কিছু সুখ কিছু ব্যথা Kichu Sukh Kichu Byatha by রত্না চক্রবর্তী - Ratna Chakraborty , chapter name মৌমা

মৌমা

একা ঘরে সন্ধ্যার অন্ধকারে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মহুয়া, এই মুখার্জী বাড়ির বড় বৌ। উপুড় হওয়া পিঠের ওঠা নামা দেখে সন্দেহ হয় মহুয়া কি কাঁদছে!  এইভাবে ফুলে ফুলে!! 
কেন ধীর স্থির,শান্ত, গম্ভীর সংযত মহুয়া এই একষট্টি বছর বয়সে এসে এভাবে কাঁদছে!  যাকে কেউ কখন উচ্ছ্বসিত হয়ে কাঁদতে বা হাসতে দেখেনি, সবটাই ছিল চাপা সংযত। শ্বশুর মারা যেতে তার পায়ের গোড়ায় শ্বাশুড়ি মাকে শক্ত করে ধরে বসেছিল আর দুচোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছিল। মা মারা যাবার খবর পেয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে, চোখে আঁচল চাপা দিয়েছিল, বরং তার ছোট জা কুহেলী ' মৌ দি গো ' বলে জোরে কেঁদে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ছোটবেলায় একই স্কুলে পড়েছে বলে বড় জা হলেও তাকে সে মৌদি বলেই ডাকত। তার স্বামী অনিরুদ্ধ যখন চলে যায়, তখন তো পাথর হয়ে বসেছিল। অনিরুদ্ধকে নিয়ে যাবার পর শুধু নিজের ঘরে গিয়ে দোরটা বন্ধ করে দিয়েছিল। সবাই ভয় পেয়েছিল, শুধু ওই শোকের মধ্যেও অনিরুদ্ধ এর মা বলেছিল "আমার বৌমা অত অবিবেচক নয়, ছেলেকে ফেলে, আমায় ফেলে সে এমন কিছু করবে না, ওকে আমি জানি গো, ওকে একটু একা থাকতে দাও, ওর কষ্টটা ওকে একা ঘরে ঝরিয়ে দিতে দাও। ওকে আমি  চিনি। " সেই মহুয়া নাকি কাঁদছে।
 কার জন্য? 
 মহুয়া প্রফেসারি করেছে, সংসার করেছে সুন্দর ভাবে, তবে ছেলের ভাবনা তাকে ভাবতে হয় নি তার শ্বাশুড়ি মা স্কুল টীচারী থেকে ততদিনে রিটায়ার করেছেন। তিনিই দক্ষ হাতে নাতি মানুষ করেছেন, ছেলে নিয়ে কোন আতিশয্য করতে কেউ দেখে নি তাকে।  খুব ভালোবাসে  ছেলেকে কিন্তু বাইরে তার প্রকাশ ছিল না। ছোট দেওর আর জা এখন নাগপুরে থাকে। কুহেলির ছেলে রূপম 'বৌমা'কে ভালো ও বাসে যেমন ভয়ও পায় তেমন। …ওদের দুই  জায়ের দুই ছেলেই শ্বাশুড়ির দেখাদেখি মহুয়াকে বৌমা বলে।  কিন্তু কখন ও কাউকেও মারা দূরে থাক বকেন নি পর্যন্ত মহুয়া।  
মহুয়া আসলে খুব কম কথা বলে, তার রাশভারী স্বভাবের জন্যই হয়ত তাকে লোকে এত মান্য করে। কুহেলী তার ছোট জা অবশ্য খুব ছটফটে হুল্লোড়ে মেয়ে, এখন বয়স হয়েছে, দুজনেরই ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। মহুয়ার নাতি বিদেশে, যেন সাহেবদের মত হয়েছে, কি দারুণ কথাবার্তা দুবছরে একবার আসে।   কুহেলী তেমনি প্রাণোচ্ছল রয়ে গেছে। মজার কথা মহুয়ার ছেলে আরবে আর কুহেলীর ছেলে রূপম কলকাতায় চাকরী করে। রূপম বাড়িতেই থাকে, ওর বিয়ে হয়েছে কলকাতার মেয়ের সংগে, মেয়ে একটা এন.জি.ও র সঙ্গে যুক্ত। বেশ ভালো হয়েছে দুজনেরই বৌ। মহুয়ার ছেলে বৌ দুজনেই ইঞ্জিনিয়ার। ওরা ওখানেই থাকবে। কুহেলীরা বরং এখানে চলে আসতে চায়। চেষ্টা করছে ব্যবসা পত্র গুটিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসতে পারে । একসাথে নিজেদের বাড়িতেই থাকবে। রূপমের একটা পুতুলের মত মেয়ে আছে, উপমা। ওর মা অফিসে বেরিয়ে যায়, কিন্তু অসুবিধার কিছুই নেই বৌমা মানে মহুয়া তো এখন ফ্রী, মহুয়ার শ্বাশুড়ি মাও মারা গেছেন। আর  ভাসুরপো বৌ সুমিত্রাও জানে তার মেয়ে সবচেয়ে ভালো থাকবে তার জেঠিশ্বাশুড়ি মানে বাড়ির বৌমার কাছে।
  তা উপমা সবার চেয়ে ভালোবাসে তার মৌমাকে, আত্মীয়স্বজনরা ডাকেন মহুয়া আর মহুয়ার  ছেলে বৌরাও ডাকে বৌমা, তা এই দুই কথা মিলেমিশে শিশুর মুখে বোল ফোটা ইস্তক হয়ে গেছে মৌমা। আধোআধো বোলে সারাদিন শুধু মৌমার নাম। আর মহুয়া, সেই চিরদিনের চুপচাপ মানুষটার এই বয়সে এসে অবিশ্বাস্য  পরিবর্তন,  সারাটা দিন  উপমার পিছনে ছোটে, এখন মহুয়া এত কথা বলে যে তার সারাজীবনের সবকথা যোগ করলেও  তার কোন হিসাবই হয় না। সুমিত্রা নিজেই বৌমার উপর নির্ভরশীল। মেয়েকে দিনে ক'বার চটকে আদর করা ছাড়া আর কিছু করেনা উপমার বাপ মা 
আর করবেই বা কি করে?  ভাইএর বিয়েতে তিনদিনের জন্য গিয়েছিল বাপের বাড়ি, মেয়ে দিনরাত কেঁদেছে 'মৌমা মৌমা 'করে। শেষে দুদিনের মাথায় মহুয়া নিজেই চলে গিয়েছে ওদের বাড়ি, নিমন্ত্রণ ছিলই কিন্তু মহুয়ার ঠিক ছিল বৌভাতের রাতে যাবেন, কিন্তু মেয়ের জন্য আগের দিন চলে গিয়ে থাকতে বাধ্য হলেন। সুমিত্রার মা নেই, বাবা প্রশান্ত হাসি হেসে বললেন " ওরে  মেয়ে তো কাঁদছেই কিন্তু আসলে ভিতর কাঁদছে তোর বৌমার, কোনদিন কারো বাড়ি রাত কাটান না তিনি কিনা.... " কথাটার মধ্যে সত্যতা আছে, চিরদিন একা থাকতে ভালোবাসা মহুয়ার দুদিনেই পাগল পাগল লাগছে। 
উপমার ধাতটা হয়েছে ওর বাবার মত ঠান্ডা লাগার, একটু সাবধানে রাখতে হয় নইলে বুকে সর্দি বসে যায়। তাই ও কি খাবে না খাবে, একদিন ছাড়া চান করবে না গা স্পঞ্জ করবে তা মহুয়া ওয়েদার দেখে ঠিক করে দেন, আর সত্যিই সেটাই উপমার জন্য একদম ঠিকঠাক। দুপুরে মেয়ে আধঘন্টাও ঘুমোয় না, সারাদুপুর দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ায়, মহুয়া পায়ে ব্যথা নিয়েও তার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ায়। খুব ব্যথা বাড়লে রূপম রাগ করে বলে " বৌমা একজন দেখাশোনার আয়া রাখি তোমার ভিষণ কষ্ট হয় " েগে যান মহুয়া বলেন " তোমাদের ঠাকুমা বলতেন আয়া দিয়ে বাচ্ছা মানুষ হয় না ঠিকমতো, ঠাকুমা দিদিমার কোল তাদের সঠিকভাবে মানুষ করে তোলে,  আমি না পারলে কোমরে ওর দড়ি বেঁধে বসিয়ে রেখে খেলব, ওর ভাবনা ভাবতে হবে না বরং সারা রাত যে কেশে কেশে অস্থির হয়ে যাচ্ছ আর সুমিত্রাকেও ঘুমাতে দিচ্ছ না তার জন্য আজই ডাক্তার দেখাও। বডড কেয়ারলেশ হয়ে গেছ। " 
অতএব ব্যথা বাড়লেও মহুয়া নাতনির সঙ্গে প্রায় হামা টেনে খেলা করেন। এখন বেশ টকস টকস কথা বলে, রাইমসের বই কিনেছেন অনেক আধোআধো বোলে তিনিও নাতনির নকল করে কবিতা বলেন, ছবির বই দেখান। সুমিত্রা বলে " জান আমরা তাড়াতাড়ি বেবী নিয়ে ভালই করেছি গো, বৌমার মুখে এমন হাসির ছটা দেখা যাচ্ছে ভালো করে। যতদিন যায় তত জড়িয়ে যায় মহুয়া। 
মেয়ে এবার নার্সারি স্কুলে ভর্তি হবে  খুব চিন্তা মহুয়ার, তিনি একদম সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারছেন না, উপমাকে নিয়ে কি করে যাবেন। মেয়েকে কারোর হাতে ছাড়তেও পারবেন না। 
 সমস্যার আচমকাই সমাধান হয়ে যায়, কুহেলীরা চলে আসে কলকাতায়,জমজমাট বাড়ি মহুয়া শান্তি পেয়ে যায়। কুহেলী এখনও খুব দৌড় ঝাঁপ করতে পারে, অল্প বয়সে প্রচুর খেলাধূলো করেছে । আবার ভরভর্তি বাড়ি, নতুন করে সংসার শুরু হয়। কিন্তু মহুয়ার যেন তাল কেটে যায় বারবার। 
কুহেলীও সেই আগের মতই আছে, তেমনই মৌদি অন্তপ্রাণ, দেওর তেমনি উদাসীন আপনভোলা, সুমিত্রা- রূপম ও যেমন ছিল তেমনই আছে তবু মহুয়ার কেমন যেন লাগে... বদলে গেছে বোধহয় একজনই উপমা। ছোট্ট  উপমা প্রথমে তো কিছুতেই যাবেনা তার থাম্মির কাছে, খালি মৌমার গলা জড়িয়ে ধরে।শেষে  কুহেলীই হেসে বলে " ও মৌদি, এ  যে কিছুতেই বশ হয় না গো, কি জাদু জানো গো। " কেমন এক তৃপ্তির হাসি আসে ঠোঁটের কোনায়, মহুয়াই উপমাকে শেখায় কেমন করে থাম্মিকে হাম দিতে হয়, থাম্মি চকো দেবে, টা টা নিয়ে যাবে...  
এই টা টায় বড় লোভ উপমার, যেহেতু মা বাবা মৌমা কেউই টা টা নিয়ে যেতে পারে না। একটু একটু করে ভাব হয় থাম্মির সাথে ছাদে ছোটাছুটি করে ফুটবল খেলে, থাম্মি গান চালিয়ে নাচে আর নাতনিকে নাচ করায়, বেশ লাগে দেখতে কিন্তু খারাপ লাগে যখন উপমা থাম্মির কোলে চরে বাগানে বিড়াল আর কাক দেখতে দেখতে ভাত খেয়ে নেয় বায়না না করে, এমনকি যে মেয়েকে কোনমতে মাছ খাওয়ানো যায় না তাকে মাছও খাইয়ে ফেলে!  অবাক বামুনদি বলেই ফেলে "অসাধ্যসাধন কল্লে গো ছোটবৌদি, বড়বৌদি পজ্জন্ত হার মেনে গেছে!" মজা করে চোখ নাচিয়ে কুহেলী বলে " তব্বে বলো"। মহুয়ার কিন্তু মনে হয় সে হার মেনে গেছে  কুহেলীর কাছে।থাম্মির সাথে ইস্কুল যেতে প্রথমদিন কেঁদেছিল উপমা, মহুয়ার মনে হয়েছিল সে যদি কষ্ট করে যেতে পারত তবে মেয়েটা ঠিক কাঁদত না। কিন্তু তিনচারদিন যাবার পরে দেখা গেল উপমার বিশাল উৎসাহ স্কুলে যাবার, আর সে দাদুর সাথে যাবে না থাম্মির সাথেই যাবে কারণ সে আগে থাম্মির সাথে পার্কে যায় দোলা চরে তারপর স্কুলে যায় আর ফেরার সময় ও আগে পার্কে শ্লিপে ওঠে তবে বাড়ি আসে। শনিবার রবিবার কান্নাকাটি পার্কে যাবে স্কুলে যাবে, শেষে কুহেলী প্রমিস করে, না কান্না করলে রোজ পার্কে নিয়ে যাবে। বিকেল থেকে সন্ধ্যেটা মহুয়ার ফাঁকা হয়ে গেল। সুমিত্রা অবশ্য আলো আলো মুখে বল্ল " ভালো হয়েছে মা তুমি এবার জব্দ, বৌমা কে জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে এই তিনবছরে হাড়গোড়ে ব্যথা ধরিয়ে দিয়েছে। " 
কিন্তু মহুয়ার ব্যথাতো কমছে না, বেড়েই চলেছে। দিনরাত মৌমা মৌমা তো অত শোনা যায় না। সকালে স্কুলে থাম্মি, বাগানে খাওয়ায় থাম্মি, বিকেলে পার্কে থাম্মি শুধু সন্ধ্যায় পড়াটা এখনও মৌমার কাছে করে। তাও এবার স্কুল মানেই বাঁধা নিয়মের লেখা পড়া যেটায় কোন শিশুই উৎসাহবোধ করে না, তার 'খেলাপড়াটা' লেখাপড়া হয়ে গেছে এটা সে কিছুতেই মানতে পারে না।  দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সেটা মহুয়া বোঝে কিন্তু এইটুকুও যদি সে ঠিক মত না পারে তাহলে তো....তাই একটু জোরজার করতেই হয়, চিরকালের আদর পেয়ে অভ্যস্ত উপমা ঠোঁট ফোলায়, পালাতে চায়, সন্ধ্যা হলেই লুকিয়ে বেড়ায়, শেষে একদিন এ,বি,সি, ডি লেখাতে বসলে বলে তুমি পচা হয়ে গেছ, থাম্মি ভালো। স্বাভাবিক কথাটাতে সব্বাই হেসে উঠে আর মৌমার বিশাল লাগে। মহুয়ার কি ছোট মন হয়ে যাচ্ছে, শ্বাশুড়ি, শ্বশুর, জা, দেওর কাউকে তো কখনও হিংসা করে নি, বর নিয়েও প্রেম নিয়েও কোন হিংসা, সমস্যা বোধ করে নি, আজ এই একষট্টি বছরে এসে এ তার কেমন পরিবর্তন!!  নিজেরই লজ্জা করে কিন্তু সহজ হতে পারেন না। 
শেষে এ বাড়ির যা কোন বাচ্ছা করেনি সেই টিচারের ব্যবস্থাই করেন শুধু এই শিশুটির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য। তার পরিবার এতই ভালো তারা তাতেও খুশি, বৌমা যা ভালো বোঝে সেটাই ঠিক। শুধু সন্ধ্যেটাও মহুয়ার হাত থেকে বেরিয়ে যায় টীচারের কাছে। 
  এবাড়ির ছোট বাচ্ছারা ছয়মাসের বেশি মার কাছে শোয় না, বুকের দুধ ছাড়ানো হয় ঠাকুমা দাদুর কাছে শুতে পাঠিয়ে, তাছাড়া বাবা মার শোয়া থেকে কে কি শিখবে ভাববে তাই তার ছেলে আর দেওরপো ও ঠাকুমার কাছেই শুতো যতদিন অবশ্য ছোট ছিল আর কুহেলীরা এখানে ছিল না। উপমা ও তাই মৌমার কাছে শুতো, মহুয়া একবছরের আগেই ন্যাপি বন্ধ করে দিয়েছিল, ওর মনে হয় বাজে অভ্যাস, ও রাতে কোলে করে তুলে বাচ্ছাকে হিসি করিয়ে এনে শোয়াতো। এর মধ্যে কুহেলীর বোন, বোনঝি এল, সারাদিন আনন্দ হৈ চৈ হল, ওরা থাকবে। উপমা তো আনন্দে আত্মহারা, জুটি ছোট বাচ্ছা তো পায় না, এতদিন ফাঁকা বাড়িতে মৌমা আর রাতে বাবা মা কে দেখত, আজ তার খুশি  দেখে কে, ওর হাসি দেখে মহুয়ার বুকটা ভরে গেল। গোল বাঁধল রাতে শোবার সময় কুট্টি দিদির সাথেই সে শোবে, সারাদিনের দৌরাত্ম্য, দুপুরে ঘুমায় নি  কান্না আর  থামেই  না, শেষে কুট্টিদিদির সাথেই ঘুমালো। আড়াই বছরের অভ্যাস মহুয়ার, রাতে ঘুম হল না খালি বিছানায় অথচ এই খালি বিছানায় শোয়াটাই বড় আরামের ছিল আড়াই বছর আগে অবধি। অনিরুদ্ধ যাবার পর দীর্ঘ সতের বছরের অভ্যাসটা এই কদিনে বদলে গেছে।
 দুদিন থেকে ওরা চলে গেল, এদুদিন উপমাকে ধরাছোঁয়া যায়নি, সারাক্ষণ কুট্টিদিদির সঙ্গে কার্টুন দেখছে সারাক্ষণ, ডোরেমন, টম এন্ড জেরি , কি খুশিই ছিল । ওরা চলে গেল, উপমা খানিক কাঁদল। বাড়িটা আজ বড় চুপচাপ হয়ে গেছে, শান্ত ক্লান্ত বাড়ি। রাত বেড়ে যাচ্ছে, কাল আবার মেয়েটার ইস্কুল আছে, মহুয়া উপমাকে আনতে গেল। উপমা কুহেলীর কোলে শুয়ে টম এন্ড জেরি  দেখছে। " চল সোনা আবার কাল দেখবে " মহুয়া বলল। শক্ত করে কুহেলীর হাউসকোটটা চেপে ধরল উপমা, " না, যাব না, আমি থাম্মির কাছেই শোব "। মহুয়া বোঝাল " আমি সেই রাজপুত্রের গল্পটা বলব, না না আজ বরং বাঘের গল্প হবে "। 
মানুষ সততই স্বার্থপর,  আত্মসুখী, তবু সে তার মনোভাব একটা চকচকে আবরণে ঢেকে রাখে কিন্তু শিশু নিরাবরণ, সত্য ঢাকতে শেখেনি তাই বলে " ওটা পচা গল্প হয়ে গেছে,  আমি শুনবো না, থাম্মির কাছে শুয়ে এটাই দেখব। " মহুয়া অসহায়ের মত বললেন " ঠাম্মির গরম হয়,  ফ্যান চালাবে বাবা, তোর তো সহ্য হয় না, আমি তো তাই পাখা বন্ধ করে শুই। " শিশু তার জেদ ছাড়ল না। শেষে বাধ্য হয়ে কুহেলী বলল " মৌদি তুমি একটু  আরাম করে ফ্যান চালিয়ে শোও, তোমার কষ্টের দিন শেষ, আমি বরং ওকে ফুলহাতা জামা পরিয়ে চাদর চাপা দিয়ে শোয়াব। কি জেদ যে হয়েছে। " 
 এখন মহুয়া তার একান্ত প্রিয় বিছানায় একান্তে।
উপমার বালিশটা দিয়ে এসেছেন তিনি।কুহেলী বলেছিল "মৌদি ও ঘুমলে আমি বরং দিয়ে আসব। " মহুয়া তাড়াতাড়ি বলেছিল " না রে থাক কাঁচা ঘুম ভাঙলে কষ্ট হবে। "  ঘরে দরজা বন্ধ করতে করতে শুনতে পেল বামুনদি বারান্দায় নিজের রাতের বিছানা পাততে পাততে আপন মনে বলছে " দ্যাকো কান্ড, কেমন আপন অক্ত চেনে, জম্মে দেকেনি তাও আপন ঠাকুমা ঠিক চিনেছে।" মহুয়ার হাতের মুঠোয় উপমার বালিশের ঝাড়নটা, ওটা দেওয়া হয় নি, জনসনের গন্ধমাখা বস্তুটার উপর মুখ রেখে সে শুয়ে আছে, মহুয়া কাঁদছে!! জীবনের এই প্রথম উচ্ছ্বসিত কান্না।