয়া সে যখন হারু ঘোষের বাড়ি যায়, হয়তো তখন বেলা হইয়াছে, সমস্ত উঠান ভরিয়া গিয়াছে রোদে। মতির ভীত শুকনা মুখ দেখিয়া শশী হাসিয়া বলে, এতবার দিলাম এখনো তোর ভয় গেল না মতি? কোন হাতে নিবি আজ?

স্পিরিট দিয়া ঘসিলে মতির বাহুতে ময়লা ওঠে। শশী বলে, বড় নোংরা তুই মতি, -গায়ে সাবান দিতে পারিস না?

ইনজেকশন দিয়া শশী দাওয়ায় বসে। পরাণ বলে, একটা পরামর্শ আছে ছোটবাবু।

বিষয়টা মতির বিবাহ-সংক্রান্ত শুনিয়া শশী জাকিয়া বসিয়া একটা বিড়ি ধরায়। ছেলের ইশারায় মোক্ষদা সরিয়া আসে কাছে। বুচিও আসিয়া ছেলে-কোলে কাছে দাড়ায়।

কুসুমকে দেখিতে না পাইয়া শশী মনে-মনে আশ্চর্য হয়। পুধের ভিটার ঘরখানার ছায়া ঘরের মধ্যেই সঙ্কুচিত হইয়া গিয়াছে। পরাণের কথা শুনিতে শুনিতে প্রতিমুহূর্তে সঞ্চয় করিয়া কুসুম হঠাৎ বাহির হইয়া আসিবে,- পরমাত্রীয়দের এই সভার একপ্রান্তে দাঁড়াইয়া থাকিবে পরের মতো।

তার সাড়া পাইয়া কুসুম যে কলসিটা তুলিয়া ঘাটে চলিয়া গিয়াছিল, শশী তাহা কেমন রোদে পায়ে দাগ আঁকিয়া পুবের ঘরের ছায়ার মধ্যে ডুবিয়া যায়। রান্নাঘরের পোড়া ডালের গন্ধে চারিদিক ভরিয়া যাওয়ার পর ঘর হইতে সে আর বাহির হয় না।

মোক্ষদার রূঢ় বাক্যস্রোতে তারপর কিছুক্ষণের জন্য মতির বিবাহের সমস্যা ভাসিয়া যায়। রান্নাঘরের খোলা দরজা দিয়া অপরাধী ভালের হাড়িটা উঠানে আসিয়া আছড়াইয়া পড়িতে আজ যে আবার ও-প্রসঙ্গে উঠিবে সে সম্ভাবনা থাকে না। শশী ভাবে, সকলের কাছে কত বকাবকিই বৌটা না জানি শুনিবে!

মোক্ষদা, বুচি, মতি সকলেই হৈ হৈ করে। ও-ঘর হইতে মুমূর্ষু পিসি চেঁচায় : কী হল রে বুচি? কী হল রে মতি?

চুপ করিয়া থাকে শশী। সকলকে চুপ করাইতে গিয়া পরাণহরা আরও বাড়ায়। কিন্তু কী নির্বিকার কুসুম – রাগের মাথায় ডালের হাড়িটা যে উঠানে ছুড়িয়া দিয়াছে, সে হাসিমুখে বাহিরে আসে। দাঁড়ায় শশীর সামনে। বলে, জ্বর এল নাকি, দেখুন দিকি ছোটবাবু।

শশী নাড়ি ধরিয়া বলে, জ্বর আসেনি বৌ। মাথা ধরেছে যে । | কতক্ষণ ধরে জলে ডুবিয়েছ তুমিই জানো, মাথার দোষ কী? কুসুম মাথা নাড়িয়া বলে, উই, আমার ঠিক জ্বর আসছে, আমি গিয়ে শুলাম। যা লো মতি, আজ তুই রাধবি যা।

কুসুম ঘরে গিয়া শুইয়া পড়ে। কিন্তু শুইয়া কেন থাকিতে পারবে এই চঞ্চলা নারী? খানিক পরে উঠিয়া আসিয়া না বলিতেই পরাণকে এক ছিলিম তামাকে দিয়া সে অদূরে বসিয়া পড়ে। সুদেবের সঙ্গে মতির বিবাহে শশীর মত নাই শুনিয়া বলে ; কেন গো ছোটবাবু, সুদেব পাত্তর কী এমন মন্দ? পুরুষমানুষের আবার বয়েস-সতীন কাটা তো নেই? ঘরে পয়সা আছে লোকটার, মেয়ে সুখে থাকবে।

শশী বলে, হারুকাকার অমত ছিল সেটা তো ভাবতে হবে বৌ! কুসুম বলে, তিনি সগ্যে গেছেন। আর কিছু কুসুম বলে না। শশী তাহাকে বুঝাইবার চেষ্টা করে, সুদেব লোক ভালো নয়, মতির সঙ্গে সুদেবকে মানায় না। কুসুম বোঝে কি না কে জানে-মোক্ষদার খর দৃষ্টিপাতে মাথায় ঘোমটা একটু টানিয়া দিয়া নিশ্চল প্রতিমার মতো বসিয়া থাকে। শশী বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠিলে সে আবার মুখ খোলে। বলে, পিসিকে একবার দেখে যান ছোটবাবু, বুড়ি কাঁদতে লেগেছে।

| শশী একটু লজ্জা পায়। মরণাপন্ন পিসিকে দেখিয়া যাওয়ার কথা প্রায়ই তাহার মনে থাকে না। পিসির মরণ এতদূর সুনিশ্চিত যে তার সম্বন্ধে করিবার এখন আর কিছুই নাই। তাই কি শশী ভুলিয়া যায় আজো পিসি বাঁচিয়া  আছ
ে?

বড় বাচিবার সাধ পিসির। পিসি মরিলে যে কাঠ দিয়া তাহাকে পোড়ানো হইবে, তাহার ঘরেরই অর্ধেকটা | জুড়িয়া সেগুলি সাজাইয়া রাখবা হইয়াছে। মাথার দিকে ঘরের কোণে দাড়-করানো পাটকাঠির বোঝা হইতে পিসি এখনো পাটের গন্ধ পায়; এক আঁটি পাট ধরাইয়া পিসির মুখাগ্নি করিকে পরাণ। মাথার চুল পিসির অর্ধেক ঝরিয়া গিয়াছে, দেহের লাল চামড়ার তলে মাংস আছে কিনা বোঝা যায় না। পিসি তবু বাচিবেই। চুপিচুপি সে শশীকে বলে, ও বাবা শশী, বই দেখে ওষুধ দিও বাবা, দামি ওষুধ দিও। দামের জন্য ভেবো না, বাবা সেরে উঠি, ওষুধের দাম তোমায় আমি মিটিয়ে দেব।

বলে, আমার যা-কিছু আছে সব তোমাকে দিয়ে যাব, তুমি ভালো করে আমায় চিকিচ্ছে কর।

তবু শশী প্রায়ই ভুলিযা যায় পিসি বাঁচিয়া  আছ
ে।

ইনজেকশন দিবার সময় প্রত্যেকবার শশী মতিকে বলিয়াছে, আর তোর জ্বর হবে না মতি।

শশীর আশ্বাস সত্য হইলে এ বছরের মতো মতিকে ম্যালেরিয়া ছাড়িয়াছে। ওদিকে যামিনী কবিরাজের বৌ, শশী যাহাকে সেন দিদি বলিয়া ডাকে, পড়িয়াছে জ্বরে।

যামিনী বিখ্যাত কবিরাজ। বহু দূরবর্তী গ্রামে তাহাকে চিকিৎসার জন্য ডাকা হয়। সিদ্ধির পাতা মিশাল দিয়া যামিনী যে চব্যনপ্রাণ প্রস্তুত করে তাহা নিয়মিত সেবন করিলে বৃদ্ধের দেহে যুবার ন্যায় শক্তির সঞ্চার হয়। মরিয়া গেলেও যামিনীর মকরধ্বজ রোগীর দেহে জীবন আনিয়া দিতে পারে। তারপর এই জীবনকে ধরিয়া রাখিবার জন্য যামিনীর আদি ও অকৃত্রিম আবিষ্কার মহাকপিলাদি বটিকা সেবন করা বিধেয়। এই বটিকা প্রস্তুত করিতে তিন রাত্রি সময় রাগে । ইহা কখনো প্রস্তুত হইয়া থাকে না। কারণ, তৈরি করিয়া রাখিলে এই মহাতেজস্কর ঔষধের গুণ সূর্যরশ্মি আকর্ষণ করিয়া লয়। সুতরাং যামিনীর মকরধ্বজের তেজে মৃতদেহে জীবন সঞ্চার হইলেও মহাকপিলাদি বটিকার অভাবে প্রাণটুকু যে সবসময় টিকিয়া থাকে, এমন নয়। কিন্তু সে অপরাধ কি যামিনীর? রোগীর কপাল! মহাকপিলাদি বটিকাতো প্রস্তুত নেই। রোগীকে না হয় বাঁচালাম, তারপর তিনদিন টেকাব কী দিয়ে?

মৃতকে যামিনীর এক লহমার জীবন দান কেহ কখনো দ্যাখে নাই। তবু লোকে বিশ্বাস করে। একজন দুজন নয়, অনেকে!

যামিনী কবিরাজের বৌ কিন্তু কখনো স্বামীর ওষুধ খায় না। অসুখ হইলে এতকাল সে বিনা চিকিৎসাতেই ভালো হয়েছে, এবার জ্বরে পড়িয়া শশীকে ডাকিয়া পাঠাইলো।

গোপাল তখন বাড়িতে ছিল। শশীর হইয়া সে বলিয়া দিল, বলগে, যাচ্ছে-তারপর শশীকে যাইতে নিষেধ করিয়া দিল ।

শশী বলিল, কেন, যাব না কেন?

গোপাল বলিল, কবে তোমায় বুদ্ধি পাকবে, ভেবে পাই না শশী ।

শশীও তাহা ভাবিয়া পায় না। সে চুপ করিয়া রহিল।

তখন গোপাল বলিল, যামিনী খুড়ে অত বড় কবরেজ, সে থাকতে ডেকে পাঠানোর মানেটা বোঝো?

শশী বলিল, আজ্ঞে না।

যুবতী স্ত্রীলোক, নানারকম কুৎসাও শুনতে পাই-

গোপালের মুখে এই কথা? লজ্জায় শশী সচকিত হইয়া গেলর। মৃদুস্বরে সে বলিল, এসব আপনার বানানো কথা বাবা।

গোপাল রাগ করিল না, বলিল, তোমার যে কী হয়েছে আজকাল বুঝতে পারি না শশী । তোমার ভালোর জন্যে একটা কথা কইলে তুমি আজকাল তর্ক জুড়ে দাও। সংসারে মানুষকে ভেবেচিন্তে কত সাবধানে চলতে হয় সে জ্ঞান তোমার এখনো জনেনি। এই তোমার উঠতি পসারের সময়, এখনই একটা বদনাম রটে গেলে-এও কি তোমায় বলে দিতে হবে? তুমি চিকিৎসার ভার নিলে বলাবলি করবে না-লোকে যামিনী কবরেজ থাকতে তুমি ছেলেমানুষ তোমার কেন আত মাথাব্যথা? সবার বাড়িতে মেয়েছেলে থাকে, এর পর কে আর ডাকবে তোমায়?

শশীর রাগ হইতেছিল। কিন্তু শৈশব ও কৈশোরের এই মনটিকে ভয় করা তাহার সংস্কারে দাঁড়াইয়া গিয়াছে, গোপালের তীক্ষ অপলক দৃষ্টিপাতে সে চোখ নামাইয়া লইল। গোপাল আবার বলিল, যামিনী খুড়োর ইচ্ছেও নয় তুমি ওদের বাড়ি যাও।

শশীর নীরবতায় গোপাল খুশি হইয়াছে। বয়স্ক উপযুক্ত সন্তানকে বশ করা, জগতে এতবড় জয় আর নাই। আজকাল নানা ছোট-বড় ব্যাপারে শশীর সঙ্গে গোপালের সংঘর্ষ বাধিতেছিল, কলহ বিবাদ নয়,-তর্ক ও মতান্তর, আদেশ ও অবাধ্যতার বিরোধ। আজ তবে শশী বুঝিতে পারিয়াছে সাংসারিক বুদ্ধিতে বাপের চেয়ে সে ঢের বেশি কাঁচা, গোপাল এখনো তাহাকে পরিচালনা করিতে পারে।

গোপাল আরও অনেক কথা বলিল, শশী নীরবে শুনিয়া গেল। শেষে তাহার কঠিন মুখের ভাব দেখিয়া আর কিছু বলা ভালো না মনে করিয়া গোপাল থামিল।

খাওয়াদাওয়ার পর শশী গেল যামিনী কবিরাজের বাড়ি।

শশীকে দেখিয়া যামিনী কবিরাজ খুশি হইল না। সদর বাড়তে সে তখন মুখে মুখে দুটি ছাত্রকে ওষুধের প্রস্তুত-প্রণালী শিখাইতেছিল, পাশের চালাটায় বুঝি সিদ্ধ হইতেছিল পাঁচন, গন্ধে চারিদিক ভরিয়া দিয়াছে। শশীকে দেখিয়া যামিনী চশমা খুলিয়া বলিল, কী মনে করে শশী? বোসো।

শশী বলিল, সেনদিদির অসুখ শুনলাম ঠাকুরদা, একবার দেখা করে যাই।

অসুখ?-যামিনী হাসে, কার কাছে শুনলে? জ্বর বুঝি হয়েছিল একটু কাল, না রে কুঞ্জ? আজ অসুখ কোথা!

তবে বুঝি কোনো কাজে ডেকেছেন, বলিয়া শশী ভিতরে গেল।

সেনদিদি শুইয়া ছিল, আচ্ছন্ন অসুস্থ, মৃতকল্প সেনদিদি।

গায়ের উজ্জ্বল রঙ লাল হইয়া অনম্ভের রঙের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে, সারা গায়ে আরও সব অস্পষ্ট চিহ্ন, শশী যা চেনে। শশীর মুখ শুকাইয়া গেল। শরতের গোড়ায় এ রোগ সে-দিদি পাইল কোথায়। গাউদিয়া গ্রামে, কলিকাতা শহরে, দেশে বিদেশে কোথাও শশী যার মতো রূপসী দেখে নাই, শুধু রূপের জন্যই হয়তো যে মিথ্যা কলঙ্ক কিনিয়াছে, এ কী রোগ ধরিয়াছে তাহাকে?

শশীর ডাক শুনিয়া যামিনী কবিরাজের বৌ চোখ মেলিয়া তাকাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, তুমি এতদিনে এসেছ শশী? আমি যে মরতে বসেছি শশী? কী অসুখ করেছে কিছু জানি না, জ্বরে অচৈতন্য হয়ে থাকি, গায়ের ব্যথা সইতে পারি না।

আমি খবর পাইনি সেনদিদি।

কাকে দিয়ে খবর পাঠাব, কেউ কি আসে আমার কাছে।

সেনদিদি চোখ মেলিতে পারে না, চোখের কোণ দিয়া জল গড়াইয়া পড়ে। শশী বিছানায় বসে, সেনদিদির গায়ের তাপ পরীক্ষা করে, কী করিবে ভাবিয়া পায় না। যামিনী অসুখের কথা গোপন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, এ পর্যন্ত চিকিৎসারও হয়তো কোনো ব্যবস্থা হয় নাই। আজকাল তাহার কী হইয়াছিল, সেনদিদির খবর লইত না কেন? এই মলিন দুর্গন্ধ চাদরে আজ কতদিন না-জানি তাহর সেনদিনি বিনা-চিকিৎসায় পড়িয়া আছে, এতটুকু সেবা করিবারও কেহ থাকে নাই। শশী কিছু বুঝিতে পারে না। যে রূপের জন্য পৃথিবীর লোক উন্মাদ, স্ত্রীর যে সৌন্দর্য মানুষ তপস্যা করিয়া পায় না, যামিনী তাই পাইয়াছে। বুড়া বয়সে সে তো স্ত্রীর দাস হইয়া থাকিবে। কীজন্য তাহার এই বিকৃত | নিষ্ঠুর অবহেলা? কে জানে, হয়তো সীতা আর হেলেন আর ক্লিওপেট্রার মতো যার অসাধারণ রূপ থাকে তাকেরিয়া খাপছাড়া কান্ডই ঘটতে থাকে জগতে।

খানিক পরে যামিনী ঘরে আসিল, মুখ ভার করিযী বলিল, এখনো তুমি বসে আছ শশী? আমি ভাবলাম তুমি বুকি চলে গেছ।

শশী বলিল, ঠাকুরদা, বাইরে আসুন দিকি একবার বাহিরে গিয়া বলল, সেনদিদির অসুখ কি আপনি ধরতে পারেননি ঠাকুরদা।

যামিনী কবিরাজ বলিল, হাসির কথা বললে বটে শশী, চল্লিশ বছর কবরেজি করছি, তিনটে জেলায় যামিনী কবরেজের নাম জানে না এমন লোক নেই, আমায় তুমি শুধোচ্ছ রোগ ধরতে পারিনি? একনজর তাকালে রোগ নির্ণয় হয়। ওঁয়ার হয়েছে ম্যালেরিয়া।

ম্যালেরিয়া নয়, ঠাকুরদা, বসন্ত! —শশী বলিল।

হ্যাঁ, বসন্ত! শরৎকালে বসন্ত?—বলিল, যামিনী কবিরাজ।

বলিল বটে, যামিনীর মুখে কালি পড়িয়াছে কিসের? শশীর কাছে যামিনী যেন অভিমান করিতেছে, একটা পাণ্ডুর ভয় আর কালো চিন্তার রাশিকে গোপন করিবার অভিনয়। শশী কড়াসুরে বলিল, আমি সেনদিদির চিকিৎসার ভার নিলাম ঠাকুরদা। ছি, ছি, আজ পর্যন্ত কিছুই করেননি?

খায় নাকি আমার ওষুধ?

শশী ঘরে গিয়া বসিল। কী ভাবিয়া যামিনীও ঘরের মধ্যে গিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। শশী দারুণ বিপন্ন বোধ করিতেছিল। আর বিষন্নতা। কয়েকদিন আগে সাতগাঁয়ে সে একটি বসম্ভের রোগী দেখিতে গিয়াছিল। তাহাকে শশী বঁচাইতে পারে নাই। বাচাইবার চেষ্টাও সে করিতে পারে নাই, তাকে ডাকা হইয়াছিল একেবারে শেষমূহুর্তে। শেষপর্যন্ত রোগীর চিকিৎসা করিয়াছিল সাতগার কবিরাজ যামিনীর পূর্বতন ছাত্র ভূপতিচরণ। শশীর হঠাৎ মনে পড়িয়াছে, সেই রোগীটি মারা যাইবার পর যামিনী হাসিয়া বলিয়ছিল, আমার ছাত্র যাকে ছাড়পত্র লিখে দিল তাকে বাচাবে শশী- আমাদের শশে?

শশী প্রাণ দিয়া সেনদিদির চিকিৎসা ও সেবা আরম্ভ করিল। অন্য রোগীরা তাহাকে ডাকিয়া পায় না। বাড়িতে কারও জ্বরজ্বালা হইলে চোখের পলকে পরীক্ষা শেষ করিয়া ওষুধ দেয়,–না বলিলে আর খবর নেয় না। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন সকলকে সে অবহেলা করে। যায় না হারু ঘোষের বাড়ি, বিনা কাজে অথবা মতিকে ইনজেকশন দিতে। কুসুম ভাবিল, শশী বুঝি রাগ করিয়াছে। তালবনের তালপুকুরে পদ্ম তুলিতে গিয়া মতি আশা করিতে লাগিল, ছোটবাবু আজ নিশ্চয় আসবে। ছোটবাবুকে একডালা পদ্ম দেব। কিন্তু কুসুমের মনে শশীর উপর রাগ কমিল না। মতির পদ্মফুলের বীচি দিয়া রাধা হইল তরকারি।

শুধু সেনদিদির ব্যবস্থা করিতে হইলে শশীর হয়তো চারদিকে তাকানোর সময় পাইত। চিকিৎসা আরম্ভ করিয়া এ-বাড়িতে গোপালের এবং ও-বাড়িতে যামিনীর উপদেশ, সমালোনা ও বাধাদানের বহরে সে বিপন্ন ও বিব্রত হইয়া রহিল। চিকিৎসায় ওদের শ্রদ্ধা নাই, এই কথাটা এমনিভাবে প্রকারান্তরে তাহাকে জানাইয়া দেওয়া হইতেছে। কিন্তু চিকিৎসার আর কোনো ব্যবস্থাও তো নাই। ভালো হোক মন্দ হোক, তার সাকে ছাঁটিয়া ফেলার মধ্যে যুক্তি আছে কোনখানে? আমার ওষুধ খায় না, বলিয়া যামিনী নিজে চিকিৎসা করিতে রাজি নয়,-ওরা মারিয়া ফেলিতে চায় নাকি সেনদিদিকে? তাই বা কেন চাহিবে? তা ছাড়া যামিনীর এই লজ্জাকর পাগলামিতে গোপাল এভাবে সাহায্য করিতেছে কেন, তার স্বাৰ্থ কী?

ব্যাপার যত রহস্যময়ই হোক, শশী একা সেন দিদির তিনটি যমের সাথে লড়াই করিতে লাগিল ।

যামিনীকে সে জিজ্ঞাসা করে, বড় গোল শিশির ওষুধ কী হল ঠাকুরদা?

যামিনী বলে, তিন দাগ ছিল না? খাইয়ে দিয়েছি। কী যে সব ওষুধ তোমার শশী,— সব ওষুধ হয় মদ, নয় সিরাপের গন্ধ!

শশী সভয়ে বলে, খাইয়ে দিয়েছেন? গোল শিশির ওষুধটা খাইরে দিয়েছেন?

তা দিলাম বৈকি? ছটফট করছিল দেখে ভাবলাম, তোমার রুগী তোমার ওষুধ, দিই খাইয়ে!

শশী রাগ করিয়া বলে, রোগী আমার নয় ঠাকুরদা, আমি চললাম। আপনার যা-খুশি করন।

সে একরকম চলিয়াই আসে। বাড়ির বাহিরে গিয়া গতি শ্লথ করিয়া দাঁড়ায়। মনে পড়ে সেনদিদির ভীরু কাতর চাহনি, একান্ত নির্ভরতা। শশী আবার ফিরিয়া যায়। বলে, ওটা যে গুটি-বসাবার ওষুধ, সাতদিন আগে ও ওষুধটা দিয়েছিলাম, আপনি জানতেন না?

যামিনীর মুখ কয়েকদিনে সম্ভবত দুশ্চিন্তাতেই শুকাইয়া পাংশু হইয়া গিয়াছে। সে চোখ মিটমিট করিয়া বলে, আমি কবরেজ মানুষ, তোমাদের ওষুধের আমি কী জানব ভাই? আমি তো কিছুই জানি না।

জানেন না তো আমায় না বলে ওষুধ খাওয়ালেন কেন? আপনিই মারবেন ঠাকুরদা সেনদিদিকে। গুটি পাকছে, এখন আপনি খাইয়ে দিলেন গুটি-বসানোর ওষুধ?

যামিনী কথা কয় না।

শশী একটু নরম হইয়া বলে, বড় অন্যায় করেছেন ঠাকুরদা, আর যেন এমন করবেন না কখনো।

যামিনী বলে, আমার একটা ওষুধ খাইয়ে দেবে শশী? তাড়াতাড়ি যাতে গুটি পাকে?

শশী তৎক্ষণাৎ সন্দিগ্ধ হইয়া বলে, থাইয়েছেন নাকি কিছু? আপনার ওষুধ?

নাহ, আমার ওষুধ খায় না।

তার মানে চেষ্টা করেছিলেন খাওয়াবার?

উদভ্ৰান্ত যামিনী এবার খেপিয়া যায়।

যদি করে থাকি? হাঁ হে শশী, যদি করেই থাকি? তোমার ওসব মদ আর সিরাপে আমি বিশ্বাস করি না বাপু চিকিৎসা হচ্ছে! এই যদি তোমার বসন্তের চিকিৎসা হয়, পুথিপত্র খালে ভাসিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে গিয়ে বসোগে যাও!

বলিতে বলিতেই যামিনী সাহস হারায়, তবু মরিয়ার মতো বলে, তুমি আর এসো না।

মাথা শশীও ঠিক রাখতে পারে না : গোড়া থেকে আপনি যা সব কান্ড করছেন ঠাকুরদা, পুলিশ ডাকলে আপনার দশ বছর জেল হয়।

যামিনী বিবর্ণ মুখে বলে, কী করলাম আমি চিকিৎসা হচ্ছে তোমার, আমি তো একটা বড়িও খাওয়াইনি আমার!

শশী আর কথা-কাটাকাটি করে না। এ পাগলের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া লাভ কী?

এই কি কলহের সময় ঠাকুরদা?

কলহ কে করছে বাপু! জ্ঞান হইলে যামিনী কবিরাজের বৌ বলে, ঘরে কে, শশী? কার সঙ্গে কথা কইছ? — চোখে সে দেখিতে পায় না, চোখদুটি বন্ধ হইয়া গিয়াছে। যামিনী ঘরে আসিয়াছে শুনিলে উতলা হইয়া ওঠে, ওকে যেতে বলো শশী, যেতে বলো ওকে, আমাকে ও বিষ খাইয়ে মারবে,– যাও না তুমি এ ঘর থেকে, চলে যাও না।

যামিনী চলিয়া গেলে বলে, বাঁচব তো শশী?

বাঁচবে বৈকি।

সেনদিদি খুশি হয়। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া পড়িয়া থাকে। শশী কি জানে না, কী অসহ্য তাহার যাতনা? সেনদিনির সহ্যশক্তি দেখিয়া বিস্ময় মানে শশী। নালিশ নাই, কাতরানি নাই, মাঝে মাঝে শুধু জিজ্ঞাসা করে বাঁচিবে কি না।

সেনদিদি বলে, এত ঘাটাঘাটি করছ, তোমার তো ভয় নেই বাবা?

কিসের ভয়? ছমাস আগে টিকে নিয়েছি।

তখন সেনদিদি বলে, ধরতে গেলে তুমি তো আমার ছেলেই। পেটের ছেলের চেয়ে তোমাকে বেশি ভালোবাসি শশী।

কথাটা শশীকে বিচলিত করিয়া দেয়। সেনদিদি যে তাকে ভালোবাসে সে তা জানে বারো বছর বয়স হইতে। কথাটা বলিবার ভঙ্গি তাহাকে অভিভূত করিয়া রাখে। কেমন একটা বালকত্বের অনুভূতি হয় এক অসুস্থা গ্রাম্য নারীর আবেগপূর্ণ কথায়। পেটের ছেলের চেয়ে ভালোবাসে? একথার অর্থ কী? সেনদিদির তো ছেলেমেয়ে হয় নাই কখনো।

একদিন সেনদিদির শিয়রে সারারাত জাগিয়া ভোরবেলা বাড়ি ফেরার সময় বাড়ির সামনে শিউলিগাছটার তলায় মতিকে শশী ফুল কুড়াইতে দেখিল। শশী যায় না বলিয়া মতি বুঝি ব্যাপার বুঝিতে পারিয়াছে।

শিউলিগাছটা ঝাঁকিয়া ফুল ঝরাইয়া দিয়া শশী জিজ্ঞাসা করিল, তুই তবে টিকে নিয়েছিলি রে মতি?

টিকে নিইনি তো!

নিস নি? কেন, টিকে নিতে কী হয়েছিল? দাড়া আজ তোদের বাড়িসুদ্ধ সকলকে টিকে দিয়ে আসব। পাড়ায় বসন্ত হয়েছে খবর রাখিস?

মতি অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া বলিল, টিকে নিলে কী হবে? মা শেতলার কৃপা হবার হলে হবেই গো ছোটবাবু, হবেই।

তোর মাতা হবে।

শিশিরে একপশলা বৃষ্টির মতো চারিদিক ভিজিয়া আছে। মতির বিবর্ণপাড় শাড়ি আধভেজা কাপড়ের মতো কোমল দেখাইতেছিল। শশীর মনে হয় শাড়ির নমনীয় স্পর্শে মতি ভারি আরাম পাইতেছে। সকালবেলা রাতজাগা চোখে মতিকে যেন তার বয়সের চেয়ে অনেক বড় মনে হইতে লাগিল । ওকে দেখিতে দেখিতে সকালবেলা বিড়ি টানার আলস্য আরও মিষ্টি লাগিল শশীর।

মতি বলিতেছিল, বৌ বলে আপনি সায়েব মানুষ, ঠাকুর-দেবতা মানেন না। সত্যি ছোটবাবু?

না, সত্যি নয়। ঠাকুর-দেবতা খুব মানি।

শুনিয়া মতি যেন স্বস্তি পাইল।

বৌ আপনার নামে যা-তা বলে।

অ্যাঁ? কী বলে?

মতি মুচকাইয়া হাসিল, কত কী বলে।

শশী হাসিয়া বলিল, তুইও তো বলিস মতি। পরাণের বৌ হয়তো তোর কাছ থেকেই বলতে শিখেছে।

মতির মুখ শুকাইয়া গেল।

আমি আপনার নামে বলি। আমি যদি আপনার নামে কিছু বলে থাকি আমার যেন ওলাউঠা হয়। হয়-হয়-হয়, তিন সত্যি করলাম, ভগবান শুনো।

শশী অবাক হইয়া বলিল, তুই তো আচ্ছা রে মতি! সকালবেলা ফুল তুলতে তুলতে ওলাউঠার নাম করছিস!

মতি এবার রাগ করিয়া বলিল, আমার যেন হয়!

রোদ উঠিলে মতি বাড়ি গেল। শশী ভাবিদ এমন গেঁয়ো স্বভাব, দেখতে তো গেঁয়ো নয়!

আর মতি ভাবিল, শেষের দিকে ছোটবাৰু আমাকে কী করে দেখছিল? আমাকে দেখতে দেখতে কী ভাবছিল ছোটবাবু?

হারু ঘোষের বাড়ির সামনে বেগুনগাছগুলি এমন সতেজ। কয়েকটা গাছে কচি কচি বেগুনও ধরিয়াছে। বড় ঘরের পাশ দিয়া পিছনের মাঠে তাকাইলে অনেক দূরে কুয়াশা দেখা যায়। দূরত্বই যেন ধোয়াটে হইয়া আছে, কুয়াশা মিছে। মতি তৃপ্তিবোধ করে। সকালবেলার সোনালি রোদে তাহার চোখের সীমানার গ্রামখানি দেখিতে অপূর্ব হইয়া উঠিয়াছে বলিয়া নয়। প্রকৃতিকে, তাদের এই গ্রামের প্রকৃতিকে, মতি এতবেশি করিয়া চেনে যে আকাশের রামধনু ছাড়া তাহার চোখ তাহার মন কোথাও রঙ খুঁজিয়া পায় না। নাকের সামনে কচি কিশলয়ের মৃদু হিদোল কোন কাঁচা মনকে দোল দেয় কে জানে, মতির মনকে দেয় না। সর্বাঙ্গের শুভ্রতায় তালগাছের রহস্যময় ছায়া মাখিয়া তালপুকুরের গভীর কালো জলে হাস সাতার দেয়, তাদের গায়ে ঠেকিয়া লাল ও সাদা শাপলাগুলি জলে ডুবিয়া ভাসিয়া উঠে, চারিদিকের তীর ভরিয়া কলমিশাকের ফুলগুলি বাতাসে যেন কেমন করিতে থাকো আকাশে ভাসে উজ্জ্বল সাদা মেঘ আর বন্য কপোতের কাক । শাপিক পাথি উড়িবার সময় হঠাৎ শিস দেয়। অল্প দূরে কাতোঁরা পাখির পাঠশালা বসে। বাতাসে থাকে কত ফুল, কত মাটি, কত ডোবার মেশানো গন্ধ।

মতি কিছু দেখে না, কিছু শোনে না, কিছু শোকে না। তালপুকুরের নির্জনতাকে সে শুধু ভোগ করে গায়ে জড়ানো আঁচলটি কোমরে বধিয়া। গা উদলা করিয়া দেওয়াতেও কেহ যে তাহাকে দেখিতে পাইতেছে না ইহাতে মতির ভারি মজা লাগে।

সংসারের কাজ না করিলে কুসুম তাহাকে বকে। তালপুকুরের ধারে কাজ-ফাকি দেওয়া আলসাটুকু মতি ভোগ করে ভবিষ্যতের চিন্তা করিতে করিতে। সুদেবকে মনে | মনে মরিবার আশীৰ্বাদ করিয়া আরম্ভ না করিলে ভবিষ্যতের ভাবনাটা তাহার যেন ভালো থোলে না।

মতির ভারি ইচ্ছা, বড়োলোকের বাড়িতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। | কাজ নাই, বকুনি নাই, কলহ নাই, নোংরামি নাই, বাড়ির সকলে সর্বদা পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন থাকে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, হাসে, তাস-পাশা খেলে, কলের গান বাজায়, আর,—আর বাড়ির বৌকে খালি আদর করে। চিবুক ধরিয়া তাহার লজ্জিত মুখখানি তুলিয়া বলে, লক্ষ্মী বৌ, সোনা বৌ, এমন না হলে বৌ? বলে, বাড়ি আলো হল!

স্বপ্ন মতির অফুরন্ত। মস্ত একটি ঘরের এককোণে সে বসিয়া আছে। সর্বাঙ্গে তাহার ঝলমলে গহনা, পরনে ঝকঝকে শাড়ি। ঘোমটার মধ্যে চন্দনচর্চিত মতির মুখখানি কী রাঙা লজ্জায়! আনন্দে সে ছোট ছোট নি:শ্বাস ফেলিতেছে আর শুনিতেছে ঘরের বাহিরে | বড়লোকের বাড়ির প্রকান্ড সংসারের কলরব। শশীর বোনের মতো পাড়ার কে যেন একটি মেয়ে মতির সঙ্গে ভাব করিয়া গেল। যামিনী কবিরাজের বৌ-এর মতো সুন্দরী একটি মহিলা, মতির বোধ হয় সে ননদই হইবে, পানের বাটা সামনে দিয়া বলিল: পান- | সাজো, বৌ। ও সোনা-বৌ, পান সাজা।

তারপর কে বলিল, বৌমাকে খেতে দে তোরা কেউ একজন।

যেই বলুক, তালপুকুরের ধারে প্রকৃতির মহোৎসব হইতে বাড়ি ফেরার সময় মতি আবার তীব্রভাবে ইচ্ছা করে সুদেব ব্যাটা মরিয়া যাক।

কুসুমের সঙ্গে আজকাল প্রায়ই ঝগড়া বাধে মতির। সকলের অগোচরে মতিকে কুসুম শশীর কথা তুলিয়া অন্যায় পরিহাস করিতে আরম্ভ করিয়াছে।

বলে, শশীর খারাপ লাগছে মতি? তাই চুপ করে বসে রয়েছিল? আহা ঘাট। ছোটবাবুকে ডাকব পরক্ষে করে ওষুধ দেবে?

মতি বলে, কেন লাগতে এলি বৌ? তোর আমি কী করেছি!

কুসুম বলে, চোখ ছলছল করছে। দেখলে ছোটবাবুর বুক ফেটে যাবে।

মতি বলে, যমের অরুচি। মর তুই, মর।

কুসুম তবু বলে, জানিস লো মতি,-রাতে তোর কথা ভেবে ছোটবাবুর ঘুম হয় না। বসে বসে মালা জপ করেন: মতি, মতি, মতি। সুদেবের সঙ্গে তোর নিকে হয়ে গেলে ছোটবাবু তালপুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করবে।

তুই তালপুকুরে ডুবে মর। মরে শাকচুরি হয়ে থাক।

মতি স্থানত্যাগ করিতে চায়, কুসুমের সঙ্গে সে কথায় পারবে কেন? কুসুম তাহাকে রেহাই দেয় না। খপ করিয়া মতির হাতটা সে ধরিয়া ফেলে। মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া অপলক চোখের তারা স্থির রাখিয়া কথাগুলিকে দাঁতে কাটিয়া কাটিয়া বলে, লজ্জা নেই তোর? এতবড় ধেড়ে মেয়ে তুই, লজ্জা নেই তোর? পেটে ভাত জোটে না, গয়লার মুখ্য মেয়ে তুই –ছোটবাবুর তুলনায় তুই ছোটলোক ছাড়া কী! অত তোর পাকামি কিসের? অমনি করিস বলেই তো বিরক্ত হয়ে ছোটবাবু আর আসে না।

তারপর মতি কুসুমের হাত দেয় কামড়াইয়া। তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া দংশিত হাতখানা ঘুরাইরা ফিরাইয়াকুসুম দাতের দাগগুলি ভালো করিয়া দ্যাখে।

কামড়ালি আমাকে তুই কামড়ালি? দাড়া তোর আমি কী করি দ্যাখ।

কী করিবে কুসুম তাঁহার কী করিবে? বুক দুরু দুরু করে মতির। ছোট বাবুকে যদি বলিয়া দেয়!

মতির মনে হয়, সে কুসুমের হাত কামড়াইয়া দিয়াছে শুনিলে ছোটবাবু ভয়ানক রাগ করিবে।

খানিক পরেই সে কুসুমের আশেপাশে ঘোরাফিরা আরম্ভ করিয়া দেয়। একসময় সাহস করিয়া বলে, লেগেছে বৌ? দেখি?

কুসুমের ক্ষমা নাই। সে ভাঙাইয়া বলে, লেগেছে বৌ? কামড়ে দিয়ে নাকামি করতে এলেন।

মতি দাওয়ায় আসিয়া খুঁটি ধরিয়া দাঁড়ায়। ভাবে, বউ কী ভীষণ মেয়ে। ও ঠিক বলে দেবে।

পিসির ঘরে খোলা দরজা দিয়া পিসিকে দেখা যায়। পিসির আজকাল কথা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। কথা বলিতে গেলে গলায় ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ হয় মাত্র, কিছুই সে বলিতে পারে না। মতিকে দেখিয়া সে হাতের ইশারায় তাহাকে কাছে ডাকে। মাথা উচু করিয়া বারবার ব্যাকুলভাবে মুখের ফাঁকে আঙুল ঢুকাইয়া পিপাসা জানায়। দেখিতে পাইয়াও মতি কিন্তু অনেকক্ষণ নড়ে না।

বলে, যাইগো যাই-অত ব্যস্ত কেন?

মোক্ষদা জিজ্ঞাসা করে, কে ডাকে লো মতি?

পিসি। জল খাবে।