কিছু সুখ কিছু ব্যথা Kichu Sukh Kichu Byatha by রত্না চক্রবর্তী - Ratna Chakraborty , chapter name কুমড়ো ডাঁটা চচ্চড়ি

কুমড়ো ডাঁটা চচ্চড়ি

হাসিমুখে তিয়াসা  বলল তার শ্বাশুড়িকে, " ওমা তোমার কুমড়ো ডাঁটা আসছে দেখলাম তোমার কাজের পিন্ডি চটকাতে। হাতের প্লাস্টিকে টিফিনকৌটো, ঘরে তালা লাগাচ্ছে। এই এল বলে। "  মনটা বিরক্তিতে ভরে গেল রীতার। সারা দিনে মোটে সময় পান না তাই এই সন্ধ্যার পর বৌমা তিয়াসার টিউশনের ছাত্র ছাত্রী বেরিয়ে গেলে তখন একটু বসেন লেখালেখি নিয়ে। আর ঠিক এই সময় প্রতিদিন আসবে এই মেয়েটি। কি 
যে এই এক নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে তার। তার ঠিক সামনে বাড়িতে অল্প একটু জমি খালি ছিল। কিছুদিন হলো সেখানে বাড়ি করেছে এক নতুন দম্পতি। ওরা অল্প বয়সী।  বাড়ি ক্যানিং সাইডে। ছেলেপুলে হয়নি এখনো, বছর দুয়েক বিয়ে হয়েছে। একটা ছোট চাকরি করে ছেলেটি। দুজনের সংসার। বৌটির মনটা খুব ভালো কিন্তু ঠিক এখানকার মতো নয়,এখানকার রীতিনীতি   বোঝে না। একটু বেশি ঘাড়ে পড়া, একটু বেশি বাড়ি আসা আসি, এগুলো যে তাদের শহরে ঠিক চলে না সে বেচারা এখনো সেটা বুঝে উঠতে পারিনি।
 মায়াই হত রীতার। মা বাবা ছেড়ে এসেছে হয়তো। মার জন্য মনটা কেমন করে। রীতা সকালবেলায় এলে গল্প করতেন, কথা বলতে বলতে নিজের কাজ করতেন। মেয়েটার তেমন কাজ নেই। স্বামী বেরিয়ে যায় ঘরে তালা দিয়ে সে বসে গল্প করতো। এখনও বাচ্চাকাচ্চা হয় নি। নানা রকম  কথা উঠে আসে। মেয়েটার নাম পম্পা। কত কথা বলে যেত সে.... তার গ্রামের কথা.... তাদের চাষের ক্ষেতের কথা.... তার বাবা ক্ষেতে নিজেও কাজ করতেন,  তাদের গাই গরুর কথা....। ভালোই লাগত রীতার, তিনি  সারা জীবন শহরেই কাটিয়েছেন  এ সব গল্প তার অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে দিত। তার গল্পের বিষয়গুলিতে হাসত  রীতার বাড়ির লোকেরা,পম্পা বলত  " মাসিমা তুমি বড়ি দিয়ে কুমড়ো শাকের চচ্চড়ি খেয়েছ?  তুমি কাঁঠাল দানা দিয়ে ডাল করতে পারো? বেশ লাগে। কাঁঠাল দানা পুড়িয়ে খেয়ে দেখো খুব ভাল লাগবে। উচ্ছে দিয়ে  নটে শাক তোমায় করে খাওয়াবো। গুড় দিয়ে কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে আমের বোল বাটা যা লাগে না....! 
এমনি সব।  দেড় কাঠা জমির উপর তার ছোটঘর খানি ছিল। চারপাশে যেটুকু ফাঁকা জমি থাকতে হয় সেটুকুর মধ্যে সে লঙ্কা গাছ বেগুন গাছ, উচ্ছে গাছ ,কুমড়ো গাছ করেছিল।  মাঝে মাঝে সে নিজে চচ্চড়ি রান্না করে নিয়ে আসত রীতার  জন্য। মামার বাড়ি গেলে অনেক ছোটবেলায়  দিদিমার হাতে এমন তরকারি খেয়েছে রীতা। এখানকার মত  এত মশলা দিয়ে রান্না করে না কিন্তু ভারী সুন্দর খেতে। একটা অন্যরকম স্বাদ আছে। রীতা বলে ফেলেছিলেন " তোর হাতের রান্না তো খুব সুন্দর রে!"
  উৎসাহিত হয়ে পড়েছিল বেচারা মেয়েটি।  সেই শুরু।  এরপর প্রায় তরকারি নিয়ে আসত তাও খারাপ ছিল না, রীতা ও চেষ্টা করতেন মেয়েটাকে যেরকম ভাবে হোক একটু ভালো রাখার। আহা একটু কথা বলতেই আসে বই তো নয়। কিন্তু মুশকিল হল রীতার সারা দিন কাজ করার পর একমাত্র সময়  পান সন্ধ্যাবেলাটা। তখন তিয়াসার স্টুডেন্টরা চলে যায়। বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। বাবু সাড়ে নটার আগে আসে না। তার বাবা ও দশটার আগে বাড়ি ঢোকে না। এই সাড়ে ছটা - সাতটা থেকে সাড়ে নটা সময়টুকু লেখার জন্য  তার থাকে। লেখাটুকু তার জীবনে একটা মুক্ত জানলা। এর অভাবে তার যেন শ্বাস কষ্ট হয়, দম বন্ধ হয়ে আসে।  তিয়াসা এই সময় নিজের ঘরে চলে যায় তার ল্যাপটপ নিয়ে বসে ।   তখন লিখতে বসেন রীতা। আর ঠিক তখনই এসে হাজির হয় পম্পা।একগাল হাসি মুখে, "  কি কচ্চেন মাসীমা? " 
রীতা তার শহুরে সৌজন্য বোধে তেমন কিছু বলে উঠতে পারেন না। " আয়" বলে বেজার মুখেই আসতে বলেন।মেয়েটা ঔদাসীন্যও বোঝে না। বেশ জমিয়ে বসে। আঁচলের তলা থেকে বার করে করে আনে তরকারী।উৎসাহী আলো আলো মুখে বলে-"খেয়ে দেখবেন মাসীমা, সজনে ফুলের বড়া দিয়ে তরকারি। আপনার ছেলে খুব ভালো খায় এটা।"  রীতা মায়া মিশ্রিত হাসেন- " রোজ রোজ এসব কেন দিস পম্পা।"  পম্পা লাজুক মুখে বলে- "কি আর দিই। মণ্ডা মিঠাই তো নয়। " 
রীতার সামনে পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষ্যে দুটি পত্রিকায় লেখা পাঠানোর কথা।কাগজে কলমে আর আজকাল লেখেন না।বৌমা তিয়াসাই মোবাইলে ডাইরেক্ট টাইপ করা শিখিয়েছে।তাই অভ্র কী বোর্ড ডাউনলোড করে সেখানেই টাইপ করেন।কিন্তু হাত সড়গড় না হওয়ায় একটু সময় লেগে যায়।তাই দুটো গল্প লিখতে বেশ সময় দরকার। লেখা পাঠানোর শেষ দিনও সামনেই। এখন পম্পার সাথে গল্প জুড়লে তার লেখার খুব ক্ষতি হবে। কিন্তু মুখের উপর "আসিস না" কি বলা যায়? 
আর যে পারে পারুক রীতা এমন বলতে পারে না। তাই অবস্থাটা দাঁড়ায় অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মত। কিন্তু অবোধ গ্রাম্য মেয়েটা সে সব বোঝেও না। দিব্যি গল্প জুড়ে দেয়। কেমন করে তার মা সজনেফুলের বড়ার তরকারী করত। তার সোয়াদ এত সুন্দর ছিল যে পম্পার কাকা জ্যাঠা দাদু সবাই মুগ্ধ হয়ে খেত। সে অনেক চেষ্টা করেও তেমন পারে না। তারপর একটা কথার খেই ধরে পম্পা পৌঁছে যায় অন্য কথায়। মায়ের রান্নার ভক্ত ছিল সবাই। যারা তাদের ক্ষেতে জন খাটত দুপুরে তাদের পাত পরত পম্পাদের বাড়িতে। তারা এক একজন তিনজন লোকের ভাত খেত।পম্পাদের বাড়িতে যে হাঁড়ি চড়ত তা নাড়ানোর ক্ষমতা পম্পার নেই। অথচ মা একা হাতেই..." এমন করে গল্পেরা ডালপালা মেলত। তাতে পাতা গজাত। ফুল ফুটত। ফল ধরত। আর রীতা মাঝে মাঝেই ঘড়ি দেখতেন। তার অবকাশী মুহুর্তগুলো একটু একটু করে গলে যাচ্ছিল আঙুলের ফাঁক দিয়ে।দীর্ঘশ্বাস গোপন করতেন।তার ছেলে ফিরলেই পম্পা বলত-"ওই দাদা ফিরেছে।আচ্ছা এখন আসি মাসীমা।" 
এক একদিন আর মেজাজ ঠিক থাকত না রীতার। পম্পা আসলে স্পষ্টতই বেজার বিরক্ত মুখে ঠান্ডা ভাবে বলতেন-" কি রে পম্পা কিছু দরকার ছিল?" পম্পা কিন্তু অপ্রস্তুত হত না। বরং এক গাল হেসে বলত-" না মাসীমা, কাল বললেন না হাঁটুর ব্যাথা।তাই একটু রসুন তেল করে আনলাম। দিন মালিশ করে দিই।"  রীতা হা হা করে ওঠেন-" এই না না। তুই পায়ে হাত দিবি কেন?" রীতা যেন ভারী অবাক একটা কথা বলেছে, এমন করে পম্পা বলে-" ও মা! পায়ে হাত দিলে কি হয়েছে। আপনি গুরুজন মানুষ। নিন নিন কাপড়টা উঁচু করুন দেখি।" 
পম্পার আন্তরিকতায় রীতার মায়া হয়।আবার অস্বস্তিও হয়। এত গায়ে ওঠা আত্মীয়তায় তিনি অভ্যস্ত নন। এমনকি তার পুত্রবধূ তিয়াসা, যাকে তিনি এত ভালোবাসেন তার সাথেও একটা স্পেস রেখে চলেন। তিয়াসাও সেটা মেইনটেইন করে। অথচ পম্পার ব্যবহারে এমন একটা ব্যাপার আছে রূঢ় কিছু বলা যায় না।
রীতা ভাবেন মেয়েটা টি.ভিও দেখে না।বিকেলে তো সবাই এই সময় স্টার জলসা জি টি.ভিতে কত সিরিয়াল টিরিয়াল দেখে।ও-ও দেখতে পারে এসব।কিন্তু এই মেয়ে জীবন থেকে গল্প খুঁজতেই ভালোবাসে।সবচেয়ে মজার কথা পম্পার কথা বলার জন্য রীতাকে খুব সঙ্গ দিতেও হয় না।সে একাই তার দেশগ্রাম আত্মীয় সজনের কথা বলে যায়।রীতার ভূমিকা সেখানে শুধু শ্রোতার।
তিয়াসা বলে- "তোমার বিরক্ত লাগে না মা? এই এক ঘেয়ে গল্প যাদের চেনোও না তাদের কথা শুনে যেতে?" রীতা বলেন -"বিরক্ত লাগলেই বা কি করবো। মুখের উপর আসিস না বলা যায়? " তিয়াসা বলে-" ওভাবে হবে না। তুমি বেশী ভালোবাসা দেখিও না। একটু ঠান্ডা ব্যবহার কর,দেখবে নিজে থেকেই বুঝে যাবে।" 
রীতা ভেবে পান না তিনি কি আর ভালোবাসা দেখান? বড় জোর পর পর ক'দিন তরকারী পাঠানোর পর একদিন নিজে কিছু রান্না করে ওর পাঠানো টিফিন কৌটে ভরে দেন। আর মায়া লাগে বলে একটু স্নেহ মিশিয়ে কথা বলেন মেয়ের বয়সী মেয়েটার সঙ্গে। তবে কি শুধু শুধু রূঢ় ব্যবহার করবেন?
এর মধ্যে দুদিন পম্পা এল না। রীতা বেশ খুশী হলেন। হয়ত এবার বুঝেছে যে তিনি ও এলে খুশী হন না। তার বেশ কিছু জমে থাকা লেখা শেষ করলেন। লিটিল ম্যগাজিনগুলোয় তিয়াসাকে দিয়ে মেল করে দিলেন। একটা মোটামুটি নামী লিটিলম্যাগের সম্পাদক ফোন করেছিল।তাদের কবিপ্রণাম সংখ্যার জন্য গল্প দিতে।এটা খুবই সম্মানের রীতার কাছে। এই পাঠকদের ভালোবাসা, লেখক সম্পাদকদের দেওয়া সম্মান এগুলোই এই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বড় প্রাপ্তি বলে মনে হয়। সারাদিনের সংসারবদ্ধ জীবনে তাই ওই বিকেলের গল্প লেখার সময়টুকু কিছুতেই হারাতে চাননা তিনি।
 কিন্তু তৃতীয়দিনে ওই ম্যগাজিনের জন্য একটা সুন্দর প্লট নিয়ে ঠিক বসেছেন লিখতে এমন সময় আবার বাজল কলিংবেল। স্পষ্টত বিরক্তমুখে দরজা খুলেই দেখলেন পম্পা এক গাল হাসি মুখে।আজ মেজাজটা গরম হয়েই গেল রীতার।লেখার মাঝে এমন ছেদ পড়লে, পরে লিখতে বসলেও, এই টানা লেখার স্বাদটা নষ্ট হয়ে যায়।গলায় বিরক্তি মিশিয়ে বললেন-"কি রে কি ব্যাপার?" 
পম্পা রীতার পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে বলে -"আর ব্যাপার মাসীমা। শরীরটা ভালো ছিল না একদম। জানি আপনি চিন্তা করবেন কেন জ্বালাতে আসছি না বলে।" 
হায় রে!!  মেয়েটা ভাবছে সে দুদিন আসে নি বলে রীতা রাগ করেছে। রীতার মনে হয় এবার এই ভালোমানুষি ছেড়ে তার স্পষ্ট করেই বলা উচিত যে এই সময়টা এলে তার খুব অসুবিধা হয়। বললেন-" শরীর তো খারাপ হবেই মা। সারাদিন এমন টইটই করে ঘুরলে। বাড়িতে শুয়ে বসে একটু রেস্টও তো নিতে পারিস। আমার আসলে এই সময়টা এলে বড় অসুবিধা হয়।সারাদিন তো সময় পাই না। এই এখনই একটু লেখালেখি নিয়ে যা বসি। একটু নিভৃত নিরালা লাগে। রোজ রোজ গল্প করলে তো আর কাজ হয় না।"
পম্পাকে হঠাৎই কেমন অপ্রস্তুত দেখায়।মনে হয় সে হঠাৎই যেন তার না বুঝে করে ফেলা অপরাধটা বুঝতে পেরেছে।তাড়াতাড়ি বলে-" হ্যাঁ হ্যাঁ সে তো বটেই মাসীমা। আপনি লিখুন বরং। আমি যাই।" 
রীতার কথাগুলো বলে ফেলার পরেই খারাপ লাগে। কিন্তু মুখের কথা আর ছোড়া তীর ফেরানো যায় না। পম্পা চলে যায়।রীতার দরজায় দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে হয় মেয়েটাকে যেন আজ কেমন শুকনো দেখাচ্ছিল। কি শরীর খারাপ ছিল তাও তো জানা হল না। উচিত ছিল জিজ্ঞেস করা।মনটা একটা কেমন বিষাদে ভরে যায়।আর লেখায় মন বসে না।চুপ করে ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েন। 
।রাতে তিয়াসা খাবার জন্য ডাকতে আসে।কিন্তু তার খেতে ইচ্ছে করে না।মনে হয় হয়ত প্রেসারটা বেড়েছে।
পরের সপ্তাহখানেক পম্পা আর আসে না।গল্পটা শেষ করে পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন রীতা। যেমন ভেবেছিলেন ঠিক যেন তেমন হয় না লেখাটা। মনে মনে ভাবেন একবার নিজে থেকেই গিয়ে খোঁজ নেবেন কেমন আছে মেয়েটা। যেতে হয় না। পরেরদিন রীতা যখন পূজোর ফুল তুলতে বাগানে যায় তখন সুশীল মানে পম্পার স্বামী সাথে দেখা হয়ে যায়। সে তখন সাইকেল নিয়ে কাজে বার হচ্ছে। রীতা জিজ্ঞেস করেন- "হ্যাঁ বাবা সুশীল পম্পার শরীর ভালো আছে?" সুশীল লাজুক মুখে বলেন -"হ্যাঁ মাসীমা। এখন ঠিক আছে। আমি আবার সামনের মাসে যাবো বাড়ি।ওর চেক আপ আছে।" কথাটা বুঝতে রীতার কিছুক্ষণ সময় লেগে যায়।
উনি জিজ্ঞেস করেন-"পম্পা এখানে নেই? " সুশীল বলে -"না মাসীমা আসলে এই অবস্থায় একা থাকে তো।তাই বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম।" 
রীতার কেমন মিশ্র অনুভূতি হয়।একটা ভালো লাগা বোধ হয়। আবার মনে হয় কই পম্পা তো কখনও বলে নি। নাকি বলতেই এসেছিল কিন্তু তিনি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন -"ডাক্তার কবে নাগাদ বলছে?" সুশীল বলে-"আগস্ট মাসের শেষে মাসীমা।" সুশীল চলে যায়।রীতা ভাবেন মেয়েটা রোজ আসত। কিন্তু তিনি অবহেলায় কোনদিনও তাকিয়েও দেখেন নি। গ্রামদেশের মেয়ে এসব কথা নিজে থেকে গুরুজনদের বলে না। কিন্তু তার শরীরে যে পরিবর্তন হয়েছে তাও নজরে পড়ল না রীতার? 
দিন চলে যায়। সুশীল একা থাকে বলে রীতা মাঝে মাঝেই বাটিতে তরকারী পাঠিয়ে দেন। টুকটাক খবরও নেন। মাঝে সুশীল একদিন জানালো ডাক্তার নাকি বলেছে একমাস আগেই ভর্তি নিয়ে নেবে।পম্পার প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে প্রায়ই। 
বেশ চিন্তায় পড়েন রীতা। আজকাল সন্ধ্যের দিকে কলিংবেল বাজলে বুকের ভিতরটা ধ্বক করে ওঠে।
 একদিন লেখা নিয়ে বসেও আনমনা হয়ে যান। মনে হয় মেয়েটার হাতের কুমড়োডাঁটা চচ্চড়ি কতদিন খান নি।
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত তখন সাড়ে নটা হবে। বাবু আর বাবুর বাবা দুজনেই ফিরেছে সবে অফিস থেকে। হঠাৎ বাইরের দরজায় কলিংবেল বাজলো।রীতা ভিতরের ঘর থেকেই শুনলেন সুশীল এসেছে। বেশ উত্তেজিত ভাবে কিছু বলছে। রীতা তাড়াতাড়ি গিয়ে দাঁড়ান। সুশীল বলে সে এখনই দেশের বাড়ি চলে যাচ্ছে। পম্পার অবস্থা ভালো নয়। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। সেই থেকে জ্ঞান ফেরে নি। ওরা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সুশীল বাড়ির ডুবলিকেট চাবি রীতার কাছে রেখে যায়। রীতা বার বার বলে-"বাবা কেমন থাকে জানিও।" 
পম্পাদের গ্রামের বাড়িতে টাওয়ার পাওয়া যায় না। ফোন করেও খবর নেওয়ার উপায় নেই। সেদিন রাতে রীতা দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না। বার বার অনাত্মীয় মেয়েটার মুখটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কত বিরক্ত হয়েছেন  মেয়েটা যখন তখন এসে উৎপাত করায়। সবসময় চেয়েছেন আর যেন সে না আসে। হঠাৎই বড় ভয় করে রীতার। সত্যিই যদি আর কোনদিনও না আসে পম্পা!  ভাবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই ভয় পেয়ে যান রীতা। রীতা পূজো করেন যদিও খুব মানামানি তার নেই। কিন্তু আজ কেন জানি না ওই গ্রাম্য মেয়েটার মতই তিনি মনে মনে বলেন-"হে মা  মঙ্গলচণ্ডী মেয়েটাকে সুস্থ করে দাও মা।আমি তোমার পূজো দেব।" 
ভোর রাতের দিকে চোখ লেগে যায় রীতার।ঠিক তখনই ল্যান্ডফোনটা বেজে ওঠে।বাবুর বাবা বিরক্ত ঘুম চোখ মেলে বলে -"কে আবার এত সকালে।"  রীতা তাড়াতাড়ি গিয়ে ধরেন ফোনটা। সুশীলের গলা।বলে-"মাসীমা ছেলে হয়েছে।" রীতা  উদ্বিগ্ন স্বরে বলেন-" ছেলে হয়েছে? আর পম্পা? পম্পা কেমন আছে সুশীল?"  সুশীল বলে -"ভালো আছে মাসীমা। সুস্থ আছে। এই সবে ওকে বেডে দিল। ওকে দেখে এসেই আপনাকে খবর দিলাম।" হঠাৎ যেন কি হয়ে যায় রীতার। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।ভেজা গলায় বলে-"ভালো থাকো বাবা। মা ছেলে সুস্থ থাকুক।"
রীতা খেয়াল করেন নি কখন তিয়াসা এসে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছে। রীতার কাছে এসে যা কখনও করে না আজ তিয়াসা সেটাই করে। সস্নেহে রীতার মাথাটা নিজের কাছে টেনে নেয়।দুজনের কেউই কোন কথা বলে না।
এখন রীতা সন্ধ্যের দিকটা আর বাড়ি থাকেন না। পম্পা আসার পর থেকে ওর বাড়িতেই যান। অসুস্থ মেয়েটা তো আর আসতে পারে না। সদ্য মা..একা বাচ্চা সামলায়। এই সময়টা গিয়ে তিনি একটু নাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করেন।
লেখালিখির সময়টা একটু কমেছে। তাতে আপসোস নেই। জীবনের চেয়ে বড় গল্প কি কিছু হয়?